আবার শুরু হল নোভাকের অরণ্যযাত্রা।
অন্যান্য বারের মতো এবারও তার খুব কষ্ট হতে লাগল।
আসন্ন বর্ষার ইঙ্গিত বহন করে ছুটে আসে কালো মেঘে, যখন তখন প্রবল বর্ষণে নোভাকের সর্বাঙ্গ হয়ে যায় জলসিক্ত।
জুতোর চামড়ায় জল শুষে শুষে চামড়া হয়ে উঠল শক্ত, তার পায়ে পড়ল বড়ো বড়ো ফোঁসকা। ফোঁসকাগুলোতে ধুলো লেগে নোভাকের অবস্থা হয়ে উঠল অতিশয় শোচনীয়।
একদিন জলে ভিজে অসুস্থ নোভাক বিশ্রাম নিতে বাধ্য হল। নদীর জলে ভালো করে পা ধুয়ে তাতে ওষুধ লাগিয়ে শুয়ে পড়ল। পা দুটোকে উঁচু করে সে পায়ের উপর গ্রহণ করলে সুর্যরশ্মির উত্তাপ এবং পর পর দুদিন একটুও হাঁটাহাঁটি করলে না। দুদিন বিশ্রাম নেবার পর তার পা ভালো হয়ে গেল। নতুন উদ্যমে শুরু হল তার অভিযান…
২৩ জানুয়ারি।
যাত্রা আরম্ভ করার এক সপ্তাহ পরে সে এসে দাঁড়াল একটা মস্ত নদীর ধারে- ম্যাপ দেখে সে বুঝল এটা কুরারে নদী।
কুরারে নদী চলে গেছে অকাদের আস্তানার ভিতর দিয়ে নোভাক মনে মনে খুব খুশি হয়ে উঠল, তার চেষ্টা অন্তত আংশিক ভাবে সফল হয়েছে।
সে এবার নতুন কায়দায় অনুসন্ধান-পর্ব শুরু করলে।
নদীর ধার দিয়ে বনের ভিতর পর্যন্ত আঁকাবাঁকা ভাবে সে প্রার্থিত বস্তুর সন্ধান করতে লাগল। তার সঙ্গে কম্পাস ছিল, কাজেই দিগভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
দিন দুই পরে হঠাৎ সে ইন্ডিয়ানদের দেখতে পেল।
তেলের সন্ধানে টহল দিতে সে যখন অরণ্যের ভিতর দিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে আসছে তখনই তার দৃষ্টি পথে ধরা দিলে একটি ক্যানো এবং দুজন আরোহী। দুটি লোকই বর্গার সাহায্যে নদী থেকে মাছ ধরছিল। নোভাক ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে পড়ে আত্মগোপন করার চেষ্টা করলে, ক্ষিপ্রহস্তে বন্দুকে টোটা ভরে সে প্রস্তুত হল যুদ্ধের জন্য।
নৌকাটা নদীর বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল– সম্ভবত আরোহীদের দৃষ্টি ঘাস জঙ্গলের মধ্যে ভূমি শয্যায় লম্বমান নোভাককে আবিষ্কার করতে পারেনি।
ক্যানোর আরোহীদের দেহের গঠন ও চুল কাটার ধরন দেখে তাদের অকা বলেই মনে হল তবু অতদূর থেকে নোভাক খুব নিশ্চিত ভাবে রেড-ইন্ডিয়ান দুটির জাতি নির্ণয় করতে পারলে না।
সাবধানের মার নেই- অতএব নোভাক হাতের বন্দুক বাগিয়ে মাটির উপরে শুয়ে রইল। প্রায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করার পরেও যখন নদীর জলে কোনো ক্যানো দেখা গেল না তখন সে আবার তেলের সন্ধানে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলে।
সেদিন বিকাল বেলা নোভাক যখন আবার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আর একটা নতুন পথ ধরে নদীর দিকে এগিয়ে আসছে তখন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে একটা ভাঙা এরোপ্লেন বা বিমান-পোত!
বিমানটি নদীর অপর তীরে অকেজো অবস্থায় পড়ে ছিল।
নদী পার হয়ে নোভাক বিমানপোতের পাশে এসে দেখলে যন্ত্রটির অবস্থা নিতান্ত শোচনীয় তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি দারুণ আঘাতে চুরমার হয়ে গেছে অর্থাৎ এককথায় সেটি হচ্ছে একটি বিমানপোতের ভগ্নাবশেষ।
ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নোভাক বুঝলে যে ভারি অস্ত্র দিয়ে বারংবার আঘাত করে যন্ত্রটিকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
নোভাক হঠাৎ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল– ব্যাপারটা কি?
বিমানটি কি হঠাৎ অচল হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়েছে?
বিমান চালকেরই বা পাত্তা নেই কেন?
বিমানের যান্ত্রিক-দেহটাকে কারা এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে? জড় পদার্থের উপর আক্রমণকারীদের এমন আক্রোশের কারণই বা কি হতে পারে?….
বিদ্যুৎঝলকের মতো একটা অশুভ চিন্তা তার মাথায় পাক দিয়ে উঠল, মনে মনে নিজেকেই বার বার অভিশাপ দিতে লাগল নোভাক নদীর ধারে ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ানো তার উচিত হয়নি। অকাদের আক্রমণের কথা তার হঠাৎ মনে পড়ল- জিভারো যোদ্ধাদের উপর ছুটে এসেছিল অকাদের তিরগুলি অরণ্যের আড়াল থেকে, আর সেই অকা-যোদ্ধাদের ডেরার মধ্যেই সে দাঁড়িয়ে আছে। সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায়!
নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই সে মনে মনে গালাগালি দিলে।
কাঁধের বন্দুকটা হাতে নামিয়ে নোভাক ভাঙা বিমানের নীচে আশ্রয় গ্রহণ করলে এবং সেইখানে গুঁড়ি মেরে বসে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগল চারদিকের ঝোঁপ-জঙ্গল।
একটা গাছের উপর ধাতু নির্মিত একটা ছোটো ঘর তার চোখে পড়ল। আর এক জায়গায় সে দেখলে অগ্নিকুণ্ডের ভস্মাবশেষ এছাড়া মানুষের বসবাসের কোনো চিহ্ন তার নজরে ধরা দিলে না।
কিন্তু…হঠাৎ তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল সেই গাছটির নীচে যার উপর ধাতু নির্মিত ঘরটি অবস্থান করছে–
একটা ঢিপি!
হ্যাঁ, একটা টিপি– কিন্তু ঢিপিটাকে দেখলে একটা কবর বলেই সন্দেহ হয়।
নোভাক এগিয়ে এসে টিপিটাকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে। তার সন্দেহ সত্য ঢিপিটা আর কিছু নয়, একটা খুব সাধারণ কবর। নোভাকের মনে নানারকম প্রশ্ন জমা হল– কবরটা কাদের? কয়জন মানুষের প্রাণহীন দেহ শুয়ে আছে এই কবরের মৃত্তিকা-শয্যায়? লোকগুলির সঙ্গে এই বিধ্বস্ত বিমানপোতটির কি কোনো সম্পর্ক আছে?
কবরের আশেপাশে মানুষের পায়ের চিহ্ন দেখা গেল না। ঝড়বৃষ্টি ও সূর্যরশ্মি সব চিহ্নকে করে দিয়েছে লুপ্ত। তবু বারবার নোভাকের মনে হল অকাদের কথা কিছুতেই সে অশুভ চিন্তাটাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলে না!
বিমানটির দুখানা ডানার মধ্যে মাত্র একখানা বর্তমান, সেই একটি মাত্র ডানার ছায়ায় বসে নোভাক চিন্তা করতে লাগল। তার ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা, কিন্তু হাতের বন্দুক রইল তৈরি আর চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠল প্রখর ও তীব্র…।
নোভাক ভাবছে, ভাবছে আর ভাবছে। সে যেন ছুটে চলেছে এক মরীচিৎকার পিছনে এই তৃষ্ণার্ত যাত্রার বুঝি আর শেষ নেই।
অরণ্যের এই অঞ্চলে হানা দিয়ে ফিরছে হিংস্র শ্বাপদ এবং হিংস্রতর মানুষ আর সেই মৃত্যুপুরীর মাঝখানে পদে পদে প্রাণ বিপন্ন করে ঘুরছে নোভাক– কিন্তু কেন?
একটা বন্য মানুষের তৈল-লিপ্ত দেহ এবং গলায় ঝোলানো একখানা বালিপাথরকে নিশানা করে সে এতদূর ছুটে এসেছে আশায় আশায়। আজ দুমাস হল সে তৈলখনির কোনো সন্ধানই পায়নি। ভবিষ্যতে যে পাবে তারই বা নিশ্চয়তা কী?
আর সে তেলের সন্ধান পাওয়ার আগেই যদি রক্ত-পিপাসু অকা-যোদ্ধারা তার সন্ধান পায় তাহলে ঘাড়ের উপর মাথাটাকে সে কি বজায় রাখতে পারবে?
নোভাক ঠিক করলে আর নয় যথেষ্ট হয়েছে, এবার সে সভ্য জগতে ফিরে যাবে মরীচিকা-লুব্ধ পথিকের মতো সে আত্মহত্যা করতে রাজি নয়।
গুঁড়ি মেরে নীচু হয়ে সে বিমানপোতের তলা থেকে বেরিয়ে এল, তার পর সেই অবস্থায় নদীর ধারে ধারে ঘন অরণ্যের ছায়ায় ছায়ায় যথাসম্ভব আত্মগোপন করে সে ছুটে চলল। দারুণ গরমে তার দেহ অবশ হয়ে এল, চোখে নামল ঘুমের আবেশ- কিন্তু নোভাক বিশ্রাম নিতে একটুও থামল না।
এখানে ঘুমিয়ে পড়লে যে কোনো মুহূর্তে সেই নিদ্রা চিরনিদ্রায় পরিণত হতে পারে। খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলল নোভাক…
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়!
নদীটা হঠাৎ যেখানে পাক খেয়ে ঘুরে গেছে ঠিক সেই জায়গায় নোভাক এসে পড়ল তাদেরই কাছে যাদের কবল থেকে পালাবার জন্যে সে এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে!
চারজন অকা নদীর ধারে তির-ধনুক দিয়ে মাছ শিকার করছিল। (রেড-ইন্ডিয়ানরা ধনুর্বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত- জলের মাছকে তারা অনায়াসেই তির দিয়ে বিঁধে ফেলতে পারে) অকাদের ক্যানোটা নদীর ধারে বাঁক ঘুরে ছুটে আসতেই নোভাকের সঙ্গে তাদের চোখাচোখি হয়ে গেল। একজন অকা ধনুকের ছিলা টেনে নদীর জলে শর সন্ধান করছিল– মুহূর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ নির্বিকার ভাবে সে মাছের উপর থেকে নোভাকের উপর নিশানা সরিয়ে নিলে পরক্ষণে শন শন শব্দে ছুটে এসে তিরটা নোভাকের মাথার কাছে একটা গাছের গুঁড়িতে বিধে গেল।
নোভাক পরবর্তী তিরের জন্য অপেক্ষা করলে না, সে চটপট জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দুটো তির তৎক্ষণাৎ তাকে অনুসরণ করলে কিন্তু পলায়মান শিকারের দেহস্পর্শ করতে পারলে না। একটা গাছের আড়াল থেকে নোভাক দেখলে চারজনের মধ্যে তিনজন অকা পাথরের আড়ালে গুঁড়ি মেরে মেরে অরণ্যে প্রবেশ করলে আর একজন রইল ক্যানোর কাছে।
গাছের আড়াল ছেড়ে নোভাক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল।
তার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিল অনেকগুলি লতার বেড়াজাল। সেই ঘন সন্নিবিষ্ট লতার বন্ধন ভেদ করে নোভাক ছুটবার চেষ্টা করলে এবং পরক্ষণেই তার ধীর্ঘ দেহ সশব্দে আছড়ে পড়ল একটা কর্দমাক্ত জলাশয়ের মধ্যে!
কোমর পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে নোভাক নিজের অবস্থা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে চারদিকে কর্দমাক্ত জল, আর সেই ঘোলাটে জলের ভিতর এখানে-ওখানে শিকড়বাকড় তুলে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলি গাছ। বন্দুকটাকে বুক অবধি তুলে ধরলে নোভাক অস্ত্রটা জলে ভিজে অকেজো হয়ে গেলেই সর্বনাশ!…
কাঁধের বোঝাটা তার মাংসপেশীতে কেটে কেটে বসছে।
জলের মধ্যে তার দেহকে আক্রমণ করেছে রক্তপিপাসু জোঁকের দল, আর বোঁ বোঁ শব্দে রণ-সঙ্গীত গাইতে গাইতে তার মাথার উপর উড়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে মশা নোভাকের সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল জোঁক ও মশকের মিলিত আক্রমণে!
এইভাবে পদে পদে মৃত্যু-যাতনা সহ্য করার চাইতে যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া অনেক ভালো- দাঁতে দাঁত দিয়ে নোভাক শত্রুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল…
তারা এল।
নোভাক শুনতে পেল লতার বন্ধন-জাল ভেদ করে তারা সশব্দে আসছে।
ডোবার মধ্যে একটা মরা গাছের গুঁড়ি পড়েছিল।
নোভাক সেই গাছটার উপর আশ্রয় নিলে…
একটু পরেই রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হল তিনজন অকা-যোদ্ধা। হাতের তিরধনুক বাগিয়ে তারা জলে নেমে পড়ল। বদ্ধ জলাশয়ের বুকে সশব্দ আলোড়ন তুলে তিনটি হিংস্র মানব-মূর্তি এগিয়ে এল নোভাকের দিকে।
আক্রমণকারীরা যখন প্রায় দশ গজ দূরে আছে তখন গর্জে উঠল নোভাকের বন্দুক। একজন অকা তৎক্ষণাৎ মারা পড়ল কিন্তু ফলাফল দেখার জন্য নোভাক একটুও অপেক্ষা করলে না, চট করে ঝাঁপ দিলে জলের বুকে গাছের গুঁড়িটার গায়ে আরও অসংখ্য শিকড়বাকড়ের আড়ালে যথাসম্ভব গা-ঢাকা দিয়ে সে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে।
একটু আগে নোভাক যেখানে ছিল ঠিক সেই জায়গাটায় গাছের গুঁড়িটাকে বিদ্ধ করে কেঁপে কেঁপে উঠছে একজোড়া তির!
সঙ্গীর মৃত্যুতে যোদ্ধা দুজন একটুও ভয় পায়নি, তারা আবার ধনুকের ছিলায় তির বসিয়ে নিলে।
আবার গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র পর পর দুবার। ধনুকধারী দুই অকা-যযাদ্ধার প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল জলার মধ্যে। একজনের ধনুক থেকে জ্যা-মুক্ত তিরে ছুটে গেল উপর দিকে, অদৃশ্য হয় গেল অসংখ্য বৃক্ষশাখা ও পত্রপল্লবের অন্তরালে…।
নোভাক বৃক্ষ কাণ্ডের আশ্রয় ত্যাগ করলে না– তার তিন শত্ৰু নিহত কিন্তু এখনও সে নিরাপদ নয়।
ক্যানোর কাছে নদীর ধারে আর একজন অকা-যোদ্ধার কথা সে ভোলেনি।
একটু পরে বদ্ধ জলাশয়ের এক প্রান্তে অনেকগুলো লতাপাতার ফাঁকে ফাঁকে একখানা মুখ দেখা দিলে চার নম্বর শত্রু।
নোভাক গুলি ছুড়ল– উপরি-উপরি দুবার অগ্নি-উদগার করলে তার বন্দুক।
অকা-যোদ্ধার গুলিবিদ্ধ শরীরটা ঝুঁকে পড়ল জলের উপর কিন্তু অজস্র লতার কঠিন আলিঙ্গন ভেদ করে মৃতদেহটা জলাশয়ের বক্ষ স্পর্শ করতে পারলে না উদ্ভিদের নাগপাশ তার প্রাণহীন শরীরকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখল।
নোভাক গাছের গুঁড়িটার উপর মাথা রেখে চোখ বুজে ফেললে। জলসিক্ত দেহে মশা আর জোঁকের আক্রমণের মুখেই সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলে তীব্র উত্তেজনায় তার স্নায়ুগুলি অবশ হয়ে পড়েছিল…
সশব্দে জল ভেঙে নোভাক ডাঙায় উঠল এবং অকাদের বেওয়ারিশ ক্যানোটাতে কাঁধের মালপত্র চাপিয়ে উঠে বসল। আশেপাশে যদি কোনো অকা যোদ্ধা লুকিয়ে থাকে তবে ফাঁকা নদীর বুকে তার শরীটা যে চমৎকার তিরের নিশানায় পরিণত হবে একথা বুঝতে নোভাকের মোটেই অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ক্লান্তিতে আর উত্তেজনায় তার শরীর তখন ভেঙে পড়ছে, অকাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার ধৈর্য তার ছিল না বন্দুকটাকে তৈরি রেখে আন্দি পাহাড়ের নীচে অবস্থিত পার্বত্যভূমির দিকে সে দ্রুত নৌকা চালনা করলে…
কয়েকঘণ্টা ধরে একটুও না থেমে সে ক্যানো চার্লিয়ে গেল। মাঝে মাঝে দারুণ ক্লান্তি আর অবসাদে তার দুই চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে তবু সে ঘুমায়নি– অবিরাম অবিরত নৌকা চার্লিয়েছে, এই অরণ্য-আবৃত সবুজ মৃত্যুপুরী থেকে যত তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায় ততই মঙ্গল। সারা রাত্রি ধরে সকাল পর্যন্ত সে প্রাণপণে বৈঠা চালাল তারপর আর পারলে না– বিকালবেলার দিকে সে ক্যানোটাকে নদীর তিরে ভিড়িয়ে দিলে।
অমানুষিক পরিশ্রমে তার হাত দুখানা তখন থর থর করে কাঁপছে।
নদীর ধারে ঘাস জমির উপর ক্যানোটাকে তুলে রেখে সে তার মালপত্রের বোঝা সমেত বন্দুকটাকে নিয়ে ধরাশয্যায় শুয়ে পড়ল এবং সেই অবস্থায় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল…
কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে সে যখন জেগে উঠল তখন আঁটার জল সরে গিয়ে আবার নদীতে জোয়ার এসেছে। চারদিকে ব্যগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করেও নোভাক ক্যানোটাকে দেখতে পেল না– সে বুঝল জোয়ারের জল তার একমাত্র অবলম্বন নৌকাখানাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে…
এবার আর জলপথে এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
অসহ্য কষ্টকর অরণ্যপথেই তাকে অগ্রসর হতে হবে।
নোভাকের চোখ ফেটে জল এসে পড়ল।
ম্যাপ দেখে তার ধারণা হল নদীর স্রোত যেদিকে চলে গেছে সেদিকে কয়েক মাইল হাঁটলেই নদীতীর থেকে ভিতরের দিকে ২০ মাইল দূরে আমেরিকানদের যে উপনিবেশ ও বিমানবন্দর আছে সেখানে সে উপস্থিত হতে পারবে। কোনো রকমে এই পথটা অতিক্রম করতে পারলেই সে নিরাপদ। কিন্তু জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আর পথ চলার উপায় ছিল না কারণ তার ম্যাচেটা হারিয়ে গেছে। দুর্ভেদ্য লতার বেড়াজাল ম্যাচেট দিয়ে না কেটে পথ চলা অসম্ভব- নোভাক নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে শুরু করল…
অসহ্য গরম আর অবসাদে তার চোখের পাতা ফুলে উঠল, বার বার বুজে এল তার দুই চোখ তবু নোভাক একবারও বিশ্রাম নেবার জন্যে থামল না। দুবার তার দৃষ্টিবিভ্রম ঘটল, দুদুবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠল মরীচিকা!
প্রথমবার সে দেখলে শিশুক্রোড়ে একটি নারী এগিয়ে চলেছে।
নোভাক চিৎকার করে তাকে আহ্বান জানালে আর সঙ্গেসঙ্গে নারীমূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল!
দ্বিতীয় বার সে দেখলে হলুদ চামড়ার পোশাকে সজ্জিত হয়ে একটি লোক হাঁটছে, তার পিঠে বাঁধা আছে একটা মস্ত বড়ো কড মাছ!
এবার আর নোভাক মরীচিৎকার মায়ায় বিভ্রান্ত হল না, মাথা নীচু করে সে লোকটির পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল– এমনকী একবার পিছন ফিরে সে মৎস্যের অধিকারীকে দেখার চেষ্টাও করলে না।
…সন্ধ্যার ধূসর অরণ্যকে লুপ্ত করে নেমে এল কৃষ্ণা রজনীর যবনিকা… পথের উপর বসে পড়ল নোভাক, তার শুষ্ক কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে এল অবরুদ্ধ ক্রন্দনধ্বনি– দূরে উপনিবেশের কুটিরগুলিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কাঁটাতারের পাহারা, বাতায়ন পথে ছড়িয়ে পড়েছে আলোর উজ্জ্বল ইশারা— অন্ধকার রাত্রির বুকে!
মুক্তির আনন্দে অনেকক্ষণ ধরে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল, তারপর কাঁধের বোঝাটাকে ছুঁড়ে ফেলে সে ছুটে গেল কাঁটাতারের বেড়ার দিকে, সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, এই! এই! এদিকে এস।
চটপট নিভে গেল সবগুলি আলো, অন্ধকার কুটিরের দ্বারে দ্বারে আবির্ভূত হল কয়েকটা চলন্ত ছায়ামূর্তি!
এই! এই! এদিকে! আবার চেঁচিয়ে উঠল নোভাক। সঙ্গেসঙ্গে অন্ধকারের গর্ভে এখানে-সেখানে জ্বলে উঠল কয়েকটা চকিত অগ্নিশিখা– ডান দিকের কাঁধে একটা অসহ্য যন্ত্রণা বোধ করলে নোভাক, ছিটকে মাটিতে পড়ে যেতে সে শুনতে পেল যান্ত্রিক কণ্ঠের কর্কশ গর্জন!
আঃ! সে রুদ্ধস্বরে আর্তনাদ করে উঠল, ওরা আমায় গুলি করল!
নোভাক বুঝতে পারলে ধীরে ধীরে তার জ্ঞান লুপ্ত হয়ে আসছে, ভগ্নকণ্ঠে সে একবার বললে, আমাকে গুলি করছ কেন?
তারপরই তার মাথাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
কাঁটা তারের বেড়ার ভিতর দিয়ে খুব সাবধানে কয়েকজন বন্দুকধারী বাইরে বেরিয়ে এল। বন্দুকের নল দিয়ে খোঁচা মেরে মেরে তারা নোভাকের শরীরটাকে পরীক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ একজন চিৎকার করে বললে, আরে! আরে! এ যে সাদা চামড়ার মানুষ!
তৎক্ষণাৎ অনেকগুলি মনুষ্যমুর্তি তার উপর ঝুঁকে পড়ল।
রক্তাক্ত শার্টটা খুলে নিয়ে কয়েকটা হাত সেই জামাটা দিয়েই তার রক্ত মুছিয়ে দিতে শুরু করলে।
মাফ করো, একটা কণ্ঠস্বর নোভাকের কানে এল, আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি। আমরা তোমাকে অন্ধকারে অকা-যোদ্ধা বলে ভুল করেছিলুম। অকাদের ভয়ে আমাদের মাথার ঠিক নেই।
হ্যাঁ, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে নোভাক শুধু একটা কথাই বলতে পেরেছিল, আমি জানি। অকাদের আমি জানি।
ওই কথাটা বলেই নোভাক অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল…
উপনিবেশের মানুষগুলির সেবা-যত্নে কিছুদিনের মধ্যেই নোভাক সুস্থ হয়ে উঠল। যে উড়োজাহাজটাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় সে দেখেছিল তার ইতিহাসও সে জানতে পারলে। কয়েকজন পাদরি ওই বিমানে চড়ে অকাদের দেশে গিয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করেও অকাদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের চেষ্টা করেন।
অকারা প্রথম কয়েকদিন কিছু বলেনি কিন্তু পরে তারা সবাইকে হত্যা করে। বিমানটিকেও তারা ধ্বংস করে দেয়। পরে একদল সৈন্য বিমানপথে ঘটনাস্থলে যায় এবং হতভাগ্য ধর্মপ্রচারকদের মৃতদেহগুলিকে কবরস্থ করে। পাছে তাদের উপর শ্বেতাঙ্গরা আক্রমণ চালায় সেই ভয়ে অকারা গ্রাম ছেড়ে আরও দক্ষিণ দিকে সরে যায়। কিন্তু রাতের অন্ধকারে তারা হানা দিতে শুরু করলে উপনিবেশের উপর সন্ত্রান্ত নাগরিকরা তাই সর্বদা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাহারা দিতে লাগল। এই সঙ্গীন মুহূর্তেই নোভাক এসে পড়েছিল উপনিবেশে আর তাই তার এই দুর্দশা…
কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে নোভাক আকাশ পথে উড়ল। উপনিবেশের বিমানবন্দর থেকে একখানা বিমান তাকে পৌঁছে দিলে সেই কুইটো শহরে– যেখান থেকে সে প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল।
সভ্য জগতের সংস্পর্শে এসে নোভাক নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল।
বিগত কয়েকটা মাস যেন কেটে গেছে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো। তবু অনেক দুঃখের মধ্যেও একটু সুখ, অনেক গরলের সঙ্গে একটু অমৃতের স্বাদও ছিল–
রক্তারক্তি, হানাহানি, ছিন্ন নরমুণ্ডের বীভৎস উৎসব আর তৈল অভিযানের ব্যর্থতা ছাপিয়েও একটুখানি আনন্দের স্মৃতি নোভাকের মনে দাগ কেটেছিল, একটি অস্পষ্ট নারীমূর্তি বারংবার এসে দাঁড়িয়েছিল তার স্মৃতির মণিকোঠায় ম্যাকানি, তার জিভারো বউ!