পাঁচটা সূর্যমুখী লঙ্কা আর পনেরোখানা বেগুনি দিয়ে ছোট একধামা মুড়ি শেষ করে জল খেয়ে জগাই বলল, “বুঝলে মাধাইদা, এইবার খিদেটা হতে লেগেছে। মুড়িটা পেটে গিয়ে খিদের বীজতলাটা তৈরি হয়ে গেল।”
মাধাই মুড়ির শূন্য ধামাটা সরিয়ে রেখে আধঘটি জল গলায় ঢেলে বলল, “তুই কি জানিস যে, হরিপুর জায়গা খুব খারাপ?”
“কেন গো মাধাইদা, হরিপুরের তো তেমন কোনও বদনাম নেই!”
“সে না থাকলেও এ জায়গা ভাল নয়। এখানকার জল পেটে গেলেই যা খেয়েছিস সব কয়েক মিনিটেই হজম হয়ে যায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফের খিদে চাগাড় দেয়।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। হরিপুরের জলের কথা খুব শুনেছি। সবাই সুখ্যাতি করে। তাতে খারাপটা কী দেখলে?”
মাধাই বড় বড় চোখে চেয়ে বলল, “খারাপ নয়? আমাদের মতো গরিবগুরবোদের ঘণ্টায় ঘণ্টায় খিদে পেলে রোজগারের পয়সা যে শুধু পেটপুজোয় খরচ হয়ে যাবে! সেটা কি ভাল? এ জায়গায় থাকলে আমাদের পোষাবে না রে জগাই।”
জগাই একটু চুপ করে থেকে বলল, “এটা একটা ভাববার মতো কথা বটে! পনেরোখানা বেগুনি আর একধামা মুড়ি তো কম নয়। কিন্তু যেই হরিপুরের জল পেটে গেছে অমনই সব যেন কোথায় তলিয়ে গেল! নাঃ মাধাইদা, লক্ষণ মোটেই ভাল নয়।”
“সেই কথাই তো বলছি। এই তো এই বাড়ির গিন্নিমা ডেকে বললেন, রাত্তিরে যেন ডাল দিয়ে বেশি ভাত খেয়ে না ফেলি। আজ নাকি লম্বা খাওয়া আছে। ডাল, ভাজা আর লাবড়ার তরকারি দিয়ে শুরু। তারপর দুই পদ মাছ আর চাটনি হয়ে নলেন গুড়ের পায়েস অবধি। শুনে ভারী আনন্দও হল। জন্মে তো আর ওসব তেমন খাওয়া হয়নি। আমাদের লঙ্কা আর নুন হলেই একথালা ভাত উঠে যায়। কিন্তু ভয় কী জানিস? পেট ঠেসে খাওয়ার পর যে-ই জলটি খাব অমনই পেটটা ফঁকা-ফঁকা লাগতে থাকবে। মনে হবে, সত্যিই কি কিছু খেয়েছি? নাকি স্বপন দেখছিলুম! তারপর ধর, এই অবস্থায় শিয়রে চিড়ে-মুড়ি কিছু না নিয়ে শুলে মাঝরাত্তিরে যখন পেট চুই চুই শুরু করবে, তখন কী উপায়?”
জগাই ভাবিত হয়ে বলল, “সত্যিই তো! এ তো বড় বিপদের কথা হল! আমাদের গঞ্জের জল যেন পাথর, পেটে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নড়বার নামটি নেই। যা খাও তা পেটে গিয়ে আড়মোড়া ভাঙে, হাই তোলে, গড়িমসি করতে থাকে, খানিক জিরোয়, একটু ঘুমিয়েও নেয়। তারপর ধীরেসুস্থে সময়মতো নেমে যায়। কিন্তু এখানে তো খাবার দাবার পেটে গিয়ে মোটে বসবার সময় পায় না। হরিপুরের জল গিয়ে তাদের অ্যায়সা তাড়া লাগায় আর এমন হুড়ো দেয় যে, বেচারারা পালাবার পথ পায় না। বেচারাদের দম ফেলার ফুরসতই হচ্ছে না। এই যে মুড়ি-বেগুনি সাঁটলুম, কোথায় গেল বলো তো? পেট তো বেশ খাঁখাঁ করছে। নাঃ মাধাইদা, তুমি ঠিকই বলেছ। হরিপুরে আমাদের পোষাবে না।”
মাধব একটা হাই তুলে বলে, “নবীন অবশ্য বলছিল হরিপুরেই আমাদের একখানা দোকান করে দেবে। বিক্রিবাটা নাকি ভালই। সেটাও একটা ভাববার মতো কথা।”
“হুঁ। প্রস্তাবটা ফ্যালনা নয়। ভাবনাটাবনা তোমার বেশ ভাল আসে। ও তুমিই বসে ভাবো। আমি কিছু ভাবতে গেলেই মাথাটা বড্ড ঝিমঝিম করে।”
ওদিকে নবীনদের উঠোনে গাঁ ঝেটিয়ে লোক এসে জুটেছে। গাঁয়ে আজ যাত্রা হওয়ার কথা ছিল, সেখানে লোকাভাবে আসর ভেঙে গেছে। দাওয়ার উপর জলচৌকিতে নতুন গামছা পেতে লাঠিটা শোয়ানো হয়েছে। নবীনের জ্যাঠা পরমেশ্বর গাঁয়ের স্কুলের হেডমাস্টার এবং পঞ্চায়েতের চাই। বলিয়ে কইয়ে মানুষ। পরমেশ্বর দাঁড়িয়ে একখানা ভাষণ শুরু করল, “বন্ধুগণ, আজ আমরা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের সম্মুখীন। সপ্তম আশ্চর্য পর্যন্ত এতকাল আমাদের জানা ছিল। আগ্রার তাজমহল, চিনের প্রাচীর, মস্কোর ঘণ্টা, মিশরের পিরামিড, আর কী যেন…”
ভিড় থেকে একজন বলল, “মনুমেন্ট!”
আর-একজন চেঁচাল, “কাশীর প্যাঁড়া।”
পরমেশ্বর মাথা নেড়ে বলল, “আরে না, না। হ্যাঁ মনে পড়েছে! ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান, টেমস নদীর সুড়ঙ্গ। আর অষ্টম আশ্চর্য আজ দেখলাম, এই লাঠিখানা। এই লাঠিখানা আজ আমার ভাইপো নবীনকে প্রাণে বাঁচিয়েছে, একদল বদমাশকে পিটিয়ে ঠান্ডা করেছে। এ বড় সোজা লাঠি নয়।”
বিশ্ববোকা হরেন গনাই বলে উঠল, “আহা, লাঠিখানা তো মোটেই বাঁকা নয় হে। দিব্যি সোজা, সটান লাঠি!”
পরমেশ্বর মাথা নেড়ে বলল, “দেখতে সোজা হলে কী হয়, এর মধ্যে স্বয়ং শিব ঢুকে বসে আছেন যে!”
কালীভক্ত চরণ দাস গম্ভীর গলায় বলে, “শিবের হাতে আবার লাঠি কবে দেখলে হে পরমেশ্বর? শিবের হল শূল। তার তিন ফলা।”
বাধা পেয়ে পরমেশ্বর বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে শূলটা তো লাঠির মাথাতেই বসানো! ওটা খুলে নিলেই শূল লাঠি হয়ে গেল!”
শ্রীপদ মল্লিক বলে উঠল, “গোঁজামিল দিলেই তো হবে না মশাই, শূল হল শূল, আর লাঠি হল লাঠি। বগি থেকে ইঞ্জিন খুলে নিলেই কি আর রেলগাড়িকে গোরুর গাড়ি বানানো যায়?”
গদাইনস্কর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দেবতাদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে কিন্তু লাঠিকে ধরা হয় না।”
সবজান্তা সনাতন দাস হেঁকে বলল, “কে বলে ধরা হয় না? স্বয়ং গাঁধীজির হাতে লাঠি ছিল না? ওই লাঠি দিয়ে পেঁদিয়েই তো সাহেবদের বৃন্দাবন দেখালেন!”
গোপাল বৈরাগী ফস করে বলে উঠল, “গাঁধীজিকে মোটেই দেবদেবীদের খাতে ধরা হয় না।”
সনাতন ফুঁসে উঠে বলল, “কে বলল কথাটা? মুখোনা একটু দেখি চাঁদুর! ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলের চুয়ান্ন নম্বর ধারাটা দেখে নিয়ো। গাঁধীজিকে ভগবানের ক্লাসে প্রমোশন দেওয়া হয়ে গেছে।”
গোপাল বৈরাগী থতমত খেয়ে মুখ লুকিয়ে ফেলল।
নাস্তিক নবকিশোর বলে উঠল, “অনেকক্ষণ ধরে তো লাঠির মহিমা শোনাচ্ছেন মশাই! এই সায়েন্সের যুগে কেউ মিরাকল বিশ্বাস করে নাকি? মিরাকল-টিরাকল সব মিথ্যে, জ্যোতিষশাস্ত্র একটা বুজরুকি, ভগবান নেই, ভূত নেই! আমাদের বিজ্ঞান যুক্তি সমিতি, সংক্ষেপে ‘বিযুস’ ঘোষণা করেছে, মিরাকল বা অলৌকিক কিছু প্রমাণ করতে পারলে তাকে হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এখন দেখান তো লাঠির কেরানি!”
বুড়ো পঞ্চানন মণ্ডল মুখের হকিটা এক গাল থেকে অন্য গালে নিয়ে বলল, “ওহে বাপু পরমেশ্বর, এবার জবাব দাও। বাক্য হরে গেল যে! সেই কখন থেকে লাঠির মহিমা দেখার জন্য এসে বসে আছি! তা কোথায় কী? কেবল বক্তিমে হচ্ছে। ওদিকে খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে গেল, হাঁটুতে বাতের ব্যথা চিরিক দিচ্ছে, মাথায় হিম পড়ছে, যত্ত সব…”
তান্ত্রিক জটাধর লাফিয়ে উঠে হুংকার দিয়ে বলে উঠল, “ওরে পাষণ্ড নবা, তোর শিরে যে বজ্রাঘাত হবে! বজ্রাঘাত না হলেও সর্পাঘাত তো নির্ঘাত। পারবি গাজির মোড়ের বটগাছতলায় রাত বারোটায় নিজের নাম সই করা একখানা কাগজ পাথর চাপা দিয়ে রেখে আসতে? তবে বুঝব তুই বাপের ব্যাটা! বুক ঠুকে বল তো সবার সামনে পারবি কিনা! পারলে তোকেই আমি হাজার টাকা দেব।”
নবা, অর্থাৎ নবকিশোর ভিড়ের মধ্যে একটু পিছিয়ে গেল। ভিড়ের পিছন দিকটায়, মস্ত একটা শিউলি গাছের ঝুপসি ছায়ায়, মাথা-মুখ র্যাপারে ঢেকে বসে ছিল নিমাই। চোখ চারদিকে ঘুরছে। শুভ কাজের আগে চারদিকটা ভাল করে জরিপ করে নিতে হয়। কোথা থেকে বিপদ আসতে পারে তা আঁচ করতে হয়, পালানোর পথের হদিশ রাখতে হয়, একই মতলবে অন্য কেউ ঘুরঘুর করছে। কিনা সেটাও দেখা দরকার। আটঘাট না বেঁধে হুড়ুম করে কাজে নেমে পড়াটা বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়। ওদিকে মাথার উপর খাঁড়া ঝুলছে, সকালে লাঠি নিয়ে কেল্লায় হাজির হতে না পারলে তার বাড়িতে গ্যানা আগুন দেবে। তবে কিনা গ্যানার গায়ের জোর থাকলেও বুদ্ধিটা বড়ই রোগাভোগা। ওই জাদুই লাঠি হাতে এলে নিমাই দরবারে হাজির হবে বটে, তবে অন্য চেহারায়। সব আগেভাগে ভেবে রেখেছে সে। লাঠি উদ্ধার হলে আরও কত কী যে করা যাবে তার লেখাজোখা নেই। ওর জোরে গোটা পরগনাই তার ট্যাঁকে এসে গেল আর কী। মুরুব্বি মাতব্বরেরা দোবেলা সেলাম দেবে। সেলামিও আসবে হাসতে হাসতে। টাকা গোনার জন্য তোক রাখতে হবে। গগনদারোগা একবার তাকে সাতপুরার বিরু মণ্ডলের গোরু চুরির জন্য সাত হাত নাকখত দিইয়েছিল। রাগটা পুষে রেখেছে সে। এবার গগনদারোগা এসে রোজ সন্ধেবেলা তার পা টিপে দেবে। এই সব ভেবে-ভেবে আপনা থেকেই তার ঠোঁটে একটু আহ্লাদের হাসি ফুটে উঠছিল মাঝে মাঝে।
আচমকা কোমরে একটা কনুইয়ের খোঁচা খেয়ে আঁতকে উঠল নিমাই। চেয়ে দ্যাখে, যে লোকটা রাস্তা থেকে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল সেই লোকটা। বড় বড় চোখে ভারী অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে লোকটা বলল, “তুমি এখানে বসে আছ যে বড়? তুমি না নবীনের ভগ্নীপোত! বাড়ির জামাই! মস্ত কুটুম! তোমার ঠাই কি এখানে হে! যাও, ভিতর বাড়িতে যাও! বাড়ির কেউ দেখে ফেললে যে বড্ড লজ্জার ব্যাপার হবে হে!”
নিমাই অপ্রস্তুত হয়ে সেঁতো হাসি হেসে বলল, “ভিতর বাড়িতে গেলে শাশুড়িঠাকরুন বড় আতান্তরে পড়ে যাবেন যে! কানাঘুষো শুনলুম, আজ নাকি বাড়িতে চুনো মাছ রান্না হয়েছে। জামাইকে তো আর চুনো মাছ দিয়ে ভাত বেড়ে দেওয়া যায় না! শীতের রাতে হয়তো আবার পুকুরে জাল ফেলতে হবে! তারপর ধরুন, মাছের আগেও তো কিছু দিতে হয় পাতে। সোনামুগের ডাল, কি পোরের ভাজা, কি পোস্তচচ্চড়ি, কি মুড়িঘণ্ট। শেষ পাতে একটু পায়েসটায়েস। না, না, এত রাতে ভিতরে গিয়ে তাদের বিব্রত করা ঠিক হবে না।”
লোকটা উত্তেজিত হয়ে বলল, “তুমি তো আচ্ছা আহাম্মক! বাপু হে, শ্বশুরবাড়ি ছাড়া আমাদের মতো মনিষ্যির কোথাও কোনও দাম আছে? আর সব জায়গায় ঘাড়ধাক্কা খেলেও শ্বশুরবাড়িতে আমরা রাজাগজা। এই তো গেল হপ্তায় রাত বারোটায় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলুম। শাশুড়িঠাকরুন গায়ে একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে উঠেও পোলোয়া রান্না করে খাওয়ালেন। বোকার মতো বসে থেকো তো! ওঠো, ওঠো, বুক চিতিয়ে বীরের মতো ভিতর বাড়িতে ঢুকে যাও…”
আশপাশের লোক কথাবার্তা শুনে তাকাচ্ছে দেখে নিমাই প্রমাদ গুনে উঠে পড়ল। কাচুমাচু হয়ে বলল, “যাচ্ছি মশাই, যাচ্ছি। এই রাতে গুরুপাক খাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।”
লোকটা খিঁচিয়ে উঠে বলল, “গুরুপাক! গুরুপাক আবার কী? পেট ঠেসে খাওয়ার পর হরিপুরের একঘটি জল খেয়ে নেবে। পাথর অবধি হজম। বলো তো আমিই তোমাকে সঙ্গে করে অন্দরমহলে পৌঁছে দিয়ে আসছি!”
নিমাই আঁতকে উঠে বলল, “না না, তার দরকার নেই। এ বাড়ির অন্ধিসন্ধি আমার জানা। ছেলেবেলা থেকেই যাতায়াত কিনা!”
“কীরকম, ছেলেবেলা থেকেই যাতায়াত কীরকম? তোমাদের কি বাল্যবিবাহ হয়েছিল নাকি?”
ফাঁপরে পড়ে নিমাই তাড়াতাড়ি বলল, “অনেকটা ওরকমই বটে। আচ্ছা মশাই, আসি গিয়ে তবে!”
বাইরের রাস্তায় এসে নিমাই একটু দাঁড়ায়। কাজটা যে খুব সহজ হবে না তা সে বুঝতে পারছে, একটা বিড়ি ধরাবে কি না ভাবতে ভাবতে সর্বে পকেটে হাত ভরেছে অমনই পিঠে একটা শক্ত খোঁচা খেয়ে বাপ রে’ বলে ঘুরে তাকায় নিমাই। যা দেখল তাতে রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার কথা। সামনে দাঁড়িয়ে পানুবাবু। হাতে রুপো বাঁধানো ছড়ি।
পানুবাবুর পরনে কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, চুলে টেরি, গায়ে দামি শাল, গলায় কম্ফটার। এখন শীতকাল বলে হাঁটু অবধি মোজা আর পাম্পশু। ডান আর বাঁ হাতে গোটা কয়েক হিরে, চুনি, পান্নার আংটি ঝকমক করছে।
পানুবাবু ভারী মোলায়েম গলায় বললেন, “সুবিধে হল না বুঝি?”
তটস্থ হয়ে নিমাই হাতজোড় করে বলে, “পানুবাবু যে! পেন্নাম হই! কীসের সুবিধের কথা বলছেন আজ্ঞে? এ জন্মে আর সুবিধে হল কোথায় বলুন। সব তাতেই কেবল অসুবিধে, সুবিধের মুখ আর ইহজন্মে দেখা হল না। তা আপনি এখানে? ইদিকে কাজ ছিল বুঝি?”
পানুবাবু জরদা-পানের পিক ফেলে বললেন, “তা কাজ আছে বই কী। কিন্তু তার আগে জানা দরকার তুই এখানে কী মতলবে ঘুরঘুর করছিস!”
নিমাই মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, মতলব কিছু নেই। ওই লাঠি নিয়ে কী সব গালগল্প কানে এল, তাই ভাবলুম যাই, গিয়ে একটু দেখে আসি৷”
ভারী মোলায়েম আর মিঠে গলায় পানুবাবু বললেন, “কিন্তু আমার কাছে যে অন্য রকম খবর আছে রে নিমাই! ঘণ্টাতিনেক আগে যে তোকে ওই লাঠিখানা কাঁধে নিয়ে নবীনের সঙ্গে ভুরফুনের মাঠে দেখা গেছে!”
নিমাই সিঁটিয়ে গিয়েও ভারী অবাক হওয়ার ভাব করে বলল, “আমাকে দেখা গেছে! ভারী আশ্চয্যি ব্যাপার তো! কিন্তু আমারই
তো চোখে পড়েনি! ভুল খবর নয় তো পানুবাবু!”
মিষ্টি হেসে পানুবাবু বললেন, “না হে নিমাই, খবর বড় পাকা।”
“তা আপনি যখন বলছেন তখন বোধ হয় তাই হবে।”
ছড়িটা তুলে আচমকা তার পেটে একটা রামখোঁচা দিয়ে পানুবাবু বললেন, “আসল কথাটা কি এবার পেট থেকে বের করবি?”
আঁক করে দু’হাতে পেটটা চেপে ধরে নিমাই বলল, “আজ্ঞে, বলছি, বলছি! ওই নবীন ছোঁকরার সঙ্গে আজই গঞ্জে আলাপ হল কিনা! হাতে লাঠি দেখে দু-চারটে কথা কইলুম। আমি সনাতন ওস্তাদের চেলা শুনে ছোঁকরা আমার কাছে তালিম নিতে চাইল।”
পানুবাবু হোহো করে হেসে বললেন, “বটে! তুই সনাতন ওস্তাদের কাছে লাঠি শিখেছিস বুঝি! কিন্তু আমার কাছে যে অন্যরকম খবর আছে রে নিমাই! তুই সনাতনের কাছে নাড়া বেঁধেছিলি বটে, কিন্তু মাসখানেক বাদেই তার ঘটিবাটি চুরি করে পালাস। তুই তো ছিচকে চোর, লেঠেল হলি কবে?”
নিমাই কোণঠাসা হয়ে ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে, ইচ্ছে তো ছিল খুব। বড় লেঠেল হব, তা পেটের দায়ে হয়ে উঠল না আজ্ঞে।”
“দ্যাখ, মিথ্যে কথা বলাটাও একটা আর্ট। বাল্মীকি, বেদব্যাস থেকে রবি ঠাকুর অবধি কে না সাজিয়ে-গুছিয়ে মিথ্যে কথা লিখে গেছে! কিন্তু সেসব লোকে মাথায় ঠেকিয়ে পড়ে। আর তুই দাঁত কেলিয়ে যেগুলো বলিস, সেগুলো ছুঁলে চান করতে হয়। বুঝলি!”
ঘাড় হেলিয়ে নিমাই বলল, “যে আজ্ঞে।”
“তবে তোকে আমার দরকার। একজন পাকা চোর না হলে কাজটা উদ্ধার হবে না। ওই লাঠিখানা আমার চাই।”
ভারী ভালমানুষের মতো চোখ বড় বড় করে চেয়ে নিমাই বলে, “সেকী পানুবাবু, সামান্য একখানা বাঁশের লাঠির জন্য আপনিও উতলা হলেন? ওসব গপ্পো বিশ্বাস করেন নাকি?”
পানুবাবু ঠান্ডা চোখে চেয়ে বললেন, “তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুইও করিস! করিস না?”
ঘাড়টাড় চুলকে নিমাই বলে, “কী যে বলেন পানুবাবু!”
“দ্যাখ, বোকা আর আহাম্মকেরা ভাবে আমার বুঝি দুটো মাত্র চোখ। বাইরে থেকে দেখলে চোখ আমার দুটোই বটে, কিন্তু যারা জানে তারা জানে যে, আমার হাজারটা চোখ চারদিকে ঘুরছে।”
সঙ্গে সঙ্গে একমত হয়ে নিমাই বলল, “তা বটে।”
“লাঠির গপ্পো যদি সত্যিই না হবে তা হলে পুরনো কেল্লায় যে গ্যানার দলের ষণ্ডা-গুন্ডারা হাতে-পায়ে-মাথায় কাঁকালে লাঠির চোট নিয়ে সব কেঁদেককিয়ে-ঘেঙিয়ে একশা হচ্ছে, তাদের ও দশা করল কে? তোর আর নবীনের মতো দুটো আনাড়ি?”
খুব চিন্তিত মুখ করে নিমাই বলে, “আজ্ঞে, তাও তো বটে! কথাটা ভেবে দেখার মতোই মনে হচ্ছে।”
পানুবাবু ফের একটা রামখোঁচা দেওয়ার জন্য ছড়িখানা তুলতেই নিমাই এক লাফে খানিক পিছিয়ে এসে একগাল হেসে বলল, “কোনওদিন কি আপনার আদেশ অমান্য করেছি পানুবাবু? জলে বাস করে কি কুমিরের সঙ্গে বিসংবাদ চলে? তা ছাড়া আমি ঝামেলা ঝাট, রক্তারক্তির মধ্যে নেইও।”
“আজ রাতেই মালটা সাফ করা চাই।”
ঘাড় চুলকে ভারী লাজুক গলায় নিমাই বলে, “যে আজ্ঞে, তা কীরকম কমিশন দেবেন পানুবাবু?”
“কমিশন ভালই পাবি রে, খুব ভাল। দুনিয়ায় সবচেয়ে দামি জিনিস কী জানিস?”
গদগদ হয়ে নিমাই বলে, “তা আর জানি না! হিরে বলুন, জহরত বলুন, সোনাদানা বলুন, তারপর শাল দোশাল বলুন, কস্তাপেড়ে শাড়ি কি ফরাসডাঙার ধুতি বলুন, তারপর গলদাচিংড়ি কি পাঁঠার মাংস বলুন কোনটা দামি নয়? এমনকী মুড়ির দামও তো ঠেলে উঠছে!”
পানুবাবু মিটিমিটি হেসে বললেন, “তার চেয়েও ঢের দামি জিনিস আছে রে। গোটা একটা রাজ্য দিলেও তার দাম হয় না, সেটা হল মানুষের প্রাণ। তোকে যে প্রাণে মারব না সেটা কি কম বকশিশ হল নাকি রে বেল্লিক?”
ভারী আপ্যায়িত হয়ে নিমাই বলল, “তা বটে, প্রাণের চেয়ে দামি আর কী-ই বা আছে! তবে কিনা ওই সঙ্গে ফাউ হিসেবেও যদি কিছু পাওয়া যেত!”
“সে আমি ভেবে রেখেছি। জিনিসটা উদ্ধার করতে পারলে তোকে আমার দলে নিয়ে নেব। আমার হয়ে গঞ্জের বাজারে আর হাটবারে তোলা আদায় করবি। কুড়ি পারসেন্ট বাঁধা কমিশন। দু’দিনেই লাল হয়ে যাবি।”
নিমাই মনে মনে ঠিক করে ফেলল, লাঠিটা হাতে আসার পর এই পানুবাবুকে দিয়ে সে দু’বেলা এঁটো বাসন মাজাবে আর ঘরদোর ঝটপাট দেওয়াবে। মাথা ঝাঁকিয়ে হাতজোড় করে সে বলল, “আজ্ঞে, এ তো হাতে চাঁদ পাওয়ার শামিল। কতকাল ধরে ইচ্ছে, আপনার সেবায় একটু লাগি। তা হলে আজ বিদেয় হই পানুবাবু!”
“মনে থাকে যেন!” হাতে এখন অনেক কাজ। মাথা খাটানো, ফন্দিফিকির বের করা, কার্যোদ্ধার করা। সুতরাং নিরিবিলিতে বসে একটু ভাবা দরকার।
রাস্তার ওপাশে একটা ঝুপসি বটগাছ। তলায় জম্পেশ অন্ধকার। নিমাই গুটিগুটি গিয়ে অন্ধকারে সেঁধিয়ে জুত করে বসে পড়ল। তিন চারটে ফিকির আছে হাতে। কোনটা কাজে লাগানো যায় সেইটেই ভেবে ঠিক করতে হবে।
আচমকাই পিঠে গদাম করে কী একটা ভারী জিনিস এসে পড়তেই বাপ রে’ বলে উপুড় হয়ে পড়ল নিমাই। সামলে ওঠার আগেই একটা ভারী গলা চাপা স্বরে বলল, “ওই পানু ব্যাটা কত দর দিল রে?”
নিমাই ধীরে ধীরে উঠে বসল। পিছনে মস্ত একখানা পেতলে বাঁধানোমোটা ভারী লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে হিরু গায়েন। চারটে খুন, গোটা ছয়েক ডাকাতির মামলায় তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। এই হিরু গায়েনের জন্যই হয়রান হয়ে-হয়ে গগনদারোগার ওজন বারো কেজি কমে গেছে, রাতে ঘুম নেই, খাওয়ায় অরুচি, গোবিন্দচরণ দাস বাবাজির কাছে বোষ্টম মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে ফোঁটা-তিলক কষ্ঠী ধারণ করেছে, তবু শান্তি পায়নি।
নিমাইয়ের বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করতে লেগেছে। তবে সেটা চেপে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “হিরুদাদা না? আহা, চেহারাটা যে একেবারে আদ্দেক হয়ে গেছে! তা শরীর-গতিক সব ভাল তো! আমরা তো ভেবে ভেবেই মরি, আমাদের আদরের হিরুদাদার হলটা কী? দেখা-সাক্ষাৎ পাই না মোটে!”
চার হাত লম্বা, দুই হাত চওড়া, পাথরে কোঁদা দানবের মতো চেহারার হিরু গায়েন দু’খানা জ্বলজ্বলে চোখে তাকে ফুটো করে দিয়ে বলল, “লাঠির জন্য পানু কত দর দিল?”
মলিন মুখে মাথা নেড়ে নিমাই বলল, “পানুবাবুর হাত মোটেই দরাজ নয়। মুঠো আলগা করতেই চান না। সামান্য দু’লাখ টাকা দিতে চেয়েছেন। আমি চাপাচাপি করায় টেনেমেনে আড়াই লাখে উঠেছেন। আমি তবু গাঁইগুঁই করায় বলেছেন, আরও কিছু দেবেন।”
হিরু তার নাগরা-পরা ডান পা-টা তুলে নিমাইয়ের কাঁকালে ছোট্ট একটা লাথি কষিয়ে বলল, “লাখ টাকা কখনও চোখে দেখেছিস? দিলে গুনে উঠতে পারবি?”
নিমাই কোঁক শব্দ করে ছিটকে গিয়েছিল। মাজা চেপে ধরে উঠে বসে হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “সেটাই তো সমস্যা। না হিরুদাদা, লাখ টাকা গুনতে গেলে নির্ঘাত মাথা গুলিয়ে যাবে। আমিও সেই কথাই বলছিলুম পানুবাবুকে, অত টাকার দরকার কী? দু-পাঁচ টাকা কম হলেও হয়। আর তেমন-তেমন লোক হলে আরও দশ-বিশ হাজার কমেই করে দেব না হয়! এই আপনিই যদি ভালবেসে বলেন, ‘ওরে নিমাই, লাঠিটা এনে দে, তা হলে কি আমি দর কষতে বসব? আপনজনদের সঙ্গে কি দরকষাকষি চলে?”
হিরু গম্ভীর মুখে বলল, “না, চলে না। দর কষলে তোর মতো আপনজনদের জন্য আমার অন্য ব্যবস্থা আছে। মাজারের পিছনে মজা পুকুরটা চিনিস? সেখানে জল নেই, দশ হাত গভীর থকথকে কাদা। তোকে যদি হেঁটমুন্ডু করে মজা পুকুরে ফেলে দিই, একশো বছরে তোর লাশ কেউ খুঁজে পাবে না তা জানিস?”
ফ্যালফ্যালে হাসি হেসে নিমাই মাখো-মাখো গলায় বলে, “আরে না, না, ছিঃ ছিঃ, এত মেহনত করতে যাবেন কেন? ধকলটাও তত কম যাবে না। নিজের শরীর-গতিকের কথাও তো মনে রাখতে হবে! আপনার দায়িত্ব কি কম? বিশ-পঁচিশটা গাঁয়ের প্রজাপালন আছে, ন্যায়বিচার আছে, এর-ওর-তার তবিল ফাঁক করা আছে, কী খাটুনিটাই যায় আপনার!”
“থাবড়া না খেলে কি মুখ বন্ধ হবে না তোর?”
“উচিত কথাই বলছি। আমরা বলব না তো কি গগনদারোগা বলবে?”
রক্ত-জল করা এক চাউনিতে নিমাই চুপ মেরে গেল। হিরু তেমনই চাপা গলায় বলল, “ও লাঠি আমার চাই, বুঝলি?”
একগাল হেসে নিমাই বলল, “ও তো আপনারই লাঠি! একটা হাঁকাড় ছাড়লেই লোকজন ইঁদুরের মতো পালানোর পথ পাবে না। হাসতে হাসতে গিয়ে তুলে নিন। তারপর লাঠি দোলাতে দোলাতে হেলেদুলে চলে যান। কোথাও আটকাবে না।”
হিরু গর্জন ছেড়ে বলে, “কখনও শুনেছিস, হিরু গায়েন ছ্যাঁচড়ার মতো ছোটখাটো চুরি বাটপাড়ি করেছে কোথাও?”
নিমাই ফের কানে হাত দিয়ে বলে, “কক্ষনও নয়।”
“ওসব তোদের মতো ছুঁচোর কাজ। লাঠিটা আজ রাতেই গোবিন্দপুরের কানু পালের পোড়োবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবি। সেখানে আমার লোক থাকবে।”
নিমাই এতক্ষণ ধরে মনে মনে ভাবছিল লাঠি হাতে পেলে সে হিরু গায়েনকে দিয়ে কী করাবে। এ লোককে বেশি কাছে ঘেঁষতে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবে বাড়ির দরোয়ান করে রাখা যেতে পারে। সে মাথা হেলিয়ে বলল, “এসব ছোটখাটো কাজ আপনাকে মানায়ও না। আপনি বড় বড় কাজগুলো দেখুন, ছোটখাটো কাজ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, ওসব আমিই সামলে দেব। তবে হিরুদাদা, এই গরিবের কথাটাও মনে রাখবেন একটু। বেঁচেবর্তে থাকতে আমাদেরও তো একটু সাধ হয় কিনা। পেটটা চলা চাই তো?”
“হ্যাঁ, তবে তার আগে শ্বাসটাও চালু রাখতে হবে তো। লাঠি না পেলে তোর শ্বাসও কিন্তু চলবে না।”
“যে আজ্ঞে। বুঝেছি।”
অন্ধকারে হিরু গায়েন ফট করে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পিঠে হিরুর ভারী লাঠির খোঁচা আর কোমরে হিরুর নাগরার লাথি একটু কাহিল করে ফেলেছে তাকে। তবে কি নিমাইয়ের সবই সয়। একটু কেতরে সে উঠে দাঁড়াল। হাতে মেলা কাজ। লাঠির উমেদার যে হারে সংখ্যায় বেড়ে চলেছে তাতে তাড়াতাড়ি বাগাতে না পারলে বেহাত হতে কতক্ষণ! উঁকি মেরে সে দেখল, এখনও নবীনদের বাড়িতে মেলা ভিড়। গোটাচারেক হ্যাজাক জ্বালানো হয়েছে। কে যেন হেঁড়ে গলায় লাঠির মহিমা বিষয়ে একটা বক্তৃতাও দিচ্ছে। নিমাই কান পেতে শুনল, হেঁড়ে গলাটা বলছে, “ভাইসব, বন্ধুগণ, মা ও বোনেরা, লাঠিই বাঙালির সনাতন ঐতিহ্য, লাঠিই আমাদের পুরনো বন্ধু এবং পরমাত্মীয়ও বটে। যেদিন থেকে লাঠিকে অবজ্ঞা করে বাঙালি বোমা বন্দুক ধরেছে সেদিন থেকেই বাঙালির অধঃপতন শুরু হয়েছে। ভেবে দেখুন সাপ মারতে, বেড়াল তাড়াতে, চোরকে ভয় দেখাতে লাঠি চিরকাল কী উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে এসেছে। এই লাঠি ল্যাংড়া মানুষের ঠ্যাঙের ভূমিকা নেয়, বুড়ো মানুষদের কমজোরি হাঁটুকে সাহায্য করে, লাঠিধারী সেপাইকে আজও মানুষ সমীহ করে। লাঠির সনাতন ঐতিহ্যকে যে আবার ফিরিয়ে আনা দরকার তা নবীনের এই আশ্চর্য লাঠিই প্রমাণ করেছে। ভাইসব, আমি স্থির করেছি আগামী নির্বাচনে আমাদের দলের নির্বাচনী প্রতীক হবে লাঠি। জানি না নির্বাচন কমিশনে লাঠি প্রতীক চিহ্ন আছে কি না, তবে আমার রচনা প্রবেশিকা বইয়ে এবার লাঠি নিয়ে একটা জ্বালাময়ী রচনা আমি ঢুকিয়ে দেব। আপনাদের কাছে নতুন করে রচনা প্রবেশিকার কথা বলার দরকার নেই। আপনারা সকলেই জানেন, রচনা প্রবেশিকা পড়ে ছাত্ররা রচনায় কুড়ির মধ্যে আঠারো-উনিশ নম্বর পর্যন্ত পেয়ে থাকে। গরিব ছাত্রদের কথা ভেবে আমরা রচনা প্রবেশিকার মূল্য এবার আরও কমিয়ে বত্রিশ টাকা করেছি। ভেবে দেখুন, বর্ধিত কলেবরের এই বইটি আরও সুলভে পাওয়ায় কত লাভ হচ্ছে আপনাদের। তাই বন্ধুগণ…”
লোকটা আরও যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সভায় একটা শোরগোল ওঠায় চুপ মেরে গেল।
ভিড়টা একটু পাতলা না হলে লাঠিটা সরানোর ফাঁক পাওয়া যাবে । নিমাই তাই ঘাঁতঘোঁত দেখে রাখার জন্য পা বাড়াল।
কিন্তু আবার বাধা পড়ল, পিঠে একটা শক্ত জিনিসের শক্ত খোঁচার সঙ্গে একটা পিলে-চমকানো গলা, “হ্যান্ডস আপ! হাত তোলো৷”।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিমাই বলল, “আজ আমার পিঠের উপর বড় ধকল যাচ্ছে যে দারোগাবাবু!”
একটা ব্যঙ্গের হাসি হেসে গগনদারোগা বলে, “তা হলে তোর পিঠটা একটা পীঠস্থান হয়ে উঠল নাকি রে নিমাই?”
“সে আর কবেন না। তা আপনি ভাল আছেন তো! পেন্নাম হই।”
“বাঃ বাঃ! সহবত তো বেশ ভাল রপ্ত করেছিস দেখছি!”
“আপনাকে ভক্তিছেদ্দা জানাব না তো কাকে জানাব বলুন! আপনি হলেন তল্লাটের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, গুরুজন, পিতৃতুল্য। দেখলেই মাথা আপনা থেকেই হেঁট হয়ে আসে।”
“বাঃ বাঃ! আর-একটু বল তো শুনি!”
“পিস্তলটা খাপে ভরে ফেলুন দারোগাবাবু। আমাদের মতো মনিষিদের জন্য আর পিস্তলকে লজ্জা দেওয়া কেন? অন্তরটার তো একটা মানসম্মান আছে?”
টেকো এবং গোলগাল চেহারার গগনদারোগা পিস্তলটা খাপে ভরে বলে, “এবার বল তো, বটতলার অন্ধকারে বসে কার সঙ্গে শলাপরামর্শ করলি এতক্ষণ!”
নিমাই হেসে একেবারে কুটিপাটি হয়ে বলে, “শলাপরামর্শ! কী যে বলেন দারোগাবাবু, শলাই বা কীসের আর পরামর্শই বা কাকে দেব! আমাকে কথা কইতে শুনেছেন বুঝি! ওই একটা রোগ হয়েছে আমার এই বুড়ো বয়সে। একা-একাই কথা কই। আমার বউও প্রায়ই বলে, ওগো, তুমি যে একা-একা কথা কও, এ তো ভাল লক্ষণ নয়! মাথার দোষ না হয়ে যায়!..”
গগন অবাক হয়ে বলে, “বউ! তোর আবার বউ কোথায়? তুই তো বিয়েই করিসনি!”
ভারী সংকুচিত হয়ে লাজুক হেসে নিমাই বলে, “আজ্ঞে গত অগ্রহায়ণেই করলুম।”
“দ্যাখ নিমাই, তোর নাড়িনক্ষত্র আমি জানি। গত অগ্রহায়ণে তো তুই চুরির দায়ে জেল খাটছিলি?”
জিভ কেটে নিমাই বলে, “ইস, ছিঃ ছিঃ! তাই তো! গত অগ্রহায়ণে নয় তবে! তা হলে বোধ হয় শ্রাবণেই হবে। ঠিক তারিখটা পেটে আসছে, মুখে আসছে না।”
গগন হেসে বলল, “না, শ্রাবণেও নয়, ইহজন্মেও নয়। তোর জন্য ভগবান বউয়ের বরাদ্দই রাখেননি। তিনি বিবেচক মানুষ তো!”
মাথাটাথা চুলকে নিমাই ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আজ্ঞে, কেন যেন মনে হচ্ছিল বিয়েটা যেন করেছিলুম। তা মনের ভুলও হতে পারে। ভীমরতিই হল নাকি কে জানে!”
“বালাই ষাট! ভীমরতি তোর শত্তুরের হোক। বিয়াল্লিশ বছর বয়সে তোর ভীমরতি হবে কোন দুঃখে? তা লোকটা কে?”
“আজ্ঞে কার কথা বলছেন?”
“বটতলার অন্ধকারে যার সঙ্গে ফিসফাস করছিলি!”
বড় বড় চোখে চেয়ে তাড়াতাড়ি জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে নিমাই। বলে, “লোক! বড়বাবু, লোক কাকে বলছেন? নমস্য ব্যক্তি, হ্যাঁ বটে, একসময়ে এই আমার-আপনার মতোই মানুষ ছিলেন বটে, তবে গত তিনশো বছর বায়ুভূত হয়ে আছেন। অসুবিধে কিছু নেই। ওই বটগাছের উপরেই দিব্যি ঘরসংসার। দাস-দাসী, পরিবার ছেলেপুলে নিয়ে জাঁকিয়ে আছেন। তা আমাকে দেখে নেমে এসেছিলেন আর কী। এই বলছিলেন, “ওরে নিমাই, অনেকদিন বাদে এলি যে বাপ! কতকাল তোর দেখা নেই?’তারপর একটু সুখ-দুঃখের কথাও হচ্ছিল। সেইটেই আপনি শুনে থাকবেন।”
গগন হেসে বলে, “উপন্যাস লিখলে নাম করে ফেলতিস রে! তা সাব ইনস্পেক্টর কালোবরণ দাসকে মনে আছে? কেমন সুন্দর মারে। বল! রুল দিয়ে এমন এমন জায়গায় ঘা দেয় যে, ব্রহ্মর অবধি ঝংকার তোলে, কিন্তু গায়ে কোথাও মারের দাগটি খুঁজে পাওয়া যায় লো। কালোবরণকে ভুলে গেলি নাকি রে নিমাই? ভুলে গিয়ে থাকলে বল, আজ রাতেই তোকে থানায় নিয়ে গিয়ে পুরনো কথা একটু ঝালাই করে দিই।”
নিমাই তটস্থ হয়ে বলে, “সে কী কথা! কালোবাবুকে ভুলে যাব আমি কি তেমন নিমকহারাম বড়বাবু? তিনি প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ। ঘরে-ঘরে ঠাকুরদেবতার ছবির পাশে তাঁর ছবিও রাখা উচিত। অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই, তাই ভেবেছিলুম কালোবাবু বোধ হয় বদলি হয়ে গেছেন!”
“তাই যেতেন। তবে তোর মায়াতেই বোধ হয় এখনও আটকে আছেন। তা লোকটা কে এবার ভালয়-ভালয় বলে দে বাপু! জানিস ূধ, আমার মোটে খিদে সহ্য হয় না। আজ গোবিন্দপুরের তেজেন তপাদারের মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন যে রে! গলদাচিংড়ি হয়েছে শুনেছি। শুনে অবধি খিদে চাগাড় মারছে। আর খিদে পেলে আমার মাথায় যে খুন চাপে এটা কে না জানে বল!”
নিমাই বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে, “তা খিদের দোষটাই বা কী বলুন বড়বাবু! সারা পরগনায় আপনাকে কম দৌড়ঝাঁপ করাচ্ছে ওই হিরু গায়েন! শরীরে এক ছটাক মায়াদয়া থাকলে আপনার এই হয়রানি দেখে কবেই ধরা দিয়ে ফেলত! আমরা হলে তো তাই করতুম। ওরে বাপু, সরকার তো আর তোর পর নয়। দেশসুদ্ধ লোককে খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে, আবদার রাখছে, মায়ের মতোই তো! থানা তো মায়েরই কোল। কিছু খারাপ জায়গাও নয়। কম্বল আছে, দোবেলা দু’থালা ভাত আছে, অসুখ হলে চিকিৎসা আছে, মাথার উপর বাবার মতো বড়বাবু আছেন। ধরা দিতে লজ্জাটা কীসের, ভয়ই বা কী?”
সচকিত গগনদারোগা পিস্তলের খাপে হাত রেখে বলল, “ওঃ, তা হলে লোকটা হিরু গায়েন!”
নিমাই হাতজোড় করে বলল, “অন্ধকারে ঠিক দেখেছি কিনা তা কে জানে বলুন। তবে হাতচারেক লম্বা, দু’হাতের মতো চওড়া পাথুরে চেহারা। হাতে পেতলে বাঁধানো লাঠি।”
দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে গগন বলে, “কী বলছিল শয়তানটা?”
“আজ্ঞে, সে কি আর ভাল শুনেছি, গেলবার বাঁ কান ঘেঁষে কালোবাবু যে থাপ্পড়টা মেরেছিলেন, তারপর থেকেই কানে বড্ড কম শুনছি। হাবেভাবে মনে হল যেন আপনাকেই খুঁজছেন।”
“আমাকে! আমাকে তার কী দরকার? আমিই তো খুঁজছি তাকে!”
“কী যেন বলছিলেন। গোবিন্দপুরে গেনু পালের পোড়োবাড়িতেই। বোধ হয় আস্তানা গাড়বেন আজ। তা আপনিও তো গোবিন্দপুরেই ভোজ খেতে যাবেন। বড়বাবু! বড্ড ভয় হচ্ছে, একটা রক্তারক্তি না হয়ে যায়। তাঁর মতলবটা ভাল বলে মনে হল না। আপনার ভাল-মন্দ কিছু হয়ে গেলে যে আমরা অনাথ হয়ে যাব! গোটা পরগনা পিতৃহীন হবে।”
শেষটা আর শুনতে পেল না গগন, “তবে রে,” বলে ছুটে বেরিয়ে গেল।
নিমাই হাঁফ ছাড়ল। খুচরো ঝামেলায় কাজের বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। এদিক-ওদিক চেয়ে ভাল করে দেখে নিল সে। নবীনদের বাড়িতে বক্তৃতা শেষ হয়েছে। লোকজন যে-যার বাড়ি ফিরছে। চারদিকে একটা আলগা অসাবধানি ভাব। রাস্তাটা পেরিয়ে সেনবীনের বাড়ির পিছন দিকটায় খড়ের গাদার পিছনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরাল। তার দেশলাইয়ের কাঠিটা না নিভিয়ে খুব যত্ন করে গাদায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে একটু সরে এল। শীতকালের শুকনো বাতাসে আগুনটা ধরেছে বেশ দাউদাউ করে। শিখাটা উপর দিকে উঠলেই কাজ।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই চারদিক থেকে চিৎকার উঠল, “আগুন! আগুন!”
গায়ে আগুন লাগলে এই উত্তুরে বাতাসে সারা গায়েই ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই গা বাঁচাতে হাঁড়ি, কলসি, ঘটি-বাটিতে জল নিয়ে সব লোক ছুটে এল। লাঠিটার কথা কারও খেয়ালই রইল না।
আড়াল থেকে মওকা বুঝে শিয়ালের মতো ছুটে এসে লাঠিটা তুলে বাগানে ঢুকে পড়ল নিমাই। তারপর পিছনের বেড়া ডিঙিয়ে কাঁচা নালাটা পার হয়ে ভুরফুনের মাঠ বরাবর হাটা দিল। না, আর ভয় নেই। মন্ত্রপূত লাঠিখানা হাতে এসে গেছে। এখন সে পরগনার রাজা। আর শিয়ালের মতো ভয়েভয়ে থাকতে হবে না। লাঠির দাপটে টাকাপয়সার লেখাজোখাও থাকবে না তার। ছিচকে চোরের কি কোনও সম্মান আছে সমাজে? গ্যানা বা হিরু গায়েন পথে বেরোলে কেমন মানুষেরা পথ ছেড়ে দেয়। হাতজোড় করে নমস্কারও করে। ‘হেঁ-হেঁ’ করে কত খাতির দেখায়। দোকানদাররা সওদার পয়সা তো নেয়ই না, বরং উলটে দশ-বিশ টাকা প্রণামী দেয়! লাঠির জোরে সে অবশ্য ওদেরও ছাড়িয়ে যাবে। এখন যেমন এ কিলোয়, ও গুতোয়, সে চোখ রাঙায়, তেমনটি আর হচ্ছে না বাবা!
দূর থেকে নবীনদের বাড়ির আগুনটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল নিমাই। একটু অবাক হল। যতটা লকলক করে উঠে ছড়িয়ে পড়ার কথা ততটা ছড়ায়নি তো! আগুনটা যেন নিবু নিবু! আগুন নিভে গেলেই লোকের খেয়াল হবে যে, লাঠিটা গায়েব। ধাওয়াও করবে বোধ হয় তাকে। তা করুক। এ লাঠি হাতে থাকতে মিলিটারিকেও পরোয়া নেই।
লাঠি কাঁধে নিয়ে বুক চিতিয়ে হাঁটতে লাগল নিমাই।