দুপুরবেলা ভাত খেয়ে গৌর যখন পুকুরে বাসন মাজছে, তখন দেখল, পাশের কচুবনের মধ্যে একটা লোকের মাথা। উবু হয়ে হয়ে কী যেন খুঁজছে। কৌতূহলী হয়ে গৌর উঠে ভাল করে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, “ওখানে কে গো?”
লোকটা মুখ তুলে তার দিকে চেয়ে একটা ধমক দিল। “কাজের সময় কেন যে এত চেঁচামেচি করিস।”
গৌর দেখল, গোবিন্দদা। চাপা গলায় সে বলল, “গোবিন্দদা! ওখানে কী করছ তুমি?”
“করছি তোর মাথা আর মুণ্ডু! কাছে আয়।”
গৌর একটু অবাক হল। তারপর হাত ধুয়ে গুটিগুটি গিয়ে কচুবনে সেঁধোল। দেখল, গোবিন্দ একটা তামার ঘটে জল নিয়ে তার ওপর একখানা সিঁদুরমাখানো ছোট্ট আয়না ধরে চারদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী যেন দেখছে। দেখতে দেখতে বলল, “সন্ধান প্রায় পেয়ে গেছি। পশ্চিম দিকেই ইশারা দিচ্ছে।”
গৌর উদগ্রীব হয়ে বলল, “কবচটা?”
“তবে আর কী খুঁজব রে গাড়ল! ইশ, কাল রাতে কী চোরের মারটাই না খেলি গুড়াদুটোর হাতে!”
“তুমি দেখেছ!”
“চোখের পাতা না ফেলে দেখেছি। প্রথম থেকে শেষ অবধি।”
গৌর অভিমানের গলায় বলল, “তবু আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করোনি? তুমি কেমনধারা ভালবাসো আমায়?”
গোবিন্দ খিঁচিয়ে উঠে বলে, “হ্যাঁ, তোকে বাঁচাতে গিয়ে দু-দুটো গুন্ডার হাতে হাড় ক’খানা ভেঙে আসি আর কী! তা তুইও তো ঘাড়েগদানে কম নোস, নিজেকে বাঁচাতে হাত-পা ছুঁড়তে পারলি না? নিদেন কামড়েও তো দিতে পারতিস!”
গৌর মুখ গোমড়া করে বলে, “সেটা পারলে আর কথা ছিল নাকি! ওরা কুটুম-মানুষ না! কুটুমের গায়ে হাত তোলে কেউ? আর তুললে দাদাই কি আমাকে আস্ত রাখবে?”
গোবিন্দ ভেবেচিন্তে বলল, “তা বটে। তা খেয়েছিস না হয় একটু মারধর। কিল, চড়, ঘুসি, চুলের গোছায় টান, এ-সব এমনিতে খেতে ভাল লাগে না বটে, তবে ওসব খেলে গা-গতর বেশ শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে, গায়ের জোর বাড়ে, মনের জোরও বাড়ে। যে-সব ছেলে মারধর খায় না, তারা একটুতেই দেখবি কাহিল হয়ে পড়ে। তা ছাড়া মারধর খেলে ভয়ডরও চলে যায়। এতে তোর ভালই হচ্ছে।”
গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “পেটে খেলে পিঠে সয়– কথাটা তো জানেনা! আমার কপালে পেটে কিছু নেই, কিন্তু পিঠে আছে।”
গোবিন্দ জবাব দিল না, দর্পণে কী যেন ইশারা পেয়ে বনবাদাড় ভেঙে পশ্চিম দিকে ধেয়ে চলল। পিছু পিছু গৌর। দন্তকলসের জঙ্গল, ভাটগাছ আর বিছুটিবন পেরিয়ে একটা ঢিবির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল গোবিন্দ। ঢিবির গায়ে একটা বড়সড় গর্ত। ছুঁচোর বাসাই হবে। সেই গর্তের সামনে দর্পণটা ধরে থেকে গোবিন্দ একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে বলল, “হয়েছে।”
“কী হয়েছে গোবিন্দদা?”
“গর্তের মধ্যেই আছে। দৌড়ে গিয়ে একটা শাবল নিয়ে আয়।”
চোখের নিমেষে গৌর দৌড়ে গিয়ে শাবল আনল। গোবিন্দ গর্তটার মুখে শাবল ঢুকিয়ে চাড় দিতেই ঢিবির অনেকটা অংশ ঝুরঝুরে হয়ে ভেঙে পড়ল। গোবিন্দ খানিক মাটি সরিয়ে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিতেই বাচ্চাসমেত তিনটে ধেড়ে ছুঁচো বেরিয়ে কিচিক-মিচিক শব্দ করে দিগবিদিক হারিয়ে ছুটে পালাল। গোবিন্দ বগল পর্যন্ত হাত ঢুকিয়ে খানিকক্ষণ হাতড়ে অবশেষে যখন হাত বের করে আনল, তখন তার হাতের মুঠোয় কবচ।
গৌরের চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল। চেঁচিয়ে বলল, “এই তো আমার কবচ!”
গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল, “সে তো ঠিকই রে। অসাবধানে রেখেছিলি বলে ছুঁচোয় মুখে করে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু অত আনন্দ করার মতো কিছু হয়নি।”
“কেন গোবিন্দদা, তোমরাই তো বলো, একবচের নাকি সাংঘাতিক গুণ!”
“সেটাও মিথ্যে নয়। তবে যোগেশ্বরবাবার দেওয়া ও কবচ হচ্ছে ঘুমন্ত। ঘুমের মধ্যে কি তুই কাজ করতে পারিস?”
“না তো!”
“তা হলে ও কবচটাও পারবে না। ওটাকে জাগাতে হবে।”
“কী করে জাগাতে হয়?”
“সে আমি কী জানি? আমার ছিল কবচ খুঁজে দেওয়ার কথা, দিয়েছি। এখন যার কবচ, সে বুঝবে।”
“কিন্তু না জাগলে আমি জাগাব কী করে?”
গোবিন্দ একটু হাসল। বলল, “সে ঠিকই জানতে পারবি। এখন কোমরে একটা কালো সুতোয় ভাল করে কবচটা বেঁধে রাখ। যেন না হারায়। সময় হলেই কবচকে ঘুম থেকে তোলা হবে। এখন কাজে যা। ঘাটে বাসন ফেলে এসেছিস, একখানা চুরি গেলে তোর বউদি আস্ত রাখবে না।”
গৌর তাড়াতাড়ি ঘাটে ফিরে গেল।
বিকেলবেলায় কবচটা খুব সাবধানে কোমরে বেঁধে নিল গৌর। তারপর গোরুর জাবনা দিয়ে, গোয়ালে সাঁজাল দিয়ে কাজ সেরে ফেলতে গেল।
হাডুডু সে খুবই ভাল খেলে। অফুরন্ত দম, একদমে তিন-চারজনকে মেরে দিয়ে আসে। যাকে জাপটে ধরে, সে আর নিজেকে ছাড়াতে পারে না।
গৌরের দল রোজই জেতে। আজও তারা তিন পাটিই জিতল। কিন্তু জিতেও গৌরের সুখ নেই, বরং উলটে তার ভয় হল। বেশি খেলাধুলো করলে খিদেটাও যে বেশি পায়। রাতের খাওয়া বন্ধ, খিদে পেলে পেটের জ্বালা জল ছাড়া আর কিছু দিয়ে তো মেটানো যাবে না। গোবিন্দদা যদি আজ না আসে বা এলেও যদি রুটি আনতে ভুলে যায়, তা হলে কী হবে?
খেলার পর মাঠের ধারে বসে রোজই গৌর বন্ধুদের সঙ্গে একটু গল্পগাছা করে। আজও করল। তারপর বাড়ি যাবে বলে সবাই যে যার পথ ধরল।
বাজারের কাছ দিয়ে আসার সময় তেলেভাজার ‘ম ম’ গন্ধে গৌর দাঁড়িয়ে গেল। বলতে নেই, তার খিদে পেয়েছে। তেলেভাজার গন্ধে সেই খিদেটা এখন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। হরিপদ আজ হিং দিয়ে আলুর চপ আর ফুলুরি ভাজছে। কী যে বাস ছেড়েছে, সে আর বলার নয়। ইচ্ছে করে, লাফিয়ে পড়ে থাবিয়ে সব খেয়ে নেয়।
কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো হল না। আইনকানুন আছে, সহবত আছে, চক্ষুলজ্জা আছে। গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরিপদর দোকানটা এড়িয়ে বটতলার ঘুরপথটা ধরল। এ-পথটা অন্ধকার, নির্জন। তা হোক, তবু ফুলুরির দোকানের সামনে দিয়ে না যাওয়াই ভাল। তার লোভী চোখের নজর লাগলে ও ফুলুরি আর তেলেভাজা যে খাবে, তারই পেটের অসুখ করবে। ৪৮
বটতলার মহাবীরের থান পেরোলেই আমবাগান। সেখানে জমাট অন্ধকারে থোকা থোকা জোনাকি জ্বলছে। ঝিঝি ডাকছে খুব। সামনেই সরকারদের পোড়ো বাড়ি, যেখানে কন্ধকাটা ভূত আছে বলে সবাই জানে। সন্ধের পর এ-পথে কেউ বড় একটা হাঁটাচলা করে না। গৌর যে খুব সাহসী এমন নয়, তবে গরিবদুঃখীদের ভয়ডর বেশি থাকলে চলে না। সে এগোতে লাগল। গুনগুন করে একটু গান ভাঁজছিল সে, ভয় তাড়ানোর জন্য। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কে রে?”
তার স্পষ্ট মনে হয়েছে, অন্ধকারে আগে আগে কে যেন হাঁটছে। এখনও চাঁদ ওঠেনি। অমাবস্যা চলছে। কিন্তু আকাশ থেকে যে ঝাঁপসামতো একটুখানি আভা-আভা আলো আসে, তাইতেই তার মনে হয়েছে, একটা সরু লোক, স্পষ্ট বোঝা যায়নি অবশ্য। কিন্তু লোকটা জবাব দিল না।
গৌর আবার হাঁটতে লাগল। আমবাগানের সঁড়িপথে ঢুকতে যাবে, এমন সময় আবার মনে হল, সামনেই কেউ একটা আছে। পায়ের শব্দ হল যেন।
“কে ওখানে?” কেউ জবাব দিল না। কিন্তু হঠাৎ ঠন করে কী একটা জিনিস যেন এসে পড়ল গৌরের পায়ের কাছে। সে প্রথমটায় চমকে উঠেছিল। তারপরে সাহস করে নিচু হয়ে মাটি হাতড়ে গোলমতো একটা জিনিস পেয়ে তুলে নিল। জিনিসটার ওপর হাত বুলিয়ে আন্দাজে বুঝল, একটা কাঁচা টাকা।
ভয়ে গৌর আর এগোতে পারল না। টাকাটা মুঠোয় নিয়ে পিছু হটে আবার বাজারে চলে এল। দোকানের আলোয় মুঠো খুলে দেখল, টাকাই বটে। কিন্তু টাকাটা তার দিকে ছুঁড়ে দিল কে? আর দিলই বা কেন? অনেকক্ষণ ভেবেও সে প্রশ্নের জবাব পেল না। তবে মনে হল, টাকাটা যখন পাওয়াই গেছে, তখন খরচ করতে দোষ নেই। যে-ই দিয়ে থাক, সে গৌরের খিদের কথা জানে।
হরিপদর দোকানে গিয়ে গরম-গরম ফুলুরি আর আলুর চপ খেল গৌর। শ্রীদাম ময়রার দোকান থেকে রসগোল্লাও খেল। টাকাটা কে দিল তা ভাবতে ভাবতে একটু অস্বস্তি নিয়েই বাড়ি ফিরল গৌর। নিতাইগোপাল তার দুই শালাকে নিয়ে খেয়ে উঠে আঁচাচ্ছে। তার দিকে চেয়ে গম্ভীর মুখে বলল, “তৈরি হ’। রাতে পাহারা দিতে হবে মনে থাকে যেন।”
গৌর মাথা নেড়ে নিজের ঘরে গিয়ে লাঠিগাছা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল।
ক্রমে রাত নিশুতি হয়ে এল। সবাই অঘোর ঘুমে। গৌর একা দাওয়ায় বসে লাঠি ঠুকে ঠুকে পাহারা দেওয়ার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে উঠে চারদিকটা ঘুরেও আসছে। হুয়া-হুঁয়া করে একঝাঁক শেয়াল ডেকে উঠল কাছেই, দীর্ঘ বিষণ্ণ সুরে একটা কুকুর কাঁদতে লাগল। রাতের আরও সব বিচিত্র শব্দ আছে। কখনও তক্ষক ডাকে, কখনও পাচা, কখনও বাঁশবনে হাওয়া লেগে মচমচ শব্দ ওঠে, কখনও গুপুস করে পুকুরে ঘাই মারে বড় বড় মাছ। ঝিঝি ডাকে, কোনও বাড়ির খোকা হঠাৎ ওঁয়া-ওঁয়া করে কেঁদে ওঠে। শব্দগুলি সবই গৌরের চেনা। তবু আজ তার একটু গা-ছমছম করতে লাগল। তাকে ঘিরে যেন ক্রমে-ক্রমে একটা রহস্যের জাল বোনা হচ্ছে। কে বুনছে? কে সেই অদ্ভুত মাকড়সা?
একটু ঢুলুনি এসেছিল গৌরের। হঠাৎ দূর থেকে একটা খটখট শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল। চটকা ভেঙে সোজা হয়ে বসল গৌর। ঘোড়ার পায়ের শব্দ না? জোর কদমে নয়, আস্তে আস্তে একটা ঘোড়া হেঁটে আসছে এদিকপানে।
গৌর ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে কপাটের আড়ালে গা-ঢাকা দিল। উঁকি মেরে দেখল, উঠোনে একটা মস্ত সাদা ঘোড়া ধীর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল, পিঠে সেই লম্বা লোকটা। লোকটা এতই লম্বা যে, ঘোড়ার পিঠ থেকেও তার পা দুটো মাটি ছুঁই-ছুঁই। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে লোকটা সোজা গিয়ে মাউ আর খাউয়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল কপাট। লোকটা ভিতরে ঢুকতেই দরজা ফের বন্ধ হয়ে গেল।
গৌরের বুকটা ভয়ে ঢিপঢিপ করছে। এই লম্বা লোকটাকে দেখলেই তার মনটা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। মনে হয় এ-লোকটা মোটেই ভাল নয়। আগের দিন ঘোড়াটা দেখতে পায়নি গৌর। আজ দেখল। গ্রামদেশে এরকম বিশাল চেহারার ঘোড়া দেখাই যায় না। খুবই ভাল জাতের তেজী ঘোড়া। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, লেজটা পর্যন্ত তেমন নাড়াচ্ছে না।
কৌতূহল বড় সাংঘাতিক জিনিস। লম্বা লোকটা যে ভাল নয়, তা বুঝেও এবং মাউ আর খাউয়ের হুমকি সত্ত্বেও, গৌরের ইচ্ছে হল, লোকটা কী করতে এত রাতে আসে, সেটা একটু দেখতে। খুব ভয় করছিল গৌরের, তবু সে পা টিপে টিপে গিয়ে মাউ আর খাউয়ের ঘরের পিছন দিকের একটা জানালার ভাঙা খড়খড়ি দিয়ে ভিতরে উঁকি দিল।
ঘরে মিটমিটে হ্যারিকেনের আলোয় লম্বা লোকটার মুখোনা দেখে বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করে ওঠে গৌরের। এ যেন কোনও জ্যান্ত মানুষের মুখই নয়। বাসি মড়ার মুখে যেমন একটা রক্তশূন্য হলদেটে ফ্যাকাশে ভাব থাকে, এর মুখোনাও সে-রকম। চোখ দুটো গর্তের মধ্যে ঢোকানো, নাকটা লম্বা হয়ে বেঁকে ঝুলে পড়েছে ঠোঁটের ওপর। একটা কাঠের চেয়ারে বসে কোলের ওপর দুই হাত জড়ো করে লোকটা স্থির দৃষ্টিতে মাউ আর খাউয়ের দিকে চেয়ে ছিল। মাউ আর খাউয়ের ভাবগতিক দেখে খুবই অবাক হল গৌর।
গুন্ডা ও দুর্দান্ত প্রকৃতির দুই ভাই এখন জড়সড় হয়ে লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখ অবশ্য দেখতে পেল না গৌর, কারণ গৌরের দিকেই তাদের পিঠ। তবে হাবভাবে বুঝতে পারল লম্বা লোকটাকে এরা দারুণ ডরায়।
লম্বা লোকটা স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ দুই ভাইকে দেখল, তারপর মৃদুস্বরে বলল, “খুন করতে প্রথমটায় হাত কাঁপে বটে, কিন্তু আস্তে-আস্তে অভ্যেস হয়ে যায়। মশামাছি মারা যেমন খুন, মানুষ মারাও তা-ই। ভয় পেয়ো না। আমার দলে থাকতে গেলে এসব করতেই হবে।”
মাউ ভয়-খাওয়া গলায় বলে, “যদি পুলিশে ধরে?”
লম্বা লোকটা মৃদু একটু হাসল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “পুলিশ কিছু করতে পারবে না। সে ব্যবস্থা আমি করব। আমার রাজ্য উদ্ধার হয়ে গেলে তোমাদের এত বড়লোক বানিয়ে দেব যে, এখন তা কল্পনাও করতে পারবে না। বড়লোক হতে গেলে একটু কষ্ট তো স্বীকার করতেই হবে।”
মাউ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “কাকে খুন করতে হবে তা যদি বলেন।”
“সময়মতো জানতে পারবে। কিন্তু তার আগে আর-একটা কাজ আছে। আমি আমাদের পুরনো প্রাসাদের নকশা থেকে জানতে পেরেছি যে, এই বাড়িটা একসময়ে আমাদের হোশাখানা ছিল। আমার বিশ্বাস, এ-বাড়ির তলায় এখনও আমার পূর্বপুরুষের ধনসম্পদ রয়ে গেছে। কাজেই নিতাই আর গৌরকে খুব তাড়াতাড়ি এবাড়ি থেকে তাড়াতে হবে।”
মাউ আর খাউ পরস্পরের দিকে একটু তাকাতাকি করল। তারপর মাউ বলল, “তা হলে ওরা যাবে কোথায়?”
লম্বা লোকটা মৃদু হাসল। তারপর বলল, “নিতাইকে নদীর ধারে একটা ছোট ঘর করে দেওয়া যাবে। আর গৌর ছেলেটা একেবারেই ফালতু। এটাকে টিকিয়ে রাখার কোনও মানেই হয় না। তোমরা কী বলো?”
মাউ আর খাউ ফের নিজেদের মধ্যে তাকাতাকি করে নেয়। তারপর মাউ বলে, “সে অবশ্য ঠিক রাজামশাই।”
গৌরের হাত-পা একথা শুনে একদম হিম হয়ে গেল। রাজামশাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, “ওকে একবার তোমরা ডুবিয়ে প্রায় মেরে ফেলেছিলে, তাই না? ছোঁড়াটা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল। এবার ওকে দিয়েই তোমাদের বউনি হোক। কিন্তু সাবধান, বোকার মতো কোনও কাজ কোরো না। এমনভাবে কাজ হাসিল করবে, যাতে কেউ তোমাদের সন্দেহ করতে না পারে।”
“যে আজ্ঞে।” রাজামশাইয়ের পরনে আলখাল্লার মতো লম্বা সাদা পোশাক। তাতে জরির চুমকি। পকেটে হাত ভরে রাজামশাই একটা চকচকে জিনিস বের করে মাউ আর খাউয়ের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “এটা রাখো।”
রাজামশাই দরজা খুলে বেরোতেই গৌর চুপিসারে সরে গিয়ে আমবাগানের মধ্যে সেঁধোল। ভয়ে তার বুক ঢিপঢিপ করছে, হাত-পা ঝিমঝিম করছে, বুদ্ধি গুলিয়ে যাচ্ছে। সে একটা গাছের গোড়ায় ধপ করে বসে দম নিতে লাগল।
রাজামশাইয়ের ঘোড়ার পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যেতে একটু নড়েচড়ে বসল গৌর। তার মনে হল, বাঁচতে হলে আর বেশি দেরি করা চলবে না। এক্ষুনি পুটুলি বেঁধে নিয়ে রওনা হয়ে পড়তে হবে।
পা টিপে টিপে চারদিকে চোখ রাখতে রাখতে গৌর নিজের ঘরে এসে কপাটটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল। জামাকাপড় তার খুবই
সামান্য। জিনিসপত্তরও তেমন কিছু নেই। একজোড়া মোটা কাপড়ের ধুতি আর দুটো গেঞ্জি গামছায় বেঁধে লাঠিগাছা হাতে নিয়ে সে যখন বেরোতে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ পিছন থেকে সরু গলায় কে যেন বলে উঠল, “গৌর কি ভয় পেলে?”
গৌর চমকে উঠে, সভয়ে জানালাটার দিকে তাকাল। জানালার ও-পাশে অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। কাঁপা গলায় গৌর বলে, “কে…কে ওখানে?”
“পালিয়ে কি বাঁচতে পারবে গৌর? যেখানেই যাও, রাজা রাঘবের গুপ্তঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পাবে না।”
“আপনি কে?”
“আমি তোমার একজন মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। এখন যা বলছি, শোনো। রাজা রাঘবের ক্ষমতা অনেক। তার মতো নৃশংস মানুষও হয় না। এই জায়গায় একসময়ে তার পূর্বপুরুষেরা রাজত্ব করত। অনেক দিন আগেই সেই রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। রাঘব আবার সেই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমরা কিছু লোক সেটা ঠেকাতে চাইছি। কেন জানো?”
লোকটা যে-ই হোক, এর কথাবার্তা শুনে গৌরের মনে হল, লোকটা শত্রু নয়। সে একটু ভরসা পেয়ে বলল, “আজ্ঞে না। বলুন।”
“রাঘবের পূর্বপুরুষেরা ছিল সাংঘাতিক অত্যাচারী। কেউ সামান্য বেয়াদবি করলেই তার গলা কেটে ফেলে দিত। আসলে ওরা রাজত্ব তৈরি করেছিল ডাকাতি করে। রাজা হয়েও সেই ডাকাতির ভাবটা যায়নি। প্রায় একশো পঁচিশ বছর আগে একদল প্রজা খেপে গিয়ে মরিয়া হয়ে প্রাসাদ আক্রমণ করে। প্রাণভয়ে রাজা আর তার আত্মীয়রা পালায়। বিদ্রোহী প্রজার হাতে কয়েকজন মারাও পড়ে। তখন যে রাজা ছিল তার নাম মাধব। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, এই বেয়াদবির শোধ সে নেবেই। সে না পারলেও তার বংশের কেউ-না-কেউ ফিরে এসে এখানে আবার রক্তগঙ্গা বইয়ে রাজ্য স্থাপন করবে।”
গৌর জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই লম্বা লোকটাই কি রাঘব?”
“হ্যাঁ। সাংঘাতিক লোক। রাঘব না-পারে এমন কোনও কাজ নেই। ওর চেহারাটা রোগা বটে, কিন্তু লোহার মতো শক্ত। যে-কোনও বড় পালোয়ানকে ও পিষে মেরে ফেলতে পারে। আর শুধু গায়ের জোরই নয়, ওর কিছু অদ্ভুত ক্ষমতাও আছে। ও চোখের দৃষ্টি দিয়ে যে-কোনও মানুষকে একদম অবশ করে দিতে পারে। নানারকম দ্রব্যগুণও ওর জানা আছে। ওর টাকাপয়সাও অনেক। যেখানে যত ভয়ংকর, নিষ্ঠুর, পাজি আর বদমাশ আছে, তাদের ও একে-একে জোগাড় করছে। সেই সব লোককে নিয়ে একটা দল তৈরি করে একদিন ঝাঁপিয়ে পড়বে এই গ্রাম আর আশপাশের পাঁচ-সাতখানা গাঁয়ের ওপর। গাঁয়ের পর গাঁ জ্বালিয়ে দেবে, বহু মানুষকে কচুকাটা করবে। তারপর নিজের দল নিয়ে রাজত্ব করবে। বুঝেছ?”
গৌর কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বুঝেছি। কিন্তু আমাকে যে মারবার হুকুম দিয়ে গেল, আমি এখন কী করি?”
“ভয় পেয়ো না। পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। একটু সতর্ক থেকো, তা হলেই হবে। আর তোমার কবচটাকে ঠিকমতো ব্যবহার কোরো।”
কবচ! কবচের কথা গৌর ভুলেই গিয়েছিল। কোমরে হাত বুলিয়ে কবচটা ছুঁয়ে দেখে সে বলল, “কিন্তু গোবিন্দদা বলছিল, কবচটা নাকি ঘুমন্ত। এটাকে না জাগালে কাজ হবে না।”
“গোবিন্দ ঠিকই বলেছে।”
“তা কবচটাকে জাগাব কী করে?”
“সে ঠিক সময়মতো জানতে পারবে।”
“এখন আমি কী করব তা হলে?”
“যেমন আছ তেমনি থাকবে। চারদিকে চোখ রেখে চলবে।”
“আপনি কে?”
“আমি রাজা রাঘবের শত্রু, এর বেশি আজ আর বলব না।”
“আমবাগানে কে একজন আমার দিকে একটা টাকা ছুঁড়ে দিয়েছিল, সে কি আপনি?”
কেউ একথার জবাব দিল না। গৌর চেয়ে দেখল, জানালার ধারে ছায়ামূর্তিটা নেই।
গৌর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুটুলি খুলে ধুতি আর গেঞ্জি যথাস্থানে রেখে দিল।