।। চার ।। – আবার জবর খবর
প্রায় প্রত্যেক দিন ভোরে বেড়ানো আমার অভ্যেস। বিশেষ করে এই সল্টলেকের ফাঁকা এ. জে. এলাকায় বেড়িয়ে খুব আনন্দ পাই।
আমি পুলিশে কাজ করলেও মনটা কবিত্বপূর্ণ। খোলা মাঠ, নীল আকাশ, ঘন মেঘ, ফুলের বাগান আমার খুবই প্রিয়।
যদিও বাসাটা আমার নিজের নয় তবুও আমার স্ত্রী বাড়ির সামনে সামান্য একটু জায়গা ঘিরে ছোট্ট একটি বাগান করেছেন। আর আমি ছাদের কার্নিশে সার দিয়ে সাজিয়ে রেখেছি নানা জাতের বাহারি ফুলের টব। যেমন—জারবেরা, বোগেনভেলিয়া, ফার্ন, গ্রাউন্ড অর্কিড—যার ছোটো ছোটো ভায়োলেট রঙের ফুল।
প্রতিদিন মর্নিং ওয়াক সেরে বাড়ি ঢোকার মুখে একবার করে আলসের ওপর রাখা সার সার টবগুলোকে দেখি। ভারি ভালো লাগে।
ফেরার পথে এক প্রতিবেশী বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় গল্প করতে করতে দেরি হয়ে গেল। তবু বাড়ির গেটে এসে অভ্যাসমতো আলসের দিকে তাকালাম। দেখি একটা টব লাইন ছেড়ে যেন সামনের দিকে সরে এসেছে। একটু অবাক হলাম। ভারী টবটা সরে এল কী করে? এর মধ্যে ঝড়বৃষ্টিও হয়নি যে ঝড়ের ধাক্কায় নড়েচড়ে যাবে।
যাই হোক ওই সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। ঢুকেই অবাক—এই সাত সকালে প্রণবেশ এসে হাজির হয়েছে।
প্রণবেশ আমার সত্যিকার বন্ধু। আগে দেখাসাক্ষাৎ কম হত। আমরা যে যার কাজ নিয়ে হিমশিম খাই। অন্য চাকুরেবাবুদের চেয়ে পুলিশ চাকুরেদের অনেক হ্যাপা। কিন্তু জুলাই মাসে দুজনেই এক মাসের ছুটি নিয়ে নেপাল বেড়াতে যাবার পর—আর ওই রাজু সুব্বার হাঙ্গামাকে কেন্দ্র করে এখন আমাদের সম্পর্ক আরও নিকট হয়েছে। অফ—ডে থাকলে ও প্রায়ই সকালে আমার এখানে চলে আসে। আমিও মাঝে মাঝে ওর বাসায় যাই। কিন্তু এত সকালে ও কখনও আসে না।
কী হে! ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছ দেখছি! হেসে বন্ধুকে স্বাগত জানাই।
কিন্তু প্রণবেশ হাসল না। বেশ আদেশের সুরেই বলল, চুপটি করে এখানে বোসো। কথা আছে। তারপর আমার স্ত্রীকে বলল, বৌদি, এবার আমাদের চা দিন।
আমি মজা করে বন্ধুর অনুমতি নিয়ে বাইরের প্যান্ট—জামা ছাড়তে কয়েক মিনিটের জন্যে ভেতরে চলে গেলাম। পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে, মুখ ধুয়ে যখন বাইরের ঘরে এসে বসলাম তখন দেখি গৃহিণী টোস্ট আর চা নিয়ে হাজির।
সবেমাত্র টোস্টে আরাম করে কামড় দিয়েছি অমনি প্রণবেশ ওর ব্রিফকেস থেকে সেদিনের কাগজখানা বের করে মাঝের পাতায় একটা খবরে দাগ দিয়ে গম্ভীর মুখে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
কাগজটা নিয়ে ঝুঁঁকে পড়লাম খবরটার দিকে। খবরটা এইরকম—
জীবন্ত কঙ্কালের পুনরার্বিভাব
গতকাল রাত দুটোর সময়ে দুজন সাংবাদিক খবরের কাগজের অফিসের ডিউটি সেরে গাড়িতে বাড়ি ফিরছিলেন। নিঝুম রাত। জনশূন্য রাজপথ। শেয়ালদা ফ্লাইওভারের কাছে আসতেই তাঁদের চোখে পড়ে একটা তেরো—চোদ্দো বছরের কঙ্কালসার ছেলে আকাশের দিকে মুখ করে বেলেঘাটা মেন রোডের দিকে জোরে হেঁটে চলেছে। সে হাঁটা সাধারণ মানুষের হাঁটার মতো নয়—যেন শূন্যে পা ফেলে দৌড়নো। গায়ে ছিল কালো রঙের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটা ফতুয়া। তার মাথাটা ছোটো। নারকেলের মতো। খাড়া খাড়া পাতলা চুল। কৌতূহলী সাংবাদিকরা তখনই সোজা না গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে বেলেঘাটা মেন রোডের দিকে চালান। গাড়ি যতই ছেলেটার কাছাকাছি হচ্ছিল, আশ্চর্যজনকভাবে ছেলেটা ততই দূরে সরে যাচ্ছিল। তারপরই ছেলেটা অন্ধকারে যেন মিলিয়ে গেল। ইতিমধ্যে তাঁরা ফ্ল্যাশে ছেলেটার অনেকগুলো ছবি তুলেছিলেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড—একটা ছবিও ওঠেনি।…
খবরটা পড়ে আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না ওই ‘জীবন্ত কঙ্কালটি’ আর কেউ নয়—নেপালের সেই রাজু সুব্বাই, যে আমার দেশের বাড়িতে বার বার আমাকে মারবার চেষ্টা করেছিল। এখন সে আমাকে মারবার জন্যেই কলকাতায় এসে পড়েছে।
এখন বুঝতে পারছ কী সাংঘাতিক বিপদ এগিয়ে আসছে? প্রণবেশ আমার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।
আমার বেশি কথা বলার শক্তি ছিল না। শুধু মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম।
কিন্তু—
প্রায় ধমক দিয়ে প্রণবেশ বলল, এখনও ‘কিন্তু’? এখনও সন্দেহ আছে নাকি?
আমি কোনোরকমে জুড়নো চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, সে কথা বলছি না। বলতে চাইছি— যে হাওড়ার দিক থেকে স্ট্র্যান্ড রোড, পোস্তা হয়ে চিৎপুর ক্রস করে বিবেকানন্দ রোড ধরে এগোচ্ছিল, সে হঠাৎ শেয়ালদা ফ্লাইওভারের কাছে এল কেন?
প্রণবেশ বলল, আমার ধারণা ও সল্টলেকে পৌঁছুবার ঠিক পথটা ধরতে পারছে না। একটা জিনিস লক্ষ কোরো, জগদীশ ঘোষও বলেছিল আকাশের দিকে মুখ করে ছুটছিল। তার মানে কী? নিশ্চয় আকাশের শোভা দেখতে দেখতে যাচ্ছিল না।
আমি বললাম, তা অবশ্যই নয়।
তাহলে?
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, বুঝতে পারছি না।
প্রণবেশ বলল, আমার ধারণা ও বাতাসে তোমার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে যাচ্ছিল।
কিন্তু দেশের বাড়িতে তো ও বেশ কিছুদিন ছিল। কই তখন তো ওরকম করে চলেনি?
প্রণবেশ বলল, ভুলে যাচ্ছ বন্ধু, তখন তোমায় খোঁজার দরকার হয়নি। তুমি ছিলে ওর নাগালের মধ্যে।
আমি চুপ করে রইলাম। ভাবছিলাম প্রণবেশের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে আমরা কি সত্যিই কলকাতা শহরে আছি, না কোনো অলৌকিক জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছি?
প্রণবেশ স্থির বিশ্বাসের সঙ্গে বলল, হাওড়ার দিক থেকে সল্টলেকে আসার অনেকগুলো পথ আছে। তার মধ্যে বিবেকানন্দ রোড, মানিকতলা হয়ে ভি. আই. পি. রোড ধরেও যেমন আসা যায় তেমনি শেয়ালদা উড়ালপোলের ক্রসিং থেকে শেয়ালদার পাশ দিয়ে বেলেঘাটা রোড দিয়ে ভি. আই. পি. রোড ধরেও আসা যায়। মনে করে দ্যাখো এই ক’দিনের মধ্যে তুমি নিশ্চয়ই ওই দুটো পথ দিয়েই যাতায়াত করেছ।
বললাম, তা করেছি। অনেকবারই করেছি।
ব্যস। তা হলে তো অংক মিলেই গেল।
আমি খানিকটা হতাশার সুরে বললাম, এ কথাটাই তাহলে তুমি আমায় বোঝাতে চাচ্ছ— সেই তান্ত্রিক আমাকে এখনও ছাড়েনি। রাজু সুব্বাকে লেলিয়ে দিয়েছে কলকাতাতেও। সে পথ না চিনলেও শিকারি কুকুরের মতো বাতাসে আমার যেটুকু গন্ধ এখনও মিশে আছে তাই শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে আসছে।
প্রণবেশ গম্ভীরভাবে বলল, হ্যাঁ।
আমি অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরলাম।
কিন্তু—একটা কথা—
বলো।
হরিদেবপুর থেকে ও কলকাতায় এল কী করে? ট্রেনে?
প্রণবেশ হেসে বলল, ট্রেনে যদি আসতে পারত তাহলে সেদিনই ছুটে এসে ট্রেনে উঠে পড়ত। তোমার মনে আছে কি অম্বুজ লাহিড়ি একটা কথা বলেছিলেন, আমরা যাদের অলৌকিক জীব বা ভূতজাতীয় কিছু বলি তারা অনেক কিছু করতে পারলেও সব কাজ তারা করতে পারে না বা সব জায়গায় তারা যেতে পারে না। কিছু বাধা থাকেই। এটাই রক্ষে। তাই অন্তত ট্রেনে, বাসে, ট্যাক্সিতে সাধারণ মানুষের মতো এরা উঠতে পারে না। এরা পথ ধরেই আসে। অবশ্যই সে পথ নির্জন হওয়া চাই। আর চাই অন্ধকার রাত।
এইখানে আমার একটা পয়েন্ট জানার আছে।
প্রণবেশ বলল, কী তোমার পয়েন্ট বলো।
শুধু রাত্রেই যদি ও হেঁটে আসে তা হলে দিনে কোথায় থাকে?
প্রণবেশ চমকে উঠে বলল, দারুণ পয়েন্টটা তো তুমি তুলেছ! এটা তো আমার মাথায় আসেনি।
বললাম, বুঝতেই পারছি একটা অদ্ভুত ধরনের বিপদ এসে পড়েছে। এখন দেখতে হবে সুব্বা দিনের বেলায় কোথায় থাকে। নিশ্চয় ভি. আই. পি. রোড দিয়ে বেলেঘাটা মেন রোডে ভালো করে খুঁজলে তার সন্ধান পেয়ে যাব। কাজেই চলো এখুনি আমরা জিপটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
প্রণবেশ বলল, খুব ভালো কথা বলেছ। কিন্তু তার আগে আমাদের একটা কাজ করতে হবে। লোকে গাঁজাখুরি ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেবে এই ভয়ে এখন আর মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলে চলবে না। দু—দিন কাগজে তো খবর বেরিয়েই গেছে। এবার সব থানায় পুলিশদের হুঁশিয়ার করে দিতে হবে। সব আগে লালবাজারকে জানাতে হবে। আর যে কাগজে এই খবরগুলো ছাপা হয়েছে তাদের কাছ থেকে জানতে হবে লোকে খবরটা পড়ে কিছু বলছে কিনা। অর্থাৎ সারা কলকাতা শহরে একটা হইচই তুলতে হবে। আর সেটা করতে হবে আজ দুপুরের মধ্যেই। কেননা আর সময় নেই। এই বলে প্রণবেশ উঠে পড়ল।
বললাম, কখন আসছ তাহলে?
প্রণবেশ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, বেলা একটায়।
ঠিক আছে। আমি রেডি হয়ে থাকব।
প্রণবেশকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসছি, ছাদের কর্নিশের দিকে লক্ষ পড়ল। চমকে উঠলাম—সেই টবটা লাইন থেকে আরও খানিকটা বেরিয়ে এসেছে।