ঘাটের জঙ্গল পরিষ্কারের প্রস্তাবে কর্নেল সেনসায়েবকে রাজি করাতে পারলেন না। তার বক্তব্য, এতে চোরের খুব সুবিধে হবে। পালানোর জন্য কষ্ট করে, পাঁচিল ডিঙোতে হবে না। তা ছাড়া তিনি যখন থাকবেন না, তখন রাম সিংয়ের বউ ছেলেমেয়েরা লেকের দূষিত জলে স্নান করে অসুখ বাধাবে। দেহাতি মানুষজনের যা স্বভাব! ঘাটের দরজা খুলে স্নান করছে, সেই সুযোগে চোরও ঢুকে পড়তে পারে। আর বিষাক্ত সাপের ব্যাপারটা তো আছেই। সেইজন্য ঘাটের দরজার কপাটের তলায় মাটি ফেলে জ্যাম করে দেওয়া হয়েছে।
অগত্যা কর্নেল আর তাকে পীড়াপীড়ি করলেন না। সেনসায়েব তার দুই বন্ধু সুশীল ভরদ্বাজ এবং রমেশ সিনহার জন্য উদ্বিগ্ন। তন্ময় এবং সৌমিত্রকে গাড়ি নিয়ে লাখানপুরে তাদের খোঁজ নিতে পাঠালেন।
কর্নেল সেনসায়েবকে বললেন, আমি আর জয়ন্ত একটু বেরোচ্ছি। বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে ফিরব। কান্দ্রা রিসর্ট এরিয়াটা এখনও দেখা হয়নি। সেক্রেটারি বার্ড আমার সকাল নষ্ট করে দিয়েছে।
সেনসায়েব হাসতে হাসতে বললেন, পাখির ছবি পরে তুলবেন কর্নেল সরকার! আগে এই চোর-রহস্যটা কিনারা করে দিন।
দেখা যাক। বলে কর্নেল পা বাড়ালেন।
গেট খুলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, একজন তাগড়াই চেহারার ষণ্ডামার্কা লোক এসে গেট ভেতর থেকে আটকে দিল। বললাম, কর্নেল! ওই সেই হরি সিং। ওকে পালোয়ান বলছিল সুদেষ্ণা। একটুও বাড়িয়ে বলেনি।
কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। তাঁর মুখ বেজায় গম্ভীর। আমরা সংকীর্ণ পিচরাস্তায় পুবদিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। বাঁ দিকে খাদ ও পাথুরে রুক্ষমাটির– ওধারে রেললাইন। ডান দিকে উঁচু জমির ওপর ইতস্তত একটা করে সুদৃশ্য আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন রঙ-বেরঙের বাড়ি। মাঝে-মাঝে পোড়ো ঝোঁপ জঙ্গলে ঢাকা জমি। কোথাও বাড়ির ভিত উঠেছে। লোহালক্কড়, বালি আর পাথরকুচির স্কুপ চোখে পড়ছিল। কিন্তু কোথাও কোনও মানুষ নেই।
প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর দেখলাম বস্তাটা অন্য একটা চওড়া রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। সেখানে একটা বাজার এবং চওড়া রাস্তার ওধারে নিচু জমিতে সরকারি কোয়ার্টার সারবন্দি দাঁড়িয়ে আছে। বাজারে তত কিছু ভিড় নেই। বাসস্ট্যান্ডে একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাজারটাও বেশ কেতাদুরস্ত। কয়েকটা ঝকঝকে চেহারার গাড়ি পার্ক করা আছে। বললাম, একেবারে পশ এরিয়া। আপনি এখানে চুরুট কেনার জন্য যদি এসে থাকেন, দাম শুনে হয়তো দুঃখ পাবেন।
কর্নেলের মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটল। বললেন, না জয়ন্ত! চুরুটের যা স্টক আছে, তাতে অন্তত এখনও দুটো দিন চলে যাবে। আমার উদ্দেশ্য ছিল লাখানপুর জংশনে যাওয়ার বাসরুট দেখা। ওই দেখ, বাসটা লাখানপুর হয়ে ধানবাদ যাবে। তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি বাসের খবরাখবর জেনে আসি।
একটা বটগাছের ছায়ায় দাঁড়ালাম। কর্নেল একটু পরে ফিরে এসে বললেন, লাখানপুর এখান থেকে প্রায় ছ কিলোমিটার। কারণ পাহাড়ি রাস্তা ঘুরে ঘুরে এগিয়ে গেছে। রেললাইন গেছে সিধে নাক বরাবর। সারাদিনে তিন বার বাস যায়। তিন বার আসে।
স্টেশনমাস্টার ভারি অদ্ভুত লোক তো! স্টেশন থেকে মাত্র দু কিলোমিটার দূরে এই বাসরুট আছে, বলেননি।
বলেননি তার কারণ স্পষ্ট। কাল এখানে পৌঁছে আমরা কোনও বাস পেতাম না। লাখানপুরের দিকে শেষ বাস ছেড়ে যায় বেলা তিনটেতে। কাজেই আমাদের এখানে রাত কাটাতে হতো। কিন্তু লক্ষ্য করো, এখানে রাত্রিবাসের জন্য এখনও কোনও হোটেল গড়ে ওঠেনি। ভবিষ্যতে গড়ে উঠতে পারে, যদি কান্দ্রা লেকের জলদূষণ বন্ধ করে শোধনের ব্যবস্থা করা যায়। যাই হোক, চলো, ফেরা যাক।
অদ্ভুত জায়গা! একটা সাইকেল-রিকশা বা একাগাড়ি-টাড়িও নেই!
সে কী! তুমি এইটুকু রাস্তা হেঁটেই নেতিয়ে পড়লে?
বিচ্ছিরি রোদ!
আহা, এমন মিষ্টি রোদকে বিচ্ছিরি বোলো না!
রাস্তার ধারে নির্দিষ্ট দূরত্বে একটা করে নানা জাতের গাছ লাগানো হয়েছে। সেগুলো এখনও তত বেড়ে ওঠেনি। কিছুক্ষণ পরে বললাম, সেনসায়েব ঘাট পরিষ্কার করতে রাজি হলেন না। স্বীকার করছি, ওঁর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আপনি ওখানে একটা লোককে দেখতে পেয়েছিলেন। কী ধরনের লোক?
রীতিমতো ভদ্রলোক।
আশ্চর্য! ওখানে উনি কী করছিলেন?
চুপচাপ বসে ছিলেন। তারপর হঠাৎ গুঁড়ি মেরে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হলেন।
বয়স্ক লোক, না–
কর্নেল হাসলেন। চেপে যাও! এবার রোদ তোমার কাছে মিষ্টি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। ওই দেখ, সুদেষ্ণা এসে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছু দূরে একটা নিচু গাছের পাশে সুদেষ্ণাকে দেখতে পেলাম। বললাম, কারও জন্য অপেক্ষা করছে যেন।
দেখা যাক। বলে কর্নেল বাইনোকুলারে তাকে একবার দেখে নিলেন।
আমরা কাছে পৌঁছলে সুদেষ্ণা একটু হাসল। দোতলা থেকে দেখছিলাম আপনারা এদিকে কোথাও যাচ্ছেন। একা বেরুনো ছোটমামার বারণ। উনি স্নান করতে গেলেন। তখন বেরিয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, স্নান করতে গেলেন? বাইরে কোথাও?
হ্যাঁ। উনি রুহা প্রপাতের নিচে স্নান করতে যান। শর্টকাটে তত কিছু দূর নয়।
তা তোমার হাতে নতুন কোনও ক্লু এসেছে বুঝি? ঝটপট বলে ফেলো।
আপনাকে রাজেনবাবুর বাড়িটা চিনিয়ে দেওয়া উচিত। সেই ভেবে চলে এলাম। আমি কি আপনার মতো ডিসরি! আমার কি আপনার মতো চোখ। আছে যে কোনও ক্লু খুঁজে পাব?
কর্নেল তার অট্টহাসিটা হাসলেন। অমনি আমাদের বাঁ পাশের ঝোপে-ঢাকা পোড়োজমি থেকে কে বলে উঠল, সাইলেন্স! সাইলেন্স!
তারপর ঢিলে প্যান্টশার্টপরা এক রোগাটে চেহারার বৃদ্ধকে ঝোপের ভেতর থেকে উঠে দাঁড়াতে দেখলাম। সুদেষ্ণা বলে উঠল, এই রে! সেরেছে! জজসাহেব আমাকে দেখলে এক্ষুণি জেলে ভরবেন।
সে রাজেনবাবুকে দেখতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে হনহন করে হাঁটতে থাকল। রাজেনবাবুর দৃষ্টি কর্নেলের দিকে। কর্নেল মাথার টুপি খুলে বিলিতি কেতায় অভিবাদন করে ইংরেজিতে বললেন, এই যে মিঃ দ্বিবেদী! আমি আপনার বাড়ি খুঁজে ক্লান্ত।
রাজেন দ্বিবেদী নেমে এসে আমার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, ইনি কে?
আমার তরুণ বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী। ও একজন সাংবাদিক।
রাজেনবাবু চাপা গলায় আমাকে বললেন, আপনাকে কিছু গোপন তথ্য দেব। খবরের কাগজে ফাঁস করে দেবেন।
কর্নেল বললেন, আপনি ওখানে কী করছিলেন?
আপনি বিকট হেসে সব ভেস্তে দিলেন। আপনার নামটা কী যেন?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আপনার পকেটে আমার নেমকার্ডটা এখনও থাকা উচিত।
রাজেনবাবু বুকপকেট থেকে কার্ডটা বের করে অদ্ভুত শব্দে হাসলেন। হ্যাঁ। আসলে কোনও একটা দিকে মনঃসংযোগ করলে আমার আর কিছু মনে থাকে না।
আপনি ওখানে কী বিষয়ে মনঃসংযোগ করছিলেন?
রাজেনবাবু ফিসফিস করে বললেন, আমার বন্ধু ডঃ বি কে সেনের প্রেতাত্মাকে ডাকছিলাম। বড্ড ভীতু। বুঝলেন? সকালে পার্বতীর মন্দিরে দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ দেখি, শয়তান নরেশ ভার্মা নিচের দিক থেকে উঠে আসছে। অমনি আমি লুকিয়ে পড়লাম। নরেশ একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকার পর আবার নেমে গেল। লেকের পশ্চিম পাহাড়ে কোথাও শয়তানটা ডেরা করেছে। আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে। ও হ্যাঁ! আপনি আমাকে সাহায্য করবেন বলছিলেন না?
নিশ্চয় করব। কিন্তু আপনি আমাকে বলেননি কে ওই নরেশ ভার্মা?
দাগী আসামী। গভমেন্টের খনিদফতরে উঁচু পদে চাকরি করত। ইউরেনিয়াম পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। আমার এজলাসে সেই মামলা উঠেছিল। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলাম। কিন্তু হাইকোর্টে গিয়ে মেয়াদ কমে পাঁচ বছরের জেল হলো। তারপর শয়তানটা জেল থেকে পালিয়ে যায়। সে প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। বলে রাজেনবাবু সাদা চুল আঁকড়ে ধরে কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
কর্নেল বললেন, তারপর কী হলো মিঃ দ্বিবেদী?
সবটা মনে পড়ছে না। আমি একদিন এজলাস থেকে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর কী যেন হয়েছিল।
এখানে বাড়ি করেছেন কতদিন আগে?
বাড়ি কি আমি করেছি? করেছে আমার বড়ছেলে সুরেন্দ্র।
তিনি কি এখন আছেন?
রাজেনবাবু হাসলেন। সুরেন্দ্র থাকে ওড়িশার সম্বলপুরে। সেখানকার ডি এম। মাঝে মাঝে আসে।
তা হলে এখানে আপনি একা থাকেন?
একা কি থাকা যায়? একজন কাজের লোক আছে।
নরেশ ভার্মার কথা বলুন মিঃ দ্বিবেদী!
হ্যাঁ–নরেশ! প্রায় দু বছর আগে এক বিকেলে পার্বতীর মন্দিরে গিয়ে বসে আছি। হঠাৎ দেখি নরেশ চুপিচুপি নিচে থেকে উঠে আসছে। আমি তো হতভম্ব। কে যেন বলেছিল, নরেশ জেল থেকে পালিয়েছে। যেই ওকে বলেছি, তুমি সেই নরেশ ভার্মা না? অমনি সে গা ঢাকা দিল। ফিরে এসে কান্দ্রা পুলিশপোস্টে খবর দিলাম। পুলিশ গ্রাহ্যই করল না। তারপর বেনামী একটা উড়ো চিঠি এল, মুখ বুজে না থাকলে আমি মারা পড়ব। সুরেন্দ্রকে সব জানিয়েছিলাম। সে আমাকে বলল, এ ব্যাপারে আমি যেন আর নাক না গলাই। যা করার সুরেন্দ্রই করবে। কিন্তু করেনি।
রাজেনবাবু করুণমুখে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। কর্নেল বললেন, সম্ভবত আপনার নিরাপত্তার জন্য আপনার ছেলে এ ব্যাপারে ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। আপনি কি এসব কথা আর কাউকে বলেছিলেন?
ডঃ সেনকে বলেছিলাম। তারপর সে হঠাৎ অপঘাতে মারা পড়ল।
অপঘাতে? না হার্ট অ্যাটাকে?
তার প্রেতাত্মা আমাকে বলেছে, অপঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। রাজেনবাবু চারদিক দেখে নিয়ে আবার ফিসফিস করে বললেন, আপনি মিলিটারির লোক। তাই আপনাকে সব জানিয়ে রাখলাম। আর একটা কথা। ডাক্তার পাণ্ডে ছিলেন সাংঘাতিক লোক। আমি কক্ষণো তার কাছে চিকিৎসা করাইনি। অসুখবিসুখ। হলে সোজা লাখানপুরে চলে যাই। আপনি কোথায় উঠেছেন যেন?
মৃন্ময়ীভবনে। সেনসায়েবের বাড়িতে।
অ্যাঁ? কী সর্বনাশ! তা হলে তো আপনাকে গোপন কথা ফাঁস করা আমার উচিত হয়নি। বড় ভুল করে ফেলেছি। ডাক্তার পাণ্ডের বউ দজ্জাল মহিলা। তা ছাড়া বিধবা হয়েও মুর্গির মাংস খায়। ছ্যা ছা!
বলে রিটায়ার্ড জজসাহেব হনহন করে হাঁটতে থাকলেন। তারপর একটা বাড়ির আড়ালে উধাও হয়ে গেলেন।
বললাম, ভদ্রলোক মানসিক রোগী তা ঠিক। তবে মাঝে মাঝে বেশ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন, আমার মনে হচ্ছে, ইদানীং এমন কিছু ঘটছে, যা রাজেনবাবুর ওপর শক থেরাপির কাজ করছে। তার মানে, ঘটনার ধাক্কায় ওঁর স্মৃতিশক্তি মাঝে মাঝে চাঙ্গা হয়ে উঠছে।
ঘটছেটা কী? জলজ্যান্ত নরেশ ভার্মা আর মৃত ডঃ বি কে সেনের প্রেতাত্মার ঘনঘন আবির্ভাব–এই তো?
আরও কিছু ঘটছে হয় তো! রাজেনবাবু যা বুঝিয়ে বলতে পারছেন না সম্ভবত।
মৃন্ময়ীভবনের কাছাকাছি গিয়ে দেখি, সুদেষ্ণা একটা কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে সে বলে উঠল, রাজেনবাবুর পাল্লায় পড়ে খুব নাকাল হয়েছেন, দুজনে, তাই না?
কর্নেল হাসলেন। তা আর বলতে?
কী বলছিলেন উনি?
নরেশ ভার্মা নামে একটা লোকের কথা।
সুদেষ্ণা চমকে উঠল। নরেশ ভার্মা?
নামটা তোমার পরিচিত নাকি?
সুদেষ্ণা ঠোঁট কামড়ে ধরে পা বাড়াল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, বড়মামার কাছে তাকে মাঝে মাঝে আসতে দেখেছি। মাইনিং ডিপার্টমেন্টের অফিসার ছিলেন।
তার সম্পর্কে আর কিছু জানো না?
না তো! বলে সুদেষ্ণা থমকে দাঁড়াল। হ্যাঁ। মনে পড়ছে, ছোটমামার কাছে শুনেছিলাম কী একটা খারাপ কাজের জন্য তার নাকি জেল হয়েছে।
গেটের সামনে যেতেই সেই পালোয়ান এসে গেট খুলে দিল। কুকুরটার সাড়া পেলাম না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের টম কি ঘুমোচ্ছে নাকি?
সুদেষ্ণা বলল, না। ছোটমামা স্নান করতে গেলে টমকে সঙ্গে নিয়ে যান। হাতে বন্দুকও থাকে। কর্নেল! এখন কফি খাবেন নিশ্চয়?
কর্নেল বললেন, নাহ। প্রায় বারোটা বাজে। জয়ন্ত! তুমি স্নান করে নাও। আজ আমার স্নানের দিন নয়।
সুদেষ্ণা বলল, বাথটাবে জল ভরা আছে। তবে কুয়ো থেকে তোলা জল তো ভীষণ ঠাণ্ডা। আমি ভানুমতাঁকে বলছি এক বালতি জল গরম করে দিয়ে যাবে। জয়ন্তবাবু! একটু অপেক্ষা করুন।
সে ভেতরে চলে গেল। আমি দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢুকলাম। কিন্তু কর্নেল হনহন করে আবার ঘাটের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং যথারীতি বাইনোকুলারে কিছু দেখতে থাকলেন। সম্ভবত সেই সেক্রেটারি বার্ড।
দুদিকের দরজা আটকে ঝটপট প্যান্টশার্ট বদলে নিয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে নিলাম। তারপর ভেতরের দিকের দরজা খুলে দিয়ে বারান্দার দিকের দরজা খুললাম। কিন্তু কর্নেলকে দেখতে পেলাম না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখে নিলাম। কোথাও উনি নেই।
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর ঘাটের দরজা থেকে একটু দূরে পাঁচিলের পুব-দক্ষিণ কোণে কর্নেলের টুপি চোখে পড়ল। উনি পাঁচিল ডিঙিয়ে ভেতরে নামলেন। তারপর পোশাক ঝেড়ে সাফ করার পর হন্তদন্ত এগিয়ে এলেন। বারান্দায় উঠলে জিজ্ঞেস করলাম, পাঁচিল ডিঙিয়ে গিয়ে কী করছিলেন?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, সেক্রেটারি বার্ড।
ওঃ কর্নেল! আমি বাচ্চা ছেলে নই।
এবার কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, মুখটি বুজে থাকবে কিন্তু! এতক্ষণে একটা ধোঁয়াটে রহস্যের লেজ ধরতে পেরেছি। বাকিটুকু অবশ্য এখনও অস্পষ্ট। তবে না–এসব কথা এখন নয়।
উনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে টুপি খুললেন। তারপর টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, সুইচ টিপে ফ্যানটা চালিয়ে দাও। আস্তে চলুক।
আসলে ওঁর কাণ্ডকারখানা দেখে এত অবাক হয়েছিলাম যে ফ্যানটা চালিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। সুইচ টিপে টের পেলাম, এতক্ষণ ঘরে বেশ। গরম ছিল।
কিছুক্ষণ পরে ভেতরের দরজা দিয়ে সুদেষ্ণা আর ভানুমতী এল। ভানুমতীর হাতে গরম জলের বালতি। সে বাথরুমে বালতিটা রেখে ঘোমটায় মুখ আড়াল করে চলে গেল। সুদেষ্ণা বলল, জয়ন্তবাবু! স্নান করে নিন।
কর্নেল হঠাৎ আস্তে ডাকলেন, তিতি!
বলুন!
তোমার বড়মামার শেষকৃত্য কোথায় হয়েছিল?
কেন? এখানেই লেকের পূর্বদিকে শ্মশান আছে। সেখানে।
তুমি তখন উপস্থিত ছিলে?
না। খবর পেয়ে তন্ময়দা এবং সৌমিত্রের সঙ্গে এখানে পরদিন এসেছিলাম। সুদেষ্ণা একটু অবাক হয়েছিল। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন এ কথা জানতে চাইছেন?
নিছক কৌতূহল। তো ওঁর মৃত্যুর সময় শুধু তোমার ছোটমামা এখানে ছিলেন?
হ্যাঁ। কাল রাত্তিরে আপনাকে তো ছোটমামা ডিটেলস ঘটনাটা বললেন।
ঠিক আছে। জয়ন্ত! স্নান করে ফেলো।
এই সময় টমের সাড়া পাওয়া গেল। সুদেষ্ণা বলল, ছোটমামা স্নান করে ফিরলেন মনে হচ্ছে।
সেনসায়েব ভেতরের দরজায় উঁকি মেরে বললেন, একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরলাম কর্নেল সরকার। একটা প্রকাণ্ড পাথর পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে এসে আমার কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে জলে পড়ল। বুঝতে পারলাম না, এটা কেউ আমাকে লক্ষ্য করে ঠেলে ফেলেছে, নাকি দৈবাৎ–এনি ওয়ে! আর আমি রুহা প্রপাতে স্নান করতে যাচ্ছি না। ওঃ! কী সাংঘাতিক ব্যাপার!