৪. এস পি-কে ফোন

এস পি-কে ফোনে পেতে একটু দেরি হল। পাওয়ার পর অমল সোম জানালেন ঘটনা দুটোর কথা। যে বাংলোয় তাঁরা উঠেছেন তার দরোয়ান আজ ভোরে জঙ্গলে হাতির পায়ে চাপা পড়ে মারা গিয়েছে। তার মৃতদেহ এখনও জঙ্গলে পড়ে আছে। কীভাবে সেখানে পৌঁছাতে হবে তাও জানিয়ে দিলেন তিনি।

এস পি সব নোট করে নেওয়ার পর অমল সোম বললেন, আমি গতকাল ডি এফ ও সাহেবকে জানিয়েছিলাম, আমাদের সঙ্গে আসা একজন। আমেরিকান মহিলা জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছেন। আমি জানি না তিনি আপনাকে জানিয়েছেন কি না! মহিলা এখনও ফিরে আসেননি। একটু আগে জানলাম, তাঁকে উগ্রপন্থীরা ধরে নিয়ে গিয়েছে।

কী করে জানলেন?

আমরা দু’জন উগ্রপন্থী, যারা এই বাংলোয় এসেছিল, তাদের ধরে রেখেছি। তাদের মুখ থেকেই খবরটা বেরিয়েছে।

খুব ভাল করেছেন মি. সোম। আমাদের যে পার্টি ডেডবডি তুলে আনতে যাচ্ছে তাদের হাতে ওদের তুলে দিন। খুব দুঃখের সঙ্গে আপনাকে একটা খবর দিচ্ছি। আজ সকালে উগ্রপন্থীরা লোকাল থানায় ফোন করে বলেছে যে, তারা স্টেফি নামের একজন মহিলাকে কিডন্যাপ করেছে। মহিলা আমেরিকান। চারদিনের মধ্যে দু’কোটি টাকা না পেলে তারা ওঁকে মেরে ফেলবে। মহিলার আমেরিকার ফোন নাম্বার ওরা দিয়েছে। আমরা মার্কিন কনসুলেটের সঙ্গে ইতিমধ্যে যোগাযোগ করেছি। বুঝতে পারছেন, ওরা টাকার গন্ধ পেয়ে গিয়েছে। এর আগে যাঁদের কিডন্যাপ করেছিল তাদের উদ্ধার আমরা করতে পারিনি। কারণ, ওরা ক্যাম্প করত ভুটানে। ওখানে আমাদের পুলিশের ঢোকার অধিকার নেই। তবু, ঘটনা যেমন ঘটবে আপনাকে তা জানিয়ে দেব। এস পি বললেন।

দ্বিতীয় ফোনটা করলেন অমল সোম সুধাংশুশেখর দত্তকে। তাঁকে শিলিগুড়ির বাড়িতেই পাওয়া গেল। খবরটা শুনে চেঁচিয়ে উঠলেন, সে কী? ভোরবেলায় লছমন জঙ্গলে কেন গিয়েছিল? ও তো জানে ভোরের মুখে জঙ্গলের হাতি বাংলোর দিকে চলে আসে। আঃ। আমি একটু পরেই রওনা হচ্ছি।

অর্জুন এবং ভানুপ্রসাদ ফিরে এল। ততক্ষণে মেজর উঠে পড়েছেন। তাঁকে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে ঘটনাগুলো বলেছেন অমল সোম।

মেজর বললেন, যাচ্চলে! লোকটাকে আমি পছন্দ করছিলাম না বটে, কিন্তু ও পালাল কেন? সবাইকে বিপদে ফেলে নিজের প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিল বলে শাস্তিটা পেল। কিন্তু স্টেফির কী হবে? টাকা না পেলে ওকে কি খুন করবে ওরা?

সেটাই চালু নিয়ম!

নিয়ম? মেয়েটা আমার ভরসায় এ দেশে এসেছে। মেরে ফেলবে বললেই হল? মানলাম, এক দেশের পুলিশ অন্য দেশে যেতে পারে না। চলুন, আমরা ভুটান পুলিশকে বলি ওকে রেসকু করতে। মেজর উত্তেজিত।

তাদের কোথায় পাবেন?

ওই পাহাড়ে যখন ভুটানিরা থাকে তখন নিশ্চয়ই থানা-পুলিশও থাকবে।

কিন্তু এখান থেকে পাহাড় টপকে তাদের ডেরা খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া সিদ্ধান্ত নেবে ভুটানের রাজধানীর কর্তারা। এখান থেকে থিম্পু যাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। রাজাভাতখাওয়া থেকে হাসিমারা হয়ে ফুন্টশলিং যেতে ঘন্টা আড়াই লাগবে। ফুন্টশলিং থেকে গাড়িতে থিম্পু অন্তত সাত-আট ঘণ্টা। এখন রওনা হলে মাঝরাত হয়ে যাবে পৌঁছোতে। অমল সোম বললেন।

তা হলেও তো তিনদিন হাতে থাকবে।

আমাদের কথায় ওরা কান দিতে না-ও পারে। একমাত্র আমেরিকান কনসুলেট চাইলে ওঁরা ভুটানের স্বরাষ্ট্র দফতরকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধ করতে পারেন।

অর্জুন ঘরের ভিতরে চলে এল। মাঝখানের যে ঘরে ভানুপ্রসাদ প্রথম রাত্রে ঘুমিয়েছিল, সেখানে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে ছিল বাদল।

অর্জুন তার পাশে বসে বলল, লছমন বলত রাত্রে জঙ্গলে ঢোকা বিপজ্জনক, কিন্তু নিজেই ওই ভুলটা করল!

বহুদিন ধরে ওকে চিনতাম। আমাকে তো ও একসময় সাহায্য করেছিল। ও যদি আমাকে চাল-আলু না জোগান দিত, তা হলে আমি না খেয়ে মরে যেতাম। ও যে আমার কাছে ওদের নিয়ে গিয়েছিল সেটা একদম বাধ্য হয়ে। ওর যে এভাবে মৃত্যু হবে তা আমি কল্পনাও করিনি বাবু। আমি যদি ওর সঙ্গে যেতাম তা হলে এরকম হত না। আমি ওকে নিয়ে বড় রাস্তা দিয়েই যেতাম। বাদল বলল।

বাদল, তুমি তো অনেকদিন ওই দলের সঙ্গে ছিলে?

হ্যাঁ বাবু।

ওরা এখন কোথায় ক্যাম্প করেছে আন্দাজ করতে পারো।

অনেক জায়গা আছে। বিজয়চাঁদ বাবুকে যেখানে রেখেছিল, সেখান থেকে সরে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে। ঠিক কোন জায়গায় তা কী করে বলব?

অর্জুন একটু ভাবল। তারপর চুপচাপ উঠে বারান্দায় চলে এল। লোক দুটো উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। দ্বিতীয় লোকটিকে সোজা করল সে। লোকটা চোখ পিটপিট করল। এই লোকটার মন দুর্বল হয়েছে। এভাবে পালিয়ে বেড়াতে ওর ভাল লাগছে না। লোকটাকে কাজে লাগানো দরকার। সে বাঁধা থাকা অবস্থাতেই লোকটাকে সোজা দাঁড় করিয়ে দিল। লোকটা অবাক হল। ওর মুখে কাপড় ঠাসা। সেই অবস্থাতেই প্রায় কোলে করে ওকে নিয়ে ভিতরে এল অর্জুন। সোফায় বসিয়ে দিতেই লোকটার চোখ পড়ল বাদলের উপর। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফারিত হল তার চোখ।

অর্জুন ওর মুখ থেকে গুঁজে রাখা কাপড় বের করতেই লোকটা ঢোক গিলল। অর্জুন বলল, তোমরা ওকে মারতে এসেছিলে?

কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারল না লোকটা। অর্জুন একগ্লাস জল ওর মুখের সামনে ধরতে ও ঢকঢক করে কিছুটা জল গিলে ফেলল। প্রথম কথা বলল সে, তুমি পালাও। তোমাকে ওরা খুঁজছে।

বাদল কোনও কথা বলল না।

ওকে নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। তুমি যদি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করো তা হলে তোমারও কোনও ভয় নেই। অর্জুন হাসল, তোমাকে দলে ফিরে যেতে হবে না।

ওরা ঠিক আমাকে খুঁজে বের করবে।

কাল যে মেমসাহেবকে কিডন্যাপ করা হয়েছে তাঁকে কোথায় রাখা হয়েছে? অর্জুন খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল।

ছাঙ্গুবাড়িতে।

সেটা কোথায়?

নদী পেরিয়ে এক মাইল ভিতরে। ভুটানে।

কাল রাত্রে কোনও নেতার সেখানে আসার কথা ছিল?

নাম জানি না। সবাই বলে নাম্বার টু। তাকে খবর দেওয়া হয়েছিল।

ক’টা ক্যাম্প আছে ওখানে?

সাতটা।

তুমি আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারবে?

না বাবু!

কেন?

আমি ওখানে কখনও যাইনি।

তা হলে তুমি কোথায় ছিলে? কোত্থেকে এসেছ?

আমরা নদীর ওপারে ছিলাম। আমাদের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, ওঁকে খুঁজে বের করতে। আমরা তিনজন ছিলাম। একজনকে কাল ছাঙ্গুবাড়িতে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। যে খবরটা দিয়েছিল তার মুখেই শুনেছি, এক মেমসাহেবকে ওখানে ধরে আনা হয়েছে।

এই সময় বাইরে গাড়ির আওয়াজ হল। অর্জুন বাইরে বেরিয়ে দেখল, পুলিশের একটা জিপ এবং ভ্যান এসে দাঁড়াল গেটের সামনে। ও সি এবং চারজন সেপাই নেমে এলেন দুটো গাড়ি থেকে।

সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে ও সি জিজ্ঞেস করলেন, মি. সোম?

অমল সোম বললেন, আমি। বসুন।

ও সি চেয়ারে বসলেন, আমরা ডেডবডি পেয়ে গিয়েছি। লোকটার নাম বলুন!

লছমন। উপাধি জানি না। এই বাংলোর দরোয়ান ছিল।

বাংলোর মালিক ফোন করেছিলেন। উনি শিলিগুড়ি থেকে আসছেন। আপনারা কী করে খবরটা পেলেন?

খুঁজতে গিয়েছিল ওকে।

বুঝলাম। বড় রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের গভীরে কীভাবে পৌঁছোলেন?

অর্জুন এগিয়ে এল, ওখানে একটা সরু হাঁটাপথ নিশ্চয়ই দেখেছেন। আমরা ভেবেছিলাম, লছমন ওখান দিয়ে শর্টকাট করতে পারে।

আপনি?

আমি অর্জুন।

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন ও সি। নমস্কার করে বললেন, আচ্ছা! আপনার কথা আমি খুব শুনেছি।

মেজর গম্ভীর গলায় বললেন, মি. সোম অর্জুনের গুরু।

ও হ্যাঁ। তারপরেই ও সি প্রসঙ্গ পালটালেন, এস পি সাহেব বলেছেন, দু’জন উগ্রপন্থীকে আপনারা এখানে আটকে রেখেছেন। তারা কোথায়?

অর্জুন অমল সোমের দিকে তাকাল। অমল সোম বললেন, ওরা এখানেই আছে।

আমরা ওদের থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই।

অমল সোম বললেন, আমি এস পি এবং ডি এফ ও-কে বলেছি, আমাদের সঙ্গে গবেষণার কাজে আসা একটি আমেরিকান মেয়েকে উগ্রপন্থীরা কিডন্যাপ করেছে। এস পি নিশ্চয়ই তার কথা আপনাকে জানিয়েছেন?

হ্যাঁ। কিন্তু ওরা কাউকে কিডন্যাপ করলে ভুটানে নিয়ে যায়। সেখানে অনুমতি ছাড়া ভারতীয় পুলিশ ঢুকতে পারে না।

তার মানে আপনি বা আপনারা স্টেফিকে উদ্ধার করতে পারবেন না?

যদি ওরা ওঁকে বর্ডার পেরিয়ে এদিকে নিয়ে আসে…!

যদি না নিয়ে আসে?

বুঝতেই পারছেন, আমাদের হাত-পা বাঁধা।

তা হলে এই দু’জনকে জিজ্ঞেস করে স্টেফির উপকার করতে পারবেন না?

আমরা অন্য তথ্য পেতে পারি। ওদের যাবতীয় সাপ্লাই ভারত থেকে যায়। এর আগে ধরপাকড় হওয়ার পর ওরা পদ্ধতি বদলেছে। সেটা কী জানতে পারলে ওরা ওখানে বিপাকে পড়বে। সেক্ষেত্রে ওরা বর্ডার পেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে।

অফিসার, আপনি যা বলা উচিত তাই বলছেন, কিন্তু আমাদের হাতে আর তিনটে দিন আছে। আপনার উপর ভরসা করে অনন্তকাল অপেক্ষা করলে স্টেফিকে হয়তো কোনওদিন দেখতে পাব না। অমল সোম বললেন।

অর্জুন বলল, আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করব।

বলুন।

একজন উগ্রপন্থী, যে মুখ খুলছে না, তাকে আপনি নিয়ে যান!

দ্বিতীয়জন? ও সি জিজ্ঞেস করলেন।

দ্বিতীয়জনকে এখনও আমাদের দরকার হবে। তাকে আমরাই আপনার থানায় পৌঁছে দেব, কথা দিচ্ছি।

দরকার হবে মানে?

আপনাদের পক্ষে যখন ভুটানে গিয়ে স্টেফিকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়, তখন আমরাই চেষ্টা করে দেখি। দ্বিতীয় লোকটার সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব নয়।

এ কী বলছেন! ওরা আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে। ওদের কাছে খালি হাতে আপনারা কী করতে পারবেন?

না পারলে যা হবে, এখানে হাতগুটিয়ে বসে থাকলেও তাই হবে।

আমি এ ব্যাপারে আপনাদের সমর্থন করছি না। যা করবেন তা নিজেদের দায়িত্বে করবেন। কিন্তু দ্বিতীয় লোকটি যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে?

দেখাই যাক। অর্জুন হাসল।

বারান্দা থেকে বন্দি করে রাখা লোকটিকে সেপাইরা তুলে নিয়ে এলে ও সি বিদায় নিলেন। মেজর এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। ওভাবে থাকতে তাঁর বোধহয় খুব পরিশ্রম হচ্ছিল। ও সি চলে যেতেই ফেটে পড়লেন মেজর, কিল মারার গোঁসাই! পটকোচিয়াম!

অর্জুন হেসে ফেলল, শব্দটার মানে কী?

মেজর বললেন, আহাম্মক। ব্রংকসের হিসপ্যানিজদের ভদ্র গালাগাল।

অর্জুন ভানুপ্রসাদকে বলল, বাদলকে ডেকে আনো।

বাদল এল মাথা নিচু করে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাদের ছাঙ্গুবাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে? গিয়েছ কখনও?

এক ক্যাম্পের লোককে অন্য ক্যাম্পে যেতে দেওয়া হয় না। তবে আমি অনুমান করতে পারছি জায়গাটা কোথায়?

তুমি ওই লোকটির সঙ্গে ভাব জমাও। জিজ্ঞেস করো, কত লোক ওই ছাঙ্গুবাড়িতে আছে? কীভাবে সেখানে পৌঁছে আমরা মেমসাহেবকে উদ্ধার করতে পারি? অর্জুন নিচু গলায় পরামর্শ দিল।

ঠিক আছে।

ওকে ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে অর্জুন অমল সোমকে বলল, চলুন, একটু ঘুরে আসি।

কোথায় যাবে?

জয়ন্তীর কাছে এই নদী গাড়িতে চেপেই পার হওয়া যায়। ওখানে জল খুব কম। দু’পাশ দিয়ে দুটো ধারা আছে। নদী পেরিয়ে কিছুটা গেলে একটা মন্দির পাওয়া যাবে। স্থানীয় লোকরা ওই মন্দিরের দেবীকে খুব জাগ্রত বলে মনে করে। গাড়ি ওই পাহাড়ে উঠতে পারে। অর্জুন বলল।

মন্দির? মেজর বিড়বিড় করলেন, আমি মন্দির ফন্দির কোথাও যাচ্ছি না।

অমল সোম বললেন, তা হলে আপনি এই ফোর্ট আগলান। আমরা ঘুরে আসছি।

.

ভানুপ্রসাদ জঙ্গলের রাস্তা ধরে জয়ন্তী-রাজাভাতখাওয়া রোডে চলে এল বেশ দ্রুতগতিতে। জয়ন্তীতে পৌঁছে খোঁজখবর নিতে একটা লোক জুটে গেল! লোকটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দালাল-দালাল ভাব। বলল, পুজো দেবেন? কোনও চিন্তা নেই। আমি মন্দিরের বন্ধ দরজা খুলিয়ে পুজোর ব্যবস্থা করে দেব। মাই নেম ইজ ওয়াংচু!

অমল সোম বললেন, ওয়াংচু? তুমি তো বাঙালি?

নো স্যার। বাংলায় কথা বলি। বাট মাই ফাদার ওয়াজ ভুটানি।

দক্ষিণা কত?

স্যার। মুরগি আর খাসির মাংসের ডিফারেন্স নিশ্চয়ই আপনার জানা। কী আর বলব!

অর্জুন বলল, চলুক ও। কী বলেন?

অমল সোম মাথা নাড়লেন। ওয়াংচু উঠে বসল পিছনে। তারপর তারই নির্দেশমতো গাড়ি চালিয়ে নদী পার হলেন ওঁরা। এখন নদীর বুকে জল নেই কিন্তু গোটা পনেরো লরি দাঁড়িয়ে আছে। তাতে বোল্ডার বোঝাই করছে শ্রমিকরা।

অর্জুন বলল, এখানে জল নেই অথচ নীচে হাঁটুজলে ভাল স্রোত রয়েছে। কীভাবে?

নো প্রবলেম স্যার। দুটো ধারা এক হয়ে গিয়ে হাঁটুজল হয়েছে। তার মানে মাটি ভেদ করে ওঠা স্প্রিং-এর জল মিশেছে। এবার আমরা ইন্ডিয়া পার হয়ে ভুটানে পৌঁছোলাম স্যার। ওয়াংচু যোগ করল, মাই ফাদারল্যান্ড।

তোমার মাদারল্যান্ড নয়? অমল সোম হাসলেন।

নো। মাই মাদার ওয়াজ ইন্ডিয়ান। বাঁ-দিকে ভাই। শেষটা ভানুপ্রসাদকে বলল।

অর্জুন ভুটান এবং ভারতের প্রকৃতিতে কোনও ফারাক দেখতে পাচ্ছিল না। পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ি উঠে যাচ্ছিল উপরে। মিনিট পনেরো যাওয়ার পর মন্দিরটাকে দেখা গেল। গাড়ি থামতে ওয়াংচু নেমে পড়ল আগে। অমল সোম বললেন, চলো, মন্দিরের ভিতরটা দেখে আসি।

অর্জুন বলল, আমি কিন্তু…।

তাকে থামিয়ে দিয়ে অমল সোম বললেন জানি।

ওয়াংচু তাঁদের জুতো খুলিয়ে মন্দিরের ভিতরে নিয়ে যেতে গিয়ে বাধা পেল। একজন ভুটানি পুরোহিত জানিয়ে দিলেন, এখন মায়ের ভোগের সময়। ভোগ শেষ হলে বিশ্রাম নেবেন। দর্শন পাওয়া যাবে বিকেল চারটে থেকে।

ওয়াংচু অনেক চেষ্টা করেও ওঁর মন ভেজাতে পারল না। এই সময় দু’টো গাড়ি উপর থেকে দ্রুত নেমে এসে মন্দিরের সামনে দাঁড়াল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও দুটো পুলিশের গাড়ি কিন্তু পুলিশ শব্দ কোথাও লেখা নেই। একজন ভারিক্কি গোছের লোক, বোঝাই যাচ্ছে বড় অফিসার, এগিয়ে যেতে গিয়ে বাধা পেলেন। তাঁদের একই কথা বললেন পুরোহিত। ভদ্রলোক ঘড়ি দেখে বললেন, ব্যাড লাক!

ওয়াংচু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ স্যার, ব্যাড লাক। এঁরাও এসেছেন ইন্ডিয়া থেকে। দেখতে পাচ্ছেন না।

অর্জুন এগিয়ে গেল। ইংরেজিতে বলল, আমি অর্জুন। একজন সত্যসন্ধানী। ইনি আমার গুরু অমল সোম।

ভদ্রলোক দু’জনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, সত্যসন্ধানী? কোন ফিল্ডে?

অর্জুন হাসল, যে-কোনও ফিল্ডে, যেখানে সত্যকে মিথ্যে দিয়ে আড়াল করা হয়।

ইন্টারেস্টিং! তার মানে আপনারা ডিটেকটিভ?

অমল সোম মাথা নাড়লেন, ডিটেকটিভ শব্দটায় আপত্তি আছে। ও। আপনারা চলুন, আমার সঙ্গে চা খেয়ে যাবেন। চারটের আগে তো মন্দির খুলবে না। আমি এখানে নতুন। কিন্তু আমার টেন্টে ভাল চা আছে। অফিসার বললেন।

অর্জুনের ইচ্ছে ছিল না কিন্তু অমল সোম বললেন, এ তো আমাদের সৌভাগ্য।

ঠিক হল ভানুপ্রসাদ গাড়ি নিয়ে ওখানেই অপেক্ষা করবে।

টেন্টে পৌঁছোতে পঁচিশ মিনিট লাগল। পাহাড়ের অনেকটা উপরে চলে এসেছেন ওঁরা। এখান থেকে শুকনো জয়ন্তী নদী এবং ওপারের ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। গরম একটুও নেই। বোঝাই যায় বিকেল থেকে ভাল ঠান্ডা পড়ে।

টেন্টের বাইরে চেয়ার পেতে দেওয়া হলে অফিসার ওঁদের বসতে বলে চায়ের অর্ডার করলেন। ওঁরা জলপাইগুড়িতে থাকেন শুনে অফিসার বললেন, আমি একবার ফুন্টশলিং থেকে বাগডোগরা হয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম সরকারি কাজে। কখনও জলপাইগুড়িতে যাইনি। আপনারা থিম্পু বা পারো গিয়েছেন?

অর্জুন মাথা নাড়ল, না। যাওয়া হয়নি।

একবার ঘুরে আসুন। এত ভাল প্রাকৃতিক দৃশ্য কম জায়গায় দেখতে পাবেন। এখনও ভিসা-পাসপোর্ট লাগে না। আইডেন্টিটি কার্ড হলেই হয়ে যায়।

চা এল। কাপে চুমুক দিয়ে অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা এদিকে কেন এসেছেন? বেড়াতে, না কোনও সত্যসন্ধান করতে?

বেড়াতেই এসেছিলাম। অমল সোম সম্ভবত এই প্রসঙ্গের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন, আমাদের সঙ্গে একজন আমেরিকান গবেষক ছিলেন। মহিলা একটা গাছের পাতার খোঁজে এসেছিলেন, যা এই অঞ্চলে পাওয়া যায়।

কী করবেন ওই পাতা দিয়ে?

শরীরে সামান্য কেটে গেলে ওই পাতার রস লাগালে জুড়ে যায়। স্টেফির ধারণা, ঠিকমতো ব্যবহার করলে আরও বড় ক্ষত জুড়তে পারে।

ইন্টারেস্টিং!

মুশকিল হল, কাল সন্ধে থেকে স্টেফিকে পাওয়া যাচ্ছে না।

সে কী? কেন?

আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, ও জঙ্গলে পথ হারিয়েছে। পরে জানতে পারলাম, ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।

কীভাবে জানলেন?

কিডন্যাপাররা ইন্ডিয়ান পুলিশকে জানিয়েছে কত টাকা তারা চায়!

আচ্ছা! অফিসার সোজা হয়ে বসলেন।

ভারতীয় পুলিশ অসহায়। কারণ, ওরা ভুটানের জমিতে ক্যাম্প করে আছে। অর্জুন বলল, বর্ডার পেরিয়ে ভারতীয় পুলিশের আসা বেআইনি কাজ হবে।

অফিসার একটু ভাবলেন, সমস্যা আমি বুঝতে পারছি। আমাদের দেশের মাটিকে এরকম অন্যায় কাজে কেউ ব্যবহার করুক তা আমরা চাই না। সমস্যা হল, এখানকার সব খবর থিম্পুতে পৌঁছোয় না। ঠিক কোন জায়গায় ক্যাম্প করা হয়েছে?

সম্ভবত ছাঙ্গুবাড়ি নামে একটা জায়গায়।

ছাঙ্গুবাড়ি? সেখানে তো লোকবসতি নেই। গভীর জঙ্গল। দেশের ভিতর থেকে ওখানে পৌঁছোবার কোনও রাস্তা নেই। বর্ডার থেকে পায়েচলা পথ থাকতে পারে।

সবক’টা ক্যাম্প ওখানেই?

বোধহয় না। স্টেফিকে ওই ক্যাম্পে কাল সন্ধের পরে দেখা গিয়েছে।

অফিসার বললেন, দেখুন, আপনাদের কথা শুনে আমি রাজধানীতে ঘটনাটা জানালে ওদের সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগবে। অথচ আমার উপর অর্ডার আছে কাল সকালেই এখান থেকে পারো যাওয়ার জন্যে। আমার এখানে যে ফোর্স আছে তাদের আমি ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারি না। আবার আপনাদের দেশের পুলিশও বর্ডার পার হতে পারবে না। লেটস টেক এ চান্স! একটু ঝুঁকে নিচু গলায় অফিসার কথা বলতে লাগলেন।

.

অফিসারের পরামর্শমতো ওঁরা ফিরে এলেন নদী পেরিয়ে। ভারত থেকে নদীর এপারে কত গাড়ি আসছে এবং তাদের ক’টা ফিরছে তার হিসেব নিশ্চয়ই উগ্রপন্থীরা জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে করছে। আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় এটা করতে বাধ্য ওরা।

বাংলোয় যখন ফিরে এলেন তখন বিকেল চারটে। গেটের সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওঁদের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে মেজরের সঙ্গে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন বাংলোর বারান্দায়। বেশ ফরসা, মধ্য ষাটের মানুষটির মাথার অনেকটাই চকচকে টাক।

অমল সোমকে নামতে দেখে তিনি উপর থেকেই হাতজোড় করলেন, আপনার ফোন পেয়ে ছুটে এলাম। আমি সুধাংশু!

চিনতে পেরেছি। অমল সোম বললেন, খুব খারাপ লাগছে। লছমন যে কেন এখান থেকে পালাতে গেল!

ও বেশ কিছুদিন ধরেই আমাকে বলছিল এখানে থাকতে চায় না। এরকম জায়গায় কোনও লোক চাকরি করতে আসতে চায় না। তাই ওকে বলেছিলাম, বদলি পেলে সরিয়ে নিয়ে যাব শিলিগুড়িতে। সমস্যাটা আমারই বেড়ে গেল।

পোস্টমর্টেম কবে হবে? অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন।

সদরে পাঠানো হচ্ছে ডেডবডি। হাতিই ওকে মেরেছে। আপনারা এখানে কতদিন থাকতে চান? সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন সুধাংশু।

আমরা একজনের অপেক্ষায় আছি। সে এলেই ফিরে যাব।

একটা অনুরোধ করব? যাওয়ার সময় সব দরজায় তালা দিয়ে যাবেন। চাবি আমার শিলিগুড়ির অফিসে পৌঁছে দিতে যদি অসুবিধে হয়, তা হলে লোকাল থানার ও সি-র কাছে রেখে যাবেন। আমার বাংলোয় এসেছেন অথচ আপনাদের সেবাযত্ন করতে পারছি না বলে খারাপ লাগছে। আচ্ছা, নমস্কার। সুধাংশু চলে গেলেন।

দ্বিতীয় লোকটিকে রেখে কোনও কাজ হল না। সে কিছুতেই ওদিকে যেতে রাজি হল না। তার ভয়, দেখতে পেলেই ওরা তাকে মেরে ফেলবে।

অতএব বাদলকে নিয়ে বসলেন অমল সোম। বাদল যে-কোনও কারণেই হোক, এতদিন উগ্রপন্থীদের দলে ছিল। ওর বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই পুলিশ অনেক অভিযোগ করতে পারবে। ধরা পড়লে আবার জেলে যেতে হবে তাকে, অন্তত সাত-আট বছরের জন্যে। এক্ষেত্রে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র রাস্তা হল, মেমসাহেবকে উদ্ধার করতে সাহায্য করা। এরকম ভাল কাজ করলে তিনি পুলিশকে অনুরোধ করবেন ওর বিরুদ্ধে কোনও মামলা না আনতে।

বাদল মাথা নাড়ল, ওরা খুব ভয়ংকর লোক। সঙ্গে এ কে ফর্টি সেভেন আছে। খালি হাতে কী করে ওদের সঙ্গে লড়াই করবেন?

সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি রাতের অন্ধকারে ওদের চোখ এড়িয়ে আমাদের ছাঙ্গুবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। পারবে?

মাথা নাড়ল বাদল। পারবে।

অর্জুন ওর সঙ্গে বসল। জয়ন্তী থেকে আধমাইল উপরে গিয়ে নদী পেরিয়ে ভুটানে যেতে হবে। নদী পার হতে কুড়ি মিনিট লাগবে। তারপর একটা কাগজে ম্যাপ এঁকে সে বুঝিয়ে দিল ছাঙ্গুবাড়িটা কোথায়!

.

সন্ধের পরে ওঁরা বের হলেন। দ্বিতীয় লোকটার পায়ের দড়ি খুলে দেওয়া হয়েছিল। তাকে থানায় নামিয়ে দেওয়া হল। ও সি অবাক হলেন, এত তাড়াতাড়ি ওকে দিয়ে কী করালেন?

করানো গেল না বলে আপনার হেপাজতে দিয়ে গেলাম। অর্জুন বলল, একটা কথা, যে-কোনও ভারতীয় বেড়াতে বা ধর্মকর্ম করতে ভুটানে যেতে পারে। এ ব্যাপারে আপনাদের আপত্তি নেই বলে জানি। ঠিক কিনা?

কোনও আপত্তি নেই। দু’দেশের মধ্যে পাসপোর্ট-ভিসা এখনও চালু হয়নি।

জয়ন্তী ছাড়িয়ে ওরা যেখানে পৌঁছোল সেখানেই পথের শেষ। এখন চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। অমল সোম বললেন, মিনিটদশেক গাড়িতেই বসে থাকা যাক। কেউ আলো জ্বালাবেন না। গাড়ির হেডলাইট নদীর ওপার থেকেও দেখা যাবে। যদি কেউ লক্ষ করে, তা হলে তাকে বিভ্রান্ত করা দরকার।

রাত দশটায় ওঁরা নদীর নুড়িতে পা দিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর মেজর থমকে দাঁড়ালেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী হল?

স্নেক! ফিসফিস করলেন মেজর।

কোথায়?

আমার জুতোর নীচে। এনি মোমেন্ট ছোবল মারবে।

অন্ধকারে মেজরের পা দেখা যাচ্ছে না। অমল সোম বললেন, আপনি লাফিয়ে সামনে চলে আসুন।

মেজর লাফ দিলেন। তার বিশাল শরীরটা পাথরের উপর আছড়ে পড়তে তিনি আর্তনাদ করেই চুপ করে গিয়ে বললেন, সরি!

উঠুন! অর্জুন বলল।

ইম্পসিবল। আমার পা ভেঙে গিয়েছে। উঃ! মেজর কাতরালেন।

অর্জুন ওঁকে টেনে তুলতেই তিনি বললেন, এজিং। বয়স হচ্ছে। আমি এখন হেঁটে যেতে পারব না। তোমাদের বোঝা বাড়াবার কোনও মানে হয় না। আমি বরং গাড়িতে ফিরে যাই। মেজর পিছন ফিরলেন।

যেতে পারবেন? পা ভেঙে গিয়েছে বলছিলেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

খঞ্জও পাহাড় ডিঙোয়। আই উইল ওয়েট ফর ইউ।

মেজর ফিরে গেলে ওঁরা নদী পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকলেন। ঘণ্টাখানেক পরে অর্জুন দেখতে পেল, পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের মধ্যে একটা আলো পরপর তিনবার জ্বলে নিভে গেল। ওটা যে টর্চের আলো তা বুঝতে অসুবিধে হল না। অফিসারের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল, উনি টর্চের আলো জ্বেলে সংকেত পাঠাবেন। সেইদিকে এগোতে বাদল বলল, ওদিকে না, এদিক দিয়ে যেতে হবে।

কেন?

ছাঙ্গুবাড়ি ক্যাম্প এদিকে।

সরাসরি না গিয়ে আমরা একটু ঘুরে যেতে চাই।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পাহাড়ে ওঠার পর অমল সোম পকেট থেকে টর্চ বের করে পরপর তিনবার আলো জ্বালিয়ে নেভালেন। কোথাও কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

অর্জুন একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে ছিল। অন্ধকার একটু একটু করে পাতলা হচ্ছে। এই সময় মানুষের গলা পাওয়া গেল। দুটো লোক কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। একজন খুব উত্তেজিত। ওরা যে ভাষায়। কথা বলছে তা বোধগম্য হল না অর্জুনের। লোক দুটো দূরে চলে গেলে বাদল এসে দাঁড়াল পাশে, ওর খবর পেয়ে গিয়েছে সাহেব। ওদের একজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে থানায়। এই খবরটা ক্যাম্পে দিতে যাচ্ছে এরা। নিশ্চয়ই নদী পার হয়ে এল।

ক্যাম্পে কারও মোবাইল ফোন নেই?

এখানে ইন্ডিয়ার টাওয়ার কাজ করে না।

অমল সোম আবার টর্চ জ্বালিয়ে সংকেত পাঠাতেই খুব কাছ থেকে গলা ভেসে এল, ওকে! উই আর হিয়ার।

ভুটানের অফিসার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ওঁর পিছনে আরও তিনজন, কিন্তু তাঁদের পরনে সাদা পোশাক। বাদলকে দেখে অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, এ কে?

অমল সোম বললেন, এই লোকটির নাম বাদল। ও ক্যাম্পটা চেনে।

অফিসার বাদলকে জিজ্ঞেস করলেন, ক্যাম্পে কত লোক আছে?

বারো-তেরোজন থাকে। এখন কত আছে জানি না।

অস্ত্র আছে নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ সাহেব। এ কে ফর্টি সেভেন আছে।

অফিসার অমল সোমকে বললেন, আমরা একটু অপেক্ষা করব। আরও রাত বাড়ুক। ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুক। না হলে দশ-বারোজনের সঙ্গে আমরা লড়াই করে জিততে পারব না। চলুন, আর-একটু এগিয়ে যাওয়া যাক।

বাদল ওঁদের পথ চিনিয়ে নিয়ে গেল। এখন অন্ধকার আরও পাতলা হয়ে গিয়েছে।

ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালেই ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ওঁরা যতটা সম্ভব গাছ এবং পাথরের আড়াল নিলেন।

বাদল নিচু গলায় বলল, ওই নিচু জায়গায় গাছের আড়ালে ক্যাম্প।

ক্যাম্পে কোনও আলো জ্বলছে না। জ্বললে গাছের ফাঁক দিয়ে তা দেখা যেত। মাঝে মাঝে হুইলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনটে নাগাদ অফিসার বললেন, নাউ অ্যাকশন নেওয়ার সময় হয়েছে। আপনারা চারধারে নজর রাখুন।

তারপরেই কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগ থেকে একটা কিছু বের করে তাতে চাপ দিয়ে সজোরে ক্যাম্পের দিকে ছুড়লেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত পরে প্রচণ্ড শব্দে পাহাড় কেঁপে উঠল। ইতিমধ্যে দ্বিতীয়বার ছুঁড়েছেন। অফিসার। এবার আরও ওপাশে। শব্দ হল প্রচণ্ড, সেইসঙ্গে আগুনের ঝলকানি। তৎক্ষণাৎ চিৎকার শুরু হল। ক্যাম্পের লোকজন ভয়ে চিৎকার করে চলেছে সমানে। কেউ একজন তাদের ধমকে থামাতে চাইছে। হঠাৎ যেদিকে বোমা ফেটেছিল সেদিক লক্ষ করে গুলি চালাতে লাগল কেউ কেউ। অর্জুন দেখল, অফিসার গ্রেনেড ছুড়লেন ক্যাম্পের নীচ লক্ষ্য করে। একজন চেঁচিয়ে বলল, শেল্টার নাও। ক্যাম্প ছেড়ে তিন নম্বরে চলে যাও সবাই। কুইক। ভুটানি পুলিশ অ্যাটাক করছে।

তারপরেই মেয়েলি গলায় চিৎকার ভেসে এল। ওটা যে স্টেফির গলা তা বুঝতে পারছিল অর্জুন। স্টেফিকে জোর করে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কিন্তু তিনি যেতে চাইছেন না। ঝোঁপঝাড় ভেঙে লোকজন ছুটছে ওপাশে।

অফিসার বললেন, লেটস গো।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অর্জুন অফিসারের সঙ্গে দৌড়োতে লাগল। দু’মিনিট পরেই দৃশ্যটা দেখতে পেলেন ওঁরা। স্টেফিকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে তিনজন লোক। একজন স্টেফিকে চড় মারল। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ওরা জায়গাটা ছাড়তে চাইছিল। স্টেফির আপত্তিতে তাতে বাধা পড়ছিল। অফিসার তৃতীয় ব্যক্তির পা লক্ষ্য করে গুলি চালাতেই সে আর্তনাদ করে পড়ে গেল। যে দু’জন স্টেফিকে ধরে টানছিল তারা ওকে পিঠে তুলতে চাইল। ততক্ষণে অর্জুন আর অফিসার পৌঁছে গিয়েছেন ওদের পিছনে। ভয় পেয়ে ওরা স্টেফিকে নামিয়ে দিতেই স্টেফি দৌড়োলেন পিছনে। লোক দুটোকে ধরে ফেলল অফিসারের লোক। অমল সোম চিৎকার করে ডাকলেন, স্টেফি! কুইক!

স্টেফিকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। অর্জুন তাঁকে খুঁজতে ক্যাম্পের ভিতরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুটে আসতে অর্জুন লাফিয়ে আড়ালে চলে যেতে যেতে বুঝল, অল্পের জন্য বেঁচে গেল এখন। কিন্তু যে লোকটা তখনও ক্যাম্পে থেকে গিয়ে অর্জুনের উদ্দেশে গুলি ছুড়ছিল, সে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে। অর্জুন চিৎকার করল, স্টেফি! কুইক চলে এসো।

নো। এক মিনিট।

ততক্ষণে অমল সোম এবং অফিসার চলে এসেছেন ভিতরে। অফিসার বললেন, মাই গড! ওরা তো রীতিমতো আর্মি ক্যাম্প তৈরি করে ফেলেছিল এখানে।

অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, স্টেফি দেরি করছে কেন?

অর্জুন চিৎকার করল, স্টেফি!

এবার স্টেফি বেরিয়ে এলেন। তাঁর হাতে একটা বড় থলে।

অমল সোম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী আছে ওতে?

ও মি. সোম! আমি পেয়েছি। একদম গাঢ় রঙের পাতা। রিয়েল বিশল্যকরণী পাতা। কাল সারাদিন ধরে এখানে কুড়িয়েছি।

ভগবান! অমল সোম বললেন।

ওঁরা ফিরতে গিয়ে অমল সোম দাঁড়িয়ে পড়লেন। দৌড়ে গেলেন চিত হয়ে পড়ে থাকা একটি মৃতদেহের দিকে। হাত বাড়িয়ে চোখের পাতা বন্ধ করে দিলেন তিনি। অর্জুন দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছিল। গলার পাশে আঙুল চেপে মাথা নাড়ল সে। প্রাণ নেই। কখন মারা গেল বাদল?

অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, সেই লোকটি না?

অর্জুন বলল, হ্যাঁ।

ওর বডি আপনারা নিয়ে যেতে চান?

কোথায় নিয়ে যাব? ওর কেউ কোথাও আছে কিনা জানি না। অমল সোম বললেন, এখানে নিশ্চয়ই আপনাদের পুলিশ আসবে?

আসা উচিত। অফিসার ঘড়ি দেখলেন, এবার আমাদের চলে যাওয়া উচিত। ভোর হতে দেরি নেই। আমাকে পারো যেতে হবে এখনই। কিন্তু মনে রাখবেন, আমি অফিসিয়ালি এখানে আসিনি। ভগবানকে ধন্যবাদ, আমি যে কারণে এসেছিলাম তা তাঁর সাহায্যে সম্ভব হয়েছে। সঙ্গীদের নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেলেন তিনি।

স্টেফিকে নিয়ে ওঁরা নদী পেরিয়ে যখন গাড়ির সামনে পৌঁছোলেন তখন সূর্য উঠেছে। দূর থেকে স্টেফিকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে দু’হাত তুলে চিৎকার করছিলেন মেজর। দৌড়ে ওঁর কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন স্টেফি, আমি পেয়ে গিয়েছি। একদম ঠিকঠাক বিশল্যকরণী!

অল্প দূরে দাঁড়িয়ে অমল সোম বললেন, কিডন্যাপড হয়েছিল, ওরা ওকে মেরেও ফেলতে পারত! কিন্তু সে সব ভুলে মেয়েটা গবেষণার পথে এগিয়ে যাওয়ার রসদ পেয়ে আনন্দে বুঁদ হয়ে আছে। তুমি একে কী বলবে অর্জুন?

পাগল মাত্ৰই জিনিয়াস নয়। কিন্তু জিনিয়াসরা পাগল হয়। অর্জুন হাসল।