৪. দত্তক বা অ্যাডপ্টেড ছেলেমেয়ে

৪.

দত্তক বা অ্যাডপ্টেড ছেলেমেয়েদের নানান সমস্যার কথা আমি এর-ওর মুখে কিছু শুনেছি। প্রমথর ল্যাবে কাজ করে এরিক ঐবিং, সেও অ্যাডপ্টেড। এরিক গল্প করতে ভালোবাসে। প্রমথর ল্যাবে গেলেই একটা না একটা ছুতো করে কিছুক্ষণ গল্প করে যায়। মজা করেই বলে ওর সমস্যার কথা। এদেশে কোনও ডাক্তারের অফিসে গেলে ফর্ম ফিল আপ করতে হয়। ফ্যামিলিতে কারো ডায়াবিটিস আছে কিনা, হার্ট ডিজিজ আছে কিনা, ক্যানসার হয়েছিল কিনা, ইত্যাদি নানান প্রশ্ন থাকে সেখানে।

“কী করে এর উত্তর জানব?” এরিক গল্প করত, “যাকে বাবা বলে জানি, তার তো চোদ্দপুরুষের কোনও ডায়াবিটিস ছিল না, আর আমার তো তেইশ বছরেই ধরা পড়ল! ওইসব প্রশ্নের উত্তরে আমি লিখি জি-ও-ডি… গড ওনলি নোজ। ডাক্তারের অফিসের লোকেরা বিরক্ত হয়, ভাবে আমি মজা করছি!”

.

ইদানীং অবশ্য ন্যাচারাল পেরেন্টসের মেডিক্যাল রেকর্ড জোগাড় করা হয় চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণে। আগে সেভাবে হত না। সত্যি কথা বলতে কি, অ্যাডপ্টেড ছেলেমেয়েদের এই সমস্যাগুলো আমরা অনেকেই বুঝি না। আর এগুলো তো শুধু দেহ-সংক্রান্ত, মনের দিকটা আরও বেদনাময়। একটা তীব্র চাপা ক্ষোভ অ্যাডপ্টেড ছেলেমেয়েদের পীড়িত করে… কেন নিজের বাবা-মা ওদের পরিত্যাগ করলেন? কী দোষ ওরা করেছিল? বিশেষ করে শেষ প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনও উত্তর নেই। আজীবন এই প্রশ্নগুলো নিয়েই ওদের কাটাতে হয়… কষ্টটা কারও কম, কারও বেশি।

.

এরিক খুব মজা করেই কথাগুলো বলত, কিন্তু পেছনে চোখের জলটা ঠিক লুকোতে পারত না। প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে জন্মদাতা বাবা-মায়ের সন্ধান করতে নিউ ইয়র্ক ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিল দক্ষিণ দিকে। ফিরেছিল বিমর্ষ হয়ে। অনেক খুঁজতে খুঁজতে শেষে অ্যালাবামাতে পৌঁছে এরিক জেনেছিল ওর মা অ্যালকোহলিক, থাকে হোমলেস শেল্টারে। বাবা জেল খাটা আসামি, বহুদিন জেল খাটার পর অল্প সময়ের জন্য ছাড়া পেয়ে আবার জেলে। সেখানেই মৃত্যু। অর্থাৎ বাপ-মা’র দিকে নাথিং টু বি প্রাউড অফ, না জানলেই বোধহয় ভালো হত। সে রকম কিছু হলেও হতে পারে ওডিনে ক্ষেত্রে, কে জানে? যেটা পজিটিভ, সেটা হল ওডিন ধীরে ধীরে নর্মাল হচ্ছে। কথাবার্তাও অনেক বেশি বলছে।

.

ইতিমধ্যে একদিন প্রীতম এল। ইংল্যান্ডে ছুটি কাটাতে গিয়েছিল। ঠিক বেড়াতে যাওয়া নয়। একটি ভারতীয় ব্রিটিশ মেয়েকে ডেট করছিল বেশ কিছুদিন ধরে। তার আমন্ত্রণেই গিয়েছিল বার্মিংহামে, মেয়েটির বাবা মার সঙ্গে দেখা করতে। রথ দেখা কলা বেচা দুটোই হয়ে গেল। একেবারে বিয়েটাই সেরে ফেলল। ধুমধাম যা কিছু ওখানেই হয়েছে। প্রীতমের মেজোমামা লন্ডনে থাকেন। লন্ডনেই ওদের ইউরোপিয়ান হেড কোয়ার্টার। পাত্রপক্ষের তরফ থেকে রিসেপশনটা মেজোমামাই দিয়েছেন লন্ডনে। এখানকার আয়োজন ছোটোখাটো, মূলত আন্টির উদ্যোগে। পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, যারা লন্ডনে যেতে পারেনি তাদের জন্য। নিমন্ত্রণ পত্র অবশ্য আগেই পেয়েছি, RSVP-র উত্তরও দিয়েছি। একটা ভারতীয় রেস্টুরেন্টে হওয়ার কথা ছিল। কোনও কারণে সেখানে হচ্ছে না। সেটা জানাতেই প্রীতম এসেছে। নিমন্ত্রিতের সংখ্যা বেশি নয়, বাড়িতেই ম্যানেজ করা যাবে।

.

আমার একটাই সমস্যা, পরের সপ্তাহে এ্যান্টের ইন্টারিম রিপোর্ট জমা দিতে হবে। প্রচুর কাজ বাকি আছে। অর্ধেক দিন নষ্ট করার সময়ও আমার নেই, অথচ প্রীতমের বিয়ের রিসেপশনে না গেলেও চলবে না। ওডিনকে বললাম ও যদি গ্রাফ আর টেবিলগুলো রিপোর্টে বসিয়ে দেয়। মুশকিল হল, সেগুলো সংখ্যায় অনেক, ঠিক মতো ফোরম্যাট করে বসাতে সময় লাগবে। তবে ওডিন দেখেছি কাজটা ভালো পারে। তাও আমি সতর্ক– যদি কিছু গুবলেট করে, তাই লেখার একটা কপি রেখে কাজটা ওকে দিলাম।

কাজটা নিতান্তই ব্যক্তিগত কাজ, সেটা আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। অনুরোধ করতে একটু সংকোচই হচ্ছিল, কিন্তু ছেলেটা সত্যিই ভদ্র। বলল, “কোনও সমস্যা নেই।” তারপর জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছি?”

বললাম। তখনই জানলাম, ওদের পরিবারে ঠাকুরদা থেকে শুরু করে অনেকেই প্রীতমের মামাদের কোম্পানিতে কাজ করতেন। তাতে অবশ্য অবাক হলাম না। প্রীতমের কাছেই শুনেছি, ইস্ট আফ্রিকার বহু লোকই ক্যাম্পর ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছে বা করেছে।

“ভালো হল,” আমাকে বলল, “উনি এখানে আছেন শুনে আমার আঙ্কল আর আন্টি ওঁকে দেবার জন্য আমার সঙ্গে একটা গিফট দিয়েছেন। বুঝতে পারছিলাম না, কী করে ওঁদের হাতে পৌঁছে দেব।”

“এতে কী আছে, আমাকে দিয়ে দিতে পার। আমি তো যাচ্ছিই।”

.

যেদিন রিসেপশন সেদিনই সকালে এসে ও আমার হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট দিল প্রীতমের মামাকে দেবার জন্যে। বলল, “আঙ্কল আন্টির ভালো নাম ওঁর মনে থাকার কথা নয়, তবু যদি ডাক নাম মনে থাকে।”

সুন্দর রংচঙে রাংতা কাগজে মোড়া একটা উপহার। সঙ্গে একটা চিরকুট। চিরকুটটা ভালো করে দেখিওনি, যাবার আগে নজরে পড়ল। স্কচটেপ দিয়ে রাঙতার ওপর লাগানো।

Dear Sir,

I am the youngest nephew of Binni and Jackie Seko. You may know them as

Best

OS

একেনবাবুকে চিরকুটটা দেখিয়ে বললাম, “কী কাণ্ড দেখুন, তাড়াহুড়োতে আঙ্কল-আন্টির ডাকনামটাই লেখেনি।”

“তা তো দেখছি স্যার। একবার ফোন করুন না, আপনিই না হয় লিখে দিন নামটা।”। একবার ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম। পেলাম না।