৪. চতুর্থ পর্ব (দশ বছর পর)

৪. চতুর্থ পর্ব (দশ বছর পর)

ত্রাতিনা চোখ খুলে তাকালো। ক্যাপসুলের পরিচিত স্ক্রীনটার দিকে তাকিয়ে সে আবার চোখ বন্ধ করল। নেপচুনের কক্ষপথ পার হয়ে সে সৌরজগতের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। পৃথিবী থেকে এখানে একটি সিগন্যাল পৌঁছাতে সময় নেয় চার ঘণ্টা। গত দশ বছরে সে দশ বার ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। প্রতিবারই গ্রাহাকে ঘুম থেকে তুলেছে, তারপর দুজন মিলে মহাকাশযান পেপিরার খুঁটিনাটি পরীক্ষা করেছে। পৃথিবীর সাথে তথ্য বিনিময় করেছে। রুখ এবং গিসার সাথে কথা বলেছে। এই দুটি এনড্রয়েড গত বারো বছর কোনো অভিযোগ না করে কন্ট্রোল রুমে বসে পেপিরার যন্ত্রপাতি লক্ষ্য করেছে, তারা না থাকলে সে প্রতিবার এতো দীর্ঘ সময়ের জন্যে ক্যাপসুলের ভেতর ঘুমিয়ে কাটাতে পারত না।

ত্রাতিনা আবার চোখ খুলে তাকালো। পরিচিত স্ক্রীনটিতে সবুজ একটি বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। স্ক্রীনটি থেকে তাকে জাগিয়ে তোলার জন্যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ত্রাতিনা শরীরে শক্তি অনুভব করতে শুরু করেছে। তাকে হাত এবং পা নাড়াতে বলা হলো। তারপর মাথা ঘোরাতে বলা হলো, চোখ খুলতে এবং বন্ধ করতে বলা হলো। তারপর ছোট একটা গুণ অংক করতে দেয়া হলো। মাথার ভেতরে গুণ অংকটি শেষ করে সে ফিসফিস করে উত্তরটি বলার সাথে সাথে ক্যাপসুলের ঢাকনাটি খুলে যেতে শুরু করে। ক্যাপসুলের দুই পাশে রুখ এবং গিসা দাঁড়িয়ে আছে। তারা হাসিমুখে ত্রাতিনাকে অভিবাদন জানাল। রুখ বলল, “পেপিরাতে তোমাকে স্বাগতম ত্রাতিনা।”

ত্রাতিনা বলল, “তোমাদের ধন্যবাদ। শেষ বছরটি কেমন কেটেছে তোমাদের দু’জনের?

গিসা বলল, “একেবারেই উত্তেজনাহীন। তোমাকে বলার মতো কিছুই ঘটেনি। পেপিরার যন্ত্রপাতি নিখুঁত–আমার মনে হয় এতো নিখুঁত না হলেই ভালো হতো। তাহলে আমাদের জীবনে একটুখানি বৈচিত্র্য থাকতো।”

”ঠিক আছে। আমরা যখন পৃথিবীতে ফিরে যাব, তখন আমাদের রিপোর্টে আমি এই কথাটি লিখে দেব।”

ত্রাতিনা তার ক্যাপসুল থেকে বের হলো। রুখ এবং গিসা তাকে দুই পাশ থেকে ধরে বের হতে সাহায্য করল। ত্রাতিনা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এতোদিন আমরা যা জেনে এসেছি আর যা শিখে এসেছি, এখন তার পরীক্ষা হবে। তোমাদের কী মনে হয় রুখ এবং গিসা, আমাদের মিশন কী : কাজ করবে?”

রুখ মুখ শক্ত করে বলল, “অবশ্যই করবে।”

গিসা বলল, “এই মিশনের প্রতিটি খুঁটিনাটি অনেকবার করে দেখা হয়েছে। নিশ্চয়ই কাজ করবে।”

ত্রাতিনা তার লাউঞ্জের দিকে যেতে যেতে বলল, “যাও গ্রাহাকে তুলে নিয়ে আস। মিশনের খুঁটিনাটিতে গ্রাহা ছিল না, তাকে আমাদের সাথে নিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি ভালো হল না খারাপ হল, বুঝতে পারছি না!”

.

কিছুক্ষণ পর লাউঞ্জে বসে খেতে খেতে ত্রাতিনা গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা, তুমি কী প্রস্তুত?”

“আমি সব সময়েই প্রস্তুত।”

“চমৎকার।”

গ্রাহা কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরের কুচকুচে অন্ধকার মহাকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি দাবি করছ আমরা এই মুহূর্তে মহাজাগতিক প্রাণী কিংবা মহাজাগতিক অস্তিত্বের মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে গেছি?”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল।

গ্রাহা বলল, “ব্যাপারটা চিন্তা করলেই আমার কেমন জানি গা গুলিয়ে আসে।”

“চিন্তা করো না।”

“হ্যাঁ। চিন্তা করছি না।”

ত্রাতিনা রুখ এবং গিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা কী প্রস্তুত?”

দু’জনেই মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। প্রস্তুত।”

“চল তাহলে কাজ শুরু করে দিই।”

.

চারজন তখন পেপিরার শেষ মাথায় গিয়ে লোডিং ডকের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। সেখানে থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটি রাখা আছে। বোমাটির তিন পাশে তিনটি ছোট ট্রিটন রকেট লাগানো। গ্রাহা একটু বিস্ময়ের সাথে বলল, “আমি আগে কখনো হাইড্রোজেন বোমা দেখিনি।”

ত্রাতিনা বলল, “দেখার কথা না! এটা রেফ্রিজিরেটর কিংবা এয়ার কুলারের মতো একটা জিনিস না।”

গ্রাহা বিস্ময়ে মাথা নেড়ে বলল, “একটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা এতো ছোট হয়, আমি জানতাম না।”

ত্রাতিনা বলল, “আমার মনে হয় পৃথিবী যদি রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে শাসন করা হতো, তাহলে বোমার ওপর আরো গবেষণা হতো, বোমাগুলো আরো ছোট হতো। কিন্তু এখন যেহেতু পৃথিবী পরিচালনা করছে। বিজ্ঞানীরা, তাই যুদ্ধ বিগ্রহ নেই। বোমা নিয়েও গবেষণা নেই।”

“ঠিকই বলেছ।”

“আমাদের এই থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটির অবস্থান ঠিক করতে হবে।”

ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলের কিছু বোতাম টিপে কাজ শুরু করে দেয়। একটা যান্ত্রিক শব্দ হয় এবং তিনটি রকেট লাগানো থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটির সামনের অংশ ধীরে ধীরে উঁচু হতে থাকে। ঠিক পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণে আসতেই সেটি থেমে গেল। ত্রাতিনা মুখে সন্তুষ্টির শব্দ করে বলল, “এখন বায়ু নিরোধক হ্যাঁচটি খুলে দিতে হবে। তাহলে রকেট তিনটি বোমাটি নিয়ে বের হয়ে যেতে পারবে।”

রুখ এবং গিসা ঘুরে ঘুরে সবকিছু পরীক্ষা করে বলল, “সব ঠিক আছে। রকেট লাগানো বোমাটি পেপিরার মাউন্ট থেকে খুলে দেয়া হয়েছে।”

“চল তাহলে ভেতরে যাই।”

“চল।”

চারজনের ছোট দলটি গোল হ্যাঁচের ভেতর দিয়ে পেপিরার ভেতরে ফিরে এলো। বায়ু নিরোধক ঢাকনা দিয়ে হ্যাঁচ বন্ধ করল। তারপর ওপরের বায়ু নিরোধক ঢাকনাটি খুলে দিল। বোমাটি এখন মহাকাশে বের হওয়ার জন্যে প্রস্তুত। শেষ মুহূর্তে ত্রাতিনা গোপন পাসওয়ার্ড দিয়ে বোমাটিকে বিস্ফোরণের জন্যে প্রস্তুত করে নিল। ঠিক তিরিশ মিনিট পরে এটি বিস্ফোরিত হবে।

ত্রাতিনা সবাইকে নিয়ে কন্ট্রোল রুমে ফিরে আসে। নিজেদের সিটে বসে নিরাপত্তা বন্ধনী দিয়ে নিজেদের আটকে নেয়। তারপর সুইচ টিপে থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটি উন্মুক্ত করে দেয়। তিনটি ট্রিটন রকেট এক সাথে গর্জন করে চালু হয়ে যায়। পুরো মহাকাশযান একটা প্রবল ঝাঁকুনি অনুভব করল এবং সাথে সাথেই তারা মনিটরে থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটিকে উড়ে যেতে দেখল। রকেট তিনটির পিছন থেকে জ্বলন্ত গ্যাস বের হতে থাকে। এবং দেখতে দেখতে সেটি চোখের আড়াল হয়ে যায়।।

ত্রাতিনা নিজেকে সিট থেকে মুক্ত করে বলল, “বোমাটি বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশন মাপার জন্যে সবকিছু ঠিক আছে?”

রুখ মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিক আছে।”

“চমৎকার। বোমা বিস্ফোরণের সিগন্যাল পাওয়ার সাথে সাথে আমাদের যোগাযোগ মডিউলটি চালু করতে হবে।”

“আমরা প্রস্তুত।”

“পরবর্তী তিরিশ মিনিট আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।”

গ্রাহা বলল, “আমি সবসময়েই শুনে এসছি, অপেক্ষা করা মৃত্যু থেকেও ভয়ংকর!”

ত্রাতিনা হাসল। বলল, “মৃত্যু মোটেও ভয়ংকর নয়।”

ঠিক তিরিশ মিনিট পর পেপিরার ভেতরে থাকা সবগুলো তেজস্ক্রিয় মনিটর এক সাথে শব্দ করে উঠল। তখন রুখ এবং গিসা গিয়ে নিউট্রিনো বীম দিয়ে তৈরি যোগাযোগ মডিউলটি চালু করে দিল। মডিউলে মনিটরের এক কোনায় তখন একটা ছোট লাল আলো জ্বলতে এবং নিভতে থাকে।

ত্রাতিনা গ্রাহার দিকে তাকিয়ে বলল, “যোগাযোগ মডিউল চালু হয়েছে। আমরা সিগন্যাল পাঠাতে শুরু করেছি।”

“কী সিগন্যাল?”

“আপাতত শুধু প্রাইম সংখ্যা। যে কোনো প্রাণী বা বুদ্ধিমান অস্তিত্ব আর কিছু জানুক বা না জানুক, প্রাইম সংখ্যার অস্তিত্ব জানে। তারা যদি আমাদের এই মহাকাশযান থেকে প্রাইম সংখ্যার সিগন্যাল পেতে থাকে, তারা জানবে আমাদেরও কোনো এক ধরনের বুদ্ধিমত্তা আছে।”

গ্রাহা জিজ্ঞেস করল, “এখন আমরা কী করব?”

“অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

গ্রাহা মৃদু স্বরে বলল, “আমি তোমাকে আগেই বলেছি, অপেক্ষা করা মৃত্যু থেকেও ভয়ঙ্কর।”

.

সবাই মিলে ছত্রিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করল। কিন্তু কিছুই হলো না। গ্রাহা বলল, “ত্রাতিনা, আমরা কতোক্ষণ অপেক্ষা করব?”

“কেমন করে বলি।”

“আমাদের কাছে সময়ের এক ধরনের পরিমাপ আছে। আমাদের শারীরিক ব্যাপারগুলো সেকেন্ড কিংবা মিলি সেকেন্ডে হয়। এই মহাজাগতিক প্রাণীর সময়ের পরিমাপ কী রকম? আমাদের এক সেকেন্ডের গুরুত্ব যদি তাদের একশ বছরের সমান হয়? তাহলে কী হবে?”

ত্রাতিনা বলল, “সেটি হওয়ার কথা নয়। এটি পৃথিবীর দিকে যখন গ্রহকণাটি পাঠিয়েছিল, সেটি আমাদের সময়ের হিসেবেই পাঠিয়েছিল।”

গ্রাহা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে কি না, সেটি আমরা কেমন করে বুঝব?”

“যদি ধরে নিই তাদের বুদ্ধিমত্তা আমাদের থেকে বেশি, তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। একটা পিঁপড়া আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না, আমরা ইচ্ছে করলেই একটা পিঁপড়াকে জ্বালাতন করতে পারি।”

এভাবে আরো বারো ঘন্টা কেটে গেল। যখন ত্রাতিনা আর গ্রাহা ক্লান্তিতে প্রায় ভেঙে পড়ছে, ঠিক তখন হঠাৎ করে পুরো মহাকাশযান অন্ধকার হয়ে গেল। মহাকাশযানের ইঞ্জিনগুলো থেমে গেল এবং মনে হলো পুরো মহাকাশযানটিতে বুঝি কবরের নীরবতা নেমে এসেছে।

কুচকুচে অন্ধকারে গ্রাহার গলার স্বর শোনা গেল। কাঁপা গলায় সে বলল, “কী হয়েছে?”

ত্রাতিনা শান্ত গলায় বলল, “মনে হয় মহাজাগতিক প্রাণী আমাদের সাথে যোগাযোগ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।”

“প্রক্রিয়াটি আমার পছন্দ হচ্ছে না।”

“পছন্দ হওয়ার কথা নয়।”

গ্রাহা কাঁপা গলায় ডাকল, “রুখ? গিসা-”

ত্রাতিনা বলল, “তাদের ডেকে লাভ নেই।”

“কেন?”

“মহাজাগতিক প্রাণী এই মহাকাশযানের প্রতিটি যন্ত্র অচল করে দিয়েছে। রুখ আর গিসা যন্ত্র।”

“আমাদের অচল করেনি কেন? আমরাও তো আসলে এক ধরনের যন্ত্র।”

“মনে হয় জটিলতার জন্য। সহজ যন্ত্র অচল করেছে, জটিল যন্ত্র অচল করেনি। কিংবা করতে পারেনি।”

খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ত্রাতিনা বলল, “এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকার আমার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে।”

গ্রাহা বলল, “আমি দীর্ঘসময় ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কাটিয়েছি। ইউরোপাতে আমার সময়টি ছিল অন্ধকার এবং নিঃশব্দ। অন্ধকার নিঃশব্দ এবং শীতল।”

ত্রাতিনা বলল, “এই মহাজাগতিক প্রাণী যদি আমাদের অচল যন্ত্রগুলো সচল না করে, তাহলে আমাদের মহাকাশযানটিও হয়ে যাবে অন্ধকার নিঃশব্দ এবং শীতল।”

অন্ধকারে আরো কিছুক্ষণ দুইজন নিঃশব্দে বসে থাকে। হঠাৎ গ্রাহা ডাকলো, “ত্রাতিনা।”

“বল।”

“আমার এক ধরনের বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে কেউ একজন আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।”

ত্রাতিনা বলল, “হ্যাঁ। আমারও বেশ কিছুক্ষণ থেকে সে রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে।”

“তার মানে প্রাণীটি আমাদের দেখছে।”

“হ্যাঁ শুধু দেখছে না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।”

ত্রাতিনার মনে হতে থাকে তার শরীরের ভেতর কিছু একটা ঢুকে গেছে এবং সেটি নড়ছে। হঠাৎ করে শরীরের একটা অংশ কেমন যেন অবশ হয়ে যায়, তারপর হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে ওঠে। অনুভূতিটি নিচ থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে। ত্রাতিনার হঠাৎ করে মাথাটা ঘুরে ওঠে, হঠাৎ করে অসংখ্য স্মৃতি মাথার ভেতর খেলা করে যায়। মুহূর্তের জন্যে সে এক ধরনের আতংক অনুভব করে আবার পর মুহূর্তে এক ধরনের বিষাদ এসে তার উপর ভর করে।

“আমার মস্তিষ্ক নিয়ে খেলছে।” ত্রাতিনা মনে মনে ভাবল, “আমাকে ভয় পেলে চলবে না। আমাকে শান্ত থাকতে হবে। শান্ত থাকতে হবে…”

কিন্তু ত্রাতিনা শান্ত থাকতে পারল না, হঠাৎ অবর্ণনীয় এক ধরনের আতংকে তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে সে এক বিন্দু আলোর জন্যে হাহাকার করতে করতে জ্ঞান হারালো।

.

৪.২

ত্রাতিনা সামনে তাকালো। যতদূর চোখ যায় শুধু শূন্যতা। ত্রাতিনা মাথা ঘুরিয়ে তার চারপাশে তাকালো। কোথাও কিছু নেই। এখানেও যতদূর চোখ যায়, শুধু শূন্যতা। সেই শূন্যতার কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। ত্রাতিনার মনে হয়, সেই শূন্যতায় সে অতলে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু সেই অতলেরও কোনো শেষ নেই। সে নিচে পড়তেই থাকবে, পড়তেই থাকবে। ত্রাতিনা দুই হাত দিয়ে কিছু একটা ধরতে চেষ্টা করল। ধরার কিছু নেই, শূন্যতা ধরা যায় না, দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না। ত্রাতিনার মনে হতে থাকে, এক অসীম শূন্যতায় সে আটকা পড়ে আছে, এই শূন্যতা থেকে তার মুক্তি নেই।

ত্রাতিনা চিষ্কার করে জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়?” তার কণ্ঠস্বর দূরে মিলিয়ে গেল, তারপর প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার ফিরে এল, আমি কোথায় … আমি কোথায় . . . আমি কোথায় ….

খুব ধীরে ধীরে প্রতিধ্বনিগুলো মিলিয়ে যেতে থাকে। তারপর এক সময় আবার সেই নৈঃশব্দ্যের শূন্যতায় ডুবে যায়।

ত্রাতিনা আবার চিৎকার করল, “আমি কোথায়?” তার চিৎকার বহু দূর থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে, প্রতিধ্বনিত শব্দগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। শব্দগুলো মিলিয়ে যেতে যেতে আবার নূতন করে অনুরণিত হয়, ত্রাতিনার মনে হয় সে বুঝি কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যায় না, কিন্তু কোনো এক ধরনের কণ্ঠস্বর। মনে হয় কেউ কিছু একটা বলছে।

“কে?” ত্রাতিনা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “কে? কথা বলে?”

ত্রাতিনা স্পষ্ট শুনল, কেউ একজন বলল, “আমি।”

“আমি কে?”

“যার কাছে এসেছ।”

ত্রাতিনার চিন্তা এলোমেলো হতে থাকে, সে প্রাণপণ চেষ্টা করে চিন্তাকে সুনির্দিষ্ট রাখতে। অনেক কষ্ট করে সে জিজ্ঞেস করল, “এটা কী সত্যি?”

কোনো উত্তর নেই।

ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “এটা কী সত্যি?”

“সত্যি বলে কিছু নেই।”

“আমি কী স্বপ্ন দেখছি?”

“সব স্বপ্ন।”

“আমি পৃথিবী থেকে এসেছি। তৃতীয় গ্রহ। নীল গ্রহ। পৃথিবী।”

“জানি।”

“পৃথিবীর মানুষ তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চায়।”

“জানি।”

“পৃথিবীর মানুষ আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে।”

“জানি।”

ত্রাতিনা ক্লান্ত গলায় বলে, “তুমি সব জানো?”

“হ্যাঁ।”

“কেমন করে জানো?”

কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি সব কিছু জানো?”

“তুমি যা জানো, আমি তা জানি।”

“তুমি আমার মস্তিষ্কে ঢুকেছ?”

“ঢুকেছি।”

“আমাদের মহাকাশযানে ঢুকেছ?”

“ঢুকেছি।”

“পৃথিবী থেকে আমরা যে তথ্য নিয়ে এসেছি, তুমি সব পেয়েছ?”

“পেয়েছি।”

“তাহলে আমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারি?”

কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা চিৎকার করে বলল, “তাহলে আমরা কী পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারি?”

এবারও কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা চিৎকার করে বলল, “কথা বল। ফিরে যেতে পারি?”

“যখন সময় হবে।”

“কখন সময় হবে?”

কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “কখন সময় হবে?” এবারও কোনো উত্তর নেই।

ত্রাতিনা আবার গভীর শূন্যতায় ডুবে যেতে থাকে। হাত দিয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু ধরা ছোঁয়ার কিছু নেই। স্পর্শ করার কিছু নেই।

ত্রাতিনার মনে হল, অনেক দূর থেকে তাকে কেউ ডাকছে। সত্যি কেউ ডাকছে, নাকি এটি মনের ভুল, সে বুঝতে পারল না। ত্রাতিনার মনে হল, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছিল, কিন্তু সেটি কী, সে মনে করতে পারল না।

আবার কেউ একজন তাকে ডাকল। ত্রাতিনা চোখ খুলে তাকায়। সে দেখল তার মুখের উপর গিসা ঝুঁকে পড়েছে। গিসা তাকে ডাকছে, এটি তাহলে স্বপ্ন নয়। এটি সত্যি। খুব ধীরে ধীরে ত্রাতিনার সবকিছু মনে পড়ে যায়। মহাজাগতিক প্রাণী তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। পুরো মহাকাশযানের প্রতিটি যন্ত্রপাতি অচল করে দিয়েছিল। এক সময় মনে হয়েছিল, তার মাথার ভেতর কিছু ঢুকে গেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর আতংকে সে জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান হারিয়ে সে খুব বিচিত্র একটা স্বপ্ন দেখছিল। সেটি কী শুধু স্বপ্ন, নাকি তার মাঝে সত্যি আছে?

ত্রাতিনা চারপাশে তাকালো। মহাকাশযানে আলো জ্বলছে। সে ইঞ্জিনের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছে। অচল হয়ে যাওয়া মহাকাশযানটি আবার সচল করে দিয়েছে। ত্রাতিনা উঠে বসল। তার মাথার ভেতর এখনও দপ দপ করছে। মহাজাগতিক প্রাণী কী তাহলে তাদের মুক্তি দিয়েছে? তাহলে এখন কী তারা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে?

ত্রাতিনা রুখকে জিজ্ঞেস করল, “সব কিছু ঠিক আছে?”

“হ্যাঁ, ঠিক আছে।”

“ইঞ্জিন সবগুলো চালু আছে?”

“চালু আছে।”

“কোয়াকম্প?”

“কোয়াকম্প নিয়ে একটু সমস্যা। শীতল প্রবাহ ছিল না বলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাপমাত্রা কমে গেলে আবার চালু হবে। গিসা সেটা দেখছে।”

“যোগাযোগ মডিউল?”

“চালু করা হয়েছে।”

“গ্রাহা কোথায়?”

“দেখলাম হেঁটে হেঁটে লাউঞ্জের দিকে গেল।”

“সে ঠিক আছে?”

“এখন ঠিক আছে। তোমার মতো অবস্থা। অচেতন হয়ে ছিল।”

“তোমরা কেমন ছিলে?”

“তিরিশ মিনিটের মতো পুরোপুরি ব্ল্যাক আউট হয়ে গিয়েছিল। কী হয়েছে কিছু জানি না।”

ত্রাতিনা উঠে দাঁড়াল। এখনো মাথার ভেতর দপ দপ করছে। সে খানিকটা টলতে টলতে হেঁটে যেতে থাকে। লাউঞ্জের সামনে তার গ্রাহার সাথে দেখা হলো। গ্রাহা লাউঞ্জের দরজার পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ রক্তশূন্য।

ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে গ্রাহা?”

গ্রাহা কোনো কথা বলল না। শূন্য দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“লাউঞ্জের ভেতর-”

“লাউঞ্জের ভেতরে কী?”

“যেও না।”

ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “যাব না?”

“না।”

“কেন?”

“বলতে পারব না।”

“বলতে পারবে না?”

“না।”

ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “আমাকে তাহলে যেতে হবে। দেখতে হবে।”

গ্রাহা হঠাৎ করে কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, “না, আমি তোমাকে যেতে দেব না।” সে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে ত্রাতিনার পথ আটকে দাঁড়াল।

ত্রাতিনা বলল, “সরে যাও গ্রাহা। আমাকে ঢুকতে দাও। আমি পেপিরার কমান্ডার হিসেবে তোমাকে আদেশ করছি।”

গ্রাহা এক ধরনের আহত দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকালো। তারপর দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “কাজটি ভালো হলো না ত্রাতিনা।”

ত্রাতিনা গ্রাহাকে পাশ কাটিয়ে লাউঞ্জের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো এবং একটা আর্ত চিৎকার করে দরজাটি ধরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল।

লাউঞ্জের মেঝেতে দুটি দেহ। একটি তার নিজের, অন্যটি গ্রাহার। দেহ দু’টি স্থির, দেখে মনে হয় মৃতদেহ। ত্রাতিনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেহ দুটোর দিকে তাকায়। মেঝেতে শুয়ে থাকা ত্রাতিনার দেহটি হঠাৎ চোখ খুলে ত্রাতিনার দিকে তাকালো, চোখের দৃষ্টি শূন্য এবং অর্থহীন। তারপর হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। কী ভয়ংকর সেই হাসি, কী অবিশ্বাস্য সেই চোখের দৃষ্টি।

ত্রাতিনা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কী জীবিত, না মৃত?”

“জানি না কী বলব? দেহগুলো নিখুঁতভাবে তৈরি। শুধু মাথায় কোনো মস্তিষ্ক নেই। ফাঁকা।”

ত্রাতিনার হঠাৎ সারা শরীর গুলিয়ে এলো। সে দরজা বন্ধ করে পিছিয়ে আসে। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।

গ্রাহা নরম গলায় বলল, “আমি তোমাকে ঢুকতে নিষেধ করেছিলাম। তুমি আমার কথা শুনলে না।”

ত্রাতিনা গ্রাহার দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলল, “আমি পেপিরার কমান্ডার। আমার সবকিছু জানতে হবে গ্রাহা।”

.

৪.৩

ত্রাতিনা তার গ্লাসের পানীয়টিতে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি বুঝতে পারছি না আমি যেটা স্বপ্নে দেখেছি, সেটি কী শুধুই স্বপ্ন, নাকি তার মাঝে সত্যতা আছে?”

গ্রাহা বলল, “না ত্রাতিনা, সেটি স্বপ্ন ছিল না। কারণ অবচেতন অবস্থায় আমারও ঠিক একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমিও দেখেছি, আমি অসীম শূন্যতায় ভাসছি। অদৃশ্য কারো কথা শুনছি, যে বলছে আমাদের তার দরকার।”

“কী দরকার হতে পারে আমি একটি অনুমান করতে পারি।”

গ্রাহা বলল, “অনুমান করা খুব কঠিন না। যে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী হচ্ছে কৌতূহলী। বুদ্ধিমান প্রাণী সবকিছু জানতে চায়। এই মহাজাগতিক প্রাণী এই মহাকাশযানের সবকিছু জেনে গেছে, তার কাছে সব যন্ত্রপাতি তুচ্ছ! এটাকে সে পুরোপুরি অচল করেছে। তারপর আবার সচল করেছে। রুখ গিসাকে ব্ল্যাক আউট করিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়েছে। কোয়াকম্পের মতো কম্পিউটারকে অচল করেছে, আবার সচল করেছে। কাজেই যান্ত্রিক বিষয় নিয়ে তার কৌতূহল নেই।”

ত্রাতিনা বলল, “তার কৌতূহল শুধু মানুষকে নিয়ে। আমাদের দু’জনকে নিয়ে।”

“হ্যাঁ।”

“আমাদের দুজনকে তৈরি করতে চেষ্টা করেছে। দেহের খুঁটিনাটি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করেছে, শুধু মস্তিষ্কটি পারেনি।”

গ্রাহা বলল, “কীভাবে পারবে? আমাদের মস্তিষ্ক সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে জটিল যন্ত্র, এখানে একশ বিলিয়ন নিউরন, একটি নিউরন অন্য দশ হাজার নিউরনের সাথে যুক্ত, প্রতি মুহূর্তে সিনান্স সংযোগ হচ্ছে-”

ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, আমাদের মস্তিষ্কের সম্ভাব্য সবগুলো স্টেট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবগুলো পরমাণুর সংখ্যা থেকে বেশি।”

“এই মহাজাগতিক প্রাণী আমাদের সেই মস্তিষ্কটি চায়। এটি দেখতে চায়। বিশ্লেষণ করতে চায়।”

ত্রাতিনা আর গ্রাহা যখন কথা বলছিল পাশে দাঁড়িয়ে তখন রুখ আর গিসা নিঃশব্দে তাঁদের কথা শুনছিল। এবার রুখ বলল, “তোমরা দুইজন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছ। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি পেপিরার কক্ষপথ আটকে দেওয়া হয়েছে। এটি পরিবর্তন করা যাচ্ছে না।”

গিসা বলল, “শুধু তাই না। পৃথিবীর সাথেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।”

ত্রাতিনা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “এই মহাজাগতিক প্রাণী হুবহু মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি করতে পারবে না। এটি বিশ্লেষণ করতে পারবে না। যার অর্থ বুঝতে পারছ?”

গ্রাহা বলল, “হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।”

“যার অর্থ আমরা অনন্তকালের জন্যে এখানে আটকা পড়েছি।”

“হ্যাঁ। আমরা অনন্তকালের জন্যে আটকা পড়েছি।”

ত্রাতিনা তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “কিন্তু আমরা এখানে দুইজন মানুষ। তুমি আর আমি। আমাদের দুজনেরইতো অনন্তকালের জন্যে আটকা থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।”

গ্রাহা একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, “তুমি কী বলতে চাইছ?”

“আমি বলতে চাইছি যে, একজন মানুষকেই এই মহাজাগতিক প্রাণী গিনিপিগ হিসেবে বিশ্লেষণ করুক। অন্যজন পৃথিবীতে ফিরে যেতে সমস্যা কোথায়?”

গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “না সমস্যা নেই। একজন অবশ্যই ফিরে যেতে পারে।”

কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে বসে থাকে। গ্রাহা জিজ্ঞেস করে, “কে থাকবে, আর কে ফিরে যাবে?”

ত্রাতিনা একটু অবাক হয়ে গ্রাহার দিকে তাকিয়ে বলে, “এটি কী রকম প্রশ্ন? অবশ্যই আমি থাকব এবং তুমি ফিরে যাবে। আমি পেপিরার কমান্ডার, পেপিরার সবার ভালোমন্দ্রের দায়িত্ব আমার। তুমি পেপিরার অতিথি, তোমাকে বাঁচিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে তোমার মেয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।”

গ্রাহা কোনো কথা বলল না। ত্রাতিনা বলল, “একটা ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মহাকাশযান থেকে বাইরে ছুঁড়ে দিও। আমি নিশ্চিত, তাহলে মহাজাগতিক প্রাণী পেপিরাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে দেবে।”

গ্রাহা এবারও কোনো কথা বলল না। ত্রাতিনা বলল, “আমার জন্যে তোমার বিচলিত হবার কোনো কারণ নেই গ্রাহা। পৃথিবীতে কোনো আপনজন আমার জন্যে অপেক্ষা করছে না। আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। তোমার কথা ভিন্ন। পৃথিবীতে তোমার স্ত্রী আছে। তোমার মেয়েটি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”

গ্রাহা এবারও কোনো কথা বলল না। কিন্তু তার মুখে খুব সূক্ষ্ম একটু হাসি ফুটে উঠল। ত্রাতিনা সেটা না দেখার ভান করে বলল, “আমার মা পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে প্রাণ দিয়েছে। এবারে আমার পালা। আমার মা যে কাজটি শুরু করেছিল, আমি সেটি শেষ করব।”

গ্রাহার মুখে এবারে খুব বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে ত্রাতিনা অধৈর্য হয়ে বলল, “তুমি কোনো কথা বলছ না কেন?”

গ্রাহা এবারে মুখ খুলল, বলল, “আমি একটুখানি অপেক্ষা করছি।”

“কিসের জন্যে অপেক্ষা করছ?”

“তোমার রক্তে রিটিলিনটুকু মিশে যাবার জন্যে।”

ত্রাতিনা চমকে উঠে বলল, “রিটিলিন?”

“হ্যাঁ। তোমার জন্যে যে পানীয়টুকু এনেছি, আমি সেখানে দুই ফোঁটা রিটিলিন দিয়ে এনেছি। কিছুক্ষণের মাঝে তুমি পুরোপুরি অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আমি লক্ষ করেছি তোমার চোখের পিউপিল বিস্তৃত হচ্ছে, তোমার কণ্ঠস্বর একটুখানি ধীর হয়ে এসেছে।”

ত্রাতিনা লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করল, সে উঠতে পারছে না। কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল, তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।

গ্রাহা একটুখানি এগিয়ে এসে ত্রাতিনার হাত স্পর্শ করে বলল, “ত্রাতিনা, তুমি এখন শুধু শুধু দাঁড়ানোর চেষ্টা করো না। কথা বলারও চেষ্টা করো না। তোমার শরীরে বিটিলিন কাজ করতে শুরু করেছে। আরো মাত্র কয়েক মিনিটি তুমি দেখতে পাবে, কথা শুনতে পাবে। তারপর তুমি ঘুমিয়ে পড়বে।”

গ্রাহা নরম গলায় বলল, “আমি জানি তুমি পেপিরার কমান্ডার হিসেবে নিজেকে মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দিয়ে আমাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠাবে। তাই আমাকে এইটুকু অপরাধ করতে হলো। মহাকাশযানের কমান্ডারকে গোপনে রিটিলিন খাইয়ে অবচেতন করা অনেক বড় অপরাধ, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আমি সেই অপরাধটুকু করেছি। জেনে শুনে করেছি। এটি না করে তোমাকে আমি পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতে পারতাম না। তুমি কিছুতেই এটা করতে দিবে না। তুমি তোমার মায়ের মতোই একজন আপাদমস্তক মহাকাশচারী।

“আমি জানি, তুমি চাইছ আমি যেন পৃথিবীতে গিয়ে আমার মেয়ের সাথে মিলিত হই। তাকে দেখি, তার সাথে কথা বলে সময় কাটাই। ত্রাতিনা, আমি আমার মেয়ের সাথে মিলিত হয়েছি। দেখা করেছি, তার সাথে কথা বলেছি, কারণ তুমি হচ্ছ আমার সেই মেয়ে। পৃথিবীতে আমার আরও একটি মেয়ে আছে। ক্লিয়া। সম্ভব হলে তুমি ক্লিয়ার সাথে দেখা করো। সেই মেয়েটিকে আমার হয়ে একবার আলিঙ্গন করো। তাকে বলো, আমি তাকে অনেক ভালোবাসি। সৌর জগতের শেষ প্রান্তে একটি ক্রোমিয়াম ক্যাপসুলের ভেতর থেকে আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। তাকিয়ে থাকব।”

গ্রাহা উঠে দাঁড়ালো। ত্রাতিনার দিকে অগ্রসর হয়ে বলল, “মা ত্রাতিনা, তুমি অচেতন হওয়ার আগে আমি তোমাকে একটি অনুরোধ করতে পারি? তুমি এখন আর কথা বলতে পারবে না। শুধু একবার একটুখানি হাসো, একটুখানি।”

ত্রাতিনার মুখে খুব ধীরে ধীরে একটুখানি হাসি ফুটে উঠল। গ্রাহা ত্রাতিনার মাথায় হাত বুলিয়ে গভীর মমতায় ফিসফিস করে বলল, “পৃথিবীতে ফিরে যাও মা। মহাকাশের জগতে তোমার প্রয়োজন নেই। ত্রাতিনা মা আমার, তোমার প্রয়োজন পৃথিবীতে।”

রুখ এবং গিসা নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল। গ্রাহা তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ত্রাতিনাকে একটা ক্যাপসুলে নিরাপদে ঢুকিয়ে দাও। তাকে শীতল করে রাখো, বারো বছর পর পৃথিবীতে ফিরে যাবার পর জাগিয়ে তুলতে হবে।”

রুখ মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”

“আর আমার জন্যে একটা ক্যাপসুল রেডি করো। আমাকে যখন মহাকাশে ছুঁড়ে দেবে, লাউঞ্জ থেকে ওই দেহ দুটোও বাইরে ছুঁড়ে দিও। এগুলো পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”

রুখ আবার মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিক আছে।”

“আমাকে ছুঁড়ে দেবার পর পেপিরার যাত্রাপথ পৃথিবীর দিকে করে নিও। আমি নিশ্চিত, মহাজাগতিক প্রাণী তখন তোমাদের ফিরে যেতে দেবে।”

রুখ বলল, “আমরা তাই আশা করছি।”

গ্রাহা এবার গিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “খুব খিদে পেয়েছে। তুমি কি আমার জন্যে চমৎকার একটা ডিনার রেডি করতে পারবে? তিতির পাখির মাংস, যবের রুটি আর আঙুরের রস?”

গিসা মাথা নাড়ল বলল, “পারব।”।

“আমি যখন খাব, তখন তুমি কী আমার প্লেটে খাবারগুলো তুলে দেবে? আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আমার মা যেভাবে তুলে দিতো?”

গিসা বলল, “অবশ্যই তুলে দেব গ্রাহা, অবশ্যই তুলে দেব।”