এখনও তা হলে ওকে এ বাড়িতে রাখা হবে?
নিত্যধনের বউ তার শাশুড়ি আর স্বামীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটি করে।
সুপ্রভা দোতলায় এসে দালানের চৌকিতে বসে পড়েছিলেন। সুপ্রভা হাঁপাচ্ছিলেন।
সুপ্রভা বউয়ের কথায় উত্তর দিতে পারলেন না, শুধু তাকালেন।
নিত্যধনও একই কথার পুনরাবৃত্তি করল, এখনও অপেক্ষায় থাকতে হবে ও নিজে চলে যায় কি না দেখতে? দূর দূর করে গলাধাক্কা দিয়ে বিদেয় করবে না? ওর সঙ্গে শাশ্বতীর বিয়ে দিলে লোকে কী ভাববে তা ভেবে দেখেছ?
দেখেছি বইকী! সুপ্রভা বলেন, যা ভাববার তাই ভাববে লোকে।
অথচ আমি যখন বলেছি–বউ নিত্যধনের দিকে তাকিয়ে বলে, তখন গ্রাহ্যই করা হয়নি। আমি তো কবে থেকেই বুঝেছি, এ ঘটনা ঘটবে। বেশ রাখুন ওকে ঘরজামাই করে, বউ বিদ্রুপের হুল বসায়, চাল চুলো তো আর নেই। আমি কিন্তু আর এখানে নেই
সুপ্রভা সহসা শিথিল ভঙ্গি ত্যাগ করেন।
হঠাৎ সুপ্রভা সোজা হয়ে বসেন।
সুপ্রভার মুখে একটা ক্ষুব্ধ ব্যঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে।
কার প্রতি ব্যঙ্গ?
ছেলে-বউয়ের প্রতি?
না, নিজের ভাগ্যের প্রতি?
কে জানে কী! তবে সুপ্রভা সেই হাসির সঙ্গেই বলেন, চুলো না থাক চাল আছে বউমা! ওকে এ বাড়ি থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করবার রাইট তোমাদেরও নেই, আমারও নেই।
জানি
নিত্যধন চাপা রাগের গলায় বলে ওঠে, বাবার ওই উইল। কিন্তু এ কথা কি জানতেন বাবা, দুধকলা খেয়ে কালসাপ কতখানি হয়ে উঠবে? এখন যদি ওকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিই, বাবা স্বর্গ থেকে দেখে খুশিই হবেন।
সুপ্রভার মুখটা বিকৃত হয়ে ওঠে।
সুপ্রভা বলেন, খুশি-অখুশির প্রশ্ন নেই নিত্য, হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না।…যে কথা তোরা শুনে এসেছিস সেইটাই সব নয়। সেটা শুধু লোক বোঝানো। আসল উইল, যা কোর্টে আছে, যার কপি তোদের উকিল কাকার কাছে আছে, তার ভেতরের মানে কী শুনতে চাস? তোরা ওকে নয়, ও-ই তোদের এ বাড়ি থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে পারে।…এ বাড়ির মালিক ওই ধ্রুবময়, ওর বাবার বাগান পুকুর ধানজমি সবকিছু বিক্রি করা টাকায় এই বাড়ি!.ধিক্কারে বিদীর্ণ হয়ে বলে ওঠেনসুপ্রভা, বিধবা পিসতুতো বোন রোগে ভুগে মরছিল, মরণকালে বড়ভাইকে বিশ্বাস করে তার হাতে নাবালক ছেলে আর সেই নাবালকের বিষয় সম্পত্তি তুলে দিয়ে গিয়েছিল।…বড়ভাই সে বিশ্বাসের খুব মান রাখল! নাবালকের সর্বস্ব বেচে নিজের নামে বাড়ি করল।..
মা! নিত্যধন চেঁচিয়ে ওঠে।
নিত্যধনের বউ লাল লাল কাঠ কাঠ মুখে তাকিয়ে থাকে শাশুড়ির মুখের দিকে।
সুপ্রভা বলেন, বলতে দে আমায়। সব কথা বলতে দে। ভিতরে বিষ পুষে পুষে জ্বলে মলাম আমি। বাড়ির ব্যাপারে গোড়ায় বললেন, ধ্রুব যদি ইচ্ছে করে চলে না যায়, ওকে কেউ তাড়াতে পারবে না। তখন এই দু আনা ধর্মজ্ঞান হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম বেশি দূরছাই করলেই স্বেচ্ছায় চলে যাবে।…কিন্তু মরণকালে তোদের বাপের আঠারো আনা ধর্মজ্ঞান উথলে উঠল, তিক্তস্বরে যেন অগ্নি হেনে সুপ্রভা কথা শেষ করলেন, তাই পুরো বাড়ি ধ্রুবর নামে লিখে দিয়ে তার কাগজপত্তর কোর্টে জমা দিয়ে রাখলেন, কপি উকিলের কাছে রাখলেন, আমায় বলে গেলেন নাবালকের সম্পত্তি নষ্ট আমি করিনি, ওর বাপের বিষয় ওরই থাকল।
নিত্যধন বলে ওঠে, আমাদের বাপের তা হলে কিছুই নেই?
কোথা থেকে থাকবে বল? ওই তো সামান্য চাকরি, এত বড় সংসার
এতদিন বলনি কেন আমাদের?
প্রাণ ধরে বলতে পারিনি নিত্য, মনে হয়েছে, আমি মরে গেলে যা হয় হোক, আমি তোদের কাছে বলতে পারব না, চিরকাল যা তোরা নিজের ভেবে এসেছিস, তা তোদের নয়।
চমৎকার! বলে বউ চলে যায়।
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সুপ্রভার বড়ছেলে, বসে থাকেন সুপ্রভা।
যেন যে কাজটা করে বসলেন, তার ওজন বুঝতে চেষ্টা করছেন।
কিন্তু শুধুই সুপ্রভার বড়ছেলে বউ?
আরও একজন কি শুনতে পায়নি? সে কি ঘরের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেনি? ছিল। তারপর সে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর, হঠাৎ ছিটকে উঠে তাড়াতাড়ি একখানা কাগজ নিয়ে খসখস করে কীসব লিখতে বসে।
কে জানে কী লেখে!
কাকে লেখে!
.
দম-আটকানো সিঁড়িটা দিয়ে উঠে এসে বাঁদিকে ঘুরেই দাঁড়িয়ে পড়ল চিরন্তন। দরজায় ভারী একটা তালা ঝোলানো।
এটা কী?
কোর্ট থেকে লাগিয়ে দিয়ে গেছে না কি রে বাবা!
কিন্তু লোকগুলো?
চিরন্তন কি এমনি নিঃশব্দে চোরের মতো আবার নেমে ফিরে যাবে?
কিন্তু তা ছাড়া?
কাকে জিজ্ঞেস করবে? সামনে তো বিরাট প্লাস্টিকের পরদা।
চিরন্তন হয়তো শেষ পর্যন্ত নিঃশব্দে নেমেই যেত, কিন্তু কোথায় যেন একটা কর্কশ কণ্ঠ ঝংকার দিয়ে উঠল, কে র্যা ওখানে? কে?
চিরন্তনের আর নেমে যাওয়া হল না, কে জানে পিছন থেকে লাঠি খাবে কিনা। চিরন্তন দাঁড়িয়ে রইল, ওই কণ্ঠের অধিকারিণীর দর্শনের আশায়।
এবার বেরিয়ে আসে একটা মেয়ে। প্লাস্টিকের পরদার ওধার থেকে। এই বোধহয় নমিতা।
সাজসজ্জা দেখে তাই মনে হল।
বলল, কাকে চান?
কড়া গলা।
চিরন্তন অবশ্য ওই মেয়েটাকে ভয় খাবে না। চিরন্তন আত্মস্থ গলায় বলল, চিত্তপ্রিয়রা কোথায় গেছে?
নমিতা কী বলত কে জানে, ততক্ষণে পিছনের সেই পর্দা আবার নড়ে ওঠে, ধবধবে ফরসা রং বিপুলকায় একটা মূর্তি বেরিয়ে আসে, কে? কাকে খুঁজছ?
চিরন্তন সপ্রতিভ গম্ভীর ভাবে বলে, আমার বন্ধু চিত্তপ্রিয়কে। তালা ঝুলছে দেখছি
অ! তা বন্ধু যদি তো তার খবর জানো না?
চিরন্তন যথারীতি সপ্রতিভ।
খবর জানতেই তো এলাম।
হু। তা খবরটা জেনেই যাও। আমি হচ্ছি চিত্তর মা। বুঝলে? বারো বছর ধরে আমার সঙ্গে মামলাবাজি করছে ও, তার ফল ফলল।…ওই যে ওই ডানহাতি ঘরে আমার বড়ছেলে বড়বউ বিরাজ করছেন! তাদেরই কি ভাল হবে নাকি? মাতৃশাপ ফলবে না ভেবেছ?…বড়গিন্নি যে দুদুবার আমাকে বিষ খাওয়াতে চেষ্টা করেছিল– হেমলতা দেবী একটি উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেন, তা পারল মারতে? হুঃ! ধর্মের কল বাতাসে নড়ে! আমি বলি হঠাৎ বউ আমায় অম্বুবাচীতে রাবড়ি খাওয়াতে আসে কেন?…এদিকে তো কথা বন্ধ। ছেলেকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। বলে–ঠাকুমা-
চিরন্তন বলে, কিন্তু চিত্ত?
হচ্ছে বাছা, কথাটা শেষ করতে দাও না। ছেলে এসে বলল, ঠাকুমা, বাবা তোমার জন্যে রাবড়ি এনেছে, অম্বুবাচীতে খাবে!
আমি বলি, ওরে হারামজাদা, তোর বাপ আমায় কখনও পোড়ামুড়ি দেয় না, আর হঠাৎ রাবড়ি?
বলে কিনা, মা স্বপ্ন দেখেছে–সব শেখানো কথা বুঝলে? আমার ছেলে এর ছন্দাংশও জানে না। যতই মামলাবাজি করুক, তবু একদিন এই গর্ভ থেকে বেরিয়েছিল তো? সব ওই ছোটলোকের মেয়ে বউয়ের কারসাজি! আমিও তেমনি ঘুঘু, সেই রাবড়ি ওই বউয়েরই পোষা বেড়ালকে লুকিয়ে ডেকে খাওয়ালাম। ব্যস, খানিক পরেই সাধের বেড়াল চোখ উলটে ফরসা!..
ভাঙা কর্কশ গলায় উচ্চকিত কতকগুলো শব্দ যেন চিরন্তনের মস্তিষ্কের কোষে কোষে পেরেক ঠুকছে, যেন চিরন্তনকে মন্ত্রাহতের মতো দাঁড় করিয়ে রেখেছে। চিরন্তন পাথর হয়ে তাকিয়ে আছে ওই শব্দের উৎসের দিকে।
কত পেরেক? ফুরোচ্ছে না?
ব্যস, ডেকে দেখালাম ডাক্তারকে, ডেকে দেখালাম উকিলকে। বউয়ের হাতে হাতকড়া পড়ে আর কী! কিন্তু আমার ওই কুলাঙ্গার ছেলে ডাক্তার উকিল দুজনের সঙ্গে কী যে যোগসাজশ করল, কত পয়সা খাওয়াল, ভগবান জানেন। সে কীর্তি ধামাচাপা পড়ে গেল।…বলল কী, এমন বেহায়া, আবার একবার। আমারই ঝিকে সোনার বিছেহার ঘুষ দিয়ে বিষ দিয়েছে আমার পানে দিতে।কথার মাঝখানে হি হি করে হেসে ওঠেন মহিলাটি, সে মাগীও তেমনি ঘুঘু, সোনার বিছেও বাগাল, আমার কাছেও এসে ফাঁস করে দিল।..সাধে বলছি ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। তা আমার ছেলে একটা মনুষ্যত্ব দেখিয়েছিল, বউকে বাপের বাড়িতে দূর করে দিয়েছিল।…শেষ পরে আবার বউয়ের মা বাপ এসে কেঁদে পড়ে গছিয়ে দিয়ে গেল। দেবে না তো করবে কী? ওই বিষধরী মেয়েকে ঘরে ঠাঁই দেবে কে? তা তদবধি ঢিট হয়ে গেছে, ও চেষ্টা আর করেনি। যা করে মুখে।…আমিও বলি, দে কত গাল দিবি দে, আমার তাতে পরমায়ু কমবে না। কথায় বলে রাখে কেষ্ট মারে কে?…এই যে সেবার তোর সাত বছরের মেয়েটা সান্নিপাতিক বিকার হয়ে মরল, পারলি রাখতে? হুঃ–ভগবান আছেন।
চিরন্তনের সারা শরীরে পাক দিচ্ছিল, চিরন্তনের মনে হচ্ছিল এখুনি বমি হয়ে যাবে। চিরন্তনের মাথা ঘুরছিল।
তবু চিরন্তন বলল, কিন্তু চিত্তপ্রিয়?
তা সেই কথাই তো বলছি বাছা! কী গুণের বউ ছেলে আমার, সেই বার্তা জানাচ্ছি। তবে মিথ্যে বলব না–ছোট বউটা ভাল ঘরের মেয়ে ছিল। পাজি হচ্ছে আমার নিজের পেটেরই কলঙ্ক, ওই তোমার বন্ধু চিত্তপ্রিয়।…কুটিলের রাজা। এই মামলা মামলা করে সর্বদা বউয়ের সঙ্গে খটখটি। বউটি গেরস্ত ঘরের মেয়ে, বাবার কালে কখনও দেখেনি এসব, ভয় খেত। খালি বলত, এসব ছেড়ে চলে চলে যাই।…তা ওই গোঁয়ার সব ছাড়া ছেড়ে তিলটি ছাড়বে না। বউকে বলে কিনা তোমার ইচ্ছে হয় চলে যাও তোমার বাপের বাড়ি।..কথাই বন্ধ, কান তত বন্ধ নয়? শুনতে তো সবই পাই। শুনতে পাই বউ বলে, বাপের বাড়ি কেন? যাই তো যমের বাড়ি যাব।..ও মা যা বলল তাই করল? হয়েছেন আমার বাছাধন তেমনি জব্দ। এখন ওই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কী করবি কর। জানি না দোরে তালা দিয়ে কোথায় চলে গেছে।
চিরন্তন হঠাৎ শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে বলে ওঠে, আর ওর বউ? ও মা বললাম যে!
ও না, বলিনি বুঝি? বউ তো গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। তা দেখা তো আর হচ্ছে। বন্ধুর সঙ্গে, বসে কী করবে?
.
গলায় দড়ি দেওয়াটা যত সহজ, তত শক্ত।
চিত্তপ্রিয়র বউ গলায় দড়ি দিল, অথচ মনীষা দিচ্ছে না।
মনীষা তার ঝিয়ের বরের হেপাজতে তার সেই পুকুরপাড়ের বাড়িটায় দিনের পর দিন কাটিয়ে চলেছে। ভাত রাঁধছে, স্কুল ঠেঙাচ্ছে, আস্তে আস্তে ঔজ্জ্বল্য হারাচ্ছে।
ক্রমশ মনীষার সেই তুলসীমন্দিরে তুলসীর জঙ্গল গজাচ্ছে, ফুলগাছগুলো ঝুনো হয়ে যাচ্ছে, লম্বা ঘাসে উঠোন ভর্তি হচ্ছে।
বৃষ্টির দিনে উঠোন আর পুকুরে একাকার হয়ে গেলে মনীষা আর তার ঝিকে ডেকে ডেকে হেসে হেসে বলছে না, দেখ নয়না, আমরা যেন জলে পড়ে আছি।
এখন বৃষ্টির দিনে বিছানায় শুয়ে থাকে মনীষা, নয়নাকে বলে, তুই নিজের ভাতটা বেঁধে নে। আমি খাব না।
আর ইদানীং ছুটির দিন হলেই দুপুরবেলাই দরজায় তালা দিয়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে মনীষা।
নয়না তো সঙ্গে যায় না, তাইনয়না টের পায় না মনীষা অনেক পাড়া পার হয়ে দূরের কোনও পাড়ার একটা পার্কে গিয়ে বসে থাকছে।
পুরু পুরু খামে ভারী ভারী সেই যে চিঠিগুলো আসত মাঝে মাঝে মনীষার নামে, সেইগুলো আসা বন্ধ হয়ে গেছে বলেই কি মনীষা এমন বদলে যাচ্ছে?
সেই চিঠিগুলোই কি মনীষাকে জানিয়ে যেত, তুমি মূল্যহীন নও, তুমি অপ্রয়োজনীয় নও। তোমার ক্ষমা পাবার জন্যে এখনও একজন ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
সে চিঠি বোধ করি ব্যর্থ হয়ে হয়ে অবশেষে থেমে গেছে।
কিন্তু মনীষা তার জন্যে ফুরিয়ে যাবে কেন? মনীষা তো তার জীবনে আবার আনতে পারত নতুন রং, নতুন স্বাদ, নতুন আলো। সেই রং, সেই স্বাদ, সেই আলো তো মনীষার দরজায় এসে মুখ বাড়িয়েছিল।..
অথচ মনীষা তাকে দরজা খুলে দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে পারল না। মনীষা জীবনের সার্থকতা খুঁজতে গেল অনেক পাড়া পার হয়ে একটা দূরপাড়ার রেলিংঘেরা পার্কে।
তবে কি বলতে হবে মনীষাও নিজের হাতে নিজের গলায় ফাঁস পরাল? যার থেকে আর মনীষার মুক্তি নেই। মনীষার কি হঠাৎ ভয় ঢুকল–কোনওখানে ছোট্ট একটু হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকুনি থেমে গেছে, তাই ওই চিঠিগুলোও থেমে গেছে? মনীষা তাই দিশেহারা হয়ে গেল! বোকা হয়ে গেল! ভোঁতা হয়ে গেল!
তা নইলে এতগুলো দিন মাস বছর পার করে এসে মনীষা এখন যেতে শুরু করল সেই একটা দুর পাড়ার রেলিংঘেরা পার্কে?
মনীষার কি খেয়াল হচ্ছে না ওই পার্কে খেলতে আসা ছেলেগুলোর মধ্যে কোনও একটা ছেলে হঠাৎ মনীষার দিকে এগিয়ে আসবে, এমন আশা করাটা পাগলামি?
মনীষার কি মনে আসছে না মনীষার এই কাঙালপনা দেখে কেউ একজন ব্যঙ্গের হাসি হেসে উঠতে পারে? বলতে পারে, কী হল অহংকারময়ী দর্পিতা? তোমার সেই তেজ গেল কোথায়? যে দর্পের ভরে তুমি একটা চিঠির উত্তর দেবার সৌজন্যটুকুও দেখাওনি। যে অহংকারে একটা অবোধ শিশুকে নিষ্ঠুর যন্ত্রণা দিয়েছ দিনের পর দিন।…এখন তো আর সে মা কোথায় গেল বলে গগন বিদীর্ণ করে না। এখন আর তুমি কোথায় জায়গা পেতে আসছ?…
হয়তো এও বলতে পারে, ওঃ স্বাবলম্বন শব্দটার মানে ভুলে গেছ তা হলে? যে শব্দটা দিয়ে আমার কান ফুটো করে চলে গিয়েছিলে!
মনীষা নির্বোধ নয়, মনীষা পৃথিবী সম্পর্কে অজ্ঞ নয়, মনীষার তো এ সব জানবার কথা। অথচ মনীষা এখন অবোধের ভূমিকায় অভিনয় করতে নেমেছে।
মনীষা টুবলু নামের একটা মোহের কাছে তার তেজ দর্প অহমিকা সব উৎসর্গ করতে বসেছে। ছোট্ট ছেলেটাকে ছেড়ে চলে এসে আত্মস্থ হয়ে বসে থাকতে পেরেছিল মনীষা, পেরেছিল নয়নাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতে, নয়নার বরকে নিয়ে কৌতুক করতে। আর পেরেছিল বৃষ্টির দিনে কুড়িয়ে পাওয়া একটা ছেলেকে বন্ধুর মর্যাদা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সঙ্গে আড্ডা দিতে।
অথচ এখন, যখন ছেলেটা বয়েসের উপর আরও চারটে বছর চাপিয়ে নিয়ে সুস্থির হয়ে বসেছে, তখন কিনা মনীষা মরিয়া হয়ে ছুটি হলেই ঘরে তালা লাগিয়ে অন্য পাড়ায় ছুটছে!
ওই চারটে বছর বড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই কি মনীষাকে এমন চূর্ণ করে ফেলতে বসেছে? অথবা সেই ভয়!
এতদিন ধারণা ছিল, আমার আছে, আমি ইচ্ছে করে নিচ্ছি না। এখন হঠাৎ ভয় হচ্ছে, বোধহয় সেই থাকাটা শূন্যের অঙ্কে মিলিয়ে যাচ্ছে, ইচ্ছে হলেও আর পাওয়া যাবে না।
অথচ মনীষা এই কাঙালপনার পথ না ধরে আবার নতুন সুরে জীবনের বাঁশি বাজাতে পারত। কিন্তু তা বাজাল না মনীষা।
মনীষার চিরদিনের বেপরোয়া উদ্ধত মন অবশেষে সেই অতি পৌরাণিক, অতি সেকেলে বস্তুটার পায়ে আত্মবিসর্জন দিতে গেল। যেটার নাম নাকি মাতৃস্নেহ।
.
কিশোর সংঘের দরজা দিয়েও আর হাঁটছিল না চিরন্তন, তবুননীদা একদিন ধরে ফেললেন তাকে।
ধরে ফেললেন একটা স্টেশনারি দোকানের কাউন্টারে।
এই যে তুই! যাক বাবা বাঁচা গেল। তিন তিনদিন তোর বাড়ি তল্লাশ করে এসেছি, তোর পাত্তা নেই।
চিরন্তনের শার্টের কলারটা ননীদার মুঠোয়। কৌশলে সেটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে চিরন্তন, কিন্তু দেখে, নাঃ বড় শক্ত মুঠো।
সেই অবস্থাতেই বলে, কিন্তু এত খানাতল্লাশের হেতু?
বলিস কী? হেতু জানতে চাইছিস? তোর নামে ওয়ারেন্ট নেই?…আচ্ছা চল, এই মাজনটা কিনে নিয়ে নামছি। তোর কেনাকাটা হয়েছে?
থাক, পরে কিনলেও চলবে।
কাজ সেরে নে না বাবা, তারপর চল দেখি তোকে।
চিরন্তনের দরকার ছিল ব্লেডের, চিরন্তন তাই বলল, থাক পরে হবে।
এই দেখ! রাগ হয়ে গেল বুঝি?
কী আশ্চর্য, রাগ কীসের? কিন্তু ওয়ারেন্টটা কীসের?
আরে বাবা, তুই ওদের আশা দিয়ে এলি নাটক লিখে দিবি, তারপর একেবারে নো পাত্তা! ওরা একেবারে হাপসে পড়ছে। শ্যামল নাকি তোর বাড়িতে পাঁচদিন লোক পাঠিয়েছে, আমিও তিনদিন গেলাম, একই উত্তর বাড়ি নেই।কখন থাকিস বল তো?
বলা শক্ত। তবে রাত এগারোটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত নিশ্চিত থাকি।
ও হো হো–ননীদা হেসে ওঠেন, তবে তো বাড়িকে উদ্ধার করিস বল? কিন্তু নাটকের কী করছিস?
এই দেখুন! নাটক লেখার আমি কী জানি বলুন তো?
আরে বাবা, ওর আর জানাজানি কী? কতকগুলো পাত্র-পাত্রী খাড়া করে তাদের মুখে বেশ কড়া কড়া কথা জুড়ে দিবি, হয়ে যাবে নাটক। এখন তো আরও সুবিধে, নাটকে পটপরিবর্তন নেই। একই দৃশ্যপটের উপর তুমি রাজসভা থেকে গুণ্ডার আজ্ঞা পর্যন্ত সবই চালিয়ে যেতে পারে। কাজেই ওই সিনসিনারির বর্ণনার সময় নষ্ট নেই। শুধু কথা! ভাল ভাল কথা! উঁচুদরের কথা! জোরালো কথা, ঘোরালো কথা!…ধোঁয়াটে কথা, রহস্যময় কথা! ব্যস, মিটে গেল কাজ।
চিরন্তনন হেসে ফেলে বলে, প্লটের দরকার নেই?
প্লট।
ননীদা চোখ বড় করে বলেন, প্লটের আবার অভাব কী? নাটক তত তোমার চারদিকে ছড়ানো। যা হোক একটু তুলে নিলেই হল। হয়তো দেখবি তোর নিজের বাড়িতেই মস্ত নাটকীয় ঘটনা, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নাট্যমূহূর্ত! প্লটটা কোনও কথাই নয়।…এ তো তোদের সেই আদ্যিকালের পঞ্চম অঙ্কের পঞ্চম দৃশ্য পর্যন্ত নাটক নয় যে, প্লট চাই, সিন চাই, হাসি চাই, কান্না চাই, আবেগ চাই, আতিশয্য চাই, দজ্জাল গিন্নি চাই, কিপটে কর্তা চাই, বোকা চাকর চাই, খরখরে ঝি চাই–আধুনিক নাটকে এত সব কিছুই চাই না। চাই শুধু জীবনরস!…হয়তো যে রস তোমার জীবন থেকেই ঘেঁকে তুলতে পারো। তা ছাড়া ওই তো বললাম, নাটকের প্লট তোমার চতুর্দিকে ছড়ানো
তা ননীদার কথাটা মিথ্যে নয়।
ননীদার চেহারাটা হাস্যকর হলেও কথাগুলো হাস্যকর নয়।
নাটক তো আমাদের চতুদিকেই ছড়ানো।
সেই সেদিন তুচ্ছ একটা স্কুলমাস্টার আর একটা হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে বসে থাকা মেয়ে, এই দুই নায়ক নায়িকাকে অবলম্বন করেই কি কম একটা নাটকীয় কাণ্ড ঘটে গেল?
আর এক নাট্যমুহূর্ত এল সেই রাত্রেই।
রাত্রের আহারের সময়।
প্রায়শই নিত্যধন সপরিবারে খেয়ে দেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়ে, চিরন্তনের সঙ্গে প্রায় দেখাশোনাই হয় না।
চিরন্তনন অনেক রাত করে ফেরে, তখন তার সঙ্গে ধ্রুব খায়, শাশ্বতী খায়, সুপ্রভা তদারকি করেন।
সেদিন রাত্রে নিত্যধন চিরন্তনের অপেক্ষায় বসে ছিল, আর সে রাত্রে শাশ্বতী খিদে নেই বলে শুয়ে পড়েছিল। ধ্রুবর কথা কেউ জানে না।
সুপ্রভা বসে ছিলেন নীরবে উদাস নেত্রে।
চিরন্তন খেতে বসে বলল, কী ব্যাপার? দাদা এখনও জেগে? এরা কই? ধ্রুব, শাশ্বতী?
বলে হাত ধুয়ে খেতে শুরু করল।
কিন্তু তার দাদা করল না।
দাদা গম্ভীর গলায় বলল, ওরা খাবে না। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
কথা!
চিরন্তন হালকা গলায় বলল, সেইজন্যে জেগে বসে আছ? আহা বেচারা! কাল সকালে বললেই হত।
সব কথা হালকা করে উড়িয়ে দেওয়া যায় না চিরো!
চিরন্তন দাদার দিকে তাকায়, চিরন্তন মার দিকে তাকায়, চিরন্তনের হঠাৎ সেই দুপুরের কথা মনে পড়ে যায়। ওঃ সেই সিনেমার কথা!
চিরন্তন আরও হালকা গলায় বলে, ও বাবা!
তুমি এইভাবে কথা বলবে জানতাম। কিন্তু এটা তোমার শোনা দরকার। জানো আজ কী হয়েছিল?
চিরন্তন অবোধ মুখে বলে, জানি না তো! কখন? কী হয়েছিল?
মা-ই বলুন।
মা? কেন, আবার মাকে খাটানো কেন? তুমিই তো বেশ বলছিনে? আর বলবার জন্যেই তো কষ্ট করে জেগে বসে আছ।
তোমার এই অগ্রাহ্যের ভঙ্গির জন্যেই কথা বলতে ইচ্ছে হয় না– নিত্যধন ক্রুদ্ধ গলায় বলে, তোমার বউদি মিছে বলে না–
বউদির কথা থাক দাদা, তোমার নিজের কথাই বলল।
ওঃ আচ্ছা! চিরন্তনের দাদা কালিবর্ণ মুখে বলে, আমার কথাই বলি-দুপুরবেলা ধ্রুববাবু কাউকে না জানিয়ে, কারুর অনুমতির তোয়াক্কা না করে শাশ্বতীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন!
আরে কাউকে না জানিয়ে কী? চিরন্তন খোলা গলায় বলে ওঠে, কী মুশকিল! আমিই তো ওদের যেতে বলেছিলাম। টিকিট দুটোও আমারই কেনা ছিল। আমার আর অন্য একজনের যাবার কথা ছিল, গেল না, আমার একা ভাল লাগল না, আমি তাই ওদের বললাম, তোরা যা। শাশ্বতীটা তো সিনেমা বলে প্রাণ বার করে। কিন্তু তাতে কী হয়েছে?
সরল অবোধ চোখে তাকায় চিরন্তন।
মনে হয় ওর মাকে চেনে না ও, চেনে না দাদাকে। অবশ্যই এটা ওর ভান। এই ভান করেই ওদের অপ্রতিভ করতে চায়।
সুপ্রভা পাথরের চোখে তাকিয়ে থাকেন।
সুপ্রভার বড়ছেলের বোধ করি সবটাই পাথর, কণ্ঠস্বরও। তুমি ওদের যেতে বলেছিলে! তুমি ওদের টিকিট দিয়েছিলে!
তাই তো বললাম! কেন, ওরা বলেনি সে কথা?
না, বলেনি।
আশ্চর্য তো! তা মার কাছে খুব বকুনি খেয়ে মরেছে তো?
সব জিনিস অমন হালকা করে দেখো না চিরো, ছোট-খাটো বকুনি খাওয়ার কথা নয়। আজ ওরা যা লাঞ্ছিত হয়েছে, সেটা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। অথচ তার কারণ তুমি! আশ্চর্য!
দাদার প্রত্যেকটি ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার ভঙ্গি চিরন্তনের কাছে চিরদিনই কৌতুকের। কিন্তু আজ আর কৌতুক বোধ করল না চিরন্তন। পিঠ সোজা করে বসে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করল, ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না, এমন লাঞ্ছনা?
তা ছাড়া কী?
কেন, ওরা কি সিনেমা দেখে ফেরার সময় ড্রিঙ্ক করে এসেছিল? না কি—
নিত্যধন ক্রুদ্ধ গলায় বলে, কেন, ওই যাওয়াটাই কি যথেষ্ট দোষ নয়?
যথেষ্ট মানে? ওটা যে একটা দোষ, এটা শুনেই তো আশ্চর্য লাগছে। তা কী লাঞ্ছনা করা হয়েছে? মেয়েটার মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢালা হয়েছে, আর ছেলেটাকে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ির বার করে দেওয়া হয়েছে?
বাড়ির বার করে!
চিরন্তনের দাদা বলে ওঠে, হুঃ। তা হলে তো ব্যাপারটা সোজাই থাকত। এতক্ষণ যা শুনলে, সেটাই শেষ কথা নয়। আমি বললাম ওই ধ্রুবটাকে দূর করে দেওয়া হোক, তখন আমাদের মাতৃদেবী বলে উঠলেন, তোমরা ওকে দূর দূর করে তাড়াবে কী, ওই ধ্রুবই তোমাদের দূর করে দেবার অধিকার রাখে।…তারপর তিনি একটি আষাঢ়ে গল্প ফাঁদলেন।
সুপ্রভা সামনে বসে আছেন, তবু সুপ্রভার বড়ছেনে এই সুরে কথা কইতে থাকে, বুঝলে, স্রেফ আষাঢ়ে গল্প। এই যে বাড়িটি দেখছ, যা নাকি আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি বলে এতদিন ভেবে এসেছি, তার একখানা ইটও নাকি আমাদের নয়। সবই নাকি ধ্রুববাবুর! এ বাড়ি ওরই পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রির টাকায়। সে সব পাকা দলিল নাকি কোর্টে আছে। এতদিন যা জেনে এসেছি সব ভুল। আর কিছু চাও?
চিরন্তনেরও বুঝি এবার স্তব্ধ হবার পালা।
নিত্যধন সেই স্তব্ধতার দিকে তাকিয়ে একটু ব্যঙ্গহাসি হেসে বলে, তোমার আর কী? নাঙ্গার নেই বাটপাড়ের ভয়! একটা মেসে গিয়ে পড়ে থাকতে পারো, একটা বন্ধুর বাড়ি গিয়ে পড়ে থাকতে পারো। আমারই স্ত্রীপুত্রের হাত ধরে রাস্তায় গিয়ে নামতে হবে।
চিরন্তন ঠাণ্ডা গলায় বলে, ধ্রুব কি আমাদের গলাধাক্কা দিয়ে পথে বার করে দেবার সংকল্প ঘোষণা করেছে?
করেনি, করতে কতক্ষণ? নিত্যধন বলে ওঠে, জানত না, তাই আশ্রিত মূর্তিতে পড়ে ছিল, এখন জানবে, আর রেয়াৎ করবে?
তা বটে! ছেলেটাকে তুমিই চিনেছ। কিন্তু মা, এই আষাঢ়ে গল্পটা কি সত্যিই তোমার বলা?
সুপ্রভা চোখ তুলে তাকান।
এখন সুপ্রভার এই চোখ দেখে মনে হয় না সুপ্রভার সারাটা জীবন শুধু তেল নুন লকড়ি, বড়ি আচার আমসত্ত্ব, আর হলুদ পাঁচফোড়ন লঙ্কার এলাকার মধ্যেই কেটেছে। সুপ্রভা যেন একটা গভীর অতলে তলিয়ে গেছেন। সুপ্রভা তারপর কথা বলেন।
বলেন, হ্যাঁ বাবা! উনি এসব কথা আমায় বলে গেছেন। ভেবেছিলাম আমার জীবদ্দশায় আর এ সব কথা উঠবে না। যেভাবে চলছে চলবে। কিন্তু রাগ না চণ্ডাল! রাগের মাথায় বলে বসলাম। কূলে এসে তরী ডোবানাম।
চিরন্তন মার আক্ষেপে কান করে না।
চিরন্তন অন্য কোনও কথা বলে না। চিরন্তন শুধু বলে, এ কথা ধ্রুব জানত না?
না।
কেবল তুমি জানতে?
হ্যাঁ।
অথচ তুমি ওকে চিরকাল আশ্রিত দয়ার পাত্র হিসেবে রেখে এসেছ?
সুপ্রভা চুপ।
চিরন্তনের দাদার বোধ করি এতক্ষণে মনে পড়ে পাতের খাবারগুলো খাবার কথা ছিল।
চিরন্তন সেটা ভুলে যায়। চিরন্তন থালাটা ঠেলে রেখে বলে, তুমি সব জেনে ওরই বাড়িতে ওকে ভিখিরি সাজিয়ে রেখে নিজেরা মালিক হয়ে বসে ভোগ করছ! ওকে নীচতলায় চাকরের মতো ঘরে একটু করুণা করে থাকতে দিয়েছ! উঃ মা! তোমাকে আমার মা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।
সুপ্রভার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, সুপ্রভা কষ্টে বলেন, আমি তোদের মুখ চেয়েই
আমাদের মুখ যদি একটু কম চাইতে মা!
কিন্তু জিনিসটার সত্যতা না দেখে–চিরন্তনের দাদা এবার বলে, মা কী শুনতে কী শুনেছেন, কী বুঝতে কী বুঝেছেন–
সুপ্রভা চোখ না মুছেই বলেন, কী বুঝতে কী বুঝব কেন নিত্য, কী থেকে কী হয় তা কি বুঝিনি চিরকাল? কী মাইনে ছিল তোদর বাপের? ঘুষের টাকাই বা কত যে, তাতে রামরাজত্ব করে সংসার করে আবার একটা এত বড় বাড়ি করে রেখে যাবেন? তোদের মালতী পিসির কথা কি মনে নেই? ইদানীংই না হয় বিধবা হল, রোগে পড়ল, ভুগে ভুগে মলো যখন সধবা ছিল কত আসত, যখনই আসত তাদের কত খাবার খেলনা দিত–
মনে আছে বইকী, নিত্যধনের তো অবশ্যই মনে আছে। নেহাত শিশু নয় সে তখন। মালতী পিসি এলেই বাড়িতে যেন দু রকমের হাওয়া বইতে দেখত সে। উপরের হাওয়াটা আহ্লাদে ভাসা। খাওয়াদাওয়া তাসখেলা, থিয়েটার দেখতে যাওয়া, রাত দুপুর অবধি হাসি গল্প।…আর তার তলায় তলায় প্রবাহিত হত একটা চাপা আক্রোশের হাওয়া।
সেটা মার।
মা সমস্ত হাসি আহ্লাদে যোগ দিতেন, কিন্তু মার ভিতরে গর্জন করত ওই আক্রোশ। যেন ওই আক্রোশের আগুন দিয়ে বাবার আহ্লাদে ডগমগ উৎফুল্ল চেহারাটাকে ভস্ম করে ফেলতে পারলে শাস্তি পাবেন।
অথচ সুপ্রভা এক ডাবর পান সেজে নিয়ে মালতীর সঙ্গে থিয়েটার দেখতে যেতেন, মালতীর আনানো গঙ্গার ইলিশের ল্যাজা তারিয়ে তারিয়ে যেতেন।
মানুষ কী না পারে। বিশেষ করে মেয়েমানুষ।
কাজেই সুপ্রভা যদি এই এতগুলো বছর ধরে এমন গুরুতর একটা কথা চেপে রেখে থাকেন, খুব আশ্চর্য নয়।
সুপ্রভা তো মেয়েমানুষ!
কিন্তু সুপ্রভার ছোটছেলের সেজন্যে তাঁকে মা বলতে কষ্ট হচ্ছে।
সুপ্রভা আস্তে বলেন, বললাম তো, ভেবেছিলাম তিনি যেমন মরণকালে বলে গিয়েছিলেন, আমিও তেমনি মরণকালেই বলে যাব। অসময়ে এতবড় একটা কথা প্রকাশ করে আমার এই সাজানো খেলাঘর ভেঙে ফেলতে পারব না।
মা! খেলাঘর তো ভেঙে ফেলবারই জিনিস।
সে তোরা বলতে পারিস, মেয়েমানুষ পারে না।
এই সংসারে এখন আর তোমার কী সার্থকতা আছে মা?
এখন? সুপ্রভা কেমন একরকম হেসে বলেন, কোনকালেই বা ছিল চিরু? এখন নয়, তখনও নয়। তবু এই বাইরের ঠাটটা আঁকড়েই পড়ে আছি চিরকাল। নইলে পায়ের তলায় মাটি কী? তখন আমি যদি আমার স্বামীর প্রাণ অন্যত্র বাঁধা বলে ঠিকরে বেরিয়ে যেতাম, কোথায় দাঁড়াতাম? এখন যদি আমি ছেলেরা আমার সম্মান রাখে না বলে কাঁদতে বসি, সে সম্মানটা আর কোথায় পেতে যাব? মেয়েমানুষকে চিরদিনই আঁচল দিয়ে আগুন ঢাকতে হয়।
চিরন্তন এই সিরিয়াস পরিস্থিতির মাঝখানে হঠাৎ হেসে ওঠে, বলে, তবে দুঃখের বিষয়, আগুনটা ঢাকে না, শুধু ওই আঁচলটাই পোড়ে। কিন্তু তারা কোথায়? সেই পরম পাপী দুটো? তাদের কি আজ শাস্তিস্বরূপ মিলও বন্ধ করা হয়েছে?
তুমি কি এখুনি তাকে ডেকে সব বলে ফেলতে চাও?
দাদার প্রশ্নে চিরন্তন মুখ তুলে তাকায়। বলে, কেন, তুমি কি চেপে রাখতে চাও?
আমি দলিলটা নিজের চক্ষে আগে দেখতে চাই।
আমি তো বলছি নিত্য, দেখবার কিছু নেই–সুপ্রভা হতাশ নিশ্বাস ফেলেন, আগে তাঁর লোভটা প্রবল হয়ে উঠেছিল, স্ত্রীপুত্রের জন্যে মায়াটা বড় হয়েছিল, কিন্তু অসুখে পড়ে পর্যন্ত ধর্মজ্ঞানটা জেগে উঠল। মাঝে মাঝেই বলতেন, আচ্ছা এ কথা কি তোমার সত্যি বলে মনে হয়, পরলোকে গিয়ে তার আগে-মরে-যাওয়া সবাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়?
হ্যাঁ, ওই ধর্মজ্ঞানটা জাগিয়ে তোলার জন্যেই ইহলোক পরলোক চিরন্তন মৃদু হেসে বলে, সভ্যতার বশে তো সহজে কিছু করতে পারে না মানুষ। করে ভয়ে।
চিরন্তন টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, আর সেই সময় সুপ্রভার বড়বউমা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তীক্ষ্ণ গলায় বলে, মাথা ধরেছিল শুয়েছিলাম, ঘরে থেকে অনেক কথাই শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু আসল কথাটাই তো বাকি থেকে গেল দেখছি, না বললেন মা, না বললেন তাঁর ছেলে। তোমাদের বোনের যে বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল, সেটা ঠাকুরপোকে জানাতে হবে না?
আর দুজন চুপ।
চিরন্তন তিনজনের মুখের দিকেই তাকায়। তারপর বলে, যাক, এটা একটা সুখবর। আমি তো ভেবেছিলাম ধ্রুবটা যা লাজুক, ও হয়তো মুখ ফুটে বলতে পেরে উঠবে না, আমাকেই বলতে হবে। বকুনির ধাক্কায় চক্ষুলজ্জাটা কাটাতে পেরেছে তা হলে।
তিনটে লোককেই চুপ করিয়ে রেখে চলে যায় চিরন্তন।
যেন কড়ে আঙুল দিয়ে গিরিগোবর্ধন তুলে দিয়ে গেল। যেন পায়ে হেঁটে নদী পার হয়ে গেল।
যেন অদৃশ্য একটা হাসির ফুলঝুরি ছিটিয়ে বলে গেল, কী তুচ্ছ কথা নিয়েই মাথা খোঁড়াখুঁড়ি কয়রা তোমরা!
ঠিক তখন, ঠিক ওই কথাটাই চিঠিতে লিখেছিল ধ্রুবময় তার চিরবান্ধবীকে।
কী তুচ্ছ কথা নিয়েই অধীর আকুল হয়ে পত্রাঘাত করেছ দেখে হাসি পাচ্ছে! ওটা আবার একটা তাড়াতাড়ি জানাবার বিষয় নাকি? আমি তো বরাবরই জানতাম। অনাদি-মামা কবেই বলেছিলেন আমায়। কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে আদৌ ইন্টারেস্টিং লাগেনি তখন। এখনও লাগছে না।…সত্যি বলতে কী, অরুচিকরই লাগছে। তোমার কাছে একান্ত অনুরোধ, যত শিগগির পারো কথাটা ভুলে যেয়ো।…কারণ তোমার ওই ভুলে যেতে পারাটার উপরই আমাদের দুজনের বিয়েটা দাঁড়িয়ে। তুমি যদি ওটা ভুলতে না পারো, হয়তো দেখবে আমিই তোমায় ভুলে গেছি।…অথচ সেই যে মেয়েটা যার পিঠে একটা লাল জজুল আছে, এটাও আমার জানা, তাকে ভুলতে আমার ভীষণ কষ্ট লাগবে।
কিন্তু চিঠিটা ধ্রুবময় লিখছে কোথা থেকে? সেই তার নীচের তলার ঘরটায় বসেই নাকি?
তাই তো দেখা যাচ্ছে। তাজ্জব তো!
ওকে আজ কেউ খেতে ডাকেনি, অথচ ও নাকি নিজেই রাঁধুনির কাছ থেকে চেয়ে সময়ে খেয়ে নিয়েছে। আর হয়তো কাল সকালেও ওর স্কুলে যাবার সময় কেউ না ডাকলে, তেমনি চেয়ে খেয়ে নিয়ে চলে যাবে। না হয় ও মাইনের টাকাটা এনে এ বাড়ির গিন্নির হাতে তুলেই দেয়, তা বলে এত বেহায়া। হবে? মান সম্ভ্রমের ধার ধারবে না?
শাশ্বতী নামের মেয়েটা তা হলে করবে কী? ওর গলায় মালা দিয়ে আজীবন জ্বলে পুড়ে মরবে? বোঝাই তো যাচ্ছে, ওর মধ্যে আগুন নেই, শুধুই জল। সেদিন একটু আলো দেখা গিয়েছিল, কিন্তু সে কিছু না।
শাশ্বতীকেও তো তা হলে চিন্তা করতে হবে, যে ছেলেটার বুকে একটা পোড়া দাগ আছে, তাও তার জানা, তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব কিনা।
কিন্তু শাশ্বতীও কি ওর মতো বুদ্ধিহীন হবে?
ওই মালা দেবার অধিকারে অধিকার অর্জন করে শাশ্বতী তো দীর্ঘদিনের একটা অন্যায়ের শোধ নিতে পারে। সেই চেষ্টাই তবে করবে না কেন শাশ্বতী? সেই অধিকার অর্জনের চেষ্টাটা। ওই মাটির পুতুলটাকে একবার হাতের মুঠোয় পেলে, ভেঙে নতুন করে গড়তে কতক্ষণ?
.
নবনাটক সংঘের ছেলেরা অভিযোগ করে করে হতাশ হয়ে গেছে, তবু আশা ছাড়ে না।
তবু তারা তাদের একটা নাটক নামলেই একবার করে এসে হানা দেয়। কী হল চিরন্তনদা, আমাদের নাটক লিখে দিলেন না? শ্যামল আবার বলে, আমার অফিসের রিক্রিয়েশান ক্লাবও একটা নাটকের জন্যে হন্যে হয়ে মরছে, খুঁজে পাচ্ছে না।
আশ্চর্য! নাটক খুঁজে পাচ্ছে না? এত অজস্র নাটক ছড়ানো
শ্যামল জোরের সঙ্গে বলে, আছে অজস্র–গিরিশ ঘোষ থেকে বাদল সরকার পর্যন্ত, কিন্তু মনের মতনটি হচ্ছে না যে!…অফিসের সমস্ত স্টাফকেই যে নিতে হবে। পাওয়া যাচ্ছে না তেমন।…না না, অন্তত আপনি আমার অফিসের ক্লাবের জন্যেও লিখে দিন একটা। তবে ওই নারীচরিত্রটরিত্র একটু কম দেবেন, বড্ড খাঁই মেয়েগুলোর, আর ডাঁটই বা কী!…আর মেয়েচরিত্রগুলো প্রমিনেন্টও করবেন না বেশি। এমনিতেই তো ওরা সোনা মুক্তোয় জরি বেনারসিতে ঠাটঠমকে যথেষ্ট প্রমিনেন্ট হয়েই থাকে, তার উপর আবার যদি নাটকেওনা না, পুরুষচরিত্রগুলোই বেশ স্ট্রং করবেন। বিশেষ করে আমাদের জেনারেল ম্যানেজারের–ইয়ে নায়কের চরিত্রটা।…আসুন না একদিন একটু পরামর্শটৰ্শ করে
শ্যামল তার জেনারেল ম্যানেজারের জন্যেই চরিত্র চায়। তিনি সন্তুষ্ট হলেই তো হয়ে গেল কাজ।
.
আবার ক্লাবের ভবানীদা একদিন নিজের বাড়িতে টেনে নিয়ে গিয়ে বসান পরামর্শের জন্যে। ননীদার মতো আদি ও অকৃত্রিম না হলেও ভবানীদা এ ক্লাবের অনেক দিনের। ভবানীদারও চুল পেকেছে বোধহয়, অন্তরালে দুএকটা দাঁতও অন্তর্হিত হয়েছে। সামনের সারিটা ঠিক থাকলেও গালে সেই অন্তর্হিত হয়ে যাওয়া সম্পদের সকরুণ চিহ্ন ভাঙা-গহ্বর।
ভবানীদার অবস্থা ভাল, বসবার ঘরের চেহারা আধুনিক রুচিসম্মত, দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ, জানলায় ক্যাকটাস, মেঝেয় বাঁকুড়ার ঘোড়া। কিন্তু ভবানীদা যেন এদের কেউ নয়। চেহারায় সাজসজ্জায় ভবানীদা এখানে বেমানান।
চিরন্তনের মনে হল আগে কম বয়েসে যখন কখনও কখনও ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভবানীদাকে ডাকতে এসেছে, কিংবা চাঁদার খাতা জমা দিতে এসেছে, তখন ঘরের এমন সাজসজ্জা দেখেছে কিনা, বোধহয় দেখেনি। দেখলে হয়তো ওই বেমানান দেখানোর স্মৃতিটাও মনে থাকত। ভবানীদা তো চিরদিনই ওই মিলের ধুতি, আর লংক্লথের পাঞ্জাবির মধ্যে সমাহিত।
চিরন্তন সোফায় বসে পড়ে বলে, বাঃ ঘরটাকে তো বেশ সাজিয়েছেন ভবানীদা!
ভবানীদা উদাস কণ্ঠে বলেন, তোমাদের বেশ লাগলেই ভাল! আমার ভাল লাগে না।
ভাল লাগে না? কেন? আর তা হলে
ভবানীদা ওই তা হলেটার সূত্র ধরেই বলেন, ছেলের শখ! গিন্নিও ছেলের সঙ্গে নতুন আধুনিক হয়ে তার তালে নেচেছেন। সেকেলে মালপত্তর টান মেরে ফেলে দিয়ে ঘর সাজিয়েছেন। আমার ভাল লাগে না, বিড়ম্বনা মনে হয়। আমার সেই সাবেকি কালের তক্তপোশে ফরাস পাতা ঘরই অনেক আরামের ছিল।
চিরন্তনের এখন মনে পড়ে যায়।
হ্যাঁ, আগে তাই দেখেছে বটে!
বড় চৌকো একখানা ছ পেয়ে তক্তপোশে তোশক চাদর পাতা থাকত ভবানীদার ঘরে, ছোট ছোট কটা তাকিয়া গড়াগড়ি যেত তার উপর। অবশ্য সব সময়েই যে ফরসা ধবধবে থাকত তা নয়।
চিরন্তন হেসে ফেলে বলে, তা তাকিয়া নিয়ে গড়িয়ে বসাটা আরামের বটে!
কাজ করতে ইচ্ছে হলে, ওই গড়িয়ে বসেও অনেক করা যায় চিরন্তন, ভবানীদা আরও উদাস গলায় বলেন, এই বাড়ি আমার ঠাকুরদার আমলের, ওই চৌকি ফরাসও ছিল তখনকার। ঠাকুরদা বসে গেছেন তাতে, জেঠামশাই বসেছেন, বাবা বসেছেন, সেটাকে টান মেরে ছাতে ফেলে দিয়ে এল!
ভবানীদার মুখে যেন একটা সর্বহারার ছাপ।
চিরন্তন কি ওই সর্বহারা বেদনার জন্যে বেদনার্ত হবে? ওই হাস্যকর ভাবপ্রবণতার গায়ে সহানুভূতির হাত বোলাবে?
তা হয় না।
চিরন্তন যা স্বাভাবিক তাই করে।
চিরন্তন হেসে উঠে বলে, ছাতে ফেলে দেওয়াটা অবশ্য নিষ্ঠুরতা হয়েছে, কিন্তু এ যুগে আপনার ওই তাকিয়া ফরাস যে স্রেফ অচল ভবানীদা!
অচল? তা হবে। অতীতকে স্বীকার করাটাই যে এ যুগে অচল। কিন্তু তোমাদের ওই ডিভ্যানআর কুশন? ওগুলো মাথায় করে নিয়ে আসা চলে, কেমন? আসল কথা, পিতৃ-পিতামহের স্মৃতির প্রতি সম্মান এই শব্দটাই এ যুগে অচল, হাস্যকর! চৌকিটায় যখন টান দিল আমার যেন পাঁজরের হাড়গুলো মড়মড়িয়ে উঠল।
চিরন্তন এই পরিস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করে। চিরন্তনের মনে হয় মরতে আমি ঘর সাজানোর প্রশংসা করেছিলাম।
তবু চিরন্তন তার স্বভাবসিদ্ধ পরিহাসের ভঙ্গিতে বলে, তা কষ্ট হয়তো হল একটু, কিন্তু কিছু লাভও হল। বহুকালের পোষা ছারপোকার বংশটা লোপ হল।
ছারপোকার নাম ছার–পোকা, বুঝলি চিরন্তন? ওর কামড় তো চামড়ার উপর উপর। এমন বিষকীট আমরা সর্বস্ব ব্যয় করে পুষে থাকি, যা হাড়ে কামড় দিয়ে মজ্জা শুষে খায় বুঝলি?
চিরন্তন বুঝল ভবানীদা আজ বড় বেশি সিরিয়াস। এমনিতে ক্লাবে পুজো প্যান্ডেলে ভবানীদাকে ঠিক এ ধরনের লাগত না তো? অথবা এ ধরনের ছিলেনও না। এটা নতুন ধরন।
ভবানীদাকে যতদূর জানে, ভাল চাকরি করেন, বাপের দরুন ছিল-টিলও কিছু, একটা মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে, কৃতী হয়ে ফিরেছে একটা ছেলে বাইরে কোথা থেকে যেন, ভবানীদার তো এমন হতাশা হবার কথা নয়!
কেন হবে?
মেয়ে পাত্রস্থা, ছেলে কৃতী, বাপের দরুন পয়সা আছে, গৃহিণী লোকান্তরে যাননি, নিজে বয়েসের পক্ষে খুব একটা স্বাস্থ্যহীন নয়, তবে? .
চিরন্তন ভাবে, একেও কি লিলিমাসির ভূতে পেল নাকি? ভগবানের ভূত?
তা নয়, ভবানীদাকে জীবনের কথার ভূতে পেয়েছে। ভবানীদা সেই বস্তুটি দেখাবার জন্যেই টেনে এনেছেন চিরন্তনকে।
কোণে ছুঁচসুতো দিয়ে সেলাই করা গোছা তিনচার ফুলস্ক্যাপ কাগজে লিখিত সেই জীবনের কথা বার করে আনেন ভবানীদা নিজের ঘর থেকে। নিতান্ত নির্বেদের সঙ্গে বলেন, তুমি তো লেখো-টেখো ভাই, ওই সব প্রকাশকদের সঙ্গে চেনাশুনো আছে, আমার এই বইটি যদি একটু ছাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দাও। অবশ্য খরচা যা পড়ে আমি দেব।
খরচা আপনি দেবেন?
চিরন্তন বিস্ময়ের গলায় বলে, তা হলে তো সোজা কোনও প্রেসের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে–
না না, ভবানীদা চুপি চুপি বলেন, ওই খরচা দেওয়ার কথাটা ব্যক্ত করবার দরকার নেই, লোকে জানবে, যেমন তোমাদের বইটই ছাপে
আমার তো জীবনে দুটো চটি বই বেরিয়েছে ভবানীদা, তাও একটা কবিতার। চিরন্তন হাসে, কিন্তু আপনি হঠাৎ? কই আগে কখনও
না। আগে কোনওদিনই এ চিন্তা আসেনি ভাই, এখন এসেছে। বানানো নাটকও নয়, উপন্যাসও নয়, একেবারে আমার নিজের জীবনের কথা, খাঁটি কথা। এই লেখা আমি ছেপে বার করে জগৎকে শোনাতে চাই। দেখাতে চাই কীভাবে মানুষ নিজের সংসারে–নিজে নির্যাতিত হয়, নিপীড়িত হয়, অবাঞ্ছিত হয়। ভবানীদা আবেগরুদ্ধ গলায় বলেন, আমি ওদের চোখ খুলে দিতে চাই চিরন্তন! এই বই পড়তে পড়তে বুঝতে পারবে তারা, তাদের প্রকৃত চেহারাটা কী?
চিরন্তন মনে মনে হাসে।
ভাবে, কী অলীক কল্পনা!
আরশির সামনে দাঁড়িয়েই কি কেউ বুঝতে পারে নিজের চেহারাটা কী? বুড়ো যে এতটা ভাবপ্রবণ তা তো জানতাম না। হঠাৎ কোনও দাগাটাগা পেয়েছে না কি? এই বয়েসে আর কী দাগা পাবে? গিন্নি তো আর অপর কারও প্রেমে পড়তে যাবে না?
নাঃ, গিন্নি নয়, ছেলে।
সেই অগ্নিদাহে খাক হয়ে যাচ্ছেন ভবানীদা।
অলস ভাবে পাতা ওলটাতে ওলটাতে একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল–ভবানীদাও ঝুঁকে পড়ে সেখানে চোখ ফেললেন, ওঃ, এই পৃষ্ঠাটা দেখছ! দ্যাখো! দ্যাখো। বোঝো তোমাদের ভবানীদার অন্তরের জ্বালা!
দ্যাখে চিরন্তন
আমার, হ্যাঁ আমার সেই ছেলে, যাকে আমি তিল তিল করে বড় করে তুলেছি আদর্শের শিক্ষা দিয়ে, নীতির শিক্ষা দিয়ে, চরিত্র গঠনের শিক্ষা দিয়ে, যার জন্যে নিজের আরাম আয়েস স্বাচ্ছন্দ্য বিলাসিতা সব কিছু ত্যাগ করেছি, সংসারের সব রস গামছা মোড়া করে নিংড়ে বার করে করে যাকে উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত পাঠিয়েছি, যার পরীক্ষায় সফল হওয়ার খবরে আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি সন্দেশ বিলিয়েছি, সেই ছেলে, যে শৈশবে বাবা ভিন্ন কিছু জানত না, সেই ছেলে আজ লায়েক হয়ে প্রেম করে একটা নিচু ঘরের মেয়েকে বিয়ে করতে উদ্যত হয়েছে। শত নিষেধেও সংকল্পে অটল। সেই সিডিউল কাস্টের মেয়েটাকে আমার পিতৃ-পিতামহের উচ্চ বংশে এনে স্থাপিত করতে না পারলে, তার নাকি বেঁচে থাকার কোনও মানে থাকবে না।
আর আমার সহধর্মিণী?
বত্রিশ বছর ধরে যাঁকে আমি কত্রীত্বের উচ্চ শিখরে বসিয়ে রেখেছি, তিনি আজ তার প্রতিদান দিচ্ছেন, তাঁর ওই কুলাঙ্গার ছেলের দলে যোগ দিয়ে।…অতএব পরাজিত আমি, লাঞ্ছিত আমি, আমি এই নাটকের দর্শকের মতো–
চিরন্তন কষ্টে হাসি চেপে মুখে করুণ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বলে, কিন্তু ভবানীদা, নিজের পরাজয়ের কাহিনী, নিজের লাঞ্ছনার কাহিনী, এটা প্রকাশ করা কি ঠিক হবে?
কেন হবে না?
ভবানীদা উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলেন, শুধু তো আমার পরাজয়ের কাহিনীই নয়, ওদের কলঙ্ক কাহিনীও।
এ যুগে একে কেউ কলঙ্ক বলে না–ভবানীদা!
বলে না? কলঙ্ক বলে না?
না না! ওই প্রেমে পড়া-টড়া আপনাদের আমলে নিন্দের ছিল, একালে–।
আর এই যে বাপের অমতে নীচ ঘরে বিয়ে? এটাও কি তোমাদের কালে–
না, এটাও নিন্দনীয় নয় ভবানীদা, চিরন্তন কৌতুক ত্যাগ করে গম্ভীর গলায় বলে, আর ওই নীচ ঘর শব্দটাই নীচ মনে করে। জাত অজাত, উঁচু জাত নিচু জাত, এসব কথা এ যুগে উচ্চারণের অযোগ্য।
ভবানীদা চিরন্তনের মুখের দিকে তাঁর কোটরগত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন, ওঃ! উচ্চারণের অযোগ্য? আর এই যে বাপকে অপমান করা? বাপের বুকে দাগা দেওয়া? এটাও ভাল?
চিরন্তনের ওই মুখটা দেখে দুঃখ হয়, চিরন্তন অনুভব করতে পারে, আগুনটা ওঁর মিথ্যা কাল্পনিক হলেও তার জ্বালাটা ওঁর কাছে তীব্র তীক্ষ্ণ সত্য। উনি কষ্ট পাচ্ছেন। উনি বিদীর্ণ হচ্ছেন।
কিন্তু কারণটা?
হাস্যকর রকমের হাস্যকর!
ওঁর ছেলে ওঁর অমতে প্রেম করে বিয়ে করছে।
চিরন্তনের চোখে এই দাহর হাস্যকরতাটা বড় বেশিভাবে লাগে। তাই দুঃখ হলেও চিরন্তন বলে ওঠে, ওটাকে অপমান বলে ভাবছেন কেন? দাগা বলে ভাবছেন কেন? নিত্যকার ডালভাতের মতো একটা অতি সাধারণ স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করছেন না কেন?
অতি সাধারণ স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করব?
ভবানীদা আস্তে কাগজের গোছাগুলো ওর হাত থেকে টেনে নিয়ে একটি গভীর নিশ্বাস ফেলে বলেন, আমারই ভুল হয়েছিল চিরন্তন, এ জ্বালা বোঝবার ক্ষমতা তোমার না থাকবারই কথা। তুমি তো বাপ হওনি। বিয়েই করোনি। স্ত্রী পুত্র জিনিসটা যে কী জানোই না! থাক, তোমাকে আর ব্যস্ত করব না, তবে মরবার আগে এটাকে আমি ছাপিয়ে যাবই।…এ সংসারে আমার মতো অভাগা আরও আছে, তারা বুঝবে আমার অপমানদগ্ধ হৃদয়ের যন্ত্রণা। বুঝবে–নিজের সন্তানের হাতে বংশগৌরব ধ্বংস হলে বুক কতটা ফাটে।
তা হয়তো বুঝবে।
তবে সত্যিই চিরন্তনের নেই সেই যন্ত্রণা বোঝবার ক্ষমতা।বংশ-গৌরব! হুঃ!
চিরন্তনের মনে হয় এরা নিজের চিতার কাঠ নিজেই সাজায়, আর সেই চিতায় নিজেই আগুন জ্বেলে জীবন্ত পোড়ার যন্ত্রণায় ছটফট করে।
কিন্তু চিরন্তনই বা অহরহ যন্ত্রণায় ছটফট করে কেন? সেটা কীসের যন্ত্রণা?
অনুভবের যন্ত্রণা?
সমস্ত পৃথিবীটাকে তার বিরাট ফাঁকি সমেত ধরে ফেলার যন্ত্রণা?
না কি ওর মধ্যে যে লেখকসত্তা ছিল, তার নিষ্ক্রিয়তার জন্যে যন্ত্রণা?
চিরন্তনের সেই সত্তার তো প্রতিশ্রুতি ছিল, তবে চিরন্তন তাকে ঘুমিয়ে পড়ে থাকতে দিয়েছে কেন? তাকে জাগিয়ে তুলতে চাইছে না কেন?
শুধু অসলতা?
শুধু নির্বেদ?
অথচ চিরন্তন ভাবে, সে যে এই সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়, সেটা শুধু লেখার জন্যে মালমশলা সংগ্রহের আশায়।
চিরন্তনের সেই ভাবনাটা আত্মবঞ্চনা। আসলে চিরন্তন কিচ্ছু না, চিরন্তন তার বন্ধুর অফিসের জেনারেল ম্যানেজারকে ভূমিকা দিতে একটি মহৎ চরিত্রসংবলিত একখানা নাটক পর্যন্ত লিখে দিতে পারে না।
ছিঃ!
অথচ চিরন্তন
নাঃ, চিরন্তননকে তার এই অলসতা ত্যাগ করতে হবে।..
.
শ্যামলের অফিসের রিক্রিয়েশান ক্লাবের জন্যে না হোক, হয়তো নিজের রিক্রিয়েশানের জন্যেই চিরন্তন আজ খাতা কলম নিয়ে বসে।
চিরন্তন তার চোখের সামনে মেলে ধরে নাটকের মাল-মশলা। যা নাকি তার আশেপাশে ছড়ানো আছে।
ননীদার কথা ভুল নয়। আছে ছড়ানো। কিন্তু বড় বেশি সংখ্যায়। কোনটাকে বেছে নেবে চিরন্তন?
তার নিতান্ত পাশেই যারা রয়েছে?
তুচ্ছ সেই স্কুলমাস্টারটা, আর নেহাতই হায়ার সেকেন্ডারি পাস করা একেবারে মাঝারি চেহারার মেয়েটা?
তাদের কথা লিখবে চিরন্তন?
কিন্তু কী হবে সেটা? হাসির নাটক?
চিরন্তনের তো তাই মনে হচ্ছে। হাসিরই।
ওরা আইনের সাহায্যে বিয়ে করে ফেলেছে। এবং সে বিয়ে আবার হিন্দুমতে শুদ্ধি করেও নেওয়া হয়েছে। দাদা স্নেহের ছোটবোনকে সম্প্রদান করেছে, বউদি হেসে গড়িয়ে জামাইবরণও করেছে আর বলেছে, রেকর্ড স্থাপন করেছে আমাদের ধ্রুবময়। বিয়ের আগে থেকেই ঘরজামাই!
ঘরটা যে ওই জামাইটারই, সে কথা ওরা যেন হেসেই উড়িয়ে দিতে চেয়েছে। তাই বিয়েতে আলো জ্বালিয়েছে, বাজনা বাজিয়েছে, লোক ডেকে নেমন্তন্ন খাইয়েছে, লাল চেলি মুড়ে বাসরে বসিয়ে কড়িও খেলিয়েছে শাশ্বতীকে দিয়ে।…
আর মেয়ে বিদায়ের সময় মা কথ ঋষির মতো কন্যাবিরহ-পীড়িতও হয়েছেন।
হ্যাঁ…বিদায় দিতে হয়েছে বইকী!
ধ্রুবময় বলেছিল, এই বাড়িতেই দুধের পাথরে দাঁড়াবে নাকি শাশ্বতী? ছিঃ!
ধ্রুবময় তাই ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল।
সুপ্রভা নিজে গিয়ে সে ফ্ল্যাট সাজিয়ে দিয়ে এসেছিলেন।
অথচ সুপ্রভা মেয়ের বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত লুকিয়ে রাত্রে ঘরে আলো জ্বেলে অনাদির যৌবনকালের একখানা ফোটো আর ধ্রুবময়ের এখনকার একটা ফোটো পাশাপাশি রেখে চোখ ঠিকরে ঠিকরে দেখতে চেষ্টা করেছেন–দুটো মুখের কাঠামোর কোথাও কোনওখানে মিল আছে কিনা। নাকের খাঁজে, চোয়ালের গড়নে, কপালের প্রশস্ততায়।
এই চোখঠিকরানো খেলা সুপ্রভার আজকের নয়, বরাবরের। দেখেছেন, তুলে রেখেছেন আর ভেবেছেন, এখন কি টের পাওয়া যাবে? বালকের মুখে কি কাঠামো ধরা পড়ে?
মেয়ের বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত সুপ্রভা দিশেহারা হয়ে রাত জেগেছেন, অথচ আবার শেষরাত্রে উঠে দধিমঙ্গলের আয়োজন করতে বসেছেন।
আইনের খোঁচায় অধিকার অর্জিত হলেও মঙ্গলকাজগুলো হওয়া চাই বইকী! তার মধ্যেই তো কাব্য, তার মধ্যেই তো মাধুর্য! সেই কাব্য আর মাধুর্যের সম্ভার নিয়েই তো পতিগৃহে যাত্রা করেছে শাশ্বতী।
কিন্তু এখন সে তার সেই পতিকে প্রায় গৃহছাড়া করে তুলছে তার ন্যায্য দাবির জন্যে লড়তে।
ধ্রুব নামের ছেলেটা, যে স্বামী হয়েই স্বামী হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে বলছে বিয়ের আগের শর্তটা মনে রাখছ না তুমি। কিন্তু মনে রেখো আমি অতএব প্রতিজ্ঞা পালন করতে পারি।
কিন্তু শাশ্বতী তার হায়ার সেকেন্ডারির বিদ্যে নিয়েই বলছে, থামো। ন্যাকামি রাখো। আজকালকার দিনে কলকাতা শহরে ও বাড়ির দাম কত জানো?
সেই দাম জানতে, আর দাবি জানাতে শাশ্বতী ন্যাকা ছেলেটাকে লুকিয়ে উকিল বাড়ি যাওয়া আসা করছে, আর বলছে, রাগ করল তো বয়েই গেল, সত্যি তো আর ত্যাগ করতে পারবে না। ডবল বিয়ের ফাঁদে গাঁথা আছে বাবা! দিশি বিয়ে, বিলিতি বিয়ে!
আর মজা এই, সুপ্রভা দেবী মেয়ের এই অভিযানে সঙ্গিনী, সাহায্যকারিণী হচ্ছেন।… এতদিনে বুঝেছেন তিনি, ছেলের থেকে মেয়ে অনেক আপনার।
ছেলের সংসারে ছেলে তো পুতুল, মেয়ের সংসারে মেয়ে পুতুলনাচের সূত্রধারক। তবে বড় গাছে নৌকো বাঁধাই ভাল।
তা এ নাটক কি নাটক পদবাচ্য?
না, প্রহসন?
চিরন্তন ভালই জানে এ নাটকের নায়ক কোনওদিনই রামানুজের মতে মরিয়া হয়ে উঠে উপায় খুঁজে বেড়াতে যাবে না। এ নায়ক হয়তো নিজের অধ্যয়ন তপস্যার মধ্যে সিদ্ধির সার্থকতা খুঁজবে। আর নায়িকা তার সংসারকে বিকশিত করে তুলবে সোফা সেটি, কার্পেট, ফ্রিজ, ফুলদানি, জাপানি ডল, বাঁকুড়ার ঘোড়া দিয়ে সাজাবার জন্যে! বাড়িটা তো পেয়েই যাবে।
দূর দূর!
হাসির নাটকে রুচি নেই চিরন্তনের।
তবে কি ওই রামানুজকে নেবে?
যার সঙ্গে অনেকদিন আর সাক্ষাৎ নেই।
শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিনের কথাটা তাই খুব স্পষ্ট মনে আছে। এমনকী রামানুজের গলার স্বরটা যেন শুনতে পায় চিরন্তন ওর কথা ভাবলে।
শেষ পর্যন্ত রাঁচিতেই পাঠাতে হল, বুঝলি? না পাঠিয়ে উপায় ছিল না ভাই! ওকে দিতে না পারলে, আমাকেই রাঁচি যেতে হত। সিওর।
খুব সম্ভব রাঁচিতে পাঠানো গেছে রীতাকে।
কিন্তু রীতাকে কি তার আগে দেখেনি চিরন্তন? রাঁচি যাবার ঠিক আগে?
কবে যেন একদিন হয়েছিল দেখা।
কিন্তু ওদের বাড়িতে নয়, আর কোথায় যেন।
রীতার সঙ্গে চেনে বাঁধা সেই কুকুরটি ছিল ঠিক।
চিরন্তনকে দেখে রীতা হি হি করে হেসে বলেছিল, ভয় খাবেন না ভয় খাবেন না, এটা মেয়ে কুকুর।
চিরন্তন বলেছিল, আমার তো ধারণা ওদেরই কামড়ানোর টেনডেনসি বেশি।
আরে দূর দূর! ওরা কামড়ানো কামড়ানো খেলা করে, কামড়ায় না। বিষদাঁত তো নেই।
তারপর একটা অদ্ভুত হাসি হেসে বলেছিল, শিগগির চেঞ্জে যাচ্ছি, জানেন তো? আমার স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে বলে আমার স্নেহময় স্বামী আমাকে অনেক খরচপত্তর করে চেঞ্জে পাঠাচ্ছেন। ভারী নাকি সুন্দর জায়গা! গিয়ে আর ফিরতেই ইচ্ছে হবে না হয়তো। তা হলে আর দেখাই হবে না। টা টা!
হাত তুলে এগিয়ে গিয়েছিল।
সেদিন চিরন্তন ওই চেঞ্জের জায়গাটার নাম জানতে পারেনি। পরে রামানুজের কাছে জেনেছিল।
এদের নিয়েই কি তবে লিখবে চিরন্তন?
কিন্তু কী হবে সেই নাটক? নায়ক-প্রধান না নায়িকা-প্রধান?
চিরন্তন আজও ধাঁধায় আছে।
রীতা যদি সত্যি পাগল না হয়, রীতা কি স্বাভাবিক? রীতাকে নিয়ে ঘর করা যায়? যে মেয়ের জীবনের ব্রত স্বামীকে লোমাজে অপদস্থ করা, তাকে নিয়ে কী করবে তার স্বামী?
অথচ চিরন্তন নিজে রামানুজের সেই হিংস্র মুখ দেখেছে। দেখেছে রগের শিরার স্ফীতি, চোয়ালের কাঠিন্য। আর সেই তার কুটিল চক্রান্তের কণ্ঠ… এটা একটা ডিভোর্সের কজ হয় না?
রামানুজ দাম্পত্যবন্ধন থেকে মুক্তি চেয়েছিল।
রীতাকে অসতী প্রতিপন্ন করতে পারলে সেই মুক্তিটা সহজলভ্য হত রামানুজের। তাই রামানুজ তার বন্ধুদের ডেকে ডেকে বাড়ি নিয়ে যেত, আর বলত তোর জন্যে আমার বউ মরছে।
শুধু চিরন্তনকে নয়, এ কথা রামানুজ দিলীপকে বলত, প্রসূনকে বলত, চৌধুরীকে বলত। ব্রিজের আড্ডায় রামানুজের এই পত্নীবাৎসল্য নিয়ে হাসাহাসি হত। শুধু দিলীপ বলত–বউটাকে ঘাড় থেকে নামাবার জন্যে আমাদের ঘাড় ভাঙতে চায় হতভাগা। কে ফাঁদে পড়তে যাবে?
কিন্তু অমন রূপসী এবং বহু গুণবতী বউকে ঘাড় থেকেই বা নামাতে চেয়েছে কেন রামানুজ?
তা কেউ বলতে পারে না।
রামানুজ কি আর কোথাও মন বাঁধা দিয়ে বসেছিল?…না, রামানুজ শুধু বন্ধক দেওয়া জীবনটাকে ছাড়িয়ে দিয়ে মুক্তির নিশ্বাস নিতে চেয়েছিল। সেই নিশ্বাসটা নিতে না পারায় দম আটকে অমন হিংস্র হিংস্র দেখতে হয়ে গিয়েছিল সে?
চিরন্তন ভাবল, আমি ওদের কেবল অ্যাভয়েড করতেই চেষ্টা করেছি, আমি সন্ধান করতে চেষ্টা করিনি ট্র্যাজেডিটা কোথায়! ওদের নিয়ে লিখব কী করে আমি?
তবে কি চিত্তব্রত?
নিজমনেই হেসে উঠল চিরন্তন।
সেই লোকটা? বারো বছর ঘর করা বউ গলায় দড়ি দিয়ে মরার পাঁচ মাস পরেই যে লোকটা আবার বিয়ে করে বসল ঘর চলছে না বলে!
লোকটাকে আমি বন্ধু বলতাম! ছি ছি! ওর থেকে ওর মা হেমলতা দেবী বরং ভাল। সোজা স্পষ্ট খাঁটি। তাঁর বাইরেটাই তাঁর ভিতরের দর্পণ। আর চিত্তব্রত? রাম রাম! সেই বিয়েতে আবার বউভাতে নেমন্তন্ন করতে এসেছিল। বলে কিনা আমারই না হয় ভাই দুবারের পুরনো ব্যাপার, ও বেচারির তো নতুন? ও তো জ্ঞানাবধি বউভাতের এই চেহারাটাই দেখে এসেছে?…কিছু না করলে বড় হতাশ হবে। বেশি কাউকে বলছি না–শুধু এই তোদের মতো দুচার জন অন্তরঙ্গ বন্ধুকে
আমি তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু নই চিত্ত- মুখের ওপর বলেছিল চিরন্তন, মুখের আলাপ মাত্র। আমাকে তোমার এ লিস্ট থেকে বাদ দাও।
চিত্তব্ৰত ফোঁস করে বলে উঠেছিল–আমার বউকে তুই ইয়ে করতিস তা জানি। কিন্তু আমি তাকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিইনি। সে আমায় যা বিপদে ফেলে, আর যা জব্দ করে গেল! অথচ অকারণ। কেন, ওই বাড়িতে কি আর কেউ বাস করছে না?
চিরন্তন বলেছিল, তোমার ঘরে বাস করছে না।
ওঃ সব দোষ তা হলে আমারই? বেশ, বলো। তবে এইটি জেনে রেখো চিরন্তন, আমি যদি লোক খারাপ হতাম, তা হলে আর আমার শালিই আমার গলায় মালা দিত না।
শালি!
অস্ফুটে বোধ করি কথাটা বলে ফেলেছিল চিরন্তন। চিত্তব্ৰত মৃদু হেসে একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছিল, হ্যাঁ, নিজের ছোট শালি। ও মরতে তো শ্বশুরবাড়িতেই ঠেলে উঠেছিলাম বাচ্চাগুলোকে টোপ দিয়ে। কে দেখত তা নয়তো মা মরা বাচ্চাদের?…তা শাশুড়ি নিজেই বললেন, জানি লীলা চিরদিনই অবুঝ অভিমানী ছিল। কিন্তু আমার এমন সোনার জামাই পর হয়ে যাবে, এ তো প্রাণে সইবে না বাবা! আমার ইলাকে তুমি নাও। নিতেই হল। আর আমারও তো দরকার।
মৃদু একটু হেসেছিল।
চিরন্তন ভেবেছিল, তা বটে!
দরকার!
আর দরকার নিয়েই তো পৃথিবী।
কিন্তু সেই দরকারি বস্তু নিয়ে নাটক লেখা যায় না। আর সেই দরকারের যজ্ঞে নেমন্তন্ন খেতে যাওয়াও যায় না।
নায়িকা ছেড়ে দিয়ে শুধু নায়ক নিয়ে লিখবে চিরন্তন?
তা ননীদাকে নিয়ে লিখতে হলে, তাই লিখতে হবে। ননীদার জীবনে নায়িকা কোথায়? তবে যদি বলা যায় এই নবনাটক সংস্থাই ননীদার জীবননায়িকা?
ননীদার তার উপর ভালবাসা, ননীদার তার জন্যে ত্যাগ স্বীকার, ননীদার তার জন্যে আবেগ আকুলতা, বিরহ মিলনের স্বপ্ন। যার সব কিছুই নায়িকার প্রতি প্রযোজ্য।
অথবা ননীদার জীবনে আজও সত্যিকার নায়িকা আসেনি। সেই নায়িকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন ননীদা।
সত্যিকার মনের মতো একটি নাটক।
ননীদা খুঁজে খুঁজে ক্রমশ হতাশ হচ্ছেন। বলছেন, এত অজস্র পড়ে রয়েছে, কিন্তু মনের মতো পাচ্ছি না একটাও। ঠিক তোর কনের মতো চিরু। দেশে এত এত লাখ লাখ তরুণী রয়েছে, তবু তুই তার থেকে তোর মনো বৃত্তি অনুসারিণী একটা ভার্যা খুঁজে পেলি না! সংসারের এইসবই হচ্ছে নাট্য উপাদান, বুঝলি? ছড়ানো আছে। অথচ কুড়িয়ে নেওয়ার ক্ষমতা নেই।
.
ননীদার সেদিনের কথাটা যেন একটা হঠাৎ আলোর মতো লেগেছিল চিরন্তনের।
এত লাখ লাখ মেয়ে রয়েছে, তার থেকে একটা মনের মতো মেয়ে জুটছে না চিরন্তনের।
অথচ সত্যিই তেমন মেয়ে চোখে পড়েনি চিরন্তনের।…
এইখানে একটু থমকেছিল চিরন্তন।
ভেবেছিল, একেবারেই চোখে পড়েনি কি?
চিরন্তনের একটা বর্ষণমুখর সন্ধ্যা মনে পড়েছিল।…চিরন্তনের একটা জলে জলময় রাস্তা মনে পড়েছিল, মনে পড়েছিল একটি স্নিগ্ধ শীতল আধারে ভরা খানিকটা প্রজ্বলিত আগুন।
চিরন্তন সেই আগুনের ধারে ঘুরে মরেছিল পাখা পোড়াবার আশায়। কিন্তু আগুনটা ক্রমশই যেন ঠাণ্ডা মেরে গেল। ওই আধারটাই ওর উপর শক্ত করে চেপে বসল। আধার ভেঙে জ্বলে উঠে, ঘুরে মরা পতঙ্গের পাখা পোড়াবার বদলে আস্তে আস্তে ছাই হয়ে গেল।…মনীষা নামের মূর্তিটাও হারিয়ে গেল কোথায় কোন দূর পাড়ায় পার্কের মাঠে।
কে জানে সেখান থেকে কোনও একটা ছোট রঙিন জামার পিছু পিছু এগিয়ে মনীষা কোনও বড় বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে কিনা।
চিরন্তনের সে নাটকের প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই।
চিরন্তন মনে মনে বলে, আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি ইতিহাসের পৃষ্ঠা ছাড়া কোনও বিরাট চরিত্রের দেখা পাচ্ছি না। এটা আমার ভাগ্যের অভিশাপ, না আমার যুগের অভিশাপ?
আমি তবে কাকে শ্রদ্ধা করব?
কাকে প্রণাম করব?
আমি কি আমার সেই বাল্যকালের স্কুলের হেডমাস্টারমশাইকে প্রণাম করব?
যিনি আমাদের পিঠে হাত বুলিয়ে আর বাবা বলে ভিন্ন কথা বলতেন না। যিনি অন্য মাস্টারমশাইরা ছাত্রদের শাসন করলে ছাত্রদের হয়ে লড়তেন। যাঁর সৌম্য চেহারা মনে করলে এখনও মন কেমন করে। যদিও ঠিক এক্ষুনি তাঁর নামটা আমি মনে আনতে পারছি না।
কিন্তু ভারী একটা মুশকিল যে, আমরা জেনে ফেলেছিলাম স্কুলের সেক্রেটারির ছেলে আর ভাইপোকে ভিন্ন অন্য ছেলেকে ফাস্ট হতে দিতে বাধত তাঁর।…আর লুকিয়ে সেক্রেটারির বাড়ি গিয়ে আগে থেকে প্রশ্নপত্র দিয়ে আসতেন তাদের।
ওইটা জানার পরই ওঁর নামটা ভুলে গিয়েছিলাম। অথচ চেহারাটা এখনও মনে আছে। কিন্তু প্রণাম করতে গেলেই সেই রাত্রের অন্ধকারে লুকিয়ে সেক্রেটারির বাড়ি যাওয়ার চেহারাটা কল্পনায় এসে যায়।
জানি–
একটা সামান্য স্কুলের হেডমাস্টারকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে হয়, অতএব লড়তে হয় লোভের সঙ্গে, দুর্নীতির সঙ্গে। কিন্তু জেনে আমার জ্ঞানবুদ্ধি হল, আর কী ঘণ্টা হল?…
.
তবে কি আমার সেই আযৌবনের আদর্শ কবি অমিত বোসকে প্রণাম জানিয়ে নিয়ে আসব আমার কলমের জগতে?
শুরু করব তাঁর সেই অনবদ্য অভিব্যক্তিময় কবিতাগুলি প্রথম পড়বার স্বাদ নিয়ে? ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বিকশিত হব প্রথম দেখার অনুভূতি দিয়ে!
আচ্ছা! এ কথা এতদিন মনে আসেনি কেন আমার? সেই অনুভূতি তো সত্যি অপূর্বই হয়েছিল!
প্রথম দেখেছিলাম তাঁকে এক পত্রিকার অফিসে। বুদ্ধিদীপ্ত মুখে ঈষৎ উন্নাসিকতার আভাস। যেটা থাকলে অভিজাতদের মানায় না। বংশগত আভিজাত্যে নয়, বুদ্ধির আভিজাত্যে। দীর্ঘদেহী নয়, বরং বলতে পারা যায় বেঁটে খাটো। কিন্তু সেই খাটোত্বটা চোখে পড়েনি চিরন্তনের অমিত বোসের আত্মস্থ ভঙ্গির চলনে, বলনে, বিশেষ ছন্দের একটি উচ্চারণে।
অমিত বোসের সামনে বসে নিজেকে ভারী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লেগেছিল চিরন্তনের। হয়তো অমিত রোসের দৃষ্টির ছায়া সেটুকু। অমিত বোস তিনি ব্যতীত আর সকলকেই নিতান্ত ক্ষুদ্র দেখে থাকেন।
পত্রিকার ওই অফিসে কীসের যেন একটা আলোচনাসভা ছিল। বোধহয় আধুনিক কবিতা নিয়ে।
অমিত বোসের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যা কিছু শুনছেন, যেন অমৃতং বালভাষিতং। তা সেটাই হয়তো সত্যি! পাণ্ডিত্যের আর উপলব্ধির যে উচ্চস্তরে বিরাজিত তিনি, সেখান থেকে ওইসব সাধারণ মানুষকে ছোটই দেখায়।
চিরন্তন সেই উচ্চতা দেখে মোহগ্রস্ত হয়েছিল সেদিন। চিরন্তন তাঁর অনুসরণ করে একদিন তাঁর মুখোমুখি পৌঁছেছিল। চিরন্তনের ওই অধ্যবসায়ের প্রতিদানে তিনি একটু কৃপা-হাস্য বিতরণও করেছিলেন।
চিরন্তন ধন্য হয়ে ফিরেছিল।
তারপর চিরন্তন অবিরত তাঁর কবিতার অনুকরণে কবিতা লিখে চলেছিল, চিরন্তন ওঁর সেই মস্তিষ্কপ্রসূত কবিতাগুলিকে বুঝবার চেষ্টা করতে অনেক বিনিদ্র রাত্রি ছটফটিয়ে বেড়িয়েছিল। কী রহস্যের ব্যঞ্জনাময়! কী অদ্ভুত প্রতাঁকের ব্যবহার! কী গভীর উপলব্ধির সমুদ্র ভাসা!
চিরন্তন সেই দিনগুলোর অনির্বচনীয় স্বাদের কথা দিয়ে ভরিয়ে একটি মহৎ কবির চরিত্র আঁকতে পারে।
পারে।
ওইটুকু পর্যন্ত পারে।
বিস্ময় দিয়ে শ্রদ্ধা দিয়ে মুগ্ধতা দিয়ে।
কিন্তু তারপর? তারপর অনেকবার দেখেছে। কফি হাউসে, প্রকাশকের দোকানে, বন্ধুর গাড়িতে। কিন্তু, তারপর আর এগোবে কী করে?
তারপর যে চিরন্তন আধুনিক বিদেশি কবিদের কবিতা পড়তে শুরু করেছিল, আর সেই শুরুর সূত্রে আর এক নতুন বিস্ময়ের আঘাতে প্রায় ছিটকে উঠেছিল। তারপর শুয়ে পড়েছিল।
অমিত বোসের মস্তিষ্কের উৎসের সন্ধান পেয়ে পুরো দিনটা বিছানা থেকে উঠতে পারেনি চিরন্তন। আহা, নেহাতই সদ্য তরুণ ছিল কিনা!
সেই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে এখন ভারী হাসি পায় চিরন্তনের। কৌতুকের হাসি।
অমিত বোসকে ছেড়ে দিল চিরন্তন।
সরিয়ে রাখল ঈষৎ হেসে।
ভাবল–তা হলে কি আমার সেই শৈশবে দেখা কাটোয়ার পিসেমশাইকে উলটে দেখব? মালতী পিসির বর, নীলমণির বাবা?…যে নীলমণির নামটা পরে ধুময় হয়ে গিয়েছিল? মালতী পিসে চিরন্তনদের বাড়িতে আসতেন।
বছরে দুচারবার তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এসে ধরে দিতেন স্ত্রীর বাল্যপ্রণয়ীর কাছে। আত্মীয় সম্পর্ক একটা ছিল অবশ্য, আর সেটুকুই সুবিধে ছিল, কিন্তু সে সম্পর্কটা এতই দূর যে, ধর্তব্যই নয়।
কিন্তু ভদ্রলোক আসতেন। রাশি করে বাগানের ফল, পুকুরের মাছ, কাটোয়ার পান্তুয়া আর রূপবতী স্ত্রীটিকে নিয়ে এসে উপঢৌকন দিতেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে। তাঁদের সেই আসার সময়কার আনন্দমুখর ছবির স্মৃতিটা মনে আছে চিরন্তনের।
পিসেমশাই বলতেন, তোমরা থিয়েটার দেখোগে বাবা, আমি একটু ঘুমিয়ে নিই।
যেন তাঁর কাটোয়ার বাড়িতে ঘুমের জন্যে জায়গা ছিল না।
আসলে ছেড়ে দিতেন তাঁর মালতাঁকে। কিন্তু সেই মানুষই টি বি হয়ে কিছুতেই হাসপাতালে যেতে চাইলেন না। চাইলেন না সেবার জন্যে নার্স রাখতে, অহরহ রোগশয্যার পাশে রেখে দিলেন তাঁর প্রিয়তমা পত্নীকে।
অতএব মৃত্যুকালে স্ত্রীকে তাঁর স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির সঙ্গে নিজের দীর্ঘদিনের ব্যাধিটিও দানপত্র করে গেলেন।
একথাও নাকি বলেছিলেন তিনি, তুমি অনাদির কাছে চলে যেও, ও তোমায় ফেলতে পারবে না প্রতাপ শৈবলিনীর ভালবাসা
এই ভদ্রলোককে কী বলবে চিরন্তন?
প্রেমিক?
মহৎ?
হৃদয়বান?
বুঝে উঠতে পারছে না।
ভাবতে গেলেই মালতী পিসির সেই কঙ্কালসার চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শেষ যা দেখেছিল। অবশ্য একবারই দেখেছিল। কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন তাকে অনাদি এক্সরে করাতে।
কিন্তু তারপর আর করাবার দরকার হয়নি বোধহয়। আর আসেননি মালতী পিসি। অনাদিই যেতেন কাটোয়ায়।
.
তবে কি চিরন্তন তার সেই কর্পোরেশনের বিদ্যাবু বাবাকেই আদর্শচরিত্র বলে ভাবতে শুরু করবে? যিনি সংক্রামক রোগ-ভীতি তুচ্ছ করে বাল্যবান্ধবীর মৃত্যুশয্যার পাশে ছুটে ছুটে যেতেন?
হয়তো তাই ভাবত চিরন্তন।
ঘুষের টাকায় রামরাজত্ব করে সংসার চালালেও।
কিন্তু মানুষটা সম্পর্কে অঙ্কটা যেন ঠিক মেলে না। তিনি কি বাল্যবান্ধবীর বোগশয্যার পাশে গিয়ে বসবার জন্যেই ছুটে ছুটে যেতেন? না কি তার বাগান পুকুর ধানজমি খামারবাড়ির হিসেব মিলোতে যেতেন?
মহিলাটির মৃত্যুকালে তার নাবালক ছেলেটার সম্পূর্ণ ভার নেবার প্রতিশ্রুতি দেবার পিছনে নাবালকের সম্পত্তির অছি হবার উদ্দেশ্যও ছিল? না, শুধুই মৃত্যুপথযাত্রিণীকে স্বস্তি দেওয়ার মহৎ মনোবৃত্তি ছিল?
অঙ্ক মিলোনো শক্ত।
ছেলেটাকে এনেছিলেন কিন্তু তাকে উচিত ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি।
গৃহিণী সুপ্রভাকে ভয় ছিল তাঁর।
কে জানে ওই গৃহিণী সুপ্রভাকে সন্তুষ্ট করতেই নাবালকের সমস্ত সম্পত্তি বেচে দিয়ে সেই টাকায় নিজের নামে বাড়ি বানিয়েছিলেন কিনা।
যখন দেখলেন, আর ভয় না করলেও চলে তখন ধর্মজ্ঞানের ভান করলেন।…না কি সেটাই সত্যি?
যখন ভোগের কাল ছিল, তখন লোভের কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন, সে কালটা ফুরোলে, ধর্মকে তাক থেকে পাড়লেন। অথবা ওই যে কী বলে অনুতাপ না কী, হয়তো তাই।
জনক-জননী মাতা-পিতা কী সুন্দর শব্দ।
অথচ সেই সুন্দরের সৌন্দর্য অনুভব করবার ভাগ্য চিরন্তনের হয়নি।
যাদের হয় তারা কী ভাগ্যবান।
কিন্তু কতজনের হয়?
চিরন্তন জানে না কার হয়, কতজনের হয়, চিরন্তনের হয়নি সে ভাগ্য। চিরন্তনের প্রণামের ইচ্ছেটা ব্যর্থতার শূন্যতায় হারিয়ে যায়।
চিরন্তনের মাকে মা বলে ভাবতে কষ্ট হয়।
যখন চিরন্তন জানত মা তাঁর নিজস্ব জগতে, বড়ি আচার আমসত্ত্ব, আর তেল নুন লকড়ির জগতেই আবর্তিত, তখন চিরন্তনের এ কষ্ট হত না! তখন শুধু চিরন্তন মাকে ভুলে যেত মাঝে মাঝে।
কিন্তু এখন চিরন্তন মাকে ভুলে যেতে পারছে না। কারণ চিরন্তন তার মার অগাধ মাতৃস্নেহের চেহারা দেখেছে, মাকে পাশাপাশি দুখানা ফোটো নিয়ে চোখ ঠিকরে বসে থাকতে দেখেছে, আর এখন মাকে ফরসা থান আর সিল্কের চাদর পরে উকিলবাড়ি যাওয়া আসা করতে দেখছে।
কে জানে, সুপ্রভা দেবী আস্তে আস্তে হেমলতা দেবী হয়ে যাবেন কিনা।
তবে কি রীতা নামের সেই মেয়েটাকে স্মরণ করা যায়?
যে মেয়েটা হেসে হেসে বলে গেল, খুব ভাল জায়গায় চেঞ্জে যাচ্ছি, হয়তো আর ফিরতেই ইচ্ছে করবে না।…টা টা!
ওই চেঞ্জে পাঠানোর স্বরূপ উদঘাটন করতে বসেনি রীতা। অনায়াসে সমস্ত পরিচিত জগৎকে টা টা করে ট্রেনে চড়ে বসেছিল হেসে হেসে।
রীতার সেই শ্যাম্পুকরা ফাঁপানো চুলে ঘেরা মুখটাকে মনে পড়ে হঠাৎ ভারী মন কেমন করছে চিরন্তনের। চিরন্তন তার খাতায় কলমটা ঠেকিয়ে আস্তে আস্তে বুলিয়ে বুলিয়ে লিখছে–আমি কি তবে রীতাকেই ভালবেসেছিলাম?
চিরন্তন ননীদার ক্লাবের নাটক কোনওদিন লিখে দিতে পারবে না।
চিরন্তনের মতো ছেলেদের দিয়ে কিছুই হয়ে ওঠে না। যারা বাজে, যারা নির্বোধ, যারা আবেগে অস্থির, তারাই ঘোরায় এই পৃথিবীর কর্মচক্র। লিখলে শ্যামলই হয়তো লিখে নেবে তার স্ক্রিপটু।
চিরন্তন শুধু বসে বসে ভাবে–নাটক লিখলে ননীদাকে নিয়ে লেখা যায়।
অথচ যখন খাতা কলম নিয়ে বসবে, তখন আস্তে আস্তে বুলিয়ে বুলিয়ে লিখবে, অথচ আমি রামানুজকে বলেছিলাম, আমি তো তোর বউয়ের প্রেমে পড়িনি।