চতুর্থ গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ–ডমরুধরের শবসাধনা
ডমরুধরের পূজার দালান। প্রস্তুত। পঞ্চমীর দিন। পূর্ব্বের মতই প্রতিমার পার্শ্বে বসিয়া ডমরুর বন্ধুবর্গের সহিত গল্পগাছা করিতেছেন।
লোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—তোমার প্রতিমায় এ বত্সর ব্যাঘ্র উচ্চ কেন? কার্তিকের ওরূপ বেশ কেন?
ডমরুধর উত্তর করিলেন,—ও কথা আর কেন বল ভাই। যে বিপদে পড়িয়াছিলাম, তা আমিই জানি। সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন,–কি হইয়াছিল?
লম্বোদর বলিলেন,–আবার বুঝি একটা আজগুবি গল্পের সূচনা হইতেছে!
ডমরুধর বলিলেন,–তোমাদের শুনিয়া কাজ কি! আমি বলিতে চাই না।
সকলের কৌতূহল জন্মিল। বলিবার নিমিত্ত সকলে সাধ্য-সাধনা করিতে লাগিলেন। অনেক সাধ্য-সাধনার পর ডমরুর বলিতে আরম্ভ করিলেন।
সন্ন্যাসী-হাঙ্গামায় আমার সূক্ষ্ম শরীর আকাশে ভ্রমণ করিয়াছিল। অবশেষে যমালয়ে গিয়া প্রথমে মান্য পরে অমান্য হইয়াছিল। সে গল্প পূর্ব্বে আমি বলিয়াছি। সেই অবধি সশরীরে আকাশ-ভ্ৰমণ করিতে আমার সাধ হইয়াছিল।
যতদূর চলে, মায়ের পূজা আমি গঙ্গাজল দিয়া সারি। গঙ্গাজলে মা যত পরিতোষ লাভ করেন, এমন আর কিছুতেই নয়। বিশেষতঃ আমাদের কাটিগঙ্গার জল। কিন্তু পূজার জন্য প্রজাদের নিকট হইতে আমি ঘৃত, মধু, পাঁঠা প্রভৃতি আদায় করি। তাহা আনিবার নিমিত্ত এই আশ্বিন মাসে আমি সুন্দরবনে আমার আবাদে গিয়াছিলাম।
একদিন বাসায় বসিয়া আছি, এমন সময় দুইজন ফকির পীর গোরাঠাদের গান করিতে আসিল। গান গাহিয়া বার্ষিক চাহিল। আমার কাছারি হইতে পূজার সময় তাঁহারা চারি আনা বার্ষিক পায়। এবার সে বার্ষিক আমি বন্ধ করিয়া দিলাম। প্রথম তাঁহারা অনেক মিনতি করিল। শেষে যখন দেখিল যে, তাহাদের বচনে আমি ভিজিবার ছেলে নই, তখন আমাকে অভিশাপ দিয়া গেল,—পীর গোরাদের ব্যাঘ্ৰ তোমাকে গ্রাস করুক।
শুনিলাম যে, পীর গোরাচাঁদ এক সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। প্রকাণ্ড এক ব্যাঘ্র চড়িয়া সুন্দরবন অঞ্চলে তিনি ভ্রমণ করিতেন। তাঁহার অনেক ধন ছিল। যাহাকে তিনি যাহা বলিতেন, তাহাই ফলিত।
আমি মনে মনে ভাবিলাম যে, সিদ্ধ হওয়া ব্যবসাটি তবে মন্দ নহে। আমিও সিদ্ধ হইব। আমি ডমরুধর; আমার অসাধ্য কি আছে?
সিদ্ধ হইবার সহজ উপায় সকলের নিকট জানিয়া লইলাম। তাঁহারা বলিল, গভীর রাত্রিতে শশানে গিয়া মড়ার পিঠে বসিয়া জপ করিতে হয়। বাঘ ভাল্লুক ভূত প্রেত আসিয়া ভয় প্রদর্শন করে। ভয় করিলেই বিপদ, না ভয় করিলে দেবী স্বয়ং আসিয়া বর প্রদান করেন। ভূত প্রেতদিগের নিমিত্ত সঙ্গে মদ ও মুড়ি-কড়াই ভাজা লইয়া যাইতে হয়।
আমি ভাবিলাম, এ তো সহজ কথা। মড়াকে আমার ভয় কি? মড়া আমি গুলিয়া খাইতে পারি। বাঘকেও আমার ভয় নাই। মন্ত্রবলে আমি বাঘের মুখ বন্ধ করিয়া দিতে পারি। ভূতকে আমার ভয় নাই। মাছ লইয়া ভূতের সঙ্গে সঙ্গে একবার কাড়াকাড়ি করিয়াছিলাম। শেষে ভূতের হাতে কামড় মারিয়াছিলাম। আমার দাঁত নাই, তাই, দাঁত থাকিলে ভূতের হাতে এখনও ঘা থাকিত। তাহার পর একটি ভূত পুষিয়াছিলাম। এলোকেশী যদি সব পণ্ড না করিত, তাহা হইলে পোষা ভূতটি এখনও আমার কাছে থাকিত।
দুই চারি দিন পরে সেস্থানে একটি লোক মরিয়া গেল। সে মজুরি করিতে আসিয়াছিল; আপনার লোক কেহ ছিল না। তাঁহার মৃতদেহ লোকে গাঙে ফেলিয়া দিল। কুম্ভীরে খাইতে না খাইতে আমি মড়াটিকে টানিয়া উপরে তুলিলাম। তাহার পর যে স্থানে লোকে মড়া পোড়ায়, সেই স্থানে রাখিয়া আসিলাম। এক বোতল মদ ও কিছু মুড়ি-কড়াইভাজা সংগ্রহ করিলাম।
গভীর রাত্রিতে একাকী শ্মশানে গমন করিলাম। মড়াটির মুখে মদ ও মুড়ি কড়াইভাজা দিলাম। কুড় কুড় করিয়া খাইতে লাগিল। তাঁহাকে উপুড় করিয়া পিঠে বসিয়া আমি কঠোর তপ আরম্ভ করিলাম। তোমাদের ও সব জপের মন্ত্র আমি জানি না। হিড়িং বিড়িং আমি মানি না। কেবল দেবীর পাদপদ্ম আমি ধ্যান করিতে লাগিলাম।
প্রথম আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইল। অবিরত বিদ্যুতের ঝলকে পৃথিবী ঝলসিত হইতে লাগিল, ঘন ঘন বজ্রনিনাদে পৃথিবী কম্পিত হইল। আমি ভীত হইলাম না। চক্ষু বুজিয়া মায়ের পাদপদ্ম ধ্যান করিতে লাগিলাম।
তাহার পর বন্য মহিষ আসিল। আমার সম্মুখে লম্ফঝম্ফ করিতে লাগিল। শৃঙ্গাঘাতে পৃথিবী বিদীর্ণ করিল। আমি ভয় করিলাম না। চক্ষু মুদিত করিয়া মায়ের পাদপদ্ম ধ্যান করিতে লাগিলাম।।
ব্যাঘ্ৰ আসিল। তাঁহার গভীর গর্জনে বনে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। আমি চক্ষু চাহিলাম না। এক মনে দেবীর পাদপদ্ম ধ্যান করিতে লাগিলাম।
ভূত প্রেত দানা দৈত্য আসিল। আমার সম্মুখে নাচিতে লাগিল। খিল্ খিল হাসিতে চারিদিক পূর্ণ করিলাম। আমি ভয় পাইলাম না, চক্ষু চাহিলাম না, কেবল বলিলাম,ঐ মদ মুড়ি কড়াইভাজা আছে। খাও, খাইয়া ঘরে যাও। তাহার পর পুনরায় ধ্যানে মগ্ন হইলাম।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–ডমরুধরের সিদ্ধিলাভ
এইরূপ কত যে বিভীষিকা হইল, সে কথা তোমাদিগকে কি আর বলিব! অবশেষে আমার পরলোকগতা মাতা আসিলেন। তিনি বলিলেন,–বাছা ডমরুধর! অনেক তপ করিয়াছ, আর কাজ নাই, এখন ঘরে চল, এখানে বসিয়া থাকিলে অসুখ করিবে। আমি কোন উত্তর করিলাম না।
তাহার পর আমার স্ত্রী এলোকেশী আসিলেন। তিনি বলিলেন,–ঘরে চল্। না গেলে এখনি কান ধরিয়া লইয়া যাইব। তোমরা সকলেই জান যে, এলোকেশীকে আমি যমের মত ভয় করি। তাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া প্রথম আমার হৃৎকম্প হইয়াছিল। কিন্তু আমার স্মরণ হইল যে, এ সব মিথ্যা। তখন আমি পুনরায় ধ্যানে প্রবৃত্ত হইলাম।
আমার সে কঠোর তপ কেহ কিছুতেই ভঙ্গ করিতে পারিল না, তখন মা দুর্গা স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মা বলিলেন,—ডমরুধর! তোমার কঠোর তপস্যায় আমি সন্তোষ লাভ করিয়াছি। এক্ষণে বর প্রার্থনা কর।
আমি চক্ষু চাহিয়া দেখিলাম যে, ঠিক যেমন এই প্রতিমা, দেবী সেই বেশে আমার নিকট আগমন করিয়াছেন। মা দশভুজা, দক্ষিণে গণেশ ও লক্ষ্মী, বামে সরস্বতী ও কার্ত্তিক, নিম্নে সিংহ ও অসুর।
মায়ের সেই উজ্জ্বল রূপ দেখিয়া আমি হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। চারিদিক আঁধার দেখিতে লাগিলাম। মনের উপরও যেন ছানি পড়িয়া গেল। কি বর চাহিব, তাহা খুঁজিয়া পাইলাম না। আমার দূরদৃষ্ট! তা না হইলে কাছে লক্ষ্মী ছিলেন। যদি ধন চাহিতাম, এত ধন তিনি দিতেন যে, রাখিতে ঘরে স্থান হইত না। কাছে সরস্বতী ছিলেন, যদি বিদ্যা চাহিতাম, তাহা হইলে আমিও একটা বি-এ, এমএ পাস করা ফোচকে ছোঁড়া হইতে পারিতাম। কিন্তু সে জ্ঞান আমার হইল না। কার্তিকের ময়ুরটি দেখিয়া আকাশ-ভ্রমণের সাধ আমার মনে উদয় হইল। আমি বলিলাম,–যদি বর দিবেই, তবে কার্তিকের ময়ুরটি আমাকে প্রদান কর। উহার পিঠে চড়িয়া আমি আকাশ-ভ্রমণ করিব।
দেবী বলিলেন,—ছি বাছা, ও কথা বলিও না। কার্ত্তিক ছেলেমানুষ। তাঁহার ময়ুরটি দিলে সে কাদিবে। আমি উত্তর করিলাম,–অন্য বর চাই না মা! নিদেন সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত একদিনের জন্য ময়ুরটিকে দাও, মা! তাঁহার পিঠে চড়িয়া সমস্ত দিন আকাশ ভ্রমণ করিয়া সন্ধ্যাবেলা তোমাদের ময়ুর তোমাদিগকে ফিরাইয়া দিব। যদি না দাও তবে পুনরায় আমি এই তপে বসিলাম। –দেবীর ভয় হইল। তিনি বলিলেন,–না বাছা! আর তপস্যা করিও না। তোমার তপে পৃথিবী তাপিত হইয়াছে। আর তপ করিলে মহাপ্রলয়ের অনল উখিত হইয়া সমস্ত জগৎ ভস্ম হইয়া যাইবে।
এই কথা বলিয়া কার্তিকের সহিত দেবী চুপি চুপি কি পরামর্শ করিলেন। তাহার পর তিনি বলিলেন,—আচ্ছা বাছা, একদিনের জন্য কার্ত্তিক তোমাকে ময়ুরটি প্রদান করিবে। আমার সিংহের একটি বাচ্চা দিয়া কার্ত্তিককে আমি ভুলাইয়া রাখিব। কিন্তু ডমরুধর! সন্ধ্যা হইলেই ময়ূরকে তুমি ছাড়িয়া দিবে। না ছাড়িয়া দিলে, সে তোমাকে লবণ, ইক্ষুরস, সুরা, ঘৃত, ক্ষীর, দধিসমুদ্র পারে স্বাদুসমুদ্রে লইয়া ফেলিবে। সে সমুদ্রে তুমি হাবুড়ুবু খাইয়া মরিবে।–এইরূপ সাবধান করিয়া দেবী আমাকে ময়ূরটি প্রদান করিলেন। কার্তিককে সিংহশাবক দিলেন। সিংহের বাচ্চাটি কোলে লইয়া কার্ত্তিক কৈলাসে গমন করিলেন। প্রতিমার যেরূপ গঠিত হয়, কার্তিকের ময়ূর প্রকৃত সেরূপ নহে। সে ময়ূর কিরূপ, খড়ি দিয়া এই শানের উপর আমি তোমাদিগকে আঁকিয়া দেখাই।
ময়ূরের ছবি দেখিতে সকলে তাঁহার উপর ঝুঁকিয়া পড়িলেন। ছবি দেখিয়া লম্বোদর একটু হাসিলেন, কুপিত হইয়া ডমরুর বলিলেন,–হাসিও না। এ তোমাদের পৃথিবীর কাক-কেঁকে প্যাকম-ধরা ময়ূর নহে। এ আসল কার্তিকের কেলাসি ময়ূর।
তাহার পর ডমরুধর পুনরায় গল্প আরম্ভ করিলেন,–গণেশ, লক্ষ্মী, দুর্গা ও সরস্বতী। প্রণাম করিয়া আমি ময়ূরের পিঠে চড়িয়া বসিলাম। তাঁহাকে আকাশের দিকে চালাইতে চেষ্টা করিলাম। ময়ূর উপরে উঠিল না। তখন দেবী হাসিয়া বলিলেন,–মন্ত্র না পড়িলে নরলোককে লইয়া ময়ূর উপরে উঠিবে না। শূন্যে আরোহণ করিবার সময় তুমি এই মন্ত্রটি পাঠ করিবে,–জয় কৈলাসবাসিনী মহেশগৃহিণী গণেশজননী।
তাহার পর সন্ধ্যাবেলা তোমার বাসার উপরে আসিয়া এই মন্ত্রটি বলিবে—জয় কৈলাসবাসিনী দ্বকগৃহিণী ষড়াননজননী।
দ্বিতীয় মন্ত্রটি অতি সাবধানে স্মরণ করিয়া রাখিবে। বাসার উপর আসিয়া এই মন্ত্রপাঠ করিলে ময়ুর তোমাকে সপ্তদ্বীপ সাত সমুদ্র তের নদী পারে লোকালোক পর্ব্বতের ওধারে সূর্যের অগম্য তিমিরপূর্ণ গভর গহ্বরে ফেলিয়া চলিয়া যাইবে।
আমি বলিলাম,–মন্ত্রটি অতি সহজ। কেন মনে করিয়া রাখিতে পারিব না? তবে দ্বিতীয় মন্ত্রে ঐ গুম্বজগৃহিণী কথাটা কিছু কঠিন।
দেবী হাসিয়া বলিলেন,–গুম্বজগৃহিণী নহে, ত্র্যদ্বকগৃহিণী।
আমি বলিলাম,–এইবার আমি ভাল করিয়া স্মরণ রাখিব, গুম্বজ নহে ত্র্যদ্বক। দেখ লম্বোদর, এই স্থানে তোমাদের একটা কথা আমি বলিয়া রাখি। প্রতিমার এই যে কার্তিক সকলে করে, এ-কেলে কার্তিক নহে এ সে-কেলে কার্ত্তিক। লম্বা কেঁচা গুফো ধেড়ে কার্তিক কি বাপু! এই কি তোমাদের ভক্তি! ছি! এখনকার কার্তিক ছেলেমানুষ। মোজা ইজের কোট টুপি পরা। সিংহশাবক কোলে কার্তিককে আমি এইরূপ দেখিয়াছিলাম।
প্রতিমারও তাই করিয়াছি।
প্রতিমা সহিত দেবী অন্তর্ধান হইলেন। আমি প্রথম মন্ত্রটি পাঠ করিলাম,–
জয় কৈলাসবাসিনী মহেশগৃহিণী গণেশজননী।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – পিং মহাশয়
ময়ূর তৎক্ষণাৎ উপরে উঠিল। অনেক অনেক উপরে উঠিল। রেলগাড়ী বা কি? তড়িগতি বা কি? তাহা অপেক্ষা দ্রুতবেগে শূন্যপথে চলিতে লাগিল। চন্দ্রলোক সূৰ্য্যলোক ধ্রুবলোক পার হইয়া গেল। কোটি কোটি যোজন পরে শেষে আমি পিংয়ের আকাশে গিয়া উপস্থিত হইলাম। লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—পিং সে কি?
ডমরুধর উত্তর করিলেন, পিং কি? পিং এইরূপ—বলিয়া পিং-এর চিত্র অঙ্কিত করিয়া দেখাইলাম। লম্বোদর বলিলেন,–তা যেন দেখিলাম! কিন্তু পিং কে?
ডমরুধর উত্তর করিলেন,—কি গেরো! পিং কে, তা আমি কি করিয়া জানিব? পিং আমার জাতি নয়, জ্ঞাতি নয় যে, তাহার পরিচয় আমি তোমাকে দিব। প্রাণ গেলেও আমি মিথ্যাকথা বলিব না। আমার সে স্বভাব নয়।
ছোট একখণ্ড কালো মেঘের উপর পিং বসিয়াছিলেন। আমি তাঁহার নিকট গমন করিলাম। দেখ লম্বোদর! তোমরা আমাকে কালো কুৎসিত কদাকার বলিয়া উপহাস কর। কিন্তু পিং আমার রূপের মর্যাদা জানেন। আমাকে দেখিবামাত্র পিং কি বলিলেন শুন।
পিং বলিলেন,–আহা, মহাশয়ের কি রূপ! ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, তাঁহার ভিতর হইতে খড়ি মাটীর আভা বাহির হইতেছে। তাহা দেখিয়া আমার উস্কোখুস্কো পালক-আবৃত কাক ভূষণ্ডীকে মনে হইল। বহুকালের প্রাচীন ছেলাপড়া বাঁশের ঝোড়ার ন্যায় মহাশয়ের অস্থিপিঞ্জর দেখা যাইতেছে। দধিপুচ্ছ শৃগালের পর্ব্বত-গহ্বরের ন্যায় আপনার দন্তশূন্য মুখগহ্বর। তাঁহার দুই ধারে কি দুইটি কাক বসিয়াছিল? ঐ যে ঠোটের দুই কোণে শুভ্রবর্ণের কি রহিয়াছে? আপনার টোল-পড়া গাল দুইটি দেখিয়া হনুমানের চড়-প্রহরিত রাবণ মাতুল কালনেমির গণ্ডদেশ আমার স্মরণ হইল। পচুল পরিবেষ্টিত মস্তকের মধ্যস্থিত বিস্তৃত টাক দেখিয়া আমার মনে হইল, বিধাতা বুঝি পূর্ণচন্দ্রটিকে বসাইয়া তাঁহার চারিদিকে শুভ্রবর্ণের মেঘ গাঁথিয়া দিয়াছেন। ফলকথা, মহাশয়কে যখন দূরে দেখিলাম, তখন মনে করিলাম যে, ময়ূরে চড়িয়া টাক-চুড়ামণি কেলে-কার্ত্তিক জগৎ আঁধার করিয়া আসিতেছেন।
পিঙের সুমিষ্ট স্তবে প্রীতিলাভ করিয়া আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিলাম,আমি আকাশে ভ্রমণ করিতে আসিয়াছি। ইহার পর দেখিবার আর কি আছে?
পিং উত্তর করিলেন,—সমুদ্রকুলে বালুকারেণুর ন্যায় ইহার পর আরও কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড আছে। কিন্তু ব্রহ্মার কোন অণ্ডই আপনার দেখিবার উপযুক্ত নহে। যাবতীয় ব্রহ্মাণ্ডের ওপারে আপনি গিয়া অশ্বাণ্ড দর্শন করুন।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—অশ্বাণ্ড! সে কিরূপ? সে কোথায়?
পিং উত্তর করিলেন,—অল্পদিন হইল ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের নিকট গিয়া যম আবেদন করিলেন যে—বঙ্গদেশের বিটলে কপট স্বদেশ ভক্তগণ শীঘ্রই প্রেতত্ব প্রাপ্ত হইবে। তাহাদের প্রেতকে আমার আলয়ে আমি স্থান দিতে পারি না। তাহাদের কুহকে পড়িলে আমি উৎসন্ন যাইব। ছেলেখেকো বক্তারাও শীঘ্র প্রেত হবে। তাহাদিগকে আমি স্থান দিব না। আমার ছেলেগুলি তাহা হইলে গোল্লায় যাইবে। স্বদেশী প্রবঞ্চকদিগের প্রেতকেও আমি স্থান দিতে পারিব না। আমার আলয়ে আসিয়া তাঁহারা হয়তো কোম্পানী খুলিয়া বসিবে। তখন যমনীকে হাতের খাড় বেচিয়া শেয়ার কিনিতে হইবে। তাঁহার মহাপ্রভুরা এককড়া কাণাকড়িও উপুড় হস্ত করিবেন না। আপনারা ইহার ব্যবস্থা করুন। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া ইন্দ্রের ঘোড়া উচ্চৈঃশ্রবাকে এক ডিম্ব প্রসব করিতে বলিলেন। বিশ্বসংসারের ওপারে এই অণ্ড আছে। ইহাতে বিটলে স্বদেশভক্ত ছেলেখেকো বক্তা ও স্বদেশী প্রবঞ্চকগণের প্রেত বাস করে। মহাশয় গিয়া অশ্বও দর্শন করুন।
পিং আরও বলিলেন যে, অশ্বারে দ্বারে এক প্রহরী আছে। প্রহরী যে কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিবে ও তাঁহার উত্তরে কি বলিতে হইবে, পিং আমাকে শিখাইয়া দিলেন।
পিঙের নিকট হইতে বিদায় লইয়া পুনরায় আমি শূন্যপথে চলিতে লাগিলাম। সমুদ্রকুলে বালুকারেণুর ন্যায় কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড পার হইয়া যাইলাম। অবশেষে বিশ্বসংসারে ওপারে দূর হইতে অশ্বাণ্ড দেখিতে পাইলাম। পরে নিকটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম যে দ্বারে ভীষণ মূৰ্ত্তি প্রহরী বসিয়া আছে।
চীকার করিয়া প্রহরী আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,হু কামস দায়? (Who comes there?)–আমি উত্তর করিলাম,—ফ্রেণ্ড। (friend) প্রহরী বলিল,–পাস ফ্রেণ্ড, অল ওয়েল (Pass friend well)
এই বলিয়া প্রহরী দ্বার ছাড়িয়া দিল। অশ্বাণ্ডের ভিতর আমি প্রবেশ করিলাম। আমি দেখিলাম যে, ব্রহ্মাণ্ডের ন্যায় অশ্বাশু ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোম দিয়া গঠিত নহে। ইহা সম্পূর্ণ অন্ধকার দিয়া নির্ম্মিত। দূর দূর বহু দূর গিয়া বিটলে স্বদেশ ভক্তদিগের দেশে গিয়া উপস্থিত হইলাম। এই প্রেতদিগের রক্ষণাবেক্ষণের নিমিত্ত এক প্রহরী নিযুক্ত আছে। প্রহরী তাহাদিগকে বৃহৎ অট্টালিকার ভিতর বন্ধ করিয়া রাখে। আমাকে দেখাইবার নিমিত্ত তাহাদিগকে সে বাহির করিল।
পৃথিবীতে ইহাদের শরীর নুদুর-নাদুর থাকে। এখানে ইহাদের এইরূপ মূৰ্ত্তি হইয়াছে। বঙ্গদেশের ইহারা সর্ব্বনাশ করিয়াছে। শত শত বাঙ্গালী যুবকের অন্নলাভের পথ রোধ করিয়াছে। সাধারণের টাকা আত্মসাৎ করিয়াছে। প্রহরী আমাকে বলিল,–সত্বর এ স্থান হইতে প্রস্থান করুন। আপনার যে এমন অপূর্ব্ব রূপ, ইহাদের বাতাস লাগিলে সে সব মাটি হইয়া যাইবে। আপনাকে আরও এক বিষয়ে সাবধান করি। কিছুদূরে আপনি ছেলেখেকো বক্তাদিগের প্রেতগণকে দেখিতে পাইবেন। তাহাদের বক্তৃতা যেন আপনার কর্ণকুহরে প্রবেশ না করে। গো অশ্ব মেষ মহিষ খর্ব্বুর শূকর বিড়াল কুকুর ইন্দুর বাঁদরের মৃত পচিত দেহ উদ্ভুত চর্বি-সত, অবিকৃত বিশুদ্ধ, পবিত্র, পুষ রূপে বিভূষিত গলিত মড়াগন্ধে আমোদিত, ময়রা মহলে সমাদৃত সর্ব্বত্র প্রচলিত ধৃত সদৃশ আপনার হৃদয় কোমল। তাহাদের বক্তৃতা-উত্তাপে আপনার হৃদয় গলিয়া যাইবে। তখন আপনি যা নয়—তাই করিয়া বসিবেন।
সভয়ে এ স্থান হইতে আমি পলায়ন করিলাম। দূরে কোটি কোটি যোজন দূরে আমি এক ছেলেখেকো বক্তা দেখিতে পাইলাম। একাকী দাঁড়াইয়া ইনি বক্তৃতা করিতেছিলেন।
বক্তা তাকালে ইনি অনেক অপোগণ্ড শিশুর ইহকাল-পরকাল ভক্ষণ করিয়াছিলেন। অনেক সংসারে ছারেখারে দিয়াছিলেন। কানে আঙ্গুল দিয়া ইহার নিকট আমি গমন করিলাম। ইহার অপর কেহ শ্রোতা ছিল না। কিন্তু একখণ্ড অন্ধকারের উপর দাঁড়াইয়া রাত্রিদিন ইনি বক্তৃতা করেন। শুনলাম যে পাতালে অসুরদিগের কানের পোকা হইলে, তাঁহারা ইহার বক্তৃতা শ্রবণ করিতে আগমন করে। পাঁচ মিনিট কাল ইহার বক্তৃতা তাহাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করিলেই কানের পোকা ধড়ফড় করিয়া বাহির হইয়া যায়।
এ স্থান হইতে বিদায় হইয়া আরও কোটি কোটি যোজন দূরে স্বদেশী প্রবঞ্চকদিগের দেশে উপস্থিত হইলাম। অনেকগুলো এই জাতীয় প্রেত দর্শন করিলাম। তাহাদের একজন পৃথিবীতে থাকিতে অনেক ব্যবসা করিয়াছিলেন, অনেক কোম্পানী খুলিয়াছিলেন, অনেক লোকের টাকা কি দিয়াছিলেন। অবশেষে এক বীমা-অফিস খুলিয়া মুটে-মজুরের টাকাও উদরস্থ করিয়াছিলেন। অনেকগুলি হাত ও পা বাহির করিয়া এই মহাপ্রভু এক্ষণে আমাকে ধরিতে আসিলেন।
ইহার বীমা অফিসে আমি অর্থ প্রদান করি,—সেই ইচ্ছায় তিনি আমাকে ধরিতে আসিয়াছিলেন। কিন্তু এ সব কার্যে আমিও একজন ঘুণ। আমি ধরা দিলাম না। সত্বর সে স্থান হইতে পলায়ন করিলাম।
বেলা তখন প্রায় তিনটা বাজিয়াছিল। সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমার বাসায় পৌঁছতে হইবে। তা
হইলে ময়ূর আমাকে সপ্তদ্বীপের ওপারে স্বাদুসমুদ্রে নিক্ষেপ করিবে। সেজন্য পৃথিবীর দিকে ময়ুরকে আমি পরিচালিত করিলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ–জিলেট জিলেকি সিলেমেল
নিম্নদিকে নামিতে-নামিতে আমি ভাবিতে লাগিলাম, আমিও দুই তিনবার স্বদেশভক্ত হইয়া সভা করিয়াছিলাম, বক্তৃতা করিয়াছিলাম, স্বদেশের হিতের নিমিত্ত চাঁদা সংগ্রহ করিয়াছিলাম, তাহার পর চাঁদার টাকাগুলি নিজে হাম্ করিয়াছিলাম। সন্ন্যাসী বিভ্রাটের পর আমিও এক স্বদেশী কোম্পানী খুলিয়া অনেক হাঁড়ী বালতি গরীব কেরাণীর মস্তকে হস্ত বুলাইয়াছিলাম। তবে প্রেত হইয়া আমাকেও ঐ অশ্বাণ্ডে গমন করিতে হইবে? কিন্তু তাহার পর আমার স্মরণ হইল যে, যম অবগত আছেন, আমি মুরগী খাই না, একাদশীর দিন পুইশাক ভক্ষণ করি না। সুতরাং সেই পুণ্যবলে অনায়াসে আমি সত্য-লোক, ব্রহ্মলোক যেখানে ইচ্ছা সেইখানে গিয়া বাস করিতে পারিব। যদি ধর্ম্ম শিখিতে চায় তো টিকিদারেরা আমার কাছে আসুক।
হু হু শব্দে ময়ূর পৃথিবীর দিকে ধাবিত হইল। অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র পার হইয়া আমি ক্রমাগত নিম্নে নামিতে লাগিলাম। অবশেষে সূর্যমণ্ডল পার হইলাম। সে স্থান হইতে পৃথিবী দেখিলাম,অতি ক্ষুত্র এক নক্ষত্রের ন্যায় ঝিমিক করিতেছে। ময়ূরের দুই পার্শ্বে আমার দুইটি পা ঝুলিতেছিল। হঠাৎ কোথা হইতে কি একটা আসিয়া আমার বাম পায়ে কামড় মারিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ছাড়িয়া দিল। চকিত হইয়া আমি সেই দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম! দেখিলাম যে, অতি বিরক্তিসূচক মুখভঙ্গিমা করিয়া চাকার ন্যায় কি একটা গড়াইয়া গেল।
আমি ভাবিতে লাগিলাম, চাকার ন্যায় ওটা কি? আমার পায়ে কামড় মারিল কেন? অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া শেষে বুঝিতে পারিলাম। আমার রূপে জগৎ আলো করিয়া শূন্যপথে আমি আসিতেছিলাম। চাকার ন্যায় ওটা রাহু। আমাকে পূর্ণিমার চন্দ্র মনে করিয়া সে আমাকে গ্রহণ লাগাইতে আসিয়াছিল। পূর্ণিমার পর প্রতিপদে চন্দ্রগ্রহণ হয়। কিন্তু আমার রূপে মুগ্ধ হইয়া সে লোভ সংবরণ করিতে পারে নাই। তারপর আমি যে পূর্ণচন্দ্র—তার আর প্রতিপদ হয় না। যাই হউক, হতজ্ঞান হইয়া সে আগে থাকিতে আমাকে গিলিতে আসিয়াছিল। ভাগ্যে আমার গায়ে মাংস নাই, কেবল হাড়, তাই সে কামড় বসাইতে পারিল না। মুখ সিঁটকে চলিয়া গেল। রাহুর দুই চারিটি দাঁত ভাঙ্গিয়া গেল কি না তা বলিতে পারি না। আমার শরীর যদি সুস্বাদু হইত, তাহা হইলে আমার গ্রহণটি সর্ব্বগ্রাস হইত। সাপ যেরূপ আস্তে আস্তে ভেককে ভক্ষণ করে, রাহুও সেইরূপ ক্রমে ক্রমে আমাকে পেট করিত। চন্দ্র-সূর্যের ন্যায় আমার আর মুক্তি হইত না। চিরকাল আমাকে রাহুর—সর্ব্বনাশ! রাহুর পেট নাই! আমাকে সর্ব্বগ্রাস করিয়া সে গালের ভিতর এক কৰে রাখিত কি কোথায় রাখিত, জানি না। কিন্তু লম্বোদর! তোমরা আর আমাকে দেখিতে পাইতে না। লম্বোদর বলিলেন,–ইস, তাই তো।
সকলে বলিলেন,–ইস, তাই তো।
ময়ুর এই ঘটনার পর নক্ষত্রবেগে পৃথিবীর দিকে ধাবিত হইল। সন্ধ্যা হয় হয়, এমন সময় আমি সমুদ্রের উপর আসিয়া উপস্থিত হইলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে সুন্দরবনের উপর আসিলাম। ময়ূর আমার বাসার দিকে ধাবিত হইল। তখনও ভূমি হইতে প্রায় একক্রোশ উচ্চে শূন্যপথে ময়ূর উড়িতেছিল। আমি ভাবিলাম, এস্থান হইতে আমার বাসা প্রায় আর দুই ক্রোশ আছে, বাসার ঠিক উপরে যাইলেই সেই দ্বিতীয় মন্ত্রটি পড়িব। তখন ময়ূর আমাকে ধীরে ধীরে আমার বাসায় নামাইয়া দিবে।
কিন্তু সে দ্বিতীয় মন্ত্রটি কি? সর্ব্বনাশ! আমি সে মন্ত্রটি ভুলিয়া গিয়াছি। মন্ত্রটি মনে করিতে না পারিলে ময়ূরে আমাকে সাত সমুদ্র তের নদী পারে লইয়া লোকালোক পর্ব্বতের ওপারে অন্ধকার গহূরে ফেলিয়া স্বস্থানে চলিয়া যাইবে। তাহা ভাবিয়া আমার প্রাণ আকুল হইল। মন্ত্রটি কি? গম্বুজ? না, তা নয়! জলটুঙ্গী না, তা নয়, ঝাঁপড়দা-মাকড়দা? না, তাও নয়। তবে কি? এ কথা নয় সে কথা, নয় এ কথা—ক্রমাগত ভাবিয়া মন্ত্রটি স্মরণ করিতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু তাঁহার একটি বর্ণও আমার মনে উদয় হইল না। এমন কি, হতভম্ব হইয়া আমি দুর্গা নামটি পর্যন্ত মনে করিতে পারিলাম না। আমি ভাবিলাম যে, যাঃ ডমরুধর! এইবার তোমার সব লীলাখেলা ফুরাইল। যাহা হউক, অনেক চিন্তা করিয়া অবশেষে আমার মনে হইল মন্ত্রটিতে জ আছে, ল আছে আর ক আছে। তাঁহার পব সেই অক্ষর কীটি যোড়তোড় করিয়া স্থির করিলাম যে, মন্ত্রটি বোধ হয় এইরূপ হইবে, জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকি।
লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি?
ডমরুধর পুনরায় বলিলেন,—জিলেন জিলেকি সিলেলে কিলেকিট কিলেকিশ।
লম্বোদর বলিলেন,–এতও তুমি জান। এ কোন ভাষা?
ডমরুধর উত্তর করিলেন,—তা জানি না ভাই, এ ভিন্ন আর কিছু তখন মনে হইল না। মন্ত্রটি এইরূপ ঠিক করিয়া আমি ভাবিলাম, একবার পরীক্ষা করিয়া দেখি; উচ্চৈঃস্বরে আমি বলিলাম, জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।
সেই কিচমচ শব্দ শুনিয়া ময়ূর ভাবিল,—কৈলাস পর্ব্বতে ভূত-প্রেত-দানা-দৈত্যের সহিত আমার বাস। অনেক তন্ত্র মন্ত্র শুনিয়াছি। এরূপ বিদঘুটে কখনও শুনি নাই। এ লোকটার ভাবগতিক ভাল নহে। বাসায় লইয়া গিয়া আমাকে হয়তো এইরূপ ভীষণ পালকহর্ষণ মন্ত্রবলে খাঁচায় পুরিয়া বন্ধ করিয়া রাখিবে। আগে থাকিতে সাবধান হওয়া ভাল। এইরূপ ভাবিয়া গাঝাড়া দিয়া ময়ূর আমাকে শূন্য দেশে ফেলিয়া দিল। তাহার পর শোঁ শোঁ করিয়া কৈলাস পর্ব্বতের দিকে উড়িয়া গেল। আমি তখন ভূমি হইতে প্রায় একক্রোশ উচ্চে আজকাল উডোকল হইতে মানুষ যেমন পড়ে, আমিও সেইরূপ হুহু শব্দে শিশার ন্যায় নীচে পড়িতে লাগিলাম। হু হু, হু হু, হু হু, কানে আমার বাতাস লাগিতে লাগিল। আমি ভাবিলাম যে, এইবার আমার দফা রফা হইল। হু হু হু হু শব্দে পড়িতে লাগিলাম, অবশেষে খপ করিয়া কাদার ন্যায় কি একটা কোমল বস্তুর উপর পড়িলাম।
কোমল বস্তুর উপর পড়িলাম, সেজন্য আমার অস্থি মাংস চূর্ণ হইয়া গেল না, সেজন্য আমার প্রাণ বিনষ্ট হইল না। যখন আমার হৃদয়ের ধড়ফড়ানি কিছু স্থির হইল, তখন আমি এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখিলাম, তাহাতে আমার চক্ষুস্থির হইল। আমি দেখিলাম যে, পর্ব্বতপ্রমাণ প্রকাণ্ড এক ব্যাঘ্রের মুখগহ্বরে আমি পতিত হইয়াছি। ব্যাঘ্ৰটি বৃদ্ধ হইয়াছিল। সেজন্য তাঁহার দন্ত ছিল না। দাঁত থাকিলে শূলসদৃশ দন্তে বিদ্ধ হইয়া তৎক্ষণাৎ আমার মৃত্যু হইত। আমার সকল কথা মনে হইল। পীর গোরাচাঁদের ফকীরদিগের অভিশাপে আমি পড়িয়াছি। এ সেই পীর গোরাচাঁদের ব্যায়। যে বাঘ চড়িয়া তিনি দেশভ্রমণ করিতেন। তোমার যে-সে ব্যাঘ্র নহে। এ রয়েল টাইগারের বাবা! এ মহারাজ ব্যাঘ্র।
লোকে বলে যে ঘুমন্ত সিংহ হাঁ করিয়া থাকিলে, তাঁহার মুখে মৃগ প্রবেশ করে না। সে ঠিক কথা নহে। রাজসাপ নামে একপ্রকার সর্প আছে। সে সাপ হাঁ করিয়া থাকিলে তাঁহার মুখে অন্যান্য সাপ প্রবেশ করে। এ বৃদ্ধ ব্যাঘ্র তাহাই করে। আকাশ-পাতাল জুড়িয়া হাঁ করিয়া থাকে। আর ইহার মুখে মৃগ প্রবেশ করে। আমি বসিয়া থাকিতে থাকিতে একটা বন্য মহিষ, চারিটা হরিণ ও দুইটা বরাহ ইহার মুখের ভিতর প্রবেশ করিল। তখন ব্যাঘ্র একেবারে কোৎ করিয়া আমাদের সকলকে গিলিয়া ফেলিল।
ব্যাঘ্রের পেটের ভিতর ঘোর অন্ধকার। আমি বিরস বদনে তাঁহার এককোণে গিয়া বসিলাম। বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম—এখন করি কি? আর রক্ষা নাই। এখনি হজম হইয়া যাইব! আমার চিহ্নমাত্ৰ থাকিবে না। দুই চারিদিন পরে একছটাক মল হইয়া বাহির হইব।
নিতান্ত সঙ্কটে পড়িলে মানুষের অনেক বুদ্ধি জোগায়। একবার কোন ডাক্তারের নিকট শুনিয়াছিলাম যে, জীবের উদর হইতে একপ্রকার অশ্লরস বাহির হয়; তাহাতেই পরিপাক পায়। তোমরা জান যে, আমার অম্বলের রোগ আছে, আর সেজন্য আমি সর্ব্বদা কাচা সোডা ব্যবহার করি। ভাগ্যক্রমে আমার পকেটে কাগজে মোড়া খানিকটা সোডা ছিল, সেই সোড়া উত্তমরূপে আমি গায়ে মাখিয়া বসিয়া রহিলাম। ব্যাঘ্রের পেট হইতে অম্লরস বাহির হইয়া মহিষ, হরিণ, শূকর সব গলিয়া পরিপাক হইয়া গেল, কিন্তু সোডার প্রভাবে আমার শরীর গলিয়া গেল না, আপাততঃ আমার প্রাণ বাঁচিয়া গেল।
তা যেন হইল। কিন্তু সে আর কয়দিন? ব্যাঘ্রের উদর হইতে বাহির না হইতে পারিলে মৃত্যু নিশ্চয়, আজ হউক, কাল হউক, মৃত্যু নিশ্চয়। কিন্তু কি করিয়া বাহির হইব? মা দুর্গার নাম এখন আমার মনে হইল। একান্ত মনে তাঁহাকে ডাকিতে লাগিলাম। পীর গোরাচাঁদকে অনেক সিন্নি মানিলাম। মা ভগবতীর ও পীর সাহেবের আমার প্রতি কৃপা হইল। বাঘের পেটের ভিতর এককোণে বসিয়া গালে হাত দিয়া ভাবিতেছি, এমন সময় হঠাৎ কে যেন আমাকে বলিয়া দিল,তোমার পকেটে কাগজ ও পেনসিল রহিয়াছে, আমাদের কর্মচারীকে পত্র লেখ না কেন?
আমার তখন ভরসা হইল। পকেট হইতে কাগজ পেনসিল বাহির করিয়া আমি আমার কর্মচারীকে এইরূপ এক চিঠি লিখিলাম,পীর গোরাঠাদের কোপে আমি পড়িয়াছি। তাঁহার ব্যাঘ্রের উদরে আমি আছি। যদি কোনরূপে আমাকে উদ্ধার করিতে পার তাঁহার চেষ্টা কর।
আমার কর্মচারী বুদ্ধিমান লোক। আমার চিঠি পাইবামাত্র সেই জোয়ারের পথে যে স্থানে ডাক্তারখানা আছে, সে স্থানে চলিয়া গেল। ডাক্তারের সহিত পরামর্শ করিয়া, যাহাতে কাজ হয়, এরূপ ঔষধ এক সের ক্রয় করিল। ইংরেজীতে ইহাকে টারটার এমিটিক বলে। আবাদে ফিরিয়া সেই ঔষধ কাপড়ে রাখিয়া এক ছাগলের গলায় বাঁধিয়া দিল। তাহার পর যে স্থানে পীর গোরাঠাদের ব্যাঘ্র বাস করে, সেই স্থানে ছাগল ছাড়িয়া দিল। বলা বাহুল্য যে, ভ্যা ভ্যা করিতে করিতে ছাগল আপনা আপনি ব্যাঘ্রের উদরে প্রবেশ করিল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ–ধাঙ্গড়ের ঘরে কন্দর্প পুরুষ
প্রায় দুই ঘণ্টা পরে ঔষধের ক্রিয়া আরম্ভ হইল। প্রথম ব্যাঘ্রের পেট কামড়াইতে লাগিল। পেটের কামড়ে ব্যাঘ্র অস্থির হইয়া ছটফট করিতে লাগিল। মাটিতে পড়িয়া গড়াগড়ি দিতে লাগিল। বৃদ্ধ হইলে কি হয়, পেটের কামড়ে সহস্র যুবা ব্যাঘ্রের বলে সে এখন লম্ফ ঝম্ফ করিতে লাগিল। ব্যথা যখন কিছুতেই নিবৃত্ত হইল না, তখন যে দিকে তাঁহার দুই চক্ষু গেল, সেই দিকে ঘোড়া-দৌড়ের অন্ধবেগে সে ছুটিয়া চলিল। ছোট ছোট গ্যাং লাফ দিয়া ও বড় বড় গাং সাঁতার দিয়া পার হইতে লাগিল ক্রমাগত দৌড়িতে লাগিল। হাঁ করিয়া দৌড়িতেছিল, সেজন্য পেটের ভিতর বসিয়া আমি কতক কতক দেখিতে পাইতেছিলাম। বন পার হইল, নদী নালা খাল বিল অনেক পার হইয়া গেল। পেটের কামড়ে সমস্ত রাত্রি দৌড়িল, সমস্ত দিন দৌড়িল, পুনরায় আর এক রাত্রি দৌড়িল। সুন্দরবনের এলাকা পার হইয়া গ্রামসমূহের নিকট মাঠ দিয়া ধাবিত হইল। অবশেষে দ্বিতীয় দিনের বেলা তিনটার সময় বমন করিতে আরম্ভ করিল। শৈশবকালে মাংস-অন্নপ্রাশনের সময় হইতে যত মহিষ হরিণ শূকর প্রভৃতি খাইয়াছিল, তাহাদের হাড়গোড় সমুদয় বমন করিয়া ফেলিল। উদগারের সহিত আমাকে সে বাহির করিয়া ফেলিল।।
কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া আমার দিকে সে দুই একবার কম করিয়া চাহিল। মনে মনে ভাবিল,–এ লোকটাকে গিলিয়া ভাল কুকর্ম করিয়াছিলাম। যেমন রূপ—তেমনি গুণ, না আছে রস না আছে কষ! কালো চামড়া মোড়া কেবল খানকতক হাড়। এর চেয়ে যদি দশ মণ পাথুরে কয়লা গিলিতাম, তাহা হইলে কাজ হইত।
এই প্রকার চিন্তা করিয়া ব্যাঘ্র দ্রুতবেগে সে স্থান হইতে প্রস্থান করিল। পশু! সে আমার রূপের মহিমা কি বুঝিবে?
লম্বোদর বলিলেন,—তা সব হইল। কিন্তু একটা কথা তোমাকে আমি জিজ্ঞাসা করি। ব্যাঘ্রের পেটের ভিতর হইতে তোমার কর্মচারীর নিকট সে চিঠি তুমি কি করিয়া পাঠাইলে?
কিয়ৎক্ষণের জন্য নীরব থাকিয়া ডমরুধর উত্তর করিলেন,–দেখ লম্বোদর। সকল কথার খোচ ধরিও না। এইমাত্র তোমাকে আমি বলিতে পারি যে, বাঘের পেটের ভিতর ডাকঘর নাই, সে স্থানে টিকিট বিক্রয় হয় না, সে স্থানে মনি-অর্ডার হয় না। তিরিক্ষি মেজাজ ডাকবাবু সেখানে বসিয়া নাই। পত্র প্রেরণের সমস্যা এইরূপে হেলায় মীমাংসা করিয়া ডমরুধর পুনরায় বলিতে লাগিলেন,বাঘের পেটে কয়দিন আমার উদরে অন্নজল যায় নাই। আমি অতিশয় দুর্বল হইয়াছিলাম। ব্যাঘ্ৰ চলিয়া গেলে কিছুক্ষণের নিমিত্ত সেই স্থানে নির্জীব হইয়া পড়িয়া রহিলাম। তাহার পর আস্তে আস্তে উঠিয়া এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখিলাম। নিকটে একখানি গ্রাম দেখিয়া তাঁহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। গ্রামখানি ছোট, কেবল ইতরললাকের বাস। গ্রামবাসীদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হইলাম যে, সে স্থান হইতে আমার আবাদ দূর, কেহ তাঁহার নামও জানে না। বরং আমার গ্রাম নিকট, সাতআট ক্রোশ মাত্র। তপস্যা করিতে যখন আমি বনে গমন করি, তখন টাকাকড়ি সঙ্গে লইয়া যাই নাই। সে নিমিত্ত নৌকা অথবা শালতি ভাড়া করিতে পারিলাম না। পদব্রজেই আমার গ্রাম অভিমুখে আমি চলিলাম।
আকাশভ্রমণে, অনাহারে, নানারূপ ভাবনা-চিন্তায় আমার পা আর উঠে না। তাহার পর বর্ষার শেষ। নদী-নালা জলে ও মাঠ-ঘাট কাদাকিফায় পরিপূর্ণ। বড়ই কষ্ট হইতে লাগিল। যাইতে যাইতে এক মাঠের মাঝখানে সন্ধ্যা হইয়া গেল। এখন কোথায় যাই। আর একটু আগে গিয়া মাঠের মাঝখানে নারিকেলপাতায় আচ্ছাদিত সামান্য একখানি চালা দেখিতে পাইলাম। সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। জনমানবকে সে নালায় দেখিতে পাইলাম না। প্রাঙ্গণে শসা গাছের এক মাচা ছিল। অনেকগুলি দুধে-শসা তাহা হইতে ঝুলিতেছিল। পেট ভরিয়া আমি সেই শসার আঁতি খাইলাম। কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া আমি চালার ভিতর প্রবেশ করিলাম। গোটাকতক মেটে হাঁড়ী ভিন্ন তাঁহার ভিতর আর কিছু দেখিতে পাইলাম না। চালার একপার্শ্বে হেঁচা বাঁশ দিয়া গঠিত একটি তক্তপোষের মত ছিল। তাঁহার উপরে একটা ছেচা মাদুর ও ময়লা বালিশ ছিল। ঘোর ক্লান্তিতে কাতর হইয়া আমি তাঁহার উপর শুইয়া পড়িলাম।
সন্ধ্যা হইল। অন্ধকার হইল। সেই সময় কে একজন চালার ভিতর প্রবেশ করিল। দিয়াশলাই জ্বালাইয়া একটা কেরোসিনের ডিবে প্রজ্জ্বলিত করিল। তখন আমি দেখিলাম যে, সে একটা কালো স্ত্রীলোক। তাঁহার হাতে শাঁখা আছে, পায়ে প্রায় পাঁচ সের ওজনের বাঁকমল আছে। মাঝে মাঝে এ অঞ্চলে অনেক ধাঙ্গড় মজুরি করিতে আসে। আমি বুঝিলাম যে, স্ত্রীলোকটা ধাঙ্গড়ানী। প্রথম আমি একটু গলার সাড়া দিলাম। সে আমায় দিকে চাহিয়া দেখিল। তাহার পর আমি উঠিয়া বসিলাম। তাঁহাকে বলিলাম যে, বাঘের মুখ হইতে আমি অতি কষ্টে বাঁচিয়া সে স্থানে আসিয়াছি। আর পথ চলিতে পারি না। রাত্রিযাপনের নিমিত্ত তাঁহারা যদি একটু স্থান প্রদান করে, তাহা হইলে আমার বড় উপকার হয়।
সাধে কি এলোকেশীর মনে সর্ব্বদা আমার প্রতি সন্দেহ। আমার গায়ের বর্ণটি কৃষ্ণঠাকুরের চেয়ে কালো। বাঘ মিথ্যাকথা বলে নাই—শরীরের ভিতর কেবল খানকতক হাড়। মাথার মাঝখানে কিন্তু এমন চকচকে টাক আর কার আছে? প্রকাণ্ড টাক। টাকের চারিদিকে পাকা চুল, মুখের দুই পার্শ্বে সাদা ফেকো। দাঁত একটিও নাই। তথাপি আমার কিরূপ একটা শ্রীছাদ আছে, কিরূপ একটা লাবণ্য আছে যে, তাতে রাহুল ও ভুল হয়। আর মাগীগুলোও আমার গায়ে যেন ঢলিয়া পড়ে। অবাক হইয়া ধাঙ্গড় মাগী আমার টাক পানে চায়, আর মুচকে মুচকে হাসে। শেষে সে কেবল দুইটি কথা বলিল,–মাঝি আসুক। তোমাদের যেমন বাবু ইহাদের সেইরূপ সম্মানসূচক উপাধি মাঝি!
কিছুক্ষণ পরে একটা হোঁৎকা মিনসে চালার ভিতর প্রবেশ করিল। তোমরা আমাকে কালো বল, কিন্তু তার রঙের তুলনায় আমি তো ফিটু গৌরবর্ণ। সে আসিয়া যেই আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিল, আর বামহাতে আমার মাথা নোওয়াই,দক্ষিণ হাতে আমার পিঠে বজ্রসম দুইটা কিল বসাইয়া দিল। গন্ধ পাইয়া আমি বুঝিলাম যে, ধাঙ্গড় মদ খাইয়াছিল।
তাহার পর বলিল,–এতদিন পরে বেটাকে আজ ধরিয়াছি। ফাঁক পাইলেই আসে যায়, ধরিতে আর পারি না। আজ বেটাকে ধরিয়াছি ইয়ারকি দিতে জায়গা পাও না আমার ঘরে ইয়ারকি। হাড় গুড়া করিয়া ঐখানে আজ পুঁতিব?
এই কথা বলিয়া সে পুনরায় আর দুইটা কিল মারিল।
আমি বলিলাম,—আমি বিদেশী লোক। তোমার ঘরে আমি কখনও আসি নাই। আজ বিপদে পড়িয়া এ স্থানে আসিয়াছি।
ধাঙ্গড় বলিল,–বিদেশী লোক! গ্রীষ্মকালে মোড়লদের পুকুরে ফেটিজালে মাছ ধরিতেছিলে? মাঝিনীকে কে একরাশি চুনোমাছ দিয়াছিল? কেন দিয়াছিলে, কি আমি বুঝিতে পারি নাই?
এই কথা বলিয়া আবার দুইটা কিল মারিল।
আমি বলিলাম,আমি কখনও ফেটিজালে মাছ ধরি নাই। আমি ভদ্রলোক। মিছামিছি বিনা দোষে আমাকে মার কেন?
ধাঙ্গড় বলিল,–ভদ্রলোক! ভদ্রলোকের ঐ রকম টাক হয়! ভদ্রলোকের ঐ রকম কিস্তৃত কিমাকার চেহারা হয়। আর মাঝিনীর পসন্দ; আমাকে পসন্দ হয় না, তোকে পসন্দ।
এই কথা বলিয়া সে পুনরায় আরও দুইটা কিল মারিল।
আমি দেখিলাম যে, কথা কহিলেই দুইটা করিয়া কিল খাইতে হয়। তাহার পর, দারুণ প্রহার বরং সহ্য হয় কিন্তু সে যে আমাকে কুৎসিত বলিল, সে কথা আমার প্রাণে সহ্য হইল না। আমি চুপ করিয়া রহিলাম।
কিন্তু নীরব থাকিয়াও নিস্তার পাইলাম না। সে আমাকে উত্তমমধ্যম অধম বিলক্ষণ প্রহার করিল; তাহার পর আমার কাপড়-চোপড় কাড়িয়া লইয়া উলঙ্গ করিয়া গলা টিপিয়া সে স্থান হইতে বাহির করিয়া দিল। কেবলমাত্র প্রাণে সে আমাকে মারিল না। আমি উঠিতে পড়িতে উঠিতে পড়িতে মাঠের আল দিয়া চলিলাম। অতি ক্লেশে বহুদুর একখানি গ্রামের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম। এক তো রাত্রি হইয়াছে, তাহার পর উলঙ্গ, এ অবস্থায় সে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিলাম না। মনে করিলাম যে প্রাতঃকালে কাহারাও নিকট হইতে একখানি হেঁড়া-খোঁড়া গামছা চাহিয়া লইব। সেইখানি পরিয়া আপনার গ্রামে যাইব।
নিকটে একটি বাগান দেখিতে পাইলাম। নারিকেল গাছ-বেষ্টিত শান-বাঁধা ঘাট-বিশিষ্ট তাঁহার ভিতর একটি পুষ্করিণী ছিল। দারুণ প্রহারে শরীর আমার বিষম কোনা হইয়াছিল। ঘাটের চাতালে আমি শয়ন করিলাম। ঘোর ক্লেশে নিদারুণ প্রহারে শরীর আর আমার কিছু ছিল না। অল্পক্ষণ পরেই আমি নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলাম। এখন রাত্রি অবসান হইয়াছিল তাহা আমি জানিতে পারি নাই। সহসা ভূত। ভূত! চীৎকার শুনিয়া আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। আমি চাহিয়া দেখিলাম যে, প্রাতঃকাল হইয়াছে; সূৰ্য্য উদয় হইয়াছে? অন্যদিকে চাহিয়া দেখিলাম যে, জনকয়েক স্ত্রীলোক সেই পুষ্করিণীতে জল লইতে আসিয়াছিল। সেই উলঙ্গ অবস্থায় আমাকে দেখিয়া ভূত! ভূত! বলিয়া চীৎকার করিতে করিতে পলায়ন করিতেছে। তাহাদের কোমর হইতে কলসী পড়িয়া ভাঙ্গিয়া গেল। কিছুদূর মাঠ হইতে কয়েক জন পুরুষমানুষ কি হইয়াছে, কি হইয়াছে বলিয়া দৌড়িয়া আসিল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ–ডমরুরের মেমের পোষাক
আমি ভাবিলাম, আবার বা প্রহার খাইতে হয়। সেই ভয়ে আমি রুদ্ধশ্বাসে দৌড়িলাম। ঐ যাইতেছে, ঐ যাইতেছে বলিয়া কেহ কেহ আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইল। কিছুদূরে গিয়া আমি আর দৌড়িতে পারিলাম না। এক স্থানে নিবিড় ভেরাস্তার বেড়া ছিল। তাঁহার ভিতর প্রবেশ করিয়া আমি লুক্কায়িত রহিলাম। আমায় আর দেখিতে না পাইয়া তাঁহারা ফিরিয়া গেল। যাইতে যাইতে একজন বলিল,–ভূত কি কখন ধরা যায়? ভূত হাওয়া। এতক্ষণ কোন কালে বাতাসের সহিত মিশিয়া গিয়াছে।
বেড়ার পার্শ্বে আমি বসিয়া হাঁপাইতেছিলাম; কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া উঠিয়া বসিলাম। এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিলাম যে, বেড়ার বাহিরে ছোট একটি তাবু রহিয়াছে। তাঁহার ভিতরে ও বাহিরে জন দুই পুরুষ ও ঘাগরা-পরা তিনজন স্ত্রীলোক রহিয়াছে। নিকটে চার পাঁচটি বালক-বালিকা খেলা করিতেছে। একটু দূরে সম্মুখের পা বাঁধা কটা টাটু ঘোড়া চরিতেছে। যাহাদিগকে বেদিয়া বা হা-ঘোরে কঞ্জড় বলে, আমি বুঝিলাম যে, ইহারা সেই জাতি। ইহাদের ঘর-দ্বার নাই। আজ এখানে কাল সেখানে গিয়া ইহারা জীবনযাপন করে। ভিক্ষা করিয়া চুরি করিয়া অথবা জরী বটি বেচিয়া ইহারা দিনপাত করে। ইহারা খোটা কথা বলে। বাজারে তুমি একশত টাকায়ও রামচন্দ্রি অথবা আকবরি মোহর কিনিতে পারবে না। কিন্তু ইহাদের নিকট দুই তিন টাকায় পাওয়া যায়। সে মোহর পূজা করিলে ঘরে মা লরী আচলা-আঁটলা বিরাজ করেন। স্ত্রীলোকে রন্ধন করিতেছিল। বেলা দশটার সময়ে সকলে আহার করিয়া গ্রাম অভিমুখে চলিয়া গেল। ঘরে কেবল এক বুড়ি রহিল। বাহিরে বসিয়া বুড়ি আপনার মনে চুবড়ী বুনিতে লাগিল। যাইবার পূর্ব্বে এক স্ত্রীলোক তাঁহার কন্যার ছোট একটি সালুর ঘাঘরা শুরু হইবার নিমিত্ত আমার নিকটে ভেরা গাছে ঝুলাইয়া দিল।
সকলে চলিয়া গেলে সেই ঘাগরার দিকে আমার দৃষ্টি পড়িল। খুপ করিয়া ঘাগরাটি বেড়ার ভিতর টানিয়া লইলাম। ঘাগরাটি চুরি করিয়া আমি পরিধান করিলাম। আমার হাঁটু পর্যন্ত হইল। তাহার পর অন্যদিক দিয়া চুপে চুপে বেড়ার ভিতর হইতে বাহির হইয়া আমি পলায়ন করিলাম। আমার গ্রাম কোন দিকে, দিনের বেলা এখন অনেকটা বুঝিয়াছিলাম। হন হন করিয়া সেই দিকে চলিতে লাগিলাম। কিন্তু শরীর দুর্বল, তাঁহার উপর প্রহারের বেদনা; অধিক দ্রুতবেগে যাইতে পারিলাম না। লাল ঘাগরা পরিয়া আমাকে মন্দ দেখায় নাই। যাহার শ্ৰী আছে, সে যা পরিধান করুক না কেন তাতেই তাকে ভাল দেখায়। যাহারা বাঁদর খেলায়, তাহাদের সহিত যেরূপ লাল ঘাগরা পরা একটা বাঁদরের মেম থাকে, আমাকেও সেইরূপ মেমের মত দেখাইল। আমার গায়ের রং একটু কালো, কেবল এই প্রভেদ। আমাকে ভাল দেখাইলে কি হয়, এরূপ মেম সাজিয়া পাঁচজনের সম্মুখে বাহির হইতে লজ্জা করে। সে জন্য আমি কোন গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিলাম না। সেজন্য লোক দেখিলে তাহাদিগকে দূরে রাখিয়া আমি পথ চলিতে লাগিলাম। এই কারণে ক্রমে পৌঁছিতে আমার অনেক বিলম্ব হইল। বেলা প্রায় পাঁচটার সময় আমাদের গ্রামের নিকট মাঠে আসিয়া আমি উপস্থিত হইলাম।
আমি ভাবিলাম এ বেশে দিনের বেলা গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিব না। পাঁচজনে দেখিলে হাসিবে। দুর্লভী বাঘিনীতে তোমরা সকলেই জান। মন্দ নয়না? যাহার জন্য ও বৎসর গৃহিণী আমার উপর ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন? তাঁহার মেটে ঘরটি গ্রামের শেষে এককোণে। আমি মনে করিলাম কিছুক্ষণ তাঁহার ঘরে গিয়া বসিয়া থাকি। তাহার পর সন্ধ্যার সময় গা-ঢাকা অন্ধকার হইলে আস্তে আস্তে বাটী যাইব, এইরূপ মনে করিয়া চুপে চুপে তাঁহার ঘরে আমি প্রবেশ করিলাম, প্রথম সে আঁউমাউ করিয়া উঠিল। আমি তাঁহাকে বলিলাম,–ভয় নাই! চুপ কর, বড় বিপদে পড়িয়া তোর ঘরে আসিয়াছি। গোল করিসনে। পূজার সময় তোকে একখানা কাপড় দিব।
আমি ভাবিয়াছিলাম, কেহ আমাকে দেখিতে পায় নাই; কিন্তু তা নয়। পরীক্ষিৎ ঘোষের কেষ্টা নামে সেই দুষ্ট এঁচোড় পাকা ছেলেটা আমাকে দেখিতে পাইয়াছিল। পরীক্ষিৎ ঘোষ আমার নিকট হইতে দশ টাকা ধার লইয়াছিল। দেড়শত টাকা সুদ দিয়াছিল তাহার পর যখন সে আসল পরিশোধ করিল, তখন তাঁহাকে হাতে রাখিবার নিমিত্ত খতখানি ফিরিয়া দিলাম না। তাঁহার বিপক্ষে আদালতে একবার মিথ্যা সাক্ষ্যও দিয়াছিলাম। মোকামায় মিথ্যা বলিতে দোষ নাই। সেই অবধি আমার উপর তাঁহার আক্রোশ। তাঁহার ছেলেটাও পথে-ঘাটে আমাকে দেখিতে পাইলে দূর হইতে ক্ষেপায়, সে বলে—টাকা, টাক বাহাদুর, টাক টাক টাকেশর দুরু দুরু দুরু দুরু মানে ডমরু। আমার নামটা ছোড়া সংক্ষেপ করিয়াছে।
পরীক্ষিৎ ঘোষের কাছে তাঁহার ছেলের দৌরাত্ম্যের বিষয় একবার আমি নালিশ করিয়াছিলাম। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,–কেষ্টা কি আপনার দিকে চাহিয়া ও সব কথা বলে?
ছোঁড়া কি করে, মনে মনে চিন্তা করিয়া আমি উত্তর করিলাম,–না। সে আমার দিকে চাহিয়া বলে, কখনও বা গাছপালার দিকে চাহিয়া বলে, কখন বা আকাশপানে দুইটা পা করিয়া মাটীর দিকে মুখ করিয়া দুই হাতের উপর ভর দিয়া চলিতে চলিতে ঐ সব কথা বলে।
পরীক্ষিৎ ঘোষ বলিল,–তবে?
সে তবের আমি আর উত্তর দিতে পারিলাম না।
কেষ্টা তাড়াতাড়ি গিয়া আপনার বাপকে সংবাদ দিল। আমি তা জানিতাম না। পরীক্ষিৎ ঘোষ আসিয়া দুর্লভীর ঘরের দ্বারে শিকল দিয়া দিল দুর্লভীকে আর আমাকে ঘরের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিল। তাহার পর পাড়ার লোককে সংবাদ দিল। দুর্লভীর ঘরে আমাঠে দেখিবার নিমিত্ত মেয়ে-পুরুষ ছেলে বুড়ো সুদ্ধ লোক ভাঙ্গিয়া পড়িল।
জাহ্নবী সাঁই বলিলেন,–আমিও দেখিতে গিয়াছিলাম।–গণপতি ভড় বলিলেন,–আমিও গিয়াছিলাম!–পুঢ়ীরাম চাকী বলিলেন,–আমিও গিয়াছিলাম।
লোদর বলিলেন,—আমি তখন বাড়ী ছিলাম না। বাড়ী থাকিলে আমিও যাইতাম। ক্রুদ্ধ হইয়া ডমরুধর বলিলেন,—যাইতে বই কি। তুমি না গেলে কি চলে?
দুর্লভীর ঘরের সম্মুখ দিকে দুইপার্শ্বে দুইটি ছোট ছোট জানালা আছে। ঘরের পশ্চাৎ দিকের প্রাচীরেও সেইরূপ ছোট জানালা আছে। সম্মুখ দিকের দুইটি জানালা দিয়া লোক সব উকি মারিয়া আমাকে দেখিতে লাগিল। সে দুইটি জানালায় ভিড় করিয়া লোকে ঠেলাঠেলি করিতে লাগিল। কেষ্টার বন্ধু জন পাঁচ ছয় ছোঁড়া চালে উঠিয়া খড় ফাঁক করিয়া উপর হইতে উকি মারিয়া আমাকে দেখিতে লাগিল। পশ্চাৎ দিকের জানালাটা কিছু উচ্চ ছিল। মাটীতে দাঁড়াইয়া তাহা দিয়া দেখিতে পারা যায় না। কেষ্টা ছোঁড়ার একবার বয়মায়েসি শুন। কোথা হইতে একটা টুল চাহিয়া আনিল। লোককে সেই টুলের উপর দাঁড় করাইয়া ঘরের ভিতর আমাকে ও দুর্লভীকে দেখাইতে লাগিল।
পুঁটিরাম চাকী বলিলেন,–অমনি দেখায় নি। এক পয়সা করিয়া টুলের ভাড়া লইয়াছিল। দেখিতে আমার একটু বিলম্ব হইয়াছিল বলিয়া আমার নিকট হইতে সে চারি পয়সা লইয়াছিল।
আধকড়ি ঢাক বলিলেন,–চারি পয়সা! আমাকে সাত পয়সা দিতে হইয়াছিল।
ডমরুধর মুখ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন,–কি দেখিবার জন্য পয়সা খরচ করিয়াছিলেন? আমাকে কি তোমরা কখনও দেখ নাই? আমি কি আলিপুরের বাগানের সিঙ্গি না বাঘ না কি, যে আমাকে দেখিবার জন্য তোমাদের এত হুড়াহুড়ি?
সপ্তম পরিচ্ছেদ–এলোকেশী মুড়া থেঙরা
দেখিতে দেখিতে কে একজন বলিয়া বসিল,–এলোকেশী ঠাকুরাণীকে সংবাদ দাও। তিনি আসিয়া কর্তাটিকে একবার দেখুন।
তখন আমার হৃৎকম্প হইল। একে তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী। তাঁহার উগ্রচণ্ডা-সর্ব্বদা রণমূৰ্ত্তি। আবার তাঁহার উপর আমি এক কন্দর্প পুরুষ। সর্ব্বদাই এলোকেশীর সন্দেহ। এ অবস্থায় আমাকে দেখিলে এলোকেশীর যে আমার কি হাল করিবেন, তা ভাবিয়া আকুল হইলাম। সেই হতভাগা ছোঁড়া কেষ্টা বলিতে না-বলিতে আমার বাড়ীতে সংবাদ দিল। এলোকেশীর গায়ের রং আমা অপেক্ষা কালো। রাগে এখন তাঁহার মুখটি অনেক দিনের ভূযোপড়া ধানসিদ্ধ হাঁড়ীর ন্যায় হইল। ভীম যেরূপ ঘণ্টাওয়ালা লোহার গদা লইয়া দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে দুৰ্য্যোধনের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়াছিলেন, এলোকেশীরও সেই রূপ মুড়ো খেরা লইয়া দুর্লভীর ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
এলোকেশীকে দেখিয়া লোকে পথ ছাড়িয়া দিল। দ্বারের শিকল খুলিয়া তিনি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন! তাহার পরবলিব কি ভাই, আর দুঃখের কথা। পোড়ার মুখ বুড়ো ডেকরা! রঃ! আজি তোর ভূত ছাড়াইব—এই কথা বলিয়া আমার মাথার টাক হইতে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত সেই মুড়ো খেঙরা দিয়া ঝাড়াইতে লাগিলেন। এলোকেশীর নব্য বয়স; ধাঙ্গড়ের কিল বা কি? এলোকেশীর এক এক ঘা খেঙরা ভীমের গদার ন্যায় আমার গায়ে পড়িতে লাগিল। আমি যত বলি—আর নয়! আর নয়! যথেষ্ট হইয়াছে, ততই খেরার প্রহারে আমার পিঠ ফাটিয়া যাইতে লাগিল। মাথার টাকে ও পিঠে সেই মুড়ো খেরার অনেক কাঠি ফুটিয়া গেল।
কেষ্টাকে মন্দ বলি, কিন্তু এই দুঃসময়ে আমার বন্ধু হইল। আমার নাকাল দেখিয়া আমোদে আটখানা হইয়া সে ও তাঁহার সঙ্গিগণ হাততালি দিয়া নাচিতে নাচিতে বলিতে লাগিল,–ট্যাক-দ, টাক-বাহাদুর, টাক টাক টাকেশ্বর দুরু দুরু দুরু।
তখন এলোকেশী আমাকে ছাড়িয়া—তবে রে আঁটকুড়ীর বেটারা। বলিয়া তাহাদের মারিতে দৌড়িলেন। আমি অব্যাহতি পাইলাম, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে নয়। দুর্লভী তখন আপনার খেঙরা লইয়া আমাকে বলিল,–তুই যেমন ঠাকুর তোর তেমনি করিয়াছেন। আমার মন ভুলাইতে রাঙা ঘাঙরা পড়িয়া সাজ-গোজ করিয়া আসা হইয়াছে; এখন আমি একবার ঝাড়াই। এইকথা বলিয়া সেও ঘাকত আমার পিঠে বসাইয়া দিল।
কত কিল কত খেঙরা আর সহ্য করিব। আমার পিঠ তো আর পাথরের নয়। আমি সে স্থান হইতে পলায়ন করিলাম। দুর্লভীর ঘর হইতে যখন বাহির হই তখন এলোকেশী বিকে,–এখনও হইয়াছে কি। চল ঘরে চল। আজ তোর আমি হাড়ীর হাল করিব। শেভরার চোটে তোর ভূত ছাড়াইব।
সেই ভয়ে আমি বাড়ী যাইলাম না। আমার খিড়কির বাগানে একগাছে ঠেস দিয়া বিরস বনে বসিয়া রহিলাম। বসিয়া বসিয়া মা ভগবতীকে ডাকিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম,–মা! আমি তোমার ভক্ত, দুর্গোৎসব আসিতেছে মা। আমি তোমার পূজা করিব। তুমি কি আমার দালানে তোমার প্রতিমা গড়া হইতেছে। তবে কেন মা আমার উপর রাগ করিয়াছ?
সন্ধ্যা হইল, ক্রমে রাত্রি হইল। বাড়ী যাইতে আমার সাহস হইল না, গাছে ঠেস দিয়া বসিয়া রহিলাম মাঝে মাঝে একটু একটু তন্দ্রা আসে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভাঙ্গিয়া যায়। স্বপ্ন দেখি যে, এলোকেশী বুঝি শূর্পণখার বেশ ধরিয়া আমার নাক কাটিতে আসিতেছেন। অথবা তাড়কা রাক্ষসী হইয়া আমাকে চর্বণ করিতেছেন। প্রহারে শরীর জ্বর জ্বর হইয়াছিল। শেষ রাত্রিতে আর বসিয়া থাকিতে পারিলান না। ভিজা মাটীর উপরেই শুইয়া পড়িলাম। একটু নিদ্রা আসিয়াছে, এমন সময় কে যেন আমাকে ডাকিলেন,—ডমরুধর! বাছা ডমরুধর!
অষ্টম পরিচ্ছেদ–অমৃত কুণ্ডের জল
চমকিত হইয়া আমি উঠিয়া বসিলাম। চক্ষু মুছিতে দেখিলাম যে, স্বয়ং মা দুর্গা একখাচ্ছি চৌকীর উপর আমার সম্মুখে বসিয়া আছেন। এ তোমার দশ-হেতে হরিতাল রঙে গর্জন তৈলে ব্যাড়বেড়ে রাঙতা-পরা দুর্গা নয়। এ কৈলাস পর্ব্বতের আসল মা দুর্গা; সুন্দর পরিচ্ছদে ও বহুমূল্য রত্ন-আভরণে ভূষিত করিয়া কুবের ইহাকে আমার নিকট পাঠাইয়াছেন।
জোড়হাতে মায়ের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আমি স্তবস্তুতি করিতে লাগিলাম। মা বলিলেন,–ডমরুধর! তুমি অপরাধ করিয়াছ। যে মন্ত্র তোমাকে আমি শিক্ষা দিয়াছিলাম, তাহা ভুলিয়া ও কি উদ্ভট সব কথা বলিয়াছিলে? জিলেট জিলেকি সিলেমে কিলেকিট কিলেকি কি বাছা? এরূপ মন্ত্র বেদে কোরানে বাইবেলে কোন স্থানে আমি দেখি নাই। পিড়িং পিড়িং দুম বলিলেও একদিক কথা থাকিত। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ তোমার এত দুর্গতি হইয়াছে। যাহা হউক, তোমাকে আমি ক্ষমা করিয়াছি। এক্ষণে হাঁ কর।
আমি হাঁ করিলাম। দেবী আমার মুখে একটু অমৃত কুণ্ডের জল ঢালিয়া দিলেন। তাহাতে আমার সর্ব্বশরীরের ব্যথা দূর হইল। যেন নূতন জীবন নূতন শরীর আমি প্রাপ্ত হইলাম। তাহার পর মা আমাকে আশ্বাস প্রদান করিয়া বলিলেন,–যাও বাছা। এখন ঘরে যাও। এলোকেণী আর তোমাকে কিছু বলিবে না। এই কথা বলিয়া মা অন্তর্ধান হইলেন। আমি বাড়ী আসিলাম। মায়ের বরে এলোকেশীর প্রসন্ন বদন দেখিয়া পরম সন্তোষ লাভ করিলাম। ডমরুধারীর গল্প শুনিয়া সকলে চমৎকৃত হইলেন। পুরোহিত বলিলেন,–ধন্য ডমরুধর! তুমি ধন্য!গণপতি ভড় বলিলেন,—ডমরুকি বিপদেই না পড়িয়াছিলেন। পুঁটিম চাকী বলিলেন,–কেবল পুণ্যবলে ডমরুধর রক্ষা পাইয়াছেন।
আধকড়ি ঢাক বলিলেন,–চমৎকার গল্প। লম্বোদর বলিলেন,—অতি চমৎকার। বন্ধুদিগের পুস্তক সমালোচনা করিবার সময় কোন লোক লেখক যেরূপ প্রেমে মজিয়া রসে ভিজিয়া ভাবে গেজিয়া বলেন,মরি মরি! আহা মরি! এও সেই আহা মরিচকসঙ্গে ডমরুর একবার লম্বোদরের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। কিন্তু কোন উত্তর করিলেন না।
অবশেষে ডমরুধর বলিলেন,–পীর গোরাচাঁদের ব্যাঘ্রের উদরে যখন ছিলাম, তখন মনে মনে সঙ্কল্প করিয়াছিলাম যে, এ বিপদ হইতে মা যদি আমাকে পরিত্রাণ করেন, তাহা হইলে মাকে আমি ব্যাঘ্রবাহিনীরূপে পূজা করিব। আমার আদেশে সেই জন্য কারিগর সিংহ স্থানে ব্যাঘ্ৰ গড়িয়াছে। লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—তুমি যে গল্পটি করিলে, কি করিয়া জানিব যে, তাহা সত্য?
ডমরুধর উত্তর করিলেন,–এই আমার পায়ে এখনও রাহুর কামড়ের দাগ রহিয়াছে। সত্য সত্যই ডমরুধরের পায়ে একটা দাগ আছে, তা দেখিয়া সকলে অবাক!
তখন লম্বোদর বলিলেন,—জিলেট জিলোক সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।