৪. গগন সাঁপুইয়ের বাড়ির পেছন দিকে

গগন সাঁপুইয়ের বাড়ির পেছন দিকে চেঁকিঘরের দাওয়ায় দুটি লোক উবু হয়ে বসা। দুজনেরই বেশ মজবুত কালো চেহারা। গগন সামনেই দাঁড়িয়ে। বসা লোক দুটোর একজন কালু, অন্যজন পীতাম্বর। কালু কথাটথা বেশি বলে না। ভ্যাজর ভ্যাজর করা তার আসে না। সে হল কাজের লোক। তবে পীতাম্বর বেশ বলিয়ে কইয়ে মানুষ। পীতাম্বরের সঙ্গে গগনের একটু দরাদরি হচ্ছিল।

পীতাম্বর বলল, “রেটটা কি খুব বেশি মনে হচ্ছে গগনবাবু? বাজারের অবস্থা তো দেখছেন! কোন জিনিসটার দর এক জায়গায় পড়ে আছে বলতে পারেন? চাল, ডাল, নুন, তেল, আটা-ময়দা, জামা কাপড় সব কিছুর দুরই তো ঠেলে উঠছে! আমরাই বা তা হলে পুরনো রেটে কী করে কাজ করি বলুন?”

গগন একগাল হেসে বলে, “ওরে বাবা, এ তো আর খুনখারাপি নয় যে, দেড়শো টাকা হাঁকছিস। একটা পাজি লোককে একটু শুধু কড়কে দেওয়া, আর আলতো হাতে দু-চারটে চড়-চাপড় মারা। ধরলাম না হয়, মুখে যেসব বাক্যি বলবি তার জন্য পাঁচটা টাকাই নিলি। আর চড়চাপড় ধর, টাকায় একটা করে। কিছু কম রেট হল? ধর, যদি দশটা চড়ই কষাস তা হলে হল দশ টাকা, আর বকাঝকা চোখ রাঙানোর জন্য পাঁচ টাকা। তার ওপর না হয় আরও পাঁচটা টাকাই বখশিস বলে দিচ্ছি। একুনে কুড়ি টাকা।”

পীতাম্বর হা-হা করে হেসে বলে, “এ তো সেই সত্যযুগের রেট বলছেন কতা। টাকায় একটা চড় কি পোষায় বলুন! আর ধমক-চমক তো এমন হওয়া চাই, যাতে লোকটার পিলে চমকে যায়। তা সেরকম ধমক-চমক চোখ রাঙানোর জন্য দরটাও একটু বেশি দিতে হবে বইকী! তার ওপর লোকটা আবার কাপালিক, মারণ-উচাটন জানে, বাণ-টান মারতে পারে। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি মশাই, অত অল্প রেটে কাজ করতে গিয়ে কাপালিককে চটাতে পারব না।”

গগন শশব্যস্তে বলে, “ওরে না না। সে মোটে কাপালিকই নয়। এক নম্বরের ভণ্ড। এইটুকু বয়স থেকে চিনি। মারণ-উচাটন জানলে কবে এ-গাঁ শ্মশান করে ছেড়ে দিত। এসব নয় রে বাবা। তবে লোকটা পাজি। আমি বাবা নিরীহ মানুষ, তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারব না। সে আমার গোরুর দুধ চায়, তার মায়ের বানে মন্দির তুলে দিতে বলে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চিরকালই হয়ে আসছে, নতুন কথা কী? শোষণ, উৎপীড়ন, নির্যাতন–এসব আর কতদিন সহ্য করা যায় বল তো! দে বাবা, একটা অসহায় লোককে একটা শয়তানের হাত থেকে বাঁচিয়ে দে। ভগবান তোদের মঙ্গল করবেন। কুড়ি না হয়, ওই পঁচিশই দেব। দশটা চড়ের দরকার নেই, গোটা দুই কম দিলেও হবে। তবে দাঁত কড়মড় করে চোখ পাকিয়ে হুমকিটা ভালরকম দেওয়া চাই। ওই সেবার ভট্ট কোম্পানির ‘রাবণবধে রাবণ যেমনধারা হনুমানকে দেখে করেছিল। দেখিসনি বুঝি? সে একেবারে রক্তজল করা জিনিস।”

পীতাম্বর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলে, “ভাল জিনিসের জন্য একটু উপুড়হস্ত হতে হয় মশাই। কাঁচাখেগো কাপালিকের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিচ্ছেন, চড়চাপড় চাইছেন, রাবণের পার্ট চাইছেন, মাত্র পঁচিশটি টাকায় কি এত হয় কত? :! এর ওপর কর্মফলের জন্য যে ভোগান্তি আছে, তার দামটা কে দেবে মশাই? আপনারা তো মশাই দু-পাঁচশো টাকা ফেলে দিয়ে হুকুম জারি করেই খালাস, ওমুকের লাশ ফেলে দিয়ে আয়, তমুকের ঘরে আগুন দিয়ে দে, ওমুকের খেতের ধান লোপাট কর, তমুকের মরাই ফাঁক করে দিয়ে আয়। ইদিকে এসব করতে গিয়ে চিত্রগুপ্তের খাতায় তো আর আমাদের নামে ভাল-ভাল সব কথা লেখা হচ্ছে না। সেখানেও তো নামের পাশে ঘনঘন ঢ্যারা পড়ছে। এসব অপকর্মের জন্য নরকবাসের মেয়াদও তো বাড়ছেই মশাই! কুম্ভীপাকে শুনেছি, হাঁড়িতে ভরে সেদ্ধ করে, বিষ্ঠার চৌবাচ্চায় ফেলে রাখে বছরের পর বছর, কাঁটাওলা বেত দিয়ে পেটায়। তা মশাই সেসব ব্যাপারের জন্য দামটা কে দেবে? পাপ-তাপ কাটাতে আমাদের যে মাসে একবার করে কালীঘাট যেতে হয়, তারকেশ্বরে হত্যে দিতে হয়, তার খরচটাই বা উঠছে কোত্থেকে? কাশীতে বাবা বিশ্বনাথের শ্রীচরণেও গিয়ে একবার মাথা মুড়িয়ে আসতে হবে, তা তারও রাহাখরচা আছে। আপনারা তো কাজ বাগিয়ে খালাস, এখন মরতে মরুক কেলো আর পীতাম্বর। না কতা, অত শস্তায় হচ্ছে না। আমাদের পরকালটার কথাও একটু ভাববেন।”

গগন ভারী অমায়িক গলায় বলে, “ওরে বাবা, ভগবান কি আর কানা নাকি? বলি হ্যাঁ বাবা পীতাম্বর, একটা পাজি লোককে ঢিট করলেও কি পাপ হয়? তা হলে বলছ যে, রাবণকে মেরে রামচন্দ্রেরও পাপ হয়েছিল? না কি দুর্যোধনকে মেরে ভীমের? পাজি বদমাশদের ঠাণ্ডা করলে ভগবান খুশি হয়ে তোদের আর পাঁচটা পাপই হয়তো কেটেকুটে দিলেন খাতা থেকে। তা ছাড়া দুর্বলকে রক্ষা করা তো মহাপুণ্যের কাজ। বিনি মাগনা করে দিলে তো খুবই ভাল, তাতে যদি না পোয় তা হলে একটা ন্যায্য দরই নে। আমার দিকটাও একটু ভেবে বল বাবা, যাতে তোরও পুণ্যি হয়, আমার ট্যাকটাও বাঁচে।”

পীতাম্বর একটু গুম হয়ে থেকে বলে, “ওই চড়পিছু চারটে করে টাকা ফেলে দেবেন, আর চোখ রাঙানোর জন্য কুড়িটি টাকা। এর নীচে আর হচ্ছে না। আর চড়চাপড় অত হিসাব করে দেওয়া যায় না, দু-চারটে এদিক-ওদিক হতে পারে। ধরুন দুই চড়েই যদি কাজ হয়ে যায় তা হলে আট চড়ের কোনও দরকার নেই। আবার আটে কাজ না হলে দশ বারোটাও চালাতে হতে পারে। তা কম-বেশি আমরা ধরছি না। ওই আট চড়ের বাবদ বত্রিশটা টাকা ধরে দেবেন। যদি রাজি থাকেন তো চিড়ে-দই আনতে বলুন, আমাদের তাড়া আছে। সেই আবার গঙ্গানগরে এক বাড়িতে আগুন দিতে হবে আজ রাতেই। আপনার কাজটা সেরেই গঙ্গানগর রওনা হতে হবে। অনেকটা পথ।”

গগন একটু অবাক হয়ে বলে, “চিড়ে-দইয়ের কথা কী বললি বাপ? ঠিক যেন বুঝতে পারলুম না।”

পীতাম্বর আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কাজ হাতে নিলে আমরা মক্কেলের পয়সায় একটু ফলার করি। ওইটেই রীতি। এর মানে হল, কাজটা আমরা হাতে নিচ্ছি। দুজনের জন্য দু ধামা চিড়ে, দু ডেলা গুড়, সেরটাক দই, আর চারটি পাকা কলা। আর মায়ের পুজোর জন্য পাঁচ সিকে করে দুজনের মোট আড়াই টাকা।

“বাপ রে! তোদের আম্বা বড় কম নয় দেখছি।”

আপনি মশাই এত কেপ্পন কেন বলুন তো! সেই নিকুঞ্জপুর থেকে টেনে এনে তো ছুঁচো মেরে আমাদের হাত গন্ধ করাচ্ছেন। খুনখারাপি, আগুন দেওয়া-টেওয়া বড় কাজ নয়। এইসব কম টাকার কাজ আজকাল আর আমরা করি না। তার ওপর যা দরাদরি লাগিয়েছেন, এ তো পোষাচ্ছে না মশাই।”

“রাগ করিসনি বাপ। চিড়ে-দইয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। পাইক বরকন্দাজ তো আমারও আছে, কিন্তু তারা সব পেঁয়ো যোগী। কালী কাপালিক তাদের মোটেই ভয় খায় না। উলটে চোটপাট করে। কাজটা কিন্তু ভাল করে করা চাই। যেন আর কখনও রা কাড়তে না পারে। মুখ একেবারে বন্ধ করে দিবি।”

গগন হাঁকডাক করে চিড়ে-দই সব আনিয়ে ফেলল। কালু আর পীতাম্বর যখন ফলারে বসেছে তখন কাজের লোক কেষ্ট এসে খবর দিল, হরিপদ কর্মকার এসেছে। গগন শশব্যস্তে বাইরে বেরিয়ে এল।

একগাল হেসে গগন বলল, “এসেছিস ভাই হরিপদ! আয়, বিপদের দিনে তুই ছাড়া আর আমার কে আছে বল? ভেতরে চল ভাই, একটু গোপন শলাপরামর্শ আছে।”

হরিপদকে ঘরে ঢুকিয়ে খিল এটে গগন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “বিপদ যখন আসে তখন চতুর্দিক থেকেই আসে। শুনেছিস তো, কাল রাতে এক সাঙ্ঘাতিক চোর ঢুকেছিল বাড়িতে! সে কী চোর রে বাবা, এইটুকুন বয়স, কিন্তু তার বুদ্ধি আর কেরামতির বলিহারি যাই। দু-দুটো বাঘা কুকুর, পাইক, বাড়িসন্ধু এত লোকজন, মজবুত দরজা-জানলা কিছুই তাকে রুখতে পারেনি। ঘরে ঢুকে সিন্দুক ভেঙে যথাসর্বস্ব নিয়ে পালিয়েই গিয়েছিল প্রায়। মা মঙ্গলচণ্ডীই রক্ষা করেছেন। এ কী দিনকাল পড়ল রে হরিপদ? এ যে বাংলার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা! কলিযুগের শেষদিকটায় নাকি চোর বাটপাড়দের খুব বাড়বাড়ন্ত হবে। তাই হচ্ছে দেখছি। ওদিকে বিজ্ঞানের যা অগ্রগতি হচ্ছে শুনতে পাই সেটাও ভয়েরই ব্যাপার। বিজ্ঞানের কলকাঠি সব চোরদের হাতেই চলে যাচ্ছে বুঝি! নইলে এত লোককে ঘুম পাড়িয়ে নিঃসাড়ে কাজটা যে কী করে সেরে ফেলল, সেইটেই ভেবে পাচ্ছি না। তাই ভাবছি সোনাদানা আর ঘরে রাখা ঠিক নয়। মুকুন্দপুরের বিশু হাজরার চালকলটা কিনব-কিনব করছিলাম, বায়নাপত্তরও হয়ে আছে। বিশু হাজরাও চাপ দিচ্ছে খুব। তাই ভাবছি, আর দেরি নয়, ঘরের সোনার ওপর যখন চোর-ছ্যাচড়ের নজর পড়েছে, তখন ও-জিনিস না রাখাই ভাল। ধানকল তো আর চোরে নিতে পারবে না, কী বলিস?”

হরিপদ কাঁচুমাচু মুখে বলে, “আজ্ঞে, তা তো বটেই।”

গগন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “নেইও বেশি কিছু। ঠাকুরদার আমলের গোটাকয় মোহর। স্মৃতিচিহ্নই একরকম। কতকালের

জিনিস। গঞ্জের শাবলরাম মাড়োয়ারির সঙ্গে কথাও হয়েছে। তবে সে সেয়ানা লোক। বলে কিনা, পুরনো আমলের মোহরে নাকি মেলা ধুলোময়লা ঢুকে থাকত। সত্যি নাকি রে?”

হরিপদ মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে, অতি সত্যি কথা। সে আমলে সোনার শোধনের তেমন ব্যবস্থা ছিল না তো।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে গগন বলে, “মাড়োয়ারিও তাই বলছে রে। সে বলেছে, মোহর গলিয়ে শোধন করে খাঁটি সোনার বাট দিলে সে নগদ টাকায় কিনে নেবে। তুই ভাই, চটপট কাজটা করে দে। মাড়োয়ারির পো কাল বাদে পরশুই নাকি দেশে চলে যাবে। তার মেয়ের বিয়ে। সোনাদানার তারও বড় দরকার। তোর জিনিসপত্তর আজই নিয়ে চলে আয়। কোণের ঘরে বসে কাজ করবি।”

হরিপদ একটু উদাস মুখে বলে, “আগে মোহরগুলো তো দেখি।” গগন তার লোহার আলমারি খুলে চমৎকার চামড়ার ব্যাগখানা বার করল। একটু দুঃখী মুখে বলল, “তুই ছাড়া বিশ্বাসী লোকই বা আর পাব কোথায়। কাজটা করে দে, থোক পঞ্চাশটা টাকা দেব’খন। তবে আজ রাতেই কাজ সেরে ফেলা চাই।”

গগন হরিপদর হাতে কয়েকখানা মোহর দিতে সে সেগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল। বিকেলের আলো মরে এসেছে। গগনের ঘরে জানলা-দরজাও বড্ড কম। তবু আবছা আলোতেও সে যা দেখল, তাতে ইন্দ্রর কথায় আর সন্দেহ নেই। সে গগনের দিকে চেয়ে বলে, “গগনবাবু, যদি অভয় দেন তো একটা কথা বলি।”

“অভয় মানে! তোর আবার ভয়ের আছেটা কী?”

“বলছি, এ-মোহর গলিয়ে আপনি যা সোনা পাবেন, সেটা এমন কিছু নয়। পান অনেক বাদ যাবে। কিন্তু.”

গগন ব্যগ্র গলায় বলে, “কিন্তুটা আবার কী রে?”

“ভাবছি ভগবান যাকে দেন তাকে ছপ্পড় ফুড়েই বুঝি দেন। আপনার কপালটা খুবই ভাল।”

গগনের মুখে একটা লোভনীয় ভাব জেগে উঠলেও মনের ভাব চেপে রেখে সে গম্ভীর হয়ে বলে, “কপালের কথা বলছিস হরিপদ! ঘরের সোনা বেরিয়ে যাচ্ছে, আর বলছিস ভগবান ছল্পর ছুঁড়ে দিচ্ছেন! এত দুঃখেও বুঝি আমার হাসিই পাচ্ছে। তা হ্যাঁ রে হরিপদ, একটু ঝেড়ে কাসবি বাবা? তাপিত এ প্রাণটা জুড়োবার মতো কোনও লক্ষণ কি দেখছিস রে ভাই? মেঘের কোলে কি আবার কোনওদিন রোদ হাসবে রে?”

হরিপদ মাথা নেড়ে বলে, “বলে লাভ কী গগনবাবু? গরিবের কথায় আপনার হয়তো প্রত্যয় হবে না। পেটের দায়ে উঞ্ছবৃত্তি করে করে মানুষ হিসাবে আমাদের দামই কমে গেছে।”

গগন হরিপদর হাতটা খপ করে জাপটে ধরে বলে, “আর দগ্ধে মারিস ভাই। বলে ফ্যাল।”

হরিপদ মাথা চুলকে বলে, “যা বলব তা বিশ্বাস হবে তো?”

“খুব হবে। বলেই দ্যাখ না। তোর হল জহুরির চোখ। আজ না হয় আতান্তরে পড়ে তোর দুর্দশা যাচ্ছে। কিন্তু গুণী লোকের কি কদর না হয়ে উপায় আছে রে! তোরও একদিন মেঘের কোলে রোদ হাসবে, দেখিস।”

“আমার রোদ হাসবে কি না জানি না, তবে আপনার রোদ তো একেবারে হা-হা করে অট্টহাসি হাসতে লেগেছে গগনবাবু। এ যা জিনিস দেখালেন তাতে আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তবে ভগবানের একটা দোষ কী জানেন গগনবাবু, তিনি বড্ড একচোখো লোক। তিনি কেবল তেলা মাথাতেই তেল দেন। এই যে মনে করুন আপনি, আপনার ঘরদোরে তো মালক্ষ্মী একেবারে গড়াগড়ি যাচ্ছেন। গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গোরু, পুকুরভরা মাছ, তবু এই দুষ্প্রাপ্য মোহরের থলিটাও যেন আপনাকে না দিলেই ভগবানের চলছিল না। এর একখানা মোহর পেলেই আমার–শুধু আমার কেন, এই গোটা গাঁয়ের ভাগ্য ফিরে যেত, তা জানেন? আমার সব ধারকর্জ শোধ হয়েও সাতপুরুষের বন্দোবস্ত হয়ে যেত।”

গগন আকুল হয়ে বলে, “ওরে, ওরকম বলিসনি। আর একটু ঝেড়ে কাস ভাই, পেট খোলসা করে বল। তোর সেই পঞ্চাশ টাকা ধার তো! বেড়ে-বেড়ে শ’চারেক হয়েছে। এই আজই সেই ধার আমি বাতিল করে দিচ্ছি। কাগজপত্র হাতের কাছেই আছে। দাঁড়া।”

এই বলে গগন আলমারি খুলে কোথা থেকে একখানা কাগজ বার করে হরিপদকে দেখিয়ে নিয়ে ঘ্যাঁচ-গ্র্যাচ করে ছিঁড়ে ফেলে দিল। তারপর বলল, “এবার বল ভাই। তোর পাওনাও মার যাবে না। পঞ্চাশের জায়গায় একশো দেব।”

হরিপদ গলাখাকারি দিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, “কিছু মনে করবেন না গগনবাবু, আমি হলুম গে নকুড় কর্মকারের নাতির নাতি। নকুড় কর্মকার ছিলেন রায়দিঘির রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের খাস স্বর্ণকার। আমরা এইসব পুরনো মোহর, ধাতুর জিনিস, গয়নাগাটির জহুরি। আমাদের বংশের ধারা এখনও লোপ পায়নি। এই মোহর সম্পর্কে আমার মত যদি সত্যিই চান তা হলে উপযুক্ত নজরানাও দিতে হবে। পুরো পাঁচটি হাজার টাকা।”

গগন চোখ উলটে ধপাস করে চৌকির ওপর বসে পড়ে বলে, “ওরে, আমার চোখেমুখে জল দে। এ যে হরিপদর বেশ ধরে–ঘরে ঢুকেছে এক ডাকাত!”

“ঘাবড়াবেন না গগনবাবু। এইসব মোহরের আসল দাম শুনলে পাঁচ হাজার টাকাকে আপনার স্রেফ এক টিপ নস্যি বলে মনে হবে।”

চোখ পিটপিট করে গগন বলে, “সত্যি বলছিস তো! ধোঁকা যদি দিস তা হলে কিন্তু…।”

একটু থেমে হরিপদ বলে, “ধোঁকা দেওয়ার মতো বুকের জোর আমার নেই। দরকার হলে আমার গদান নেবেন। কালু আর পীতাম্বর তো আপনার হাতেই আছে।”

গগন ধড়মড় করে উঠে বলে, “আহা, আবার ওকথা কেন? কালু আর পীতাম্বর এই পথ দিয়েই কোথায় যাচ্ছিল, খিদে-তেষ্টায় কাহিল, এসে হাজির হল। তা আমি তো ফেলতে পারি না, শত হলেও অতিথি। একটু ফলার করেই চলে যাবে। কথাটা চাউর করার দরকার নেই। হ্যাঁ, এখন মোহরের কথাটা হোক!”

“হবে। মোহর সম্পর্কে আপনাকে যা বলব তার জন্য পাঁচটি হাজার টাকা এখনই আগাম দিতে হবে গগনবাবু। নইলে মুখ খোলা সম্ভব নয়। এ-আমাদের বংশগত বিদ্যে। বিনা পয়সায় হবে না।”

গগন কিছুক্ষণ স্তম্ভিত চোখে থেকে বলে, “কুলুঙ্গিতে মা কালীর একটা ফোটো আছে দেখছিস? ওই ফোটো ছুঁয়ে বল যে, সত্যি কথা বলছিস।”

হরিপদ ফোটো ছুঁয়ে বলে, “সত্যি কথাই বলছি।”

“পাঁচ হাজার টাকা কত টাকায় হয় জানিস? একখানা-একখানা করে গুনলে গুনতে কত সময় লাগে জানিস? জন্মে কখনও দেখেছিস পাঁচ হাজার টাকা একসঙ্গে?”

হরিপদ একটু বিজ্ঞ হাসি হেসে বলে, “আপনি এই মোহর নিয়ে গঞ্জের নব কর্মকার বা বসন্ত সেকরার কাছে গিয়ে যদি হাজির হন তা হলে তারা চটপট মোহর গলিয়ে দেবে, মূর্খরা তো জানেও না যে, এইসব মোহর এক-একখানার দামই লাখ-লাখ টাকা। আমাকে না ডেকে যদি তাদের কাউকে ডাকতেন, তা হলে আপনার লাভ হত লবডঙ্কা।”

গগন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়ে বলল, “কত টাকা বললি?”

“লাখ-লাখ টাকা। সব মোহরের সমান নয়। এক-এক আমলের মোহরের দাম এক-একরকম। এগুলো সবই ঐতিহাসিক জিনিস। দুনিয়ার সমঝদাররা পেলে লুফে নেবে। তবে হুট বলে বিক্রি করতে বেরোবেন না যেন। তাতে বিপদ আছে। পুলিশ জানতে পারলে খপ করে ধরে ফাটকে দিয়ে দেবে। এর বাজার আলাদা। চোরাপথে ছাড়া বিক্রি করা যাবেও না। কিন্তু কথা অনেক হয়ে গেছে। যদি হরিপদ কর্মকারের মাথা ধার নেন তবে তার দক্ষিণা আগে দিয়ে দিন।”

গগনের হাত-পা কাঁপছে উত্তেজনায়। কাঁপা গলাতেই সে বলে, “ওরে, আর একটু বল। শুনি। এ যে অমাবস্যায় চাঁদের উদয়!”

“বলতে পারি। কিন্তু আগে দক্ষিণা।”

গগন ফের আলমারি খুলল এবং কম্পিত হাতে সত্যিই পাঁচ হাজার টাকা গুনে হরিপদর হাতে দিয়ে বলে, “যদি আমাকে ঘোল খাইয়ে থাকিস

তা হলে নির্বংশ ভিটেছাড়া করে দেব কিন্তু।”

“সে জানি।” বলে হরিপদ টাকাটা ট্র্যাকে গুঁজল। তারপর বলল, “মশাই, আমি যদি লোকটা তেমন খারাপই হতুম, তা হলে এই মোহরের আসল দাম কি বলতুম আপনাকে? বরং এর একখানা সোনার দামে কিনে নিয়ে গিয়ে লাখ টাকা কামিয়ে নিতুম। সে তুলনায় পাঁচ হাজার টাকা কি টাকা হল?”

গগন একটা শ্বাস ফেলে বলে, “না, তুই ভাল লোক। তোর মনটাও সাদা। এবার মোহরের কথা বল।”

হরিপদ মোহরগুলো মেঝের ওপর উপুড় ঢেলে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে বলল, “মোট দুশো এগারোখানা আছে, তাই না?”

গগন একখানা শ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

“এর মধ্যে নানা জাত আর চেহারার মোহর দেখতে পাচ্ছেন তো! কোনওটা তেকোনা, কোনওটা ইংরেজি ‘ডি’ অক্ষরের মতো, কোনওটা ছ’কোনা, কোনওটা পিরামিডের মতো–এগুলোই পুরনো। হাজার-দেড় হাজার বছর আগেকার। এগুলোর দামই সবচেয়ে বেশি। গোলগুলো তো পুরনো নয়, কিন্তু ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এগুলোও কম যায় না। এগুলো যদি গলিয়ে ফেলতেন গগনবাবু, তা হলে যে কী সর্বনাশই না হত।”

“পাগল নাকি! গলানোর কথা আর উচ্চারণও করিস না, খবর্দার।”

হরিপদ মাথা চুলকে বলে, “কিন্তু মুশকিল কী জানেন, এসব যে অতি সাঙ্ঘাতিক মূল্যবান জিনিস?”

“বুঝতে পারছি রে। তা হ্যাঁ রে, দুশো এগারোর সঙ্গে লাখ লাখ গুণ দিলে কত হয়?”

“তার লেখাজোখা নেই গগনবাবু, লেখাজোখা নেই। আর সেইটেই তো হয়েছে মুশকিল।”

গগন তেড়ে উঠে বলে, “কেন, দু’শো এগারোর সঙ্গে লাখ-লাখ গুণ দিতে আবার মুশকিল কিসের? আজকাল তো শুনি গুণ দেওয়ার যন্ত্র

বেরিয়ে গেছে! ক্যারেকটার না ক্যালেন্ডার কী যেন বলে!”

“ক্যালকুলেটার।”

“তবে? ওই যন্ত্র একটা কিনে এনে ঝটপট গুণ দিয়ে ফেলব। মুশকিল কিসের?”

“গুণ তো দেবেন। গুণ দিয়ে কুলও করতে পারবেন না। কিন্তু ৫৮

আমি ভাবছি অন্য কথা। এত টাকার জিনিস আপনার ঘরে আছে জানলে যে এ বাড়িতে ভাগাড়ে শকুন পড়ার মতো দশা হবে! ডাকাতরা দল বেঁধে আসবে যে! কুকুর, বন্দুক, দরোয়ান দিয়ে কি ঠেকাতে পারবেন? গাঁয়ে-গঞ্জে কোটি-কোটি টাকার জিনিস তো মোটেই নিরাপদ নয়।”

গগন চোখ স্থির করে বলে, “কত বললি?”

“কোটি-কোটি।”

“ভুল শুনছি না তো! কোটি-কোটি?”

“বহু কোটি গগনবাবু। আর ভয়ও সেখানেই।”

গগন হঠাৎ আলমারি খুলে একটা মস্ত ভোজালি বের করে ফেলল। তারপর তার মুখ-চোখ গেল একেবারে পালটে। গোলপানা অমায়িক মুখোনা হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠল, চোখে সাপের ক্রুরতা। চাপা গলায় গগন বলে, “মোহরের খবর তুই ছাড়া আর কেউ জানে না। তোকে মেরে পাতালঘরে পুঁতে রেখে দিলেই তো হয়।”

হরিপদ দুপা পেছিয়ে গিয়ে সভয়ে বলে, “আজ্ঞে, আমার কাছ থেকে পাঁচকান হবে না। সে ভয় নেই। কিন্তু আপনারও বুদ্ধির বলিহারি যাই। এই হরিপদ কর্মকার ছাড়া ও-মোহর বেচবেন কী করে? মোহরের সমঝদার পাবেন কোথায়? এ-তল্লাটে তেমন সেকরা একজনও নেই যে, এইসব মোহরের আসল দাম কত তা বলতে পারে। যদিবা শহরে-গঞ্জে কাউকে পেয়েও যান সে আপনাকে বেজায় ঠকিয়ে দেবে বা মোহরের গন্ধ পেয়ে পেছনে গুণ্ডা বদমাশ লেলিয়ে দেবে। কাজটা সহজ নয় গগনবাবু।

গগন সঙ্গে-সঙ্গে ভোজালিটা খাপে ভরে আলমারিতে রেখে একগাল হেসে বলে, “ওরে, রাগ করলি নাকি? আমি তোকে পরীক্ষা করলাম।”

হরিপদ মাথা নেড়ে বলে, “আমার আর পরীক্ষায় কাজ নেই মশাই, ঢের শিক্ষা হয়েছে। আমার পৈতৃক প্রাণের দাম মোহরের চেয়েও বেশি। আমি আপনার কাজ করতে পারব না। এই নিন, আপনার পাঁচ হাজার টাকা ফেরত নিন।”

এই বলে ব্ল্যাক থেকে টাকা বের করে হরিপদ গগনের দিকে ছুঁড়ে দিল।

গগন ভারী লজ্জিত হয়ে বলে, “অমন করিসনি রে হরিপদ। একটা মানুষের মাথাটা একটু হঠাৎ গরম হয়ে উঠেছিল বলে তুই এই বিপদে তাকে ত্যাগ করবি? তুই তো তেমন মানুষ নোস রে।”

“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না। আর বিশ্বাস না করলে এই মোহর হাতবদল করা আপনার কর্ম নয়। পাঁচ হাজার টাকায় তো আর মাথা কিনে নেননি।”

গগনবাবু পুনমূষিক হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে, “দাঁড়া ভাই, দাঁড়া। আমারও মনে হচ্ছিল যেন, পাঁচ হাজার টাকাটা বড্ড কমই হয়ে গেল। তোকে আমি আরও দশ হাজার দিচ্ছি ভাই, আমাকে বিপদে ফেলে যাস না।”

“না মশাই, আপনার ভাবগতিক ভাল ঠেকছে না। এখন ছেড়ে দিচ্ছেন, কিন্তু পরে বিপদে ফেলবেন।”

“আচ্ছা, আরও দশ। মোট পঁচিশ হাজার দিলে হবে? না, তাও গাল উঠছে না তোর? ঠিক আছে, আরও পাঁচ ধরে দিচ্ছি না হয়।”

বলে গগন আলমারি থেকে টাকার বান্ডিল বের করে মোট ত্রিশ হাজার টাকা গুনে দিয়ে বলল, “এবার একটু খুশি হ ভাই। কিন্তু কথা দে, তোর মুখ থেকে মোহরের খবর কাকপক্ষিতেও জানবে না। মা কালীর ফোটোটা ছুঁয়েই বল একবার।”

হরিপদ কালীর ফোটো ছুঁয়ে বলে, “জানবে না। আপনি মোহরগুলো গুনে-গুনে ব্যাগে ভরে আলমারিতে তুলে রাখুন। আলমারির চাবি সাবধানে রাখবেন। আর চারদিকে ভাল করে চোখ রাখা দরকার।”

“তা আর বলতে! তবে বড় ভয়ও ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছিস। আজ রাতে আর ঘুম হবে না যে রে।”

“ঘুম কম হওয়াই ভাল। সজাগ থাকাও দরকার। আমিও বাড়ি গিয়ে একটু ভাবি গে।”

“যা, ভাই যা। ভাল করে ভাব। কত যেন বললি? কোটি-কোটি না

কী যেন! ঠিক শুনেছি তো!”

“ঠিকই শুনেছেন। এবার আমি যাই, দরজাটা খুলে দিন।”

আলমারি বন্ধ করে চাবি টাকে খুঁজে গগন দরজা খুলে দিল।

হরিপদ গগনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা বাজারে গিয়ে চাল, ডাল, তেল, নুন, আনাজ কিনে ফেলল। একশিশি ঘি অবধি। বাড়িতে ফিরে যখন বাজার ঢেলে ফেলল, তখন অধরা অবাক, “এ কী গো! এ যে বিয়ের বাজার!”

“এতদিনে ভগবান বুঝি মুখ তুলে একটু চাইলেন। বেশ ভাল করে রান্নাবান্না করো তো। আমি একটু ঘুরে আসছি।”

“আবার কোথায় যাচ্ছ?”

“জামাকাপড়ের দোকানে। তোমার জন্য শাড়ি, অলঙ্কারের জন্য প্যান্ট আর জামা নিয়ে আসি। ফিরে এসে সব বলব’খন। এখন সময় নেই। সন্ধে অনেকক্ষণ হয়েছে, দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।”