উদভ্রান্তের মতো বনে জঙ্গলে পাহাড় পর্বতে ঘুরে বেড়ালাম। তারপর যখন সম্বিৎ ফিরে এলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। শান্তি ফেরাতে পুনরায় শিবিরে গেলেও ওড়াতে পারলুম না। কারণ ইতিপূর্বেই আমার নাম ফেরারীদের তালিকায় উঠে গেছে। এই সাময়িক অন্তর্ধানের কোনো সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ আমার জানা নেই। তখন থেকে আমি কেবল পালিয়ে পালিয়েই বেড়াচ্ছি। ক্রিস্টোফার এক জোড়া শূন্য হতাশ চোখে মলির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তোমার ধারণাটাই সম্পূর্ণ ভুল। সান্ত্বনার সুরে মলি বললো, তুমি আবার নুতন করে সব কিছু আরম্ভ করতে পারো।
কারোর পক্ষেই কি তা আর সম্ভব? নিশ্চয়! তাছাড়া তুমি তো এখনও যুবক! তোমার বয়সও কম।
হ্যাঁ তা ঠিক। তবে আমি একবারে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। সব কিছুই আজ আমার নিঃশেষ হয়ে গেছে।
নাঃ, দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালো মলি। তোমার কিছুই ফুরিয়ে যায়নি। এর সমস্তটাই তোমার কল্পনাপ্রসূত। আমার বিশ্বাস, প্রত্যেকের জীবনেই একবার করে এই ধরনের একটা অনুভূতির জোয়ার আসে। তখন মনে হয়, দিগন্ত জুড়ে গভীর অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। পায়ের নিচে মাটিটুকু তো আর খুঁজে পাব না। সবকিছুর চরম পরিসমাপ্তি বুঝি আসন্ন।….
তুমি নিশ্চয় কোনো এক সময় এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলে? তা না হলে তো এত নিখুঁত ভাবে বর্ণনা দিতে পারতে না?
অকপটে মাথা দুলিয়ে বলল–হ্যাঁ, তা হয়েছিলাম বৈকি।
তোমার সমস্যাটা কি ছিলো?
সমস্যাটা যদিও কিছু নতুন নয়। অনেকের ভাগ্যেই সেরকম ঘটতে দেখা গেছে। আমি যে যুবকটির বাগদত্তা ছিলাম সে একজন পাইলট ছিল। আগের যুদ্ধে সে মারা যায়।
শুধু এই…আর কিছু নয়তো?
সে বলল–হ্যাঁ, আরো আছে। ছেলেবেলায় আমি একটা প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পাই। আমাকে হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তখন থেকেই একটা বিরূপ ধারণা ছিল বুকের মধ্যে। জ্যাকও যখন তারপর দুর্ঘটনায় মারা গেল, তখন মনে হল–সমস্ত জীবনটাই বুঝি এইরকম ক্রুর বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা ছিল। মানুষের কোনো স্বপ্নই সত্যি হয় না।
হা…পেরেছি বুঝতে। আর তারপরে বুঝি… রেন মলির দিকে চোখ তুলে প্রশ্ন করল জিলের সঙ্গে বুঝি পরিচয় হল?
মলির পাতলা ঠোঁটে হাসির রেখা ছড়িয়ে গেল। বলল–হ্যাঁ এবং জিলের আসার সঙ্গে সঙ্গে নতুনভাবে যেন আমার জীবনটা বইতে শুরু করল। এ যেন সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। আগের যাবতীয় ভয় আর দুর্ভাবনা কোথায় যেন একমুহূর্তে মিলিয়ে গেল। জিল নামটার মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে সুখ আর নিরাপত্তার আস্বাদ।
তার ঠোঁট থেকে যেন হঠাই হাসির রেখাটুকু মিলিয়ে গেল। চোখে মুখে দেখা গেল ঝড়ের পূর্বাভাস। প্রচণ্ড ঠান্ডার জন্যও তার শরীরটা বারকয়েক কেঁপে উঠল।
সে বলল–সত্যিকারের ঘটনাটা কি? কিসের জন্য তুমি এত বিচলিত হচ্ছো মলি? সত্যিই তুমি মনে মনে খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। বল কথাটা ঠিক কিনা?
মলি আস্তে করে মাথা নেড়ে বলল–হ্যাঁ। জিলের সঙ্গে নিশ্চয় কিছু-এর সম্পর্ক আছে? ও কি তোমায় কিছু বলেছে বা এমন কোনো কাজ করেছে…
না আসলে জিল নয়। ওই লোকটা…ওই লোকটা ভয়ঙ্কর…
ক্রিস্টোফার চমকে উঠে বলল–কাকে তুমি ভয়ঙ্কর বলছো? প্যারাভিসিনি?
মলি বলল-না না, সার্জেন্ট ট্রেটার!
রেন বল সার্জেন্ট ট্রেটার?
মলি বলল-হা, ওই ভদ্রলোকই ইঙ্গিত করলেন এমন কতগুলো ব্যাপার…জিলের ব্যাপারে এমন কতগুলো বাজে ধারণা ঢুকিয়ে দিলেন আমার মাথায়। আমি কোনোদিন সে সমস্ত বিষয়ে চিন্তা পর্যন্ত করিনি! এমন কি তাদের অস্তিত্বের কথাও জানা ছিল না আমার! লোকটি সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর। ঘৃণা করি আমি…এই ধরনের লোকদের ভীষণ ঘৃণা করি আমি…
চিন্তার ভাঁজ পড়ল ক্রিস্টোফারের ভূ দুটিতে। বিস্ময়ের আভাস ছিল তার কথার সুরে। জিল? …জিল। হ্যাঁ দুজনেই আমরা প্রায় সমবয়সী। যদিও ওকে বয়সে কিছুটা বড় দেখায় তবে তা নয় আসলে। হ্যাঁ, ঠিকই। জিলের সঙ্গেও নাকি অনেক মিল আছে অজ্ঞাত হত্যাকারীর। তবে মলি–এ সব চিন্তা খুবই হাস্যকর। ভিত্তিহীন অলীক কল্পনামাত্র। কারণ, কার্লভার স্ট্রীটে যেদিন ওই মেয়েটা মারা যায়, সেদিন জিল সারাক্ষণ তোমার সঙ্গেই ছিল এখানে?
মলি চুপ করে রইল। তার আড়ষ্ট চোখমুখ। মলির ভাবগতিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করল ক্রিস্টোফার। বলল–তবে কি জিল এখানে ছিল না?
মলি এবার উত্তর দিল। জড়িত গলায় বলল– সেদিন সারাক্ষণই জিল বাড়ীর বাইরে ছিল। খুব সকালেই সে বেরিয়েছিল গাড়ী নিয়ে। আমি জানতাম, শহরের অপরদিকে একটা নিলাম ঘর থেকে ও কিছু তারের জাল কিনতে গেছে। সেই কথা জানিয়ে গিয়েছিল আমাকে। এর মধ্যে এতটুকু অবিশ্বাস ছিল না, কিন্তু…
রেন প্রশ্ন করল–সেখানে কি ও যায়নি?
মলি ম্লানমুখে এগিয়ে গেল টেবিলটার দিকে, তারপর টেবিলের ওপর থেকে দুদিনের আগের ইভনিং স্ট্যাণ্ডার্ডটা তুলে আনল।
ক্রিস্টোফার কাগজটা সাগ্রহে নিয়ে বলল–এটা তো দেখছি দুদিনের পুরনো একটা লণ্ডন সংস্করণ?
জিল যখন ফিরে এলো তখন এই পত্রিকাটা ওর কোটের পকেটে ছিলো।
তাহলে…তাহলে ও নিশ্চয় লণ্ডনে গিয়ে থাকবে।
ক্রিস্টোফারের দৃষ্টিতেও সন্দেহের ছায়া। একবার মলির দিকে আর একবার কাগজটার দিকে ফিরে তাকালেন ক্রিস্টোফার।
ঠোঁট বেঁকিয়ে শিস্ দিতেও শুরু করলেন মৃদু সুরে। পরমুহূর্তে সংযত করলেন নিজেকে। এখন ওই সুরটার উপযুক্ত সময় নয়।
মলির চোখের দিকে একবারও না তাকিয়ে এবং খুব সুনির্বাচিত শব্দ সাজিয়েই তিনি তার বক্তব্যটা উপস্থিত করলেন।
কতটুকু জানো জিলের সম্বন্ধে তুমি?
থামো…থামো, চুপ করো!
আর্ত সুরে চেঁচিয়ে উঠলো মলি।
শয়তান ট্রেটারও আমাকে এই একই প্রশ্ন করেছিলেন।
অথবা এমন ধরনেরই একটা কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। বললেন, মেয়েরা প্রায়শই কিছু না জেনে সম্পূর্ণ অপরিচিত অজ্ঞাত কুলশীল কোনো পুরুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। তাদের পূর্ব জীবন সম্বন্ধে তাদের স্ত্রীদের সঠিক কোনো ধারণা থাকে না।
যুদ্ধের সময়েই এমন ঘটনা বেশি ঘটে।
কেবলমাত্র পুরুষদের মুখের কথা বিশ্বাস করেই মেয়েরা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তিনি খুব একটা মিথ্যে বলেননি। এ ধরনের অনেক কাহিনীই ইদানীং শোনা গেছে।
তুমিও আবার এই একই কথা বলতে শুরু করো না।
আমি আর সহ্য করতে পারছি না! আমরা ভাগ্যচক্রে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি বলেই এই সমস্ত চিন্তা-ভাবনা মনের মধ্যে উদয় হচ্ছে। যত অবিশ্বাস্যই শোনাক না কেন, যে কোনো অশুভ ইঙ্গিতই এখন আমরা অতি সহজে বিশ্বাস করে নেবো।
কিন্তু সেটা সত্যি নয়…আদপেই সত্যি না! আমি…
আচমকাই মলির বাক্যস্রোত মাঝপথে রুদ্ধ হয়ে এলো। ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হলো ভেজানো দরজাটা, ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল জিল।
থমথমে মুখ চোখ। তোমাদের অন্তরঙ্গ আলাপ-আলোচনায় কোনোরকম বাঁধা দিলাম না তো?
বিশেষ কাউকে উদ্দেশ না করেই তির্যক কণ্ঠে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো জিল।
রেন অপ্রস্তুতভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি আপনার মিসেসের কাছ থেকে কয়েকটা রান্নার টুকিটাকি শিখে নিয়েছিলাম।
তাই নাকি? ভালো ভালো!…দেখুন মিঃ রেন বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের আজগুবি গল্প করে বেড়ানো খুব একটা উচিত নয়। দয়া করে আপনি এখন রান্নাঘর থেকে বাইরে যান… কি আমার কথাটা কি আপনার মাথায় ঢুকল না?…
হ্যা..নিশ্চয়!
আর একটা কথা মনে রাখবেন। মলির কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন। আমার স্ত্রী পরবর্তী শিকার হোক, এটা আমি চাই না!
ক্রিস্টোফার শান্ত গলায় বলল– সেইজন্যই, আমি মনে মনে এত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছি।
এই সহজ কথাটার মধ্যে কোনো গূঢ় অর্থ আছে কিনা, সেটা গ্রাহ্য করল না জিল। তার মুখচোখ আরো পাঁশুটে হয়ে উঠল। জিল কঠিন স্বরে মন্তব্য করল–চিন্তা-ভাবনার দায়িত্বটা আমার উপর ছেড়ে দেন না কেন! আমিই আমার স্ত্রীকে দেখাশোনা করতে পারবো। যদি ভালো চান তো এখান থেকে আপনি চলে যান!
মলি নিবেদন জানাল–দয়া করে তুমি চলে যাও রেন!
রেন দরজার দিকে এক পা-এক পা করে এগোলেন। এগোতে এগোতে বলে গেলেন– তবে আমি কাছাকাছি আছি। তার এই বক্তব্যটা যে যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ সেটা বলাবাহুল্য।
জিল অধৈৰ্য্য ভঙ্গিতে বলল–আপনি কি যাবেন দয়া করে?
ক্রিস্টোফার শিশুর মত সরল হাসি হেসে বলে-হা…হ্যাঁ, কম্যাণ্ডার, নিশ্চয়… তিনি বাইরে বেরিয়ে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিলেন। সোজাসুজি জিল এবার ফিরে তাকালো মলির দিকে। তারপর বলল–মলি, তোমার কি একটুও কাণ্ডজ্ঞান নেই? ওই খুনে পাগলটার সঙ্গে ঘর বন্ধ করে বসে আছো?
বক্তব্যটা গুছিয়ে নিয়ে মলি বলল–তবে ওই লোকটা খুব একটা ভয়ঙ্কর প্রকৃতির নয়, তাছাড়া আমি নিজেই খুব সাবধান হয়ে আছি। যে কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতির সঙ্গে আমি মোকাবিলা করতে পারব।
জলি মুচকি হেসে বলল–মিসেস বয়েলও এই একই কথা বলেছিলেন।
মলি বিরক্ত সুরে বলল–ও…জিল, আবার তুমি সেই একই কথা বলতে শুরু করেছ?
আমি দুঃখিত মলি, কিন্তু সব কেমন যেন আমার গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। এই বাজে প্রকৃতির লোকটির মধ্যে তুমি যে কি এমন দেখলে আমি তো বুঝতে পারছি না।
মলি শান্তস্বরে বলল–ওই লোকটার জন্য আমার কষ্ট হয়।
জিল বিদ্রূপ সুরে বলল–একটা খুনে পাগলার জন্য সমবেদনা? মলি এবার অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল জিলের দিকে।
তারপর বলল–হ্যাঁ, একটা খুনে পাগলার জন্য আমার মনে সমবেদনা জাগতে পারে!
শুনলাম তুমি ওকে ক্রিস্টোফার বলেই ডাকছিলে। এতটা ঘনিষ্ঠতা কি করে হলো?
মলি রেগে গিয়ে বলল–জিল, বোকার মত কথা বলো না, আজকাল সবাই সবার নাম ধরে ডাকে, সেটা তুমি ভালোভাবেই জানো!
হ্যাঁ, জানি, তবে তার জন্য সময় লাগে দু-চারদিন। এক্ষেত্রে যেন একটু তাড়াতাড়ি মনে হচ্ছে। সম্ভবতঃ তুমি ক্রিস্টোফার রেনকে আগে থেকেই চিনতে। ভদ্রলোক যে মিথ্যে পরিচয়ে এখানে আসবেন তা আগে থেকে ঠিক করা ছিল। আসলে তাকে তুমিই হয়ত ডেকেছিলে। এটা নিশ্চয় তোমাদের দুজনের কারসাজি।
মলি অবাক চোখে জিলের দিকে তাকিয়ে বলল–জিল তোমার কি বুদ্ধি কি লোপ পেতে শুরু করেছে? তোমার কথার মানে কি?
জিল বলল–আমার কথার মধ্যে এমন কোনো জটিলতা নেই। আমি বলতে চাই ক্রিস্টোফার রেনের সঙ্গে তোমার অনেকদিনের পুরনো পরিচয়। এবং কোনো কারণে তোমাদের এই পরিচয়টা আমার কাছে গোপন করতে চাও।
মলি বলে নিশ্চয় তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
জিল বলে–এই পুরোন পরিচয়ের কথা যে তুমি আমার কাছে গোপন করবে তা আমি জানি। তবে একটা নির্জন হোটেলে রেনের হঠাৎ আবির্ভাবটাও কেমন আশ্চর্যজনক যোগাযোগ বলে মনে হয়।
মেজর মেটকাফ…
কিংবা মিসেস বয়েলের চেয়েও বেশি আশ্চর্যের?
অবশ্যই! আমি অন্তত সেই রকমই মনে করি। তাছাড়া বইয়ে যা পড়েছি–এই সমস্ত উন্মাদ প্রকৃতির খুনিদের নারীর প্রতি একটা তীব্র মোহ থাকে।
এখানেও প্রমাণ পাওয়া গেছে।…
আচ্ছা তোমাদের কি ভাবে পরিচয় হলো? এর ইতিহাসই বা কতদিনের?
তোমার কথাবার্তা ক্রমেই পাগলের প্রলাপে গিয়ে পৌঁছেছে, জিল।
এখানে আসবার আগে ক্রিস্টোফার রেনের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয়ই ছিলো না।
তুমি কি দুদিন আগে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে লণ্ডনে গিয়েছিলে? অপরিচিত অতিথি হিসাবে এই হোটেলে এসে আশ্রয় নেবার ব্যাপারেও নিশ্চয় তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো?
তুমি নিশ্চয় জান ভালোভাবে, আগের কয়েক সপ্তার মধ্যে আমি লণ্ডনে যাইনি।
তাই বুঝি? খুবই আশ্চর্যের কথা! জিল পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা পশমের দস্তানা বের করল। তারপর বলল–গত পরশু এই দস্তানাটাই তো ছিল তোমার হাতে–আমি যেদিন তারের জাল কিনতে সেলহ্যামে গেলাম?
তীব্র অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো মলি, সেদিন বাইরে বেরোবার সময় আমি ওই দস্তানাটাই পরেছিলাম।
তুমি আমাকে জানালে, জরুরী প্রয়োজনে তোমাকে গ্রামের দিকে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তুমি গ্রামের গেলে তো এটা এলো কোথা থেকে? ক্ষুব্ধ চিত্তে গোলাপী মাথা নেড়ে মলির দিকে বাড়িয়ে ধরলো জিল।
ক্ষনেকের মধ্যে বোবা হয়ে গেল মলি, তুমি লণ্ডন গিয়েছিলে, তাই না? প্রশ্ন করলো জিল।
হা, গিয়েছিলাম। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো মলি। তার দু গালে রক্তিম আভা।
আমি এখান থেকে লণ্ডনেই চলে যাব।
ক্রিস্টোফার রেনের সঙ্গে দেখা করেছে?
না না, ওসব কোনো ব্যাপারই নয়।
তবে কি জন্যে?
মলি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল,–এই মুহূর্তে তোমায় আমি তার উত্তর দিতে রাজি নই।
তার অর্থ একটা বিশ্বাস যোগ্য গল্প বানাবার সময় চাইছো।
এই তো? তুমি… তুমি এত নিচ জিল!
উত্তেজনায় মলি গলা কাঁপিয়ে বলল, আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
আমি অবশ্য করি না, কিন্তু করতে পারলেই যেন স্বস্তি পেতাম।
এখন মনে হচ্ছে…, তুমি আমার কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত, অপরিচিত… তোমার সম্বন্ধে প্রায় কিছুই আমি জানি না।
আমার বক্তব্যও ঠিক তাই।
তুমি আমার জীবনে একজন বিদেশী আগন্তুক ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার কাছে নির্দ্বিধায় মিথ্যে বলতেও তোমার বাধে না…।
আমি কখন তোমাকে মিথ্যে বলেছি?
মলির ঠোঁটের ফাঁকে রুগ্ন হাসি ফুটে উঠলো।
তুমি কি ভাবছো আমি তোমার এই তারের জাল কিনতে আসার আষাঢ়ে গল্প সত্যি বলে বিশ্বাস করি?
ওই একই দিনে তুমিও লণ্ডনে গিয়েছিলে।
তুমি নিশ্চয় আমাকে কোথাও দেখেছিলে? ক্লান্তকণ্ঠে জিল বললো, এবং আমার ওপর এইটুকু বিশ্বাসও তোমার নেই যে…।
তোমাকে বিশ্বাস!
আমি আর কোনোদিনই কাউকে বিশ্বাস করবো না… কখনও না।
ইতিমধ্যে কিচেনের ভেজানো দরজাটা যে নিঃশব্দে ঈষৎ ফাঁকা হয়েছিলো, দুজনের কারোরই সেটা নজরে পড়েনি।
মৃদু শব্দে কেশে উঠলেন প্যারাভিসিনি।
পরিবেশটা সত্যিই বেশ অস্বস্তিকর! বিব্রত কণ্ঠে মন্তব্য করলেন তিনি।
আমি আশা করি, তোমাদের এই মনোমালিন্যটাও তেমন গভীর নয়।
যুবক যুবতীদের দাম্পত্য কলহে এমন অনেক অবাঞ্ছিত প্রসঙ্গেরই অবতারণা ঘটে থাকে, যাকে হালকা ভাবে গ্রহণ করা উচিত।
জিল তীব্র স্বরে বলে উঠল–দাম্পত্যকলহ? খুব ভালো বলেছেন কথাটা।
প্যারাভিসিনি মাথা নেড়ে বললেন–হ্যাঁ নিশ্চয়, তোমাদের তরুণ মনের ভেতরে যে আলোড়ন চলছে তা আমি বুঝতে পারছি। কারণ একসময় তোমাদের এই বয়সটা আমি পার হয়ে এসেছি। এবং আমার স্ত্রীও খুব মুখরা ছিল। কিন্তু আমি যা এখন বলতে এসেছি তা হল এই যে, ইনসপেক্টর ট্রেটার আমাদের সকলকে ড্রইংরুমে যেতে বলছেন। কথাবার্তা শুনে মনে হল ভদ্রলোকের মাথায় নতুন কোনো পরিকল্পনা এসেছে। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–পুলিস কোনো সূত্র পেয়েছে তা প্রায়ই শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু পুলিসের মাথায় কোনো পরিকল্পনা এসেছে একথা কেউ শুনেছে বলে তো আমার বিশ্বাস হয় না। আমাদের এই পুলিস অফিসার সার্জেন্ট ট্রেটার খুবই জেদী এবং পরিশ্রমী এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তেমন একটা তার বুদ্ধি আছে বলে তো মনে হয় না।
মলি বলল–জিল, তুমিই হয় যাও আমার এখনও রান্না বাকি আছে। সম্ভবতঃ সার্জেন্ট ট্রেটার তার কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন।
প্যারাভিসিনি বলল,–রান্নার কথাই যখন উঠলো আপনি কি কখনও রুটির টুকরোর উপর মুরগীর মেটে ছড়িয়ে তার ওপর যকৃতের তেল দিয়ে ভাজা শুয়োরের মাংস আর রহিসরষের মোটা প্রলেপ দিয়ে কখনও টোস্ট তৈরি করেছেন? ওঃ, সে কি অপূর্ব খেতে।
জিল রুক্ষুকণ্ঠে জবাব দিল-যকৃতের তেল এই বাজারে খুব একটা পাওয়া যায় না। আসুন মিঃ প্যারাভিসিন।
আমি কি এখান থেকে আপনাকে সাহায্য করবো কোনোভাবে ম্যাডাম?
জিলের কণ্ঠে বাজল অন্য সুর– তার কোনো প্রয়োজন হবে না। আপনি আমার সঙ্গে ড্রয়িংরুমেই চলুন। প্যারাভিসিনি মুচকি হাসলেন। বললেন– আপনার স্বামী ভয় পাচ্ছেন আমাকে। যদিও এটাই স্বাভাবিক। তিনি আমাকে আপনার সঙ্গে একা রাখতে চান না। সম্ভবতঃ আমার এই অদ্ভুত চেহারাটাই দায়ী এজন্য। তবে তিনি যে অসম্মান করছেন আমায়, তা কিন্তু নয়। এবং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি যেতে চাই না। ভদ্রলোক কথাটা বলে আড়ম্বর সহকারে বিদায় নিল।
মলি অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলে উঠল–মিঃ প্যারাভিসিনি নিশ্চয় আপনি….
প্যারাভিসিনি ডান ও বাঁদিকে মাথা ঘুরিয়ে জিলকে উদ্দেশ্য করে বললে– সত্যিই আপনার মাথায় বেশ বুদ্ধি ধরেন মিঃ ডেভিস। কোনোরকম সুযোগ নেওয়ার পক্ষপাতি আমি নই। আমি কি আপনার ও ট্রেটারের কাছে নির্দোষিতার প্রমাণ দাখিল করব। আমি যে একজন খুনে উন্মাদ নই, আপনারা কি সেকথা বিশ্বাস করবেন? কিন্তু তা সম্ভব হবে কিভাবে? নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা খুবই কষ্টসাধ্য…।
ভদ্রলোক কথা থামিয়ে আস্তে আস্তে শিস্ দিতে শুরু করল।
মলি অস্বস্তি সুরে বলল, দোহাই আপনার। দয়া করে আর ওই সুরটা বাজাবেন না।
তিনটে ইঁদুর অন্ধ–ছড়ার এইগুলো কথাই তো তাই না? এখন আমি এর মানেটা বুঝতে পারি। খুবই ঘৃণ্য নিষ্ঠুর লেখা। নার্সারির পদ্য হিসাবেও এর কোনো সাহিত্যিকগত মূল্য নেই। গ্রাম্য কবির নিষ্ঠুর মানসিকতাই প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠেছে। কিন্তু বাচ্চারা অনেক সময় এই নিষ্ঠুরতা পছন্দ করে। সেইজন্য তারা মনে রাখে ছড়াটা। তিনটে অসহায় ইঁদুরের শোচনীয় এই অবস্থাই তাদের মনে আনন্দের খোরাক জোগায়। সেই শেষ দৃশ্যটার দৃশ্য খুবই করুণ, চাষীর বউ একটা ধারালো কঁচি দিয়ে ইঁদুরের লেজগুলো কেটে দিচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় তিনটে অন্ধ ইঁদুর ছটফট করছে। ব্যাপারটা দেখতে খুব একটা ভালো লাগে না। কিন্তু বাচ্চারা এতেই আনন্দ পায়।
মলি ক্ষোভ ও হতাশার সুরে বলে উঠল–মিঃ প্যারাভিসিনি আমার একান্ত অনুরোধ, এ ধরনের আলোচনা আপাততঃ এখন আপনি বন্ধ করুন। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি খুবই নিষ্ঠুর আর পৈশাচিক। মলির মুখটা আস্তে আস্তে রাগে রাঙ্গা হয়ে উঠল। তাকে একজন রুগী ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। গলার সুরটা যেন আজ অন্য সুরে বাজছে। সে আবার বলতে শুরু করল–আপনি তো সারাক্ষণ শুধু হেসেই বেড়াচ্ছেন। আপনাকে মনে হচ্ছে দেখে আপনি যেন একটা বেড়ালসর্বদা আমাদের মত ইঁদুরের সঙ্গে আপনি খেলা করছেন।
কথা থামিয়ে জোরে জোরে হাসতে থাকে মলি।
জিল বলল–মলি শান্ত হও। চলো আমরা না হয় ড্রয়িংরুমে একসঙ্গে যাই। নিশ্চয় ট্রেটার খুব বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। রান্নাবান্না পরে করলেও চলবে। খুনের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলাই এখন জরুরী।
প্যারাভিসিনি যেতে যেতে মন্তব্য করলেন–আমি আপনাদের সাথে যেতে না পারার জন্য দুঃখিত। ফাঁসির আসামীরা তাদের প্রাতঃরাশটা খাওয়ার সময় উপভোগ করে!
রেনের সঙ্গে দেখা হল বড় হল ঘরটায়। জিল কটাক্ষ দৃষ্টিতে একবার তাকে দেখল। কিন্তু মলি তার দিকে একবারের জন্যও তাকালো না। দৃষ্টি সামনে রেখে সে সোজা এগিয়ে গেল। দলটা যেন মৌন শবযাত্রার লাইনের মত হেঁটে চলল।
সার্জেন্ট ট্রেটার ও মেজর মেটকাফ ড্রয়িংরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। মেটকাফের মুখে একটা চাপা রাগের ছাপ ফুটে উঠেছে। ট্রেটার কিন্তু বেশ প্রাণচঞ্চল।
ট্রেটার সমবেত দলকে আহবান জানালেন–আসুন আসুন…, আমি সকলকেই একসঙ্গে দেখতে চাই। এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে একটা ছোটখাটো পরীক্ষা করতে চাই–আর সেইজন্য সকলেরই সাহায্য আমার দরকার।
মলি ট্রেটারকে প্রশ্ন করল–এরজন্য খুব বেশি সময় লাগবে? আমার কিন্তু এখনও রান্না বাকি আছে। লাঞ্চের ব্যবস্থাটাতো ঠিকমতো সারতে হবে।
ট্রেটার মাথা দুলিয়ে বললহা তা তো ঠিক, আমি আপনার কথা মানছি। কিন্তু মিসেস ডেভিস বর্তমান পরিস্থিতিতে একবেলা খাওয়ার দিকে মন না দিয়ে এই হত্যারহস্যের উপর দৃষ্টি দেওয়া আমাদের সকলের উচিত। মিসেস বয়েলের কথাটা একবার ভাবুন তো! তার কিন্তু আর কোনো খাবারের প্রয়োজন হয়নি।
মেটকাফ রেগে গিয়ে বললেন সার্জেন্ট, আপনার কথাবার্তাগুলো কিন্তু শুনতে খুব একটা ভালো লাগে না। কোনো ভদ্রমহিলার সামনে এভাবে কথা বলা উচিত নয়।
ট্রেটার বললেন মেজর মেটকাফ, এরজন্য আমি খুবই দুঃখিত। তবে এই ব্যাপারে আমি সবার কাছ থেকেই সহযোগিতা আশা করছি।
মলি প্রশ্ন করল–আপনার স্কী দুটো খুঁজে পেয়েছেন?
সার্জেন্টের চোখে যেন দপ করে আগুন জ্বলে উঠল– বলল–না এখনও পাইনি, তবে কে এটা চুরি করছে, এবং তার চুরি করার কারণটাই বা কি সে ব্যাপারে আমি বুঝতে পারছি। অবশ্য এ ব্যাপারে আমি এখন কিছু বলব না।
প্যারাভিসিনি অনুরোধের সুরে বললেন-দোহাই আপনাকে বলতে হবে না, এই সব কথা শেষের পরিচ্ছদে বেশ মানায়। উত্তেজনাটা তাহলে বেশ উপভোগ করা যায় ভালোভাবে।
এটা কোনো নাটক নভেলের গল্প নয়, আমরা কেউই এখানে খেলা করতে আসিনি।
সত্যিই কি তাই? আমার মনে হয় কোথাও আপনি ভুল করছেন, আসলে এটা তো একটা রঙ্গমঞ্চই অন্ততঃ একজনের কাছে তো বটেই।
মলি বিড়বিড় করে নিজের মনে বলল–বর্তমান হত্যাকারী এই পরিবেশটা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করছে।
প্রত্যেকের দিকে মলি একবার তাকালেন। তার মুখটা আবার লাল হয়ে উঠল। সে বলল- এটা আমার কথা নয় কথাটা বলেছিলেন সার্জেন্ট ট্রেটার। তিনি আমাকে এই কথাটা বলেছিলেন।
কথাটা যে ট্রেটারের খুব একটা ভালো লাগল তার মুখ দেখে তা মনে হল না। সে বলল — আপনার কথাবার্তা শুনে বেশ ভালো লাগে মিঃ প্যারাভিসিনি, ঠিক যেন কোনো রহস্য নাটকের দৃশ্য। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন এর প্রতি মুহূর্তেই লুকিয়ে আছে বাস্তব। সমস্ত কিছুই বর্তমানে ঘটে যাচ্ছে।
রেন মৃদু হেসে বললেন–তবে যতক্ষণ না ব্যাপারটা আমার ঘাড়ের উপর টের পাচ্ছি—
ট্রেটার এবার গলা ঝাড়া দিলেন। তার চালচলনের মধ্যে আনলেন একটা পুলিসোচিত দৃঢ়তা।
কিছুক্ষণ আগে আমি আপনাদের কাছ থেকে একটা কথা শুনেছি। মিসেস বয়েল যখন মারা যান তখন সে সময় আপনারা কে কোথায় ছিলেন–ওই কথা থেকে জানা যায়–মিঃ রেন ও মিঃ ডেভিস তাদের নিজের নিজের শোবার ঘরে ছিলেন, মিসেস ডেভিস ছিলেন রান্নাঘরে। মেজর মেটকাফ তখন মাটির নিচে গুপ্ত ঘরের সন্ধান পান। এবং মিঃ প্যারাভিসিনি বসে বসে পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন।
ট্রেটার একটু চুপ করে সকলের দিকে একবার তাকালেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, আপনা নিজেরাই আমাকে এই কথাগুলো বলেছেন। তবে এগুলোর সত্যতা যাচাই করার সুযোগ আমার কাছে নেই। আপনাদের এই কথা সত্যিও হতে পারে আবার মিথ্যেও হতে পারে। স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে এটাই বলতে হয় এই কথাগুলোর মধ্যে চারটে কথা সত্যি কিন্তু একটা মিথ্যে– কিন্তু প্রশ্ন কোন্ কথাটা মিথ্যে?
তরুণ সার্জেন্ট সকলের মুখের ওপর তার কুটিল দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলে। তবে কেউ কোনো উত্তর করল না।
আপনাদের মধ্যে সত্যি কথা বলেছেন চারজন আর একজন ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমটাকে আবিষ্কার করার জন্য আমি এই সুন্দর পরিকল্পনা করেছি তার ফলে সত্যিকারের হত্যাকারীর সন্ধান পাওয়া যাবে।
জিল তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করল–মিথ্যেবাদীকেই যে হত্যাকারী হতে হবে তেমন কোনো কথা নেই। অন্য কোনো বিশেষ কারণে কেউ মিথ্যে কথা বলতে পারে!
এক্ষেত্রে তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই মিঃ ডেভিস।
কিন্তু আপনার পরিকল্পনাটাই বা কি সার্জেন্ট? একটু আগেই বললেন যে কথাগুলোর সত্য মিথ্যে যাচাই করার মত আপনার কোনো সুযোগ নেই!
ট্রেটার মাথা দুলিয়ে বলল–তা নেই ঠিকই তবে আপনারা প্রত্যেকেই যদি অতীতের এই ভূমিকাটা আরেকবার অভিনয় করে দেখান…
মেজর মেটকাফ বিদ্রুপের সুরে বললেন, বাঃ অপরাধের পুনর্বিন্যাস! পদ্ধতিটাও যদিও সম্পূর্ণভাবে বিদেশী!
ট্রেটার বলল–মেজর আপনি ভুল করছেন, এটা ঠিক অপরাধের পুনর্বিন্যাস নয়। কিছু নিরাপরাধ ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট ভূমিকাটুকু আবার অভিনয় করা।
কিন্তু এর থেকে আপনি কি জানতে পারবেন বলে মনে হয়?
কিছু মনে করবেন না, এ ব্যাপারে এখন আমি কিছু বলতে পারব না।
মলির কণ্ঠে তীব্র বিস্ময়ের সুর শোনা গেল–আপনি কি আমাদের ওই সময়ের ঘটনাটুকু অভিনয় করে দেখাতে বলছেন।
ট্রেটার বললেন– হ্যাঁ, অনেকটা সেইরকমই?
ঘরের মধ্যে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল, সবাই যেন অস্বস্তিকর পীড়ায় ভুগছে।
মনে মনে মলি ভাবল–এটা একটা ফঁদ। সত্যিই পরিকল্পনা মাফিক ফাঁদ। কিন্তু কিভাবে এই ফাঁদটা কার্যকরী হবে…
ড্রয়িংরুমের এইরকম পরিস্থিতি দেখে মনে হয় যেন পাঁচজনই অপরাধী। প্রত্যেকেই যেন খুশিমনে তরুণ সার্জেন্টের দিকে অস্বস্তিভরা চাউনিতে বারবার তাকাতে লাগল। যে তাকানোর মধ্যেও ছিল একটা গোপন উত্তেজনার চাঞ্চল্য। সবার আগে ক্রিস্টোফারই চেঁচিয়ে উঠল, বলল কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না…এর সাহায্যে আপনি কি করতে চান অথবা যদি আগের ঘটনাটা অভিনয় করে দেখাই তাহলে সমাধানটাই বা কি হবে? এ সমস্ত অবাস্তব ধ্যান ধারণা!
মিঃ রেন সত্যিই কি তাই?
জিল আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে বলল–হ্যাঁ, নিশ্চয়, আপনার বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি সার্জেন্ট। আমরা এব্যাপারে সকলেই আপনাকে যতটা পারি সাহায্য করব। আমরা ওই সময় কে কি কাজ করছিলাম আমাদের সেই কাজই করতে হবে, তাই তো?
ট্রেটার বলল–হ্যাঁ আপনি ঠিক বলেছেন। আমি আরেকবার দেখতে চাই।
ট্রেটারের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মেজর মেটকাফ। ট্রেটার সেদিকে গ্রাহ্যই করল না। প্যারাভিসিনিকে লক্ষ্য করে বললেন, মিঃ প্যারাভিসিনি আপনি তো পিয়ানোতে একটা গানের সুর তুলছিলেন তাই তো? আপনি তখন ঠিক কি করছিলেন দয়া করে একবার দেখাবেন?
প্যারাভিসিনি দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়ে পিয়ানোর সামনে টুলের ওপর বসলেন। তিনি মুচকি হেসে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন- এই প্রাণহীন পিয়ানোর ভেতর থেকে এখুনি মৃত্যুর সুর ভেসে আসবে। সকলে মন দিয়ে শুনুন। সেই বিখ্যাত সুর তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
যথারীতি পিয়ানোর সাদা কালো রীডের ওপর হাত দিলেন তিনি।
ভদ্রলোক বেশ উপভোগ করছেন ব্যাপারটা মলির তাই মনে হল। সত্যিই তিনি বেশ সয়ে সয়ে উপভোগ করছেন ব্যাপারটা।
বড় ড্রয়িংরুমের মধ্যে এই সুরটা যেন একটা মাদকতা নিয়ে এল সকলের বুকের ওপর দিয়ে যেন একটা শিহরণ লেগে যাচ্ছে।
সার্জেন ট্রেটার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন– ধন্যবাদ, মিঃ প্যারাভিসিনি, ঠিক এটাই জানতে চাইছিলাম। আগের বারেও আপনি এই একইভাবে বাজাচ্ছিলেন?
সে উত্তর দিল, হ্যাঁ সার্জেন্ট। একেবারে এইরকম। এবং মাত্র তিনবার আমি এই লাইনটা করেছিলাম।
মলির দিকে তাকালেন ট্রেটার, বললেন মিসেস ডেভিস আপনি পিয়ানো বাজাতে পারেন?
মুখে কিছু না বলে শুধু সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল মলি, মিঃ প্যারাভিসিনি যেভাবে দেখালেন, সেভাবে নিশ্চয় সুরটা ফোঁটাতে পারবেন?
মলি বলল–খুব ভালোভাবেই পারব?
ট্রেটার বললেন, তাহলে আপনি এই টুলের ওপর গিয়ে বসুন এবং আমার বলামাত্র আপনি বাজানোর জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
মলির মুখের পর যেন একটা বিভ্রান্তির ছায়া ফুটে উঠল। তারপর পায়ে পায়ে বিপরীত দিকে পিয়ানোর দিকে এগিয়ে গেল।
প্যারাভিসিনি একটি বিরক্তি ভঙ্গিতে টুল ছেড়ে দাঁড়ালেন। তার গলায় শোনা গেল মৃদু প্রতিবাদের সুর– কিন্তু সার্জেন্ট আমার ধারণা ছিল– আমরা সবাই যে যার নিজের ভূমিকাটাই দুবার পালন করব। আমি তো সেইসময় পিয়ানোই বাজাচ্ছিলাম।
ট্রেটার বলল হ্যাঁ আগের কাজ একই থাকবে তার কোথাও কোনো বিচ্যুতি হবে না। তবে একই ব্যক্তির দ্বারা যে তা পালিত হবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
জিল আবার বিড়বিড় করে বলল এর পেছনে যে কি উদ্দেশ্য আছে তা তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
এর পেছনে সুনির্দিষ্ট একটা কারণ ঠিক আছে মিঃ ডেভিস। প্রত্যেকেরই কথাটুকু যাচাই করার জন্য এই একটাই পথ আমি বলতে চাই। তাহলে আমি আপনাদের ভূমিকাটুকু জানিয়ে দিচ্ছি। মিসেস ডেভিস এখানে এই পিয়ানোর কাছে আপনি অপেক্ষা করুন। মিঃ রেন, আপনি রান্নাঘরের দিকে যান দয়া করে, মিসেস ডেভিসের রান্নাবান্নার দিকে একটু নজর রাখবেন। আপনাকে মিঃ রেনের শোবার ঘরে যেতে হবে, মিঃ প্যারাভিসিনি। সেখান থেকে আপনি ঐরকম শিস্ দিতে থাকুন। ওই সুরটাই ফুটিয়ে তুলবেন। সুরটা তো খুব প্রিয় আপনার। মেজর মেটকাফ, আপনি মিঃ ডেভিসের শোবার ঘরে টেলিফোনের লাইনটার দিকে লক্ষ্য রাখবেন আর মিঃ ডেভিস সিঁড়ির দিকে কাঠের আলমারির পাশ দিয়ে অন্ধকার গুপ্তকক্ষের দিকে এগিয়ে যান।
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বললেন না, তারপর চারজনই কোন কথা না বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। ট্রেটারও তাদের পেছন পেছন গেল।
ট্রেটার বলল–মিসেস ডেভিস আপনি এক থেকে পঞ্চাশ গুনুন। গোনা শেষ হলেই পিয়ানোয় হাত দেবেন।
ট্রেটার ফের সকলের পেছন পেছন চলল। দরজাটা জোরে বন্ধ হবার আগে প্যারাভিসিনির হতচকিত কণ্ঠস্বর মলির কানে ভেসে এলো।
পুলিস যে কখনও আবার এই ধরনের ছেলেখেলায় মেতে ওঠে, সে কথা জন্মে কোনোদিন শুনিনি।
আটচল্লিশ…উনপঞ্চাশ…পঞ্চাশ… গোনা শেষ করে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো মলি।
তারপর বাধিত ভঙ্গিতেই সাদা কালো রীডগুলোর ওপর ঝুঁকে পড়লো।
তার নরম আঙুলের মৃদুস্পর্শে যেন প্রাণ ফিরে পেলো পিয়ানোটা।
প্রশস্ত ড্রয়িংরুমের মধ্যে এমন একটা ক্রুর নিষ্ঠুর ছন্দই শুধু বুকে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সুরটা।
তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
জানলা কপাট বন্ধ…
মলির মনে হলো তার হৃৎস্পন্দনও বুঝি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে ক্রমশ শিরায় শিরায় অস্তির এক উত্তেজনা। শরীরের সমস্ত রক্তকণিকাও যেন নাচতে শুরু করেছে তালে তালে। দেখা যাচ্ছে প্যারাভিসিনি যা বলেছিলেন।
মিথ্যা নয়।
বরঞ্চ তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এই ছড়াটার মধ্যে এক ধরনের ক্রুর নিষ্ঠুরতা আছে। এবং মনের ওপরও এর প্রভাব খুবই দূর প্রসারী।
শিশুবেলায় এই ছড়া শুনে কি অবোধ নিষ্ঠুরতায় মেতে উঠতো মনটা! পরিপূর্ণভাবে সাবালক হবার পরেও তার প্রভাবটুকু যেন কাটিয়ে ওঠা যায় না।
দোতলায় কোনো শোবার ঘর থেকে এই একই সুরে শিস্ দিচ্ছে কেউ। তবে শব্দটা খুবই মৃদু এবং অস্পষ্ট।
কান খাড়া করে না শুনলে সবটা ঠিক উপলব্ধি করা যায় না।
প্যারাভিসিনিই তাহলে রেনের ঘর থেকে শিস্ দিতে শুরু করেছেন। যুবক ক্রিস্টোফারের ভূমিকাটুকু বেশ ভালোই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আচমকা পাশের ঘর থেকে বেতার ঘোষিকার সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। সার্জেন্ট ট্রেটারই নিশ্চয় রেডিওটা চালিয়ে দিয়েছেন।
ভদ্রলোক কি তাহলে মিসেস বয়েলের ভূমিকাই গ্রহণ করলেন।
কিন্তু কেন?
এই পরিকল্পনার পশ্চাতে আসল উদ্দেশ্যই বা কি?
গোপন ফাঁদটাই বা কোথায়।
ফাঁদ যে একটা পাতা আছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
মলি অন্তত মনে মনে নিশ্চিত।
একঝলক ঠান্ডা হাওয়া হঠাৎ তার পিঠে এসে লাগলো।
কেউ যেন নিঃশব্দে পেছনে দাঁড়িয়ে তুহিন শীতল হাত রাখলো ঘাড়ের ওপর। ভীষণ ভাবে চমকে উঠে ফিরে তাকালো মলি।
কেউ কোথাও নেই।
দরজাটা আগের মতোই বন্ধ। নিশ্চয় দরজাটা কেউ খুলে ছিলো। তা নাহলে ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ পাবে কেন?
মনে মনে মলি ভীষণ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। যদি সত্যিই কেউ সকলের অলক্ষ্যে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
ব্যক্তিটি প্যারাভিসিনি হওয়াও বিচিত্র নয়।
তিনিই হয়তো এখন সহজাত সাবলীলভঙ্গিতে পেছন থেকে মলির ওপর ঝুঁকে পড়ে দশটা বাঁকানো শক্ত আঙুল দিয়ে…আপনি তাহলে সত্যিই ম্যাডাম আপনার মৃত্যুর সুর বাজিয়ে চলেছেন?
বাঃ…দৃশ্যটা বেশ মনোহর! … দূর, কি যে সব আবোল-তাবোল চিন্তা হচ্ছে মাথার মধ্যে।
সমস্তই অলীক অর্থহীন কল্পনা। বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো যোগযোগ নেই।
তাছাড়া ভদ্রলোক তো এখনো আগের মতোই মৃদু সুরে শিস্ দিচ্ছেন। দোতলায় রেনের শোবার ঘর থেকেই ভেসে আসছে শব্দটা।
হঠাৎ একটা কথা মনে আসতেই মলি পিয়ানোর ওপর থেকে হাত গুটিয়ে নিলো। প্যারাভিসিনির বাজনা কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি।
আসল রহস্যটা কি সেইখানে?
হয়তো আদপেই ভদ্রলোক তখন পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন না।
তার পরিবর্তে লাইব্রেরি ঘরে মিসেস বয়েলকে গলা টিপে হত্যা করবার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
ট্রেটার যখন মলিকে প্যারাভিসিনির ভূমিকা নিতে বললেন, তখন ভদ্রলোক খুব বিরক্ত বোধ করছিলেন।
তার চোখেমুখে একটা বিমূঢ় বিভ্রান্ত ভাব ফুটে উঠেছিলো।
এবং তিনি যে খুবই মৃদু সুরে পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন সে কথাটাও দৃষ্টান্ত সহযোগে বুঝিয়ে দিলেন মলিকে।
হয়তো এই বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য যে তাঁর সঙ্গীতের সুরটা এতই নিম্ন গ্রামে বাঁধা ছিলো যে বাইরে থেকে সেটা শুনতে পাওয়া যায় না।
কিন্তু এখন এই নাটকের পুনরাভিনয়ের সময় যদি সুরটা কারো কানে যায় তবে প্রকৃত পক্ষে ট্রেটারের উদ্দেশ্যই সফল হবে।
আসল অপরাধীও ধরা পড়বে হাতে নাতে। ড্রয়িংরুমের ভেজানো দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল। মলি ভেবেছিল যে আগন্তুক বোধহয় প্যারাভিসিনি, সেই ভেবে ভয় পেয়ে চিৎকার করতে যাচ্ছিল কিন্তু ট্রেটারকে দেখে সে মনোবল ফিরে পেল। কোনরকমে বেরিয়ে আসা আর্তনাদটাকে সে চেপে রইল। তার বাজনাও সবেমাত্র শেষ হয়েছে।
ট্রেটার উচ্ছ্বাসের সুরে বলল–অসংখ্য ধন্যবাদ মিসেস ডেভিস। তার চোখে মুখে একটা চঞ্চলতার কুটিল ছায়া খেলে গেল। তার গতিভঙ্গিতে দেখা গেল এক বলিষ্ঠের ছাপ।
মলি এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে বলল–আপনার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কি? আপনি যাকে চাইছিলেন তাকে খুঁজে পেয়েছেন?
আনন্দের সঙ্গে ট্রেটার মাথা দুলিয়ে বলল–হ্যাঁ নিশ্চয় যাকে চেয়েছিলাম তাকেই পেয়েছি। মলি প্রশ্ন করে, তাহলে প্রকৃত অপরাধী কে? তার নাম কি।
ট্রেটার বলল–মিসেস ডেভিস, আপনি কি সিত্যই জানেন না? কিন্তু ব্যাপারটা কিন্তু তেমন কিছু নয়। আপনি খুব বোকা বলেই সে লোকটিকে আপনি খুঁজে পাননি। শুধু আপনি কেন –আপনারা সকলেই বোকা। আর আপনাদের এই বোকামি আমাকে তৃতীয় শিকারের মুখোমুখি দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে। সত্যিই ম্যাডাম, আপনার এখন সাংঘাতিক বিপদ।
মলি বলল–আমি?… আপনি কি বলছেন আমি তা কিছু বুঝতে পারছি না।
ট্রেটার বলল–আমার বক্তব্য খুব একটা জটিল নয় মিসেস ডেভিস, মিসেস বয়েলের মত আপনিও সত্যটাকে লুকিয়েছেন। সবকিছু স্বীকার করেননি।
মলি বলল–তার মানে? আপনি কি বলতে চাইছেন?
হা আপনিই।… আমি যখন লঙরিজ ফার্মের মামলাটার কথা বললাম, তখন এই সমস্ত ঘটনা আপনি জানতেন। এই মামলা সংক্রান্ত প্রতিটি ঘটনাই আপনার জানা। তাই আমার কাছ থেকে ঘটনাটা শোনা মাত্র আপনি অস্থির হয়ে উঠলেন। মিসেস বয়েল যে ওই সময় পুনর্বাসন দপ্তরের একজন অফিসার ছিলেন তা প্রথম আপনিই বললেন, আপনারা দুজনেই এ অঞ্চলের অধিবাসী। সেই জন্য যখন আমি মনে মনে হিসেব করে দেখলাম তৃতীয় শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কার সব থেকে বেশি, তখন সবার আগে আপনার মুখটাই আমার মনে আসে। লক্ষ্য করে দেখলাম ওই মামলার ব্যাপারে আপনি অনেক কিছুই জানেন। সাধারণ দৃষ্টিতে পুলিশের যতই নিরীহ প্রকৃতির মনে হোক না কেন, তাদের চোখ কান সবসময় ভোলা থাকে।
মলি অবাক চোখে ট্রেটারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তারপর ক্লান্তস্বরে বলল– আমার মানসিক অবস্থাটা আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। ওই দুঃস্বপ্নের স্মৃতিটা আমি আমার মন থেকে মুছে ফেলতে চাই।
ট্রেটার ঠান্ডা গলায় বলল–হ্যাঁ সেটা আমি বুঝতে পারছি। আপনার কুমারী জীবনের পদবীতো ওয়েনরাইন? ঠিক তো?
মলি ঘাড় নেড়ে বলল।
ট্রেটার বলল, আর আপনাকে দেখে যতটা কমবয়সী মনে হয় আসলে কিন্তু ততটা ছেলেমানুষ আপনি নন।
১৯৪০ সালের ওই দুর্ঘটনার সময় আপনি স্থানীয় এ্যাবিভ্যালের স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন।
মলি বলল না আমি নই।
ট্রেটার উত্তেজিত হয়ে বলল, সত্যকে অস্বীকার করবেন না মিসেস ডেভিস।
মলি বলল–আমি সত্যি কথা বলছি। আপনি বিশ্বাস করুন।
লঙরিজ ফার্মের শিশুটা যে মারা গিয়েছিলো অত্যাচারের ফলে সে মারা যাবার আগে আপনার কাছে একটা চিঠি পাঠায়। কোনোরকমে চুরি করে সে ঠিকানাটা জোগাড় করে চিঠির মধ্যেই সাহায্য চেয়েছিল সে আপনার। কোনো ছাত্র ঠিক সময় মত স্কুলে হাজির হচ্ছে কিনা তার দায়িত্ব শিক্ষিকার। কিন্তু সে দায়িত্ব আপনি পালন করেননি। হতভাগ্য ছাত্রের অনুরোধটা আপনার পাষাণ হৃদয়ে এতটুকু নাড়া দেয়নি। এমন কি সেই চিঠিটারও কোনো গুরুত্ব দেননি।
মলি বাধা দিয়ে বলল-দাঁড়ান…দাঁড়ান, আপনি যার কথা বলছেন সে আমি নয়–সে আমার দিদি। আমার দিদি আমার থেকে সাত বছরের বড়। সে একজন শিক্ষিকা ছিলো। কিন্তু চিঠিটা সে অবজ্ঞা করেছে সে ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। আমার দিদি ওই সময় নিউমোনিয়ায় ভুগছিল। চিঠিটা তার হাতে এসে পৌঁছয়নি। এবং এই ব্যাপারটা সে বিন্দু বিসর্গও জানতো না। যখন খামটা সত্যিই তার হাতে পৌঁছল তখন আর করার কিছু ছিল না। সে ছেলেটা মারা গেল। আমার দিদি খুবই অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। তার ওপর ওরকম একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় দিদি খুব ভেঙে পড়েছিল। মনে রাখবেন এই ঘটনার পেছনে তার কোনো হাত ছিল না। তবুও সে নিজেকে অপরাধী মনে করত। বিবেকের দংশন থেকে সে একটুও মুক্তি পায়নি। আমরা পুরো ঘটনাটা জানতাম বলে ঘটনাটাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতাম। ভুলেও কখনও এ বিষয়ে কোনো কথা দিদির সামনে উল্লেখ করিনি। ব্যাপারটা আমাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মত মনে হত।
মলি নিজের অজান্তেই দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল, তার শরীরটা তখনও কাঁপছে। শেষে নিজেকে সংযত করে যখন আবার মুখ তুলে তাকাল তখন দেখল ট্রেটারের একজোড়া চোখ তার মুখের উপর পড়েছে।
ট্রেটার ধীরে ধীরে বলল–তা হলে আপনি নন আপনার বোন? যদিও তাতে কিছু এসে যায় না। তাই না। আপনার বোন… আপনার ভাই… তার ঠোঁটের কোণে দেখা গেল কুটিল হাসি। কথা বলতে বলতেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে কি যেন বের করলেন।
মলিও অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে ট্রেটারের হাতের জিনিষটার দিকে।
তারপর বলল–কিন্তু … কিন্তু পুলিসরা তো সবসময় রিভলবার নিয়ে চলাফেরা করে, আমার তাই ধারণা।
ট্রেটার বললেন– তবে আমি পুলিস নই মিসেস ডেভিস। তাই আপনি আমার হাতে রিভলবার দেখতে পাচ্ছেন, আমার নাম জিম। আমি হতভাগ্য জর্জের ভাই। আপনি আমায় পুলিস বলে মনে করেছিলেন আর এই মঙ্কসওয়েলে পা দেওয়ার আগে টেলিফোনের তারটা কেটে দিই। তার ফলে নতুন করে পুলিসের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় রইল না।
মলি কোনো কথা বলল না। তার দু চোখের মধ্যে আছে এক বিস্ময়। কোনো যাদুকর বুঝি তাকে যাদু করেছে। রিভলবারের নলটাও তার দিকেই তাক করা আছে।
ট্রেটার বলল–এক পা নড়বেন না মিসেস ডেভিস। চেঁচিয়ে লোক জড়ো করেও কোনো লাভ নেই। আপনার ফুসফুস দুটো তাহলে এই রিভলবারের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।
ট্রেটারের মুখে সেই কুটিল হাসি। মলির হাবভাবে দেখা গেল একধরনের শিশুসুলভ ভাব। ট্রেটারের গলার স্বরও খুব বদলে গেছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো কিশোর কথা বলছে।
ট্রেটার দু বার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল–হ্যাঁ আমিই সেই হতভাগ্য জর্জের বড় ভাই। লঙরিজ ফার্মেই যে জর্জ মারা গিয়েছিল। ওই নোংরা নিষ্ঠুর মেয়েটাই আমাদের ওখানে পাঠিয়েছিল। ওই ফার্মের কর্মচারী মিসেস গ্রেগ খুবই আমাদের সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। আপনিও আমাদের কোনো সাহায্য করেননি। তিনটে অন্ধ ইঁদুরের মত আমরা ওই ফার্মে বন্দী ভাবে জীবন যাপন করতাম। তখনই মনে মনে ভাবতাম বড় হলে আমি আপনাদের প্রত্যেককেই মেরে ফেলব। এই প্রতিজ্ঞার কথা আমি ভুলিনি এবং কিভাবে আমার এই প্রতিজ্ঞাকে সার্থক করব তা সবসময় ভাবতাম।
ট্রেটার একটু চুপ করে আবার বলতে শুরু করল, সেনাবাহিনীর ডাক্তাররা সবসময় আমাকে বিরক্ত করত। নানারকম অদ্ভুত প্রশ্ন করত। সেইজন্য আমি পালাবার পথ খুঁজছিলাম। কারণ আমার সন্দেহ হয়েছিল ওরা হয়ত আমাকে আটকে রাখতে চায়। কিন্তু এখন আমি সাবালক আমার স্বাধীন ভাবে কাজ করার অধিকার এখন হয়েছে।
মলি যেন তার বুদ্ধিটা কিছু ফিরে পেয়েছে। আলাপচারিতার মধ্যে এই খুনে জায়গাটাকে এখন ভুলিয়ে রাখতে হবে। মলি মনে মনে চিন্তা করল। এছাড়া কোনো উপায় নেই। তাহলে অন্ততঃ আত্মরক্ষার কাজটা হতে পারে।
মলি কাতর কণ্ঠে বলল– কিন্তু জিম শোন, আমাকে মেরে তুমি মুক্তি পাবে না। এখান থেকে যেতে পারবে না।
প্রশ্নটা শুনে জিমের মুখ কালো হয়ে গেল। বলল, হ্যাঁ আমার স্কী দুটোও কে লুকিয়ে রেখেছে অনেক খুঁজেও পাইনি।
জিম একটু থেমে আবার বলল– তবে এই মুহূর্তে আমার কোনো ভয় পাচ্ছে না। কেননা রিভলবারটা আপনার স্বামীর। আমি ড্রয়ার থেকে এটা চুরি করেছি। সকলে ভাববে আপনাকে তিনিই খুন করেছেন। তবে আমার তাতে কিছু এসে যায় না, সমস্ত ব্যাপারটাই বেশ মজার। এই ধরনের লুকোচুরি খেলতে আমার বেশ ভালোই লাগে।
লণ্ডনের ওই মেয়েটা মারা যাবার আগে তখন আমাকে চিনতেই পারল না। তখন তার মুখেও দেখা দিল ভয়ের ছাপ। বোকা বুড়ি মিসেস বয়েলের খুন হওয়াটা কম মজার নয়।
আনন্দ সহকারে ট্রেটার মাথা দোলান। তারপর শিস দিতে লাগল–তিনটে ইঁদুর অন্ধ…
ট্রেটার যেন কিছুটা হকচকিয়ে গেল। তার হাতের মুঠোর রিভলবারটা কিছুটা কেঁপে উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ যেন বলে উঠল-মিসেস ডেভিস, আপনি শুয়ে পড়ুন।
মলি কিছু না বলেই নরম কার্পেটের মধ্যে শুয়ে পড়ল, ইতিমধ্যে মেজর মেটকাফ ট্রেটারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ট্রেটারের রিভলবারটা দূরে ছিটকে পড়ল। আচমকা একটা গুলি গিয়ে লাগল দেওয়ালে টাঙানো একটা অয়েল পেন্টিংয়ের বুকে।
সমস্ত ড্রইংরুমে এখন বিশৃঙ্খলা পরিবেশ। জিল রিভলবারের আওয়াজ শুনতে পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হল। তার পেছনে মিঃ রেন ও মিঃ প্যারাভিসিনি। প্রত্যেকের চোখেমুখে একটা উৎকণ্ঠা ও ভয়।
মেজর মেটকাফ ছদ্মবেশী ট্রেটারের দুটো হাত ধরে পরিবেশটা সকলকে বুঝিয়ে দিলেন।
মিসেস ডেভিস, যখন পিয়ানো বাজানোয় মগ্ন ছিলেন, তখন আমি চুপি চুপি ভেতরে ঢুকে সোফার আড়ালে লুকিয়ে থাকি, প্রথম থেকেই আমি ওকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। কেননা আমি জানতাম ও পুলিস অফিসার নয় আমিই পুলিস অফিসার ইনসপেক্টর ট্রানার মেটকাফের ছদ্মবেশে আমি এখানে এসেছি। কারণ স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড এখানে কোনো দায়িত্বজ্ঞান পুলিস অফিসারের উপস্থিতি যুক্তিযুক্ত মনে করে।
ভদ্রলোক একবার ট্রেটারের দিকে তাকালেন। তারপর আবার বললেন–তাহলে ট্রেটার এখানে আর কোনো গণ্ডগোল করার চেষ্টা করো না। ঠান্ডা হয়ে আমার সঙ্গে চলো, আমি কথা দিলাম, এখানে কেউ তোমার গায়ে হাত তুলবে না।… আমার কথাটা মাথায় ঢুকেছে তো?
ট্রেটারের মধ্যে দেখা গেল এক আমূল পরিবর্তন। কিছু আগের উগ্রতা ভাবটা তার মধ্যে এখন আর দেখা গেল না। শান্ত ছেলের মত এখন বাধ্য ও বিনয়ী, এই মুহূর্তে তার গলাটাও যেন মনে হল অল্পবয়সী ছেলের মত। বলল, জর্জ আমার ওপর রাগ করবে না তো?
মেটকাফ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল–না, না জর্জ কিছুতেই রাগ করবে না। তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। জিলের পাশ দিয়ে যাবার সময় সে আস্তে বলল–একেবারে উন্মাদ। বদ্ধউন্মাদ।…সত্যিই হতভাগ্য মূক।
ট্রেটারকে সঙ্গে নিয়ে মেটকাফ বাইরে চলে গেল। মিঃ প্যারাভিসিনি দু পা এগিয়ে ক্রিস্টোফারের হাত ধরে বলল–চলুন– আমরাও চলে যাই।
বড় ড্রয়িংরুমের মধ্যে মলি ও জলি দুজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। পরে জিলের দুই বাহুর মধ্যে ধরা দিল মলি। তখন সে ভয়ে কাঁপছে।
জিলের গলায় একরাশ উৎকণ্ঠার সুরে বলল–তুমি কোনো আঘাত পাওনি তো মলি।
মলি বলল–না, না আমি ভালো আছি। কিন্তু আমার মধ্যে এমন কতগুলো উদ্ভব ধারণা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে…প্রথমে তো আমি ভেবেছিলাম… তুমি… নিশ্চয় ঐদিনে লণ্ডন গিয়েছিলে…।
জিল বলল–হ্যাঁ গিয়েছিলাম। আগামীকাল ছিল আমাদের বিবাহবার্ষিকী, তোমার জন্য একটা উপহার আনতে যাওয়াই ছিল আমার উদ্দেশ্য। ভেবেছিলাম তোমাকে একটা চমক লাগিয়ে দেবো। তাই গোড়ায় কিছু বলিনি।
মলি অবাক সুরে চেঁচিয়ে বলল–কি আশ্চর্য! সেদিন তো আমিও লণ্ডনে গিয়েছিলাম।
জিল অনুতাপের সুরে বলে–আমি তোমার উপর খুব বাজে ব্যবহার করেছি। কেন জানি না ওই আধপাগলা যুবকটিকে প্রথম দেখামাত্র একটা হিংসার ভাব জেগে উঠেছিল। অথচ তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। হয়ত আমার তখন বিচারবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। আমায় তুমি ক্ষমা করো মলি।
বন্ধ করা দরজাটা একটু ফাঁক করে প্যারাভিসিনি উঁকি দিলেন। তার হাবভাবে বেশ একটা খুশির আমেজ, সে বলল–এই পুনর্মিলনে বাধা দিতে বাধ্য হলাম বলে আমি দুঃখিত। সত্যি বলতে কি এমন দৃশ্যের তুলনা হয় না। কিন্তু হায়। আমার যাবার সময় এসে গেছে। আমি এখন আপনাদের কাছে বিদায় নিতে এসেছি। পুলিসের একটা জিপ এই বরফের পাহাড় ভেদ করে কোনোরকমে আমি এখানে এসে পৌঁছেছি। অনেক কষ্টে তাদের রাজী করিয়েছি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য।
প্যারাভিসিনি মলির কাছে এসে কানে কানে বলল–তবে ম্যাডাম, অদূর ভবিষ্যতে আপনার নামে যে বাক্সটা পাঠাবো তার মধ্যে বিশেষ টোস্ট তৈরির মশলা সমস্ত মজুত থাকবে। তার সঙ্গে দু-চার জোড়া মোজা থাকবে। আশা করি অনুগত ভক্তের এই সামান্য উপহারটুকু গ্রহণ করতে আপনি অরাজী হবেন না।… আর হ্যাঁ আমার চেকটা হলঘরের পেপারওয়েটের নিচে চাপা দেওয়া আছে।
প্যারাভিসিনি মলির হাতের তালুতে মৃদু চুম্বন করে দ্রুত পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন।
মলি বিড় বিড় করে বলল–নাইলন। যকৃতের তেল,… মিঃ প্যারাভিসিনি কি তাহলে আসলে খ্রীস্টমাস বুড়ো সান্তাক্লজ নাকি?
কথাবার্তার ধরনধারণ দেখে মনে হয় কালোবাজারীদের কোনো বড় চাই–জিল পরিহাসছলে কথাটা বলল।
জিলের কথা শেষ হতে না হতেই ক্রিস্টোফার রেন আবার এল। তার চালচলনে একটা ব্যস্ততার ছাপ। সে বলল–আপনাদের কথায় মাথা গলাতে বাধ্য হচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে রান্নাঘরের দিক থেকে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে। মনে হয় এবিষয়ে আপনার একবার নজর দেওয়া উচিত।
মলির গলা দিয়ে একটা আর্তনাদের সুর বেরিয়ে এল, বলল–হ্যায় হায়…। এতকষ্ট করে মাংসের কোপ্তাগুলো করলাম মনে হয় সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল এতক্ষণে।
ভয় পাওয়া হরিণীর মতই মলি দুজনের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গেল।