চার – ফাদার সাইমনের দুর্বিপাক
সম্প্রতি রেললাইনের আর স্টেশন হবার পর থেকে এলাকায় এক খ্রিস্টান গোরা পাদরির আবির্ভাব ঘটেছে। মাথায় হেরুর মতন উঁচু, বিশাল চেহারা। মাথায় টাক আছে। মুখে আছে একরাশ কাঁচাপাকা গোঁফদাড়ি। হাঁটু অব্দি সাদা জিনের আলখেল্লা। গায়ে গামবুট বারোমাস। পিঠে ভারী বোঁচকা থাকে। হাতে একখানি ময়ূরমুখো লাঠি। স্টেশনে নেমে কিছুক্ষণ মাস্টারের কাছে আড্ডা দেন। চমৎকার বাংলা বলেন। লিখতে পড়তেও পারেন বাংলায়। প্রথম এলেন যখন, স্টেশন মাস্টার তখন কার্লটন সায়েব। কার্লটনেরই নাকি বন্ধু উনি! অ্যালোপ্যাথি, হোমিয়োপ্যাথি—দুটোতেই ধুরন্ধর ডাক্তার এই পাদরিবাবা। গোরাংবাবুর সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। তবে লোকে বলে, পসার চটে যাবার আশঙ্কায় গোরাংবাবু ওঁকে মনে মনে বেজায় মন্দ বাসেন। কী কথায় খুব তর্কাতর্কি হয়েছিল একদিন—সেই থেকে দুজনে দুজনকে দেখলেই সরে যান। গোরাংবাবু নাকি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘মানবসেবাটেবা সব ভুয়ো, এসেছেন তো খ্রিস্টান করতে—তবে সেগুড়ে বালি সায়েব! এলাকার ছোটলোকগুলো বড্ড বেয়াড়া। দেখেশুনে চলবেন।’
অগস্তিবাবু বলেন, ‘আরে, সাচবাত হাম সমঝ লিয়েছে না। হামারা বিলাভেড ডকটর গৌরাঙ্গবাবুকা সাথ কমপিটিশান চলেছে। চরণ চৌকিদারকো পুছো না দাদা! সব বাতা দেগা। ইস্ট্রাগল ফর একজিস্টেন্স!’
ব্যাপারটা হল এই।
চরণ চৌকিদারের মেয়ে বিন্নির মধুপুরে বিয়ে হয়েছিল। গত জষ্টিতে বাবার বাড়ি এল বেড়াতে। গাঁয়ের মেয়ে। গাঁয়ের মাঠঘাট বিলখাল জঙ্গলে চরে খেয়ে আর পাঁচটা মেয়ের মতনই মানুষ হয়েছে। স্বভাব যাবে কোথা? এসেই একদিন গেল ভাগীরথীর ঝিলে সিঙাড়া তুলতে! লোকে বলে, ইয়াকুব তান্ত্রিককে খামোকা চোখ রাঙিয়ে গাল দিয়েছিল সেখানে। তারপর ফিরে এসে সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ মাথা দুলিয়ে ভবের খেলা উঠল। সে কী দুলুনি, সে কী চোখের রঙ, সে কী ‘তোলমাতোল’ কাণ্ড! থরথর করে উঠোন কাঁপে চৌকিদারের। পাড়াপড়শির ভিড় বেড়ে গেল দেখতে দেখতে। বিন্নি অবিশ্রান্ত বকবক করে যাচ্ছে, কিছু বোঝা যায় না। অনেক কষ্টে কেবল বোঝা গেল, ইয়াকুব তান্ত্রিকের নাম ধরে ডাকছে। খবর তক্ষুনি চলে গেল। কিন্তু ইয়াকুব ঘরে নেই। কালীসাধক লোক—হয়তো কোথায় গঙ্গার কোনো নির্জন চড়ায় গিয়ে বসে আছে সাধনায়। রাত বাড়ল। তখন সবাই বলল, ‘এই তো সেদিন মজিদের মেয়ের ভূতে ধরা রোগ সেরে গেল গোরাংবাবুর হোমিয়োপ্যাথিতে। তাকেই ডাকো না হে চৌকিদার!’
চরণ লন্ঠন হাতে চলে এল গোরাংবাবুর কাছে। আর যাই করুন, রাতে বেরোবেন না—সে তুমি লাখ টাকা দাও, কিংবা স্বয়ং লাটসায়েবটি হও। কী করে যাবেন? ঘরে একা যুবতী বিধবা মেয়েটা থাকবে কেমন করে?
চরণের ভাগ্য ভালো। ফিরে যাচ্ছে স্টেশনের বারান্দা হয়ে—গেট পেরিয়ে। হঠাৎ দেখে কি, পাদরিসায়েব সাইমন বসে রয়েছে স্টেশন ঘরে। টিকিট কাটবার ঘুলঘুলি দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে চরণ। কিন্তু সাহস পায় না। চৌকিদারি প্রতাপ তো এক্ষেত্রে কেঁচো। ওরে বাবা, স্বয়ং গোরা সায়েব। সে আমলে গোরা সায়েবের নাম শুনলেই বউঝিরা গাঁ ছেড়ে মাঠে ঝোপে জঙ্গলে লুকোনোর পথ দেখে। তবে সাইমনকে আর কেউ ডরায় না। জানা গেছে, এ গোরা নির্বিষ ঢোঁড়া।
অগস্তিবাবুর চোখ পড়েছিল।…’কৌন হ্যায় রে? আভি কোই টেরেন নেহী।’
চরণের মুখে তবু কথাটি নেই। রেলের লোককে সে প্রচণ্ড সমীহ করে। সেই সময় ভূতুড়ে একচোখো আলো নিয়ে খালাসি চাঁদঘড়ি। (পদবি জমাদার—জাতে নাকি চাঁড়াল আসলে, তবে বেহার মুল্লুকের) তার শুয়োরের পাল সামলে স্টেশনে ঢুকছে। সে বলল, ‘আরে বাস! চৌকিদার দাদা যে! কী খোবোর? কোথায় যাওয়া হবে?’
দুইজনেই গাঁজা খায়। সেই সূত্রে আত্মিক বন্ধনটা শক্ত।
চাঁদঘড়ি খালাসি রেলের লোক। সেই সব ঠিকঠাক করে দিল। তক্ষুনি সাইমন সায়েব বোঁচকা নিয়ে হাজির হলেন রাঙামাটি।
বিন্নি তখন মাটিতে লুটোচ্ছে। বুকটা কেঁপে—কেঁপে উঠছে। পেটের কাপড় খুলে দিতে বললেন সাইমন। রোগটা আর কিছু নয়—হিস্টিরিয়া। আগাগোড়া সব শুনলেন। ছেলেবেলার খবর নিলেন। হুঁ, একবার ভয় পেয়েছিল দারুণ—তখন ছবছর বয়স। বাড়ির পিছনের যজ্ঞডুমুর গাছের নিচে হাগতে গিয়েছিল। কী দেখে দৌড়ে পালিয়ে এসেছিল।
ফাদার বোঁচকা খুলে হোমিয়োপ্যাথির বাকসো বের করলেন। চারপাশে সব অগুণতি পুরুষমানুষ মেয়েমানুষ। মাঝখানে লন্ঠন জ্বলছে। মাটিতে লুঠোচ্ছে ভরা যুবতীর বেপথু দেহ। একটা স্তন আদ্ধেক বেরিয়ে আছে। মেয়েরা কেউ ঢাকতে পারত গিয়ে—কিন্তু গোরা সায়েবের কাছে যায় বা কেমন করে! তা দেখে চরণ কাঁদল। মেয়ের স্তনটা দেখেই তার কান্না পেল। অমন নিষ্ঠুর চৌকিদারটা—সে কিনা হু হু করে কাঁদে আর বলে, ‘আহা হা মা আমার! আহা হারে মানবজন্মো!’
ইগ্নেশিয়াই এক্ষেত্রে ভালো কাজ দেবে। ফাদার চৌকিদারের হাতে ওষুধ দিলেন। তারপর স্মেলিং সল্টের শিশি বের করলেন। ফাদার বরাবর অবাক হন একটা কাণ্ড দেখে—এখনও হলেন। হিস্টিরিয়ার রুগিরা যখন ফিট হয়েছে, স্মেলিং সল্ট নাকের কাছে যাবার আগেই, ছিপিখোলা মাত্র জ্ঞান ফিরে পায়। যেন অবচেতনে সব টের পায়—ঝাঁঝালো খর গন্ধ সইবার ভয়ে চেতনাকে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অনেকক্ষেত্রে ফাদার দেখেছেন, স্মেলিং সল্ট নয়—নিতান্ত পোস্টকার্ড জ্বালিয়ে নাকে ধুঁয়ো দেবার জন্যে যেই আগুন ধরাতে গেছেন রুগি ফোঁস করে প্রশ্বাস ফেলে চোখ খুলছে।
সব কাজ শেষ করে ফিরে আসছিলেন ফাদার সাইমন। সঙ্গে চরণ আলো নিয়ে আসতে চাইছিল—তাকে নিবৃত্ত করলেন ফাদার। একা আসছেন রাঙামাটি থেকে ধুলোউড়ির মাঠ পেরিয়ে।
দূরে আলো দেখা গেল। আলোটা কাছে এলে দেখলেন, গোরাংবাবু ঘোড়া চেপে আসছেন—হাতে লন্ঠন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কথা বলতে হল। নির্জন রাত্রির মাঠ। ‘…হ্যালো ডক্টর! কেমন আসেন? বালো তো? মেয়ের কবর বালো তো? এটরাত্রে কোটায় চলিলেন?’ হাত বাড়িয়ে দিলেন ফাদার সাইমন ঘোড়ার ওপর।
হাত নিয়ে গোরাংবাবু বললেন, ‘ভালো ফাদার—সব খবর ভালো। আপনার কুশল তো?’
‘কুশল আছে। এটো রাত্রে কোটায় যাবেন হাপনি?’
‘আর বলবেন না। চরণ এল সন্ধেবেলা। মেয়ের কি অসুখ নাকি? তা—তখন কেমন করে যাই? মেয়ে একা থাকবে। এদিকে আমার সেই লোকটা—হেরু, হেরুকে তো দেখেছেন….’
ফাদার হাসতে হাসতে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ—দ্যাট সুপারম্যান! হে—হে—হেউর!’
গোরাংবাবু বললেন, ‘হেরু ছিল না। গিয়েছিল হাউলির ওখানে গাড়ি তুলতে—ওর তো ওই কাজ। আর বলবেন না!…হুঁ… তারপর ব্যাটা এল। তখন ওকে বাড়িতে বসিয়ে রেখে এতক্ষণে সময় পেলুম। আপনি কোত্থেকে আসছেন?’
আবার জোর হাসতে লাগলেন ফাদার সাইমন…’মাই গুডনেস! আমি তো চরণের বাড়ি থেকে আসছে এখন। চলুন, পেসেন্ট বালো আসে। ইগ্নেশিয়া দিলাম। আপনি কী বোলেন? ঠিক হয়নি?’
গোরাংবাবু মনে মনে ক্ষেপে বললেন, তা—না জেনেশুনে কেমন করে বলব, বলুন? মহাত্মা হ্যানিমানের। সায়েন্স তো ডালভাত নয়!’
ফাদার সকৌতুকে বললেন, ‘বালো কোঠা। বালো কোঠা ডালবাট না আসে। চলুন গপ করতে ফিরে যাই।’
গোরাংবাবুর জেদ বেড়ে গেল। বললেন, না ফাদার। আমি একবার যাব। আমার কর্তব্য এটা!
ফাদার অগত্যা চলে গেলেন। এই নেটিভ ডাক্তারটা বড্ড অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ! ওদিকে গোরাংবাবু টিটিং টিটিং করে টাট্টু হাঁকিয়ে গিয়ে দেখেন, সব নিশুতি। ডেকে—ডেকে চৌকিদার উঠল না। গাঁজা টেনে এতক্ষণে পড়ে গেছে বিছানায়। রাগে অপমানে ক্ষুব্ধ হয়ে গোরাংবাবু সেদিন ফিরে এসেছিলেন। মাঝখানে ঘোড়া খামোকা কষ্ট পেল। কাটা আল ডিঙোতে দুজনেই পড়েছিলেন।…
কিন্তু মজার কথা বিন্নির অসুখটা মোটেও সারেনি। এই একমাসে আরও বেড়ে গেছে। যখন তখন ভর ওঠে, ফিট হয়। ইয়াকুব তান্ত্রিককে ধরা হয়েছিল। সে গা করে না। শুধু বলে ‘সময় হলেই যাব যখন তখন গিয়ে অশরীরী আত্মার পাল্লায় পড়ে মরব নাকি? লোকে জেনে গেছে, খেলাটা ইয়াকুবেরই। লখা—মরা—সরা বাউরি ভাইগুলো একেবাক্যে বলেছে—সেদিন ঝিলে বিন্নি ইয়াকুবকে গাল দিয়েছিল। আর হেরু—হেরু থাকলে সেও সাক্ষী দিত। তার সামনেই ওটা ঘটেছিল। হেরু তো এখন ফেরারি।’
ফাদার সাইমন কিন্তু বরাবর আসছেন আর ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। কাজ হচ্ছে না। ইতিমধ্যে হু হু করে বর্ষা নেমে গেল। কী বর্ষা, কী বর্ষা! মাঠঘাট জলে থই থই। হাজার ব্যাঙ ডাকতে লাগল। লাঙল পড়ল জমিতে জমিতে। দেখতে দেখতে কর্ণসুবর্ণর ঐতিহাসিক টিলাগুলো সবুজ ঘাসে ভরে গেল। তেরোশো বছর আগের ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত্বকে প্রকৃতি পায়ে লাথি মেরে সামনের জীবনকে ডেকে বললেন, আয় আমরা ভালোবাসা খেলি। আমি তোকে দিলুম রঙ, তুই আমাকে দে ধ্বনিসমূহ।
রাতের দিকে নিসর্গজগতে এক আশ্চর্য ধ্বনিপুঞ্জ বাজতে থাকে। কোটি কোটি প্রাণ চিৎকার করে অস্তিত্ব ঘোষণা করে চলে। তারাও আছে, তারা আছে! গোরাংবাবুর ঘরের সামনে বটগাছটা থেকে টুপটুপ করে জলের ফোঁটা ঝরে। পাকা বটফল খসে পড়ে সামনে। বৃষ্টির মধ্যে চলে যায় রাতের রেলগাড়ি। বৃষ্টি ছাড়ার পর আজকাল শুক্লপক্ষের চাঁদ দেখা যায়। ঝকঝকে জ্যোৎস্নায় ভিজে ঘাস আর খেতে খেতে জল চকচক করে। শেয়াল ডেকে ওঠে। পেঁচা ডাকে। লক্ষ কোটি পোকামাকড় পরস্পর ডাকাডাকি করে। সুসময়—ভালোবাসার রেশমি পর্দার আড়ালে জন্মদানের সুসময় বয়ে যাচ্ছে—এসো, সবাই এসো! পৃথিবীকে প্রাণে প্রাণে ভরে দিই। তারপর সেই ফিংফোটা চাঁদনিতে প্রকাণ্ড ছায়া ফেলে কে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে গোরাংবাবুর খিড়কির দিকে। খিড়কিটা সারারাত খোলা থাকে আজকাল…
ফাদার সাইমন এসেছিলেন বিকেলে। অগস্তিবাবু কদিন বাদে চলে যাচ্ছেন বড় একটা স্টেশনে। নতুন মাস্টার আগামীকালই এসে পড়বার কথা। এবার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট মাস্টারও বহাল করছে রেল কোম্পানি। নতুন স্টেশন মাস্টার ফের গোরা সাহেব। নাম জর্জ হ্যারিসেন। অস্ট্রেলিয়ার লোক। সবে এদেশে এসেই এই ভূতুড়ে জায়গায় তাকে ঠেলেছে রেলকোম্পানি। এ. এস. এমটি নাকি বাঙালি। বয়সে নিতান্ত তরুণ। নাম সুধাময় চক্রবর্তী। বধর্মানের ওদিকে কোথায় প্রথম চাকরি—দ্বিতীয় জায়গা চিরোটি। বাছাধন কেঁদে পথ পাবে না।
ফাদার সাইমনকে এই সব কথা বলছিলেন অগস্তিবাবু। গল্প করতে করতে রাত বেড়ে গেল। কোয়ার্টারে যাবেন গয়া পাস করিয়ে। গাড়ির সময় হয়ে এল।
হঠাৎ ফাদার বললেন, ‘এখনই আসছি।’ বলে বেরিয়ে গেলেন। রেলের একটা লন্ঠন হাতে নিয়েছেন। চাঁদঘড়ি বলে গেছে, তার বউটার জ্বর। গোরাংবাবুর ওষুধে কিছু হচ্ছে না। আজই ভাবছিলেন, যাবে নাকি ডাউন স্টেশনে চৌরিগাছার অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারের কাছে ওষুধ আনতে। তা স্বয়ং ফাদার যখন এসে পড়েছেন, তখন অন্য কথা নেই।
চাঁদঘড়ির এখন নীল লন্ঠন দোলাবার কথা—ডাউন সিগনালের কাছে। সে চলে গেছে ওদিকে। আর একজন খালাসি রামধনিয়া সিগন্যালের হাতলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কী ভেবে একা একা পা বাড়ালেন ফাদার সাইমন। চাঁদঘড়ি নিশ্চয় ওর বউকে বলে রেখেছে। আসলে এটাই স্বভাব ফাদার সাইমনের। রোগী আছে শুনলে আর তর সয় না।
লাইন ডিঙিয়ে চলে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। অগস্তিবাবুর গল্পে বেশ দেরি হয়ে গেছে। বেচারি জ্বরে হয়তো ধুঁকছে। এই বিদেশে কেউ দেখার লোক নেই। এখনও কোয়ার্টার পায়নি মিনিয়াল স্টাফ। শিগগির কোয়ার্টার হয়ে যাবে। এখন লাইনের ওপর ছোট ছোট কুঁড়েঘর বানিয়ে বাস করতে হচ্ছে।
চাঁদঘড়ির বাড়ির সামনে যে ছোট্ট পুকুর—তার এদিকে গোরাংবাবুর খিড়কির ঘাট। সবে নবমীর চাঁদ বৃষ্টিধোয়া আকাশে খোকার মুখের মতন ফুটে উঠেছে। বেশ ঝকমকে জ্যোৎস্না আছে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন ফাদার সাইমন।
কে একজন প্রকাণ্ড মানুষ খিড়কি দিয়ে গোরাংবাবুর বাড়ি ঢুকে গেল। চমকাতেন না ফাদার। কিন্তু মানুষটা অতিকায়। এবং তখুনি হেরুর ব্যাপারগুলো সব মনে পড়ে গেল।…
অনেক রাতে অগস্তিবাবুর কোয়ার্টারে শুয়ে ব্যাপারটা ভেবে আকাশপাতাল হাতড়ালেন ফাদার সাইমন। কিছু বুঝতে পারলেন না। ক্রমশ উত্তেজনা বাড়তে থাকল তাঁর। সে রাতে আর ঘুম হল না। কিন্তু অগস্তিবাবুকেও কিছু বললেন না।
সকালে চা খেয়েই ফাদার সাইমন গোরাংবাবুর কাছে হাজির। ‘হ্যাল্লো গাওরাঙ্গবাবু, কেমন আসেন? কবর বালো? মেয়ে কোটায়? ডাকুন। ডেকব।’
গোরাংবাবু সবে চায়ের গেলাস হাতে বসেছেন। একটু অবাক নিশ্চয় হলেন। হঠাৎ সাতসকালে ফাদার সাইমন কেন? বললেন, আসুন আসুন ফাদার। স্বর্ণ, মা স্বর্ণ! ফাদার এসেছেন রে! কী ভাগ্যি! চা দিয়ে যা না!
স্বর্ণলতা পাদরিকে দেখে মনে মনে বরাবর খেপে ওঠে। বাবার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে নয়—ওই গোরা সায়েবের দুটা জ্বলজ্জ্বলে নীল চোখে একটা মতলববাজ ধূর্ত শেয়ালের ওৎপেতে থাকা মূর্তি আছে যেন। সাইমন স্বর্ণর দিকে কী এক অদ্ভুত দৃষ্টে তাকান। অনেক পুরুষের অনেক চাউনি স্বর্ণের চেনা। এইটি অন্যরকম। পাদরিটা কি তার পরানপাখি খোঁজেন? এই পাদরি কি তার নিষ্ফল শরীরের ব্যাপারসাপার নিয়ে উদ্বিগ্ন?
আবার চা করতে করতে সে আনমনে পাদরিকে ওজন করে দেখল এবং ঝাঁটাপেটা করল। ইচ্ছে করেই চিনি কম দিল পেয়ালায়। এই পেয়ালাটা রেলের হান্টার সায়েব উপহার দিয়েছিলেন গোরাংবাবুকে। এমন সুন্দর ঝকঝকে সাদা চিনেমাটির পেয়ালা—সারা গায়ে সবুজ নকসা; হান্টার সায়েব যেখান থেকে এটা এনেছিলেন, সেখানে সে আরেক পৃথিবী সম্ভবত—যা নিয়ে স্বর্ণের মনে অস্ফুট প্রহেলিকায় ভরা এক মায়ানগর আছে। পেয়ালাটা দেখতে দেখতে তার আঁচ পায় স্বর্ণ। আর, বাবার বিবেচনায় এই মহার্ঘ জিনিসটে কেবল গোরা সায়েবদের জন্যে রাখা। অবশ্য একবার কবে অগস্তিবাবুও এতে চা খেয়েছিলেন মনে পড়ে। এতে পাদরিটাকে চা দিতে ইচ্ছেই করছে না এখন।
গোরাংবাবুর ডাকে আজ একটা চাপা উদ্বেগ আছে, স্বর্ণ টের পেল। সে একটু আড়ষ্টভাবে রেখেই চলে আসছিল। সাইমন ডাকলেন, ‘এই টো! এসে গেছে। সারনো! কী বলুন গাওরাঙ্গবাবু—দি গোলডেন ক্রিপার…হাঃ হাঃ হাঃ! টুমি বালো টো মা? বালো কোবোর?’
স্বর্ণ অস্ফুটস্বরে বলে, ‘হুঁ। আপনি ভালো আছেন?’
‘হ্যাঁ।’ ফাদার সাইমন ঝোলা থেকে একগুচ্ছের ছাপানো রঙিন কাগজ বের করে বলেন, ‘এগুলো টোমার জন্য। নাও, মা। ডাকটারবাবু, আপনার মেয়েকে আমি কিসু বালো কটা শেখাবো। কিসু মনে করবেন না—প্লিজ।’ গোরাংবাবু ট্যারা চোখে খ্রিস্টধর্মের পুস্তিকাগুলো দেখে নিলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না। দিক না। স্বর্ণ তো আর খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে না! পড়ুক। পড়লে কত কী জানা যায়। চর্চা বাড়ে। যেটুকু শিখেছিল, সব তো যেতে বসেছে!
স্বর্ণের অবশ্য লোভ হচ্ছিল। কিন্তু পাদরির চোখের সেই নীল আলোটা ঠান্ডা হয়ে তার শরীরময় ঘুরছে টের পেয়ে সে দ্রুত সরে গেল।
ঘরে এখন রুগিপত্তর নেই। একটু পরে হয়তো এলেও আসতে পারে দুচারটে। একথা ওকথার পর ফাদার সাইমন এবার আসল কথাটা পাড়লেন। তাঁর কষ্টকর বাংলা সংলাপ থেকে গোরাংবাবু যা বুঝলেন তাঁর শরীর হিম হয়ে রইল কয়েক মিনিট। ব্যাপারটা ঠিক এরকম : নিজের মনে খেলাচ্ছলে যা নিঃসঙ্কোচে করে যাচ্ছি, হঠাৎ কেউ এসে তা দেখে ফেলামাত্র যেন তার অসঙ্গতিটা ধরা পড়ল।
বারবার শিউরে উঠলেন গোরাংবাবু। মনে মনে দ্রুত ঠিক করে ফেললেন, যথেষ্ট হয়েছে। আর হেরুকে পাত্তা দেওয়া ঠিক হবে না।
তবে কথা কী, বড্ড মায়া হয় ছোঁড়াটার জন্যে। এত ন্যাওটা ছিল! যা বলা গেছে, তাই শুনেছে।…
ফাদার সাইমন কিন্তু গম্ভীর নন। কৌতুকপরায়ণ পুরুষ। শুধু বলেন ‘এটা সট্টি একটা পাজল! আমি ডামব—ফাউনড্ডে! হটোবম্বো হয়েসি ডাকটারবাবু।’
অতি কষ্টে একটু হেসে ভীত গোরাংবাবু বলেন, ‘আমি ডাকাতের সর্দার নই ফাদার। সামান্য গোবেচারা মানুষ। কেউ এসে কিছু চাইলে না করতে পারিনে!’
সাইমন একটু চুপ করে থেকে বলেন, ‘ঠিক। ঠিক। তো একটা কটা আমি বলসি গাওরাঙ্গবাবু।’
‘বলুন।’
‘হেরুকে আমার সাটে ডেকা করে দিন।’ অকাট্য খ্রিস্টীয় শপথ উচ্চারণ করেন সাইমন। ‘তার কোনো বয় নাই। আমি টাকে কিসু কটা বলব। বিলিভ মি, প্লিজ!’
এবার গোরাংবাবু খোলা হাসলেন। ‘কী কথা বলবেন ফাদার, শুনি? ধর্মকথা! হেরু কিন্তু সব রোগের বাইরে চলে গেছে। ওকে আমিও তো কম শেখাইনে! বলি, তুই বাপু ধরা দে পুলিশের কাছে। ব্যাটা মুলোর মতন দাঁত বের করে হাসে। আসলে ওকে বড্ড ভয় করি—ও বোঝে ফাদার, শালা বাউরি এখন আমাকে পেয়ে বসেছে।’
সাইমন ‘শালা বাউরি’ কথাটা দুবার বলে জোর হাসতে থাকেন। তারপর মুখস্থবাক্য বলেন, ‘মনুষ্য পাপী। উদ্ধারকর্তার সুসমাচার উহাদের নিকট পহুঁছে নাই।…ডাকটারবাবু, আপনি আজ একবার চেষ্টা করুন। কোন ডর নাই।’
গোরাংবাবু উদ্বিগ্নমুখে শুধু বলেন, ‘আচ্ছা দেখছি।’
ফাদার সাইমন চলে গেলে স্বর্ণকে ডাকলেন গোরাংবাবু। সব কথা বললেন। স্বর্ণ রেগে লাল তক্ষুনি। ‘তুমি তো বড্ড বোকা মানুষ বাবা! কেন উড়িয়ে দিলে না?’
‘কী মুশকিল! ব্যাটা পাদরি যে সত্যি সব স্বচক্ষে দেখেছে!’
‘দেখুক। বললেই হত, ও হেরু না—অন্য লোক। রুগির জন্যে ডাকতে এসেছিল!’
‘যাঃ! খিড়কির দোর দিয়ে তেমন কেউ আসে নাকি!’
স্বর্ণ আরও রেগে বলল, ‘কথা বলতে জানলে দিনকে মানুষ রাত করে দিতে পারে।’
মিটিমিটি হাসেন গোরাংবাবু।… ‘তুই পারিস বুঝি?’
‘পারতুম। আমাকে বললে গোরা পাদরিটাকে ঘোল খাইয়ে ছাড়তুম!’… স্বর্ণ জবাব দ্যায়।’ ‘… থাকগে, যা হবার হয়েছে। এখন শোন—হেরুকে বলে দিলেই হবে, কিছুদিন যেন আসে না এদিকে। আর, কখনো ওকে পাদরিটার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়ো না। তোমাকে তো বিশ্বাস নেই—হয়তো সত্যি সত্যি তাই করে বসবে। তুমিও যেমন—হেরুও তেমনি! মগজে তো খালি গোবর পোরা সব!’
সে রাতে হেরুর প্রতীক্ষা করছিলেন গোরাংবাবু। স্বর্ণও কান পেতে ছিল। সন্ধ্যা থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছিল। আকাশ কালো হয়ে গেছে মেঘে। বৃষ্টির শব্দে রেলগাড়ির শব্দ চাপা পড়েছিল। বৃষ্টি মধ্যে দুবার একটু কমলেও ঠিক মাঝরাতে আবার একপশলা এসে গেল। আজ বছরের পয়লা কাড়ান তাহলে।
একসময় তারই মধ্যে হেরু হাজির হল। ভিজে জবজবে শরীর—কোঁচড় থেকে একরাশ কীসব বের করে বাবা—মেয়ের পায়ের কাছে রাখলে, দুজোড়া চোখ ধকধক করে জ্বলে উঠল। এত সোনার অলঙ্কার! হেরু নিঃশব্দে হাসছে কতক্ষণ কোনো মুখে কথা নেই। তারপর গোরাংবাবু চাপা হাঁসফাঁস করে বলে উঠলেন, ‘এ কী এনেছিস হেরু? কার বুকে হন্তা দিলি রে? ওরে, কার সর্বনাশ করলি তুই?’
হেরু বলে, ‘এত কথায় কাজ কী ডাকতোরবাবু? ইগুলো আপনার পেন্নামী। অ্যাদ্দিন তো ঢের নুন খেয়েছি—রেখে দ্যান। কাজে লাগবে।’
ছটফট করে ওঠেন গোরাং ডাক্তার। খেপে যান।…’কী কাজে লাগবে রে শালা বাউরি? তোর ডাকাতির ধনে আমি পেচ্ছাব করে দিই। যা—নিয়ে যা এক্ষুনি! পালাঃ বলছি!’
স্বর্ণ হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে। একটা ভারী আর চওড়া সোনার হার—অনেকগুলো রঙিন পাথর বসানো আছে তাতে, তুলে নিয়ে গলার কাছে রাখে এবং হেসে দুজনের মুখের দিকে তাকায়! বৃষ্টির ছাঁট আসছে দাওয়ায়। কুপির আলো টলটল করে কাঁপছে। এত উজ্জ্বলতা সইতে পারছে না শিখাটা। গোরাংবাবু আর্তনাদ করেন—’স্বর্ণ! ছিঃ, ছিঃ।’
স্বর্ণ একটার পর একটা গয়না গায়ে রেখে পরখ করে। হেরু শুধু হাসে। গোরাংবাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রী কাঁপেন। কী বলবেন, আর খুঁজে পান না।
হঠাৎ স্বর্ণ বলে ওঠে, ‘ও হেরু! এ কী? কী এটা?’… তারপর আঙুলে তুলে নেয় মস্তো একটা কানপাশার ওপর থেকে একচিলতে নরম কাদাটে লাল কী বস্তু।
হেরু বলে, ‘আক্ত।’
‘রক্ত!’…বাবা মেয়ে একসঙ্গে অস্ফুট চ্যাঁচায়।
‘হ্যাঁ—অক্ত।’
স্বর্ণ বলে, ‘ও।’…তারপর আঙুলটা বাড়িয়ে বৃষ্টিতে ধুয়ে ফেলে।…’তা বাবা, এগুলো আমরা রাখব কোথায়?’
‘তোর মাথায়।’… বলে গোরাংবাবু চলে যান। প্রচণ্ড অভিমান আর অসহায়তায় ছটফট করতে—করতে অন্ধকার ঘরে গিয়ে গুম হয়ে বসে থাকেন।
নির্বিকার স্বর্ণ গয়নাগুলো বৃষ্টির মধ্যে খোলা উঠোনের ধানসেদ্ধ করার উনুনটার ভিতর পুঁতে রাখে। হেরু দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে কুপিটা তুলে তাকে যথেষ্ট আলো জোগায়।
এইসব করে ভিজে কাপড় বদলে, রাত আরও বাড়তে বাড়তে, হেরুকে খেতে দিয়ে স্বর্ণ ফাদার সাইমনের প্রসঙ্গ তোলে। যতক্ষণ খায় হেরু, জবাব দ্যায় না। খাওয়া শেষ করে নিষ্ঠার সঙ্গে আঁচায়। তারপর দেয়ালে পিঠ রেখে পা ছড়িয়ে বসে। এবং বলে, ‘পাদরির সঙ্গে দেখা হবে।’
তখন স্বর্ণ বলে, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে। হেরু, তুমি এখন এসো।’
হেরু হাই তুলে বলে, ‘যাই।’
হঠাৎ স্বর্ণর মনে হয়, হেরু কোথায় শোয় রাতে—দিনমান কোথায় ঘোরে, কিছু জিগ্যেস করা হয়নি অ্যাদ্দিন। আজ হেরুকে একটু মূল্যবান লাগছে। সে বলে, ‘হেরু—তুমি এখন কোথায় রাত কাটাবে?’
হেরু একটু হাসে।…’বিষ্টির রাতে পড়ে আমার এদানীং খুব কষ্ট গো সন্নদি। শালা গাছপালায় আর পোষায় না। ভাবছি….’
স্বর্ণর মনে মায়া আসে।…’তা বাপু, বউর কাছে গিয়ে থাকলেই পারো’!
পলকে হেরুর মুখটা বেঁকেচুরে কুচ্ছিত হয়ে যায়।…’তুমি জানো না সন্নদি, নাকি জানো? কানে আসেনি কথাটা? নাকি এসেছে?’
কৌতূহলী স্বর্ণ বলে, ‘কী কথা?’
‘আমার বউ মাগি তলায়—তলায় জাত দিয়েছে।’
‘তার মানে?’
‘হ্যাঁ গো! চাঁদপাড়ার এক মোছলমানের সঙ্গে উয়ার বড্ড পীরিত আজকাল।’—হেরু বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে উঠোনে চলে গিয়ে কেমন হাসে।… ‘এখন সন্নদি, আমার সন্দ লাগে, উ ছেলেটা আমার লয়!’
অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন গোরাংবাবু। চাপা গর্জে বলেন, ‘ওরে হেরু! ওরে শালা পাষণ্ড বাউরি! তোর মাথায় বাজ পড়বে রে শালা!’
‘ক্যানে গো ডাক্তারবাবু? ক্যানে? বাজ পড়বে ক্যানে?’
‘চো—ও—প! মেরে মুখ ভেঙে দেব শালার। আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি তোর ছেলেকে।’
কাতর হেরু বলে, ‘আমি দেখি নাই। আমার ডর লাগে, বড় তরাস বাজে ডাক্তোরবাবু। আমি ডাকাত—টাকাত পাপী মানুষ—তবু আমার বুকে ঢাক বাজে। কী জানি ছেলের মুখে কার মুখ দেখি—’
‘বেরো শালা, এক্ষুনি বেরো’!
স্বর্ণ ফোঁস করে ওঠে।… ‘শোও গে তো বাবা! রাতদুপুরে পাড়া মাথায় করো না। কে কোথায় ওৎ পেতে আছে। হেরু, তুমি এসো।’
‘যাই।’… বলে হেরু আস্তে আস্তে খিড়কির ওদিকে অদৃশ্য হয়।
স্বর্ণ এক দৌড়ে খিড়কির দরজা বন্ধ করে এসে কতক্ষণ চুপচাপ ভাবে—হেরুর কথা, তার বউর কথা—আর উনুনের অলঙ্কারগুলোর কথা। মায়ামমতা আর লোভে তার ঘুম কেড়ে নিল আজ। গোরাংবাবুও ঘুমোতে পারছিলেন না। স্বর্ণ করল কী! ছি, ছি—এ অন্যায়, এ অধর্ম।…
এর কদিন পরে এক পাখিডাকা সকালে রাঙামাটির চাষারা ফাদার সাইমনকে মাঠে অদ্ভুত মূর্তিতে আবিষ্কার করল।
ফাদারের গায়ে আষ্টে পিষ্টে বুনো আলুর শক্ত মোটা লতা দিয়ে বাঁধন—আলের ওপর একটা শেয়ালকুলকাঁটার ঝোপের সঙ্গে টানা দেওয়া। তাঁর মাথাটা ন্যাড়া, একটা প্রকাণ্ড টিকি রাখা হয়েছে, দাড়িও জায়গায় জায়গায় সাফ এবং পোশাক—আসাক সমেত সারা গায়ে যত কাদা, তত মেটেহাঁড়ির তলার কালিতে কুচকুচে। অধিকন্তু, তাঁর গলায় আস্ত একটা হাঁড়ির মাথা মালার মতন বসানো রয়েছে।
ফাদার সাইমন কথাবলতে পারছিলেন না। ধরাধরি করে সবাই মিলে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে এল। সেখান থেকে ট্রেনে তাঁকে কাটোয়া নিয়ে গেলেন রেলের হান্টার সায়েব।
খবর শুনে স্বর্ণ হাসতে হাসতে মারা পড়ার দাখিল। কিন্তু গোরাংবাবুর মুখ সাদা ছাই। এবার পুলিশে—পুলিশে, লাল ফুল ফোটাবে তাঁর ঘরবাড়ি জুড়ে। ভাবলেন, গয়নাগুলো চুপিচুপি তুলে কোনো জংলি পুকুরে ফেলে দিয়ে আসবেন।
কিন্তু স্বর্ণ সজাগ বড্ড। উনুনের কাছে গেলেই তার সাড়া আসে। হল না।
কয়েকটা দিন গেল। পুলিশ এল না তবু। তখন একটু আশ্বস্ত হতে পারলেন গোরাংবাবু। এবং আরও কয়েকটা দিন পরে বাবা—মেয়ে দুজনে ফাদার সাইমনের লাঞ্ছনার ঘটনাটা ইনিয়ে—বিনিয়ে কল্পনা করে খুব হাসাহাসি করতে লাগলেন। ব্যাটা পাদরি আচ্ছা জব্দ হয়েছে। কিন্তু তবু মনের ধুকুপুকু যায় না। সাইমন সায়েব সব চেপে চুপচাপ থাকবেন আর কদ্দিন? এদিকে উঠোনের উনুনের তলায় যখের ধনের মতো চোরাই গয়নাগুলো বর্ষার রসে যেন উজ্জ্বলতর হতে থাকল দিনে দিনে।