গাইড মানুষটিকে নায়ীরার খুব পছন্দ হল। নীল চোখ এলোমেলো চুল এবং রোদেপোড়া তামাটে চেহারা। নায়ীরাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, আমাকে বলেছে একজন মহিলাকে নিয়ে যেতে! তুমি তো মহিলা নও, তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে!
নায়ীরা হেসে বলল, আমাকে বাচ্চা বলা ঠিক হবে না, আমার বয়স পনের।
পনের একটা বয়স হল? আমার বয়স তেতাল্লিশ। তোমার তিন গুণ।
নায়ীরা বলল, আমি আসলে খুব বেশি মানুষ দেখি নি, তাই দেখে মানুষের বয়স অনুমান করতে পারি না। তবে তোমাকে দেখে মোটেও তেতাল্লিশ বছরের মানুষ মনে হচ্ছে না।
কী বলছ তুমি? মানুষের বয়স ঠিক করা উচিত তার অভিজ্ঞতা দিয়ে। যদি সেভাবে ঠিক করা হত তা হলে আমার বয়স হত সাতানব্বই বছর!
সত্যি?
হ্যাঁ। এমন কোনো কাজ নেই যেটা আমি করি নি।
নায়ীরা বলল, তোমার পদ্ধতিতে বয়স ঠিক করা হলে আমি এখনো শিশু। আমার অভিজ্ঞতা বলে কিছু নেই। একেবারে শূন্য।
গাইড মানুষটি বলল, একেবারে শূন্য কেন হবে? নিশ্চয়ই পড়াশোনা করতে স্কুলে গিয়েছ, সেখানে কত রকম বন্ধুবান্ধব, কত রকম শিক্ষক-শিক্ষিকা, কত রকম অভিজ্ঞতা
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, উঁহু, আমি কখনো স্কুলে যাই নি।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, স্কুলে যাও নি?
না। শুধু স্কুল কেন, কোথাও যাই নি। আমার পুরো জীবন কাটিয়েছি চার দেয়ালঘেরা একটুখানি জায়গার ভেতর।
কেন?
নায়ীরা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, কারণ, আমি একজন ক্লোন।
মানুষটি কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, ক্লোন?
হ্যাঁ।
কিন্তু, কিন্তু মানুষটি বিভ্রান্তের মতো বলল, আমাকে তো সেরকম কিছু বলে নি।
নায়ীরা আহত গলায় বলল, আমি দুঃখিত যে তোমাকে এটা আগে থেকে বলে দেয় নি। আমি সত্যিই দুঃখিত যে, টেহলিস শহরে সত্যিকার একজন মানুষ না নিয়ে তোমার একজন ক্লোনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
না-না-না, মানুষটি তীব্র গলায় বলল, আমি সে কথা বলছি না। পৃথিবীতে বহু আগে আইন করে ক্লোন তৈরি করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তা হলে তোমাকে কেন তৈরি করা হল?
আসলে আইনের ভেতর ফাঁকফোকর থাকে। সাধারণত ক্লোন তৈরি করা নিষেধ, কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য বিশেষ প্রয়োজনে বিজ্ঞান কেন্দ্রকে অনুমতি দেওয়া হয়।
যদি অনুমতি দেবে, তা হলে তাকে মানুষের মতো বেঁচে থাকতে দেবে না কেন? তাকে চার দেয়ালের মধ্যে আটক রাখবে কেন? স্কুলে যেতে দেবে না কেন-
নায়ীরা আবার জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি নিশ্চিত, বাইরের মানুষ যদি আমাদের কথা জানে তা হলে তারা ঠিক তোমার মতো কথা বলত। কিন্তু বাইরের মানুষ আমাদের কথা কোনোদিন জানবে না আমরা হচ্ছি অত্যন্ত গোপনীয় একটা প্রজেক্ট! তুমিও নিশ্চয়ই কোনোদিন আমাদের কথা বাইরে জানাতে পারবে না
মানুষটি হতচকিতের মতো মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলছ। আমাকে অঙ্গীকার করতে হয়েছে এখানকার কোনো তথ্য কখনো বাইরে জানাতে পারব না। কখনোই না।
নায়ীরা বলল, কাজেই আমাদের কথা বাইরের পৃথিবীর কেউ কখনো জানবে না।
আমি খুব দুঃখিত।
আমার নাম নায়ীরা।
আমি খুব দুঃখিত, নায়ীরা।
নায়ীরা হাসিমুখে বলল, তুমি আমার অনেকখানি দুঃখ দূর করে দিয়েছ।
কীভাবে তোমার দুঃখ দূর করেছি?
আমি এখানে এসেছি প্রায় এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে আমি সবাইকে বলেছি আমার নাম নায়ীরা, কিন্তু কেউ একটিবারও আমাকে আমার নাম ধরে সম্বোধন করে নি।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, কেন?
কারণ একজন ক্লোনের নাম থাকার কথা নয়। একটা ক্লোনের পরিচিতি হয় শুধু একটা সংখ্যা দিয়ে।
কী ভয়ংকর রকমের অমানবিক একটা নিয়ম।
বিচার-অবিচার বিষয়গুলো মানুষের জন্য। আমি মানুষ নই, আমি ক্লোন। একজন ক্লোন আর ল্যাবরেটরির গিনিপিগের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
মানুষটি কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাছে এসে তার পিঠে হাত রেখে বলল, আমি খুব দুঃখিত, নায়ীরা। আমার নিজেকে মনে হচ্ছে একটা দানব-
তোমার দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই- বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে নায়ীরা মানুষটির দিকে প্রশ্নভাবে তাকাল।
মানুষটি বলল, আমার নাম রিশি।
তোমার দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই রিশি।
আছে। নিশ্চয়ই আছে।
নায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, না, নেই। তুমি পুরো বিষয়টুকু দেখছ তোমার মতো করে। একজন মানুষের পক্ষ থেকে একজন মানুষ তার জীবনে যা কিছু পায় আমরা তার। কিছু পাই না, তোমাকে সেটা ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
রিশি মাথা নাড়ল, বলল, করবে না?
হয়তো করবে। কিন্তু পুরো বিষয়টা আমাদের পক্ষ থেকে দেখলে করবে না। জন্মের পরমুহূর্ত থেকে আমরা জানি, আমরা ক্লোন, আমাদের তৈরি করা হয়েছে ক্লোন গবেষণায় ব্যবহার করার জন্য। আমরা ধরেই নিয়েছি জন্ম হওয়ার পর একসময় আমাদের কেটেকুটে শেষ করে দেওয়া হবে। এর বাইরে আমরা যেটুকু পাই সেটাই আমাদের বাড়তি লাভ। সেটাই আমাদের জীবন।
রিশি মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু সেটা তো হতে পারে না।
কিন্তু সেটাই তো হচ্ছে। আমরা এটা মেনে নিয়েছি। আমি মনে করি, আমি অসম্ভব সৌভাগ্যবান একজন-একজন- নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একজন মানুষ। হ্যাঁ, মানুষ। ক্লোন শব্দটা আমি ব্যবহার করছি না।
কেন তুমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মানুষ ভাবছ?
কারণ টেহলিস শহরের দুর্গম অভিযানের সময় তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। তোমার সঙ্গে আমি সময় কাটাতে পারব। মানুষ মানুষের সঙ্গে যেভাবে কথা বলে আমি তোমার সঙ্গে সেভাবে কথা বলতে পারব। তুমি জান আমার জন্য সেটা কত বড় ব্যাপার?
রিশি কোনো কথা না বলে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল। নায়ীরা বলল, আমরা সারা জীবন এরকম একটা কিছুর স্বপ্ন দেখে এসেছি। আমার আরো দশটি বোন আছে, তারা তাদের জীবনে কী পাবে আমি জানি না, কিন্তু আমি অন্তত একজন মানুষের কাছ থেকে। মানুষের সম্মান পেয়েছি।
রিশি নিচু গলায় বলল, তোমাকে প্রথম যখন দেখেছি তখন ভেবেছি তুমি নিশ্চয়ই বাচ্চা একটি মেয়ে। বয়সে তুমি আসলেই বাচ্চা। কিন্তু তুমি একেবারে পরিণত মানুষের মতো কথা বলো।
নায়ীরা শব্দ করে হেসে বলল, চার দেয়ালের ভেতরে আটকা পড়ে থেকে আমরা বইপত্র পড়া ছাড়া আর কিছু করতে পারি না। আমার বয়সী একটা মেয়ের কী নিয়ে কীভাবে কথা বলতে হয় আমি জানি না। সেজন্য আমার কথা হয়তো তোমার কাছে অকালপকের কথার মতো মনে হচ্ছে।
রিশি মাথা নাড়ল, বলল, না। অকালপক্ব একটি জিনিস আর পরিণত মানুষ সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। তুমি অকালপক্কের মতো কথা বলো না, তুমি এই অল্পবয়সেই একেবারে পরিণত একজন মানুষের মতো কথা বলো।
নায়ীরা বলল, তার জন্য আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। যে মানুষটি থেকে আমাদের ক্লোন করা হয়েছে পুরো কৃতিত্ব তার। শুনেছি সে একজন অসাধারণ মহিলা ছিল। আমি যদি তার সম্পর্কে কিছু একটা জানতে পারতাম! আমার এত জানার ইচ্ছে করে।
চেষ্টা করেছ?
নায়ীরা হেসে ফেলল, বলল, তুমি বারবার ভুলে যাচ্ছ যে আমি একজন ক্লোন। আমি আমার পছন্দের একটি গান শোনার চেষ্টাটুকুও করতে পারি না।
রিশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত।
নায়ীরা বলল, আমি মোটও দুঃখিত নই। তোমার সঙ্গে খুব বড় একটা অ্যাডভেঞ্চারে যাব চিন্তা করেই আমার মনে হচ্ছে আমার ক্লোন হয়ে থাকার সব দুঃখ মুছে গেছে।
রিশি কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
রিশির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর হঠাৎ করে নায়ীরার জীবনটুকু অন্যরকম হয়ে গেল। এত দিন বিজ্ঞান কেন্দ্রে তাকে তুচ্ছ একজন ক্লোন হিসেবে দেখা হয়েছে। হঠাৎ করে রিশি তাকে পুরোপুরি একজন মানুষ হিসেবে দেখছে। রিশির তুলনায় সে একটি বাচ্চা শিশু ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু রিশি তাকে কখনোই ছোট শিশু হিসেবে দেখছে না। প্রত্যেকটা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে, পরামর্শ করছে। নারীরা প্রথম প্রথম ভেবেছিল, রিশি বুঝি তাকে। একটু খুশি করানোর জন্য এগুলো করেছে, কিন্তু কয়েক দিনের ভেতরেই বুঝে গেল, সে সত্যি সত্যি তার সাহায্য চাইছে। টেহলিস শহরের ভ্রমণটুকু শুরু হবে একটা পার্বত্য অঞ্চল থেকে। সেই পার্বত্য অঞ্চলের একটা বড় অংশ তাদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে। উঁচু একটা পাহাড়ে একটা গ্লাইডার রাখা থাকবে। সেই গ্লাইডারে করে দুজন অবমানবের এলাকার ওপর দিয়ে ভেসে যাবে। সত্যিকারের একটা প্লেনে না গিয়ে গ্লাইডারে কেন যেতে হবে নায়ীরা সেটা বুঝতে পারছিল না। ফ্লাইট কো-অর্ডিনেটরকে জিজ্ঞেস করার পর মানুষটি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, প্লেনে কেমন করে যাবে? নিচে পুরো এলাকাটাতে অবমানবরা থাকে। তারা যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। ভয়ংকর সব। অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্লেন রাডারে ধরা পড়া মাত্রই মিসাইল ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, গ্লাইডারকে ফেলবে না?
কীভাবে ফেলবে? গ্লাইডার যেসব হালকা জিনিস দিয়ে তৈরি হয় সেগুলো রাডারে ধরা পড়ে না।
দেখতেও পাবে না?
না। বছরের এই সময়ে এলাকায় মেঘ থাকে। মেঘের ওপর দিয়ে গ্লাইডার উড়ে যাবে, অবমানবরা টের পাবে না।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু গ্লাইডার তো আকাশে বেশি সময় ভেসে থাকতে পারবে না। কখনো না কখনো নিচে নেমে আসবে।
ফ্লাইট কো-অর্ডিনেটর মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আমরা একটু উষ্ণ বাতাসের প্রবাহের জন্য অপেক্ষা করছি। সেটা এলে বড় একটা এলাকায় বাতাস উপরে উঠে আসবে। তার উপর ভর করে অনেক দূর চলে যাওয়া যাবে।
সেটা কত দূর?
আমরা এখনো জানি না। রিশি একজন প্রথম শ্রেণীর গ্লাইডার পাইলট, আমাদের ধারণা সে অনায়াসে সাত-আট শ কিলোমিটার উড়িয়ে নিতে পারবে।
তারপর?
তারপরের অংশটুকু দুর্গম। দুর্গম বলে অবমানবের বসতিও কম। তোমাদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে। কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামিও না, রিশি ব্যাপারটি দেখবে।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু আমিও একটু ধারণা করতে চাই।
হঠাৎ করে ফ্লাইট কো-অর্ডিনেটরের মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে গেল। সে কঠিন গলায় বলল, যেসব বিষয়ে তোমার ধারণা থাকার কথা শুধু সেসব বিষয়ে তোমাকে ধারণা দেওয়া হবে। অহেতুক কৌতূহল দেখিয়ে কোনো লাভ নেই মেয়ে।
নায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল।
রিশির কাছে এরকম কোনো সমস্যা নেই। যে কোনো বিষয়ে নারীরা তাকে প্রশ্ন করতে পারে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রিশি এই প্রশ্নের উত্তর দেয়। গ্লাইডারে করে তারা কত দূর যেতে। পারবে নায়ীরা একদিন রিশির কাছে জানতে চাইল। রিশি চিন্তিত মুখে বলল, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। আমাকে বাতাসের প্রবাহের যে ম্যাপ দিয়েছে তার থেকে অনুমান করতে পারি যে, ছয় থেকে সাত শ কিলোমিটার যেতে পারবে।
বাকিটুকু? বাকিটুকু কেমন করে যাব?
রিশি হেসে বলল, হেঁটে!
হেঁটে?
হ্যাঁ। গোপনে যেতে হলে হেঁটে না গিয়ে লাভ নেই।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু পুরোটুকু তো হেঁটে যেতে পারবে না। শেষ অংশটুকুতে জলাভূমি রয়েছে। সেখানে?
রিশি ঠাট্টা করে বলল, কেন, সাঁতরে যাবে? তুমি সাঁতার জান না? না
য়ীরা মাথা নেড়ে বলল, ঠাট্টা করো না। সত্যি করে বলো।
রিশি তখন গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা সেই অংশটুকু কীভাবে যাব সেটি নিয়ে এখন আলাপ করছি। ওপর থেকে নানারকম পরিকল্পনা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু পরিকল্পনাগুলো বেশিরভাগ সময়ে খুব দুর্বল।
দুর্বল?
হ্যাঁ।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, আচ্ছা রিশি, এমন কি হতে পারে যে শেষ অংশটুকুর আসলে কোনো পরিকল্পনা নেই?
রিশি অবাক হয়ে বলল, পরিকল্পনা নেই?
না।
কেন থাকবে না?
কারণ সেখানে পৌঁছানোর আগেই কিছু একটা হবে।
রিশি ভুরু কুঁচকে বলল, কিছু একটা হবে? কী হবে?
আমরা মারা পড়ব। নিশ্চিতভাবে মারা পড়ব।
কেমন করে মারা পড়ব? কেন মারা পড়ব?
নায়ীরা বলল, সেটা আমি জানি না। কিন্তু যারা আমাদের পাঠাচ্ছে তারা সেটা জানে।
রিশি কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, এরকম অদ্ভুত একটি বিষয় তোমার মাথায় কেমন করে এল?
নায়ীরা একটু লজ্জা পেয়ে যায়, মাথা নিচু করে বলল, আমি দুঃখিত রিশি যে বিজ্ঞান কেন্দ্রের এত বড় বড় মানুষকে নিয়ে আমি সন্দেহ করছি। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি কেন জানি হিসাব মেলাতে পারছি না। তারা বলেছে, আমার মস্তিষ্কে করে একটি গোপন তথ্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু সেটি তো সত্যি হতে পারে না। পারে?
রিশি বলল, আমি সেটা জানি না।
নায়ীরা বলল, আমি তাদের সেটা জিজ্ঞেস করেছি, তারা ঠিক উত্তর দিতে পারে নি।
রিশি বলল, হয়তো তারা এর উত্তর জানে না।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু তারা আমার কাছে মিথ্যা কথা বলেছে।
মিথ্যা কথা বলেছে?
হ্যাঁ, নায়ীরা বলল, কেউ মিথ্যা কথা বললে আমি কেমন করে জানি টের পেয়ে যাই।
সেটি কেমন করে হতে পারে?
আমি জানি না। আমি আমাদের ক্লোন করা বোনদের সঙ্গে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা কাটাতাম। তাদের কথা বলার একটা ধরন আছে, সেটা আমরা জানি। আমাদের কখনোই একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিথ্যা বলতে হত না। তাই সত্যি কথা বলার ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক। মিথ্যে বললেই অস্বাভাবিক মনে হয়।
রিশি ঘুরে ভালো করে নায়ীরার দিকে তাকাল। মনে হল তাকে ভালো করে একবার দেখল। তারপর বলল, আমি কি কখনো তোমার সঙ্গে মিথ্যা বলেছি?
নায়ীরা হেসে ফেলল, বলল, না। সেজন্য তোমার ওপর আমি নির্ভর করি। তা ছাড়া-
তা ছাড়া কী?
তুমি মিথ্যা বলতে পার না। তাই তুমি যখন মিথ্যা বলার চেষ্টা কর, তখন সবাই সেটা বুঝে ফেলে।
রিশি ভুরু কুঁচকে বলল, সত্যি? আমি কি কখনো চেষ্টা করেছি?
হ্যাঁ। নায়ীরা মুখ টিপে হেসে বলল, কদিন আগে একবার চেষ্টা করেছিলে। টেবিল থেকে কী একটা জিনিস তুলে খুব যত্ন করে একটা কাগজে ভাঁজ করে রাখছিলে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী তুলছ? তখন তুমি চমকে উঠে আমতা-আমতা করে বললে, না মানে ইয়ে একটা বিচিত্র পোকা। মনে আছে?
রিশির মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, হ্যাঁ, মনে আছে।
নায়ীরা বলল, সেটা পোকা ছিল না। সেটা অন্য কিছু ছিল। তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছিলে! কিন্তু সেটা অন্যরকম মিথ্যা। তার মধ্যে কোনো অন্যায় ছিল না।
রিশি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ নায়ীরা। তুমি অসাধারণ একটি মেয়ে।
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি কিন্তু অসাধারণ মেয়ে হতে চাই নি। খুব সহজ সাধারণ একটি মেয়ে হতে চেয়েছিলাম।
যা-ই হোক, তুমি কি জানতে চাও, আমি সেদিন টেবিল থেকে কী তুলেছিলাম?
না। তুমি যেহেতু বলতে চাও নি, আমি সেটা জানতে চাই না।
ঠিক আছে।
তা ছাড়া আমি অনুমান করতে পারি তুমি কী তুলেছিলে এবং কেন তুলেছিলে, তাই জানার প্রয়োজনও নেই।
রিশি চোখ বড় বড় করে নায়ীরার দিকে তাকাল। নায়ীরা বলল, পুরো ব্যাপারটা করেছ আমার জন্য, আমার ভালোর জন্য। তাই আমি এখন না জানলেও কোনো ক্ষতি নেই। একসময় আমি জানব। কারণ তুমি আমাকে জানাবে।
রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, নায়ীরা, তুমি একটি অসাধারণ এবং এবটি বিচিত্র মেয়ে।
নায়ীরা বলল, আমি যদি অন্য দশজন মানুষের মতো বড় হতে পারতাম তা হলে হয়তো বিচিত্র হতাম না।
একটু আগে তুমি যে বিষয়টা বলেছ সেটা অন্য কেউ বললে আমি একেবারেই গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু যেহেতু তুমি বলছ, আমি গুরুত্ব দিচ্ছি। তুমি নিশ্চিত থাক নায়ীরা, আমরা রওনা দেওয়ার পর কীভাবে যাব তার পুরোটুকু আমি ঠিক করে নেব। তোমাকে আমি সুস্থ দেহে টেহলিস শহরে পৌঁছে দেব।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
বিজ্ঞান কেন্দ্র যদি সত্যি সত্যি তোমাকে আর আমাকে মাঝপথে মেরে ফেলার চেষ্টা করে, আমি সেটা হতে দেব না। আমি তোমাকে রক্ষা করব।
আমি জানি, তুমি আমাকে রক্ষা করবে।
সত্যি সত্যি কেউ যদি তোমাকে হত্যা করতে চায়, তুমি জেনে রাখ নায়ীরা, তোমাকে হত্যা করার আগে আমাকে হত্যা করতে হবে।
ঠিক কী কারণ জানা নেই নায়ীরা হঠাৎ মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, বলল, কেউ যদি আমাকে এখন মেরেও ফেলে তবুও আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।
রিশি এগিয়ে এসে নায়ীরাকে শক্ত করে বলল, কেউ তোমাকে মেরে ফেলতে পারবে না, নায়ীরা। কেউ না।
.
ইঞ্জিনটা থামার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে রিশি নেমে আসে। বাইরে অন্ধকার, আকাশে বড় একটা চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলোয় পুরো এলাকাটাকে একটা অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্যের মতো মনে হচ্ছে। পাহাড়ের শীতল ও সতেজ বাতাসে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে রিশি নায়ীরাকে ডাকল, নায়ীরা, নেমে এস।
নায়ীরা তার ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে নিচে নেমে এল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, কী সুন্দর।
হ্যাঁ। রিশি বলল, দিনের আলোতে জায়গাটা আরো সুন্দর দেখাবে।
গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে একজন বলল, আমি তা হলে যাই?
রিশি বলল, যাও।
মানুষটি বলল, তোমাদের জন্য শুভকামনা।
ধন্যবাদ।
গাড়িটি গর্জন করে উঠে ঘুরে পাহাড়ি পথ দিয়ে নেমে যেতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বহুদূরে হেডলাইটের আলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল। রিশি আবছা অন্ধকারে নায়ীরার দিকে তাকাল। বলল, আমাদের দ্রুত এখান থেকে সরে যাওয়া উচিত।
কেন?
গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনে যদি কোনো অবমানব এসে পড়ে!
নায়ীরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, এটি কি অবমানবের এলাকা?
না, কিন্তু এরা খুব দুধর্ষ। মাঝে মাঝেই পার্বত্য এলাকায় হানা দেয় বলে শুনেছি।
নায়ীরা বলল, চল, তা হলে সরে যাই।
হ্যাঁ, চল।
দুজন তাদের কাঁধে ব্যাকপ্যাক তুলে নেয়। রিশি একবার আকাশের দিকে তাকায়, তারপর পকেট থেকে জি.পি.এস. বের করে কোনদিকে যেতে হবে ঠিক করে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। তার থেকে কয়েক পা পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে নায়ীরা বলল, আমাদের কতদূর যেতে হবে?
দূরত্বের হিসাবে খুব বেশি নয়, কিন্তু পাহাড়ি এলাকা। কখনো উপরে উঠতে হবে আবার কখনো নিচে নামতে হবে। রাস্তা নেই-ঝোঁপঝাড়, বনজঙ্গল ভেঙে হাঁটতে হবে, তাই সারা রাত লেগে যেতে পারে।
সারা রাত?
হ্যাঁ। রাতের মধ্যেই পৌঁছে যেতে চাই। পারবে না?
পারব।
চমৎকার।
দুজনই চোখে নাইটভিশন গগলস লাগিয়ে নিয়েছে। সেই গগলসে পুরো এলাকাটাকে অলৌকিক একটা জগতের মতো মনে হয়। চারপাশে ঝোপঝাড়, বড় বড় গাছ। দূরে হঠাৎ হঠাৎ কোনো রাতজাগা প্রাণী দেখা যায়। মানুষের পায়ের শব্দ শুনে ছুটে পালিয়ে গিয়ে দূর থেকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, এখানে কি বড় কোনো বন্য প্রাণী আছে?
আছে। পাহাড়ি চিতা আর ভালুক।
তারা আমাদের আক্রমণ করবে না তো?
করার কথা নয়। বনের প্রাণী মানুষকে ভয় পায়। আর যদি কাছাকাছি আসে তুমি অনেক আগেই দেখতে পাবে।
তা ঠিক।
দুজনে আবার নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। রিশি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, নায়ীরা, তোমার সমস্যা হচ্ছে না তো?
না। হচ্ছে না।
হলে বলো।
বলব।
মানুষের শরীর খুব বিচিত্র জিনিস, তাকে দিয়ে যে কত পরিশ্রম করানো যায়, সেটি অবিশ্বাস্য।
ঠিকই বলেছ।
রিশি হালকা কথাবার্তা বলতে বলতে হঠাৎ বলল, নায়ীরা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কর।
তোমাকে মাঝে মাঝেই খুব আনমনা দেখি। কী ভাব তখন?
আমার ভাবার খুব বেশি কিছু নেই। আমার সঙ্গে যাদের ক্লোন করা হয়েছিল তারা ছাড়া আমার আপনজন কেউ নেই। আমি তাদের কথা ভুলতে পারি না। ঘুরেফিরে আমার শুধু তাদের কথা মনে হয়।
রিশি নরম গলায় বলল, খুবই স্বাভাবিক। আমি তোমার বুকের ভেতরকার যন্ত্রণাটা বুঝতেই পারছি।
পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে নায়ীরা বলল, না, রিশি। তোমরা সেই যন্ত্রণাটুকু বুঝতে পারবে না। প্রথমে আমরা ছিলাম উনিশ জন। একজন একজন করে সরিয়ে নেয়ার পর হয়েছি এগার জন। শেষ কত দিন এই এগার জন মিলে ছিলাম একটা পরিপূর্ণ অস্তিত্ব। তার মধ্যে থেকে একজনকে সরিয়ে নেওয়া হলে তার পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন।
আমি দুঃখিত, নায়ীরা।
নায়ীরা বলল, আমি প্রতি মুহূর্তে অন্যদের কথা ভাবতে থাকি। আমার মনে হয় তাদের সবাইকে একটিবার স্পর্শ করার জন্য আমি আমার পুরো জীবনটুকু দিয়ে দিতে পারব।
রিশি দ্বিতীয়বার বলল, আমি সত্যিই দুঃখিত, নায়ীরা।
.
রিশি এবং নায়ীরা যখন তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছায় তখন পুব আকাশ আলো হতে শুরু করেছে। পাহাড়ের চূড়ায় বিশাল পাখির মতো ডানা মেলে একটা গ্লাইডার শুয়ে আছে। তার পাশে বসে দুজন তাদের পিঠ থেকে বোঝা নামিয়ে নেয়। দুজনে ক্লান্ত দেহে বড় পাথরে হেলান দিয়ে বসে লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিতে থাকে। রিশি নায়ীরার দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লাগছে তোমার?
ভালো। চারদিকে তাকাতে তাকাতে নায়ীরা বলল, আমি প্রকৃতির এত সুন্দর রূপ আগে কখনো দেখি নি। শুধু মনে হচ্ছে
কী মনে হচ্ছে?
মনে হচ্ছে আমার অন্য বোনগুলোকেও যদি কোনোভাবে এখানে আনতে পারতাম তা হলে কী মজাটাই না হত।
রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। নায়ীরা তার ব্যাকপ্যাকে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে বলল, আমরা কখন রওনা দেব রিশি?
রিশি পাহাড়ের পাদদেশে ঘন জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা অবমানবদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। দিনের আলোয় বের হতে চাইছি না। অন্ধকার হওয়ার পর গ্লাইডারটি ভাসিয়ে দেব।
তা হলে আমি এখন একটু বিশ্রাম নিতে পারি?
হ্যাঁ নায়ীরা, পার।
ঠিক আছে, আমি তা হলে একটু ঘুমিয়ে নিই।
ঘুমাও। আমি পাহারায় থাকব।
নায়ীরা গুটিসুটি মেরে শুয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। এই দীর্ঘ পথ বিশাল বোঝ টেনে এনে মেয়েটি সত্যি সত্যি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রিশি একটা পাথরে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে বসে থাকে। খুব ধীরে ধীরে চারদিক আলোকিত হয়ে উঠছে। ভোরের প্রথম আলোতে একটা পাহাড়ের চূড়ায় বিশাল একটা গ্লাইডারের পাখার নিচে গুটিসুটি মেরে একটি কিশোরী ঘুমিয়ে আছে। দৃশ্যটি অন্যরকম। রিশি তাকিয়ে থাকে, তার মনে হতে থাকে এটি আসলে ঘটছে না, এটি কল্পনার একটি দৃশ্য। ভালো করে তাকালেই দেখবে আসলে এটি এখানে নেই।
.
নায়ীরা যখন ঘুম থেকে উঠেছে তখন সূর্য অনেক ওপরে উঠে গেছে। পাহাড়ের চূড়ায় এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা।
কাছাকাছি রিশি যেখানে বসেছিল সেখানেই চুপচাপ বসে আছে। নায়ীরাকে জেগে উঠতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ঘুম হল?
হ্যাঁ, এভাবে আগে কখনো ঘুমাই নি।
এভাবে নিশ্চয়ই আগে কখনো ক্লান্তও হও নি।
তুমি একটু বিশ্রাম নেবে না?
নিয়েছি। নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, কখন নিয়েছ? তুমি তো এখানেই সারাক্ষণ বসে আছ।
রিশি হেসে বলল, এটাই আমার বিশ্রাম। আমার অভ্যাস আছে। যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এস, কিছু একটা খাই।
হ্যাঁ, খিদে পেয়েছে।
পাহাড়ের বাতাস খুব সতেজ। এই বাতাসে নিশ্বাস নিলে এমনিতেই খিদে পায়। যাও, দেরি করো না।
খাবারের আয়োজনটুকু ছিল সহজ। এলুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়ানো যবের রুটি, কিছু প্রোটিন আর গরম কফি। খাওয়া শেষ করে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে রিশি বলল, জীবনটা যদি এখানে থেমে যেত, মন্দ হত না। কী বলো?
নায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল হ্যাঁ। চারপাশে এত সুন্দর যে চোখ জুড়িয়ে যায়। আমার কী মনে হচ্ছে জান?
কী?
আমরা যেটাকে সভ্যতা বলছি, সেটা ঠিকভাবে অগ্রসর হয় নি।
কেন? রিশি চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, এরকম একটা কথা মনে হওয়ার কী কারণ?
মানুষ নিশ্চয়ই একসময় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকত। এখন প্রকৃতিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঘোট ঘোট ঘুপচির ভেতরে থাকে। চার দেয়ালের ভেতরে থাকে। সূর্যের আলো বন্ধ করে নিজেরা আলো তৈরি করে। যখন অন্ধকার থাকার কথা, তখনো আলো জ্বেলে রাখে।
রিশি হেসে ফেলল, বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমার কী মনে হয় জান?
কী?
মানুষ নিশ্চয়ই আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যাবে।
নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি একটা জিনিস কখনো বুঝতে পারি নি।
সেটা কী?
মানুষে মানুষে যুদ্ধ করে কেন?
সেটা শুধু তুমি নও, কেউ বুঝতে পারে না।
নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আগে পৃথিবীতে ছিল শুধু মানুষ। এখন নিজেরা নিজেরা দুই ভাগ হয়ে গেছে, মানব আর অবমানব! একজন আরেকজনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। ভবিষ্যতে কি আরো ভাগ হবে, আরো বেশি যুদ্ধ করবে?
রিশি মাথা নাড়ল, বলল, তোমার এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না নায়ীরা। আমার ধারণা, কেউই জানে না।
দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে কফির মগে চুমুক দেয়। পাথরে হেলান দিয়ে দূরে তাকায়। ঘন সবুজ বনে দূর প্রান্তর ঢেকে আছে। সেখানে ভয়ংকর অবমানবরা ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
রিশি কফির মগটি নিচে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। বলল, এস নায়ীরা, আমরা গ্লাইডারটা প্রস্তুত করি।
নায়ীরা উঠে দাঁড়াল। গ্লাইডারটা বিশাল একটা সাদা পাখির মতো দুটো পাখা ছড়িয়ে রেখেছে। হালকা ফাইবার গ্লাসের কাঠামোর ওপর পাতলা পলিমারের আবরণ। পাহাড়ের চূড়ার দমকা হাওয়ায় যেন উঠে চলে না যায় সেজন্য পাথরের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। রিশি পুরো গ্লাইডারটা ভালো করে পরীক্ষা করে সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে বলল, চমৎকার জিনিস। এর মধ্যে কোনো ফঁকিঝুঁকি নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীর একেবারে সেরা ইঞ্জিনিয়াররা তৈরি করেছে।
নায়ীরা গ্লাইডারটার ওপরে হাত বুলিয়ে বলল, এত হালকা একটা জিনিস আমাদের দুজনকে নিতে পারবে?
শুধু আমাদের দুজনকে নয়, আমাদের জিনিসপত্র, খাবারদাবার সবকিছু নিতে পারবে। রিশি গ্লাইডারের সামনে ছোট ককপিটটা দেখিয়ে বলল, এখানে বসব আমি, আমার সামনে কন্ট্রোল প্যানেল। আর তুমি বসবে পেছনে।
নায়ীরা পেছনের ছোট ককপিটটা ভালো করে দেখল। ছোট হলেও সে বেশ আরাম করেই বসতে পারবে। দুজনের মাঝখানের অংশটুকু তাদের খাবারদাবার, জিনিসপত্র রাখার জন্য।
রিশি তার ব্যাগ খুলে জিনিসপত্র বের করে গ্লাইডারে তুলতে থাকে। নায়ীরাও তার ব্যাগ খুলে নেয়। শুকনো খাবার, পানি, কিছু জ্বালানি, গরম কাপড়, স্লিপিং ব্যাগ বের করে সাজিয়ে রাখতে থাকে। সবকিছু রাখার পর রিশি ঢাকনাটা বন্ধ করে আবার সন্তুষ্টির মতো শব্দ করল। বলল, আমাদের কাজ শেষ। এখন শুধু অন্ধকার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা। অন্ধকার হলেই রওনা দিতে পারব।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, আমাকে বলেছিলে একটা উষ্ণ বাতাসের প্রবাহ শুরু হবে, সেটা কি শুরু হয়েছে?
গোপনীয়তার জন্য আমাদের কাছে কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। শর্টওয়েভ রেডিওতে আবহাওয়ার খবর শুনে অনুমান করতে হবে।
সেটা শুনবে না?
শুনব। গ্লাইডার ভাসিয়ে দেওয়ার পর শুনব। রেডিওটা আছে ককপিটে। রিশি দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের এখন আর কিছু করার নেই। চল জায়গাটা একটু ঘুরে দেখি।
চল। নায়ীরা উঠে দাঁড়াল। বলল, এরকম একটা সুযোগ পাব, আমি কখনো ভাবি নি।
একটা ঝরনাধারার মতো শব্দ শুনছি। চল দেখি, জায়গাটা খুঁজে পাই কি না।
আবার হারিয়ে যাব না তো?
না। হারাব না। জি.পি.এস. আবিষ্কারের পর পৃথিবী থেকে কেউ কখনো হারিয়ে যায় নি।
ঝরনাটি খুঁজে বের করতে তাদের ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। পাহাড়ের ওপর থেকে বিশাল একটি জলধারা নিচে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে। চারপাশে ভেজা কুয়াশার মতো পানির কণা, নিচে ঘন বৃক্ষরাজি। বড় একটা গ্রানাইট পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে দুজন ঝরনাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। রিশি বলল, কী সুন্দর!
একটি সুন্দর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে নায়ীরা প্রতিবারই উচ্ছাস প্রকাশ করেছে। এবারে এত সুন্দর একটি দৃশ্য দেখেও রিশির কথার প্রতিধ্বনি তুলে নায়ীরা কিছু বলল না দেখে রিশি একটু অবাক হয়ে ঘুরে নায়ীরার দিকে তাকাল। নায়ীরা এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ-মুখ লালচে এবং মনে হল সে অল্প অল্প কাঁপছে। রিশি অবাক হয়ে বলল, নায়ীরা, তোমার কী হয়েছে?
নায়ীরা বলল, বুঝতে পারছি না। কেমন যেন শীত করছে। রিশি নায়ীরাকে স্পর্শ করে চমকে উঠল, শরীর উত্তপ্ত, যেন পুড়ে যাচ্ছে। বলল, সে কী? তোমার তো দেখি অনেক জ্বর। কখন জ্বর উঠেছে?
আমি জানি না। এই একটু আগে থেকে শরীর খারাপ লাগতে শুরু করেছে।
রিশি নায়ীরাকে একটা পাথরের ওপর হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। বলল, তুমি এখানে বস। দেখি, কী করা যায়।
ছোটখাটো অসুখের জন্য তাদের কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র আছে, কিন্তু সঙ্গে করে কিছু নিয়ে আসে নি। রিশি নায়ীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, দেখা যাক, জ্বরটা কতটুকু ওঠে। যদি বেশি ওঠে আমি তোমার জন্য ওপর থেকে ওষুধ নিয়ে আসব।
না, না-, নায়ীরা কাতর গলায় বলল, আমাকে একা ফেলে রেখে যেও না।
রিশি নায়ীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমি যাব না। যদি দেখি তোমার খুব বেশি জ্বর উঠে গেছে তা হলে তোমাকে পাঁজাকোলা করে ওপরে নিয়ে যাব।
নায়ীরা রিশির কথা ঠিক বুঝতে পারল বলে মনে হল না। সে শূন্যদৃষ্টিতে রিশির দিকে। তাকিয়ে রইল। তার চোখ ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ হয়ে উঠছে, ঠোঁটগুলো শুকনো এবং কেমন যেন নীল হয়ে আসছে। নায়ীরা থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। রিশি নিজের জ্যাকেটটা খুলে নায়ীরার শরীরকে ঢেকে দিয়ে তাকে শক্ত করে ধরে রাখে। নায়ীরা চাপা গলায় বিড়বিড় করে কিছু বলল, রিশি ঠিক বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, কী বলছ নায়ীরা?
নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, আমাকে মেরে ফেলবে।
কে তোমাকে মেরে ফেলবে?
সবাই মিলে। নায়ীরা শূন্যদৃষ্টিতে রিশির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার শরীরে ওরা বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
নায়ীরা জ্বরের ঘোরে কথা বলছে, তবুও রিশি কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করল। বলল, কেমন করে বিষ ঢুকিয়েছে?
আমাকে অচেতন করে আমার বাম হাতের শিরার ভেতরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি জানি।
তুমি সেটা নিয়ে চিন্তা করো না নায়ীরা। আমি তোমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করব।
নায়ীরা বিড়বিড় করে বলল, গত পনের বছরে আমার কখনো অসুখ করে নি। আমার কেন এখন অসুখ হল? কেন?
রিশি নায়ীরাকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, এটা হয় নায়ীরা। সব মানুষের ছোট বড় অসুখ হয়। হতে হয়।
নায়ীরা বিড়বিড় করে বলল, আমাকে মেরে ফেলবে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। তারপর হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে রিশির ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল।
রিশি সাবধানে নায়ীরাকে পাথরের ওপর শুইয়ে দিয়ে ঝরনা থেকে আঁজলা করে পানি নিয়ে এসে ভেজা কাপড় দিয়ে তার মুখ, হাত-পা মুছে দেয়। তার নাড়ি, নিশ্বাস স্বাভাবিক। জ্বরটুকু কমিয়ে দিতে পারলেই কোনো বিপদের ঝুঁকি থাকে না। কিন্তু রিশি কিছুই করতে পারছে না। সে নায়ীরার হাত ধরে বসে রইল।
ধীরে ধীরে নায়ীরার জ্বর আরো বাড়তে থাকে। ছটফট করতে করতে কাতর গলায় তার বোনদের ডাকতে থাকে সে। আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে। তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। একসময় শরীরে অপ্রতিরোধ্য এক ধনের খিঁচুনি শুরু হয়ে যায়। রিশি নায়ীরাকে শক্ত করে ধরে রেখে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, নায়ীরা একটু সহ্য কর। একটু সহ্য কর, সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখো, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে-সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
সমস্ত শরীরে খিচুনি দিতে দিতে একসময় হঠাৎ নায়ীরার শরীর অবশ হয়ে এলিয়ে পড়ে। রিশি তার হৃৎস্পন্দন, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের গতি পরীক্ষা করে দেখে, তার সারা শরীর ঘামতে শুরু করেছে। নায়ীরার ওপর থেকে রিশি নিজের জ্যাকেটটি সরিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জ্বর নামতে শুরু করে। রিশি নায়ীরার মাথার কাছে বসে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে।
ঘণ্টাখানেক পর নায়ীরা চোখ মেলে তাকাল। রিশি তার ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন লাগছে নায়ীরা?
নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, ভালো।
চমৎকার। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। রিশি জিজ্ঞেস করল, তোমার কি আগে কখনো এরকম জ্বর উঠেছিল?
না।
জ্বরের ঘোরে তুমি তোমার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়ার কথা বলছিলে। কথাটা কি তোমার মনে আছে?
নায়ীরা মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, মনে আছে।
কেন বলছিলে সেটা?
নায়ীরা তার বাম হাত বের করে একটা লাল বিল্টুকে দেখিয়ে বলল, এই যে এখানে দেখ। এখান দিয়ে তারা আমার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
রিশি বিন্দুটা ভালো করে পরীক্ষা করল। সেখানে একটা সুচ ঢুকানো হয়েছিল, এত দিন পরেও সেটা বোঝা যাচ্ছে।
রিশি বলল, তোমার শরীরে কেন বিষ ঢোকাবে?
আমি জানি না।
রিশি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি অসুস্থ। তুমি কি টেহলিস শহরের যাত্রা শুরু করতে চাও? নাকি আমরা ফিরে যাব?
না। নায়ীরা মাথা নাড়ল, আমি ফিরে যেতে চাই না। তা ছাড়া-
তা ছাড়া কী?
আমার এখন নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছে না।
নায়ীরা উঠে দাঁড়াল। ঝরনার জলধারার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ইস! কী। সুন্দর।
রিশি বলল, আমাদের এখন যেতে হবে নায়ীরা।
চল যাই।
দুজন পাথরে পা রেখে হাঁটতে হাঁটতে ওপরে উঠতে থাকে। রিশি পকেট থেকে তার ঘোট ইলেকট্রনিক ডায়েরিটা বের করল। তাকে কখন কী করতে হবে সেখানে লেখা আছে। বিকেল পঁচটা তিরিশ মিনিট : গ্লাইডারে উড্ডয়ন। তার নিচে ছোট ছোট করে লেখা : গোপনীয়; অপরায়ু বা বিকেলে নায়ীরার সমস্ত শরীরে খিচুনি দিয়ে প্রচণ্ড জ্বর উঠতে পারে। এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কোনোভাবেই টেহলিস শহরের অভিযান বন্ধ করা যাবে না।
রিশি নিঃশব্দে তার ইলেকট্রনিক ডায়েরিটা বন্ধ করে পকেটে রেখে দেয়। নায়ীরার সন্দেহটি তা হলে আসলেই সত্যি?