আলোকের সন্ধানে
কিরীটীর বসবার ঘর।
রাত্রি তখন প্রায় পৌনে নটা হবে।
খাওয়াদাওয়া সকলের হয়ে গেছে, কিরীটী একটা খোলাখুলি আলোচনা করবার জন্য সকলকেই তার ঘরে আহ্বান করেছে। রণধীর, বিনতা দেবী, সমীর, অধীর, কিশোর, ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী, ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী, বারীন চৌধুরী, যতীনবাবু, সমর রায় ও স্থানীয় থানাইনচার্জ অমরেন্দ্রবাবু।
***
কিরীটী বলছিল, ভদ্রমোহদয় ও ভদ্রমহিলাগণ, আজ রাত্রে আপনাদের এখানে কেন আমি ডেকে পাঠিয়েছি জানেন? একটা খোলাখুলি আলোচনা করবার জন্য। একটা কথা সর্বাগ্রে আপনাদের জানিয়ে দেওয়া উচিত, ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর মতের সঙ্গে আমিও একমত। অর্থাৎ গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তাকে খুন করা হয়েছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং আমি তা প্রমাণ করব। কিন্তু করবার আগে আমি সকাতরে অনুনয় জানাচ্ছি, যদি আপনাদের মধ্যে কেউ কোন কথা গোপন করে থাকেন তবে আমাকে এখনও বলুন।
কিন্তু সকলেই স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল, কারও মুখে কোন কথা নেই।
বেশ তবে শুনুন, গম্ভীর স্বরে কিরীটী বলতে শুরু করল, প্রথম থেকে চিন্তা করে দেখতে গেলে, ডাঃ চক্রবর্তীর মতামতটা অবহেলা করলে চলবে না। তিনি তার মতটা চিন্তা করেই দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন এই হত্যাকাণ্ড দলবদ্ধভাবে হয়েছে, না কোন একজনের দ্বারাই হয়েছে। কথা হচ্ছে মানসিক উত্তেজনার ফলে কেউ কাউকে খুন করতে পারে কিনা? ডাঃ চক্রবর্তী, আপনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট, আপনার এ বিষয়ে মতামত কি?
ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, হ্যাঁ, তা হতে পারে, অত্যন্ত মানসিক চিন্তা বা উত্তেজনার ফলে খুন করা কিছুই অসম্ভব নয়।
কিরীটী জবাব দিল, সেরকম মানসিক উত্তেজনা এঁদের সকলেরই ছিল। বহুদিন ধরে এঁরা প্রত্যেকে এদের জীবনের সঙ্গে অন্যের জীবনের তুলনামূলক পার্থক্যটা সব সময় রূঢ় ভাবেই দেখতেন। রণধীরবাবুর মনের অবস্থা যা ছিল, সমীরবাবুরও তাই। একটা মানসিক বিদ্রোহ তিল তিল করে বহুদিন ধরে নিরন্তর একটা মানসিক উত্তেজনার ফলে গড়ে উঠেছে। অধীরবাবুর মানসিক অবস্থাটাকে apathy বলা চলে, কিন্তু কিশোরের অবস্থা আপনার কি বলে মনে হয় ডাঃ চক্রবর্তী?
মানসিক অবস্থা তার ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ডাঃ চক্রবর্তী বলতে লাগলেন, সে ইতিমধ্যে Schizophreniaর symptoms দেখতে শুরু করেছিল। তার জীবনের প্রতি রূঢ়তা ও নির্বিমুখতা তাকে নিরন্তর পীড়িত করছিল। এক কথায় যাকে suppression বলা চলে, তা থেকে সে ক্রমে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে এগিয়ে চলেছিল। তার মন সব অদ্ভুত deluison বা স্বপ্নের মধ্যে বিচরণ করছিল। সে নিজেকে কখনো কখনো শত্রু ও ভয়ঙ্কর সব লোকেদের দ্বারা পরিবেষ্টিত দেখত। এটা বিশেষ চিন্তার কথা। কেননা এই ধরণের মনের অবস্থা থেকেই অনেক সময় খুন করবার একটা প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। এখানে suferer খুন করে খুন করবার জন্য নয়। নিজেকে অত্যাচার থেকে বাঁচাবার জন্য। ওদের মানসিক বিকারের দিক থেকে বিচার করে দেখতে গেলে এটা খুবই rational–স্বাভাবিক।
হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করলে, তবে কি তোমার মনে হয় ডাক্তার, কিশোরই তার কাকাকে খুন করেছে?
সকলেই উদগ্রীব হয়ে উঠল, প্রত্যেক ভাইয়ের মুখেই যেন একটা ভীতি-চিহ্ন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
কিন্তু আর একটা কথাও এই সঙ্গে ভাবতে হবে কিরীটী, যেভাবে সাজিয়ে খুন করা হয়েছে, ততখানি জ্ঞান বা মনের গঠনশক্তি কিশোরের ছিল কিনা সন্দেহ। অবশ্য এ ধরনের মানসিক বিকারগ্রস্তেরা খুব সহজ ও সাধারণ ভাবেই খুন করে। ভেবেচিন্তে চাতুর্যের সঙ্গে করে না, যেটা এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। সে যদি খুন করত, তবে একটা spectacular ভাবেই খুন করত-যা এক্ষেত্রে হয়নি।
কিরীটী আবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা খুন হবার পর, তোমার কি মনে হয় ডাক্তার, বাকি সবাই জানতে পেরেছিল?
ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ। আমার মনে হয় এঁরা জানতেন এবং সেটাই আমার মনে সর্বপ্রথম সন্দেহের উদ্রেক করে। এমন ধরনের একদল ভীতু লোক ইতিপূর্বে আমি দেখিনি। এদের দেখলেই মনে হয়, যেন এরা প্রত্যেকেই ইচ্ছা করে কিছু গোপন করে রেখেছেন।
তাই যদি হয়, কিরীটী জবাব দিল, তবে এঁদের মুখ দিয়েই বলিয়ে নেব আসল ব্যাপারটি কি?
ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, অসম্ভব। তা তুমি পারবে না।
না, অসম্ভব নয়। তুমি হয়ত জান না, সাধারণ কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই এঁদের মুখ দিয়ে আমি অনেক সত্য কথা ইতিপূর্বে বের করি নিয়েছি এবং বাকি সত্যটুকুও আজকের আলোচনার মধ্য দিয়ে বলিয়ে নেব। মোটামুটি ভাবে সাধারণত মানুষ সত্য কথাই বলতে চায় বা বলেও থাকে।
তার কারণ মিথ্যা কথা বলবার চাইতে সত্য কথাটা বলা অনেক সহজ। কেননা সত্য কথা বলতে ভাবতে হয় না বা চিত্ত করতে হয় না, আপনা থেকে যেন আপনিই বের হয়ে আসে। তুমি একটা মিথ্যা কথা বলতে পার, দুটো বা তিনটি বলতে পার, কিন্তু কেবলই অনবরত একটার পর একটা শুধু মিথ্যা কথাই বলে যেতে পার না। সেটা অসম্ভব।
সত্য একসময় তোমার অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবেই এবং তখুনি সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে এদের প্রশ্ন করে ও খোঁজ নিয়ে যতটুকু জেনেছি, তার থেকে মোটামুটি ভাবে কতকগুলো point খাড়া করেছি। যেমন :
১। গগনেন্দ্রনাথ তাঁর হার্টের ব্যারামের জন্য প্রত্যহ নিয়মিত ভাবে এমন একটা ঔষধ খাচ্ছিলেন, যার মধ্যে একটা ingredient হচ্ছে ডিজিট্যালি।
২। ডাঃ চক্রবর্তীর একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ তার মেডিকেল ব্যাগ থেকে খোয়া যায় সেদিন।
৩। গগনেন্দ্রনাথ তার ফ্যামিলির কাউকে বাইরের কোন তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে মিশতে দিতে একেবারেই পছন্দ করতেন না ও কোথাও বের হতে দিতেন না।
৪। কিন্তু ঐদিন বিকালে সকলকেই বাইরে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং হোটেলে তিনি একা ছিলেন।
৫। সমীরবাবু তার জবানবন্দিতে প্রথমে বলেছিলেন তিনি বেড়িয়ে যখন ফিরে আসেন তখন ঠিক সময় কত তা তিনি জানতেন না, কেননা তার ঘড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে বলেন, তিনি তাঁর কাকার হাতের রিস্টওয়াচ দেখে সময় ঠিক করে নেন।
৬। ডাঃ চক্রবর্তী ও কিশোর পাশাপাশি ঘরে থাকতেন।
৭। সাড়ে ছটার সময় চা খাবার জন্য যখন সকলে প্রস্তুত তখন সবাই খাবার ঘরে বসে, তবু একজন ভৃত্যকে গগনেন্দ্রনাথকে চা খেতে আসবার জন্য ডাকতে পাঠানো হয়েছিল।
৮। গগনেন্দ্রনাথ একদিন বলেছিলেন, আমি কখনও কিছু ভুলি না, মনে রেখো এ কথা। আমি আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘ ষাট বছরের জীবনের কোন কথাই ভুলিনি, সব আমার মনে আছে। সব মুখই আমার মনে আছে।
যদিচ আমি প্রশ্নগুলো, কিরীটী বলতে লাগল, আলাদা আলাদা ভাবে টুকেছি, তথাপি একসঙ্গে সব কটি point বিচার করা যায়। যেমন প্রথম দুটো পয়েন্ট, গগনেন্দ্রনাথ তার হৃদরোগের জন্য নিয়মিত ভাবে একটা ঔষধ পান করতেন, যার মধ্যে একটা ingredient ছিল ডিজিট্যালিন। ডাঃ চক্রবর্তীর একটু হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ খোয়া যায়। ঐ দুটো পয়েন্টই এই কেসে আমার মনকে সর্বপ্রথম সন্দেহাম্বিত করে তোলে। আমার আর এখন বলতে বাধা কিছুই নেই যে, এই দুটি প্রশ্ন আমার বিচারে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক এবং অমিল বলে মনে হয়। বুঝতে পারছেন না আপনারা বোধ হয় আমি কি বলতে চাচ্ছি। শীঘ্রই সব আমি বুঝিয়ে দেব। শুধু এইটুকুই সকলে মনে রাখুন, উপরিউক্ত এই দুটি point আমার কাছে মনে হয়, যার মীমাংসা সর্বপ্রথম হওয়া প্রয়োজন এই কেসে। সকলেরই জবানবন্দি আমি নিয়েছি, এখন সেই জবানবন্দি থেকে যেটুকু তথ্য আপনাদের সকলের মুখ থেকে আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি সেই সম্পর্কেই আলোচনা করা আমাদের এই মিলনের মুখ্য উদ্দেশ্য।
কিরীটী একটুখানি থেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার বলতে শুরু করলে, গোড়া থেকেই শুরু করছি। সর্বপ্রথম সমীরবাবুর কথাই বিচার করে দেখা যাক। তার পক্ষে তার কাকার জীবন নেওয়া সম্ভব ছিল কিনা? তিনি একদিন গভীর রাত্রে তার ভাই অধীরবাবুর সঙ্গে তাদের কাকার জীবন নেওয়ার সংকল্প করছিলেন আমি তা নিজের কানে শুনেছিলাম। আমি জানি সেসময় সমীরবাবু একটি ভয়ানক মানসিক উত্তেজনার মধ্যে ছিলেন। ঐ ব্যাপারের সময় তার মনে আরও একটা অন্য উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীর সস্নেহ আকর্ষণেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক, প্রতিমা দেবীর দিকে তার মন তখন ঝুঁকেছে। তার তখনকার মানসিক অবস্থায় তার পক্ষে যে-কোন কাজ করা আশ্চর্য নয়। তিনি তার বর্তমান জীবনের প্রতি বীতস্পৃহ হয়ে উঠেছিলেন। এবং সেই অবস্থায় তার কাকার সম্মোহন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শেষ উপায় বেছে নেওয়াটাও খুবই স্বাভাবিক। অথবা যে কল্পনাটা তার একদা মানসিক উত্তেজনার মধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছিল, সেটাকেও কার্যে পরিণত করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। ভাল কথা, কথাপ্রসঙ্গে আপনাদের ঐদিনকার ঐ সময়ের গতিবিধির একটা তালিকা তৈরী করেছি, সে সম্পর্কেও একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক।
১। সমীরবাবুরা সকলে ও সমরবাবু তিনটে পাঁচ মিনিটের সময় হোটেল থেকে বেড়াতে বের হন।
২। তিনটে পনের মিনিটের সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ও ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী বেড়াতে বের হন।
৩। চারটে পনের মিনিটের সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু বেড়াতে যান।
৪। চারটে কুড়ি মিনিটের সময় ডাঃ চক্রবর্তী জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ফিরে আসেন।
৫। চারটে পঁয়ত্রিশ মিনিটের সময় রণধীরবাবু বেড়িয়ে হোটেলে ফিরে আসেন।
৬। চারটে চল্লিশ মিনিটের সময় তার স্ত্রী বিনতা দেবী ফিরে আসেন ও ফিরে তার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করেন।
৭। চারটে পঞ্চাশ মিনিটের সময় বিনতা দেবী তাঁর স্বামীর ঘরে যান।
৮। পাঁচটা দশ মিনিটের সময় অধীরবাবু বেড়িয়ে ফিরে আসেন।
৯। পাঁচটা চল্লিশ মিনিটের সময় বারীনবাবু, যতীনবাবু ও সমরবাবু ফিরে আসেন।
১০। পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময় সমীরবাবু ফিরে আসেন।
১১। ছটার সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ফিরে আসেন।
১২। ছটা তিরিশ মিনিটের সময় ভৃত্য গগনেন্দ্রনাথকে চা খেতে ডাকবার জন্য গিয়ে দেখে তিনি মৃত।
***
কিরীটী বলতে লাগল, উপরিউক্ত সময়ের তালিকা বিচার করলে দেখা যাচ্ছে তিনটে পাঁচ মিনিটের সময় সমীরবাবু অন্য ভাইদের সঙ্গে হোটেল থেকে বেড়াতে বের হন। গগনবাবু তখন বেঁচে ছিলেন। বেড়াতে গিয়ে সমীরবাবু ও প্রতিমা গাঙ্গুলীর সঙ্গে কথাবার্তা হয়। প্রতিমা দেবীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ একসময় তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলের দিকে ফিরে আসেন। তার কথামত পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময় হোটলে এসে ঢোকেন। তিনি হোটেলে এসে তার কাকার সঙ্গে দেখা করেন ও কথাবার্তা বলেন; তারপর নিজের ঘরে চলে যান ও ছটার সময় সকলের সঙ্গে চা খেতে খাবার ঘরে আসেন। তিনি তার জবানবন্দিতে বলেছেন, পাচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময়ও নাকি তার কাকা বেঁচে ছিলেন। কিন্তু পরের একটা ব্যাপারে বোঝা যাচ্ছে স্পষ্টই যে তার কথা ঠিক নয় বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সাড়ে ছটার সময় গগনবাবুকে চা পান করতে ডাকতে গিয়ে ভূত তাকে মৃত অবস্থায় পায়। ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী নিজে একজন ডাক্তার। তিনি বলেছেন তার ডাক্তারী বিদ্যানুযায়ী গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু, যখন তাকে মৃত বলে আবিষ্কার করা হয়, তারও একঘণ্টা আগে ঘটেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে ডাঃ গাঙ্গুলী ও সমীরবাবুর কথা যদি সত্যি বলে মেনে নিই, তবে একজনের statement অন্যজনের statement-এর সঙ্গে আদপেই মিলছে না। Conflicting statements! যদি মেনে নিই যে ডাঃ গাঙ্গুলী ঠিক বুঝতে পারেননি….
সহসা এমন সময় কিরীটীকে বাধা দিয়ে প্রতিমা বলে উঠল, না মিঃ রায়, আমি আপনাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি ভুল আমার হয়নি। তাছাড়া অত সহজে আমি ভুল করি না।
কিরীটী বললে, বেশ, তাই যদি মেনে নিই, তবে এই ধরনের conflicting statement থেকে দুটো conclusion আমরা করতে পারি। হয় ডাক্তার গাঙ্গুলী অথবা সমীরবাবু দুজনের একজন ইচ্ছা করে মিথ্যা কথা বলছেন!
প্রতিমা কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিরীটী তাকে বাধা দিয়ে বলতে লাগল, কিন্তু ধরে নিই যদি সমীরবাবুই এক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলছেন, দেখা যাক কেন তিনি মিথ্যা কথা বলছেন। তার এ ধরনের মিথ্যা বলবার গোপন উদ্দেশ্য আছে কিনা? ধরে নেওয়া গেল ডাঃ গাঙ্গুলীর কথাই সত্য, তার ভুল হয়নি বা তিনি ইচ্ছা করে মিথ্যা কথা বলছেন না, সমীরবাবু হোটেলে ফিরে এসে কাকার সঙ্গে যখন দেখা করেন, তার আগেই তার কাকা মারা গেছেন, অর্থাৎ তিনি গিয়ে তার কাকাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান এবং ধরে নিই, যদি সত্যি তাই হয়েই থাকে, তবে সেই অবস্থায় তাঁর পক্ষে তখন কি করা সম্ভব?
হয় তিনি ঘাবড়ে গিয়ে সাহায্যের জন্য সকলকে ডাকাডাকি শুরু করতে পারেন, অথবা ধীরভাবে তখুনি গিয়ে সকলকে ব্যাপারটা জানান কি হয়েছে। অথবা এমনও হতে পারে ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি প্রথমে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যান। তারপর কোন কিছু ভেবে কাউকে ও বিষয়ে কোন কথা না বলাই শ্রেয় বিবেচনা করে নিঃশব্দে সে স্থান ত্যাগ করে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচনা করেন। কী বলেন আপনি সমীরবাবু, তাই নয় কি?
সমীরবাবু বাধা দিয়ে বললেন, ব্যাপারটা তাহলে একেবারে হাস্যকর বা ছেলেমানুষির মত দাঁড়ায় না কি?
তাহলে বলতে হয়, কিরীটী বললে, ডাঃ গাঙ্গুলীই হঠাৎ ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুসময় সম্বন্ধে ভুল করেছেন! কিন্তু তার আগে আমরা ভাবব, এ ধরনের ব্যবহার করা আপনার পক্ষে তখন সম্ভব ছিল কিনা। কেননা তাতে এও প্রমাণ হয় যে, আপনি নির্দোষ। কেননা আপনি যখন আপনার কাকার সঙ্গে দেখা করতে যান, তিনি তখন মৃত। বেশ এখন ধরা যাক, তাই যদি ঘটে থাকে এবং সত্যিই সমীরবাবু নির্দোষ হন, তবে তার ঐদিনের ঐ অদ্ভুত ব্যবহারের একটা মীমাংসায় আমরা আসতে পারি কিনা? এর মীমাংসা সহজেই হয়, যদি তাকে নির্দোষ ধরে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তার সেই রাত্রের কথাগুলো, যা তিনি তার ভাইকে বলেছিলেন তাঁর কাকার সম্পর্কে সেটাও মনে রাখতে হবে আমাদের। তিনি হোটেলে ফিরে এসে কাকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যখন দেখলেন। তার কাকা মৃত, তার দোষী মন ও দোষী স্মৃতিতে সহজেই একটা সম্ভাবনা জেগে ওঠা স্বাভাবিক যে তাদের সেই রাত্রের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে-কিন্তু তার দ্বারা হয়নি। অর্থাৎ তিনি যখন সে পরিকল্পনাকে কার্যে পরিণত করেননি তখন নিশ্চয়ই তার সঙ্গী করেছে। ফলে প্রথমেই হয়ত তার ছোটভাই অধীরের কথা মনে পড়ল। কেননা তারা দুজনেই এ কল্পনা করেছিলেন।
সহসা এমন সময় সমীর উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, না না, কখনও না। একেবারে মিথ্যা কথা।
কিন্তু সমীরবাবুর প্রতিবন্ধকে কোনরূপ কান না দিয়েই কিরীটী বলে যেতে লাগল, বেশ তাই যদি হয়, তাহলে এখন দেখা যাক, অধীরবাবুর দ্বারা তার কাকাকে খুন করা সম্ভব কিনা? অধীরবাবুর বিরুদ্ধে প্রমাণ কি? তারও মানসিক অবস্থা তার মেজদা সমীরবাবুর মতই ছিল এবং দু ভাই কতকটা একই মনোবৃত্তির। কেননা তার সঙ্গেই সেরাত্রে সমীরবাবু তাদের কাকাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
অধীরবাবু পাঁচটা দশ মিনিটের সময় হোটেলে ফিরে আসেন। তিনিও বলেছেন তিনি ফিরে এসেই সোজা প্রথমে তার কাকার সঙ্গে দেখা করতে যান এবং তিনিও নাকি তার কাকার সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। অথচ সেই সময় কেউই তাকে তার কাকার সঙ্গে কথা বলতে দেখেননি। অর্থাৎ কেউ তার উক্তির সাক্ষী নেই। এক্ষেত্রে অধীরবাবুর চমৎকার একটা alibi আছে। কেউ তখন সেখানে ছিল না। বারীনবাবু, যতীনবাবু ও সমরবাবু বাইরে চলে গেছেন। ওঁদের সকলের movement–এর সময়তালিকা থেকেই তা প্রমাণিত হয়। তাই যদি হয় এবং তার ঐ alibi প্রমাণিত না হয়, তবে অধীরবাবুর পক্ষে এক্ষেত্রে তার কাকাকে খুন করা এতটুকুও অসম্ভব বা আশ্চর্যজনক নয়।
অধীর কিরীটীর দিকে সহসা চোখ তুলে চাইল। কী একটা করুণ মিনতি, কী দারুণ অবসন্নতায় ভরা তার দু-চোখের দৃষ্টি!
কিরীটী আবার বলতে লাগল, আরও একটা কথা, যেদিন গগনেন্দ্রবাবু খুন হন, তার পরদিন সকালে অধীরবাবুকে কেউ তার জানালা দিয়ে কোন একটা বস্তু বাড়ির পিছনের দিকে ফেলে দিতে দেখেছিলেন এবং সেটা হচ্ছে একটা হাইপোড়রমিক সিরিঞ্জ।
সহসা এমন সময় ডাঃ চক্রবর্তী বলে উঠল, কিন্তু আমিও পরদিন সকালে আমার হারিয়ে যাওয়া সিরিঞ্জটা আমার ঔষধের ব্যাগের উপরেই পাই।
কিরীটী বললে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি আপনার সিরিঞ্জটা পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু এটা আর একটা সিরিঞ্জ। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি অধীরবাবু?
অধীর জবাব দিলে, সেটা আমার নিজস্ব সিরিঞ্জ ছিল।
তাহলে আপনি স্বীকার করছেন যে, আপনিই সেদিন সকালে সে সিরিঞ্জটা জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কেন স্বীকার করব না?
সহসা এমন সময় বিনতা অধীরকে বাধা দিয়ে প্রবলভাবে বলে উঠল, অধীর, অধীর, এ তুমি কি বলছো ভাই! কিছুই তো আমি বুঝতে পারছি না।
বিস্মিত ও রাগান্বিত ভাবে অধীর তার বৌদির দিকে ফিরে তাকাল, এতে আশ্চর্য হবার বা না বুঝবার মত তো কিছুই নেই বৌদি। পুরাতন একটা সিরিঞ্জ আমার এক ডাক্তার বন্ধু আমাকে একসময় দিয়েছিল। সেটা সেদিন সকালে ফেলে দিয়েছি; কিন্তু আমি কাকাকে খুনও করিনি বা বিষও দিইনি।
এমন সময় প্রতিমা বলে উঠল, আমিই সিরিঞ্জটা কয়েক দিন আগে অধীরবাবুকে দিয়েছিলাম।
আশ্চর্য! সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সিরিঞ্জের ব্যাপারটা। তবু মনে হচ্ছে, কিরীটী বলতে লাগল, এর একটা মীমাংসাও যেন খুঁজে পাচ্ছি। দুটো সিরিঞ্জও পাওয়া যাচ্ছে। এবং তা থেকে দুটো ব্যাপার আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠছে। প্রথমটায় অধীরবাবুকে দোষী প্রমাণ করতে পারলে, হয়ত সমীরবাবুর নির্দোষিতা প্রমাণ হয়ে যায়, কিন্তু সব দিক ভাল করে দেখেশুনে আমাদের সুবিচারই করতে হবে। দেখা যাক, অধীরবাবু যদি নির্দোষ হন, তবে কিভাবে ব্যাপারটা ঘটতে পারে। তিনি হোটেলে ফিরে এলেন। তিনি তার কাকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন তিনি মৃত (?), তার তখন মনে হতে পারে যে হয়ত তার মেজদাই কাকাকে খুন করেছেন। কেননা তাঁরা দুজন মাত্র কয়েকদিন আগে এক রাত্রে তাদের কাকাকে এ পৃথিবী থেকে সরাবার কল্পনা করেছিলেন। ফলে ঐ কথাটা সহসা মনে উদয় হওয়ায় হয়ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কী করবেন, কী ঐ সময় করা উচিত—এই সব নানা সাত-পাঁচ ভেবে হয়ত শেষে তিনি ঐ সময় কোন কিছু না প্রকাশ করাই সব দিক থেকে বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচনা করে সরে পড়েন এবং এর কিছুক্ষণ বাদে সমীরবাবু ফিরে এসে কাকার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যখন জানতে পারলেন যে তার কাকা মৃত তখন তিনিও ঐ এক কারণেই কিছু প্রকাশ না করে চুপ করে সরে পড়লেন। এদিকে হয়ত অধীরবাবু ঘরে ঢুকেই তার ঘরে সিরিঞ্জটা দেখতে পান এবং সাত-পাঁচ ভেবে সেটা সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে ফেলেন। পরের দিন সকালে সেটা বাড়ির পিছনদিকে ফেলে দেন। কেননা হয়ত তার সন্দেহ হয়েছিল, তার মেজদাই এ সিরিঞ্জ দিয়ে কাকাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছেন।
এ ছাড়াও আর একটা দিক দিয়ে মনে হয় অধীরবাবু নির্দোষ। তিনি আমাকে তার একটু আগে দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন যে তিনি দোষী নন। কিন্তু এমন কথা বলেননি যে তারা দোষী নন, কেননা তার মনে মেজদার প্রতি দৃঢ় সন্দেহ ছিল। কিন্তু আমার কানে ঐ তিনি ও তারার পার্থক্যটা এড়ায়নি। এর থেকেই হয়ত অধীরবাবুর নির্দোষিতা প্রমাণ হতে পারে।
ঘরের প্রত্যেকটি প্রাণীই যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত কিরীটীর কথা শুনছে। কারও মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।
কিরীটী একটুখানি থেমে একটা নতুন সিগারেট ধরিয়ে মৃদু একটা টান দিল ও একগাল ধোঁয়া ছেড়ে আবার বলতে শুরু করল, আচ্ছা, এবারে সমীরবাবু নির্দোষ কিনা এইভাবে বিচার করে দেখা যাক। ধরা যাক, অধীরবাবুর কথাই সত্যি। গগনেন্দ্রনাথ পাঁচটা ত্রিশ মিনিটের সময় বেঁচেই ছিলেন। তাই যদি হয়, তবে কি ভাবে সমীরবাবু দোষী হতে পারেন? আমরা ধরে নিতে পারি, পাঁচটা পঞ্চান্ন মিনিটের সময় যখন তিনি বেড়িয়ে হোটেলে ফিরে আসেন, যখন তার কাকার সঙ্গে গিয়ে কথা বলেন, সেই সময় তাকে তিনি খুন করেন। সে-সময় আশেপাশে লোক ছিল বটে, কিন্তু শীতের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সেই স্বল্পালোকে অন্যের অজান্তে তার পক্ষে তার কাকাকে খুন করাটা এমন কিছু কষ্টসাধ্য বা আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়। কিন্তু তাহলে ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীর কথা মিথ্যে হয়ে যায় যে, তার মতে গগনেন্দ্রনাথের দেহ পরীক্ষা করবার অন্তত এক ঘণ্টা আগে মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিমা দেবী বাধা দিয়ে বলে উঠল, আমার ধারণা নির্ভুল।
কিরীটী বলতে লাগল, আরও একটা সম্ভাবনা এক্ষেত্রে আছে। ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী সমীরবাবুর ফিরবার কিছু পরেই হোটেলে ফিরে আসেন। যদি সমীরবাবুর কথামত সে-সময় তার কাকা বেঁচেই থেকে থাকেন, তাহলে আমাদের ধরতে হবে ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীই নিশ্চয়ই গগনবাবুকে খুন করেছেন। তিনি জানতেন গগনবাবু অসুস্থ। মানসিক বিকৃতি তার ঘটেছে। সমাজেরও বিশেষ করে এদের family-র পক্ষে তিনি মূর্তিমান অমঙ্গল ও অশান্তি। এবং সেই সঙ্গে এই অত্যাচারিতদের দেখে এঁদের জন্যে তার মনে একটা অনুকম্পাও জেগেছিল। হয়ত সেই কারণেই এঁদের বাঁচাতে নিজ হাতে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করেছেন।
সহসা ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী বাধা দিয়ে বলে উঠল, না, আমি খুন করিনি।
কিন্তু মনে পড়ে কি প্রতিমা দেবী, আপনি একদিন ডাঃ চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ঐ শয়তান বুড়োকে খুন করা উচিত। ঐ শয়তানকে খুন করতে পারলে এখন হয়ত ওদের বাঁচবার আশা আছে…..দশজনের মঙ্গলের কাছে একজনের মৃত্যু সে তো বড় বেশী কথা নয়…
প্রতিমা বললে, হ্যাঁ, এ কথা একদিন কথায় কথায় ডাঃ চক্রবর্তীকে বলেছিলাম বটে, কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি, সেই শয়তান দুর্দান্ত অত্যাচারী বিকৃতমস্কি লোকটাকে যতই আমি ঘৃণা করি না কেন, তাকে সত্যি সত্যি খুন করব এমন কথা স্বপ্নেও আমি কোনদিন ভাবিনি। না, তাকে খুন করা দূরে থাক, তাকে মরবার পর ছাড়া স্পর্শ পর্যন্ত করিনি।
কিরীটী গম্ভীরভাবে বললে, তাহলে বাধ্য হয়েই আমাকে বলতে হয় ডাক্তার যে, আপনি না হয় সমীরবাবু আপনাদের মধ্যে একজন নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলছেন!
এবারে সমীর সহসা চিৎকার করে বলে উঠল, আপনারই জিত হল মিঃ রায়। সত্যিই আমি মিথ্যা কথা বলেছি। আমি যখন বেড়িয়ে ফিরে কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন তিনি মৃত। আমি অত্যন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই ঘটনার আকস্মিকতায়। কী করব প্রথমটা বুঝে উঠতে পারি না, সব গোলমাল হয়ে যায়। আমি তাঁকে বলতে যাচ্ছিলাম, তার নাগপাশের অধীনে আর আমি থাকব না। আমি চলে যাব। আজ থেকে আর আমি এ বাড়িতে থাকব না। আমি মুক্ত, আমি স্বাধীন। রাস্তায় রাস্তায় আমি ভিক্ষা করে খাব তবু তোমার মত শয়তানের কৃপাপ্রার্থী হয়ে এ কয়েদখানায় আর আমি বাঁচতে চাই না। কিন্তু গিয়ে দেখলাম তখন তিনি মৃত, তাঁর শরীর বরফের মত ঠাণ্ডা প্রাণহীন। আমার মনে ঠিক সেই কথাটাই জেগেছিল, যা একটু আগে আপনি অধীর সম্পর্কে বলেছিলেন, যে অধীর হয়ত শেষে কাকাকে খুন করেছে এবং আমি কাকার ডান হাতের উপরে একবিন্দু রক্ত দেখেছিলাম, তাতে মনে হয়েছিল যে তাকে কোন কিছু ইনজেকশন করা হয়েছে।
কিরীটী সহসা বলে উঠল, এই একটা পয়েন্ট যাতে আমি স্থিরনিশ্চিত হতে পারিনি যে, কীভাবে আপনি আপনার কাকার প্রাণ নেবার সংকল্প করেছিলেন। তবে একটু ধারণা করেছিলাম যে, আপনার কল্পনার সঙ্গে সিরিঞ্জের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমাকে যদি বিশ্বাস করেন তবে বাকিটা বলুন।
সবই বলব মিঃ রায়, একটা ইংরাজী বইতে পড়েছিলাম, একজন একজনকে ইনজেকশন করে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছিল। সেই থেকেই ঐভাবেই খুন করবার একটা দুষ্ট চিন্তু সর্বদা আমার মাথায় ঘুরত।
এখন বোঝা যাচ্ছে, ঐজন্যই আপনি শেষ পর্যন্ত একটা সিরিঞ্জ কিনেছিলেন।
না, কিনিনি, বৌদির বাক্স থেকে সেটা চুরি করে নিয়েছিলাম।
সহসা বিনতা দেবী যেন লজ্জায় লাল হয়ে উঠে বললে, কিন্তু আমি-আমি সে কথা জানতাম না।
কিরীটী বললে, এতক্ষণে দুটো সিরিঞ্জের রহস্য উদঘাটিত হল। যেটা বিনতা দেবীর ছিল, সমীরবাবু সেটা চুরি করলেন। পরে অধীরবাবু সমীরবাবুর ঘরে সেটা পেয়ে সন্দেহবশে মেজদাকে বাঁচাবার জন্য বাড়ির পিছনে ফেলে দিলেন। বেশ, তাহলে আবার আমাদের সময়তালিকাটি পুনর্বিচার করে দেখা যাক।
তিনটে পাঁচ মিনিটের সময় সমীরবাবু, সমরবাবু ও রণধীরবাবু সব বেড়াতে বের হন।
তিনটে পনের মিনিটের সময় ডাঃ চক্রবর্তী ও ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী বেড়াতে বের হন।
চারটে পনের মিনিটের সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু বেরিয়ে যান।
চারটে কুড়ি মিনিটের সময় জুরে কাঁপতে কাঁপতে ডাঃ চক্রবর্তী ফিরে আসেন।
চারটে পয়ত্রিশ মিনিটের সময় রণধীরবাবু ফিরে আসেন।
চারটে চল্লিশ মিনিটের সময় বিনতা দেবী ফিরে এসে গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যান এবং তার সঙ্গে কথা বলে স্বামীর ঘরে যান প্রায় চারটে পঞ্চাশ মিনিটের সময়।
পাঁচটা দশ মিনিটের সময় অধীরবাবু ফিরে আসেন।
পাঁচটা চল্লিশ মিনিটের সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু ফিরে আসেন।
পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময় সমীরবাবু ফিরে আসেন।
ছটার সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ফিরে আসেন।
ছটা তিরিশ মিনিটের সময় গগনেন্দ্রনাথ মৃত আবিষ্কৃত হন।
এই সময় তালিকা সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, চারটে পঞ্চাশ মিনিটের সময় বিনতা দেবী যখন ফিরে এসে তার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলে রণধীরবাবুর ঘরে চলে যান ও পাঁচটা দশ মিনিটের সময় যখন অধীরবাবু ফিরে আসেন—এই যে কুড়ি মিনিট সময় তার মধ্যে (অধীরবাবুর কথা যদি সত্যি বলে মেনে নিই) গগনেন্দ্রনাথ খুন হয়েছেন।
এখন কথা হচ্ছে, ঐ কুড়ি মিনিট সময়ের মধ্যে কে তাকে খুন করতে পারে! ঐ সময় ডাঃ গাঙ্গুলী ও সমীরবাবু দুজনে এক জায়গায় ছিলেন। যতীনবাবুর (যাঁর গগনেন্দ্রনাথকে খুন করবার মত কোন সঙ্গত কারণই থাকতে পারে না) একটা alibi আছে বটে, তিনি, বারীনবাবু ও সমরবাবু একসঙ্গে ছিলেন। রণধীরবাবু ও তার স্ত্রী বিনতা দেবী পাশের ঘরেই ছিলেন; ঐ সময়ে ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী তার ঘরে একা একা শুয়ে জ্বরে গোঙাচ্ছেন। হোটেলে নীচের তলায় আর কেউই প্রায় ছিল না। ঐ সময় কারো কাউকে খুন করবার অপূর্ব সুযোেগ হতে পারে। এমন কি কেউ হোটেলের নীচের তলায় ঐ সময় ছিল যে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করতে পারে? বলতে বলতে কিরীটী আড়চোখে একটিবার অদূরে উপবিষ্ট কিশোরের দিকে তাকাল। তারপর আবার বলতে লাগল, একজন সে-সময় সেখানে ছিল—সে হচ্ছে কিশোর। কিশোর সেদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আগাগোড়া হোটেলে নিজের ঘরেই ছিল। হোটেলের বাইরে যায়নি।
এ কথাও ঠিক যে বেলা তিনটে থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত কিশোর তার নিজের ঘরে ছিল না। তার প্রমাণ পেয়েছি। কিশোর তার জবানবন্দিতে একটা বিশেষ কথা বলেছিল। ডাঃ চক্রবর্তী নাকি জ্বরের ঘোরে তার নাম ধরে ডাকছিলেন। কিন্তু কিশোর যে ঘরে থাকে সেখান থেকে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘর দূরে, জ্বরের ঘোরে সেখান থেকে ডাকলেও সে ডাক শোনা যেতে পারে না। তাছাড়া ডাঃ চক্রবর্তীও জ্বরের ঘোরে কিশোরকে নাকি স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আসলে ডাক্তারের সেটা স্বপ্ন নয়, কিশোরকে সশরীরেই তার ঘরে সেদিন দেখেছিলেন তার শয্যার পাশে। তিনি মনে করেছিলেন, ওটা তার স্বপ্ন বা জুরবিকার। আসলে সত্যি সত্যি কিশোর সে-সময় ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে গিয়েছিল। এমনও তো হতে পারে, কিশোর সেই সময় তার কাকাকে খুন করে ডাক্তারের ঘরে সিরিঞ্জটা রাখতে গিয়েছিল।
কিশোর মুখ তুলে কিরীটীর দিকে তাকাল। তার মাথার তৈলহীন রুক্ষ এলোমেলো চুলগুলি মুখের চারপাশে ও ঘাড়ের উপর এসে ঝাপিয়ে পড়েছে। বড় বড় সুন্দর টানা টানা দুটি চক্ষু। সে চোখের দৃষ্টিতে কোন ভাব নেই। যেন সহজ অসহায় উদাস ব্যথায় ক্লান্ত, অশ্রুআবিল।
এমন সময় ডাঃ চক্রবর্তী বলে উঠল, আশ্চর্য!
কিন্তু মনোবিজ্ঞানের দিক দিয়ে এটা কি একেবাবেই অসম্ভব ডাঃ চক্রবর্তী? কিরীটী প্রশ্ন করলে।
কিন্তু তাদের বাধা দিয়ে বিনতা দেবী যেন একপ্রকার চিৎকার করেই বললে, না না, এ অসম্ভব! এ অসম্ভব! এ হতে পারে না!
কেন হতে পারে না বিনতা দেবী?
তীক্ষ্ম ধারাল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটী বিনতা দেবীর দিকে তাকাল। সাপের দৃষ্টির মত সম্মোহন সে দৃষ্টিতে, যেন অন্তর্ভেদী ধারাল তীক্ষ্ণ আলোর রশ্মির মত অনুসন্ধানী। বিনতার অন্তস্তল পর্যন্ত ভেদ করছে। বিনতা বললে, হ্যাঁ, অসম্ভব। এ শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, এ আপনার বাতুলতা।
কিশোর চেয়ারটার উপরে একটু নড়েচড়ে বসল। তার ভাবলেশহীন পাথরের মত খোদাই করা মুখের উপরে যেন সহসা একটা চাপা কৌতূহলের আভা ফুরিত হচ্ছে।
কিরীটী একবার মাত্র তীব্র দৃষ্টিতে বিনতা দেবীর দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগল, আপনি একজন সত্যিকারের বুদ্ধিমতী মহিলা বিনতা দেবী। আপনারবুদ্ধির প্রশংসা কিরীটী রায়ও করছে।
আপনি কি বলতে চান, মিঃ রায়? তীক্ষ্ম স্বরে বিনতা দেবী প্রশ্ন করল।
আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাই বিনতা দেবী যে, এতক্ষণে সত্যিই আমি বুঝতে পেরেছি তীক্ষ্ণ ধারাল বুদ্ধির একটা চমৎকার মুখোশ আসল সত্যিকারের রূপটাকে ঢেকে রেখেছে। সত্যিই আপনি প্রশংসার যোগ্য। বাংলাদেশের সাধারণ ঘরোয়া মেয়েদের মধ্যে এতখানি বুদ্ধির প্রখ্য ইতিপূর্বে আমার চোখে আর পড়েছে কিনা বলতে পারি না।
কুণ্ঠায় ও লজ্জায় বিনতা দেবীর দৃষ্টি নত হয়ে এল। কিরীটী বলতে লাগল, লজ্জিত হবেন না মিসেস মল্লিক। তোষামোদ বা চাটুকার্য আমার পেশা নয়। এ বাড়ির অদ্ভুত জীবনধারার সঙ্গে আপনি আপনার নিজস্ব গড়ে-ওঠা জীবনধারাকে অতি কৌশলের সঙ্গে যেন খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। বাইরে আপনি আপনার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করতেন, তাঁর মতেই মত দিয়ে চলতেন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আপনি তাকে সমস্ত অন্তর দিয়েই ঘৃণা করতেন, তার সমগ্র কাজ ও ব্যবহারকে অন্যায় অবিচার বলে অবজ্ঞা করতেন। কিছুদিন থেকে আপনি ভাবছিলেন এবং আপনার স্বামীকে নিয়ে এ বাড়ি ত্যাগ করে চলে যাবার জন্য উত্তেজিত করছিলেন। আপনি ভেবেছিলেন তা যদি পারেন তবেই নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে তিল তিল করে যে নাগপাশের বন্ধনে আপনার স্বামী বাঁধা পড়েছিলেন, তার প্রভাবকে অস্বীকার করবার মত মনের শক্তি আর আপনার স্বামীর ছিল না।
অনেক চেষ্টাতেও যখন আপনি আপনার স্বামীকে আপনার মতে আনতে সক্ষম হলেন, তখন অতি অদ্ভুত উপায়ে আপনার স্বামীর ঘুমিয়ে পড়া মনকে জাগিয়ে তুলবার জন্য আঘাত হানবার কল্পনা করলেন। তাকে ভয় দেখালেন, আপনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। স্বাধীন ভাবে জীবিকা অর্জন করবেন। আপনি সত্যিই আপনার স্বামীকে ভালবাসেন। এটা আপনার স্বামীকে মাত্র ভয় দেখানোর উপায় ভেবেছিলেন, একথা শুনলে যদি আপনার স্বামী। শেষ পর্যন্ত ফিরে দাঁড়ান। এবং হয়েছিলও তাই। আপনার কথায় সত্যি এতদিন পরে। রণধীরবাবুর ঘুমিয়ে পড়া পৌরুষের গোড়ায় আঘাত লাগল। এতদিনকার কাকুতিমিনতি যা করতে পারেনি, এক কথায় সেটা সম্ভব হল। এমনিই হয়। কখন কী সামান্য ঘটনা হতে যে মানুষের মনের মূলটা পর্যন্ত নড়ে ওঠে, চিরদিনকার যুক্তি শিথিল হয়ে আসে, কেউ তা বলতে পারে না। রণধীরবাবুর মনের গোড়াতেও ঝড় উঠল। তিনি হয়ত ভাবলেন, যার জন্য এত দুঃখ, এত কষ্ট, তাকে শেষ করে ফেলতে পারলেই সব আপদের শান্তি হয়, তাই হয়ত তিনি শেষ পর্যন্ত…
বিনতা প্রবল ভাবে বাধা দিল, না, না, এ আপনার ভুল কিরীটীবাবু। আপনি ভেবেছেন। আমার স্বামীকে আমি সেদিন ঐ কথা বলবার পর আমার স্বামী খুব রেগে বা চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু আসলে তা তিনি হননি। তাছাড়া আমি সেদিন বিকেলে বেড়িয়ে ফিরে আমার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করে সোজা আমার স্বামীর ঘরে গিয়ে প্রবেশ করি, এবং চা খেতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা দুজনে সে ঘরে বসে গল্প করেছি। তার মৃত্যুর জন্য আমি হয়ত বা দায়ী হতে পারি, অর্থাৎ আমার শ্বশুরকে আমার মনের অভিসন্ধির কথা বলে তার দুর্বল শরীরে আঘাত দিতে পারি, হয়ত সে আঘাতের ফলে তার হঠাৎ মৃত্যু হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়, এবং সত্যি যদি হয়ে থাকে, তাহলেও আমার বিরুদ্ধে আপনার কোন প্রমাণই নেই মিঃ রায়।
কিরীটী গম্ভীর স্বরে বললে, আছে বৈকি। আমার সময়-তালিকাটার বারো নম্বর পয়েন্টটা বিবেচনা করে দেখুন। সাড়ে ছটার সময় যখন চা খেতে সকলে খাবার ঘরে গেছেন, গগনেন্দ্রনাথকে চা পান করতে ডাকবার জন্য ভৃত্যকে তার কাছ পাঠানো হয়েছিল।
সমীর বললে, আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না মিঃ রায়!
অধীরও সঙ্গে সঙ্গে বললে, আমিও বুঝলাম না।
কিরীটী জবাব দিলে, ও বুঝতে পারছেন না, না? গগনেন্দ্রনাথকে ডাকতে একজন ভৃত্যকে পাঠানো হয়েছিল কেন? চিরদিন আপনার ভাইরা একজনের মধ্যে যে কেউ বা বিনতা দেবীই তাকে চা পান করবার বা খাবার সময় ডাকতে যেতেন। কেননা সেটাই আপনাদের কাকা বেশী পছন্দ করতেন। কাকাকে ডাকতে যাওয়া আপনারা আপনাদের একটা কর্তব্য বলেই মেনে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে ইদানীং সর্বদাই আপনাদের মধ্যে একজন
একজন তার কাছে কাছে থাকতেন। সমীরবাবু ও বিনতা দেবী দুজনেই তাদের জবানবন্দীতে একথা স্বীকার করেছেন। তাই যদি হয়, তবে সেদিন সন্ধ্যায় চা পান করবার জন্য আপনাদের মধ্যে কেউ একজন তাকে না ডাকতে গিয়ে ভৃত্যকে পাঠানো হয়েছিল কেন? এ বাড়ির প্রচলিত নিয়মের কেন ব্যতিক্রম হয়েছিল সেদিন সন্ধ্যায়?
কেউ আপনারা ডাকতে যাননি, কেননা ঘটনার আকস্মিকতায় আপনারা সকলেই তখন বিমূঢ় ও বিবশ হয়ে গিয়েছিলেন। কী করা উচিত না উচিত এ প্রশ্নটাই আপনাদের প্রত্যেককে তখন বিচলিত করে তুলছিল। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মনে আপনারা ভাবছিলেন, কেন আপনাদের মধ্যে একজন কাকাকে ডাকতে যাচ্ছে না। তার কারণ একটা ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদের জন্য মনে মনে আপনারা প্রত্যেকেই তখন অবশভাবে অপেক্ষা করছিলেন।
বিনতা দেবী জবাব দিলেন, না, তা হয়। আমরা প্রত্যেকেই সেদিন ক্লান্ত ও অবসন্ন। অবশ্য স্বীকার করি আমাদেরই একজনের কাউকে ডাকতে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু যেহেতু আমাদের মধ্যে কেউ যায়নি বলেই যে আমাদের মধ্যে কেউ দোষী এ যুক্তিটা ছেলেমানুষের যুক্তির মত হল না?
কিরীটী বললে, হয়ত বা তাই। কিন্তু বিনতা দেবী, আপনি বা সমীরবাবুই বেশীরভাগ সময় ও কাজটা করতেন, সেকথা দুজনেই তো আপনারা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেদিন রাত্রে ইচ্ছা করেই আপনি তাকে ডাকতে যাননি। কিন্তু কেন আপনি যাননি জানেন? কিরীটীর স্বর সহসা যেন ছুরির ফলার মত তীক্ষ্ণ ও ধারাল হয়ে উঠল, তার কারণ আপনি তখন জানতেন যে আপনার শশুর মৃত। হ্যাঁ, আপনি জানতেন। গভীর উত্তেজনায় কিরীটীর গলার স্বর কাঁপতে লাগল।
বিনতা দেবী প্রত্যুত্তরে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কিরীটী তার কথায় ক্ষেপমাত্র করে বলতে লাগল, না না, আমি আপনার কোন কথা বা কোন যুক্তিই মানতে চাই না। শুনুন মিসেস মল্লিক, আমি—যা আমি কিরীটী রায় বলছি, আমাকে চেনবার ও জানবার অবকাশ হয়ত আপনার হয়নি, তাহলে এভাবে নিজেকে লুকোবার এই হাস্যকর প্রয়াস নিশ্চয়ই করতেন না।
স্বীকার করি আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা এবং অনেকের চাইতে ঢের বেশী বুদ্ধি রাখেন। কিন্তু তবু আমার চোখে ধূলো দেবার মত ক্ষমতা আপনার নেই। অবিশ্যি এটা ঠিকই যে বেড়িয়ে ফিরে এসে যে সময় আপনি গগনবাবুর সঙ্গে দেখা করেন, সে সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু হোটেলেই ছিলেন এবং তারা আপনাকে গগনবাবুর সঙ্গে কথা বলতেও দেখেছেন। তারা শুধু দূর থেকে আপনাকে গগনবাবুর সঙ্গে কথা বলতেই দেখেছিলেন, কিন্তু কী কথা যে আপনি বলছিলেন তা তারা শুনতে পাননি। কেননা এত দূর থেকে সেটা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আসলে সে-সময় আপনি যে সেখানে কী করছিলেন তার কোন প্রমাণই আমাদের হাতে নেই। তবু এ বিষয়ে আমার একটা theory আছে বা কল্পনা করেছি।
আগেই বলেছি আপনার বুদ্ধি আছে। খুব তাড়াতাড়ি যদি আপনি যে কোন ভাবেই হোক আপনার খুড়শ্বশুরকে এ সংসার থেকে সরাবার ইচ্ছা করতেন তবে সেটা সহজেই এবং অনেকদিন আগেই করতে পারতেন। একটুখানি বুদ্ধি আর তার সঙ্গে একটুখানি সুযোগের যোগাযোগ। কিন্তু তাড়াতাড়ি কাজটা না শেষ করে হয়ত বিশেষ একটা সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। আপনি হয়ত সকালবেলা কোন এক সুযোগে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে ঢুকে ডিজিট্যালিনের শিশিটা ও সিরিঞ্জটা চুরি করে এনেছিলেন। কাউকে খুন করবার মত ঔষধ বেছে নেওয়া আপনার পক্ষে বিশেষ কষ্টকর ছিল না। কেননা নার্সিং আপনি কিছুদিন শিক্ষা করেছিলেন। ডাক্তারী ঔষধপত্র সম্পর্কে বেশ কিছু জ্ঞান আপনার আছে। আপনি ইচ্ছা করেই ডাক্তারী ব্যাগ থেকে ডিজিট্যালিনের শিশিটা বেছে নেন, ঠিক যে ধরণের ঔষধ আপনার শ্বশুর খেতেন। আপনি সিরিঞ্জে ঐ ঔষধ ভরে রাখেন ও উত্তেজনার বশে গগনেন্দ্রনাথের শরীরে প্রয়োগ করে তাকে খুন করেন। কিন্তু কাজ হাসিল হয়ে যাবার পর সিরিঞ্জটা আর ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে রাখবার সুযোগ পাননি, কেননা সেই সময় ডাঃ চক্রবর্তী তার ঘরে শুয়ে জ্বরের ঘোরে কাপছিলেন।
আগে থাকতেই সব আপনি planকরে রেখেছিলেন। দূর থেকে বারীনবাবু ও যতীনবাবু গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে আপনাকে কথা বলতে দেখেছেন মাত্র। আপনি অনায়াসেই গগনেন্দ্রনাথের হাতে ইনজেকশন করে বিষপ্রয়োগ করেছিলেন। বুড়ো রোগগ্রস্ত মানুষ, বাধা দেবার বা চিৎকার করবারও সুযোগ পাননি হয়ত এবং বিষপ্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটেছিল। কাজ শেষ করে আবার হয়ত কথা বলবার ভান করে বা অভিনয় করে আবার তাঁর পাশে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যান। দূর থেকে যতীনবাবু ও বারীনবাবু সে সময় আপনাকে দেখতে পান। তারা ভেবেছেন আপনি তার সঙ্গে কথা বলছেন, খুবই এটা স্বাভাবিক। কে আপনাকে এক্ষেত্রে সন্দেহ করতে পারে বলুন! তারপর আপনি সেখান থেকে ফিরে আপনার স্বামীর ঘরে ঢুকে বাকি সময়টা তার সঙ্গেই কথাবার্তা বলে কাটান, সেখান থেকে আর অন্য কোথাও যাননি।
কাজ হাসিল হয়ে গিয়েছিল, কোথাও আর যাবার তো দরকার ছিল না। আপনি জানতেন, কেউ আপনাকে সন্দেহ করতে পারবে না। বহুদিন থেকে গগনেন্দ্রনাথ হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন সকলেই ভাববেন তিনি হঠাৎ হার্টফেল করেই মারা গেছেন। সবই ঠিক ছিল বিনতা দেবী, কিন্তু সামান্য একটা কারণের জন্য আপনার সমগ্র plan ভেস্তে গেল। আপনি কাজ হাসিল করবার পর সিরিঞ্জটা আর আগের জায়গায় রেখে আসবার সুযোগ বা সুবিধা পাননি। কেননা ডাঃ চক্রবর্তী তখন তার ঘরে ছিলেন। যদিও আপনি জানতেন না যে, ডাক্তার ইতিপূর্বেই তার সিরিঞ্জটা যে খোয়া গেছে তা জানতে পেরেছিলেন। বিনতা দেবী, এই একটিমাত্র গলদেই সব ভেস্তে গেল। নচেৎ চমৎকার একটি perfect crime হয়েছিল।
সহসা যেন ঘরের মধ্যে একটা বজ্রপাত হয়েছে। স্তম্ভিত হতবাক হয়ে সবাই বসে রইল, কারও মুখে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত নেই।
শ্মশানের মতই একটা জমাট স্তব্ধতা যেন সমগ্র ঘরখানির মধ্যে থমথম করছে।
সবাই যেন বোবা হয়ে গেছে বিস্ময়ে আতঙ্কে ও ঘটনার আকস্মিকতায়।
এমন সময় রণধীর উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে এবং প্রতিবাদের সুরে বললে, না না, এ একেবারে মিথ্যে কথা। ও নির্দোষ, সম্পূর্ণ নির্দোষ। ও কিছুই করেনি। আমার কাকা তার আগেই মারা গিয়েছিলেন।
কিরীটী চোখ দুটো সহসা যেন অস্বাভাবিক এক উজ্জ্বলতায় ঝকঝক করে উঠল, মৃদুস্বরে সে বলল, আঃ। তাহলে শেষ পর্যন্ত আপনিই গগনেন্দ্রনাথকে খুন করেছিলেন, বলুন?
আবার মুহূর্তের জন্য স্তব্ধতা।
রণধীর ততক্ষণে চেয়ারের উপরে আবার থপ করে বসে পড়েছে। গভীর উত্তেজনায় তখনও তার সর্বশরীর কাঁপছে। ক্লান্তক্লিষ্ট স্বরে কোনমতে শুধু উচ্চারণ করলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ,–আমিই তাকে খুন করেছি।
কিরীটী প্রশ্ন করলে, আপনিই তাহলে ডাঃ চক্রবর্তীর ব্যাগ থেকে সিরিঞ্জ ও ডিজিট্যালিনের শিশিটা চুরি করেছিলেন?
হ্যাঁ।
কখন?
একটু আগে আপনিই তো তা বললেন মিঃ রায়!
কেন আপনি তাকে খুন করলেন?
সে কথা আমাকে আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন কি মিঃ রায়?
হ্যাঁ, আমি জিজ্ঞাসাই করছি। বলুন? জবাব দিন?
জানেন তো আমার মনের অবস্থা তখন কী রকম হয়েছিল। কিন্তু কেন, কেন আমাকে আপনি এ প্রশ্ন করছেন মিঃ রায়? রণধীরের কণ্ঠ থেকে যেন একটা প্রবল বিরক্তির ঝাজ ঝরে পড়ল, কী হবে আপনার এসব শুনে?
কিরীটী বললে, অনেক কিছুই হবে রণধীরবাবু। আমি চাই এখনও আপনি যা জানেন তা গোপন না করে খুলে সব বলুন। এখনও সত্য কথা বলুন।
সত্য কথা বলব?
হ্যাঁ হ্যাঁ, সত্যি কথা বলুন।
হা ভগবান, তাই আমি বলব। কিন্তু জানি না, সেকথা বিশ্বাস করবেন কিনা। তবু–তবু আমি বলব। একটা দীর্ঘশ্বাস রণধীরের বুকখানা কাপিয়ে বের হয়ে এল। রণধীর বলতে লাগল, সেইদিন দুপুরে আমার মনের অবস্থা অত্যন্ত unbalanced ছিল। আর এ জীবন সহ্য হচ্ছে না। এ বন্ধন যেন নাগপাশের মতই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে। মুক্তি-মুক্তি চাই। এমনি ভাবে আর বেশীদিন থাকলে আমি বোধ হয় পাগল হয়েই যাব। আমার কেবলই কদিন থেকে মনে হচ্ছিল, আমিই এ সব কিছুর জন্য দায়ী। আমি সকলের বড়। ছোট ভাইরা সব আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। তাদের অসহায় যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে কতদিন-কতদিন আমি ভেবেছি, এই শৃঙ্খল আমি ছিড়ে ফেলব। সকলকে আমি মুক্তি দেব। সকলকে আবার বাঁচিয়ে তুলব। দিনের পর দিন এক বৃদ্ধ বিকৃত-মস্তিষ্কের নিষ্ঠুর খেয়ালের নাগপাশে বন্দী হয়ে জর্জরিত হবার চাইতে বুঝি মৃত্যুও ভাল। কী যে সে যন্ত্রণা আমি ভোগ করেছি তা কেউ জানত না।
আপনাকে আমি কী বলব মিঃ রায়, কতদিন রাত্রে শিশুর মতই আমি একা একা শয্যায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছি। কিশোরের মনের অবস্থা দিন দিন যেভাবে সর্বনাশের পথে এগিয়ে চলছিল, সে আর যেন দেখতে পারছিলাম না। আমার সহ্যশক্তি যেন ভেঙে এড়িয়ে যাচ্ছিল। বাপ-মা-হারা ছোট ভাইটির সেই অসহায় করুণ মুখখানা যেন আমার হৃদয়ে নিশিদিন ব্যর্থ অনুশোচনার দাবাগ্নি জ্বালাত। সাপ যেমন তার চোখের দৃষ্টিতে শিকারকে সম্মোহিত করে রাখে, আমারও হয়েছিল সেই অবস্থা।
কাকার উন্মাদ পরিকল্পনা যেন অক্টোপাশের মত অষ্টবাহুতে আমাকে আঁকড়ে ধরে আমার রক্ত শোষণ করছিল। সমস্ত রাত্রি ধরে কত সঙ্কল্পের পর সঙ্কল্পই না আটতাম, কিন্তু সকালবেলা কাকার মুখের দিকে চাইলেই বন্যার মুখে স্রোতের কুটোর মত সব ভেসে যেত। অহর্নিশি অন্তর ও বাইরের এই দ্বন্দ্ব যেন আমায় পাগল করে তুলছিল, সামান্য শব্দে কেঁপে উঠতাম, সামান্য উত্তেজনায় আমার বুক কাঁপত। বোঝাতে পারব না আপনাকে আমার সেই অসহায় অবস্থার কথা। শেষকালে আর স্থির থাকতে পারলাম না। সেদিন বিকালে অনেক সাহস সঞ্চয় করে একটা উত্তেজনার মধ্যেই কাকার কাছে এগিয়ে গেলাম এর একটা শেষ মীমাংসা করতে।
সহসা অধীর ও সমীর চিৎকার করে উঠল, দাদা! দাদাভাই!
রণধীর তখন পাগলের মতই হয়ে উঠেছে, সে ভাইদের কথায় প্রবলভাবে চিৎকার করে বলে উঠল, না না, তোরা থাম। তোরা থাম। আজ তোরা আমায় বলতে দে। আজ আমার সকল সঙ্কোচ ভেঙেছে। দীর্ঘ একুশ বছরের এ অসহ্য যন্ত্রণা আর পুষে রাখতে পারছি না।
হ্যাঁ শুনুন মিঃ রায়, তারপর কাকার সামনে গিয়ে কি দেখলাম জানেন, দেখলাম তিনি মৃত। মৃতদেহ সেখানে চেয়ারের উপরে বসে আছে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, কী করব-কী করা উচিত! চিৎকার করে সকলকে একবার যেন ডাকতে গেলাম, কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে আমার কোন স্বর বের হল না। তখন আমি ধীরে ধীরে আমার ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। কাউকে কোন কথা বললাম না। আমিও তার হাতে ইনজেকসনের দাগ দেখেছিলাম। আমি জানি কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। করতে পারে না। তবু আপনাকে বললাম। বলে রণধীর হাঁপাতে লাগল।
ডাঃ চক্রবর্তী বললে, খুব স্বাভাবিক এটা রণধীরবাবু, যা আপনি করেছেন। একেই দীর্ঘদিন ধরে আপনি অন্তরে ও বাইরে উত্তেজিত ছিলেন, আপনার ঐ মানসিক অবস্থায় ওভাবে হঠাৎ কাজ করা কিছুই আশ্চর্য নয়। খুব স্বাভাবিক। আপনার তখন মানসিক পক্ষাঘাত হয়েছে।
কিরীটী এতক্ষণে বললে, রণধীরবাবু, আপনার এ কথা আমি বিশ্বাস করি। এবং ঐজন্যই বিনতা দেবী গগনেন্দ্রনাথকে মৃত জেনেও সেকথা গোপন করে গেছেন, তাই নয় কি?
রণধীর বললে, তাই। কিন্তু মিঃ রায়, সত্যি কি আপনি আমাকে সন্দেহ করেছিলেন?
ঠিক তাই নয়, কিরীটী বললে, তবে একবার মনে হয়েছিল, আপনার দ্বারা তাঁকে খুন করা একেবারে অসম্ভব নয়।
তবে, রণধীর বললে, আমাদের মধ্যে যদি কেউই তাকে খুন করে থাকি, তবে কে তাকে খুন করলে? কী সত্যি ঘটেছিল? আসল ব্যাপারটা কি?
জানতে চান কি তবে সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল? কিরীটী বলতে লাগল, শুনুন বলছি। সিরিঞ্জ ও ডিজিট্যালিন ডাঃ চক্রবতীর ব্যাগ থেকে খোয়া গিয়েছিল। গগনেন্দ্রনাথের হাতেও ইনজেকশনের দাগ ছিল, সে আপনারা অনেকেই দেখেছেন ও বিশ্বাস করেন। ময়নাতদন্ত হলেই সে কথা আমরা জানতে পারতাম। কিন্তু তার আর উপায় নেই। আমাদের যখন সন্দেহ হয়েছে তখন আসল সত্যটা জেনে আমাদের সন্দেহটা মিটিয়ে নেওয়া ভাল, যখন খুনী আমাদের মধ্যে বসে আছে নির্ভয়ে স্বচ্ছন্দ চিত্তে।
সমীর বললে, এখনও আপনি বিশ্বাস করেন মিঃ রায় যে, আমাদের মধ্যেই কেউ কাকাকে হত্যা করেছি।
কিরীটী চুপ করে রইল।
.
(আমার পাঠক-পাঠিকাগণ,
আপনারা প্রথম থেকেই সমগ্র ব্যাপারগুলো পড়েছেন। কী করে রহস্যটা গড়ে উঠল, সেটাও আপনাদের চোখের উপরেই। প্রত্যেকটি চরিত্র নিয়েই কিরীটী সূক্ষ্ম বিচার করেছে এবং আলোচনার মধ্যে দিয়ে সে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে খুনী কে? আপনাদের জিজ্ঞাসা করছি, বলুন দেখি কে খুনী এবং কেন তাকে আপনারা সন্দেহ করছেন?
লেখক)
.
কিরীটী বলতে লাগল, শুনুন প্রথম থেকেই দুটো ব্যাপার আমার কাছে একটু আশ্চর্য ঠেকেছিল। যার কোন মীমাংসাই পাচ্ছিলাম না খুঁজে। গগনেন্দ্রনাথ নিত্য একটু ঔষধ সেবন করতেন, যার মধ্যে একটা ingredientDigitain; দ্বিতীয়ত, ডাঃ চৌধুরীর হাইপোড়রমিক সিরিঞ্জটা কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। এই দুটো পয়েন্টকে একসঙ্গে বিচার করে দেখুন, তাহলেই দেখতে পাবেন ঐ দুটো point–এর জন্য আপনাদের সকলকেই সন্দেহ করা যেতে পারে। অথচ সূক্ষ্ম বিচার ও আলোচনার দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেল আপনারা ভাইরা বা বিনতা দেবী কেউই দোষী নন।
যে লোকটা আগে থেকেই হার্টের ব্যারামে ভূগছিল এবং প্রত্যহ ঔষধের সঙ্গে ডিজিট্যালিন সেবন করছিল, তাকে মারতে হলে ঔষধের সঙ্গে একটু বেশীমাত্রায় ডিজিট্যালিন সেবন করিয়ে দিলেই সবচাইতে সহজ ও বুদ্ধিমানের কাজ হত। আপনাদের মধ্যেই যদি কেউ হত্যাকারী হতেন, তাহলে ঐভাবে আপনাদের কাকাকে হত্যা করতে হলে কী করতেন? যে শিশি থেকে তিনি নিয়মিত ঔষধ সেবন করতেন, তার মধ্যে বেশীমাত্রায় ডিজিট্যালিন মিশিয়ে রাখতেন। কেউ টের পেত না। কেউ জানতেও পারত না, অথচ নিঝঞাটে কাজটা হাসিল হয়ে যেত এবং এভাবে কাজটা একমাত্র সম্ভব হত তাদের দ্বারা যারা তাঁর বাড়ির লোক বা যারা তাকে সেই ঔষধ খাইয়ে দিলে কেউই সন্দেহ করতে পারবে না। যখন বিনতা দেবীর মুখে শুনলাম ঔষধের শিশিটা ভেঙে গেছে তখন ঐ সন্দেহটা বেশী করে আমার মনে উঠেছিল।
ওভাবে মারা গেলে এবং শিশির ঔষধটা পরীক্ষা করলে যখন দেখা যেত যে, তার মধ্যে বেশীমাত্রায় ডিজিট্যালিন আছে, তখন অনায়াসেই ওটার একটা explanation খাড়া করা যেতে পারত। বলা যেত, ভুল করে হয়ত ঔষধের দোকানদার যে ঔষধটা dispenseকরেছে, তাতে বেশী ডিজিট্যালিন মিশিয়ে ফেলেছে। এতে বাড়ির লোকের দোষ কী? এমন ভুল তো দোকানদাররা মাঝে মাঝে করেও থাকে, ফলে কিছুই ওই শিশি থেকে প্রমাণ করা যেত না। কিন্তু ওই সঙ্গে আর একটা সম্ভাবনাকে অস্বীকার করতে পারিনি। সেটা হচ্ছে মৃতের দেহে ইনজেকশনের দাগ ও সেই সঙ্গে ডাক্তারের ঘর থেকে ডিজিট্যালিনের শিশিটা ও সিরিঞ্জটা চুরি যাওয়া। এর দুটি মাত্র মীমাংসা হতে পারে। এক ডাক্তারেরই দেখার ভুল, সিরিঞ্জ বা ঔষধ মোটেই চুরি যায়নি। অথবা হত্যাকারী সিরিঞ্জ ও ঔষধ চুরি করেছিল এইজন্য যে, গগনেন্দ্রনাথের নিত্য-ব্যবহৃত শিশিটার মধ্যে অন্যের অলক্ষে ডিজিট্যালিন ঢালার অবকাশ পায়নি বলে। অর্থাৎ এর থেকেই প্রমাণ হচ্ছে যে, হত্যাকারী বাড়ির কেউ নয়, বাইরের লোক।
এ ব্যাপারটা যে আগে আমার মনে উদয় হয়নি তা নয়। কিন্তু রণধীরবাবুদের দিকটা ভেবে দেখতে গেলে, ওঁদের দিক থেকে কাকাকে হত্যা করবার এত সঙ্গত কারণ ছিল যে, তাদের বাদ দিতে পারিনি প্রথমটায় আমার সন্দেহের তালিকা থেকে এবং তখনই ভাবতে লাগলাম, এও কি সম্ভব! ওঁদের দোষী সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ওঁরা নির্দোষ। এখন এইটাই আমাদের মীমাংসা করতে হবে। হত্যাকারী একজন বাইরের লোক। অর্থাৎ গগনেন্দ্রনাথকে এমন একজন কেউ হত্যা করেছে যে গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে এত পরিচিত নয়, যাতে করে সে অনায়াসেই তার ঘরে ঢুকে ঔষধের শিশিটার মধ্যে বেশী করে ডিজিট্যালিন মিশিয়ে রেখে আসতে পারে। এই ঘটনার সময় গগনেন্দ্রনাথের কাছাকাছি বা আশেপাশে বাইরের লোক কারা ছিল সেইটাই এখন বিচার করে দেখতে হবে।
সমরবাবু, যতীনবাবু, ডাঃ চক্রবর্তী, ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ও বারীনবাবু-এঁরাই এখানে ছিলেন।
প্রথমেই ধরা যাক যতীনবাবুর কথা। যতীনবাবুর সঙ্গে এঁদের কোন পরিচয়ই ছিল না। তাছাড়া তিনি যদি খুনই করে থাকেন, কী উদ্দেশ্যে খুন করবেন। তার পক্ষে কোন strong motive তো নেই। একমাত্র Homicidalmaniacছাড়া তার পক্ষে ওভাবে গগনেন্দ্রনাথকে হঠাৎ খুন করবার কোন সঙ্গত কারণই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এবং এও আমরা জানি তিনি সে ধরনের লোক নন। অসুস্থ হলেও মস্তিষ্ক তার সম্পূর্ণ সুস্থ।
যতীনবাবু এতক্ষণে কথা বললেন, মিঃ রায়, এটা কি সত্যই হাস্যকর নয়? যদিও তার ভাইপোদের প্রতি তার ব্যবহার এতটুকুও পছন্দ করতাম না এবং মাঝে মাঝে আমার ভীষণ রাগ হত তার প্রতি ও তাকে সর্বান্তঃকরণেই আমি ঘৃণা করতাম, তথাপি সেই সামান্য কারণে একজন অপরিচিত রোগগ্রস্ত বৃদ্ধকে খুন করতে কখনই কেউ পারে না। তাছাড়া তাকে খুন করবার মত সুযোগও তো আমার মেলেনি। কেননা আমি বারীনবাবু ও সমরবাবুর সঙ্গেই আপনার বর্ণিত ঐ কুড়ি মিনিট সময়ের মধ্যে ছিলাম।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, তা জানি। আচ্ছা এখন দেখা যাক, ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীই খুন করেছেন কিনা সেটা বিচার করে। তার পক্ষে ঐভাবে ডিজিট্যালিন ইনজেক্ট করে গগনেন্দ্রনাথকে মারা এমন কিছুই অসম্ভব নয়, কেননা তিনি একজন শিক্ষিত ডাক্তার। কিন্তু যেহেতু তিনি সাড়ে তিনটের আগেই হোটেল ছেড়ে চলে যান ও ফিরে আসেন সন্ধ্যা ছটায়, তার পক্ষে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করবার সুযোগ পাওয়া অসম্ভব ছিল। তাছাড়া এক্ষেত্রে তার খুন করবার উদ্দেশ্যই বা কি থাকতে পারে?
তারপর ধরা যাক ডাঃ চক্রবর্তীকে। তিনি, রণধীরবাবুর কথা মেনে নিলে, সাড়ে চারটের সময় যখন জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ফিরে আসেন-তার আগেই গগনবাবু খুন হয়েছেন। বারীনবাবুর ও যতীনবাবুর evidence-এ প্রমাণ হয় চারটে যোল মিনিটের সময় গগনবাবু বেঁচেই ছিলেন। তার মানে, এক্ষেত্রে ঐ কুড়ি মিনিটের পাকে ডাঃ চক্রবর্তীকে ফেলা যায় না। অবশ্য ডাঃ চক্রবর্তী হোটেলে ফিরে আসবার পথে কী করেছেন না করেছেন তার। কোন প্রমাণ নেই। কেননা ঐ সময় কেউ তার সাক্ষী ছিল না সেখানে। তাহলে একদিক দিয়ে ঐ সময় ডাঃ চক্রবর্তীর পক্ষে গগনবাবুকে খুন করা মোটেই আশ্চর্য বা অসম্ভব নয়।
কিন্তু এও ভাবতে হবে যে, তিনিও একজন শিক্ষিত ডাক্তার। অবশ্য একটা কথা আমার বরাবরই মনে হয়েছে। ডাক্তার যদি খুনী হন, তবে তিনিই প্রথম এ ব্যাপারে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন কেন যে এ ব্যাপারে কোন রহস্য আছে, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়? তাছাড়া গগনেন্দ্রনাথকে খুন করবার তার উদ্দেশ্যই বা কি থাকতে পারে? গগনবাবুর সঙ্গে তার পরিচয়ও ছিল না। এক্ষেত্রে ডাঃ চক্রবর্তী সম্পূর্ণ একজন তৃতীয় ব্যক্তি। তিনি নিজেই যদি দোষী হতেন তবে ব্যাপারটাকে এভাবে খুঁচিয়ে না তুলে বুদ্ধিমানের মত চুপচাপই থাকতেন। আমাদের common sense কি অন্তত তাই বলে না?
কিন্তু ঐ সময় আর একজন হোটেলে ছিল, সে হচ্ছে কিশোর। সে অনায়াসেই ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে সিরিঞ্জ চুরি করে নিয়ে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করতে পারত। কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে সেও করেনি। তবে কে হত্যা করলে?
একটু থেমে আবার কিরীটী বলতে লাগল, এইবার আসুন আমার তৃতীয় ও চতুর্থ পয়েন্টে। গগনেন্দ্রনাথ তাঁর ফ্যামিলির কাউকে বাইরের কোন তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে মিশতে দিতে একেবারেই পছন্দ করতেন না ও কোথাও বের হতে দিতেন না। অথচ সেদিন বিকালে তিনি তার ভাইপোদের ইচ্ছামত অন্য সকলের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যেতে বললেন, কোন আপত্তিই করলেন না। দুটো ব্যাপারই একটা আশ্চর্য নয় কি! এটা তার স্বভাবের একেবারেই বিপরীত।
এবার গগনেন্দ্রনাথের মানসিক অবস্থাটা একটু আললাচনা করে দেখা যাক। অদ্ভুত প্রকৃতির লোক ছিলেন তিনি।
তার মনে অন্যের উপরে শাসন ও প্রভুত্ব করবার একটা উম্মাদ পৈশাচিক আকাঙ্ক্ষা ছিল। এই যে একটা প্রভুত্ব করবার আকাঙক্ষা, একটা শক্তিপ্রয়োগের লোভ, এটাকে জয় করার মত তার মানসিক শক্তি ছিল না। এবং তার দীর্ঘ কর্মজীবনে ঐ জিনিসটা বরাবরই উপভোগ করে এসেছিলেন ও অপ্রতিহত ভাবে প্রথমে আন্দামানের কয়েদীদের উপর ও জেলার-জীবনে কয়েদীদের উপর, পরে নিজের অসহায় ভাইপোদের প্রতি প্রয়োগ করেছিলেন। অথচ মজা হচ্ছে এই যে, আসলে তিনি একজন পরের প্রতি প্রভুত্ব করবার মত শক্তিশালী লোক ছিলেন না। শুধু সুযোগ ও সুবিধা তার সহায় হয়েছিল মাত্র। এবং এইভাবে অন্যের প্রতি অন্যায় প্রভুত্ব করবার একটা নেশা তাকে শেষ পর্যন্ত পেয়ে বসেছিল।
এবারে আসা যাক আমাদের আট নম্বর পয়েন্টে। তিনি একদিন বলেছিলেন, আমি কখনও কিছু ভুলি না। মনে রেখো এ কথা। আমি আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘ ষাট বছরের জীবনের কোন কথাই ভুলিনি। সবই আমার মনে আছে। সব মুখই আমার মনে আছে। কথাগুলো সেদিন হয়ত ডাঃ গাঙ্গুলীর মনে অনেকখানি চঞ্চলতা এনেছিল। কিন্তু আসলে এ কথাগুলো সেদিন তিনি ডাঃ গাঙ্গুলীকে বলেননি। হঠাৎ তার আশেপাশে অন্য কোন বিশেষ এক পরিচিত ব্যক্তির মুখ দেখেই ও কথাগুলো সেই লোককে উদ্দেশ করেই বলেছিলেন।
কিরীটী আবার একটু থেমে বলতে লাগল, আবার ভেবে দেখা যাক গগনেন্দ্রনাথের হত্যার দিন বাইরের অন্য কোন লোক সে সময় হোটেলে ছিল কিনা। একমাত্র কিশোর ছাড়া রণধীরবাবুরা প্রত্যেকেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। গগনেন্দ্রনাথ একা তার ঘরের সামনে বারান্দায় চেয়ারের উপরে হেলান দিয়ে বসেছিলেন।
এবারে বারীনবাবু ও যতীনবাবুর কথাগুলো ভাল করে বিচার করে দেখা যাক। যতীনবাবুর দৃষ্টিশক্তিকে আমি প্রশংসা করতে পারি না। সে প্রমাণ আমি পেয়েছি যখন তিনি বলেছিলেন তার ঘরের অল্পদূর দিয়েই খানসামাটা প্রায় যখন ছুটে গিয়েছিল তিনি তাকে চিনতে পারেননি। তাছাড়া যতীনবাবু ও বারীনবাবুর ঘর পাশাপাশি; এক ঘরের লোক অন্য ঘরের লোককে দেখতে পারেন না। অথচ দুজনের ঘর থেকেই বারান্দায় যেখানে গগনেন্দ্রনাথ বসেছিলেন সেখানটা স্পষ্ট দেখা যায় এবং দুজনেই দেখেছিলেন একজন খানসামা গগনবাবুর কাছে গিয়ে কোন কারণে গালাগালি খেয়ে কিশোরের ঘরের দিকে ছুটে পালায়। বেলা চারটের সময় যতীনবাবু যখন নিজের ঘরে বসে বই পড়ছেন, বারীনবাবু তাকে বেড়াবার জন্য ডাকতে যান। বারীনবাবু তার জানবন্দিতে বলেন, একজন খানসামা গগনবাবুর কাছে যায়, তারপরই একটা গোলমাল শোনা যায়, খানসামাটা আবার কিশোরের ঘরের দিকে চলে যায়।
সহসা এমন সময় ডাঃ চক্রবর্তী প্রশ্ন করলেন, তাহলে কি তুমি বলতে চাও কিরীটী যে, হোটেলের একজন খানসামাই শেষ পর্যন্ত গগনেন্দ্রনাথকে খুন করেছে?
দাঁড়াও দাঁড়াও ডাক্তার, ব্যস্ত হয়ো না। আমি এখনও আমার বক্তব্য শেষ করিনি। খানসামা গগনবাবুর কাছে বকুনি (?) খেয়ে কিশোরের ঘরের দিকে ছুটে পালায়। যতীনবাবু ও বারীনবাবু দুজনেই তা দেখেছেন। অথচ আশ্চর্য, কেউই তার মুখ দেখতে পাননি বা চিনতে পারেননি। কিন্তু মজা এই যে, বারীনবাবুর ঘর থেকে বারান্দায় যেখানে গগনেন্দ্রনাথ বসেছিলেন তার দূরত্ব মাত্র একশত গজ।
বারীনবাবু খানসামার সাদা রঙের পোশাকের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি খানসামার পোশাকের অমন নিখুত বর্ণনা দিতে পারেন পলায়নপর খানসামাকে দেখে, অথবা তার মুখটা দেখতে পেলেন না বা তাকে চিনতে পারলেন না, এটা কি আশ্চর্য ও অবিশ্বাস্য নয়? অথচ তাঁর নাকি চোখের অসুখ, সর্বদা রঙীন কাঁচের চশমা ব্যবহার করেন। চোখে আলো সহ্য হয় না। সহসা ডাঃ চক্রবর্তী চিৎকার করে উঠলেন, তবে কি—তবে কি
কঠিন শান্ত কণ্ঠে কিরীটী জবাব দিল, হ্যাঁ, তাই। বারীনবাবুই গগনেন্দ্রনাথের হত্যাকারী।…এবং শুধু গগনেন্দ্রনাথেরই নয়, ইতিপূর্বে কিছুকাল ধরে কলকাতা শহরে যে কয়েকটি নৃশংস অমানুষিক হত্যা বা খুন হয়েছে, সব কটি হত্যা-রহস্যেরই মেঘনাদ…বলতে বলতে কিরীটীর চোখ সৌম্য-শান্ত অদূরে উপবিষ্ট বারীনবাবুর প্রতি ন্যস্ত হল। সহসা বারীনবাবু চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মতই কিরীটীর উপরে ঝাপিয়ে পড়লেন।
মেঝের উপরে দুজনে দুজনকে আঁকড়ে ধরে গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু অসীম বলশালী কিরীটীর কাছে অল্পক্ষণের মধ্যেই বারীনাবুকে পরাস্ত হতে হল।
সকলে মিলে বারীনবাবুর হাত বেঁধে চেয়ারের উপরে বসাল। বারীনবাবুর মুখে একটি কথা নেই। সর্বশরীর তার রাগে তখন ফুলছে। চোখের রঙীন চশমা কোথায় ছিটকে পড়েছে। গোল গোল দুটো চোখ থেকে যেন ক্ষুধিত জিঘাংসার একটা অগ্নিশিখা ছুটে বেরিয়ে আসছে।
কিরীটী গায়ের জামা-কাপড় একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললে, মনে পড়ে বন্ধু! এক মাস আগে রসা রোডের মোড়ে এক গভীর রাত্রের কথা? আজও তোমার সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষুসে রক্তলোলুপ দৃষ্টির কথা আমি ভুলিনি!
অমরবাবু, নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল ওরফে বারীন চৌধুরী ওরফে মহীতোষ রায় চৌধুরী–কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলার, দানেধ্যানে প্রাতঃস্মরণীয় ডাঃ এন. এন. চৌধুরী, চেতলার অবসরপ্রাপ্ত আলিপুর জেলের ডেপুটি সুপারিন্টেন্টে ডাঃ অমিয় মজুমদার, রাণাঘাট লোকাল ট্রেনের সেই হতভাগ্য যুবকের হত্যাকারী নরখাদককে আপনার হাতে তুলে দিলাম। ঘরের মধ্যে যেন মৃত্যুর মতই স্তব্ধতা থমথম্ করছে।
সহসা বারীনবাবু বলে উঠল, কিরীটী রায়, তুমি আমায় ধরবে বটে! বলতে বলতে বিদ্যুৎবেগে সে উঠে দাঁড়াল এবং চোখের পলকে ঘর থেকে ছুটে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। কী করে যে ইতিমধ্যে সকলের অলক্ষ্যে সে তার হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছিল কেউ তা টের পায়নি।
আসলে বারীনের হাতের কবজিতে একটা তীক্ষ্ণ ছুরি বাঁধা থাকত, তার সাহায্যে সে সকলের অলক্ষ্যে বাঁধন কেটে ফেলেছিল।
.
সমস্ত পুরী শহরটা তন্নতন্ন করে খুঁজেও মহীতোষের সন্ধান পাওয়া গেল না।
কলকাতায় সুব্রতকে ইতিপূর্বেই সকল কথা জানিয়ে কিরীটী তার করে দিয়েছিল। মহীতোষ সেখানেও যায়নি।
.
দিন পাঁচেক পরের কথা।
পরদিন সকলে কলকাতার পথে যাত্রা করবে।
রাত্রি তখন বোধ করি সাড়ে নটা। অন্ধকার রাত্রি। সকলে সাগরের তীরে বসে আছে। অন্ধকারে উলঙ্গ সাগর কুদ্ধ দানবের মত গর্জাচ্ছে।
আকাশে তারাগুলি মিটমিট করে জ্বলছে আর নিভছে।
ডাঃ চক্রবর্তীই প্রশ্ন করলে, বারীনবাবুকে কি তুমি প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছিলে কিরীটী?
কিরীটী বললে, তবে শোন। মানুষের প্রতিভা যখন বিপথে যায় তখন এমনি করেই বুঝি ধ্বংসের মুখে ছুটে যায়। মানুষের খেয়ালের অন্ত নেই। বারীনবাবুর মত লোকেরা মানুষের দেহে শয়তান। এ একটা মানসিক বিকার। বিকৃত-মস্তিষ্কের একটা অদ্ভুত পৈশাচিক অনুভূতি। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইদানীং কিছুকাল ধরে কলকাতার উপরে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলছিল তার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ি। শুধু যে খুন করে রক্ত দেখবার একটা নেশাতেই মহীতোষ খুন করত তা নয়। পিছনে তার অতীত জীবনের কিছুটা সম্পর্কও ছিল। বিখ্যাত ডাঃ অমিয় মজুমদার খুন হবার কিছুকাল পরেই সুব্রতর সাহায্যে মহীতোষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে কেবলই আমার মনে হত যে, তার মত অদ্ভুত শিক্ষিত বিকৃত মস্তিষ্ক ইতিপূর্বে আর আমি দেখিনি এবং সেই থেকেই তার প্রতি আমি নজর রাখি।
মহীতোষ সম্পর্কে খোঁজ করতে করতে জানতে পারি, কলকাতা শহরে কেউ তার পাঁচ বছর পূর্কোর জীবনের কোন কথাই জানেনা এবং জানবার চেষ্টাও করেনি। লোকটা যেন হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। ডাঃ অমিয় মজুমদারের খুনের দিন মহীতোষের চোখের যে দৃষ্টি আমি সহসা দেখেছিলাম, অন্তরের অন্তস্থলে তা আমার গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। এখানে মহীতোষের চোখের তারার সেই দৃষ্টিই খুঁজে পেয়েছিলাম সেইদিন যেন। আমি মহীতোষের পূর্ব-জীবনের সন্ধান করতে শুরু করলাম এবং কেমন করে সব কথা আমি অনুসন্ধানের ফলে জানতে পেরেছিলাম তাও আমি বলব।
তোমার আহ্বানে আমি যখন পুরীতে এলাম, প্রথম দিনই হঠাৎ দূর থেকে বারীনবাবুকে দেখে আমি যেন চমকে উঠলাম। মুখে সাদা দাড়ি, চোখে রঙীন কাঁচের চশমা, কেবলই যেন মনে হতে লাগল এমনি লম্বা চেহারার একজনকে কোথায় দেখেছি। এমনি চলার ভঙ্গি, এমনি কণ্ঠস্বর, এমনি হাসি। কেন যেন কেবলই আমার মনে হত বৃদ্ধের ছদ্মবেশের অন্তরালে যেন কোন একটা পরিচিত চেনা লোক লুকিয়ে আছে। সহসা একদিন এমন সময় আচমকা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য বারীনের চশমাহীন চোখ আমি তার অজান্তেই দূর থেকে দেখেছিলাম। সে দৃষ্টি তো আমার ভুলবার নয়, চকিতে মনের কোণে সন্দেহের বিদ্যুৎ জেগে উঠল। আমি সতর্ক হয়ে উঠলাম এবং সেই থেকেই একটা চিন্তা আমার মনে কেবলই ঘুরপাক খেতে লাগল, এই ছদ্মবেশে মহীতোষ এখানে কেন?…
ইতিপূর্বে মহীতোষের পূর্ব ইতিহাস আমি অনেকটা অনুসন্ধানের ফলে সংগ্রহ করেছিলাম। মহীতোষের আসল নাম নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল। ওর জন্ম হয় সামান্য এক ঘাতকের ঘরে এবং সে কথা আমি জানতে পারি ওর অনুপস্থিতিতে একদিন রাত্রে ওর শোবার ঘরে হানা দিয়ে, দেওয়ালে টাঙানো এক এনলার্জড় ফটো দেখে। ওর ঠাকুর্দা ছিল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ঘাতক। ছবিট তারই। যেসব হতভাগ্যদের ফাঁসির হুকুম হত, তাদের ফাসির দড়িতে লটকাবার কাজ করত প্রথমে ওর ঠাকুন্দা, পরে ওর পিতা। পুরুষানুক্রমে ওরা ওই ঘাতকের ব্যবসা করত। ওর বাপ রামশরণ কাঞ্জিলালকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পিতার ব্যবসা গ্রহণ করতে হয়েছিল শিক্ষার অভাবে। কিন্তু বোধ হয় নিরঞ্জনের বাপ সে কাজ ঘৃণা করত এবং সেই জন্যই হয়ত সে তার পুত্রকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে।.।
নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল কলিকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে এম. এ. পাস করে পাটনায় প্রফেসারী করত। কিন্তু রক্তের যা ঋণ, তার দাবি বড় ভয়ানক। সে ভয়ঙ্কর পৈশাচিক কর্মের অনুভূতি তার পিতা ও ঠাকুর্দার রক্তের মধ্যে প্রবাহিত ছিল, সেটা নিরঞ্জন কাঞ্জিলালের রক্তেও সংক্রামিত হয়েছিল। খুন করবার একটা দুর্জয় লালসা ও পৈশাচিক অনুভূতি নিরঞ্জনের অবচেতন মনের মধ্যে প্রথমে ক্রমে ক্রমে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। সে তার শিক্ষাদীক্ষা সত্তেও সেই অবচেতন পশুমনের পৈশাচিক অনুভূতির কাছে আপনার অজ্ঞাতেই আপনাকে ধরা দিতে বাধ্য হয়েছিল। দুই পুরুষের রক্তের ঋণ তাকেও শোধ করতে হল। এ ছাড়া তার আর উপায় ছিল না এবং পরে সে এইভাবে সংক্রামিত হয়ে খুন করে একটা পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করত।
একবার রাঁচি শহরে ওইভাবে কোন এক ভদ্রলোককে খুন করতে গিয়ে ও ধরা পড়ে, বিচারে ওর পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হয় এবং ওকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। সেই সময় গগনেন্দ্রনাথ আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের জেলার ছিলেন। যা হোক জেল থেকে মুক্তি পাবার পর নিরঞ্জন আরও দুর্বার হয়ে ওঠে। কিন্তু তার শিক্ষা হয়ত তার সেই অবচেতন প্রবৃত্তির সামনে এসে শিক্ষা ও প্রকৃতিগত পৈশাচিকতার সঙ্গে বাধায় সংঘর্ষ। অবশেষে শয়তানেরই হয় জয়। রক্তের ঋণ! রক্তের ঋণ! নিরঞ্জনের মুখ চেনা বলেই সেদিন গগনেন্দ্রনাথ ওই কথা বলেছিলেন। তাকে হয়ত হঠাৎ চিনতে পেরেছিলেন। তাই তার মুখ দিয়ে ওকথা বের হয়েছিল।
ছদ্মবেশেও নিরঞ্জন আপনাকে গগনেন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি এবং নিরঞ্জনও ব্যাকুল হয়ে ওঠে, কেননা গগনেন্দ্রনাথকে ইহসংসার থেকে সরাবার মতলবেই সে পুরীতে তার পিছু পিছু ধাওয়া করে এসেছিল। ডাঃ অমিয় মজুমদারও পাটনায় প্রথম জীবনে ডাক্তারী করতেন ও হয়ত নিরঞ্জনকে চিনতেন। ডাঃ এন. এন. চৌধুরীও নিরঞ্জনের বাপকে ও তাকে চিনতেন। আলিপুরের সুপারও তাকে চিনতেন। নিরঞ্জন যখন ছদ্মনামে ছদ্মবেশে নতুন জীবন শুরু করল, তার স্বতই মনে হল তার চেনা লোকদের না সরাতে পারলে হঠাৎ হয়ত কোন একদিন তার আসল ও সত্যকারের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়বে। ফলে তার সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবে। সেও একটা কথা এবং তার প্রকৃতিগত পৈশাচিকতা দুটোতে মিলে তাকে খুনের নেশায় মাতিয়ে তুলল।
কিন্তু সে আশা করেনি হয়ত যে, গগনেন্দ্রনাথ তার ছদ্মবেশের ভিতর থেকেও তাকে চিনতে পারবেন। ফলে নিরঞ্জন মরীয়া হয়ে উঠল এবং সুযোগ খুঁজতে লাগল। সুযোগ মিলেও গেল হঠাৎ। বারীনকে আমি সন্দেহ করলেও আমার মনে তখনও একটা সন্দেহের কাটা খচ খচ করছিল, কিন্তু তার evidence শোনবার পর আর কোন সন্দেহ রইল না। বুঝলাম এ সেই নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল এবং এই গগনেন্দ্রনাথের হত্যাকারী। কাঞ্জিলাল তার evidence-এ দুটি মাত্র ভুল করেছিল, যাতে করে আমার চোখের দৃষ্টি খুলে যায় ও সমস্ত সন্দেহ মিটে যায়। এক নম্বর হচ্ছে, সে পলায়নপর খানসামার বেশভূষার নিখুঁত description দিলে, অথচ তাকে চিনতে পারলে না এবং ভুলে গিয়েছিল যে সে চোখের ব্যারামের অজুহাতে রঙীন কাঁচের চশমা ব্যবহার করছে! ২ নং সে ভুল করে, সিরিঞ্জটা ডাক্তারের ঘরে রাখতে গিয়ে প্রথমেই কিশোরের ঘরে গিয়ে ঢোকে। সে আগে থাকতেই ওদিন কোন এক সময় ডাক্তারের ব্যাগ থেকে সিরিঞ্জ ও ঔষধের শিশিটা চুরি করেছিল, পরে খানসামার বেশ পরে গগনেন্দ্রনাথকে হত্যা করে তাড়াতাড়ি ভুল করে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘর ভেবে কিশোরের ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ে। ডাঃ চক্রবর্তী তখন নিজের ঘরে শুয়ে জ্বরের ঘোরে গোঙাচ্ছেন। টের পাননি। কিন্তু ইনজেকশন দেবার সময় নিশ্চয়ই গগনেন্দ্রনাথ বাধা দিয়েছিলেন, এবং তাতেই গোলমাল শোনা যায়, যতীনবাবু ভেবেছিলেন গগনবাবু বুঝি নিত্যকারের মত ভৃত্যকে গালাগাল করছেন। পরে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করে বারীন যখন সিরিঞ্জ রেখে আসে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে, ডাঃ চক্রবর্তীও টের পাননি। তারপর বারীন তার খানসামার বেশ বদল করে নিজ বেশে এসে যতীনবাবুকে বেড়াতে যাবার জন্য আহ্বান করে ও দুজনে বেড়াতে বের হন। এবং বারান্দার সামনে দিয়ে যাবার সময় যতীনবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিরঞ্জন গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলবার অভিনয় করে। আসলে কিন্তু তার কথায় গগনেন্দ্রনাথ কোন জবাবই দেননি। কিন্তু অন্যমনস্ক যতীনবাবু সেটা বুঝতে পারে নি। তাছাড়া আগেই বলেছি, যতীনবাবুর দৃষ্টিশক্তি তত প্রখর নয়। বারীন নিজের মনগড়া ভাবে যতীনবাবুকে বুঝিয়ে দেয় ও বলে, দেখলেন, ভদ্রলোক জবাবটা পর্যন্ত ভাল করে দিলেন না! যতীনবাবুও তাই বুঝে চুপ করে রইলেন। তিনিও জানতেন যে গগনেন্দ্রনাথ অভদ্র ও বদমেজাজী। তা ছাড়া তিনি তো তখন জানতেন না যে গগনেন্দ্রনাথ মৃত!
কিশোরের স্বপ্নও মিথ্যা নয় বা সেটা delirium–ও নয়। সে দেখছিল একজন সাদা পোশাক পরা পরী তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে তার বিকৃত স্বপ্নাতুর কল্পনায় বারীনের খানসামার সাদা পোশাককে পরীর পোশাক বলে ভুল করেছিল। কিন্তু এই প্রমাণেই তো তাকে দোষী বলে ধরা যায় না। আমি প্রথম যেদিন তাকে রসা রোডে রাত্রে দেখি, সে তাড়াতাড়ি পালাবার সময়, তার নামের আদ্যক্ষর এন লেখা রুমালটা ফেলে যায়। তাছাড়া তার আঙুলের ছাপ কায়দা করে নিয়েছি ও সেটা কলকাতায় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছিলাম, সেখানকার অপরাধীদের ফাইলে রক্ষিত আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে। ডাঃ চক্রবর্তীর সিরিঞ্জের গায়েও তার আঙুলের ছাপ ছিল, সেটাও নেওয়া হয়েছিল। সব হুবহু এক, মিলে গেছে। আমারই ভুল হয়েছিল তাকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে আলোচনা করা। তা না হলে হয়ত সে পালাবার সুযোগ পেত না।
কিরীটী চুপ করলে। অদুরে অন্ধকারে সমুদ্রের কালো কালো ঢেউগুলো সাদা ফেনার উচ্ছ্বাস বুকে নিয়ে যেন ক্রুদ্ধ গর্জনে এদিকে ছুটে আসছে।
তুমি কি সত্যই কোণারকে গিয়েছিলে কিরীটী? অমিয় জিজ্ঞাসা করল।
কিরীটী জবাব দিল, না। কলকাতায় বারীনের আসল ইতিহাসের খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বারীন যে এত তাড়াতাড়ি খুন করবে তা ভাবতে পারিনি।
–: সমাপ্ত :–