৪. কর্নেল নীলাদ্রি সরকার

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ব্রেকফাস্ট খেতে-খেতে ফোনটা ধরলেন …কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।

নমস্কার কর্নেল! আমি জয়ন্ত বলছি। না–আপনার তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্ত নই।

কর্নেল বললেন, মানে জয়ন্ত চ্যাটার্জি? লালবাজার?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি এখন কোথাও বেরোচ্ছেন না তো?

বেরোব না কী বলছ? দশটা পঁয়ত্রিশে আমার গাড়ি। প্রতাপগড় ঘুরতে যাচ্ছি।

কর্নেল, প্রতাপগড়ের বদলে মুর্শিদাবাদ চলুন বরং।

পাগল! এই তো সেদিন–মানে গত ফেব্রুয়ারিতে মুর্শিদাবাদ ঘুরে এলুম। তোমার মাথা খারাপ হয়েছে জয়ন্ত? সেখানে কবর ছাড়া আর দেখবার কী আছে? এ বয়সে কবর দেখলেই ভয় করে–পা দুটো পিছলে যাবার চান্স আছে যে কোন মুহূর্তে। হাঃ হাঃ হাঃ!

কর্নেল, প্লিজ! কবরেই চলুন আপাতত। আমি…

কবরে যেতে বলছ?

প্লিজ, আবার একবার মুর্শিদাবাদ চলুন। হ্যাঁ।

কেন?

ফোনে বলা যাবে না। আপনি এখনই আপনার ট্রাভেল এজেন্টকে বলে দিন–প্রতাপগড় ক্যানসেল করে মুর্শিদাবাদের ব্যবস্থা করুক! আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

বিরস মুখে ফোন ছেড়ে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার অন্যমনস্কভাবে বুকে একবার ক্রুস আঁকলেন। আর ব্রেকফাস্টের স্বাদ পেলেন না। মিসেস অ্যারাথুন একপট কফি রেখে গিয়েছিল একটু আগে। আস্তে আস্তে কফিটা খেতে থাকলেন। অনেকদিন থেকে ইচ্ছে প্রতাপগড় যাবার। যাওয়া হচ্ছিল না নানা কারণে। অবশেষে যদি বা ব্যবস্থা হল, শেষমুহূর্তে লালবাজার ইনটেলিজেন্সের জয়ন্ত চ্যাটার্জি সব ভণ্ডুল করে দিল।

অবশ্য, কর্নেল ইচ্ছে করলেই চ্যাটার্জিকে ভণ্ডুল করতে পারেন। সামরিক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার নীলাদ্রি সরকার এখন পুরো স্বাধীন। কেউ তাঁকে দিয়ে জোর করে কিছু করাতে পারে না। কিন্তু মুর্শিদাবাদ এবং কবর এই শব্দ দুটো তাকে খুব ভিতর থেকে আঘাত করেছে। জয়ন্তর কথায় কী একটা রহস্যের আভাসও আছে, যা তাঁকে চারদিক থেকে টেনে ধরে বসিয়ে দিয়েছে। দেখা যাক্ তবে এক্ষুনি হুট করে পর্যটনসূচি তাই বলে তিনি বাতিল করছেন না। আগে সব ঠাণ্ডা মাথায় শুনবেন। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবেন।

মাত্র দশ মিনিট বাদে ষষ্ঠীচরণ এসে খবর দিল, দুজন পুলিস অফিসার বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছেন।

কর্নেল আস্তে আস্তে বাইরের ঘরে গেলেন। মুখটা বিরস–তাই গম্ভীর ছিল। কিন্তু জয়ন্তর পাশে অন্য অফিসারটিকে দেখে তার গাম্ভীর্য মুহূর্তে চলে গেল। খুশি হয়ে বললেন, আরে, আরে! মিঃ সত্যজিৎ গুপ্ত যে! নমস্কার, নমস্কার। কেমন আছেন? আপনিই তাহলে মুর্শিদাবাদের কবর বয়ে এনে লালবাজারে জয়ন্তর কাঁধে চাপিয়েছেন? বাঃ বাঃ!

ওঁরা হেসে উঠলেন। মিঃ গুপ্ত বললেন, আর বলবেন না স্যার! এবার স্বয়ং নবাব এস্টেটের ট্রাস্টিবোর্ডের কেস। মিনিস্টার পর্যায়ে এসে চাপ দিয়েছে। আর চাকরি তো রইলই না–মুখ দেখানোর উপায়ও নেই নিজের কাছে। অথচ একদিক থেকে কেসটা খুব পরিষ্কার–একেবারে জলের মতো।

জয়ন্ত চ্যাটার্জি নিঃশব্দে একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন কর্নেলের দিকে। কর্নেল সেটা একবার খুলে ও উল্টে দেখে রেখে দিলেন। বললেন; আগে মুখে বলুন মিঃ গুপ্ত।

সত্যজিৎ গুপ্ত বললেন, শহরের বাইরে কাটরা মসজিদ এলাকায় জঙ্গলের মধ্যে একটা খোঁজা গোরস্তান আছে।

হ্যাঁ, আছে। দেখেছি।

দিন সাতেক আগে একরাত্রে সেই গোরস্তানের বুড়ো পাহারাওলা আর তার যুবতী বউকে দুজায়গায় দুটো কবরের ওপর মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

কিসে মারা যায় ওরা?

পোস্টমর্টেমে কিছু পাওয়া যায়নি। তাই শেষ অব্দি ডাক্তারি রিপোর্টে বলা হয় যে আচমকা কিছু দেখে ভয় পেয়ে দুজনে মারা গেছে। ভয় পেয়ে মৃত্যুর যে সব সাধারণ লক্ষণ থাকে, দুটো দেহে অবিকল তাই সব রয়েছে। হার্টফেল।

তারপর?

একটা কবর ছিল একেবারে শেষদিকে উঁচু পাঁচিলের প্রায় গায়ে। তার চারদিকে ফুলের গাছ রয়েছে ঘন। সেই কবরটাকে কেউ খুঁড়ে রেখেছে। মানে, ওপরের পাথর সরিয়ে খুঁড়েছে। আর তার তলায় যে লাশটা রয়েছে, প্রায় আড়াইশো বছর আগের লাশ। কিছু হাড়গোড় আর কাপড়-চোপড় মাত্র তাও হাত দিলে গুঁড়ো হয়ে যায়। লাশটার মাথার দিকে একটা চৌকো চিহ্ন স্পষ্ট। দুবর্গফুট জায়গায় কোন ভারি বাকসো বসানো ছিল নিশ্চয়। সেটা নেই। এর ফলেই ধারণা করা হয়েছে যে কেউ বাকসোটা সরিয়েছে এবং তার মধ্যে নিশ্চয় মূল্যবান জিনিসপত্র ছিল।

তার মানে সোনা-দানা?

জয়ন্ত চ্যাটার্জি হেসে বললেন, হীরেমোতি বলুন বরং।

কর্নেল বললেন, রাইট, রাইট। তা, কারো পায়ের চিহ্ন নেই?

মিঃ গুপ্ত জবাব দিলেন, কবরের তলায় নেই। ওপরে সবটাই পাথর। পরদিন সকালে প্রচণ্ড একপশলা বৃষ্টিতে যা ছিল ধুয়ে গেছে। তবে কবরের পাথর, মাটি যা কিছু খোঁড়া হয়েছে, সব লাশের মাথার আর পায়ের দিকে জড়ো করা আছে। যে বাকসোটা তুলেছে, সে দুদিকে দুপা রেখে কাজ করেছে। এবং আগেই বললুম, সেই জায়গাগুলো মসৃণ পাথর। কাজেই ট্রাস্টিবোর্ডের ধারণা যে কোন ধনবান নবাব উপাধিধারী খোঁজার ওই কবরে প্রচুর ধনরত্ন ছিল, সেই উদ্দেশ্যেই এই হত্যাকাণ্ড। তবে বোর্ডের আরজি হচ্ছে, ওই ধনরত্ন উদ্ধার করতে হবে। হত্যাকাণ্ডের কিনারা করাটা গৌণ।

কিন্তু হত্যাকাণ্ড বলছেন কেন? মর্গের রিপোর্ট তো উল্টো বলছে।

গোয়েন্দা অফিসার সত্যজিৎ গুপ্ত একটু চুপ করে থেকে বললেন, রিপোর্ট তাই বলছে। কিন্তু পাহারাওলা আর তার স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে কবরের ধনরত্ন চুরির যোগসূত্র নেই–তাই বা বলি কোন যুক্তিতে? প্রায় একই সময়ে দুটো ব্যাপার ঘটেছে। কাজেই…।

পুলিসের কাছে খবর গেল কীভাবে? কখন? কে দিল?

হ্যাঁ–সেটা বলা হয়নি। ওই রাত্রেই এক ভদ্রলোক তিনি একজন সিনেমা পরিচালক, নাম মিঃ সোমনাথ ভট্ট…

হ্যাঁ। সোমনাথ ভট্টের একটা ডকুমেন্টারি আমি দেখেছিলুম যেন।

মিঃ ভট্ট তার ইউনিট নিয়ে খোঁজা গোরস্তানের লোকেশনে ছবি তুলতে যান। ভদ্রলোক ওই দুর্ঘটনার রাত্রে সেখানে বৃষ্টির জন্যও বটে–আবার খুব ভোরে নিরুপদ্রবে কাজ শুরু করবেন বলে গোরস্তানের একটা ঘরে ছিলেন। সঙ্গে ইউনিট বলতে দুজন যুবক, দুটি যুবতী। মিঃ ভট্ট থানায় খবর দেন তক্ষুনি–মানে রাত তখন ঠিক দুটো পঁয়তাল্লিশ। সঙ্গে তার নিজের স্টেশনওয়াগন গাড়ি ছিল। সব ডিটেলস এই ফাইলে পাবেন। আকস্মিক যোগাযোগ নিশ্চয়। ওঁদের খুঁটিনাটি জিজ্ঞেসপত্র করে যা জানা গেছে, শুটিঙ-এর সময় ভিড় হতে পারে এই ভয়েই ওঁরা ওখানে গিয়েছিলেন। তাছাড়া মিঃ ভট্টের ছবির ব্যাপারে যা জানা গেছে ওঁর মতো পরিচালকের পক্ষে সেটা খুবই স্বাভাবিক। ওঁ কোন লিখিত স্ক্রিপ্ট থাকে না–তা ফিল্মমহলে তদন্ত করে জানা গেছে। আর–মাকস্মিক যোগাযোগ বলছি, আরও একটি কারণে। মিঃ ভট্টর এই নতুন ছবিতে সেক্সের প্রাধান্য থাকার কথা ছিল। তাই ভিড় এড়াতে চাওয়া ওঁর পক্ষে স্বাভাবিক। এবং সেজন্যেই ওই লোকেশন বেছেছিলেন। পৌঁছেছিলেনও সবার অজান্তে সন্ধ্যাবেলায়। মিঃ গুপ্ত সিগারেট জ্বেলে ধোঁয়ার রিং পাকাতে ব্যস্ত হলেন।

কর্নেল জয়ন্ত চ্যাটার্জির উদ্দেশে বললেন, তা আমাকে কি সেই ধনরত্ন উদ্ধার করে দিতে হবে, জয়ন্ত?

জয়ন্ত চ্যাটার্জি হেসে বললেন, কী করতে হবে আপনাকে–আমি কিছু জানি না। শুধু এটুকু জানি যে ঐতিহাসিক জায়গা সম্পর্কে আপনার যেমন দুর্দান্ত নেশা আছে, তেমনি খুব সাধারণ নিরীহ মানুষ বেমক্কা খুন হলে আপনার। সেখানে প্রচণ্ড সহানুভূতি।

কফি খাও তোমরা। ততক্ষণ আমি ফাইলে চোখ বুলিয়ে নি।

ষষ্ঠীচরণ কফির ট্রে রেখে দরজার বাইরে পর্দার আড়ালে গিয়ে ওঁৎ পেতে রইল যথারীতি।

একটু পরে মুখ তুলে কর্নেল বললেন, তোমাদের এই খুন কথাটা আমার বড় বিশ্রী লাগছে। মর্গের রিপোর্টে এটা জোর গলায় অস্বীকার করছে যে কোন দৈহিক আঘাতের ফলে ওরা মারা গেছে।

সত্যজিৎ গুপ্ত বললেন, কী দেখে ভয় পেতে পারে তাহলে?

সেটা বলা কঠিন। অন্তত যদি মর্গের রিপোর্ট কারেক্ট বলে মানি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এই রিপোর্টেই কিছু–থাক্ গে।..বলে কর্নেল উঠলেন।…জয়ন্ত, ফাইলটা রাখলে আপত্তি আছে?

মোটেও না। ওটা সব ডুপ্লিকেট কপিতে ভরতি। বরাবর রাখতে পারেন।

ঠিক আছে। আমার আর প্রতাপগড়ে যাওয়া কোনদিনই হবে না!.কর্নেল গজগজ করে বললেন।…মিঃ গুপ্ত, আমি বিকেলের মধ্যে আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলব। আপনি আজ কলকাতায় আছেন তো?

সত্যজিৎ গুপ্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাকে সঙ্গে না নিয়ে আমি মুর্শিদাবাদে ফিরছিনে স্যার।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, দেখা যাক।

জয়ন্তবাবুরা চলে যাবার আধঘণ্টা পরে কর্নেলের যখন একদফা ফাইলের কাগজগুলো পড়া শেষ হয়েছে, সেই সময় ষষ্ঠীচরণ এসে বলল, বাবামশাই! কারা দেখা করতে এসেছে।

একটু পরে কর্নেল ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখলেন দুটি যুবক-যুবতী বসে আছে। তাকে দেখে ওরা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। কর্নেল বললেন, বসুন বসুন। বাই এনি চান্স মিঃ সোমনাথ ভট্টের ফিল্ম-ইউনিটে নিশ্চয় আপনারা দুজনে ছিলেন–মানে মুর্শিদাবাদ খোঁজা গোরস্তানের লোকেশানে?

শান্ত-স্মিতা দুজনে অবাক হয়ে পরস্পর তাকাতাকি করল। তারপর শান্ত বলল, আপনি আমাদের চেনেন?

বললুম–বাই এনি চান্স।

 চান্স নয়, ফ্যাক্ট। বলে শান্ত একটু হাসল।..কিন্তু কী আশ্চর্য!..

আশ্চর্য কিছু নয়। একটু আগে কেসের ফাইলটা আমার কাছে এসেছে।

 শান্ত উৎসাহিত হয়ে বলল, এতো ভারি আশ্চর্য যোগাযোগ।

হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন মাই ডিয়ার ইয়ংম্যান। গোটা কেসটাই যেন দাঁড়িয়ে আছে। কতকগুলো আশ্চর্য যোগাযোগের ওপর। যাক গে, এবার আপনাদের নাম বলুন।

শান্ত বলল, আমি শান্তশীল রায়চৌধুরী। থাকি পাইকপাড়ায়। ইনি…

স্মিতা বলল, আমি শুচিস্মিতা বসু। বেলেঘাটায় থাকি।

কর্নেল বললেন, এবার বলুন, আমাকে আপনারা চিনলেন কীভাবে?

শান্ত কিছু বলার আগে স্মিতা বলতে থাকল, গতবছর সম্ভবত শীতের সময় খবরের কাগজে মুর্শিদাবাদ প্যালেস হোটেলের মার্ডার কেসটার খবর বেরিয়েছিল। আমার আবার খবরের কাগজ পড়ার ভীষণ বাতিক। তাছাড়া ক্রাইম ফিকশান। পড়াও একটা হবি। তাই মনে মনে আপনি আমার হিরো ছিলেন।…

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, হিরো হবার পক্ষে আমার বয়স অত্যন্ত অনুপযুক্ত।

স্মিতা সলজ্জ হাসল। শান্ত বলল, স্মিতা আমাকে কলকাতা ফেরার পথে আপনার কথা বলে। আপনার ঠিকানা খুঁজতে ভীষণ হন্যে হয়েছি। নয়তো তক্ষুনি আসতাম আপনার কাছে। হঠাৎ কাল আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সে একটা বড় কাগজের রিপোর্টার। তাকে বলতেই সে প্রতিশ্রুতি দিল। তারপর রাতের মধ্যে আপনার বর্তমান ঠিকানাটাও যোগাড় করে দিল। তারপর আজ সকালে গেলুম ওঁর বাড়ি। তারপর দুজনে সোজা চলে এলুম।

কর্নেল বললেন, ভালো, এবার বলুন, কেন আমার কাছে এসেছেন?

শান্ত বলল, জানেন কর্নেল? আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে বেশ অদ্ভুত লেগেছিল। ইউনিটের পরিচালক সোমনাথবাবু আর আমরা চারজন : সবাই পরস্পর অপরিচিত। মাত্র লোকেশনে যাবার সময় সকালে সোমনাথবাবুর ফ্ল্যাটে আমাদের আলাপ হয়েছে। কিন্তু প্রথমেই আমার একটু খুঁতখুঁতে ভাব পেয়ে বসে। কেন–সেটা স্পষ্ট বোঝাতে পারব না। খালি মনে হচ্ছিল, কী একটা ঘটতে যাচ্ছে–যা অনিবার্য। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। অথচ এর নির্দিষ্ট কোন প্রত্যক্ষ কারণ দেখতে পাচ্ছিলুম না।

প্রথমে বলুন, মিঃ ভট্টের সঙ্গে আলাপ বা যোগাযোগ হল কী ভাবে?

শান্ত পকেট থেকে একটা কাটিং বের করে কর্নেলের হাতে দিল। কর্নেল পড়ে দেখলেন। ছোট্ট বিজ্ঞাপন। একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী ছবিতে অভিনয় করার জন্য সুদর্শন যুবক-যুবতী আবশ্যক। ফটোসহ লিখুন। বক্স নম্বর ৪৪৮০১; দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা।

কর্নেল বললেন, আপনি ফটো পাঠিয়ে লিখলেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। তারপরই টাইপ করা ইংরিজি চিঠি এল। তাতে লেখা ছিল : সতেরই জুলাই সকালে একেবারে তৈরি হয়ে চলে আসুন বাইরে যাবার জন্যে। এই সেই চিঠিটা।

কর্নেল দেখলেন স্বাক্ষরটা পড়া যায় না–আঁকাবাঁকা জটিল রেখা কিছু। বললেন, তারপর?

নির্দিষ্ট ঠিকানায় এসে দেখি, পরিচালক আর কেউ নন সোমনাথ ভট্ট। আমি ওঁর ছবি দেখিনিকাগজে খুব পণ্ডিতি আলোচনা পড়েছিলুম। খুব সফিটিকেটেড ব্যাপার। আমার মনে ভীষণ আগ্রহ ছিল ওঁর প্রতি। আর খুলে বলাই ভালো, কমার্শিয়াল ছবি আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। বরং ইনটেলেকচুয়াল কিছু হলে নেশা ধরে যায়। তার ফলে মিঃ ভট্টের ছবিতে নামবার সুযোগ পেয়ে কৃতার্থ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক।

স্মিতা বলল, আমিও বিজ্ঞাপন দেখে ফটো পাঠাই। আমাকেও একইভাবে যেতে লেখা হয়…হুবহু একই চিঠি। তারপর গিয়ে দেখি, পরিচালক আর কেউ নন, সোমনাথ ভট্ট। বার দুই তার আগে আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। একবার একটা ফাংশনের শেষে উনি নিজের পরিচয় দিয়ে নিজে থেকে এসে আলাপ করেছিলেন। তারপর একবার রাস্তায় দেখা হয়েছিল। নিজে থেকেই বলেছিলেন, আমাকে চান্স দেবেন–যদি নতুন ছবি করেন। কাজেই, সতেরই জুলাই সকালে গিয়ে দেখলুম, উনিই সেই পরিচালক।

শান্ত বলল, আপনি আমাদের তুমি বললে খুশি হব।

কর্নেল বললেন, বেশ। তোমরা সোমনাথ ভট্ট সম্পর্কেই যেন বেশি জোর দিয়ে কথা বলছ। কেন, সেটা কিন্তু স্পষ্ট হল না। আমি পুলিসের ফাইল। দেখলুম, সোমনাথবাবু পুরো ক্লিন। ইনটেলেকচুয়াল মহলে খ্যাতিমান পরিচালক। সরকারের নানা দপ্তরের জন্যে কিছু ডকুমেন্টারি ছবি করে দিয়েছেন। এখন কথা হচ্ছে–শান্ত, তুমিই বলো, কোন নির্দিষ্ট ব্যাপারের দরুন তুমি আমার কাছে। আসার কথা ভেবেছ?

শান্ত বলল, না। সোমনাথবাবু সম্পর্কে আমার জোর দিয়ে বলার কিছু নেই। কিন্তু আমি এখনও সেই অস্বস্তিতে ভুগছি। তবে স্পষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছি নে, তখন ওকথা থাক্। আপাতত আপনি এই কাগজটা দেখুন। এটা আমি খুনের রাতে আমাদের ঘরের দরজায় কুড়িয়ে পেয়েছিলুম।

কর্নেল কাগজটা দেখলেন। লাইনটানা সাদা কাগজে আঁকাবাঁকা হরফে ইংরেজিতে লেখা। দেখলে মনে হয়, খুব তাড়াতাড়ি লেখা কোন ছাত্রের পরীক্ষাপত্রের একটা পাতা। সবটা পড়ে কর্নেল মুখ তুলে বললেন, এটা তুমি পুলিসকে জানাওনি দেখছি।

শান্ত বলল, জানাইনি–কারণ ওটার কোন গুরুত্বই দিইনি।

কিন্তু ওটা কাছে রেখে দিয়েছিলে?

অপ্রস্তুত হেসে শান্ত বলল, আসলে ওটা যখন পকেটে রাখি, তখন অব্দি আমার মধ্যে সেই অস্বস্তিটা কাজ করছিল। তারপর দুর্ঘটনা যখন সত্যি ঘটে গেল, ওটার কথা ভুলে গেলুম। একটুও মনে ছিল না। হঠাৎ প্যান্টটা কাঁচতে গিয়ে–মানে, কলকাতা ফেরার পরেই, মনে পড়ে গেল। তখনও ওটার গুরুত্ব দিই নি। কিন্তু স্মিতা পরে যখন…

কিন্তু তবু ওটা ফেলে দাওনি।

শান্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, কর্নেল, আমার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে। নিজের অনেক আচরণের অর্থ নিজের কাছেই স্পষ্ট হয় না। যেমন ধরুন, খুব চেনা লোককেও হঠাৎ কখনও কখনও ভীষণ অচেনা লাগে! তার। ফলে বোকার মতো তাকে তার পরিচয়, চেয়ে বসি। পরে লজ্জা পাই। আমি ভীষণ অন্যমনস্ক মানুষ, কর্নেল!

স্মিতা নড়ে উঠল।…হ্যাঁ হ্যাঁ। সে রাতে যখন শান্ত আর আমি কবরখানার দালানের ওপরতলায় যাচ্ছিলুম, হঠাৎ শান্ত আমাকে বলে বসল–আপনি কে? জানেন কর্নেল, আমি কী চমকে গিয়েছিলুম?

কর্নেল বললেন, তোমাদের ইউনিটে এমন প্রশ্ন আর কাকেও করেছিলে শান্ত? স্মরণ করতে পারো?।

শান্ত একটু ভেবে জবাব দিল, ঠিক মনে পড়ছে না। কেন, কর্নেল?

এমনি। যাক গে, তোমরা কফি খেতে-খেতে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।

 ষষ্ঠী ট্রে রেখে ওদের দুজনকে দেখতে-দেখতে বেরিয়ে গেল।

কর্নেল বললেন, পুলিসের ফাইলে তোমাদের প্রত্যেকের জবানবন্দি বা সাক্ষ্য আছে। তোমরা আর কী গোপন করেছ?

স্মিতা বলল, দালানের ওপরতলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি স্পষ্ট কাকেও দেখেছিলুম। শান্ত বলেছিল, ওর নাকি অনেক পোষা বাঁদর আছে–অন্ধকার কবরখানায় ছেড়ে দেবে। বলে হাসতে লাগল সে।

কর্নেল বললেন, বাঁদর!

শান্ত বলল, ও আমার একটা হবি। সত্যিকার বাঁদর না–নিতান্ত কাল্পনিক। যখন কিছু ভালো লাগে না, মনে অস্বস্তি থাকে–সে দিন বা রাত যখনই হোক, কল্পনায় অজস্র বাঁদর নিয়ে খেলা করি। ওদের ছেড়ে দিয়ে ছুটোছুটি দেখি। গণ্যমান্য লোক রাস্তায় যেতে দেখলেই তার কাঁধে… সে হাসতে লাগল।

হঠাৎ স্মিতা বলল, আরেকটা ব্যাপার পুলিসকে বলি নি। বলতে লজ্জা। পেয়েছিলুম। জানি না, তা কোন কাজে লাগবে কি না।

লাগতে পারে বলো। কর্নেল কী ভাবতে-ভাবতে বললেন।

মিঃ ভট্ট আমাকে বাইরে তার গাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুব বিশ্রি একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন!

ফিল্ম সংক্রান্ত?

 হ্যাঁ–ফিল্ম সংক্রান্ত। তবে… মুখ নিচু করল স্মিতা।

শান্ত বলল, উদ্ভট লজ্জা তোমার, স্মিতা। আমি বলে দিচ্ছি কর্নেল। ওকে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হিরোর সঙ্গে সেক্সয়াল ব্যাপারে লিপ্ত হতে হবে বলেছিলেন মিঃ ভট্ট। সেই দৃশ্য তিনি ক্যামেরায় তুলবেন।

হিরো কে?

তখনও ঠিক ছিল না। আমরা তো মোটে দুজন ছিলুম। যে-কোন একজনকে সম্ভবত হিরো করতেন মিঃ ভট্ট। আগে থেকে কোন প্ল্যান ছিল না ওঁর। কোন লিখিত কাহিনী বা স্ক্রিপ্ট–কিছু না।

জানি। ক্যামেরা ওঁর কলম। তা তুমি রাজি হয়েছিলে স্মিতা?

স্মিতা জোরে মাথা দোলাল।

সেটাই স্বাভাবিক। তারপর?

শান্ত বলল, একই প্রস্তাব উনি শ্রীলেখাকেও দিয়েছিলেন। তিনিও রাজি হননি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আবার আমরা মিঃ ভট্টের প্রতি সন্দেহের বোঝা চাপাচ্ছি। কিন্তু পুলিস রিপোর্ট বলছে, মিঃ ভট্ট–যাকে বলে, খুব ঝরঝরে পরিষ্কার-মানে ক্লিন। কোনো পিছনের কালো চিহ্ন নেই। খ্যাতিমান, শিক্ষিত, অভিজাতবংশীয় মানুষ। একটু খামখেয়ালি–এই যা। প্রতিভাবান শিল্পীরা। খামখেয়ালি না হওয়াটাই সন্দেহজনক।–বলে কর্নেল একটু হাসলেন।

শান্ত বলল, না কর্নেল, ওঁকে সন্দেহ করছি না। আমি অনেক ভেবেছি ভেবে শুধু মনে হয়েছে, ফিল্ম ইউনিট নিয়ে ওই লোকেশনে যাবার পরই অমন ভয়ানক কাণ্ড ঘটল–সে কি নিতান্ত আকস্মিক যোগাযোগ?

কেন একথা তোমার মনে হচ্ছে?

ওই কাগজটা আমাদের আস্তানায় পড়ে থাকার পর থেকেই মনে হচ্ছে। কথাটা। তাছাড়া বলেছি, আমার একটা অদ্ভুত অস্বস্তি ছিল।

এখানে ফেরার পর মিঃ ভট্টের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়েছে তোমাদের?

হ্যাঁ। উনি দুদিন আগে আবার কোথায় একটা লোকেশন দেখতে গেছেন। বলেছেন, ফের আমাদেরই নিয়ে যাবেন।

তুমি যাবে?

যাব বই কি।

স্মিতা?

স্মিতা প্রবল মাথা দুলিয়ে বলল, মোটেও না। ফিল্মে নামার সখ মিটে গেছে আমার।

কর্নেল বললেন, আচ্ছা। এবার বলো, শান্ত, সে রাতে আর এমন কিছু দেখেছিলে–যা পুলিসকে বলনি?

শান্ত বলল, যা সব দেখেছিলুম, তা ভালই জানি–আমারই মাথার উদ্ভট চিন্তার ফসল। যেমন ধরুন, সব সময় মনে হচ্ছিল পিছনে কে এসে দাঁড়াল। কিংবা কী যেন ঘটতে চলেছে ষড়যন্ত্র হচ্ছে…এইসব। তাছাড়া আর কিছু বলতে পারছিনে।

ওপরতলায় কাকে সিগারেট খেতে দেখেছিলে–তোমাদের সবাই অবশ্য তা দেখেছে, রিপোর্টে দেখলুম। কিন্তু কথা হচ্ছে–তাহলে এটা পরিষ্কার যে ওই সময় বাইরের কেউ সেখানে ছিল। তোমার কী মত, শান্ত? নিশ্চয় সবাই একসঙ্গে একই কল্পনা করে না।

শান্ত বলল, আমি ভেবেছিলাম–সিতারার কোন প্রেমিক।

তাহলে অনায়াসে আমরা পুলিসের মতই তার ঘাড়ে সব দায় চাপাতে পারি।

কেন? সিতারার প্রেমিক সিতারাকে খুন করবে কেন? শান্ত বলল।

কবরের ধনরত্ন চুরি করাই আসলে তার উদ্দেশ্য ছিল। তাই…

শান্ত বাধা দিয়ে বলল, সিতারাকে আপনি দেখেননি কর্নেল। ওর যে প্রেমিক, সে কবরের ধনরত্নের চেয়ে দামী ধনরত্নের মালিক।

কর্নেল হেসে বললেন, তুমি খুব ভাবপ্রবণ ছেলে। সুন্দরীদের চেয়ে ধনরত্ন এখনও পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষের পরম কাম্যবস্তু। স্মিতা, আশা করি এ মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হবে না। শান্তর পাওয়া কাগজে অবশ্য উল্টো কথা লেখা আছে। কিন্তু মাইন্ড দ্যাট–এ ভাষণ কার, এখনও আমরা জানি না।

শান্ত বলল, কার হতে পারে?

কোন খোজার।

শান্তর চোখ উজ্জ্বল হল। উত্তেজিত মনে হল তাকে। কিন্তু তক্ষুনি আবার সে স্বভাববশে ঠাণ্ডা হয়ে পড়ল। বলল, কর্নেল, আপনি একটা অন্ধকার জায়গায় আলো ফেলছেন মনে হচ্ছে। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় এই কাগজটা কোন পুরনো বই বা দলিল-টলিলের কপি?

তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, শান্ত। আমারও তাই মনে হচ্ছে।

স্মিতা বলল, কর্নেল, শ্রীলেখাদিকে আসতে বলব আপনার কাছে?

আসতে বলার দরকার নেই। আমি নিজেই যাব। ওঁদেরও আমার দরকার।

শান্ত বলল, কিন্তু আমার মনে হয়–শ্রীলেখাকে পেলেও সায়ন্তনবাবুকে খুঁজে পাবেন না।

কেন? ওঁর ঠিকানা তো পুলিসের কাছে আছে।

গিয়ে দেখবেন, বাসা বদলেছে।

 সে কী? কেন?

শান্ত হঠাৎ হেসে ফেলল।–সায়ন্তন ভীষণ ভীতু ছেলে। তবে সেজন্যে নয়–আসলে ফিল্মে নামবার জন্যে ও ওই ছদ্মনাম নিয়েছে। ওর আসল নাম হচ্ছে, ফরিদ আমেদ।

স্মিতা বলল, ভ্যাট! আমি বাজি রাখব–ও কখনো ফরিদ আমেদ নয়। হতেই পারে না। ওর চেহারা…

কর্নেল হাত তুলে বললেন, চেহারায় আমাদের ধর্মসম্প্রদায়ের কোন পরিচয় থাকে না স্মিতা!

শান্ত হাসতে হাসতে বলল, স্মিতাদের প্রেমভালোবাসা পাবার পক্ষে ওই নামটা খুব হোপফুল। এবং স্মিতা ভুরু কুঁচকে নিঃশব্দে শাসালে কর্নেল হো হো করে হেসে উঠলেন।

পরক্ষণে ফের গম্ভীর হয়ে বললেন, এবার কাজের কথায় আসা যাক।…