৪. এমপ্রেস রেস্টুরেন্টে খাওয়া

০৪.

মারিয়া ওয়ারেনটন এমপ্রেস রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য বেঁকে বসল–আমি ওখানকার বুড়িগুলোকে দেখাতে চাই যে ওদের চাইতে আমার অনেক দামী হীরের গয়না আছে।

-তোমার যা ইচ্ছে। দেওয়ালের গায়ে লাগানো গুপ্ত সিন্দুকটা খুলে উইলবার গয়নার বাক্সটা বার করল। মারিয়া গয়নাগুলো পরার পর উইলবারের মনে হল, না মারিয়াকে সত্যিই মানিয়েছে।

ম্যাগী যখন ব্রাডেকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকল, তাদের উপস্থিতি কেউ তেমন লক্ষ করল না।

একজন ওয়েটার এসে সাহায্য করতে চাইল। ম্যাগী বলল, আমিই একে নিয়ে যাচ্ছি। আমাকে একটা নিরালা দেখে টেবিল দেখিয়ে দাও।

মেনুকার্ডটা ম্যাগী তুলে নিয়ে বলল, আপনি কি খাবেন?

 ওয়েটার বলল আমি সাহায্য করব?

ব্রাডে খিটখিটে বুড়োর গলায় খিঁচিয়ে উঠল, কিছু দরকার নেই। আমি জানি আমি কি খেতে চাই। আমাকে বোকা ভাববার কারণ নেই।

ওয়েটারটি চলে গেলে ম্যাগী বলল তোমার অত রাগারাগি করা উচিত নয়।

–আস্তে, আমি একজন অথর্ব খিটখিটে বুড়ো। তারপর মেনুকার্ড তুলে নিয়ে বলল, কি গলাকাটা দাম। মাছই অর্ডার দাও।

ম্যাগী গোমড়া মুখে বলল, আমি চিকেন মেরীল্যান্ড ভালবাসি।

–আরে দামটা দেখ।

কিন্তু তুমিই তো বলেছে আমরা কোটিপতি হতে যাচ্ছি।

–যদি সফল না হই, তাহলে এই খাবারের দামটা আমার পকেট থেকে যাবে। সুতরাং আমরা মাছই খাব। তারপর চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বলল এড ঠিকই বলেছে, মেয়েগুলো যা হীরে। জহরত পরেছে, তার দাম অনেক হবে।

হঠাৎ একটু শোরগোল উঠল। উইলবার আর মারিয়া রেস্টুরেন্টে এসে ঢুকল। মারিয়াকে অপূর্ব দেখাচ্ছিল। তার গয়নার কাছে অন্য সব হীরে নিষ্প্রভ দেখাল।

-হে ভগবান। ব্রাডে বলে.উঠল। দেখ দেখ মেয়েমানুষটাকে। ওর হীরের কলারটার দামই হবে কুড়ি লাখ ডলার। ব্রেসলেট দুটোর দাম হবে তিরিশ লাখ। আর কানের দুল–ও মোট ষাট লাখ ডলারের গয়না পরে আছে।

ম্যাগী বলল, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি ওটা একটা নষ্ট মেয়েমানুষ।

ওয়েটার এগিয়ে এসে ব্রাডেকে বলল, আর কিছু লাগবে কি, স্যার?

কফি। আর, হ্যাঁ। ঐ যে দুজন এক্ষনি এল, ওরা কারা?

মিঃ এ্যান্ড মিসেস উইলবার ওয়ারেনটন, স্যার। ওয়েটার সসম্ভ্রমে বলল।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখন চিনতে পারছি। ওরা কি এখন থাকছে এখানে?

–হ্যাঁ, প্রায় আরও দিন দশেক থাকবে।

চমৎকার জুড়ি, ব্রাডে বলল।

ঘরে ফিরে যাবার কুড়ি মিনিট পরে মাইক এল, বলল, আমাকে আপনি খুঁজছিলেন।

–তোমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তো?

হা। বাইরের দিকে একটা স্টাফ রেস্টুরেন্ট আছে। খাবারের ব্যবস্থা ভালই। ওখানে একজন সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে আমার আলাপ হল।

–ভাল। হ্যাঁ, আমরা রেস্টুরেন্টে একটা জুড়ি দেখলাম।বউটা অনেক টাকা দামের গয়না পরে। সাবধানে খোঁজনাও ওরা গয়নাগুলো কোথায় রাখে, সিকিউরিটি গার্ডের কাছেরাতে গয়নাগুলোজমা দেয় কিনা। দুজন হাউস ডিটেকটিভ সম্পর্কেও খোঁজ নাও। শুনেছি খুব কঠিন জাতের লোক।

মাইক মাথা নাড়ল। তার ভেতরের যন্ত্রণাটা তাকে অস্থির করে তুলছিল। উঠে দাঁড়িয়ে সহজ হবার চেষ্টা করে বলল, আমি একটু হাওয়া খেতে যাচ্ছি। পরে দেখা করব আর রিপোর্ট দেব।

ব্রাডে তাকে লক্ষ্য করছিল। হঠাৎ তার মনে হল এই কঠোর দর্শন সেনাটির মধ্যে কোন গণ্ডগোল আছে। কপালে ঘাম। গর্তে বসা চোখ। বোধহয় জ্বর হয়েছে। ব্রাডে চিন্তাটা সরিয়ে হীরের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ল।

.

কেবিনে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করল ম্যানুয়েল।

 কি হল?– ভয়ার্ত স্বরে ফুয়েনটেস বলল।

–আমি ওদের, ধাপ্পা দিয়েছি। কিন্তু বেশীক্ষণ খাটবে না। তুমি সাঁতার কাটতে জান?

–হ্যাঁ। কেন?

পুলিশটা সুবিধের নয়। দাঁড়াও,বলে ঘরের আলো নিবিয়ে মাস্তুলের আড়ালে দাঁড়াল ম্যানুয়েল। দেখল, রাস্তার ওপারে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।

ঘরে ফিরে টেরেস বলল–শোন তোমাকে একটু সাঁতার কাটতে হবে। ডান দিকের তৃতীয় বোটটায় যাবে। আমার বন্ধুর বোটে। আমার নাম করবে। তারপর আমার ঘরের আলো নেভানো দেখলে ফিরে আসবে। আমি জানি পুলিশটা সার্চ ওয়ারেন্ট আনতে গেছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমার নৌকায় ওরা সার্চ করবে।

ঘণ্টাখানেক পরে সত্যিই লেপস্কি এসে ম্যানুয়েলের নৌকা ওলটপালট করে দিল। তল্লাশী শেষ হবার পর ম্যানুয়েল ধূর্তের মতন হাসল। এবার আপনার বিশ্বাস হল তো, আমি সত্যি কথা বলার মানুষ। আমার বন্ধু ফুয়েনটেস এতক্ষণ হাভানায় পৌঁছে গিয়ে বউ আর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আনন্দ করছে। ম্যানুয়েলের দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে লেপস্কি চলে গেল। তারও আধঘণ্টা বাদে ফুয়েনটেস ফিরে এল। ম্যানুয়েল বলল, ওরা আর বিরক্ত করবে না। যাও, গিয়ে শুয়ে পড়।

.

মাঝরাতের পর হোটেলের বিশাল রান্নাঘরে প্রচণ্ড কর্মচাঞ্চল্য কমে এসেছে। প্রধান রাধুনী আর তার প্রধান সহকারী বাড়ি চলে গেছে। শেষ খাবারটাও পরিবেশন হয়ে গেছে। কেবলমাত্র তৃতীয় রাধুনী ডোমিনিক রয়ে গেছে। সে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত ডিউটিতে থাকবে। নাইট ক্লাব বা ক্যাসিনো থেকে ফেরা কোন বোর্ডারের যদি খাবার দরকার হয়।

ডোমিনিক ডেজেল কালো বেঁটেখাটো, মোটামুটি সুদর্শন মানুষ। বয়স তিরিশ বছর। এই চাকরীটার সুযোগ সুবিধে ভালই। মনের আনন্দে তাই ডোমিনিক মাঝরাত থেকে ভোর সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত রান্নাঘরের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে রাজত্ব করছিল। মাঝরাতেও তাকে অনেক সময় খাবার পরিবেশন করতে হয়। অবসর সময়টা সে বই পড়ে আর ভবিষ্যতে নিজস্ব একটা রেস্টুরেন্ট খোলর স্বপ্ন দেখে।

আজকের রাতটা শান্ত। ওয়েটার দুজন তাদের ঘরে বসে ঝিমোচ্ছে। ডোমিনিক অফিস ঘরে।

রাত আড়াইটে। খুবনিঃশব্দে অনিতা এসে রান্নাঘরে ঢুকল। সন্ধেবেলায় তার কাজ শেষ হবার পরে সে বেসমেন্টে মেয়েদের বিশ্রামঘরে একটা টয়লেটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। বিশ্রামঘরের সামনের করিডোরটাই রান্নাঘরে চলে গিয়েছে। রাত দুটো কুড়ি মিনিট পর্যন্ত সে অপেক্ষা করল। তারপর বাইরে এসে কান পাতল, হোটেল নিস্তব্ধ। দুজন ডিটেকটিভ যে কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারে।

জোশ প্ৰেশকট নামে ডিটেকটিভটাকে সবাই ভয় করে। আগে লোকটা পুলিশে চাকরীকরত। হোটেলে সে অনেক চুরি-চামারী বন্ধ করেছে। সবাই তাকে ভয় পায়, আর লোকটা চরকির মতন হোটেলে সব জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। রান্নাঘরে, সুইমিং পুল কোথাও সে ছাড়েনা।

অনিতা চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে তাকিয়েছিল। এত জিনিসপত্র আছেওখানে, বোমাটা কোথায় রাখা যায় এমন নিরাপদ জায়গা সে মনে করতে পারল না। তার বুক ধক ধক করছিল। সে রান্নাঘর ছেড়ে ভাড়ার ঘরে ঢুকল। সার সার ময়দা, আটা, ডাল চিনি ইত্যাদির জার বসানো রয়েছে।

হঠাৎ কার পায়ের শব্দ শুনে অনিতা চমকে তাকাল। দেখল ডোমিনিক তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তুমি এখানে কি করছ, অনিতা?

অনিতা জোর করে হাসি আনবার চেষ্টা করল আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম, ডোমিনিক? এই শক্ত সমর্থ জোয়ান মেয়েটির ওপর ডোমিনিকের দুর্বলতা রয়েছে। অনিতাও তা জানে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে খানিক প্রশয়ও দিত যাতে রান্নাঘর থেকে কিছু উদ্বৃত্ত খাবার তার স্বামীর জন্য নিয়ে যেতে পারে।

আজ গভীর রাতে অনিতা ডোমিনিককে খুঁজতে এসেছে শুনে ডোমিনিক গদগদ হয়ে উঠল।

আমার অফিসে এস, ডোমিনিক ধরা গলায় বলল।

অনিতা ডোমিনিকের হাত ধরে অফিসঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবল, পেড্রো আমার প্রিয়, এ সবই তোমার জন্য করতে হচ্ছে। অফিসঘরে ডোমিনিক জোরজবরদস্তি শুরু করল। অনিতা যত সম্ভব এড়াতে লাগল আর সময় নিতে লাগল বোমাটা কোথায় রাখা যায় ভেবে। এমন সময় ঝনঝন করে টেলিফোনটা বেজে উঠল। এতে সম্বিত ফিরে এল ডোমিনিকের। আরে তার চাকরিটাই যাচ্ছিল এই মেয়েটার জন্য। ছিঃ ছিঃ।

অফিসের অপর প্রান্তের একটা দরজা দেখিয়ে ডোমিনিক বলল, ঐ দরজা দিয়ে চলে যাও তাড়াতাড়ি।

খুব বেঁচে গেছে সে,অনিতা ভাবল আর ভগবানকে ধন্যবাদ দিল।দরজাটা খুলে অনিতা দেখল, সামনের করিডরটা রেস্টুরেন্টের দিকে গেছে। সে রাস্তা চেনে। ব্যালেটগুলোর পেছন দিক দিয়ে গিয়ে বড় রাস্তায় নামা যায়। তারপরেই সমুদ্রতীর।

.

দুটো দিন পার হয়ে গেল।

এই দুটো দিন পুলিশ ফুয়েনটেসকে তন্ন তন্ন করে খুঁজল তারপর ভাবল সত্যিই বোধহয় ও হাভানাতে চলে গেছে।

হসপিটালে পেড্রো এখনও অচৈতন্য অবস্থায় রয়েছে। তার ঘরের পাশে সবসময় একজন ডিটেকটিভ পাহারা দিতে লাগল।

অনিতা কাজের ফাঁকে ফাঁকে ম্যানুয়েলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল। বোমাটা সে ময়দার জারের মধ্যে রাখবে ঠিক করেছে। অবশ্য বোমাদুটো এখনও ম্যানুয়েলের হাতে এসে পৌঁছায়নি।

এই দুদিন মাইক আর ম্যাগী ব্রাডের প্রয়োজনীয় খবর জোগাড় করে ফেলেছিল। তাই ব্রাডে হ্যাডনের সাথে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করল। ভাল আর দামী সামুদ্রিক খাবার পাওয়া যায়–ইয়ট ক্লাবের এমন একটা রেস্টুরেন্ট হ্যাডন মিটিং-এর ব্যবস্থা করল।

রাত নটার সময় ব্রাডে তার বৃদ্ধের ছদ্মবেশ খুলে রেস্টুরেন্টে এসে ঢুকল। একটা নির্জন মত টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসল।

খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর হ্যাডন বলল–কেমন চলছে এ পর্যন্ত?

ম্যাগী ভালই কাজ করছে। রিসেপশন ক্লার্কটিকেও বেশ জমিয়ে নিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, এখনও জানতে পারিনি সিন্দুকটা ঠিক কোথায়? তাড়াহুড়ো করতে আমি বারণ করেছি। আস্তে আস্তে রিসেপশন ক্লার্কটির থেকেই আমি তা বার করতে বলেছি। মাইকও গার্ডদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছে। দ্বিতীয় গার্ডটা বেশি চালাক। আর ডিটেকটিভ দুটোও পেশাদার। তারা রাতে সবসময় সজাগ ভাবে পাহারা দেয়।

হ্যাডন বিরক্ত স্বরে বলল–লু মনে হচ্ছে না তো তুমি খুব বেশী এগিয়েছ। একটা একটা দিন যাচ্ছে আর আমার মিটার চড়ছে।

লু ব্র্যাডে বলল-আরে এড আমার কি তোমার জন্য কষ্ট হয় না। তবে তুমিই আমাকে কাজে লাগিয়েছ–তোমাকেই তার দায় নিতে হবে।

হ্যাডন গর্জন করে বলল তার মানে?

 ব্রাডে হাত দেখিয়ে হ্যাডনকে থামাল, সিলাস ওয়ারনেটনের নাম শুনেছ?

 হ্যাডন চোখ বুজে মনে করবার চেষ্টা করল, আরে কে না জানে ওরনাম। কিন্তু ওর কি সম্পর্ক এ ব্যাপারে?

খাওয়া চালিয়ে যেতে যেতে ব্রাডে বলল–ওয়ারেনটনের ছেলে-বৌ এখন এই হোটেলে মধুচন্দ্রিমা যাপন করছে। মেয়েটার সারা শরীর হীরে দিয়ে মোড়া।

উত্তেজনায় হাড়নের হাত থেকে কাটা চামচ পড়ে গেল, ঐ হীরেগুলোর বাজারে দাম হবে আশি লক্ষ ডলার, জান কি? বালা দুল আর ব্রেসলেট, তাই তো?

ব্রাডে মাথা নাড়ল।

ঐ হীরেগুলোর কথা আমি সব জানি। বলে যাও, তারপর?

–ওরা হোটেলে আরও দিন দশেক থাকছে।

শোন, এড, সিন্দুকের কথা ভুলে ওয়ারেনটনের হীরেগুলোর দিকে নজর দিলে কেমন হয়? আর মাইক ব্যানিয়েনকে পছন্দ করে ঠিক কাজ করেছ। লোকটার অব্যর্থ লক্ষ্য–একজন প্রাক্তন সৈনিকের সব গুণই তার মধ্যে আছে। কিন্তু একটা জিনিস আমাকে অবাক করেছে, সে এইসব অপরাধমূলক ব্যাপারে নিজেকে জড়াতে গেল কেন?

–অত চিন্তার কি আছে? তার ভাই তোমার থেকেও বেশী অপরাধী। সে যখন গ্যারান্টি দিচ্ছে, তখন এত দুশ্চিন্তার কি আছে?

-তা ঠিক। তবে দৃষ্টিটা যেন অসুস্থ লোকের দৃষ্টি বলে মনে হয়।

–ওর ভাই বলেছে ওর টাকার দরকার। আমি ব্যানিয়েন সম্পর্কে আগ্রহীনই-হীরের সম্বন্ধে বল। আর কি খবর পেয়েছ?

–ওয়ারেনটন সিন্দুকে গয়না রাখেনা। ঘরের মধ্যে কোন গুপ্ত জায়গায় রাখে। গার্ড মাইককে তাই বলেছে।

-হ্যাডন একটু ভেবে বলল, তুমিবলছসিন্দুকটার পেছনেনা গিয়ে ওয়ারেনটনের হীরেগুলোর দিকে নজর দিতে।

–ঠিক তাই।

তবে আমার মতে তুমি যদি পঞ্চাশ আর আশি লক্ষ জোগাড় করতে পার—

–অর্থাৎ তুমি সিন্দুকের আর ওদের হীরেগুলো দুটোই সরাতে বলছ।

আমি এখনই তা ঠিক বলছি না। তুমি আগে সিন্দুকটা কোথায় আছে খুঁজে বার কর। ইতিমধ্যে আমি কেনড্রিকের সঙ্গে ওয়ারেনটনের হীরেগুলো নিয়ে কথা বলব। আচ্ছা, আগামীকাল রাতে আমাদের এখানেই আবার দেখা হতে পারে। তুমি সিন্দুকের খবর নাও। আর আমি ওয়ারেনটনের হীরেগুলো হজম করা যাবে কিনা খোঁজ নেব।

–ঠিক আছে।

–ঠিক আছে।

কিছুক্ষণ আগে ম্যাগী আর মাইক স্টাফ রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া সেরে গল্প করছিল।

ম্যাগী ব্যানিয়নকে পছন্দ করে। তাকে দেখলে ম্যাগীর ওর বাবার কথা মনে পড়ে যায়।

মাগীর বাবাও সেনাবাহিনীতে ছিল। কিন্তু চুরি করবার অপরাধে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বাবা মারা যাবার পর ম্যাগী এখানে-ওখানে ভেসে বেড়িয়েছে। হরিয়েছে অনেক কিছু। কিন্তু কলগার্লের জীবন যাপন করলেও তার চেহারা কিম্বা ভেতরকার মানুষটা নষ্ট হয়নি। ব্র্যাডে তাকে সোনার হৃদয়ওলা এক মেয়ে ভাবে।

তার মধ্যে এমন একটা সহমর্মিতা আছে পুরুষরা তা সহজেই অনুভব করতে পারে।

মাইকও কথায় কথায় তার মেয়ের কথা বলেছিল। ম্যাগী বলেছিল তার বাবার কথা।

মাইক বলছিল–শুধুমাত্র মেয়েকে বাঁচাতে আমি এই কাজটা করতে রাজি হয়েছি। কাজটা হবে তো?

ম্যাগী বলল- লু হবে বলেই তো বলেছে। তুমি দুশ্চিন্তা কোরনা।

ব্রাডে রাতে ম্যাগীকে জিজ্ঞেস করল–তোমার সাথে রিসেপশন ক্লার্কের সম্পর্ক কেমন চলছে?

-কেন, কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি?

বুড়োর মেকআপ নিতে নিতে ব্ৰাডে বলল–না, না, শোন আজ রাতেই যেন তেন প্রকারেণ ওর কাছ থেকে সিন্দুকের খবরটা নেবে।

ম্যাগী অবাক হয়ে বলল, কি করে তা করব?

–শোন, বলবে তোমার রোগীটি ভীষণ খিটখিটে স্বভাবের। সে মেয়ের জন্য কতগুলি মূল্যধন জহরত কিনেছে। আর তোমার ওপর ভর দিয়েছে হোটেলের সিন্দুক কতটা সুরক্ষিত তা জানার। খবরটা না দিতে পারলে তোমার চাকরী যাবে।

কাল, সকালেও তো জিজ্ঞেস করা যায়।

-না, যদি আজ পারভিনের সঙ্গে রাত কাটাও ও পুলিশের কাছে তোমার নামটা মুখে আনতে পারবে না।

উঃ কি চালাক তুমি লু। সত্যিই তো।

পরদিন একই রেস্টুরেন্টে একই সময় ব্রাডে আর হ্যাডন মিলিত হল।

–হ্যাডন জেনেছো, কোথায়?

–হ্যাঁ, পেন্টহাউসের ওপরতলায়।

–কি করে জানলে?

ম্যাগী রিসেপশনক্লার্কটিকেকজাকরে জেনেছে। শুধু তাই নয়, পারভিন আমাকে সিন্দুকটা দেখিয়েছেও। একটা এলিভেটর সোজা পেন্টহাউসের ওপর তলায় সিন্দুক ঘরে উঠে গেছে। ওয়ারেনটনদের মাথার ওপর। প্রতিদিন রাতে সিকিউরিটি গার্ডরা বোর্ডারদের বাক্সগুলি সংগ্রহ করে ঐ সিন্দুকে রাখে। প্রতিটি বাক্সের একটা করে নম্বর আছে। কাজটা শুরু হয় এগারটা থেকে দুটোর মধ্যে। আরও এক রাতের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে পারভিন আমাদের সিন্দুকটা দেখিয়েছে। সিন্দুকটা সলিড। তবে ওটা আমার কাছে কোন ব্যাপার নয়। সমস্যা হচ্ছে বাক্সগুলো কেমন করে সরিয়ে হোটেলের বাইরে নিয়ে যাব?

হ্যাডন বলল-দাঁড়াও ভাবি। কেনড্রিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওয়ারেনটনদের হীরেগুলো ও পঞ্চাশ লাখ টাকায় ব্যবস্থা করবে। তবে বাক্স থেকে বার করে জহরতগুলোও যাচাই করে নিতে চায়। কেনড্রিকের ওপর সন্দেহ গিয়ে পড়বে। তাই বাক্সগুলো আমি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাব।

ব্রাডে বলল–বাক্সগুলোর কথা ভুলে চল ওয়ারেনটনদের হীরেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাই।

–আরে লু, সিন্দুকটা পেন্টহাউসের উপরেই। আমাদের চোদ্দ আনা কাজ তো হয়েই গেল। এবার, আমাকে সিন্দুকটা আর এলিভেটরের কথা আরও বল।

–এলিভেটরটা সবচেয়ে ওপরতলায়। সেটা আরও একটা তলা ওপরে যায়–অর্থাৎ পেন্টহাউসের ওপরতলায়। এলিভেটারের দরজার সামনে সার্ভিস লেখা আরও একটা দরজা রয়েছে। চাবি দেওয়া। পারভিন চাবিটা খোলে। আমরা এলিভেটরের ভেতরে যাই। এলিভেটরে বোতামের জায়গায় একটা চাবি আছে। পারভিন চাবিটা খুললে এলিভেটরটা সোজা আর একটা তলা উঠেসিন্দুকঘরের ভেতরে থেমে যায়। ঘরটায় কোন দরজা জানলা নেই।তবে ছাদের সিলিং এ একটা ট্র্যাপ ভোর আছে। বোধহয় আগুন লাগলে পালাবার জন্য ঐ দরজাটা।

–একটা বাক্স কি দেখেছ?

হ্যাঁ পারভিন দেখিয়েছে। ওসব তালা খোলা আমার বাঁ হাতের খেল।

ধর যদি কুড়িটা বাক্স থাকে, তোমার খুলতে কতক্ষণ লাগবে।

 –আধ ঘন্টা।

–তাহলে এবার প্ল্যান করা যাক। প্রথমে ওয়ারেনটনদের হীরেগুলো হাতাবে। তারপর সিন্দুকঘরে যাবে।সিন্দুক থেকে বাক্সগুলো বার করে চটপটতার থেকে জহরতগুলো সরিয়ে একটা থলেতে ভরবে। বাক্সগুলো আবার বন্ধ করে সিন্দুকে রাখবে, সিন্দুক বন্ধ করবে। এইভাবে অপারেশনটা হবে। আমি ইতিমধ্যে কেনড্রিকের সঙ্গে কথাবলছি। পরশু রাতে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।

–বেশ তাই হবে, ব্রাডে বলল।

.

আগুনের গোলার মতন সূর্যটা টুপ করে সমুদ্রের জলে ডুবে গেল। চারিদিকে আধার নেমে এল। টেরেস ম্যানুয়েল কাঁধে একটা থলে নিয়ে তার নৌকায় গিয়ে ঢুকল।

–এই তোমার আসা। ফুয়েনটেস চেঁচিয়ে বলল। অপেক্ষা করছি তো করছিই। –বেশ তো, অপেক্ষা করনা। নৌকা থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তা দিয়ে চলে যাও। পুলিশ ছাড়া তোমাকে কেউ আটকাবে না।

ফুয়েনটেস একদম চুপসে গেল।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে ফুয়েনটেস বলল বল, কি খবর?

-ও মারা যাচ্ছে।

–কে পেড্রো? ফুটেনটেস বিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করল।

–আমার হসপিটালের বন্ধুটি বলল, পেড্রো নিশ্চয় করে মারা যাচ্ছে। আর বড়জোর এক সপ্তাহ বাঁচতে পারে।

–তাহলে আমাদের বোমাগুলোর দরকার নেই। ওসব ঝামেলা করতে হবে না।

–কিন্তু অনিতার সাথে আমাদের যা চুক্তি হয়েছে সেই অনুযায়ী পেড্রোকেও আমাদের সাথে হাভানায় নিয়ে যেতে হবে।

-কিন্তু পেড্রো তো মারা যাচ্ছে।

–হ্যাঁ, সুতরাং অনিতা আর আমার মধ্যে আর কোন চুক্তি হতে পারে না।

তার মানে? ফুয়েনটেস চেঁচিয়ে উঠল। ঐ বোকা মেয়েছেলেটার জন্য আমরা পঞ্চাশ লক্ষ ডলার হাতছাড়া করব?

-সেটাই তো আমি ভাবছি। আমি সত্যি কথা বলার মানুষ। অথচ এই পঞ্চাশ লক্ষ ডলার আমার জীবনের অনেক বন্ধ দরজা খুলে দিতে পারে।

আমার অংশের কথাটা তুমি ভুলেই যাচ্ছ। ফুয়েনটেস রাগে গর গর করে উঠল।

ম্যানুয়েল তার সবুজ রঙের চোখে ভাবলেশহীন ভাবে ফুয়েনটেসের দিকে তাকাল। ভুলিনি। তুমি দশ লক্ষ পাবে।

–তাহলে কি ঠিক করলে?

ম্যানুয়েল উদাসীনের মতন বলল–মেয়েটাকে আমায় মিথ্যে বলতে হবে। এরজন্য আমি নিজের কাছে নীচ হয়ে যাব। কিন্তু টাকার ব্যাপারটা তুচ্ছ করতে পারছি না। যদিও হৃদয়ে একটা ক্ষতস্থান থেকে যাবে মেয়েটাকে ঠকাবার জন্য।

–তাহলে বোমাগুলোর কি দরকার হবে?

–নিশ্চয়ই। অনিতার কাছে আমাদের এই অভিনয়গুলো চালিয়ে যেতেই হবে।

আমাদের পিতলের দরকার হবে।

সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

 হঠাৎ অনিতা দরজা ঠেলে ঢুকল। তাকে দেখে মনে হয় সে অসুস্থ।

 ম্যানুয়েল নিজেকে সামলে নিয়ে বলল- ভাল খবর আছে।

অনিতা সঙ্গে সঙ্গে বলল কার, পেড্রোর? পেড্রো কেমন আছে?

–আমার বন্ধুটি বলল পেড্রো এত ভাল আছে যে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সে নড়তে-চড়তে পারবে।

–আমার বিশ্বাস হয় না, অনিতা রুদ্ধশ্বাসে বলল। নানা–আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

অ্যান্টিবায়োটিক অসাধ্য সাধন করে। অনিতার থেকে চোখ সরিয়ে ম্যানুয়েল বলল-পেড্রো চমৎকার ছেলে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সে একটা কথাও বলেনি। সে তোমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে।

অনিতা ছুটে গিয়ে পাশের ঘরটায় ঢুকে পড়ল। ঘর থেকে তার কান্নার আওয়াজ আসতে লাগল। ম্যানুয়েল চোখ বুজে ভাবলচল্লিশ লক্ষ ডলার তার এই বুকের ক্ষতটাকে মিলিয়ে দিতে পারবে তো?

ম্যানুয়েল শুনতে পেল অনিতা কান্নাবিজড়িত গলায় ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে। আরও দশ মিনিট পরে অনিতা বেরিয়ে এল। সেই দৃঢ় সতেজ মুখ। ম্যানুয়েল ভাবল এই মেয়ে আমাদের। পেন্টহাউসে ঠিক ঢোকাতে পারবে।

–আর দেরী করছ কেন? অনিতা বলল।

–হ্যাঁ, ড্রয়ার থেকে সেলোফেন কাগজে মোড়া নোমা দুটো বার করল ম্যানুয়েল। ছোটো বোমাটা সিগারেট প্যাকেটের আকারে। শোন, অনিতা ছোটটা তুমি হোটেলের লবীতে রাখবে। বড়টা রান্নাঘরে। আশাকরি বড়টা ব্যবহার করতে হবে না।

বোমা দুটো নিয়ে অনিতা বলল–আমি বোমা দুটো লুকিয়ে রাখব। আমার ওপর নির্ভর করতে পার। অনিতা ম্যানুয়েলের হাতের উপর হাত রেখে বলল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। ফুয়েনটেসকে আমি বিশ্বাস করিনা। লোকে বলে তুমি সত্যবাদী। ম্যানুয়েল তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল- সব ঠিক হয়ে যাবে। তাঁর নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছিল।

প্রতিটা মানুষেরই কোন না কোন দুর্বলতা আছে, যেমন ছিল স্প্যানিস বে হোটেলের নাইট ডিটেকটিভ জোশ প্রেসকটের। সে ঘড়ির কাঁটা মেনে চলে। কিন্তু সে নারীদের প্রতি আকৃষ্ট।

লোকটা বিপদজনক জানার পর মাইক তার সময় তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে যে প্রেসকট রাত একটার সময় হোটেলের করিডোর দেখে। রাত একটা চল্লিশ মিনিটে সে হোটেলের লবি আর রেস্টুরেন্টে যায়। দুটোর সময় রান্নাঘর। দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে সে হোটেলের পার্ক আর সুইমিং পুল ঘুরেফিরে দেখে। লোকটার প্রতিদিনের কর্মসূচী এদিক ওদিক হয়না। ব্যানিয়েন ব্রাডেকে খবরটা জানিয়ে দিল।

তাই আজ রাত দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আলো ঝলমল কিন্তু জনপ্রাণী শূন্য সুইমিং পুলের জলে নেমে পড়ল ম্যাগী। জলপরীর মতন সে সাঁতার কাটতে লাগল। সেই সময় প্রেসকট এসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।

দূর থেকে জলের শব্দ পেয়ে প্রেসকট ছুটে সুইমিং পুলের ধারে এসে বিকিনি পরা ম্যাগীকে সাঁতার কাটতে দেখল। নির্জন রাতে ম্যাগীকে এই অবস্থায় দেখে সে প্রায় পাগল হয়ে গেল।

ব্রাডের শেখানো মত ম্যাগী তাকে ইশারা করে সিঁড়ির কাছে চলে এসেনা-উঠতে পারার ভান করল। প্রেসকট তাড়াতাড়ি এসে তার হাত ধরল। আড়াল থেকে সব দেখে ব্রাডে তাড়াতাড়ি হোটেলের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আপাততঃ কমসেকম আধঘন্টার মতন প্রেসকটকে আটকিয়ে রাখবে ম্যাগী।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে ব্রাডে ওপরতলায় সার্ভিস লেখা দরজাটার কাছে পৌঁছে গেল। এখান থেকে এলিভেটরে চড়ে সে সিন্দুকঘরে যাবে।

সিন্দুকঘরে পৌঁছে সে টর্চ জ্বালিয়ে সিন্দুকের তিনটি তালা পরীক্ষা করে দেখল। না, কোন সমস্যাই নেই। একটা ইস্পাতের তার বেঁকিয়ে নিলেই হল। সে ট্র্যাপ-ডোরটা খুলে মই বেয়ে উঠে বাইরে মাথা বাড়াল। পেন্টহাউস থেকে আলো আসছে। দেখতে পেল মারিয়া হীরের গয়নাগুলো পড়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্রাডে আলোর ঝলমল করা হীরেগুলোর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

উইলবার একটা ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে এসে ছবি তুলল। তারপর দুজনেই ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

সময় এখন দুটো পঞ্চাশ মিনিট। এরও পাঁচ মিনিট পর ব্রাডে ঘরে ফিরে এল। তারও কুড়ি মিনিট পর ম্যাগী ফিরে এল।

-কেমন আটকিয়ে রেখেছি।

বাঃ চমৎকার। কিন্তু আগামীকাল?

এদিকে ম্যাগী বলল–আমার সঙ্গে কথা হয়ে আছে। ব্রাডে হাসল। আগামীকাল আমরা কাজটা সারছি।

.

 অনিতা তার কালো সুইট সার্ট আর কালো ট্রাউজার্স পরে সবার অলক্ষ্যে হোটেলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সে সুইমিং পুলের ধার দিয়ে গিয়ে স্টাফদের প্রবেশপথের দিকে এগোল। কিন্তু হলের কিনারায় প্রেসকটকে দেখে সে প্রমাদ গুনল। তারপরেই দেখল প্রেসকট ম্যাগীকে হাত বাড়িয়ে উপরে ওঠাচ্ছে। সে ছুটে কর্মচারীদের প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ডুপ্লিকেট চাবির, সাহায্যে সে দরজা খুলে করিডর বেয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোল।

ওয়েটার দুজনকে বসার ঘরে সকালের প্রাতঃরাশের জন্য ডিশ সাজাতে ব্যস্ত দেখল। কিন্তু ডোমিনিক কোথায়? দেখল অফিসঘরে বসে ডোমিনিক একমনে বই পড়ছে।

চট করে সে ভাড়ার ঘরে ঢুকে ময়দার জারের ঢাকনীটা খুলল। তারপর হাত ঢুকিয়ে ময়দার ভেতর গর্ত করে বোমাটা ঢুকিয়ে দিল। তারপর সাবধানে ময়দার ওপরের ভাগটা সমান করে দিল। একটা ঝাড়ন দিয়ে ভাল করে হাত মুছে ভাড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

প্রায় দৌড়ে সে হোটেল লবীতে পৌঁছে গেল। জনপ্রাণী নেই কোথাও। প্রেসকট কোথায় গেল? সে বোমাটা রাখার জন্য পাগলের মতন একটা জায়গা খুঁজতে লাগল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল প্রবেশদ্বারের কাছেই একটা কাঠের খোদাই করা মেক্সিকান মেয়ের মূর্তি। অনিতা মুর্তিটার, একটা খাঁজে বোমাটা ঢুকিয়ে দিল। ছোট বোমাটা ঠিক খাপ খেয়ে গেল। অনিতা বাইলে এল।

পেছনে এবার সে পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল-অনিতা। অন্ধকার ফুঁড়ে ম্যানুয়েল অনিতার সামনে দাঁড়াল। সব ঠিক আছে?

অনিতা কেঁপে উঠল। নিজেকে সামলিয়ে বলল, বলেছিলাম তো কাজটা করব। করেছি।

–একটা ঝরঝরে লিংকনের দরজা খুলে দিল ম্যানুয়েল। উঠে পড়।

–পেড্রোর খবর নিয়েছো?

ম্যানুয়েল তার হাঁটুতে চাপড় দিয়ে বলল–সব চমৎকার। পরশু তাকে জেল হাসপাতালে ভর্তি করা হবে।

-সত্যিই কি ও এত ভাল আছে?

–যা বলবার তো বললাম। এবার তোমার কথাগুলো বল। বোমাগুলি কোথায় লুকিয়েছে।

অনিতার নিজেকে অনেক হাল্কা লাগছিল। তারা কী সত্যিই সফল হবে? পেদ্রোকে নিয়ে সে হাভানার পথে পাড়ি দিতে পারবে। অধীর-উত্তেজনায় ও প্রত্যাশায় তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল।

ম্যানুয়েল অনিতার কথাগুলো শুনছিল বটে, কিন্তু মনের গভীরে কেউ তাকে বলে যাচ্ছিল ম্যানুয়েল তুমি এই সরল মেয়েটাকে, যে নাকি তার স্বামীকে পাগলের মতন ভালবাসে তাকে তুমি ঠকাচ্ছ।

ম্যানুয়েল প্রাণপনে নিজেকে বোঝাতে লাগল–পঞ্চাশ লাখ ডলার। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল ফুয়েনটেসের কথা। ঐ অপদার্থটাকে কাটাতে হবে। ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দেবে। ওকে সরাতে কোন অসুবিধাই হবে না। পঞ্চাশ লাখ ডলার পেলে সে জীবনে আর কোন অসৎ কাজ করবে না।

অনিতার ফ্ল্যাটবাড়ির কাছে গাড়ি থামাল ম্যানুয়েল। তাহলে আগামীকাল?

–হ্যাঁ। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি ম্যানুয়েল।

ম্যানুয়েলের মনে আবার একটা কাঁটা খচখচ করে উঠল। সে আস্তে করে বলল, তুমি তোমার স্বামীকে ফেরৎ পাবে অনিতা।

.

সকালে ব্রাডে বৃদ্ধের ছদ্মবেশ পরে হুইল চেয়ারে বসে একটা ইস্পাতের টুকরো, তাঁর প্রয়োজনের যন্ত্রে রূপান্তরিত করছিল। সামনে বসে মাইক তাকে লক্ষ্য করছিল।ম্যাগী সাঁতার কাটতে গেছে।

গতকাল রাতে ম্যাগী ব্রাডেকে মাইকের মেয়ের কথা বলেছে। শুনে খুবই অভিভূত হয়েছে। ব্রাডে।

মাইক বলল–ওটা দিয়ে কি হবে?

-ইস্পাতের এই টুকরো দিয়েই সিন্দুক খুলব। আজ রাতেই। মাগী আমাকে তোমার মেয়ের কথা বলেছে। শুনে আমি খুবই দুঃখ পেয়েছি। খুবই করুণ ব্যাপার। তোমার টাকাটা তুমি পেয়ে যাবে, মাইক। তোমার কোন দুশ্চিন্তা হচ্ছে?

-না না, আপনি যখন বলছেন কোন সমস্যা হবে না, আমি মিছিমিছি দুশ্চিন্তা করতে যাব কেন? বলতে বলতে হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল মাইক। তার মুখ সাদা হয়ে গেল।

ব্রাডে তাকে লক্ষ্য করছিল–তুমি অসুস্থ মাইক। তাই না? দেখ আমি তোমাকে পছন্দ করি। কিন্তু এই কাজটায় একজনের যদি সামান্য ভুলও হয় তাহলে সবাই আমরা ডুবে যাব। মাগীর দায়িত্ব হোটেল ডিটেকটিভকে সামলান। তোমার দায়িত্ব সম্ভাব্য কোন প্রতিরোধকারীকে দেখলে তাকে মোকাবিলা করা। আমার দায়িত্ব সিন্দুক খোলা এবং ওয়ারেনটনদের হীরেগুলো হাতানো। কিন্তু তোমাকে যে অসুস্থ লাগছে, মাইক?

মাইক কয়েকমুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর বলল, আমি আগামী ছমাসের মধ্যে মারা যাব। আমার টারমিনাল ক্যানসার হয়েছে।

ব্রাডে শিউরিয়ে উঠল। টারমিনাল ক্যানসার।

মাইক বলল, আমার নিজের জন্য কোন চিন্তা নেই। আমার মেয়ের জন্য আমি সব করতে পারি। তুমি চিন্তা কোরনা। তোমাকে ডোবাব না।

না, মানে কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিনা। ধর রাতে কাজে নামার পর তোমার যন্ত্রণা শুরু হল। সত্যি কথা বল মাইক। তুমি যদি বোঝ, কাজটা পারবে না, আমরা কাজটা ছেড়ে দেব। আমি কোনমতেই জেলে যেতে চাই না। ম্যাগীও জেলে যাক, আমি তা চাইনা। ভগবানের দোহাই, মাইক। বল কাজটা তুমি পারবে?

মাইক দৃঢ়স্বরে ব্রাডের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, আমি তোমায় ডোবাব না। আমার কাছে যন্ত্রণা কমাবার ওষুধ আছে। আমি আজ রাতে ওষুধ খেয়েই কাজে নামব। আমি কথা দিচ্ছি, তুমি যা বলবে আমি অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করব।

ব্রাডে মাইকের কথা শুনে আশ্বস্ত হল।

.

সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ম্যানুয়েল তার নৌকো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেবিনের বাংকে শুয়ে ফুয়েনটেস টেরেসের কাজকর্মের শব্দ শুনতে পেল। তার বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। পুলিশ রয়েছে আশেপাশে।

ম্যানুয়েল ঘরে ঢুকে বলল, আমার নৌকো তৈরী। আজ রাতেই কাজটা করব আমরা। তারপর কয়েকদিনের মধ্যে হাভানার দিকে রওনা হব। ঐ নৌকোয় থাকবে পঞ্চাশ লক্ষ ডলার আর আমাদের বন্দী উইলবার ওয়ারেনটন। কেউ আমাদের থামাতে সাহস পাবে না।

চমৎকার, চমৎকার।

–তুমি সর এখান থেকে। আমাকে চিন্তা করতে দাও।

ফুয়েনটেস কেবিনে ফিরে এল। উঃ সে দশ লাখ ডলারের মালিক হবে। কত কি করা যাবে ঐ টাকাটা দিয়ে। একটু পরে ম্যানুয়েল ঘরে ঢুকল। চল আমরা খাব।

খাওয়া দাওয়া চুকলে ম্যানুয়েল বলল, শোন বন্ধু। কাজটার মধ্যে অনেক সমস্যা আছে। ধর, একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ম্যানুয়েল বলল আমরা অনিতার ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে পেন্টহাউসে ঢুকব। এটা প্রথম ধাপ। তারপর দুজনকে বেঁধে উইলবারের বাবাকে ফোন করব। তার বাবা পঞ্চাশ লাখ ডলার জোগাড় করবে। এতে কিছু সময় নেবে। একশ ডলারের নোটে নেব ঐ টাকাটা। তার মানে অনেকগুলো টাকা। তাকে বলা হবে পুলিশের কাছে যেতে, যদি সে ছেলে-বউয়ের জীবন চায়। এ পর্যন্ত সমস্যা হবেনা। আমরা তাকে বলব তার ছেলেকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি। হাভানার উপকূলে তাকে আমরা ছেড়ে দেব। এরপর তুমি তোমার টাকার ভাগটা নেবে। আমিও আমার ভাগ নেব। তারপর দুজনেই অন্য কোথাও চলে যাব। পুলিশ না থাকাতে সমস্যাও হবে না।

–তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

তুমি পেড্রোর বউ অনিতার কথা ভুলে যাচ্ছ।

–আরে, ও বাড়াবাড়ি করলে আমি ওর গলা কেটে ফেলব।

–তখনই পুলিশ এসে মাথা গলাবে। কোন হত্যা-টত্যা চলবে না। অনিতাকে খুন করলে লাসটা কোথায় সরাব?

–তাহলে নৌকোয় তোলার পর তাকে খুন করব।

–আরে অনিতা সাধারণ মেয়ে নয়। ওর স্বামী ছাড়া ও নৌকোয় উঠবে না। এদিকে লোকটা হয় মরছে নয় ইতিমধ্যেই মারা গেছে।

ফুয়েনটেস হতাশায় হাত ছুঁড়ল। তার স্কুল মাথায় আর কোন উপায় আসছিল না। –তাহলে আমরা করবোটা কী?

সমস্যা একটাই। এটা না সমাধান করতে পারলে আমাদের হাতে টাকা আসবেনা। টেবিলে একটা ঘুষি মেরে ম্যানুয়েল বলল, সমস্যাটার একটা সমাধান করতেই হবে।

ফুয়েনটেস চুপ করে রইল আর ম্যানুয়েলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ম্যানুয়েল স্বগতোক্তির মতন বলে উঠল, না আমাকে মিথ্যে বলতেই হবে যে ওর স্বামীকে আমরা নৌকোয় আনবোই। তারপর সে যদি তার স্বামীকে না পেয়ে বেঁকে বসে তাহলে তাকে তোমার হাতে ছেড়ে দেব। ম্যানুয়েল অসহায়ের মতন তার মাথায় হাত দিয়ে বলল আমার। জাতভাইরা বলে আমি সত্যের মানুষ। এরপর আমার এ নামের ওপর অধিকার থাকবে না। কিন্তু জীবনের এতগুলো বছর আমি সত্যের মানুষই ছিলাম।

ম্যানুয়েলের স্বগতোক্তি শুনে ফুয়েনটেসের হঠাৎ মনে হল, এই লোকটা যদি সত্যকে বিসর্জন দিয়ে দলের একজনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, তাহলে আমার সাথেও তো করতে পারে। আমার দশ লাখ এর হাতে কি নিরাপদ? নৌকোয় উঠে টেরেস যদি অনিতাকে তার হাতে ছেড়ে দেয়–সেখানেই কি ব্যাপারটা শেষ হবে। মাথায় লাঠি মেরে সে যদি ফুয়েনটেসকেও হাঙ্গরের ভোজ হবার জন্য জলে ফেলে দেয়? ভেবে শিউরে উঠল ফুয়েনটেস। ম্যানুয়েল ফুয়েনটেসকে দেখছিল না। সে তার হাতের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছিল, হে। ভগবান, আমাকে মিথ্যে বলতে হবে। আমাকে ক্ষমা কর।