ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৪. অরণ্যের গ্রাস

৪. অরণ্যের গ্রাস

মানুষের সমাজ থেকে বিতাড়িত মোগলি আবার ফিরে এল তার নেকড়ে-মায়ের কোলে। গুহার ভিতর থেকে মাঝে মাঝে এক নাক তুলে বাতাসে ঘ্রাণ গ্রহণ করছিল মা-নেকড়ে। মন্ত্রণাসভার পাথরটার উপর থেকে শুষ্ক ব্যাঘ্রচর্মের গন্ধ ভেসে আসছিল তার নাকে।

মোগলি তার অভিজ্ঞতার কাহিনি বলছিল মা-নেকড়ের কাছে। সব ঘটনা সবিস্তারে বলার পর সে বলল, আকেলা আর ধূসর ভাইটি সাহায্য না করলে আমি কিছুই করতে পারতাম না, মা! মা! তুমি যদি দেখতে মদ্দা মোষগুলো খাদের ভিতর কেমন করে ধেয়ে গিয়েছিল, অথবা মানুষগুলো যখন আমাকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ছিল তখন কেমন করে গ্রামের দরজার ভিতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে সব কিছু তছনছ করে দিয়েছিল মোষের দল।

শেষের দৃশ্যটা দেখলে আমি খুশি হতাম না, মা-নেকড়ে ক্রুদ্ধস্বরে বলল, আমার বাচ্চাদের কেউ শেয়ালের মতন তাড়িয়ে দিলে সেই দৃশ্য চুপচাপ দেখার অভ্যাস আমার নেই। আমি সেখানে থাকলে মানুষের দলটাকে উচিত শিক্ষা দিতাম। তবে হ্যাঁ, যে-মেয়েটি তোমাকে খেতে দিয়েছিল, তাকে আমি কিছু বলতাম না।

ঠিক আছে, ঠিক আছে বাবা-নেকড়ে আলস্যজড়িত স্বরে বলল, ওহে রাক্ষসী, আমাদের খোকা আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছে, এটাই তো বড়ো কথা। মানুষের কথায় আমাদের কী দরকার? মানুষের কথা ছেড়ে দাও।

সঙ্গেসঙ্গে প্রতিধ্বনির মতন বলে উঠল বাঘিরা আর বালু, হা, হা মানুষের কথা ছেড়ে দাও।

মোগলি হেসে বলল, সে আর কখনো মানুষের মুখ দেখতে চায় না- এমন-কী মানুষের গলার স্বর বা গায়ের গন্ধ পর্যন্ত তার কাছে এখন অসহ্য।

কিন্তু, আকেলা হঠাৎ বলে উঠল, মানুষ যদি তোমায় ছাড়তে না চায়? ছোট্ট ভাইটি, তাহলে কী করবে তুমি?

আমরা এখানে পাঁচজন আছি, ধূসর নেকড়ে উপস্থিত সকলের উপর একবার দৃষ্টিপাত করল, কথাটা শেষ করার সময়ে তার দাঁতে দাঁত ঠুকে একটা কর্কশ শব্দ উঠল।

সেরকম কিছু ঘটলে আমরাও মানুষ-শিকারে যোগ দিতে পারি, বাঘিরা বলল, কিন্তু তুমি হঠাৎ মানুষের কথা ভাবলে কেন?

কারণ আছে বলেই ভাবছি, নিঃসঙ্গ নেকড়ে উত্তর দিল, শেরখানের চামড়াটা যখন মন্ত্রণাসভার পাথরে ঝুলিয়ে দেওয়া হল আমি তখন আমার পায়ের ছাপ ধরে ধরে আবার গ্রামের দিকে ফিরে গেলাম। আমাদের পায়ের ছাপগুলোর উপর পা ফেলে আমি অনেকবার এদিক-ওদিক ঘুরলাম, তারপর ওই ছাপগুলোর মধ্যে গড়াগড়ি খেলাম নানাভাবে। কারণ, কেউ যদি আমাদের পদচিহ্ন ধরে অনুসরণ করার চেষ্টা করে, তাহলে কিছুতেই সে সফল হবে না– অসংখ্য পদচিহ্নের গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলবে সে। একটু পরেই ম্যাং নামে বাদুড় এসে জানিয়ে দিল গ্রামে ঢোকার প্রধান দরজার পাশে লাল ফুল ফুটেছে (জ্বলন্ত আগুন), আর বন্দুক হাতে মানুষরা বসে আছে সেখানে।

আকেলা একটু থামল, তার পাঁজরে কয়েকটা শুকনো ক্ষতচিহ্নের উপর নজর বুলিয়ে নিয়ে বলল, আমি জানি শুধু আমোদ-আহ্লাদ করার জন্য মানুষরা বন্দুক বহন করে না। সুতরাং ছোট্ট ভাইটি- তুমি জেনে রাখো একটা লোক নিশ্চয়ই বন্দুক হাতে আমাদের অনুসরণ করবে- হয়ত এতক্ষণে সে আমাদের পায়ের ছাপগুলোর কাছে পৌঁছে গেছে।

কিন্তু কেন? মানুষরা আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে। আমিও চলে এসেছি তাদের ছেড়ে। আবার তারা কী চায় আমার কাছে? মোগলি ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল।

ছোট্ট ভাইটি, তুমিও মানুষ, আকেলা উত্তর দিল, আমরা বনের শিকারি তোমার জাতভাই কী করছে বা কেন করছে, আমাদের তা জানার কথা নয়– সেটা জানবে তুমি।

আকেলা চট করে তার পা সরিয়ে নিল। যেখানে তার পা ছিল, জায়গাটাতে মাটির মধ্যে গম্ভীর হয়ে বিধে গেল মোগলির ছুরি।

আবার যখন তুমি মানুষের দল আর মোগলিকে নিয়ে কথা বলবে, ছুরিটাকে খাপের ভিতর ঢুকিয়ে রেখে শান্তভাবে মোগলি বলল, দুজনকে জড়িয়ে একসঙ্গে কথা বলবে না।

আলাদা করে দু-বার দুজনের নাম উচ্চারণ করবে।

ওফ! দাঁতটা খুবই ধারাল বটে, মাটি কেটে যেখানে ছুরিটা বসে গিয়েছিল, সেই জায়গাটা শুকল আকেলা, কিন্তু মানুষের সঙ্গে মিশে তোমার চোখের নজর ভোতা হয়ে গেছে। আঘাত করার জন্য তুমি যে-সময়টা নিয়েছ, ওই সময়ের মধ্যে একটা হরিণকে আমি খতম করে দিতে পারি।

কথাটা সত্যি। মোগলি আঘাত করেছিল অতি দ্রুত। কোনো মানুষের চোখের দৃষ্টি সেই ক্ষিপ্রতাকে অনুসরণ করে আত্মরক্ষা করতে পারত না। কিন্তু আকেলা মানুষ নয়, নেকড়ে, তার ক্ষিপ্রতা অবিশ্বাস্য।

হঠাৎ একলাফে উঠে দাঁড়াল আকেলা, মাথা তুলে বাতাস শুঁকতে লাগল, তার দেহের পেশিগুলো হয়ে উঠল আড়ষ্ট ও কঠিন। বাঘিরার মতোই বাতাসে ঘ্রাণ গ্রহণ করতে লাগল ধূসর নেকড়ে এবং আলো ছুটে গিয়ে পঞ্চাশ গজ দূরে ওৎ পেতে বসে পড়ল শিকারি পশুর অভ্যস্ত ভঙ্গি নিয়ে। চতুষ্পদ সঙ্গীদের দিকে তাকাল মোগলি, তার দৃষ্টিতে ফুটল ঈর্ষার আভাস। মানুষের তুলনায় তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় যথেষ্ট তীক্ষ্ণ হলেও বনচারী শ্বাপদের মতো তীব্র অনুভূতি তার নাকে নেই।

মানুষ! আকেলা চাপা গলায় গর্জে উঠল।

বালদেও! মোগলি বলল, লোকটা আমাদের অনুসরণ করছে। ওর হাতের বন্দুকে নলের উপর চমকে উঠছে সূর্যের আলো। দেখেছ?

আমি জানতাম মানুষ আমাদের অনুসরণ করবে, গর্বিতকণ্ঠে বলল আকেলা, বিনা কারণে নেকড়েরা আমায় নেতা বলে মেনে নেয়নি।

শেরখানের ভারী চামড়া মাথায় নিয়ে মোগলি যখন গ্রাম ছেড়ে বনের দিকে রওনা হল এবং তাকে অনুসরণ করল ধূসর নেকড়ে আর আকেলা- তখন তাদের পায়ের চিহ্ন খুব স্পষ্ট হয়েই ফুটে উঠেছিল বনের পথে। বালদেও খুব সহজেই সেই পায়ের ছাপগুলো অনুসরণ করতে সমর্থ হয়েছিল; কিন্তু আকেলা যেখানে ছাপগুলো নষ্ট করে দিয়েছে, সেই জায়গাতে গিয়েই হোঁচট খেল বৃদ্ধ শিকারি– অনেকগুলো পদচিহ্নের গোলকধাঁধা তাকে হতভম্ব করে দিল। ঠিক সেইসময় বনের ভিতর থেকে কয়েক জোড়া বন্য চক্ষু বালদের উপর নজর রাখছিল এবং তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তারা নিজেদের মধ্যে কথা কইছিল। কিন্তু সেই নতকণ্ঠের অস্পষ্ট আওয়াজ ধরার মতো শ্রবণশক্তি মানুষের নেই, তাই বালদেও বুঝতে পারেনি তার চারপাশে বনচারী শ্বাপদের দল তাকে নজরবন্দি করে রেখেছে। ক্রুদ্ধ ও বিব্রত বালদেও আপনমনেই কথা বলছিল অতিশয় হিংস্র ভঙ্গিতে।

ধূসর নেকড়ে জানতে চাইল, লোকটা কী বলতে চায়?

মানুষের ভাষা থেকে জঙ্গলের ভাষায় অনুবাদ করল মোগলি, লোকটা বলছে এমন পায়ের ছাপ সে জীবনে কখনো দেখেনি। লোকটা খুব ক্লান্ত, সেকথাও বলছে।

বালদেও এইবার একটা হুঁকো বার করে সেই হুঁকো থেকে ধূমপান শুরু করল। যারা তার উপর নিঃশব্দে নজর রাখছিল, তাদের নাকে তামাকের গন্ধ ভেসে এল বনের বাতাসে। ভবিষ্যতে দূর থেকে ওই গন্ধটাই তাদের বালদেও নামক মানুষটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করে দেবে সন্দেহ নেই।

এই সময় হঠাৎ একদল কাঠুরে এসে উপস্থিত হল সেখানে। বালদেওকে দেখে তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর কথা কইতে লাগল তার সঙ্গে। কাঠুরেরা বালদেওকে জানত, শিকারি হিসাবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল অনেক দূর পর্যন্ত। বালদেও এইবার কাঠুরেদের কাছে তার অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে শুরু করল। মোগলি নামে শয়তান-শাবকের কাহিনি সে কাঠুরেদের জানাল। শেরখানকে যে সে নিজের হাতে মেরেছে সেকথাও সে জানাতে ভুলল না। তারপর বলল, মোগলি কেমন করে সারা বিকাল ধরে তার সঙ্গে লড়াই করেছে নেকড়ের রূপধারণ করে এবং কেমন করে আবার মানুষের চেহারা নিয়ে বালদের বন্দুকটাকে এমন জাদু করেছে যে, বন্দুক থেকে গুলি ছুটে গিয়ে বালদেরই একটা মোষকে খতম করে দিয়েছে। গ্রামের মানুষ এখন ওই শয়তান-শাবককে হত্যা করার জন্য বালদেওকে নিযুক্ত করেছে; কারণ সিওনীতে তার চাইতে সাহসী শিকারি কেউ নেই। ইতিমধ্যে মেসুয়া আর তার স্বামীকে বন্দি করেছে গ্রামবাসী তাদের অপরাধ ওই শয়তান-আশ্রিত ছেলেটার তারাই হচ্ছে মা আর বাবা। তারা দুজনে যে ডাইনি আর জাদুকর সেকথা স্বীকার করানোর জন্য তাদের উপর ভয়ংকর অত্যাচার চালানো হবে এবং স্বীকৃতি পাওয়ার পরে তাদের পুড়িয়ে মারা হবে, একথাও জানাতে ভুলল না বালদেও।

কাঠুরেরা সাগ্রহে জানাল, ওই অনুষ্ঠানে তারা উপস্থিত থাকতে চায়, তাই ওই মহৎ কার্যটি কখন সম্পন্ন হবে সেই সময়টা তাদের জানা দরকার।

বালদেও বলল সে জঙ্গল থেকে ফিরে আসার আগে কিছুই করা হবে না, কারণ গ্রামের লোক চাইছে আগে ওই শয়তান ছেলেটাকে হত্যা করতে তারপর ব্যবস্থা হবে তার বাপ-মায়ের। বক্তব্যের উপসংহারে বালদেও জানাল জাদুকর আর ডাইনিকে হত্যা করাই উচিত- জঙ্গলের নেকড়ে-পালিত শিশুকে যারা আশ্রয় দেয়, তারা মনুষ্যজাতির কলঙ্ক।

কিন্তু, কাঠুরেরা সংশয় প্রকাশ করল, ইংরেজরা যখন এই হত্যাকাণ্ডের কথা শুনবে তখন কী হবে? ওই সাদা চামড়ার মানুষগুলো বদ্ধ পাগল ডাইনিকে হত্যা করার জন্য যারা দায়ী, তাদের ধরে নির্ঘাত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে।

সমস্যার সমাধান করে দিল বালদেও– গ্রামের মোড়ল সরকারকে জানাবে মেসুয়া আর তার স্বামী সাপের কামড়ে মারা পড়েছে। সর্পদংশনে মৃত্যু ওই এলাকায় খুব স্বাভাবিক ব্যাপার- কাজেই ইংরেজরা কিছু সন্দেহ করতে পারবে না। সব ঠিক হয়ে আছে, কিন্তু ওই নেকড়ে-মানুষকে হত্যা না করলে কিছুই করা সম্ভব নয়। এখন বালদের প্রশ্ন হচ্ছে, ওই ভয়ংকর ছেলেটা কি কাঠুরেদের চোখে পড়েছে?

কাঠুরেরা সভয়ে জানাল নেকড়ে-মানুষের সঙ্গে তাদের দেখা হয়নি। তবে বালদের মতন সাহসী ও দক্ষ শিকারি যে তাকে খুঁজে বার করতে পারবে, এবিষয়ে তারা নিঃসন্দেহ। সূর্য এখন অস্তায়মান, কাঠুরেরা বলল তারা বালদের সঙ্গে তার গ্রামে গিয়ে ডাইনিটাকে দেখতে ইচ্ছুক। বালদেও বলল যদিও তার প্রধান কর্তব্য হচ্ছে পূর্বোক্ত শয়তান-আশ্রিত নেকড়ে-মানুষকে খতম করা, তবু জঙ্গলের মধ্যে একদল নিরস্ত্র মানুষকে নেকড়ে-মানুষের কবলে ছেড়ে দিলে সে নিজের বিবেকের কাছেই অপরাধী হবে- অতএব সে নিজেই বন্দুক হাতে কাঠুরেদের সঙ্গে যাবে। অতঃপর বীরদর্পে সারিবদ্ধ হয়ে গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল কাঠুরের দল এবং বালদেও নামক শিকারি…

বন্ধুদের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল মোগলি, ওরা মেসুয়া আর তার স্বামীকে ফাঁদে ফেলেছে। লোকগুলো বদ্ধ উন্মাদ। ওরা লাল ফুল (আগুন) দিয়ে মেসুয়াদের পুড়িয়ে মারতে চাইছে। আমি কিছুতেই তা হতে দেব না। তবে বালদেও গ্রামে ফিরে যাওয়ার আগে গ্রামের লোক মেসুয়াদের কোনো ক্ষতি করবে না। আমি এখন গ্রামে যাব। তোমরা এই লোকগুলোকে আটকে রাখ। অন্ধকার ঘন হওয়ার আগে ওরা যেন গ্রামে না পৌঁছাতে পারে।

ধূসর নেকড়ের দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল, আমরা ওদের দড়িতে বাঁধা ছাগলের মতো একজায়গায় গোল হয়ে ঘোরাতে পারি। মানুষ জাতটাকে আমি খুব ভালোভাবেই জানি।

না, না, অতটা দরকার নেই। বনের পথে ওরা সঙ্গীর অভাব বোধ করতে পারে। তাই ওদের একটু গান শুনিয়ে দিও। বাঘিরা, তুমিও নেকড়ে-ভাইদের গানের সঙ্গে গলা মেলাতে পার।

মানুষকে গান শোনাব আমি? বাঘিরা? কালো চিতার দুই চোখে কৌতুকের আভাস, আচ্ছা; বলছ যখন, চেষ্টা করে দেখব।

পরক্ষণেই দূর হতে দূরে, বন হতে বনান্তরে ভেসে গেল বাঘিরার গর্জিত কণ্ঠস্বর। মোগলি দেখল কাঠুরের দল এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেই তো সবে শুরু এবার চিৎকার করে উঠল ধূসর নেকড়ে, তার সঙ্গে যোগ দিল তার তিন সঙ্গী। সেই শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই গম্ভীর গর্জনে সাড়া দিল বাঘিরা। তারপর শুরু হল কালো চিতা ও চার নেকড়ের মিলিত ঐকতান। দিনের আলো মুছে যাওয়ার আগেই শ্বাপদকণ্ঠের হিংস্র কণ্ঠসংগীত মানুষগুলোকে আতঙ্কে পাগল করে দিল ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে তারা গাছে চড়তে শুরু করল। বালদেও উচ্চৈঃস্বরে কয়েকটা মন্ত্র আওড়াতে লাগল শয়তানের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। জন্তুদের গলার আওয়াজ যতক্ষণ পাওয়া গেল ততক্ষণ কেউ গাছ থেকে নামতে সাহস পেল না। শ্বাপদকণ্ঠ নীরব হওয়ার অনেক পরে তারা গাছ থেকে নামল এবং একসময়ে ঘুমিয় পড়ল।

ইতিমধ্যে গ্রামে পৌঁছে গেছে মোগলি। আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখল, চাষের জমি থেকে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে গ্রামের সব মানুষ। সন্ধ্যার সময়ে তারা রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকে কিন্তু আজ তারা রান্নার কথা ভুলে গাঁয়ের মস্ত গাছটার তলায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে কথা কইছে এবং মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে।

গ্রামবাসীর স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল ছিল মোগলি। তারা যতক্ষণ খাওয়া-দাওয়া, ধূমপান আর গল্পগুজব নিয়ে মত্ত থাকবে ততক্ষণ মেসুয়াদের বিপদের আশঙ্কা নেই– কিন্তু নৈশভোজ শেষ হলেই লোকগুলো বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। বালদেওর আসার সময় হয়েছে। মোগলির বনবাসী চতুষ্পদ বন্ধুরা যদি তার কথামতো কাজ করে থাকে, তবে গ্রামবাসীর কাছে বেশ রসিয়ে অনেক কিছু বলার সুযোগ পাবে বালদেও। ইতিমধ্যেই মোগলি জানালা দিয়ে দেখে নিয়েছিল, ঘরের মধ্যে হাত-পা আর মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। মেসুয়া ও তার স্বামী। জানালা দিয়েই গৃহপ্রবেশ করল মোগলি, তারপর দুজনকেই বন্ধনমুক্ত করে দিল।

ভয়ে আর যন্ত্রণায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল মেসুয়া। (সারা সকাল তাকে নির্দয়ভাবে প্রহার করা হয়েছিল। নিষ্ঠুর গ্রামবাসীরা তাকে পাথর ছুঁড়ে মারতেও দ্বিধাবোধ করেনি। তার স্বামী বিশেষ ভয় পায়নি, তবে কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল আর রেগে গিয়েছিল খুবই। সে তার দাড়ি থেকে ধুলো আর আবর্জনা ঝেড়ে ফেলছিল নিঃশব্দে।

তোমাদের মুখ বাঁধা হয়েছে কেন? মোগলি জিজ্ঞাসা করল, হাত-পা বেঁধে রাখার কারণটাই বা কী?

আমাদের মেরে ফেলা হবে, মেসুয়ার স্বামী বলল, তোমার মতো ছেলের বাপ-মা হয়েছি, এই আমাদের অপরাধ। তাকিয়ে দেখ আমার শরীর রক্তাক্ত করে দিয়েছে ওরা।

মেসয়া কিছু বলেনি। কিন্তু তার শরীরে রক্ত ঝরতে দেখেই মোগলির চোখদুটো জ্বলে উঠল, দাঁতে দাঁত ঘষে সে বলল, কে করেছে এই কাজ? এই রক্তের দাম তাকে দিতেই হবে।

সারা গ্রামের সমস্ত মানুষই এই কাজের জন্য দায়ী, বলল, মেসুয়রা স্বামী, আমার যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে। আমার গরু-মোষের সংখ্যাও খুব বেশি। অতএব আমি আর মেসুয়া হলাম ডাইনী। তোমাকে আশ্রয় দেওয়ার অপবাদ দিয়ে আমাদের খুন করা হবে।

জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ওই যে পথটা চলে গেছে, ওই পথ ধরে সোজা চলে যাও, মোগলি বলল, তোমাদের হাতে-পায়ে এখন আর বাঁধন নেই। এখনই তোমরা এখান থেকে পালাও।

কিন্তু জঙ্গলের পথ তো আমরা তোমার মতো চিনি না, বাছা, মেসুয়া বলল, খুব বেশি পথ আমি হাঁটতে পারব না বলেই মনে হচ্ছে।

গ্রামের মেয়ে-মরদ সবাই মিলে তাড়া করে আমাদের ধরে ফেলবে, তারপর আবার টেনে আনবে এইখানে। মেসুয়ার স্বামী বলল।

হুম! ছুরির ফলা দিয়ে হাত চুলকে নিল মোগলি, গ্রামের কোনো লোকের আমি ক্ষতি করতে চাই না। এখনও পর্যন্ত। তবে তোমাদের নিয়ে বোধ হয় তেমন মাথা ঘামাতে পারবে না ওরা। কারণ, একটু পরেই ওরা অন্য বিষয় নিয়ে চিন্তিত ও বিব্রত হয়ে পড়বে।

কথা থামিয়ে হঠাৎ সে মাথা তুলল, এক প্রবল শব্দঝটিকা তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে আঘাত করেছে গ্রামের ভিতর থেকে ভেসে আসছে বহু মানুষের কণ্ঠস্বর এবং ধাবমান পদশব্দ।

ওহ! তাহলে বালদেওকে আমার বন্ধুরা ঘরে ফিরতে দিয়েছে!

মেসুয়া বলে উঠল, তোমাকে খুন করার জন্য ওকে পাঠানো হয়েছিল। তোমার সঙ্গে কি বালদের দেখা হয়েছিল বনের মধ্যে?

হ্যাঁ–ইয়ে–হ্যাঁ, আমি ওকে দেখেছিলাম বটে। এখন গাঁয়ের মানুষের কাছে ও অনেক কিছু বলবে। যতক্ষণ ও কথা কইবে ততক্ষণ আমাদেরও কিছু করার আছে। তবে প্রথমেই আমায় জানতে হবে, ওরা কী করতে চায়। ভালো করে ভেবে দেখ, কোথায় যেতে চাও তোমরা। আমি ফিরে এলে তোমাদের যাওয়ার জায়গাটা আমাকে জানাবে।

জানালার ভিতর দিয়ে লাফ মেরে মোগলি বাইরে এসে পড়ল। গ্রামটাকে ঘিরে যে-পাঁচিলটা অবস্থান করছিল, সেটার সঙ্গে গা মিলিয়ে সে দৌড় দিল। সে যেখানে এসে দাঁড়াল, সেখান থেকে পিপুল গাছের তলায় সমবেত জনতার সব কথাই ভেসে আসছিল তার কানে। বালদেও তখন সটান শুয়ে পড়েছে মাটির উপর। থেকে থেকে সে কাশছে এবং তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে গোঙানির আওয়াজ। জনতার মধ্যে সকলেই তাকে নানারকম প্রশ্ন করছিল। বালদেওকে তখন দেখাচ্ছিল উদ্ভ্রান্তের মতন তার চুলগুলো কাঁধের উপর ছড়িয়ে পড়েছে, হাত-পায়ের চামড়া ছিঁড়ে গেছে তাড়াহুড়ো করে গাছে চড়তে গিয়ে এবং কথা বলতে তার কষ্ট হচ্ছে খুবই। তবু নিজের গুরুত্ব সে ভালোই বুঝতে পেরেছিল। তার মুখ থেকে বনের ভিতর জাদুকরের ভেলকি আর শয়তানের সংগীতধ্বনির বিবরণ শুনে ভয়ে-বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল গ্রামের মানুষ।

বাঃ! মোগলি আপনমনে বলল, খালি কথা, কথা আর কথা! মানুষদের সঙ্গে বাঁদরদের বিশেষ তফাৎ নেই দেখছি। ওরা সকলেই এখন বালদেওর গপপো শুনতে ব্যস্ত, মেসুয়াকে পাহারা দেওয়ার জন্য কোনো লোক সেখানে নেই। এই সুযোগে যা করার করতে হবে।

মোগলি আবার মেসুয়ার কুঁড়েঘরের দিকে ফিরল। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে, হঠাৎ পায়ের উপর একটা স্পর্শ অনুভব করল সে।

মা! মোগলি বিস্মিতকণ্ঠে বলে উঠল, তুমি এখানে?

আমি শুনলাম আমার ছেলেরা বনের মধ্যে শিকারের গান গাইছে। তখন যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করলাম। ছোট্ট ব্যাং! (মা-নেকড়ের আদরের ডাক) তোমাকে যে-মেয়েটি দুধ পান করতে দিয়েছিল, আমি তাকে একবার দেখতে চাই, মা-নেকড়ে বলল। তার সর্বাঙ্গ তখন শিশিরে ভিজে গেছে।

মানুষগুলো তাকে বেঁধে রেখেছিল। আমি সেই বাঁধন কেটে দিয়েছি। ও এখন তার স্বামীর সঙ্গে জঙ্গলের পথ ধরে পালিয়ে যাবে।

আমি ওদের অনুসরণ করব। বুড়ো হয়েছি বটে, কিন্তু আমার দাঁতগুলো এখনও পড়ে যায়নি।

মা-নেকড়ে পিছনের পায়ে খাড়া হয়ে উঠে জানালার ফাঁকে দৃষ্টিপাত করল। তার জানোয়ারি-চোখ অন্ধকার ছুঁড়ে মানুষ দুটিকে দেখতে পেল। মিনিটখানেক পরে কৌতূহল নিবৃত্ত করে আবার সামনের দুই পা নামিয়ে জানালা থেকে নিঃশব্দে মাটির উপর দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

তুমি এখানে অপেক্ষা কর, মোগলি বলল, কিন্তু মেয়েটি যেন তোমাকে দেখতে না পায়।

মা-নেকড়ে একটু পিছিয়ে এসে লম্বা লম্বা ঘাসের মধ্যে শরীরটা মিশিয়ে দিল। কোনো মানুষ সেখানে উপস্থিত হলে বুঝতেই পারবে না যে, এইটুকু ঘাস-জমির মধ্যে অতবড়ো একটা নেকড়ে লুকিয়ে রয়েছে। আত্মগোপনের কৌশল ভালোভাবেই জানত মা-নেকড়ে।

মোগলি জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল, মেসুয়া তার স্বামীর সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে যেতে প্রস্তুত। কোনোরকমে খানহিওয়াড়াতে পৌঁছাতে পারলেই তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ। কিন্তু এখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত।

চলে যাও তাহলে, মোগলি বলল, গ্রামের কোনো লোক তোমাদের আটকাতে পারবে না। আজ রাতে দরজা খুলে ঘরের বাইরে আসার ক্ষমতা হবে না কোনো লোকের। কিন্তু ওই মানুষটা ওখানে কী করছে?

মেসুয়ার স্বামী তখন কুঁড়েঘরের এক কোণে হাঁটু পেতে বসে মাটি খুঁড়ছিল। তাকে লক্ষ্য করেই মোগলির প্রশ্ন।

ওখানে রয়েছে সামান্য কিছু টাকা, মেসুয়া বলল, আর কিছু আমরা নিতে পারব না।

ওঃ, বুঝেছি, মোগলি বলল, ওই জিনিসটাকে আমি হাতে হাতে ঘুরতে দেখেছি বটে। কিন্তু গ্রামের বাইরে গিয়েও ওই জিনিসটা তোমাদের দরকার হবে?

মেসুয়ার স্বামী ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকাল, এটা নিতান্ত মূর্খ, শয়তান-টয়তান নয়। একটু থেমে সে আবার বলল, এই টাকা দিয়ে আমি একটা ঘোড়া কিনতে পারব। আমরা মার খেয়েছি ভীষণভাবে, আমাদের শরীর গেছে ঘেঁতো হয়ে পায়ে হেঁটে খুব তাড়াতাড়ি চলতে পারব না আমরা, ফলে একটু পরেই গ্রামের লোক আমাদের তাড়া করে ধরে ফেলবে।

আমি বলছি তারা তোমাদের অনুসরণ করতে পারবে না। তবে ঘোড়ার কথা ভেবে তুমি ভালোই করেছ। মেসুয়া ভীষণ ক্লান্ত, ঘোড়া পেলে তাকে আর কষ্ট করে হাঁটতে হবে না।

মেসুয়ার স্বামী টাকাগুলোকে তার কোমরে কাপড়ের ভাঁজে গুঁজে রাখল। মোগলির সাহায্যে জানালা দিয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল মেসুয়া। রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া প্রহারে জর্জরিত মেয়েটিকে কিছুটা চাঙ্গা করে দিল। কিন্তু তারার আলোয় আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে রাতের অরণ্য তার মনে ভীতির সঞ্চার করল।

মোগলি ফিস ফিস করে বলল, খানহিওয়াড়ার রাস্তা তোমরা জানো? তারা মাথা নাড়ল, জানে।

বেশ। মনে রেখ, জঙ্গলে তোমাদের ভয় পাওয়া কোনো কারণ নেই। খুব তাড়াতাড়ি পথ চলারও দরকার হবে না। তোমাদের সামনে আর পিছনে হয়তো গান শুনতে পাবে, তাতে ভয় পেয়ো না।

আগুনে পুড়ে মরার চাইতে জঙ্গলের মধ্যে বিপদের ঝুঁকি নেওয়া ভালো, মেসুয়ার স্বামী বলল, মানুষের হাতে মরার চাইতে বনের জানোয়ারের কবলে মরলে কষ্ট অনেক কম।

মেসুয়া কিছু বলল না, মোগলির দিকে তাকিয়ে হাসল।

আমি বলছি, মোগলি বলল, জঙ্গলের মধ্যে কেউ তোমাদের গায়ে দাঁত বসাবে না অথবা থাবা মারবে না। কোনো মানুষ বা জানোয়ার তোমাদের পথ আটকাবে না। তোমরা বিনা বাধায় খানহিওয়াড়াতে পৌঁছে যাবে। নিরাপত্তার জন্য তোমাদের উপর সর্বদাই নজর রাখা হবে।

মেসুয়ার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মোগলি আবার বলল, তোমার স্বামী আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা বিশ্বাস করবে?

নিশ্চয়। বাছা আমার; তুমি মানুষ, প্রেত বা বনের নেকড়ে, যা-ই হও না কেন, তুমি তো আমারই সন্তান তোমার কথায় বিশ্বাস করব না?

আমার বন্ধুরা যখন গান গাইবে তখন তোমার স্বামী ভয় পাবে, আমি জানি। কিন্তু তুমি বুঝবে, তুমি ভয় পাবে না। ধীরে ধীরে যাও, তাড়াতাড়ি হুড়োহুড়ি করার দরকার নেই। গ্রামে ঘরে ঘরে দরজা বন্ধ, কেউ বাইরে আসতে সাহস করবে না।

মোগলির কাছে বিদায় নিয়ে খানহিওয়াড়ার পথে যাত্রা করল মেসুয়া আর তার স্বামী। তারা জঙ্গলের পথ ধরার সঙ্গেসঙ্গে গোপন স্থান থেকে একলাফে বাইরে আত্মপ্রকাশ করল মা-নেকড়ে।

ওদের পিছু নাও, মোগলি বলল, আর সারা জঙ্গলকে জানিয়ে দাও এদের নিরাপত্তার কথা। একবার শুনিয়ে দাও তোমার গলায় আওয়াজ। আমি এখন বাঘিরাকে ডাকব।

তৎক্ষণাৎ রাতের স্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে বেজে উঠল একটানা নত ও গভীর জান্তব কণ্ঠস্বর। মোগলি দেখল, মেসুয়ার স্বামী সচমকে ঘুরে দাঁড়াল; সে এখন তার পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরে আবার ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে।

যাও, যাও, সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল মোগলি, আমি তো আগেই বলেছি, তোমরা গান শুনতে পাবে। ওই গানের আওয়াজ তোমাদের অনুসরণ করে খানহিওয়াড়া পর্যন্ত যাবে. নির্ভয়ে এগিয়ে যাও তোমরা।

মেসুয়া তার স্বামীকে আশ্বস্ত করে সামনে এগিয়ে যেতে বলল… ঘন অন্ধকারের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল দুটি দ্বিপদ মনুষ্য এবং তাদের পিছনে অনুসরণ-রত একটি চতুস্পদ শ্বপদ-মা-নেকড়ে!…

অকস্মাৎ মোগলির পায়ের কাছে যেন মাটি খুঁড়ে উঠে দাঁড়াল কালো কুচকুচে একটি জন্তু-বাঘিরা! তাকে সঙ্গে নিয়ে মেয়াদের পরিত্যক্ত কুটিরে প্রবেশ করল মোগলি। চারপাই এর উপর শরীর বিছিয়ে শুয়ে পড়ল কালো চিতা। মোগলি বলল, সে এখানে থাকবে না।

গ্রামবাসীরা কুটিরের দরজা খুলে যখন মেসুয়া আর তার স্বামীকে পোড়াতে আসবে তখন বন্দিদের পরিবর্তে বাঘিরাকে দেখলে তাদের অবস্থা যে কতটা শোচনীয় হবে, সেকথা অনুমান করে হেসে উঠল মোগলি।

দূর থেকে একটা কোলাহল এগিয়ে আসতে লাগল বন্ধ কুটিরের দিকে। মোগলি বলল, ওই যে লোকগুলো আসছে। আমি ওদের সামনে থাকতে চাই না। তুমি যা ভালো বুঝবে, করবে।

তাই হোক, বাঘিরা বলল, আমি শুনতে পাচ্ছি ওরা আসছে।

লাঠি, মুগুর, ছোরা, কাস্তে প্রভৃতি নিয়ে সশস্ত্র নারী-পুরুষের এক হিংস্র জনতা আছড়ে পড়ল বন্ধ দরজার গায়ে। হ্যাঁচকা টানে খুলে গেল দরজার শিকল এবং মশালের আলোতে জনতার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অভাবিত দৃশ্য।

ঘরের মধ্যে কোথাও মেসুয়া বা তার স্বামীর চিহ্ন নেই, কিন্তু চারপাই-এর উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছে একটা কালো কুচকুচে প্রকাণ্ড জানোয়ার! ভয়ংকর এক স্তব্ধতা নেমে এল ঘরের ভিতর!…

প্রায় আধমিনিট পরে জনতার সম্মুখভাগ হয়ে উঠল অত্যন্ত সচল ও সক্রিয়, ঠেলাঠেলি আর ধাক্কাধাক্কি করে তারা দরজার চৌকাঠ থেকে পিছিয়ে যেতে সচেষ্ট হল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে মাথা তুলল বাঘিরা, তার চোয়াল খুলে গিয়ে হাই উঠল– রক্তলাল মুখগহ্বরের ভিতর থেকে মশালের আলোতে ঝক ঝক করে উঠল তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি! জনতা আর দাঁড়াল না– ভীষণ চিৎকারে চারদিক কাঁপয়ে প্রত্যেকটি মানুষ দৌড় দিল তার নিজস্ব ঘরের দিকে মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেল গ্রামের রাস্তা!

জানালা দিয়ে ঘরের বাইরে লাফিয়ে পড়ল বাঘিরা, যেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল মোগলি।

দিনের আলো ফুটে ওঠার আগে ওরা কেউ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে না, বাঘিরা বলল, এখন আমি কী করব?

সারা রাত ওদের উপর নজর রাখো, মোগলি বলল, আমি এখন ঘুমাতে যাব।

জঙ্গলে ঢুকে একটা পাথরের উপর শয্যাগ্রহণ করে ঘুমিয়ে পড়ল মোগলি। সমস্ত দিন সে ঘুমিয়ে কাটাল। তার ঘুম ভাঙল আবার রাত্রি ঘনিয়ে আসার পরে। জেগে উঠে সে দেখল একটা হরিণ শিকার করে তার জন্যে অপেক্ষা করছে বাঘিরা। হরিণের মাংসে ক্ষুধা নিবারণ করার পর বাঘিরার দিকে তাকাল মোগলি।

ওই মেয়েটি আর পুরুষটি নিরাপদে পৌঁছে গেছে খানহিওয়াড়াতে, বাঘিরা বলল, নেকড়ে-মা খবরটা পাঠিয়ে দিয়েছে চিলের সাহায্যে। মধ্যরাতের আগেই একটা ঘোড়া পেয়ে গিয়েছিল ওরা এবং ঘোড়ায় চড়ে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেছে যথাস্থানে। খবরটা ভালো নয়?

নিশ্চয়ই ভালো খবর।

গ্রামের মধ্যে মানুষের দলটা বাইরে বেরিয়েছিল তখনই, যখন সূর্য উঠে গেছে আকাশের মাঝামাঝি। তারপর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার ঢুকে গেছে ঘরের মধ্যে।

তারা তোমায় দেখতে পায়নি তো?

 হয়তো দেখেছে। আমি গ্রামের প্রধান দরজার সামনে গড়াগড়ি দিচ্ছিলাম। আর সেইসময় একটু-আধটু গানও গেয়ে থাকতে পারি। যাকগে, ওসব কথা ছেড়ে দাও। বনের বাসিন্দারা সবাই ভালো আছে। এখন মানুষের কথা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত।

হাঁ, ওদের কথা সকলেই ভুলে যাবে খুব অল্পদিনের মধ্যে। আচ্ছা, হাতি আজ রাতে কোথায় খাদ্যগ্রহণ করবে জানো?

যেখানে তার খুশি হবে সেখানে। হাতির মেজাজ-মর্জির খবর কে রাখবে? কিন্তু হঠাৎ হাতির খোঁজ কেন? এমন কোন কাজটা আছে, যা হাতি করতে পারে- আর আমরা পারি না?

হাতি আর তার তিন ছেলেকে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে।

 ওহে আমার ছোট্ট ভাইটি! তুমি কাকে কী বলছ? হাতি হচ্ছে বনের মান্যগণ্য বাসিন্দা। তাকে এস বললেই আসবে আর যাও বললেই যাবে, এমন জিনিস সে নয়।

যদি সে আসতে না চায়, তাহলে তাকে বলবে ভরতপুরের মাঠে লুঠতরাজের যে-ঘটনা ঘটেছিল, সেই কারণেই তাকে ডেকে পাঠিয়েছে মোগলি।

ভরতপুরের মাঠে লুঠতরাজ, দু-তিনবার কথাটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলল বাঘিরা, ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। ব্যাপারটা যদি ভালো না লাগে, হাতি খুব চটবে। কিন্তু যে-কথা শুনলে হাতির মতো প্রাণী বাধ্য ছেলের মতো আদেশ পালন করে, সেই দারুণ কথাটা আমাদের শিখে রাখা দরকার।

হাতি এল নিঃশব্দে। সঙ্গে তিন ছেলে। জঙ্গলের প্রথা অনুসারে হাতি মোগলিকে অভিবাদন জানাল, উত্তম শিকার।

মোগলি হাতির দিকে তাকাল না; বাঘিরাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি এখন একটা গল্প বলব। গল্পটা যে-শিকারির মুখ থেকে আমি শুনেছি, তাকে আজ বনের মধ্যে তুমি তাড়া করেছিলে। যে-হাতিটা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, সে একটা হাতি-ধরা ফাঁদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। ফাঁদের মধ্যে পুঁতে রাখা ধারাল বাঁশের খোঁচায় তার পা থেকে কঁধ পর্যন্ত চিরে ফাঁকা হয়ে একটা সুদীর্ঘ ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি হয়। পরে সেই ক্ষত শুকিয়ে যায়, থেকে যায় একটা সাদা দাগ।

মোগলি হাত তুলল, সঙ্গেসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল হাতি। তার শ্লেট পাথরের মতো কালো শরীরে চাঁদের আলোতে ফুটে উঠল একটা সাদা দাগ। মানুষরা সেই ফাঁদের কাছে এল হাতিকে বন্দি করার জন্য, মোগলি বলতে লাগল, কিন্তু হাতি ছিল ভীষণ শক্তিমান, সে দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে গেল। তার ক্ষতস্থান শুকিয়ে গেল ধীরে ধীরে। তখন সে ফিরে এসে ওই হাতি-শিকারিদের ফসলের ক্ষেতে হানা দিল। সঙ্গে ছিল তার তিন ছেলে। এই ঘটনা ঘটেছিল অনেকদিন আগে আর অনেক দুরে ভরতপর নামে জায়গাটার ক্ষেতের উপর। ওই ক্ষেতগুলোর ফসল কাটার সময় কী হয়েছিল হাতি?

ওই ক্ষেতগুলোর ফসল তুলেছিলাম আমি আর আমার তিন ছেলে।

 ফসল তোলার পর আবার কখন জমি চাষ করা হয়েছিল?

 জমিতে আর চাষ হয়নি, হাতি বলল।

আর যেসব মানুষ ওই শস্যক্ষেত্রের আশেপাশে বাস করত, তাদের কী হল? মোগলি জিজ্ঞাসা করল?

তারা সেখান থেকে চলে গিয়েছিল।

যে-সব কুঁড়েঘরে তারা ঘুমাত, সেগুলো কী হল?

আমরা কুঁড়েঘরগুলো ভেঙে ফেললাম। তারপর জঙ্গল সেগুলোকে গিলে ফেলল। লতাপাতা আর ঘাস ছেয়ে ফেলল দেয়ালগুলো। চাষের ক্ষেতজমি আর গরু-মোষ চরাবার মাঠে জঙ্গল গজিয়ে গেল। পাঁচ-পাঁচটা গ্রাম চলে গেল বনের গর্ভে। সেখানে এখন আর কোনো মানুষ থাকে না, থাকতে পারে না। কিন্তু তুমি এত কথা জানলে কেমন করে?

জেনেছি মানুষেরই মুখ থেকে, মোগলি বলল, এখন দেখছি বালদের মতো মানুষও মাঝে মাঝে সত্যি কথা বলে। তবে তুমি যা করেছ, ভালোই করেছ। এখন দ্বিতীয়বার ওই কাজটা তোমায় করতে হবে। আরও একটা গ্রামকে ফেলে দিতে হবে জঙ্গলের গ্রাসে। নিঃশেষে মুছে যাবে ওই গ্রাম অরণ্যের গর্ভে। জানো, ওই গ্রামের মানুষরা আমায় তাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদেরই জাতভাইকে তারা লাল ফুল (আগুন) দিয়ে পুড়িয়ে মারতে চায়। যে-মেয়েটি আমাকে খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়েছিল, তাকে তারা খুন করতে চেয়েছিল। আমি বাধা দিয়েছিলাম বলেই খুনের চেষ্টা সফল হয়নি। ওই লোকগুলোকে এখানে আমি থাকতে দেব না। তারা অন্য কোথাও চলে যাক। যে-মেয়েটি আমায় খাবার দিয়েছিল, তাকে মেরে ওরা রক্তাক্ত করেছিল। সেই রক্তের গন্ধ আমি পেয়েছি। সেই রক্তের গন্ধ এখনও আমার নাকে লেগে আছে। অত্যাচারী মানুষগুলোর দরজার উপর নতুন গজিয়ে ওঠা সবুজ ঘাসের গন্ধই কেবল পারে আমার নাক থেকে ওই রক্তের গন্ধ মুছে ফেলতে। ওই গন্ধ আমার মুখের মধ্যেও জ্বালা ধরায়। হাতি, জঙ্গলকে নিয়ে এস, তাকে ঢুকিয়ে দাও মানুষের গ্রামের মধ্যে।

ওঃ! হাতি বলল, বাঁশের খোঁচায় যে ক্ষতটা হয়েছিল সেটার জ্বালা কমল যখন দেখলাম জঙ্গলের গ্রাসে মানুষের গোটা গ্রামটা মুছে গেল। এখন আমি তোমার যন্ত্রণা বুঝতে পারছি। এখন থেকে তোমার লড়াই হবে আমার লড়াই। হ্যাঁ, জঙ্গলকে আমি টেনে আনব মানুষের গ্রামের মধ্যে।

হাতি তার তিন ছেলে নিয়ে নিঃশব্দে স্থানত্যাগ করল। মোগলি তখনও ক্রোধে এবং ঘৃণায় কাঁপছে; আর বাঘিরা তার দিকে তাকিয়ে আছে ভীত দৃষ্টিতে। বাঘিরা জানে, অবস্থা যদি তেমন খারাপ হয় তাহলে গ্রামের পথে তীরবেগে ছুটে গিয়ে জনতার মধ্যে ডাইনে-বাঁয়ে থাবা চালাতে হবে অথবা সন্ধ্যার সময়ে নিঃশব্দে শিকার করতে হবে মানুষ কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় একটা সম্পূর্ণ গ্রামকে নিঃশেষে মুছে ফেলার পরিকল্পনা তাকে শঙ্কিত করে তুলল…

হাতি আর তার তিন ছেলে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দুদিন ধরে হেঁটে ষাট মাইল দূরে থামল। তারপর তারা খেতে শুরু করল। একসপ্তাহ ধরে তারা ভোজন করল। ধীরে ধীরে। নিঃশব্দে। সবাই জানে, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে হাতিরা তাড়াহুড়ো করে না।

সপ্তাহটা শেষ হতে-না-হতেই- কেউ বলতে পারে না কেমন করে গুজবটা রটে গেল– জঙ্গলের তাবৎ প্রাণী জানল, একটা বিশেষ উপত্যকায় মানুষের বসতির কাছে খুব চমৎকার খাবার আর সুস্বাদু পানীয় জল পাওয়া যায়। শুয়োর ভালো খাদ্যের লোভে পৃথিবীর শেষ প্রান্তেও যেতে রাজি- সকলের আগে দল বেঁধে জায়গাটার উদ্দেশ্যে রওনা হল বুনো শুয়োরের দল। হরিণরা তাদের অনুসরণ করল। তারপর এল নীলগাই। নীলগাইদের পিছন পিছন এল জলাভূমির বন্য মহিষের দল।

পথ চলতে চলতে অনেক জানোয়ার নিরুৎসাহ হয়ে সরে পড়ল, কিন্তু অনেকেই এগিয়ে চলল সামনে। দিন দশেক পরেই দেখা গেল শুয়োর, হরিণ আর নীলগাইদের বিশাল দল প্রায় দশ মাইল জুড়ে বৃত্তাকারে এগিয়ে আসছে এবং তাদের তাড়া দিয়ে পিছনে ছুটছে মাংসভোজী শ্বাপদের দল। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটি গ্রাম আর গ্রামের নিকটবর্তী ফসলভরা ক্ষেত। ওই ফসলের ক্ষেত পাহারা দেওয়ার জন্য মাচা বেঁধে বসেছিল কয়েকজন লোক। তৃণভোজী পশুপাখিদের তাড়ানোর জন্যই পূর্বোক্ত ব্যবস্থা।

এক অন্ধকার রাতে হাতি আর তার তিন ছেলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে মাচাগুলোকে ভেঙে ফেলল। মাচায় যারা ক্ষেত পাহারা দিতে বসেছিল, তারা কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালাল। সঙ্গেসঙ্গে ক্ষেতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল হরিণের পাল। তারা যা খেতে পারল না, সেই ফসল গেল শুয়োরদের পেটে। গরু-মোষ চরানোর মাঠের উপর দিয়ে ছুটোছুটি করার ফলে শত শত জানোয়ারের খুরের আঘাতে নষ্ট হয়ে গেল মাঠের ঘাস। হরিণ আর শুয়োররা অবশ্য ইচ্ছা করে জমি নষ্ট করেনি, পিছন থেকে নেকড়ের দল তাড়া দেওয়ার ফলেই তারা ছুটতে বাধ্য হয়েছিল জমির উপর দিয়ে। বার্লির জমি আর চাষের ক্ষেত ধ্বংস হয়ে গেল অসংখ্য তৃণভোজর পদাঘাতে। ভোর হওয়ার আগেই তৃণভোজীদের বৃত্তে এক জায়গায় ভাঙন ধরল। মাংসভোজীরা একটু তফাতে সরে এসে দক্ষিণদিকে একটা পথ ছেড়ে দিল। সঙ্গেসঙ্গে সেই পথে ছুটতে ছুটতে অন্তর্ধান করল ভয়ার্ত তৃণভোজীর দল। কয়েকটি অত্যন্ত দুঃসাহসী পশু নিকটবর্তী ঝোপে লুকিয়ে রইল পরবর্তী রাত্রে আবার ফসলের ক্ষেত থেকে আহার্য সংগ্রহের জন্য।

সকালে উঠে গ্রামবাসী দেখল, তাদের ফসল শেষ করে গেছে তৃণভোজী বন্য পশুর দল। চটপট গ্রাম ছেড়ে সরে না গেলে খাদ্যাভাবে তাদের মৃত্যু অবধারিত। মোষগুলো যখন চারণভূমিতে পৌঁছাল, তারা দেখল, হরিণরা সব শেষ করে গেছে। ক্ষুধার্ত মোষের পাল খাদ্যের সন্ধানে মাঠ ছেড়ে বনে ঢুকল এবং ভিড়ে গেল বনচারী জাতভাইদের দলে। গ্রামে কয়েকটা ঘোড়া ছিল। আস্তাবলের মধ্যেই পড়েছিল তাদের মৃতদেহগুলি। প্রত্যেকটা ঘোড়ার মাথার খুলি চূর্ণ-বিচুর্ণ। একমাত্র বাঘিরাই পারে ওইভাবে মাথার খুলি চূর্ণ করতে।

গ্রামের বাসিন্দারা ঠিক করল, যে-শস্য জমিয়ে রাখা হয়েছে তা-ই খেয়ে তারা বর্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তারপর ভৃত্যের কাজ করে সারা বছরের ক্ষতি সামাল দিতে সচেষ্ট হবে। তারা যখন এইসব ভাবছে, সেই সময়ে হল হাতির আবির্ভাব। যে মাটির ঘরে শস্য মজুত করা ছিল, গজদন্তের একটি ধাক্কায় সেই ঘরের একটা কোণ গেল ভেঙে, পরক্ষণেই হাতির পায়ের তলায় চুর্ণ হয়ে গেল শস্যভরা বাঁশের মস্ত বাক্স।

তারপরও কিছুদিন টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল গ্রামের মানুষ। কিছু কিছু খাদ্য তখনও তাদের ঘরে ছিল। কিন্তু বনের পশুরা আবার তাদের উপর উপদ্রব শুরু করল। তারপর নামল বর্ষা। ভাঙাচোরা ঘরের ভিতর গ্রীষ্মের উত্তাপকে যখন শীতল করে নামল বর্ষার ধারাস্রোত, তখনই সেখানে জন্ম নিল সবুজ উদ্ভিদের চারা। অতি দ্রুত সেই সবুজ বন্যা ছেয়ে ফেলল ভাঙা ঘরগুলোকে। অবশেষে একদিন নিতান্ত নিরুপায় হয়েই গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে এল মানুষ- নারী, পুরুষ, বুড়ো, জোয়ান, শিশু কেউ বাদ রইল না, সকলেই যাত্রা করল নূতন আশ্রয়ের সন্ধানে।

বর্ষায় শেষেই জঙ্গল গ্রাস করে নিল মানুষের বসতি। ভাঙাচোরা দলা-পাকানো মাটির ঘরের চিহ্নটুকুও অবলুপ্ত করে দিল অরণ্যের বুভুক্ষু শ্যামলিমা।