ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৪. অভাবিত বিপর্যয়

৪. অভাবিত বিপর্যয়

কয়েকমুহূর্ত পরেই স্তব্ধ হয়ে গেল গর্জনধ্বনি। তবু শব্দের উৎস ধরে যথাস্থানে পৌঁছে গেল অশ্বারোহী সুবন্ধু অকস্মাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সুবন্ধুর অশ্ব তার কণ্ঠ থেকে নির্গত হল তীব্র আর্তস্বর! ঘোড়ার পিঠে বসে সুবন্ধু দেখল এক ভয়াবহ দৃশ্য-তার সামনেই মাটিতে পড়ে আছে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ দুটি দেহ-গ্রীকসৈনিক আজাক্স ও এক প্রকাণ্ড সিংহী! আজাক্সের সর্বাঙ্গ নখদন্তের প্রহারে ছিন্নভিন্ন এবং সিংহীর বক্ষবিদ্ধ করে অবস্থান করছে আজাক্সের তরবারি! শ্বাপদ ও দ্বিপদ দুজনেই স্থির, কারও দেহেই জীবনের লক্ষণ নেই। নিকটেই দুটি সিংহশাবক দাঁড়িয়ে মৃদু শব্দ করে ধরাশায়ী জননীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিল অশ্বারোহীর আবির্ভাবে তারা ভীত হয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করল।

সুবন্ধু বুঝল একটু পরেই মাংসলোলুপ শৃগাল, নেকড়ে আর গৃধিনীর দল এসে মৃতদেহ দুটিকে ছিন্নভিন্ন করে উদরপূরণ করবে। কথাটা ভাবতেই তার খারাপ লাগল-সম্মুখযুদ্ধে নিহত অরণ্যসম্রাজ্ঞী ও গ্রীক সৈনিকের মৃতদেহ শবভোজী পশুপক্ষীর আহার্য হবে একথা জেনে নিষ্ক্রিয় থাকা যায় না– অতএব, তরবারি দিয়ে মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ দুটিকে সে কবর দিল এবং কবরের উপর চিহ্নস্বরূপ বসিয়ে দিল আজাক্সের উন্মুক্ত তরবার। তারপর অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে সে স্থান ত্যাগ করল বিষণ্ণচিত্তে।

অস্তায়মান সূর্যের শেষ রশ্মি যখন আকাশের পট থেকে বিদায় নিতে চাইছে, পৃথিবীর বুকে যখন ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া– সেইসময় একটি সরাইখানার সামনে এসে দাঁড়াল এক পরিশ্রান্ত অশ্বারোহী। উক্ত অশ্বারোহী আমাদের পরিচিত-সুবন্ধু।

মুক্ত দ্বারপথে প্রাচীরবেষ্টিত প্রাঙ্গনের উপর পদার্পণ করতেই সুবন্ধুর কাছে ছুটে এল সরাইখানার এক ভৃত্য, মহাশয় কি এখানে খাদ্যগ্রহণ করেই চলে যাবেন? নাকি, এই পান্থশালায় রাত্রিযাপন করবেন?

সুবন্ধু ঘোড়া থেকে নেমে ভৃত্যকে বলল, আমি এইখানে রাত্রিযাপন করতে চাই। এই অশ্ব এবং আমার জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করো।

ভৃত্য এগিয়ে এসে অশ্বের বলগা ধারণ করল, আপনার বাহনকে আমি অশ্বশালায় নিয়ে যাচ্ছি। খাদ্য ও শয়নকক্ষের জন্য আপনি পান্থশালার মালিকের সঙ্গে কথা বলুন।

মালিক কোথায়?

–অনুগ্রহ করে ভিতরে প্রবেশ করুন। সেখানেই মালিকের সন্ধান পাবেন।

সুবন্ধু পান্থশালার ভিতর প্রবেশ করতে উদ্যত হল, কিন্তু সিঁড়ির প্রথম ধাপের উপর পা রাখার আগেই ভিতর থেকে এক ব্যক্তি সবেগে ছিটকে এসে পড়ল প্রাঙ্গনের উপর। লোকটি উঠানের উপর দিয়ে কিছুটা গড়িয়ে গিয়ে উঠে বসল, তারপর একবার উঠে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেই আবার বসে পড়ল– তার কণ্ঠ থেকে নির্গত হল অস্ফুট আর্তস্বর– উঃ!

যে-ভৃত্য সুবন্ধুর ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়েছিল, সে সবিস্ময়ে বলে উঠল, অহহা, শল্য! তুমি পায়ের ব্যবহার ছেড়ে দিয়ে শুন্য পথে যাতায়াত শুরু করেছ কবে থেকে?

প্রাঙ্গনে উপবিষ্ট ব্যক্তি যাতনাবিকৃত কণ্ঠে বলল, যাদব! আমায় বিদ্রূপ না করে শীঘ্র ভিতরে প্রবেশ করে পান্থশালার কর্মচারীদের সাহায্য করে। এক অনার্য রমণী আমাদের আক্রমণ করেছে। সেই বর্বর রমণীর পদাঘাতেই আমার এই দুর্দশা।

–বলো কী! তোমরা কয়েকজন বলিষ্ঠ পুরুষ মিলিত হয়েও একটিমাত্র রমণীকে পরাস্ত করতে পারছ না? ধিক!

শল্য নামক ব্যক্তি ক্রুদ্ধস্বরে বলল, আমাকে ধিক্কার দেওয়া যত সহজ, ওই অনার্য নারীর সম্মুখীন হওয়া তত সহজ নয়– বুঝেছ?

পান্থশালার ভিতর থেকে তখন ভেসে আসছে বহুকণ্ঠের কোলাহল! যাদব নামে যে ভূত্যটি সুবন্ধুর ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়েছিল সে সুবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলল, আর্য! আপনি অশ্বের বলগা ধারণ করুন। আমি একবার ভিতরে গিয়ে–

তাকে বাধা দিয়ে সুবন্ধু বলল, তোমার ভিতরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি ব্যাপারটা দেখছি।

–কিন্তু আর্য—

 যাদবের বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই সুবন্ধু তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল, কঠিন স্বরে বলল, যে অনার্য রমণী একাকী সরাইখানার ভৃত্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে, আমি তাকে দেখতে চাই। তোমাকে যা বলেছি তাই করো। এই মুহূর্তে আমার ঘোড়াকে অশ্বশালায় নিয়ে যাও। আদেশ অমান্য করলে বিপদ ঘটতে পারে।

যাদব বুদ্ধিমান ব্যক্তি। অস্ত্রধারী যোদ্ধার আদেশ অমান্য করলে যে প্রাণ পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে একথা বুঝতে তার কিছুমাত্র বিলম্ব হল না- ঘোড়ার লাগাম ধরে সে নিঃশব্দে প্রস্থান করল অশ্বশালার উদ্দেশ্যে।

ভিতর থেকে তখনও ভেসে আসছিল তুমুল কোলাহল ধ্বনি শব্দের উৎস লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতেই সুবন্ধুর চোখে পড়ল এক অভাবিত দৃশ্য! তিনটি বলিষ্ঠ পুরুষ এক অনার্য রমণীকে আক্রমণ করেছে। ভূমিতে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে আছে আরও দুই ব্যক্তি স্পষ্টই বোঝা যায় ওই রমণীর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে তারা ধরাশয্যা অবলম্বন করেছে। চোখের পলক ফেলার আগেই রমণী হাত চালাল আর্তনাদ করে একটি আততায়ী সরে এল তার নাগালের বাইরে। অপর দুইজন দাঁড়িয়ে ইতস্ততঃ করতে লাগল।

ঘরের মধ্যে একটি স্থূলকায় ব্যক্তি দাঁড়িয়েছিল নিরাপদ দূরত্বে সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নি। এইবার সে কর্কশকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল তোমরা সমবেত হয়েও এক সামান্য নারীকে এই পান্থশালা থেকে বহিষ্কার করতে পারছ না? ধিক!

আততায়ীদের মধ্যে এক ব্যক্তি কুণ্ঠিতস্বরে বলল, প্রভু! আপনি অযথা আমাদের প্রতি দোষারোপ করছেন। এই রমণী সামান্য নয়, ব্যাঘ্রীর ন্যায় ভয়ংকরী।

আমি কোনো কথা শুনতে চাই না, স্থূলকায় ব্যক্তি সগর্জনে বলল, যাও, আর যে যেখানে আছে, সবাইকে ডেকে আনো- এই দুর্বিনীতা রমণীকে পান্থশালার বাহির নিক্ষেপ করো।

ওহে ভৃত্যের দল, রমণীর কণ্ঠস্বরে বিদ্রুপের আভাস, মালিকের আদেশ পালন করার আগে একটা কথা শুনে যাও- এইবার যে আমার অঙ্গস্পর্শ করার চেষ্টা করবে, সে আর কাল প্রভাতের সূর্যোদয় দেখার সুযোগ পাবে না।

পরক্ষণেই রমণীর হাতে কোষমুক্ত তরবারি বিদ্যুৎশিখার মতো চমকে উঠল। যে তিনব্যক্তি রমণীকে ঘিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারা ক্ষিপ্রপদে সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে।

স্থূলকায় ব্যক্তি রমণীকে উদ্দেশ করে বলল, আমার পান্থশালার বিভিন্ন স্থানে বহু ভৃত্য বিভিন্ন কার্যে নিযুক্ত রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ। তুমি যদি এই মুহূর্তে স্থানত্যাগ না করো, তাহলে আমার আদেশে তারা সমবেতভাবে তোমাকে আক্রমণ করবে। অতএব তোমার উচিত–

আহাহা! উচিত-অনুচিত বিবেচনা সকলের সমান নয়, ঘরের দরজা থেকে ভেসে এল পুরুষের সকৌতুক কণ্ঠ, কিন্তু আরও কয়েকটি বীরপুরুষ যদি অস্ত্র হাতে নারীর অপমান করতে উদ্যত হয়, তাহলে আমার পক্ষে নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। আর সেরকম কিছু ঘটলে মহাশয়ের জীবনও বোধহয় বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

সকলে বিস্মিতনেত্রে দেখল দরজায় দাঁড়িয়ে আছে এক দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ পুরুষ, তার পিঠে ধনুর্বাণ এবং কটিদেশে তরবার। একনজর দেখলেই বোঝা যায় আগন্তুক যুদ্ধব্যবসায়ী পেশাদার যোদ্ধা-অস্ত্রের ব্যবহারে বিলক্ষণ পারদর্শী।

সর্বাগ্রে নিস্তবদ্ধতা ভঙ্গ করল অনার্য রমণী, কী আশ্চর্য! সুবন্ধু! তুমি এখানে!

আগন্তুক সহাস্যে বলল, আমাদের কথাবার্তা পরে হতে পারে। আগে সরাইরে মালিকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করি।

স্থূলকায় ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে আগন্তুক অর্থাৎ সুবন্ধু বলল, অনুমানে মনে হয় আপনি এই সরাইখানার মালিক।

-হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?

—আমি এই সরাইখানায় আশ্রয়প্রার্থী।

–আপনাকে আশ্রয় দেওয়া যায় কিনা সেটা আমার বিবেচ্য। আপনি তো দেখছি এই অনার্য রমণীর পরিচিত।

–আমি এই অনার্য রমণীর অনুগত সেবক। কিন্তু আপনার ভৃত্যরা দল বেঁধে এই রমণীকে আক্রমণ করেছিল কেন?

এই রমণীও আপনার মতোই এই সরাইখানায় আশ্রয় নিতে চায়। আমি ওকে স্থান দিতে রাজি হইনি। তবু এই রমণী পান্থশালা ত্যাগ করতে সম্মত হয় নি। তখন আমার আদেশে ভৃত্যরা এই রমণীকে বলপূর্বক বহিষ্কার করতে সচেষ্ট হয়েছিল। ফলে বিবাদের সূত্রপাত।

এটা তো পান্থশালা। অর্থের বিনিময়ে যে-কেউ আশ্রয় নিতে পারে।

–অভিভাবকহীন নিঃসঙ্গ নারীকে আমি আশ্রয় দিই না।

বর্তমানে আমাকেই এই নারীর অভিভাবক মনে করতে পারেন।

–করলাম। তবুও বাধা আছে।

–আবার কীসের বাধা?

–আমার পান্থশালায় অনার্যের প্রবেশ-অধিকার নেই।

 পামর! সুবন্ধু সক্রোধে গর্জন করে উঠল, গ্রীসের তরবারি যখন এই পুণ্যভূমিকে ছিন্নভিন্ন করছে, তখন তুমি আর্য ও অনার্যের জাতিভেদ নিয়ে মস্তিষ্ককে ঘমাক্ত করছ?

সরাইখানার মালিক ভীত হয়েছিল, কিন্তু সে উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল, আপনি হয়তো অনার্য রমণীর সেবা করতে কৃতার্থ হয়েছেন, তবে

স্তব্ধ হও, মালিক তার বাক্য সমাপ্ত করার আগেই বাধা দিয়ে সুবন্ধু ভীষণ স্বরে বলল, তোমার ন্যায় ব্যক্তি আর্যজাতির কলঙ্ক। এই অনার্য রমণীর পদধূলি তোমার পান্থশালাকে পবিত্র করেছে জানবে। ঘৃণ্য ব্যক্তির কাছে আমি এই রমণীর সঠিক পরিচয় দিতে রাজি নই। এই মুহূর্তে আমাদের দুজনের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করো, নচেৎ

নচেৎ কী হতে পারে মুখে প্রকাশ করল না বন্ধু, কিন্তু তার ডানহাতের আঙুলগুলি মষ্টিবদ্ধ হল তরবারির হাতলের উপর এবং মৃদু আকর্ষণে কোষবদ্ধ তরবারিতে জাগল ঝনৎকার ধ্বনি!

সেই ভয়াবহ ইঙ্গিত বুঝতে মালিকের দেরি হল না, সে শশব্যস্তে বলে উঠল, আমি এখনই আপনাদের রাত্রিবাসের উপযুক্ত ব্যবস্থা করছি। অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে আসুন।

একটি কক্ষে সুবন্ধ ও তার সঙ্গিণীকে নিয়ে প্রবেশ করল পান্থশালার মালিক, এই কক্ষে আপনারা রাত্রিবাস করতে পারেন। মূল্যস্বরূপ দশটি তাম্রমুদ্রা পেলে খুশি হব।

সুবন্ধু দেখল ঘরটি পরিচ্ছন্ন; ঘরের মধ্যে দুটি কাষ্ঠনির্মিত আধারের উপর সযত্নে বিস্তৃত দুটি শয্যা রয়েছে এবং একপাশে একটি সুদৃশ্য কাষ্ঠাধারের উপর রয়েছে জলপূর্ণ পাত্র ও ভৃঙ্গার। সন্তুষ্ট হয়ে সে মালিকের দিকে দৃষ্টিপাত করল, তোমার প্রাপ্য দিতে আমাদের আপত্তি নেই।

মালিকের প্রসারিত হস্তে এসে পড়ল একটি মুদ্রা। সেদিকে একনজর তকিয়েই চমকে উঠল মালিক, একী! এ যে স্বর্ণমুদ্রা!

হ্যাঁ, স্বর্ণমুদ্রা দিয়েই তোমাকে খুশি করার চেষ্টা করলাম। পরিবর্তে তুমিও আমাদের খুশি করবে বলে আশা করি। এখন আমার কথা শোনো- দ্বাররক্ষী আমার অশ্বকে অশ্বশালায় নিয়ে গেছে। ওই অশ্বের জন্য উপযুক্ত খাদ্য ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করবে। আমার অশ্ব দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ক্লান্ত হয়েছে, অতএব তার পরিচর্যায় যেন ত্রুটি না হয়, একটু থেমে সুবন্ধু অবার বলল, আমাদের জন্যও কিছু খাদ্যের ব্যবস্থা করে। অন্ধকার হয়ে আসছে। একটা আলোর প্রয়োজন অনুভব করছি।

–যথা আজ্ঞা। আমি এখনই আলো এবং খাদ্যের ব্যবস্থা করছি। মালিক প্রস্থান করল। রাজকুমারী ছায়া! সুবন্ধু বলল,

তোমাকে এই সরাইখানায় দেখব বলে আশা করি নি। তুমি আমায় চমকে দিয়েছে।

আমিও তোমাকে এখানে আশা করিনি।, ছায়া বলল, চরম সংকটের সময় অভাবিতভাবে আবার আমি তোমার সাহায্য পেলাম। তোমার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না।

ঋণের কথা বলে লজ্জা দিও না রাজকন্যা। হয়তো কেনোদিন আমিও তোমার সাহায্যপ্রার্থী হব।

তেমন দিন যদি আসে তাহলে দেখবে অনাৰ্যদুহিতা ছায়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কুণ্ঠিত নয়। কিন্তু তুমি হঠাৎ এখানে এসেছ কেন? তোমার সঙ্গী গ্রীকসৈনিক কোথায়? তুমি তো তার সঙ্গে গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারের শিবিরের দিকে যাত্রা করেছিলে

-হ্যাঁ কিন্তু পথিমধ্যে।

সুবন্ধুর বাক্য সমাপ্ত হল না, ঘরের মধ্যে প্রজ্বলিত দীপ হস্তে প্রবেশ করল সরাইখানার মালিক। তার সঙ্গে এসেছে এক ভৃত্য কিছু খাদ্য ও পানীয় বহন করে। নিকটস্থ কাষ্ঠাধারের উপর আহার্যের পাত্র ও পরিপূর্ণ ভৃঙার স্থাপন করে ভৃত্যটি প্রস্থান করল।

মালিক সবিনয়ে বলল, আয়োজন অতি সামান্য। দরিদ্রের কুঠিরে আপনাদের উপযুক্ত আপ্যায়ন করতে পারলাম না। আমার অক্ষমতা নিজগুণে মার্জনা করবেন।

মালিকের দিকে দৃষ্টিপাত করে রাজকন্যা ছায়া শ্লেষতিক্ত স্বরে বলল, তুমি যে প্রয়োজন হলে যথেষ্ট বিনয় প্রদর্শন করতে পারো তা দেখে সুখী হলাম। আমাদের আর কিছু প্রয়োজন হবে না। তুমি এখন বিদায় গ্রহণ করতে পারো।

অভিবাদন জানিয়ে মালিক অন্তর্ধান করতেই ছায়া সুবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলল, এবার বলো, পথিমধ্যে এমন কী ঘটল যার ফলে তুমি ও গ্রীকযোদ্ধা পরস্পরের সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে?

বলছি শোনো, সুবন্ধু বলতে শুরু করল, তোমাকে আগেই বলেছিলাম আজাক্স নামক ওই গ্রীকযোদ্ধার সঙ্গে আমি যাত্রা করেছিলাম মাসাগার গ্রীকশিবিরের দিকে উদ্দেশ্য, সম্রাট আলেকজান্ডারের সাক্ষাৎলাভ। বনের পথে হঠাৎ দুটি ক্রীড়ারত সিংহশাবকের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং আমার গ্রীকসঙ্গী শাবকদুটিকে ধরে সম্রাটকে উপহার দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। আমি তাকে নিষেধ করেছিলাম– কারণ, আমি জানতাম শাবকদের জননী নিকটেই অবস্থান করছে। আমার নিষেধে কর্ণপাত না করে গ্রীকযোদ্ধা শাবকদুটির পিছনে ছুটতে ছুটতে অরণ্যের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল। আজাক্সের অনুরোধে আমি ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। আচম্বিতে বনভূমি কম্পিত করে জাগল বজ্রপাতের ন্যায় ভয়ংকর গর্জনধ্বনি!

কী সর্বনাশ! ছায়া অস্ফুট স্তস্বরে বলে উঠল, গ্রীকসৈনিক নিশ্চয়ই সিংহীর আক্রমণে নিহত হয়েছে।

–তোমার অনুমান নির্ভুল। তবে সিংহীও পরিত্রাণ পায় নি। নখদন্তে জর্জরিত হয়ে প্রাণত্যাগ করেছিল আজাক্স, কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে অসির প্রচণ্ড অঘাতে সিংহীর বক্ষ বিদীর্ণ করে দিয়েছিল। শব্দ অনুসরণ করে অকুস্থলে পৌঁছে দেখলাম মৃত্যু আলিঙ্গনে বদ্ধ হয়ে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে এক প্রকাণ্ড সিংহী ও গ্রীকযোদ্ধা আজাক্স। সম্মুখ যুদ্ধে নিহত গ্রীকযোদ্ধা ও অরণ্যসম্রাজ্ঞীর দেহ। শবভোজী শৃগাল ও গৃধিণীর উদরস্থ হবে ভাবতেই অত্যন্ত বেদনাবোধ করলাম– অতএব। তরবারির সাহায্যে মৃত্তিকা খনন করে মৃতদেহ দুটিকে একই স্থানে কবরস্থ করলাম এবং অশ্বারোহণে অগ্রসর হলাম মাসাগার গ্রীকশিবিরের দিকে।

একটু থেমে ভৃঙার থেকে তৃষ্ণানিবারণ করল সুবন্ধু, তারপর আবার শুরু করল তার কাহিনি, গ্রীকশিবিরে গিয়ে সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু উদ্দেশ্যে সফল হল না। জনৈক সেনানায়ক জানাল সম্রাট ব্যস্ত আছেন, এখন দেখা হবে না। তখন স্থির করলাম সেনাপতি সেলুকসের সঙ্গে দেখা করে আজাক্সের শোচণীয় মৃত্যুর কথা জানাব এবং স্বয়ং সেনাপতির সঙ্গে গিয়ে সম্রাটের সাক্ষাৎলাভ করব। সেই উদ্দেশ্যেই ফিরে আসছিলাম, পথে এই সরাইখানায় তোমার সঙ্গে অভাবিত ভাবে দেখা হয়ে গেল। আমার কাহিনি তো শুনেছ, এবার তোমার কথা বল– রাজকুমারী! তুমি হঠাৎ এই পান্থশালায় অতিথি হলে কেন?

আমি গিয়েছিলাম কোদন্ডরাজ্যে। কোদন্ডরাজ্যের জ্যেষ্ঠপুত্র অম্বর, কনিষ্ঠ অহিদত্ত। আমার পরলোকগত পিতা জ্যেষ্ঠ রাজকুমার অম্বরের সঙ্গে আমার বিবাহ স্থির করে গিয়েছিলেন। কনিষ্ঠ অহিদত্তের সঙ্গেও আমার বিশেষ সখ্যতা ছিল। আমরা পূর্বপরিচিত-তিনজনই একসঙ্গে এক অস্ত্রশিক্ষকের কাছে একসময় অস্ত্রচালনার শিক্ষা গ্রহণ করেছি। অম্বর ও অহিদত্ত দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। আমি তাদের সাহায্যে পিতৃব্যের কবল থেকে হৃতরাজ্য উদ্ধার করতে উদ্যোগী হলাম। বিবাহের পূর্বে ভাৰী স্বামীর গৃহে গমন করতে কিছু সংকোচ বোধ করেছিলাম, কিন্তু সংকটকালে সংকোচ ত্যাগ করাই সমীচীন বিবেচনা করলাম। আশা ছিল সমস্ত ঘটনা শুনে কোদন্ডরাজও আমায় নিতান্ত নির্লজ্জা মনে করবেন না। না, তিনি আমায় নির্লজ্জা মনে করেন নি, সকল বৃত্তান্ত শুনে যথেষ্ট সহানুভূতি জানিয়েছিলেন, কিন্তু

—কিন্তু কী? দুই রাজপুত্র বুঝি তোমায় সাহায্য করতে সম্মত হয় নি?

সবন্ধু! তুমি তাদের জানো না। অম্বর ও অহিদত্ত আমার জন্য প্রাণবিপন্ন করতেও কুণ্ঠিত হত না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাকে সাহায্য করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি?

সুবন্ধু সবিস্ময়ে বলল, দুই ভাই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা; দুজনেই তোমায় ভালোবাসে, অথচ তোমাকে সাহায্য করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না রাজকুমারী।

-কোদরাজ্যের মুখে শুনলাম দুই ভাই মৃগয়ায় গিয়ে একদল দুস্য কর্তৃক আক্রান্ত হয়। দুই রাজপুত্রের পরাক্রমে কয়েকজন দস্যু হতাহত হওয়ার পর তারা ভীত হয়ে পলায়ন করে। কিন্তু দুস্যদের অস্ত্রাঘাতে দুজনই মারাত্মক ভাবে আহত হয় অতিকষ্টে তারা রাজপ্রাসাদে ফিরে এসে শয্যাগ্রহণ করে। কয়েকদিনের মধ্যেই জ্যেষ্ঠ রাজকুমার অম্বর মৃত্যুবরণ করল। কনিষ্ঠ অহিদত্ত এখনও শয্যাশায়ী, তার অস্ত্রধারণের ক্ষমতা নেই। এই দুঃসংবাদ আমার হৃদয় চূর্ণ করে দিল। কোনোমতে শোক সংবরণ করে আমি ফিরে আসছিলাম– পথিমধ্যে এই সারাইখানায় কিয়ৎকাল বিশ্রাম গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম ফলে এই বিপত্তি।

রাজকুমারী! একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না। অম্বর এবং অহিদত্তকে নিহত ও আহত দেখে তুমি ফিরে এলে কেন? কোদন্ডরাজ তোমায় নিশ্চয়ই সাহায্য করতে পারেন- তুমি তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে না কেন?…

কোদন্ডরাজ্যের কিছু করার নেই। তুমি বোধহয় ভাবছো অম্বর ও অহিদত্ত কোদন্ডরাজ্যের সেনাবাহিনী নিয়ে আমার পিতৃব্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে কিন্তু তা নয়। শুধুমাত্র তাদের বাহুবল ছিল আমার একমাত্র ভরসা।

রাজকন্যা ছায়া! তোমার আশা নিতান্তই দুরাশা। দুটি মাত্র মানুষ মহাবীর হলেও সেনাবাহিনীর সাহায্য ছাড়া একটি রাজ্য জয় করতে পারে না।

–পারে। তাহলে মন দিয়ে শোনো। বাহিক রাজ্যের আইন অনুসারে রাজবংশের যে কোনো ব্যক্তি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রাজাকে ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাত্রে যুদ্ধে আহ্বান জানাতে পারে। রাজ্যের আইন উভয়পক্ষকেই দুজন সহকারী যোদ্ধার সাহায্য গ্রহণের অনুমতি দেয়। তবে এক শর্ত সাহায্যকারীদের দেহে রাজরক্ত থাকা চাই। আমার পিতৃব্যের গৃহে শরভ ও কর্বুর নামে রাজবংশের দুই দুধর্য যোদ্ধা বাস করে। পিতৃব্য নিজেও অতিশয় দক্ষ যোদ্ধা। শরভ, কর্বুর ও পিতৃব্যের মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যুদ্ধজয় করতে পারে, এমন তিনটি মাত্র রাজবংশের মানুষ আমার পরিচিত। দুই রাজপুত্রের নাম আগেই উল্লেখ করেছি– আর একজন হচ্ছে বাত্নিক রাজ্যের রাজকন্যা ছায়া অর্থাৎ আমি। কিন্তু এখন আর এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। আমি সিংহাসনের আশা ত্যাগ করেছি। ভাগ্য আমার প্রতি প্রসন্ন নয়।

রাজকুমারী! ভাগ্য তোমার প্রতি প্রসন্ন কি অপ্রসন্ন তা এখনই বলা চলে না। হয়তো ভাগ্যবিধাতা তোমার শৌর্য ও সাহস পরীক্ষা করতে চান।

–কেমন করে? তুমি কি বলতে চাও আমি এককভাবে তিনটি দুর্ধর্ষ যোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শক্তি ও সাহসের পরীক্ষা দেব?… না, সুবন্ধু! জয়-পরাজয় যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে প্রাণবিপন্ন করতে আমি ভয় পাই না। কিন্তু পরাজয় যেখানে সুনিশ্চিত, সেখানে বৃথা বীরত্ব-প্রকাশ আত্মহত্যারই নামান্তর।

–তোমাকে আমি কখনোই আত্মহত্যার প্ররোচনা দেব না। আমি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে রাজি আছি। পরাজয় এবং মৃত্যু যদি অনিবার্য পরিণাম বলে মনে করতাম, তাহলে নিশ্চয়ই এমন প্রস্তাব করতাম না। রাজকুমারী! আসিচালনায় তোমার অপূর্ব কৌশল আমি স্বচক্ষে দেখেছি, নিজের শক্তিসামর্থ্যের উপর আমার পূর্ণবিশ্বাস আছে। আমি মনে করি মিলিতভাবে যুদ্ধ করলে আমাদের পক্ষে তিনটি যোদ্ধাকে পরাস্ত করা অসম্ভব নয়।

পিতৃব্য, শরভ ও কর্বুর রণনিপুণ সাহসী যোদ্ধা। তাদের বিরুদ্ধে দুটি মানুষের জয়লাভ করার সম্ভবনা খুবই কম। তবে সুবন্ধু, তোমার কথা স্বতন্ত্র যে ব্যক্তি ছুরিকার সাহায্যে ব্যাকে হত্যা করতে পারে, সে অসাধারণ মানুষ। তুমি পাশে থাকলে তরবারির ফলকে ভাগ্যপরীক্ষা করতে আমার আপত্তি নেই। এই অসম যুদ্ধে যদি জয়লাভ করতে পারি তাহলে তোমাকে প্রচুর ধনরত্ন দেব। কিন্তু

রাজকুমারী হঠাৎ স্তব্ধ হল। তার ললাটে জাগল চিন্তার কুটিল রেখা।

সুবন্দু সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, কিন্তু বলে থামলে কেন রাজকন্যা? তোমায় বেশ হাসিখুশি দেখছিলাম, হঠাৎ যেন এক দুশ্চিন্তার মেঘ তোমায় গ্রাস করে ফেলল!

-হ্যাঁ, সুবন্ধু। তোমার বলবীর্যের প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস না থাকলে ভাগ্যের বিরুদ্ধে প্রাণ নিয়ে জুয়া খেলতে রাজি হতাম না। কিন্তু এই যুদ্ধের একটি শর্ত আছে যোদ্ধাদের দেহে রাজরক্ত থাকা চাই। তোমার–

বাধা দিয়ে সুবন্ধু বলল, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হলে যোদ্ধাদের রাজরক্তের অধিকারী হতে হবে একথা তুমি আগেই বলেছ। রাজকন্যা, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো আমার শরীরে রাজরক্ত প্রবাহিত। যথাসময়ে এবং যথাস্থানে আমি প্রমাণ উপস্থিত করব।

ছায়ার ললাট থেকে দুশ্চিন্তার রেখা মিলিয়ে গেল, ওষ্ঠাধরে ফুটল হাসির রেখা, এই অসম যুদ্ধে যদি জয়ী হতে পারি, তাহলে তোমাকে আমি প্রচুর ধনরত্ন দিয়ে পুরস্কৃত করব।

সুবন্ধু হাসল, তোমার কাছে আমি ধনরত্নের প্রত্যাশী নই। রাজকুমারী! তোমার বন্ধুত্বই আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। কিন্তু আর নয়, এইবার শয্যাগ্রহণের সময় হয়েছে– আমি দীপ নির্বাপিত করছি।

..সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আস্তাবলে উপস্থিত হল সুবন্ধু ও ছায়া। প্রভুকে দেখে অস্ফুট নাসিকাধ্বনিতে অভ্যর্থনা জানাল অঞ্জন। অদূরে অবস্থিত বংশদন্ড থেকে জিন ও রেকাব নিয়ে অশ্বের অঙ্গসজ্জা সম্পূর্ণ করল সুবন্ধু, তারপর বলগা ধারণ করে তাকে নিয়ে এল আস্তাবলের বাইরে। সঙ্গিণীর দিকে দৃষ্টিপাত করে সুবন্ধু বলল, রাজকুমারী! তুমি অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করো। আমি তোমার পিছনে আসন গ্রহণ করে অশ্বকে চালনা করব।

মৃদু হেসে অনায়াস ভঙ্গিতে অশ্বপৃষ্টে আরোহণ করল ছায়া। কিন্তু সুবন্ধু ঘোড়ার পিঠে ওঠার সুযোগ পেল না, একটি বলিষ্ঠ হাত পিছন থেকে এগিয়ে এসে অশ্বের বলগা চেপে ধরল সজোরে!

সচমকে পিছন ফিরে সুবন্ধু দেখল এক দীর্ঘকায় পুরুষ তার ঘোড়ার লাগাম চেপে ধরেছে! আগন্তুক আর্যাবর্তের অধিবাসী নয় তার পোশাক পারস্যদেশীয় বণিকের মতো। আগন্তুকের বেশভূষা বণিকের মতো হলেও তার কটিবন্ধে আবদ্ধ তরবার এবং দেহের গঠন দেখলেই বোঝা যায় মানুষটি পেশায় বাণিজ্যজীবী হলেও অস্ত্রচালনায় সে নিতান্ত অনভ্যস্ত নয়।

ক্রুদ্ধ ও বিস্মিত সুবন্ধু উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, কে তুমি? আমার ঘোড়ার লাগাম ধরেছ। কেন?

অপরিচিত পুরুষ বলল, তোমার সঙ্গে আমার কথা বলার প্রয়োজন আছে।

আমার সময় নেই, তিক্তস্বরে সুবন্ধু বলল, তুমি আমার অপরিচিত, আমার সঙ্গে তোমার কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে না। লাগাম ছাড়ো, আমায় যেতে দাও।

–আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তুমি কোথাও যেতে পারবে না। অবশ্য তোমার সঙ্গিনী ইচ্ছা করলে স্থানত্যাগ করতে পারে, তার সঙ্গে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।

একলম্ফে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ভূমিতে অবতীর্ণ হল ছায়া, আগন্তুক! এই ব্যক্তির সাহচর্য আমার প্রয়োজন। এই মুহূর্তে তুমি স্থান ত্যাগ করো, নচেৎ–

বাক্য অসমাপ্ত রেখে ছায়া তার দক্ষিণ হস্ত তরবারির হাতলে স্থাপন করল।

আগন্তুকের ওষ্ঠাধরে ফুটল ব্যঙ্গের হাসি, সুন্দরী! আমি সরাইখানার ভৃত্য নই। নারীর দেহে আঘাত করতে চাইনা, কিন্তু ধৃষ্টতা প্রকাশ করলে আমি তোমাদের শাস্তি দিতে বাধ্য হব।

ছায়া সক্রোধে তরবারি আকর্ষণ করল, কিন্তু অস্ত্র কোষমুক্ত হওয়ার আগেই তার হাত চেপে ধরল সুবন্ধু, ক্ষান্ত হও। এই ব্যক্তির কথায় স্পষ্টই বুঝতে পারছি সরাইখানার ভৃত্যদের সঙ্গে আমাদের কলহের পরিণাম সে স্বচক্ষে দর্শন করেছে- তবু যখন সে একাকী আমাদের পথরোধ করে দাঁড়াতে সাহসী হয়েছে, তখন বুঝতে হবে বণিকের পোশাকধারী এই মানুষটি নিতান্তই নিরীহ বাণিজ্যজীবী নয়, প্রয়োজন হলে কটিবন্ধের তরবারি ব্যবহার করতে সে কুণ্ঠিত হবে না। অনর্থক রক্তপাতে আমার রুচি নেই, তার চাইতে ওর দাবি মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আগন্তুক! তুমি বিদেশি পারসীক, আমার অপরিচিত- আমার কাছে তোমার কি প্রয়োজন?

আগন্তুক হাসল, আমি পারস্যদেশের বণিক, নাম আর্সাসেস। আমি সংবাদ পেয়েছি আজাক্স নামক এক গ্রীকসৈনিক এক ভারতীয় যোদ্ধার সঙ্গে মাসাগার গ্রীকশিবিরের দিকে যাত্রা করে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। অনুমানে মনে হয় তুমিই সেই ভারতীয় যোদ্ধা। তাই তোমার কাছেই আমি আজাক্সের সন্ধান জানতে চাই।

ভ্রূকুঞ্চিত করে সুবন্ধু বলল, আমি যে সেই ভারতীয় যোদ্ধা তার প্রমাণ কি? এমন কথা তোমার মনে হল কেন?…

-সেনাপতি সেলুকসের কাছে সেই ভারতীয় যোদ্ধার দৈহিক আকৃতির যে বিবরণ পেয়েছি, তোমার সঙ্গে তার সাদৃশ্য আছে। উক্ত যোদ্ধার দেহে ও ললাটে রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্নের কথা শুনেছি; তোমার শরীর ও ললাট অনেকগুলি ক্ষতচিহ্ন বহন করছে। তোমার বাহনটির দেহবর্ম রক্তাভ পিঙ্গল, কপালে শ্বেততিলক। আজাক্সের সঙ্গী ভারতীয় সৈনিকটির সঙ্গে যে অশ্ব ছিল, তার বর্ণনার সঙ্গে তোমার বাহনের এতটুকু অমিল নেই। অতএব অনুমান করছি আজাক্স তোমার সঙ্গেই ছিল। যুবক! তুমি কি বলতে চাও আমার অনুমান ভুল?

-না হে আর্সাসেস! তোমার অনুমান ভুল নয়। কিন্তু পারস্যদেশীয় এক বণিক হঠাৎ এক গ্রীকসৈনিক সম্বন্ধে কেন কৌতূহলী হয়ে উঠল সেইটাই আমার প্রশ্ন।

-সম্রাট আলেকজান্ডার আমায় স্নেহ করেন। পেশায় বাণিজ্যজীবী হলেও অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য আমায় সংগ্রহ করতে হয়।

বুঝেছি। তুমি সম্রাটের বেতনভোগী গুপ্তচর।

-তুমি যা খুশি তাই মনে করতে পারে। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। এখন বলো আজাক্স কোথায়?

-বনমধ্যে এক সিংহীর আক্রমণে তার মৃত্যু হয়েছে।

–তবে গ্রীকশিবিরে সেই সংবাদ পৌঁছে দাও নি কেন?

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জড়িত হয়ে আমার সঙ্গিনীর সঙ্গে আমি স্থানত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছি। কাজ শেষ করে আজাক্সের মৃত্যুসংবাদ গ্রীকশিবিরে নিশ্চয়ই পৌঁছে দেব।

–আজাক্সের মৃত্যুসংবাদ গ্রীকশিবিরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমি গ্রহণ করছি। কিন্তু তার আগে তোমার সঙ্গে অকুস্থলে গিয়ে আমি স্বচক্ষে আজাক্সের মৃতদেহ দেখতে চাই।

–অর্থাৎ আমাকে তুমি বিশ্বাস করছ না?…

 অবশ্যই তোমাকে আমি বিশ্বাস করছি। তবে অধিকতর বিশ্বাস রাখি আমার নিজস্ব দৃষ্টিশক্তির উপর।

-তাহলে—

-তাহলে আমার সঙ্গে তোমাকে অকুস্থলে যেতে হবে। আমি নিজের চোখে গ্রীকসৈনিক আজাক্সের মৃতদেহ দেখতে চাই।

সর্বনাশ! আমাদের বিলম্ব হয়ে যাবে।

বণিকের ওষ্ঠাধরে ফুটল বিদ্রুপের হাসি, রাজকার্যে বিলম্ব হলে এমন কি ক্ষতি হবে?

গম্ভীর স্বরে সুবন্ধু বলল, বিদেশি! তুমি বিদ্রুপের ছলে চরম সত্যকে প্রকাশ করেছ। যথাস্থানে পৌঁছাতে বিলম্ব হলে সর্বনাশ হতে পারে।

বণিক কিছু বলার আগেই সামনে এগিয়ে এল ছায়া, বণিক আর্সাসেস! আমার একটি অনুরোধ রাখবে?

বিনীত ভঙ্গিতে অভিবাদন জানিয়ে পারসীক বণিক বলল যদি নিতান্ত অসম্ভব না হয় তাহলে অবশ্যই তোমার অনুরোধ রাখব। রমণীর অনুরোধ বিশেষ করে সুন্দরী রমণীর অনুরোধ রক্ষা করা পুরুষের কর্তব্য। বলল, কী তোমার অনুরোধ?

মুহূর্তের জন্য ছায়ার চোখেমুখে ফুটল লজ্জার আভাস, পরক্ষণেই সংকোচ দমন করে সে সহজ হল, কাল প্রভাতে তুমি বাহিক রাজ্যে এস। আমি ও আমার সঙ্গী যদি তখনও জীবিত থাকি, তবে অবশ্যই তোমাকে নিহত গ্রীকযোদ্ধার মৃত দেহের সম্মুখে নিয়ে যাব। উপরন্তু প্রচুর ধনরত্ন তোমায় আমি উপহার দেব। অনার্যজাতি সচরাচর মিথ্যা বলে না, আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো।

ছায়ার আপাদমস্তক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করল বণিক, সুন্দরী! কিছু মনে কোরো না তোমায় দেখে প্রচুর ধনরত্নের অধিকারী বলে মনে হচ্ছে না।

বণিকের চোখে চোখ রাখল ছায়া, এখন আমি কপর্দকশূন্য, কিন্তু কল্য প্রভাতে যদি আমি জীবিত থাকি, তাহলে প্রচুর ধনরত্ন আমার হস্তগত হবে … পারসীক! নীরব কেন? বলো, আমার প্রস্তাবে তুমি সম্মত?

বণিক মতপ্রকাশ করার আগেই সুবন্ধু বলে উঠল ওহে পারসীক! এই অনার্য রমণী বাহিক রাজ্যের রাজকন্যা। যদি কাল প্রভাতে এই রাজকন্যা জীবিত থাকে তবে অবশ্যই সে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবে।

ভ্রূকুঞ্চিত করে বণিক আর্সাসেস বলল, তোমাদের কথায় রহস্যের আভাস পাচ্ছি। কিন্তু আজাক্সের মৃতদেহ আমি নিজের চোখে দেখতে চাই। মৃতদেহে অস্ত্রঘাতের পরিবর্তে নখদন্তের ক্ষতচিহ্ন দেখলে আমি যুবকের সততা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হব এবং আমার মুখ থেকে সমগ্র ঘটনার বিবরণ শুনে সম্রাট আলেকজান্ডার যে সবিশেষ প্রীত হয়ে এই যুবককে পুরস্কৃত করবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। হে আর্যযোদ্ধা– চলার পথে তুমি যদি রহস্যের আবরণ উন্মুক্ত করো, অর্থাৎ রাজকন্যার জীবন কেন বিপন্ন হচ্ছে এবং গ্রীকশিবিরে সম্রাটের সাক্ষাৎপ্রার্থী এক আর্যযোদ্ধা অকস্মাৎ তার সঙ্কল্প পরিবর্তন করে কেন বিপন্না রাজনন্দিনীর সাহচর্য গ্রহণ করতে চাইছে সেই সব কথা যদি খুলে বলো, তাহলে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত হয় আর সময়টাও কেটে যায় বেশ ভালোভাবে।

যখন নিতান্তই ছাড়বে না, তখন চলল। শুধু আজাক্সের মৃতদেহ নয়, তরবারির আঘাতে নিহত সিংহীর মৃতদেহও তুমি দেখতে পাবে। কিন্তু এই বিলম্বের জন্য যে ক্ষতি হবে, তা অপূরণীয়।

–লাভক্ষতির কথা এত শীঘ্র বিবেচনা করা যায় না। হে আর্যযোদ্ধা! এখন অগ্রবর্তী হও এবং কাহিনি শুরু করো।

যথা আজ্ঞা, অশ্বের বলগা ধরে অগ্রসর হল সুবন্ধু, তবে শোনো বণিক…

দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার সময় সুবন্ধু নিজের সম্বন্ধে এবং রাজকন্যার ছায়ার সম্পর্কে যা বলেছিল সেইসব কথা বণিক আর্সাসেরের জানা না থাকলেও আমাদের জানা আছে– অতএব পুনরুক্তি অনাবশ্যক। সব কিছু শুনে কোনো মন্তব্য করল না বণিক, কেবল তার দুই চক্ষুর দৃষ্টি এক গোপন উত্তেজনায় প্রখর হয়ে উঠল। অশ্বের বপ্পা ধরে পথ চলছিল সুবন্ধু তার পাশাপাশি হেঁটে চলছিল বণিক এবং অশ্বের অপর পার্শ্বে কঠিন বন্ধুর পথে পুরুষ সঙ্গীদের সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে এগিয়ে চলেছিল রাজকুমারী ছায়া। সুবন্ধু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তার সঙ্গিনীর চরিত্র বুঝে নিয়েছিল, তাই ছায়াকে সে অঞ্জনের পৃষ্ঠে আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করে নি। বণিক আর্সাসেস নারীর প্রতি সৌজন্য জানিয়ে রাজকুমারীকে অশ্বারোহণে অগ্রসর হতে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু গর্বিত গ্রীবাভঙ্গিতে বণিকের প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়ে ছায়া পথ চলতে লাগল দৃঢ় পদক্ষেপে। বণিক দ্বিতীয়বার অনুরোধ করে নি- কেবল তার অধর-ওষ্ঠের বঙ্কিম রেখায় বিদ্রূপ-তিক্ত হাসির পরিবর্তে ফুঠে উঠল প্রশংসার অভিনন্দন। রাজকুমারী একবারও বণিকের দিকে দৃষ্টিপাত করে নি, তাই এই পরিবর্তন তার চোখে ধরা পড়ল না। কিন্তু বণিক আর্সাসেসের মানসিক পরিবর্তনের আভাস সুবন্ধুর নজর এড়িয়ে যায় নি। আপন মনেই একবার হাসল সুবন্ধু, তারপর অশ্বের বলগা ধরে এগিয়ে চলল নীরবে…