চেয়ার
রতন বেশ মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে। টেবিলের অন্য পাশে বসে থাকা মানিক তার প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করছে। রতন হঠাৎ করে মানিকের দিকে তাকাল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী হলো মানিক? তুমি খাচ্ছ না?”
মানিক বলল, “চেষ্টা করছি।”
রতন ভুরু কুঁচকে বলল, “কোনো সমস্যা?”
মানিক বলল, “না মানে ইয়ে, কে বেঁধেছে?”
রতন বলল, “কে বেঁধেছে মানে? অবশ্যই আমি বেঁধেছি।”
মানিক বলল, “এই প্রথম?”
“কেন? প্রথম কেন হবে? আমি প্রত্যেক দিন রাধি।”
মানিক ইতস্তত করে বলল, “তুমি বৈজ্ঞানিক মানুষ। বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিক গবেষণা করবে। রান্না-বান্না করে সময় নষ্ট করো কেন?”
রতন বলল, “আমার রান্না করতে মোটেও সময় নষ্ট হয় না।”
“সময় নষ্ট হয় না?
“না।”
“কেন?”
“রান্না করার জন্য আমার রান্না করার যন্ত্রে শুধু ডায়ালটা ঘুরিয়ে সুইচটা টিপতে হয়। যেমন এই যে গরুর গোশতটা তুমি খাচ্ছ এটা রান্না করার জন্যে আমি ডায়ালটা সেট করেছি হালকা ঝাল, ভুনা সঙ্গে আলু। সবজিটার জন্যে সেট করেছি আলু, ফুলকপি, গাজর আর বরবটি। ডাল ছিল মসুর এবং মুগ এক সাথে স্পেসিফিক গ্রাভিটি টু পয়েন্ট ফাইভ–”
মানিক হাত তুলে রতনকে থামাল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও। তোমার গোশতে কোনো আলু নেই। কী একটা আছে এটা কার্ডবোর্ড হতে পারে, কাঁঠাল পাতাও হতে পারে। সবজিতে আলু ফুলকপি আর গাজর নেই, আবার সেই কাঁঠাল পাতা আছে। আর ডাল–”
রতন এবারে মানিককে থামাল। বলল, “এটা আসলে কাঁঠাল পাতা। এটা হচ্ছে বাঁধাকপি। আর গোশতে আলু না দিয়ে যে বাঁধাকপি দেয়া হয়েছে তার একটা কারণ আছে। এলগরিদমে দেয়া আছে যে গোশতের পরিমাণের সাথে আলুর পরিমাণ যদি আনুপাতিক না হয় তাহলে মেশিন একটা বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে খানিকটা স্বাধীনতা দেয়া আছে। খাবারের পুষ্টি ক্যালোরি অপটিপমাইজেশানে–”
মানিক হাত তুলে থামাল, বলল, “তোমার বিজ্ঞানের কচকচি থামাও। তুমি আসলে রান্না কর না। তোমার যন্ত্র রান্না করে। তুমি অনেক ভালো ভালো যন্ত্র আবিষ্কার করেছ কিন্তু আমি দুঃখিত–কথাটা নিষ্ঠুর হলেও বলতে হবে, তোমার রান্না করার যন্ত্রটা ভালো হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি এই যন্ত্র চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে।”
রতন বলল, “কেন? তুমি এই কথা কেন বলছ?”
“যেমন মনে করো এই গোশতের ব্যাপারটা। এখানে সাবানের গন্ধ।”
রতন বলল, “গোশতকে সাবান দিয়ে ধুলে একটু সাবানের গন্ধ থাকতেই পারে।”
“গোশতকে কেউ কখনো সাবান দিয়ে ঘোয় না। সেটা যদি ছেড়েও দেই, এই গোশত রান্না হয়নি, এটা কাঁচা।”
“খাবারকে বেশি রান্না করলে তার ভাইটামিন নষ্ট হয়ে যায়। পুষ্টি কমে আসে।”
মানিক মাথা নাড়ল, বলল, “পুষ্টির জন্যে কাঁচা মাংস খাওয়া যদি জরুরি হয় তাহলে আমি নিশ্চয়ই সারমেয় হয়ে জন্মাতাম।”
রতন ভুরু কুচকে বলল, “সারমেয় মানে কী?”
“সারমেয় মানে কুকুর। আমি কুকুর না। আমি কাঁচা গোশত খাব না।”
রতন বলল, “আমাদের খেতে হয় শরীরকে রক্ষা করার জন্যে। এই টেবিলে যে খাবার দেয়া আছে তুমি যদি নিয়মিত সেটা খাও তোমার শরীরের সকল প্রয়োজন মিটবে। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট ভাইটামিন–”
মানিক বলল, “আমি তোমার কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট আর ভাইটামিনের শীতবস্ত্র দহন করি।”
রতন অবাক হয়ে বলল, “কী বললে?”
“আমি অমার্জিত এবং অশালীন কথা বলি না। যদি বলতাম তাহলে বলতাম আমি তোমার কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট আর ভাইটামিনের খেতা পুড়ি।”
রতন একটু অবাক হয়ে বলল, “ও! তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে। তুমি আমার রান্না পছন্দ করনি।”
মানিক বলল, “বলাটা ভদ্রতা নয় কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি তোমার এই রান্না করা খাবার পুরোপুরি অখাদ্য।”
রতন একটু ইতস্তত করে বলল, “এর পুষ্টিগুণ ঠিক আছে।”
“মানুষ পুষ্টিগুণের জন্যে খায় না। একজন মানুষের জীবনে আনন্দের যে কয়টা বিষয় আছে তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাবার। আমরা মানুষ হিসেবে সেই খাবার উপভোগ করতে চাই।”
“সত্যি?”
“তুমি যদি এটা জেনে না থাকো তাহলে আমি তোমার জন্যে করুণা অনুভব করি। বিজ্ঞান যেরকম একটা বিষয়, রান্না করাও একটা বিষয়। রন্ধনশাস্ত্রের উপর কত বই লেখা হয়েছে তুমি জানো?”
“নেটে সার্চ দিয়েই তো সব রেসিপি পাওয়া যায়।”
“সেটা তুমি দিতে থাকো। কিন্তু পৃথিবীতে ভালো ভালো রেস্টুরেন্ট তৈরি হয়েছে। মানুষ সেখানে গিয়ে খাবার উপভোগ করে।”
রতনের মুখ দেখে মনে হলো এই পুরো বিষয়টা বুঝি সে এই প্রথম জানতে পেরেছে। মানিক প্লেট থেকে হাত সরিয়ে বলল, “যে খাবার খেতে ভালো না আমি সেটা খাব না। তার মাঝে যত পুষ্টিই থাকুক না কেন।”
রতন বলল, “তুমি একটা জিনিস জানো?”
“কী?”
“এই যে তুমি ভালো স্বাদের কথা বলছ সেই স্বাদটা কোথায়?”
“আমার মুখে। তুমি যদি এখনো না জেনে থাক তাহলে তোমাকে জানিয়ে দিই আমরা মুখ দিয়ে খাই। তাই স্বাদটাও আমাদের মুখে।”
রতন বলল, “তোমার ধারণা হচ্ছে আমরা মুখ দিয়ে খাই তাই স্বাদের অনুভূতিটা আসে মুখ থেকে, আসলে
“আসলে কী?”
সবকিছু আমাদের মস্তিষ্কে। কোনো একটা কিছু খেতে যে আমাদের ভালো লাগে তার কারণ সেটা খেতে ভালো তা নয়। তার কারণ তখন আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের একটা সিগন্যাল দেয়। সেই সিগন্যালটা আসে নিউরনের সিনান্স কানেকশন থেকে। যখন একটা সিনা “।
মানিক হাত তুলে থামাল, “তোমার সিনাঙ্গের শীত বস্ত্র দহন করি।”
রতন তখন থতমত খেয়ে থেমে গেল। মানিক বলল, “তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমি খাবার টেবিল থেকে উঠে হাত ধুয়ে বাইরে যাব। মোড়ের খাবারের দোকান থেকে শিক কাবাব আর নানরুটি খেয়ে বাসায় যাব।”
রতন বলল, “হু।” কিন্তু তাকে দেখে বোঝা গেল সে মানিকের কথাটা শোনেনি, কিছু-একটা চিন্তা করছে।
মানিক বলল, “ইচ্ছে করলে তুমিও আমার সাথে আসতে পার। সুস্বাদু খাবার বলতে কী বোঝায় তুমি তার একটা ধারণা পাবে।”
রতন আবার বলল, “হু।”
এবারেও সে কিছু শোনেনি। মানিক বলল, “আমি কি যাব? তুমি কি আমার সাথে যাবে?”
রতন আবার বলল, “হুঁ।”
বোঝাই যাচ্ছে সে কিছু শুনছে না। ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে মানিক বলল, “তোমার ল্যাবরেটরির আলমারির ভেতরে কাঁচের বোতলে লাল রঙের কী যেন আছে। মনে হয় ভিনেগার–আমি খানিকটা ঢেলে নিয়ে গেলাম, বাসায় সালাদের মাঝে দিব।”
রতন বলল, “হু।”
মানিক তখন হাল ছেড়ে দিল। কোনো এক সময় রতন তাকে বলেছিল এই বোতলে মারাত্মক কী একটা এসিড, এটার থেকে দূরে থাকতে। সেটাকে ভিনেগার হিসেবে সালাদে দেয়া নিয়ে যখন রতনের মাথাব্যথা নেই তার মানে এখন সে কিছুই শুনছে না। মানিক আগেও দুই একবার রতনকে এভাবে চিন্তায় ডুবে যেতে দেখেছে। তাই সে আর এটা। নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে টেবিল থেকে উঠে হাত ধুয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। রতন ঠিক একইভাবে বসে রইল।
ঠিক দুই সপ্তাহ পর মানিক রতনের একটা এস.এম.এস পেল। সেখানে লেখা, “আজ রাতে তোমার আমার বাসায় খাবার দাওয়াত। খাবার মুখে দিয়ে ভালো না লাগলে তোমাকে খেতে হবে না।”
মানিক ঠিক করেছিল রতনের বাসায় অন্য সবকিছুর জন্যে সে যাবে কিন্তু খাওয়ার জন্যে কখনোই যাবে না। রতনের এস.এম.এস, পেয়ে সে অবশ্যি তার মত পাল্টালো। মুখে দিয়ে ভালো না লাগলে খেতে হবে না। এরকম কঠিন একটা কথা তো নিশ্চয়ই শুধু শুধু বলেনি নিশ্চয়ই সুস্বাদু। খাবারের আয়োজন করেছে।
সন্ধেবেলা রতনের বাসায় গিয়ে মানিক দেখল খাবার টেবিলে খাবার সাজানো। মানিক ভেবেছিল রতন নিশ্চয়ই অসাধারণ কিছু খাবার রান্না করে এনেছে কিন্তু দেখল আসলে সেরকম কিছু না। আগেরবার যেরকম কড়কড়ে কিছু ভাত, ত্যালত্যালে শবজি, ম্যাড়ম্যাড়া মাংস আর জ্যালজ্যালে ডাল ছিল, হুবহু সেই একই খাবার। শুধু তাই না সবকিছুতেই সেই কাঁঠাল পাতার মতো বাঁধাকপি। মানিকের প্রথমে মনে হলো এটা নিশ্চয়ই একটা রসিকতা। কিন্তু মানিক জানে রতনের নানা ধরনের গুণ তার মাঝে ছিটেফোঁটা রসিকতা নেই। কাজেই এটা কোনো রসিকতা নয়। মানিক শুকনো মুখে বলল, “এটাই তোমার আয়োজন?”
রতন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“মুখে দিয়ে ভালো না লাগলে খেতে হবে না?”
“না।”
মানিক ইতস্তত করে বলল, “আমি যদি মুখে না দিয়েই বলি ভালো লাগছে না তাহলে?”
রতন ভুরু কুঁচকে বলল, “মুখে না দিয়ে কেমন করে বলবে?”
“সমস্যা কী? এর আগেরবার যখন আমাকে খেতে ডেকেছিলে কথন তুমি হুবহু এই একই খাবার দিয়েছিলে। একই রং একই চেহারা একই গন্ধ। তখন আমার খেতে যেরকম লেগেছিল এখন তার থেকে অন্যরকম লাগবে কেন?”
রতন চোখে-মুখে একটা রহস্যের ভঙ্গি করে বলল, “আগে একটু খেয়ে দেখো।”
মানিক খুবই দুঃশ্চিন্তার ভঙ্গি করে টেবিলে রাখা মাংসের বাটি থেকে চামচে করে একটু ঝোল নিয়ে মুখে দেয়ার চেষ্টা করল তখন হঠাৎ রতন “না না না” বলে প্রায় চিৎকার করে ছুটে এল। মানিক ভয় পেয়ে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
রতন বলল, “তুমি এভাবে খেতে পারবে না। ঠিক করে বসে খেতে হবে।”
“ঠিক করে বসে? আমি শুধু একটু চেখে দেখছিলাম—“
“তুমি যদি চাখতেও চাও, ঠিক করে বসে চাখতে হবে।”
রতনের কাজকর্ম খুবই রহস্যজনক, কিন্তু মানিক বেশি অবাক হলো। বড়ো কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আগে তার কাজকর্ম এরকম রহস্যময় হয়ে যায়। এখন মনে হয় সে তার কোনো নূতন আবিষ্কার দেখাবে কিন্তু কড়কড়ে ভাত আর ম্যাড়ম্যাড়া মাংস কী আবিষ্কার হতে পারে মানিক ভেবে পেল না। মানিক অবশ্যি কোনো প্রশ্ন করল না, একটা চেয়ারে বসতে গেল তখন রতন আবার “না না না” বলে প্রায় চিৎকার করে উঠল। মানিক আবার ভয় পেয়ে প্রায় চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“এই চেয়ারে বসে না। বসার জন্যে তোমাকে আরেকটা চেয়ার এনে দিচ্ছি।”
“মানিক অবাক হয়ে বলল, এই চেয়ারে বসলে কী হবে?”
রতন তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভিতর থেকে আরেকটা চেয়ার নিয়ে আসে। চেয়ারটা অন্য রকম, মাথার কাছে একটা বড়ো হেলমেটের মতো। উপরে নীচে আলো জ্বলছে। চেয়ারের পিছনে একটা বাক্স দেখে মনে হয় এটা কোনো এক ধরনের কম্পিউটার। ভেতর থেকে শো শো শব্দ করে বাতাস বের হচ্ছে। রতন চেয়ারটা রেখে বলল, “তুমি এই চেয়ারে বস।”
মানিক একটু ভয়ে ভয়ে বলল, “আ-আমি এই চেয়ারে বসব?”
“হ্যাঁ।”
“এখানে বিদঘুঁটে কীসব যন্ত্রপাতি লাগানো।”
“তোমার সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।”
মানিক বলল, “তুমি জান আমি যন্ত্রপাতি খুবই অপছন্দ করি।”
“জানি।”
“কাজেই এই চেয়ারে এত যন্ত্রপাতি নিয়ে আমি বসতে রাজি না।”
“তোমাকে তো সারাজীবন বসতে হবে না। কিছুক্ষণ বসতে হবে। অন্য চেয়ারে না বসে এই চেয়ারে বসে খেতে হবে।”
মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “আমি রাজি না।”
রতন অবাক হয়ে বলল, “বসতে রাজি না?”
“না।”
“কেন?”
“যদি যন্ত্রটা আমাকে কিছু করে ফেলে?”
রতন বলল, “মানিক। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যন্ত্র তোমাকে কিছু করে ফেলবে না। তুমি এই চেয়ারে বসো, তোমার যদি এতটুকু অস্বস্তি হয় সমস্যা হয় তুমি চেয়ার থেকে উঠে এসো! কেউ তোমাকে এই চেয়ারে বেঁধে রাখছে না।”
মানিক তবুও সন্দেহের চোখে এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। রতন বলল, “এই দেখো, আমি এই চেয়ারে বসছি।” বলে রতন চেয়ারটিতে বসে বলল, “আমার কিছু হয়েছে? হয়নি।” সে আবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি এইভাবে একবার বসে দেখো।”
মানিক বলল, “ঠিক আছে। তোমাকে বিশ্বাস করে আমি এই একবার বসছি। কিন্তু জেনে রাখো এই প্রথম এবং এই শেষ।”
“ঠিক আছে।”
“আমি যন্ত্রকে ঘৃণা করি। শুধুমাত্র তোমার কারণে এরকম বিদঘুঁটে একটা যন্ত্রের কাছাকাছি আমি বসতে যাচ্ছি।”
“ঠিক আছে।”
“আমি ঘড়ি ধরে ঠিক এক মিনিট এই চেয়ারে বসে থাকব। তারপর উঠে যাব।”
“ঠিক আছে।”
মানিক তখন গিয়ে চেয়ারটিতে বসল, তার চোখে মুখে তখন খানিকটা বিরক্তি, খানিকটা ক্রোধ, খানিকটা যন্ত্রণা, খানিকটা তাচ্ছিল্য এবং খানিকটা অস্থিরতা। কিন্তু চেয়ারে বসার সাথে সাথে তার চোখে মুখে একটা বিচিত্র পরিবর্তন দেখা গেল। বিরক্তি, ক্রোধ যন্ত্রণা তাচ্ছিল্য অস্থিরতা সবকিছু সরে গিয়ে সেখানে এক ধরনের বিস্ময় আর আনন্দের ছাপা পড়ল। সে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, “অপূর্ব!”
রতন জিজ্ঞেস করল, “কী অপূর্ব?”
“তোমার রান্না। খাবারের এত সুন্দর ঘ্রাণ আমি জীবনে কখনো পাইনি! মনে হচ্ছে একেবারে স্বর্গীয়। আহা হা হা!”
রতন বলল, “তুমি বলেছ ঠিক এক মিনিট পর এই চেয়ার থেকে উঠে পড়বে। এক মিনিট শেষ হবার খুব বেশি দেরি নেই। তুমি ইচ্ছে করলে এখন উঠে পড়তে পার।”
মানিকের মুখে কেমন জানি বিহ্বল একটা হাসি ফুটে উঠল। বলল, “না রতন। আমার ওঠার কোনো দরকার নেই। খাবারের এই অপূর্ব ঘ্রাণে আমার জিবে পানি চলে এসেছে। আগে আমি খাব।”
রতন হাসি গোপন করে বলল, “ঠিক আছে।” তখন সে মানিকের সামনে আরেকটা চেয়ারে বসে পড়ল। মানিক খুব আগ্রহ নিয়ে তার প্লেটে কয়েক চামচ কড়কড়ে ভাত নিয়ে সেগুলোর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর পুরো প্লেটটা হাত দিয়ে নাকের কাছে এনে একটু ঘ্রাণ নিয়ে বলল, “আ হা-হা-হা! কী অপূর্ব ঘ্রাণ!”
তারপর হাত দিয়ে কয়েকটা ভাত নিয়ে মুখে দেয় আর সাথে সাথে তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে। ফিসফিস করে বলে, “অপূর্ব! অপূর্ব! একটা ভাতের যে এরকম স্বাদ হতে পারে আমি সেটা কোনোদিন কল্পনা করিনি! শুধু এই ভাত খেয়েই আমি দশটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব। এই অপূর্ব চাল তুমি কোথায় পেয়েছে রতন?”
রতন সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে বলল, “এই তো পেয়েছি, আর কী! যাই হোক তুমি শুধু ভাত খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলো না। একটু সবজি খাও। একটু মাংস খাও।”
মানিক তখন লোভীর মতো সবজির বাটিটা নিজের কাছে টেনে এনে কয়েক চামচ সবজি নিয়ে তার দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর খুব সাবধানে এক টুকরো বাঁধাকপি নিয়ে মুখে দিয়ে চিবুতে থাকে। খাওয়ার আনন্দে তার সারা মুখ ঝলমল করতে থাকে, ধীরে ধীরে তার চোখ দুটো আধবোজা হয়ে যায়। মানিকের মুখ দিয়ে তৃপ্তির নানা রকম শব্দ বের হতে থাকে!
রতন তাকে ডাকল, “মানিক।”
“বলো।”
“আমার রান্না কেমন হয়েছে?”
মানিকের গলা আবেগে প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। কোনোভাবে কষ্ট করে বলল, “ভাই রতন, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। তোমার মতো এত সুন্দর করে কেউ রান্না করতে পারবে না। আমি লক্ষ টাকা বাজি ধরতে পারি, সারা পৃথিবীতে তোমার মতো এত চমকার কেউ রান্না করতে পারবে না।”
রতন হাসি হাসি মুখ করে বলল, “থ্যাংকু মানিক। এখন তুমি খাও।”
মানিক তখন খেতে শুরু করল, একটু একটু করে খাবার মুখে দেয় এবং সাথে সাথে তার সারা শরীর আনন্দের একটা শিহরণ বয়ে যায়। তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে আর মুখ থেকে তৃপ্তির নানা ধরনের অব্যক্ত আনন্দের অস্পষ্ট শব্দ বের হতে থাকে। রতন নিজেও খায় কিন্তু তার মাঝে সেরকম বাড়াবাড়ি আনন্দের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। তার চোখে মুখে খানিকটা কৌতূহল এবং মুখে এক ধরনের হাসি তার চেয়ে বেশি কিছু সেখানে নেই।
মানিক তার খাওয়া শেষ করত বলে মনে হয় না, সে খেতেই থাকে এবং খেতেই থাকে। রতন এক সময় প্রায় জোর করে টেবিল থেকে খাবারের প্লেট আর বাটি সরিয়ে নিল তখন মানিক বাধ্য হয়ে তার খাওয়া। শেষ করে চেয়ার থেকে উঠে এল। বেশি খাওয়ার কারণে মানিক খুব ভালো করে নড়তে পারছিল না, কোনোমতে এসে সে সোফায় গড়িয়ে পড়ল। বিশাল একটা অশালীন ঢেকুর তুলে বলল, “রতন, আজকে তোমার রান্না খেয়ে আমি প্রথমবার অনুভব করলাম স্বর্গীয় অনুভূতি বলতে কী বোঝায়। তোমাকে আগে আমি বেশি গুরুত্ব দেইনি, কিন্তু যে এত চমৎকার, এত অসাধারণ রাধতে পারে তাকে আসলে মাথায় তুলে রাখা উচিত।”
রতন সামনে আরেকটা সোফায় বসে বলল, “মানিক। আমি আসলে রাঁধতে পারি না। এর আগেরবার তোমাকে যা খেতে দিয়েছিলাম, আজকেও আমি তোমাকে হুবহু একই জিনিস খেতে দিয়েছি।”
মানিক হা হা করে হাসল। বলল, “তুমি বললেই তো আর আমাকে সেটা বিশ্বাস করতে হবে না। আমি নিজেই তো খেয়েছি, রান্নার পার্থক্য স্বাদের পার্থক্যটা তো আমি নিজে দেখেছি।”
“তুমি দেখ নাই। এখানে অন্য একটা ব্যাপার কী ঘটেছে।”
মানিক জিজ্ঞেস করল, “কী ঘটেছে?”
রতন বলল, “মনে আছে, আমি তোমাকে বলেছিলাম, স্বাদের পুরো ব্যাপারটা আসলে মুখে ঘটে না, এটা ঘটে তোমার মস্তিষ্কে।”
“বলেছিলে নাকি?”
“হ্যাঁ। বলেছিলাম। আবার বলছি। যেহেতু ব্যাপারটা ঘটে তোমার মস্তিষ্কে তাই কোনো কিছু খেয়ে সেটা ভালো লাগার জন্য আমরা সেটাকে সুস্বাদু করে রান্না না করে মস্তিষ্কে সুস্বাদু লাগার অনুভূতি দিলে একই ব্যাপার ঘটবে।”
মানিক চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “মস্তিষ্কে? মস্তিষ্কে অনুভূতি?”
“হ্যাঁ”
“সেটা তুমি কখন দিয়েছ?”
“আমার চেয়ার।”
“তোমার চেয়ার?”
রতন বলল, “মনে নেই তোমাকে আমি আমার ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে খেতে দিইনি! তোমাকে বাধ্য করেছি আমার স্পেশাল চেয়ারে বসতে?”
“হ্যাঁ। মনে আছে?”
“এই চেয়ারটা বিশেষভাবে তৈরি। মাথার মাঝে হাই ফ্রিকোয়েন্সির ম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে মস্তিষ্কের ভেতর ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করতে পারে?”
মানিক কিছুক্ষণ রতনের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি আমার মস্তিষ্ক অনুরণন করেছ নাকি আসলেই খাবারগুলো স্বর্গীয় ছিল আমি সেটা কোনোদিন জানতে পারব না। কিন্তু আমাকে বলতেই হবে, আজ রাতের খাওয়াটা আমার জন্য ছিল একটা স্বর্গীয় অনুভূতি।”
রতন মাথা নাড়ল, বলল, “আমি জানি। আমি নিজেকে দিয়ে পরীক্ষা করেছি। কিন্তু আমি আরো একজনকে দিয়ে ব্যাপারটা পরীক্ষা করাতে চেয়েছিলাম, তাই আমি তোমাকে ডেকে এনেছি। কাজেই এখন আমি বলতে পারি আমার এক্সপেরিমেন্ট পুরোপুরি কাজ করেছে। আমি এখন জানি কেমন করে ইচ্ছে করলেই একজন মানুষকে মজার মজার খাওয়ার অনুভূতি দেয়া যায়। ভালো করে রান্না করারও দরকার নেই, যা খুশি রাঁধতে পারো, খাওয়ার সময় শুধু মস্তিষ্কে স্বাদের অনুভূতিটা দিতে হবে।”
মানিক কষ্ট করে সোফায় সোজা হয়ে বসে বলল, “তুমি যেভাবেই বলতে চাও বলো, কিন্তু আমি তোমাকে জানাতে চাই আজ রাতের খাবারটা ছিল একটা স্বর্গীয় অনুভূতি।”
রতন হাসল, বলল, “আমি তো কখনো স্বর্গে যাইনি তাই স্বর্গের অনুভূতি কেমন হয় এখনো জানি না।”
একটু পর মানিক জিজ্ঞেস করল, “এখন এই চেয়ারটা দিয়ে তুমি কী করবে?”
রতন বলল, “আমার কাজ শেষ তাই এই চেয়ারের আর কোনো দরকার নাই। যন্ত্রগুলো খুলে অন্য কাজে লাগাব। আমার পরের গবেষণা হবে–”
মানিক তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “কী বললে? এই চেয়ারের আর দরকার নেই?”
“কী বলছ তুমি? তোমার দরকার না থাকলে আমাকে দিয়ে দাও। আমি নিয়ে যাব। আমার বাসায় রাখব।”
রতন হা হা করে হেসে বলল, “তুমি না একটু আগে আমাকে বলেছিলে তুমি যন্ত্রকে ঘৃণা কর! এখন তুমি এই যন্ত্র তোমার বাসায় নিয়ে যাবে?”
মানিক থতমত খেয়ে বলল, “এটা তো যন্ত্র নয়, রতন। এটা হচ্ছে স্বর্গের সাথে যোগাযোগের একটা মাধ্যম।”
রতন বলল, “সব যন্ত্রই এরকম যোগাযোগের কোনো না কোনো মাধ্যম। তুমি হয়ত আগে লক্ষ করনি।”
মানিক বলল, “ঠিক আছে। তাহলে এখন তুমি কি এই চেয়ারটা। আমাকে দেবে?”
“তুমি যদি চাও অবশ্যই দেব! কিন্তু আমি তোমাকে একটা জিনিস বলি। সেটা হচ্ছে স্বাভাবিক কাজ স্বাভাবিকভাবে করতে হয়, সেখানে খামোখা যন্ত্রকে হাজির করতে হয় না! যদি ভালো খেতে চাও ভালো রান্না করা শিখে নাও, যন্ত্র দিয়ে মস্তিষ্কে স্টিমুলেশন দিও না।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে।” মানিক হাত তুলে রতনকে শান্ত করে। বলল, “মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যন্ত্রের ভূমিকা এটা নিয়ে একটা গোল টেবিল বৈঠক করা যাবে। আপাতত তুমি আমাকে এই চেয়ারটা দাও।”
“অবশ্যই দিব। কিন্তু একটা শর্ত।”
“কী শর্ত?”
“তুমি এই চেয়ার দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পার। কিন্তু অন্য কোনো মানুষকে এই চেয়ারের কথা বলতে পারবে না।”
“বলব না। আমি জানি তুমি কখনো কোনো সাংবাদিককে তোমার গবেষণার কথা বল না। বলতে চাও না।”
কাজেই সেদিন রাত্রিবেলা মানিক এই বিশেষ চেয়ারটা ঘাড়ে করে তার বাসায় নিয়ে গেল।
.
এরপর থেকে মানিকের দিনগুলো সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গেল। এমনিতে সে খাওয়া পছন্দ করে এখন খাওয়ার ব্যাপারটা তার জীবনের একমাত্র ব্যাপার হয়ে গেল। সকালে নাস্তা করতে বসে সে খেতেই থাকে। খাওয়ার সময় সেটা টের পায় না পরে বেশি খাওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে। আগে কখনোই দুপুরে খাওয়ার জন্যে বাসায় আসত না এখন যত ঝামেলাই থাকুক সে দুপুরে খাওয়ার জন্য বাসায় ফিরে আসে। তার বাসার কাজকর্মে সাহায্য করার মহিলা ময়নার মা যেটাই বেঁধে রাখে সে খেয়ে শেষ করে ফেলে! রাত্রে বেলায় তো কথাই নেই, রান্না করা খাবার থাকলে ভালো, না থাকলেও সমস্যা নেই ফ্রিজে যা আছে মানিক কপকপ করে খেতে থাকে। এভাবে খেতে থাকলে মানিকের কয়েকদিনের মাঝে হাতির মতো মোটা হয়ে যাবার কথা। তার শরীর এত অল্প সময়ে এত খাবার সহ্য করতে পারবে কি না সেটাও একটা বিশাল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল। খাবার খেতে কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু হজম করতে গিয়ে তার শরীর কাহিল। হতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত কী হতো কেউ বলতে পারে না কিন্তু তার মাঝে হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় পুরো ব্যাপারটা অন্য রকম হয়ে গেল।
.
মানিক সেদিন রাতের খাবার খেয়ে সোফায় বসে একটা বই পড়ছে, ফ্রিজে খাবার নেই বলে আজকে বেশি খেতে পারেনি, তাই ভেতরে একটু অতৃপ্তির ভাব। ঠিক এরকম সময়ে তার দরজায় শব্দ হলো। দরজা খুলতেই দেখে সেখানে কালা কবি দাঁড়িয়ে আছে। কালা কবির নাম কেন কালা কবি সেটা কেউ জানে না, কারণ সে কালো না এবং কবিও না। তার গায়ের রং যথেষ্ট ফর্সা এবং সে যদিও কবি সাহিত্যিকদের জগতে ঘুরোঘুরি করে, তার। চেহারা এবং ভাবভঙ্গি কবিদের মতো কিন্তু সে নিজে কোনোদিন একটা লাইন কবিতাও লিখেনি। মানুষটা ধুরন্ধর, মতলববাজ এবং অসৎ, তাকে। দেখলেই সবার মুখ কালো হয়ে যায় সেজন্য হয়ত তার নাম কালা কবি। তবে শব্দটা কালো না হয়ে কেন কালা তারও ভালো ব্যাখ্যা নেই। দরজায় কালা কবিকে দেখে মানিকের মুখটা একটু কালো হয়ে গেল, সে তারপরও যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক থাকার ভান করে বলল, “আরে! তুমি! কী মনে করে? এসো।”
কালা কবি ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “তোমাদের এইদিকে একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত ছিল। তাই ভাবলাম তোমার বাসাটা দেখে যাই।” কথাটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, জেনেশুনে তাকে কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়ার কথা না।
মানিক মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে রেখে বলল, “এসো, এসো, বসো।”
কালা কবি না বসে ঘরের ভিতরে হেঁটে হেঁটে সবকিছু দেখতে দেখতে তার সেই বিশেষ চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, “এটা কী?”
মানিক কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “চেয়ার।”
“চেয়ারটা এরকম কেন? এত যন্ত্রপাতি কেন?”
মানিক ইতস্তত করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “না মানে ইয়ে এটা হচ্ছে গিয়ে মানে যাকে বলে একটা ডাক্তারি চেয়ার। মানে শরীরে সমস্যা থাকলে এখানে বসে, মানে ইয়ে সেই সমস্যাগুলো তখন বোঝা যায়।” মানিক ভালো মিথ্যে কথা বলতে পারে না তাই তার কথাটা খুবই খাপছাড়া শোনাল।
কালা কবি খুবই সন্দেহের চোখে একবার মানিকের দিকে তাকাল তারপর আরেকবার চেয়ারটার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আমার বড়ো দুলাভাইয়ের ডায়াগনস্টিক চেম্বার আছে, আমি সেখানে এইরকম কোনো ডাক্তারি চেয়ার কখনো দেখি নাই।”
মানিক আমতা আমতা করে বলল, “এটা ঠিক বাণিজ্যিক নয়, এটা অনেকটা পরীক্ষামূলক চেয়ার। সেজন্যে মনে হয় কখনো দেখোনি।”
কালা কবি আরো সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “তোমার বাসায় পরীক্ষামূলক যন্ত্রপাতি কীভাবে এসেছে? তুমি কবি মানুষ, সবসময় বলে বেড়াও যন্ত্রপাতিতে তোমার এলার্জি–”
মানিক আবার মাথা চুলকাল, সে মিথ্যে কথা বলতে পারে না কিন্তু এখন তাকে মিথ্যা কথাই বলতে হবে, কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “এটা আমার ছোটো খালুর চেয়ার। তার ছেলে বানিয়ে দিয়েছে। খালুর বাসায় রাখার জায়গা নেই তাই এখানে পাঠিয়েছে।”
একটা বাসায় একটা চেয়ার রাখা যায় না এটা খুব বিশ্বাস করার মতো কথা না তাই কালা কবি আরো অনেক বেশি সন্দেহের চোখে মানিকের দিকে তাকিয়ে রইল। মানিক তখন তার কথাটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে নেওয়ার জন্যে বলল, “তা তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো।”
বলেই বুঝতে পারল এই কথাটা বলা ঠিক হয়নি। কারণ কালা কবি তখন যে কাজটা করল তার জন্যে মানিক একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। মানিক কিছু বোঝার আগেই কালা কবি হেঁটে হেঁটে গিয়ে তার এই বিশেষ চেয়ারটাতে বসে পড়ে। মানিক অবাক হয়ে দেখল এতক্ষণ কালা কবির চোখে মুখে একটা সন্দেহ, একটা ভ্রুকুটি খেলা করছিল হঠাৎ করে তার বদলে সেখানে আনন্দের একটা ছাপ এসে পড়ল। তার চোখে মুখে আরাম আর তৃপ্তির একটা ঢেউ খেলে যেতে থাকে, মানিক দেখল কালা কবির চোখ আরামে কেমন যেন বন্ধ হয়ে আসছে।
মানিক কী করবে বুঝতে পারল না, সে যন্ত্রপাতি চালাতে পারে না বলে এটা সব সময়েই অন করে রাখা থাকে। এভাবে যে কালা কবি এখানে বসে যাবে সে একেবারেই সন্দেহ করেনি। একজন বড় মানুষ একটা চেয়ারে বসে গেলে তাকে টেনে ওঠানো সম্ভব না, মানিক তাই সে চেষ্টা করল না, বলল, “এখানে বসো না। উঠে আসো তাড়াতাড়ি উঠে। আসো।”
কালা কবি মধুর স্বরে বলল, “কেন ভাই? বসলে কী হয়?”
মানিক বলল, “দেখছ না কত যন্ত্রপাতি–এখান থেকে কতকিছু বের হয়। মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে।”
কালা কবির মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো, সে সারা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “মস্তিষ্কের ক্ষতি হলে হোক। আমার কিছু আসবে যাবে না। আমি এখানেই বসব। বসে থাকব।”
মানিক নিজেই লক্ষ করেছে এই চেয়ারে বসলেই একটা আরামের। অনুভূতি হতে থাকে আর খাওয়া শুরু করলে তো কথাই নেই। ভাগ্যিস কালা কবির সামনে কোনো খাবার নেই, যদি কোনো একটা খাবার থাকতো তাহলে কী হতো?
কালা কবি তার ঢুলুঢুলু চোখ খুলে বলল, “কী আরাম! আমার বাপের জন্মে কখনো এত আরাম পাই নাই। কী হয়েছে? আমার এত আরাম লাগে কেন?”
মানিক কী বলবে বুঝতে পারল না, চোখ বড়ো বড়ো করে কালো। কবির দিকে তাকিয়ে রইল। কালা কবি তখন ধীরে ধীরে তার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে লাগিয়ে ফস্ করে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে সেটা জ্বালিয়ে নিয়ে লম্বা টান দিল। মানিক দেখল সাথে সাথে কালা কবির সমস্ত চেহারা যেন আনন্দে, আরামে, সুখে, তৃপ্তিতে একেবারে একশ ওয়াট বাতির মতো জ্বলে উঠল! মানিকের আর বুঝতে বাকি রইল না এই চেয়ারের গোপন কথাটা এখন কালা কবি টের পেয়ে যাবে। সে শুনল, কালা কবি তার সারা শরীর এলিয়ে দিয়ে গভীর আরামের একটা শব্দ করল, “আ-হ্-হ্-হ্-হ্-হ্…!”
কালা কবি কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে আবার সিগারেটে আগের থেকেও একটা লম্বা টান দিল আর মনে হলো এবারে আনন্দে, আরামে আর তৃপ্তিতে তার সারা শরীর এলিয়ে গেল। সে ঢুলুঢুলু চোখে মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই সিগারেটে কী আছে বলো তো? একেক টানে মনে হচ্ছে একেবারে স্বর্গে চলে যাচ্ছি! ব্যাপারটা কী?”
মানিক জানে ব্যাপারটা কী, কিন্তু সেটা তো আর কালা কবিকে বলতে পারে না, তাই যেটা বলতে পারে সেটাই বলল, “আমার ঘরে আমি কাউকে সিগারেট খেতে দিই না! তুমি যদি খেতে চাও বাইরে গিয়ে খাও।”
কালা কবির মুখে বিশাল একটা হাসি ফুটে উঠল, বলল, “কেন? ঘরে সিগারেট খেলে কী হয়?”
“ঘরে বোঁটকা একটা গন্ধ হয়।”
কালা কবি তখন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, কাছে দাঁড়িয়ে থেকে খানিকক্ষণ চেয়ারের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর আবার সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে মুখ বিকৃত করে খকখক করে কেশে উঠল। বলল, “এ কী? এত মজার সিগারেটটার এই অবস্থা কেন? সিগারেট তো না মনে হচ্ছে। ট্রাকের মবিল পোড়া ধোঁয়া।”
মানিক এবারে মুখ শক্ত করে বলল, “ঘরের ভেতরে না। বাইরে।”
কালা কবিও তার মুখ শক্ত করে বলল, “দাঁড়াও। আমাকে ব্যাপারটা আগে বুঝতে দাও। এই চেয়ারে বসে সিগারেট খেলে মনে হয় বেহেশতি সিগারেট আর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেই মনে হয় মবিল পোড়া ধোয়া–ব্যাপারটা কী?”
মানিক বলল, “কোনো ব্যাপার নেই। রাত হয়েছে, তুমি এখন বাসায় যাও। আমার কাজ আছে।”
শুধু কথা বলেই মানিক শান্ত হলো না, সে সারাজীবন যে কাজটা করেনি সেই কাজটা করে ফেলল, কালা কবিকে সে ঠেলে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করল।
কালা কবি মোটেই বের হতে রাজি হলো না, সিগারেটটা হাতে নিয়ে প্রায় জোর করে আবার চেয়ারটাতে বসে গেল, তারপর সিগারেটে লম্বা আরেকটা টান দিয়ে আনন্দের একটা শব্দ করল, “আ হ হ হ হ হ হ…!”
মানিক বুঝতে পারল সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। কালা কবি এই চেয়ারটা সম্পর্কে জেনে গেছে। ঠিক তাই হলো, সে ঢুলুঢুলু চোখে মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন আমি বুঝতে পারছি তুমি কেন এই চেয়ার নিয়ে সত্যি কথাটা কাউকে বলো না!”
মানিক কোনো কথা বলল না। কালা কবি বলল, “এই চেয়ারে বসে সিগারেট টানতেই এত আনন্দ, একটা রসগোল্লা খেলে না জানি কত আনন্দ হবে। মানিক ভাই, দাও না একটা রসগোল্লা!”
মানিক বলল, “রসগোল্লা নেই।”
“তাহলে কী আছে?”
“কিছু নেই।”
“কিছু নাই? ভাত, রুটি, ডিম?”
“না। কিছু নেই।”
“কিছু নাই?” কালা কবি একটু ব্যস্ত হয়ে বলল, “তাহলে ঐ খবরের কাগজটা দাও না।”
“কেন?”
“খেয়ে দেখব কেমন লাগে।”
“খবরের কাগজ? তুমি খবরের কাগজ খাবে?” কা
লা কবি ঢুলুঢুলু চোখে বলল, “কেন? খেলে সমস্যা আছে?”
মানিক কোনো কথা বলল না, মুখ শক্ত করে খবরের কাগজটা কালা কবির হাতে ধরিয়ে দিল। কালা কবি প্রথমে খেলাধুলার পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলল। মানিক দেখল কালা কবির চোখে-মুখে আনন্দ। সে যত তৃপ্তি দিয়ে খবরের কাগজটা খেলো কোনো মানুষ এত তৃপ্তি করে কখনো রসমালাই কিংবা গুড়ের সন্দেশ খায়নি। খেলাধুলার পৃষ্ঠা শেষ করে সম্পাদকীয় পাতা, তারপর আন্তর্জাতিক খবর, সবার শেষে পত্রিকার হেডলাইন সে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল। শুধু যে খেলো তা নয়, প্রতি এক মিনিট পর পর আহা উঁহু করে তৃপ্তির শব্দ করতে লাগল।
মানিক বলল, “খবরের কাগজ খেয়ে ফেলাটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।”
সিনেমার পৃষ্ঠাটা চিবুতে চিবুতে কালা কবি বলল, “কেন? ভালো হচ্ছে না কেন?”
“খবরের কাগজ কেউ খায় না। এটা খাওয়ার জিনিস না। এটা তোমার হজম হবে না। তোমার পেটের সমস্যা হবে।”
কালা কবি বলল, “যে জিনিস খেতে এত মজা সেটা হজম হবে না কেন? একশবার হজম হবে।”
মানিক কী করবে বুঝতে না পেরে হতাশ হয়ে সোফায় বসে কালা কবির দিকে তাকিয়ে রইল।
কালা কবি খবরের কাগজ পুরোটা খেয়ে শেষ করে শেলফ থেকে সাতশ পৃষ্ঠার সঞ্চয়িতাটা নিয়ে খাওয়া শুরু করল। মানিক অনেক কষ্ট করেও তাকে থামাতে পারল না।
কালা কবি অবশ্যি পুরো সঞ্চয়িতাটা খেয়ে শেষ করতে পারল না, শেষ একশ পৃষ্ঠা বাকি থাকতেই এম্বুলেন্স ডেকে কালা কবিকে হাসপাতালে নিতে হলো। ইমার্জেন্সিতে একজন ডাক্তার ঘুম ঘুম চোখে বসেছিল কালা
কবিকে দেখে উঠে এল। জানতে চাইল, সমস্যাটা কী? কালা কবি পেট চেপে ধরে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে বলল, “ব্যথা। পেটে ব্যথা!”
“কী হয়েছে। কেন ব্যথা?”
কালা কবি তখন কোনো উত্তর দিল না। মানিক বলল, “আজকের খবর কাগজ আর সঞ্চয়িতার প্রায় পুরোটা খেয়ে ফেলেছে।”
ডাক্তারের ঘুম ঘুম ভাব পুরোপুরি ছুটে গেল, “কী খেয়ে ফেলেছে?”
মানিককে আবার বলতে হলো, “আজকের খবরের কাগজ আর। সঞ্চয়িতার প্রায় পুরোটা।”
ডাক্তার বলল, “খ-খ-খ” মানিক বাক্যটা শেষ করিয়ে দিল, “জি। খবরের কাগজ।”
“আর স-স-স”
“জি, সঞ্চয়িতা। তৃতীয় সংস্করণ। অফসেট কাগজ—“
ডাক্তার কিছুক্ষণ কালা কবির দিকে আর কিছুক্ষণ মানিকের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
মানিক একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “সেটা বলা সম্ভব না। যদি বলাও হয় বোঝানো সম্ভব না। যদি বোঝানো সম্ভব হয় বিশ্বাস করানো সম্ভব না। যদি বিশ্বাস করানো সম্ভব হয় গ্রহণ করা সম্ভব না। যদি গ্রহণ করানো সম্ভব হয়–“
ডাক্তার এই সময় হাত তুলে মানিককে থামিয়ে দিল।
.
গভীর রাতে দরজায় শব্দ শুনে রতন ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দিল। দেখল মানিক তার চেয়ারটা ঘাড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রতন জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার মানিক, এত রাতে?”
“তোমার চেয়ারটা ফেরত দিতে এসেছি।”
“কেন?”
“কারণটা এই মুহূর্তে বলে শেষ করা সম্ভব না। যদি বলা হয়। বোঝানো সম্ভব না। যদি বোঝানো সম্ভব হয় বিশ্বাস করানো সম্ভব না। যদি বিশ্বাস করানো সম্ভব হয় গ্রহণ করা সম্ভব না। যদি গ্রহণ করা সম্ভব হয়”
রতন হাত তুলে থামিয়ে দিল। বলল, “বুঝেছি। এসো, ভেতরে এসো।”
মানিক ভিতরে ঢুকে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “মনে আছে, যন্ত্রপাতি নিয়ে
আমার একটা এলার্জির মতো ছিল?”
“হ্যাঁ। মনে আছে।”
“এলার্জিটা আবার ফিরে এসেছে।” রতন হাসি হাসি মুখে বলল, “চমৎকার!”