দুপুরবেলায় ছানু আর কদম আর লাটুর মিটিং বসল। দাদুর হারানো ঘড়ি নিয়ে তারা খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
লাটু অসম্ভব দাদুভক্ত। সে বলল, “ঘড়িটার জন্য দাদুকে ঠাকুমার কাছে অপমান হতে হচ্ছে। এটা আমি সহ্য করতে পারছি না। ঘড়িটা খুঁজে বের করতেই হবে।”
ছানু আর কদম একটু ঠাকুমা-ঘেঁষা। ছানু ঠোঁট উল্টে বলল, “খুঁজে বের করে কী লাভ? দাদু তো আবার হারাবে।”
কদমও মাথা নেড়ে বলল, “খুঁজে বের করতে পারলেও ঘড়িটা দাদুকে ফেরত দেওয়া হবে না। ঠাকুমার কাছে থাকবে। দাদু দরকারমতো ঠাকুমার কাছ থেকে কটা বেজেছে জেনে নেবে।”
লাটু বলল, “দাদু কি আর ইচ্ছে করে হারায়। তা ছাড়া এবার হয়তো দাদু ঠিকই বলছে। ঘড়িটা হারায়নি। সারাতেই দেওয়া হয়েছে।”
ছানু বলল, “মোটেই নয়। ঠাকুমার ভয়ে দাদু ওসব বানিয়ে বলছে। মনে নেই এর আগেরবার দাদু বারবার বলছিল যে, ঘড়িটা চুরি যায়নি, চুরি গেছে রেডিওটা!”
কদমও সায় দিয়ে বলে, “ঠিক কথা। ঘড়ির ব্যাপারে দাদু সত্যি কথা কমই বলে। আমার মনে আছে গতবছর নীল ডায়ালের যে ঘড়িটা হারাল, দাদু বলেছিল, সেটা নাকি চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে। আমরা বাচ্চা মানুষরাও জানি যে, চিলে ঘড়ি নেয় না।”
লাটু একটু রেগে গিয়ে বলে, “দাদু মোটেই মিথ্যে কথা বলেনি। জয়গোপালের দোকান থেকে গরম জিলিপি নিয়ে আসছিল দাদু। চিলটা ছোঁ মারে। দাদু জিলিপির ঠোঙা বাঁচাতে হাতচাপা দেয়। চিলটা ঠোঙার বদলে হাত থেকে ঘড়িটা ভুল করে নিয়ে যায়। ভেলভেটের ব্যান্ড ছিল তাই নিতে পেরেছে।”
কদম বলল, “গুল। চিলে ঘড়ি নিলে দাদুর কব্জিতে আঁচড়ের দাগ থাকত।”
ছানু বলল, “সাদা ডায়ালের যে ঘড়িটা তার আগে হারিয়েছিল, সেটাও কিছুতেই ম্যাজিশিয়ান ভ্যানিশ করে দেয়নি। ম্যাজিশিয়ান কিছু ভ্যানিশ করলে তা ফের ফিরিয়েও আনে।”
লাটু বলে, “তোরা সব সময়েই দাদুর দোষ দেখিস। দাদুর দোষটা কী? বাজারের পথে লোকটা ম্যাজিক দেখাচ্ছিল। নানারকম জিনিস হামানদিয়ে গুঁড়ো করে ফের টুপি থেকে আস্ত আস্ত বের করছিল। দাদু তার ঘড়িটা দেয়। ম্যাজিশিয়ান যখন হামানদিস্তায় সব গুঁড়ো করে টুপিটার ঢাকনা খুলতে যাচ্ছে, ঠিক সেইসময়ে বাজারের কয়েকটা দুষ্টু ছেলে শিবের ষাঁড় বিশ্বেশ্বরকে খেপিয়ে দিল যে! বিশ্বেশ্বরের তাড়া খেয়ে সব লোকজন চোঁ-চাঁ দৌড়াল। সেই ম্যাজিশিয়ান কোথায় উধাও হল কে বলবে? দাদু যে কোনওক্রমে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিল এই ঢের। প্রাণের চেয়ে কি ঘড়ি বেশি?”
কদম হুঁ হুঁ করে মাথা নেড়ে বলে, “তুই বড় দাদুর দিকে টানিস। কালো ডায়ালের ঘড়িটা তাহলে আমাদের গোরু ধবলীই খেয়েছে! দাদু বলেছিল জাবনা মাখতে গিয়ে ঘড়িটা জাবনার সঙ্গে মিশে যায় আর ধবলী নিশ্চয়ই সেটা জাবনার সঙ্গে খেয়ে নিয়েছে। বলেছিল তো?”
“তাতে দোষটা কী হল?” লাটু বুক চিতিয়ে প্রশ্ন করে।
“ধবলী যদি গিলেই থাকে তবে পরদিন তার গোবর ঘেঁটে ঘড়িটা আমরা পেলাম না কেন?”
“ঘড়িটা হয়তো ও হজম করে ফেলেছে।”
“ঘড়ি কখনও হজম হয়? মোটেই জাবনার সঙ্গে ঘড়ি মিশে যায়নি।”
লাটু বিপন্ন হয়ে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা। অত পুরনো কথায় কাজ কী? এ ঘড়িটা নিয়ে মিটিং ডাকা হয়েছে, এটা নিয়েই কথা হোক।”
“কথা হোক।”
“কথা থোক।”
লাটু বলল, “ঘড়িটা আমরা খুঁজব। প্রথমে আমরা দাদুর কাছে গিয়ে নানারকম প্রশ্ন করে জেনে নেব ঠিক কী কী সকালবেলায় ঘটেছে।”
কদম বলল, “কী লাভ? দাদু তো সত্যি কথা বলবে না।”
ছানু বলল, “শুধু তাই নয়, দাদু অনেক কিছু বানিয়ে বলে আমাদের কাজ আরও জটিল করে তুলবে।”
লাটু চোখ কটমট করে তাকিয়ে বলল, “তাহলে তোমরা বলতে চাও যে, আমাদের দাদু একজন মিথ্যেবাদী?”
ছানু বলল,”মোটেই নয়।”
কদম বলে, “আমরা বলতে চাই আমাদের দাদু ঘড়ি হারানোর ব্যাপার ছাড়া অন্য সব বিষয়েই সত্যবাদী।”
ছানু যোগ করে বলল, “শুধু ঘড়ি নয়। দাদু আরও কিছু কিছু জিনিস হারান। যেমন, চটিজুতো, বাঁধানো দাঁত, চশমা, লাঠি, পয়সা…”
লাটু বাধা দিয়ে বলল, “অন্য সব কথা থাক। আমরা শুধু একটা বিষয়েই আজ আলোচনা করব।”
এইভাবে অনেক তর্কবিতর্কের পর একটা কাগজে কয়েকটা প্রশ্ন লেখা হল। দাদুকে এই প্রশ্ন করা হবে। কিন্তু এমনভাবে করা হবে যাতে দাদু বুঝতে না পারেন যে, তাঁকে জেরা করা হচ্ছে।
লাটু পরামর্শ দিল, “মাথা চুলকোলে দাদু খুব আরাম পায়। অতএব আমি যখন দাদুকে জেরা করব তখন কদম তাঁর মাথা চুলকোবে। আর ছানু, তুই দাদুর পায়ের আঙুলগুলো টেনে দিবি।”
এসব পরামর্শ শেষ করে তিন ভাইবোনে উঠল। দিবানিদ্রার পর হারানচন্দ্র বিষণ্ণ মুখে দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ার পেতে বসে ছিলেন। মনটা খুবই খারাপ। তাঁকে এ বাড়ির কেউ বিশ্বাস করে না। তা ছাড়া তিনি কস্মিনকালেও ভূত প্রেত ঈশ্বর কিছুই মানেননি। কিন্তু এখন ঠেকায় পড়ে সব কিছুকেই একরকম স্বীকার করে ফেলতে হবে হয়তো। এটাকে
তিনি একটা হেরে-যাওয়া বলে মনে করেন। ভূতকেই যদি মানেন তবে ঈশ্বরকে মানতেও দেরি হবে না। ওই যে কী একটা কথা আছে না, ইফ উইনটার কাস ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড?
খুব আনমনে বসে ছিলেন হারানচন্দ্র। হঠাৎ তিন নাতি-নাতনি এসে হাসি হাসি মুখে তিনদিকে দাঁড়াল।
“দাদু, তোমার মাথা চুলকে দেব?”
“দাদু, তোমার পায়ের আঙুল টেনে দিই?”
তিনজনই বিচ্ছু। তার মধ্যে লাটুটা তাঁর ন্যাওটা। হারানচন্দ্র একটু সন্দেহের চোখে ওদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “তা দে।”
কদম আর ছানু দাদুর সেবায় লেগে গেল। হারানচন্দ্র ভারী আরাম পেয়ে চোখ বুজে ফেললেন। ঘুম-ঘুম ভাব।
লাটু খুব মিঠে গলায় ডাকল, “দাদু!”
“আজ সকালে তুমি কি উত্তরদিকে বেড়াতে গিয়েছিলে?”
“উত্তরদিক! তা হবে বোধহয়।”
“ঠিক করে বলো।”
“কেন রে? দিক দিয়ে কী করবি?”
“আমাদের একটা বাজি হয়েছে। বলো না।”
“হ্যাঁ। উত্তরদিকেই।”
“বেড়ানোর সময় তোমার সঙ্গে কারও দেখা হয়েছিল?”
“হয়েছিল বোধহয়।”
“বলো না।”
“আঃ, বড্ড জ্বালাচ্ছিস। এখন যা।”
ছানু বলল, “তাহলে কিন্তু পায়ের আঙুল টানব না।“
কদম বলল, “আমিও মাথা চুলকোব না।”
দাদু তিনজনকে আর একবার দেখে বলেন, “মতলবখান কী তোদের? অ্যাঁ!”
“আগে বলো।” লাটু বলে।
হারানচন্দ্র বলেন, “হয়েছিল দেখা।”
“কার সঙ্গে?”
“অনেকের সঙ্গে। সব কি মনে থাকে?”
“মনে করে বলো।”
মাথা চুলকোনো আর পায়ের আঙুল টানার আরামে চোখ বুজে হারানচন্দ্র বললেন, “একটা বেঁটে লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কটা বাজে। তা আমি একটু লক্ষ করে দেখলাম লোকটার মাথায় দুটো শিং আছে।”
কদম বলল, “এঃ, এটা একদম চলবে না দাদু। গুল।”
হারানচন্দ্র হার না মেনে বললেন, “আর একটা ঢ্যাঙা লোকের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। সে সময় জানতে চায়। তা দেখলাম এ লোকটার হাতের চেটো আর পায়ের পাতা অবিকল বাঘের থাবার মতো।”
ছানু আঙুল টানা বন্ধ করে বলল, “ভাল হচ্ছে না কিন্তু দাদু। আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছি।”
লাটু হতাশ হয়ে বলে, “এরকম করলে তদন্ত এগোবে কী করে বলো তো?”
হারানচন্দ্র অবাক হয়ে বলেন, “কিসের তদন্ত?”
ছানু বোকার মতো বলে ফেলল, “বাঃ, তোমার ঘড়িটা চুরি গেছে না! আমরা সেটা খুঁজতে বেরোব যে!”
লাটু ছানুর মাথায় একটা গাঁট্টা মেরে বলল, “বললি কেন?”
“তদন্তের কথা তুই-ই তো বলে ফেললি!” ছানু মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে।
হারানচন্দ্র দুজনের মাঝখানে পড়ে বললেন, “বুঝেছি। তোরা ধরে নিয়েছিস যে, ঘড়িটা চুরিই গেছে! কিন্তু বাস্তবিক তা নয়। ঘড়িটা এক জায়গায় আছে। খুব ভালই আছে। সেটা ফেরতও পাওয়া যাবে। চিন্তা নেই।”
লাটু বলল, “কোথায় আছে সেটা আমরা জানতে চাই। ঘড়ির ব্যাপারে তোমার যে বদনাম হয়ে যাচ্ছে তা আর আমরা সহ্য করব না। কাকে দিয়েছ বলো।”
হারানচন্দ্র জটাইয়ের কথাটা বলতে চান না। বললে কোথাকার জল কোথায় দাঁড়াবে কে বলতে পারে। তিনি ভূত ভগবান তন্ত্রমন্ত্র কিছুই মানেন না। এই দুষ্টু নাতি-নাতনিরা যদি জানতে পারে যে, তাঁর ঘড়িতে ভূত ভর করেছে, এবং সেটা শোধন করতে জটাইকে দিয়েছেন, তবে এরা খেপিয়ে মারবে। তিনি একটু চিন্তা করে লাটুর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, “বলতেই হবে?”
“বলতেই হবে।”
হারানচন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “রাস্তায় হঠাৎ গর্ডন সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। গর্ডন তো যন্ত্রপাতি নিয়েই থাকে সারাদিন। ঘড়িটা একটু ফাস্ট যাচ্ছিল বলে তাকে দেখালাম। গর্ডন বলল, সারিয়ে দেবে। তাই তাকে দিয়েছি সারাতে।”
গর্ডন সাহেবের উল্লেখে তিন ভাইবোনের মুখ শুকিয়ে গেল। গর্ডন সাহেবকে ভয় পায় না এমন লোক এই অঞ্চলে কমই আছে। বিশেষ করে বাচ্চারা। তা বলে গর্ডন যে তোক খারাপ তা নয়। বয়স প্রায় হারানচন্দ্রের মতোই হবে। ধবধবে সাদা দাড়ি। ধবধবে সাদা গায়ের রং। খাঁটি সাহেব। সেই ইংরেজ আমল থেকেই এখানে আছে। তার বাপ-মাও এখানেই ছিলেন। মরার পর তাঁদের এখানকারই কবরখানায় কবর দেওয়া হয়। গর্ডন আর দেশে ফিরে যায়নি। তার বাপের বিরাট ব্যবসা ছিল কলকাতায়। ছেলের জন্য বিশাল একখানা বাড়ি, প্রচুর টাকা আর কোম্পানির শেয়ার রেখে গেছেন। তাতে গর্ডনের ভালই চলে যায়। থাকার মধ্যে আছে এক বুড়ি পিসি। ভারী খিটখিটে আর ঝগড়ুটে বলে বুড়িকেও সবাই ভয় খায়। গর্ডন সাহেবের নানা বাতিক। এক গাদা ভয়ংকর চেহারার কুকুর আছে তার। নানারকম যন্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য সে একটা বড়সড় ওয়ার্কশপ বানিয়েছে নিজের বাড়িতে। দিনরাত সেখানে খুটখাট দমাস-দুম শব্দ হয়। কখনও হঠাৎ গলগল করে হলুদ ধোঁয়া বেরোয় তার ওয়ার্কশপ থেকে। কখনও বা বিটকেল সব রাসায়নিকের গন্ধে বাতাস ভরে যায়। মাঝরাত্তিরে হঠাৎ হয়তো নীল আগুনের শিখা ওঠে আকাশে। প্রথম প্রথম এসব দেখে বিপদ ঘটেছে ভেবে মানুষ ছুটে যেত। এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। তবে গর্ডন সাহেবের এসব কাণ্ড দেখে সকলেই তাকে এড়িয়ে চলে। একসময়ে শোনা গিয়েছিল গর্ডন সাহেব একটা উড়ুক্কু মোটর সাইকেল তৈরি করছে। আর একবার রটে গেল, গর্ডন একটা কলের মানুষ তৈরি করেছে এবং সেই কল-মানুষ জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ অবধি সব করতে পারে। আর একবার গুজব শোনা গেল, গর্ডন এমন একটা হাওয়া কল তৈরি করেছে যা দিয়ে ইচ্ছেমতো ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করা যায়। এগুলো সত্যি না মিথ্যে তা কেউ জানে না, কিন্তু নানারকম রটনার ফলে সকলেই গর্ডনকে একটু সমঝে চলে।
গর্ডন খুব লম্বাচওড়া আর গম্ভীর মানুষ। বড় একটা হাসেটাসে। হাতে থাকে গাটওয়ালা একটা মোটা লাঠি। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। চামড়ার ফিতেয় বাঁধা তিন-চারটে বিকট কুকুর নিয়ে যখন সে রাস্তায় বেরোয়, তখন বাচ্চারা তরাসে গিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে সেঁধোয়। গর্ডনের বাগানে আম জাম পেয়ারা কিছু কম নেই। কিন্তু ভয়ে কেউ সেই বাগানের ধারেকাছে যায় না। এক ভয় কুকুরের, আর এক ভয় মাটির নীচেকার চোরা কুঠুরির। মায়েরা দুই বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য চিরকাল বলে এসেছে, গর্ডন সাহেব এসে ধরে নিয়ে গিয়ে পাতালঘরে কুলুপ এঁটে রাখবে।
তাই দাদুর কাছে গর্ডনের কথা শুনে ছানু কদম আর লাটুরও মুখ শুকিয়ে গেল। কথাটা মিথ্যে নাও হতে পারে। কারণ গর্ডন বাস্তবিকই নানারকম যন্ত্রবিদ্যা জানে। দাদুর সঙ্গে তার ভাব প্রায় সেই ছেলেবেলা থেকেই।
তিন ভাইবোন আবার বাগানে গিয়ে মিটিঙে বসল।
ছানু বলল, “দাদু গর্ডন সাহেবের কথা বলে ঘড়ি হারানোর ব্যাপারটা চাপা দিতে চাইছে।”
কদম বলল, “আমারও তাই মনে হয়।”
লাটু মাথা নেড়ে বলল, “মোটেই নয়। ঘড়িটা একটু বিটকেল দেখতে তো ছিলই। বাবাকে ঠকিয়ে কেউ ঘড়িটা গছিয়ে দিয়েছে। বিটকেল ঘড়ি গর্ডন সাহেব ছাড়া আর কে সারাবে? দাদু ঠিক কাজই করেছে।”
কদম বলে বসল, “তুই তো দাদুর ল্যাংবোট।”
ছানু বলল, “একদম ল্যাংবোট। দাদু যেদিকে, তুই-ও সেদিকে। দাদু যদি সত্যি কথাই বলে থাকে, তবে সেই শিং আর লেজওয়ালা বেঁটে লোক, থাবাওয়ালা লম্বা লোকের গল্পও সত্যি।”
লাটু খেঁকিয়ে উঠে বলে, “সত্যি নয় তো শুনে ভয় পাচ্ছিলি কেন?”
ছানুও সমান তেজে বলল, “তুইও তো দাদুর মতো ভূত মানিস না, ভগবান মানিস না, তাহলে রাতে একা ঘরে শুতে আর বাথরুমে যেতে ভয় পাস কেন? আর কেনই বা পরীক্ষার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে সরস্বতীর ছবি প্রণাম করে যাস?”
এইরকম যখন তিন ভাইবোনে তর্ক চলছে, সেই সময় নিত্য দাস “জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি! জয় শিবশম্ভো! জয় করালবদনী!” বলে এসে ফটকে দাঁড়াল। শুনে তিন ভাইবোনে। তো থ! কারণ নিত্য দাস পরম বৈষ্ণব। শাক্তদের সে মোটেই পছন্দ করে না। যেমন জটাইদাদু রাধা বা কৃষ্ণের নাম শুনলে তেড়ে মারতে আসেন তেমনি, নিত্য দাস কালীর নাম শুনলে জিব কাটে। সেই নিত্য দাসের মুখে কালীর জয়ধ্বনি শুনলে কে না মূর্ছা যাবে?
তিনজনে দৌড়ে গিয়ে নিত্য দাসকে ঘিরে ধরল। লাটু বলল, “তুমি কালীর নাম নিচ্ছ, ব্যাপার কী গো নিত্যদা?”
নিত্য দাস মাথা নেড়ে বলল, “কালীর নাম নেব না তো কার নাম নেব? কালীই আসল?”
“তুমি না বোষ্টম!”
“সে ছিলাম আজ সকাল অবধি। জটাইবাবার যা মহিমা দেখলাম, তাতে মনে হল, ছ্যা ছ্যা, এতকাল করেছি কী? তন্ত্রসাধনার মতো জিনিস আছে? আজ সকাল থেকে আমি তান্ত্রিক হয়ে গেছি।”
“কী দেখলে বলল না!” বলে কদম নিত্য দাসের কাপড়জামা টানাহ্যাঁচড়া শুরু করে দিল।
“ওঃ, সে যা দেখলাম দিদি, বলার নয়। চারদিকে যেন ভূতের বৃষ্টি। লম্বা ভূত, বেঁটে ভূত, চালাক ভূত, গানদার ভূত একেবারে গিজগিজ করছে বাবার থানে।”
“সত্যি! ও মাগো!” বলে কদম নিত্য দাসকে জাপটে ধরে। নিত্য দাস তাকে কোলে নিয়ে হেসে বলে, “ভয় কী দিদি? জটাইবাবার মহিমায় ভূতেরা সব চাকরবাকর হয়ে আছে। ভূতে গান গাইছে, ভূতে বাসন মাজছে, ভূতে বাবার পা দাবাচ্ছে। ওঃ, সে যা দৃশ্য!”
লাটু চাপা গলায় বলল, “গুল!”
নিত্য দাস মাথা চুলকে বলল, “হ্যাঁ, গুলও দিচ্ছে তারা। নিজের চোখে দেখলাম, কয়লার গুঁড়ো, গোবর আর মাটি মেখে
এত বড় বড় গুল দিচ্ছে রোদে বসে।”
লাটু বলল, “আর মিথ্যে কথা বোলো না নিত্যদা। ভূত তুমি মোটেই দেখনি।”
নিত্য দাস কথাটা না শোনার ভান করে হঠাৎ হুংকার দেয়, “জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি। জয় শিবশম্ভো!”
ছানু লাটুর দিকে চেয়ে বলে, “দাদুর মতো তুইও সব কিছু উড়িয়ে দিস। জটাইদাদুর একটা ভূত তো আছেই। বাঞ্ছারাম।”
“ওটাও গুল।”
নিত্য দাস জিব কেটে বলে, “সে কী কথা! বাবার মুখ দিয়ে জীবনে একটাও মিথ্যে কথা বেরোয়নি। বাঞ্ছারাম তো আছেই, বাঞ্ছাসীতাও আছে। নিজের চোখে দেখেছি।”
লাটু চোখ পাকিয়ে বলে, “কী দেখেছ? আমরা গিয়ে যদি
তাদের দেখা না পাই, তাহলে কিন্তু ভাল হবে না নিত্যদা!”
নিত্য দাস এক গাল হেসে কদমকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, “দেখা পাবে বই কী! তবে দেখার চোখ চাই। প্রথমটায় আমি বুঝতে পারিনি কিনা।”
লাটু বলল, “সে কী রকম?”
নিত্য দাস বলে, “কাউকে বোলো না কিন্তু। ব্যাপারটা হল বাবার থানে সকালে গিয়ে একটু বসেছি, হঠাৎ কারা যেন কাছেপিঠে কথাবার্তা বলতে শুরু করল। কিন্তু কাউকে দেখছি না। স্পষ্ট শুনছি একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ভুতুড়ে ভাষায় কথা বলছে। নিরিখ পরখ করে বুঝলাম, কথাবার্তা হচ্ছে ঘড়ির ভিতর।”
“ঘড়ির ভিতর?” তিনজনে একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে।
“তাহলে আর বলছি কী? কিন্তু সে-ঘড়িও যে-সে ঘড়ি নয়। পাক্কা ভুতুড়ে বিটকেল এক ঘড়ি। ঠাহর করে দেখলাম ঘড়ির দুটো কাঁটাই কথাবার্তা বলছে। তখন বুঝতে আর অসুবিধে হল না, বাবা যোগবলে বাঞ্ছারাম আর বাঞ্ছাসীতাকে ঘড়ির দুটো কাঁটা করে রেখে দিয়েছেন। বড় কাঁটাটা বাঞ্ছারাম, ছোটটা তার বউ বাঞ্ছসীতা।”
লাটু ধমকে ওঠে, “ঘড়িটা কি জটাইদাদুর কাছে আছে?” নিত্য দাস এক গাল হেসে বলে, “তবে আর কোথায়? সে এক অশৈরি ঘড়ি ভাই। আসল ঘড়ি তো নয়। স্বয়ং শিব বাবার তপস্যায় খুশি হয়ে নিজে এসে দিয়ে গেছেন। “
তিন ভাইবোনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। লাটু উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, “ঘড়ি তাহলে জটাইদাদুর কাছে!”
কদম বলল, “দাদু মিথ্যে কথা বলেছে।”
ছানু বলল, “দাদু গুল মেরেছে।”
লাটু কটমট করে ভাইবোনের দিকে চেয়ে থেকে একটা ধমক দিল, “চোপ! গুরুজন সম্পর্কে শ্রদ্ধা রেখে কথা বলবি।”
নিত্য দাস ভিক্ষে নিয়ে বিদেয় হওয়ার পরেই তিন ভাইবোনে জটাই তান্ত্রিকের বাড়ি রওনা হল।
সন্ধে হয়ে এসেছে। শহরের একেবারে ধারে নির্জন জায়গায় গাছগাছালিতে ঘেরা জায়গাটায় এলেই কেমন গা-ছমছম করে। একটু দূরেই নদী। নদীর ধারে শ্মশান। সন্ধের মুখে গাছগাছালি পাখিতে ভরে গেছে। পাখিদের ডাক ও ঝগড়ার শব্দে জায়গাটা যেন আরও ছমছম করছে।
জটাই তান্ত্রিকের বাড়ি খুবই পুরনো। আসল বাড়িটা খুব বড় ছিল। এখন কয়েকটা থাম আর নোনাধরা দেয়াল ছাড়া বাকিটা ধ্বংসস্তূপ। তার মধ্যেই দু’খানা ইটের ঘর কোনওরকমে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে মস্ত উঠোন। উঠোনে কয়েকটা বেলগাছ।
তিনজনে খুব সন্তর্পণে আগড় ঠেলে উঠোনে ঢুকল। কেউ কোথাও নেই।
লাটু ডাকল, “জটাইদাদু! ও জটাইদাদু!” কেউ সাড়া দিল না। ছানু ভয়ে-ভয়ে বলল, “জটাইদাদু বোধহয় বাড়ি নেই। চল, পালিয়ে যাই।”
লাটু খিঁচিয়ে উঠে বলে, “নেই তো ঘরের দরজা খোলা কেন?”
কদম বলে, “হয়তো জটাইদাদু ধ্যানট্যান করছে।”
লাটুরও একটু ভয়-ভয় করছিল। কিন্তু ভাইবোনের সামনে সেটা পাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে, সেই ভয়ে সে গটগট করে গিয়ে ঘরে ঢুকল। তারপরই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
জটাই তান্ত্রিক ঘরের মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। জ্ঞান নেই। কিংবা মারাও গিয়ে থাকতে পারেন।
লাটু ভয় পেলেও চেঁচাল না। চারদিক চেয়ে দেখতে লাগল। আচমকা সে বাতাসে একটা কড়া চুরুটের গন্ধ পায়।
গর্ডন যে সব সময়েই চুরুট খায়, এটা সবাই জানে।