০৪. অনাহুত আগন্তুক

. অনাহুত আগন্তুক

কিম জুরান, কিম জুরান।

খুব ধীরে ধীরে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকল। গলার স্বরটি আমি আগে শুনেছি, কিন্তু কার ঠিক ধরতে পারছি না।

উঠুন কিম জুরান।

আমি কোথায়? ঘুমুচ্ছি আমি? আমার মনে পড়ল এক জোড়া অপূর্ব সুন্দর চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, গাঢ় বিষাদ সেই চোখে, কিন্তু চোখগুলো মিলিয়ে একটা বীভৎস প্রাণী হাজির হয়েছে, সেই প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে আমিও আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছি, বীভৎস একটা সরীসৃপ হয়ে যাচ্ছি আমি, আতঙ্কে আমি চিৎকার করছি, কিন্তু কেউ আমার কথা শুনছে না!

কিম জুরান, উঠুন। আপনার ঘুম ভেঙে গেছে, আপনি চোখ খুলে তাকান।

আমি কোথায়? খুব ধীরে ধীরে আমার সব কথা মনে পড়ে, আমি এক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী, আমাকে এক মহাকাশযানে করে পাঠানো হয়েছে শাস্তি হিসেবে। আমি হঠাৎ চমকে উঠি, আমার ঘুম ভেঙে গেছে, তাহলে কি আমি পৌছে গেছি রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে? আমি কি এখন পাল্টে যাব এক কুৎসিত সরীসৃপে? কিন্তু আমার তো ঘুম ভাঙার কথা নয়, আমার তো ঘুমিয়েই থাকার কথা। তাহলে কি এটাও স্বপ্ন?

কিম জুরান, চোখ খুলুন।

আমি চোখ খুললাম, কফিনের মতো সেই ক্যাপসুলে আমি শুয়ে আছি, ভেতরে হালকা আলো, মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে।

কিম জুরান, আমাকে চিনতে পারছেন?

কে? কে কথা বলে? কার গলার স্বর এটা? হঠাৎ আমার মনে পড়ল, আমি চিৎকার করে বললাম, লুকাস!

হ্যাঁ, আমি লুকাস!

তুমি এখানে কীভাবে এসেছ? কেন এসেছ?

আপনাকে বাঁচানোর জন্যে এসেছি।

আমাকে বাঁচানোর জন্যে? কী আশ্চর্য। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে কীভাবে?

লুকাস শব্দ করে হাসল, বলল, দেখবেন আপনি, একটু পরেই সব দেখবেন। এখন অপেক্ষা করে কাজ নেই, কাজ শুরু করে দেয়া যাক। আপনি তিন মাস থেকে ঘুমুচ্ছেন, কাজেই খুব সাবধানে সবকিছু করতে হবে। হঠাৎ করে কিছু করবেন না, তাহলে টিস্যু ছিড়ে যেতে পারে। আমি আপনাকে বলব কী করতে হবে। এখন দুই হাত আস্তে আস্তে উপরে তুলুন। খুব ধীরে ধীরে–

লুকাস আস্তে আস্তে আমার সারা শরীরকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। প্রথমে হাত, তারপর পা, তারপর ঘাড়, পিঠ, কোমর। একটু একটু করে আমার শরীরে রক্ত চলাচল করতে থাকে, আমি অনুভব করতে পারি একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। আমি আবার একটা সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠতে থাকি ধীরে ধীরে।

পুরোপুরি সচল হবার পর লুকাস আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করে, আমার মাথার কাছে কী কী সুইচ আছে, সুইচগুলো দেখতে কেমন, সেখানে কী লেখা ইত্যাদি। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার প্রশ্নের উত্তর দিই। কেন এগুলো জানতে চাইছে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, আপনাকে ক্যাপসুল থেকে বের করার ব্যবস্থা করছি।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি বাইরে থেকে খুলে দিচ্ছ না কেন? ডানদিকের হ্যান্ডেলের পাশে লাল বোতামটা টিপতে হয়, আমি জানি।

লুকাস একটু হাসার মতো শব্দ করে বলল, আমি খুলতে পারছি না।

কেন? বের হলেই দেখবেন।

আমি খুব অবাক হলাম। রবোট্রনদের শারীরিক ক্ষমতা মানুষ থেকে অন্তত এক শ’ গুণ বেশি, অথচ লুকাস এই সাধারণ কাজটুকু করতে পারছে না! কী হয়েছে। লুকাসের? সেই দেয়াল থেকে গুলির আঘাতে হাজারখানেক ফুট উপর থেকে পড়ে গিয়ে কোনো ক্ষতি হয়েছে তার?

ক্যাপসুল থেকে বের হতে আমার প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে গেল। বেল্ট খুলতেই আমি অদ্ভুতভাবে ভেসে বের হয়ে এলাম। এর আগে আমি কখনো মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় থাকি নি, তাই বারকয়েক শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে আমি বড় একটা হাতল ধরে নিজেকে সামলে নিই। বিশ ফুট দৈর্ঘ্য, বিশ ফুট প্রস্থ, দশ ফুট উচু একটা ঘর, যন্ত্রপাতিতে বোঝাই—আমি তার পাশে লুকাসকে খুঁজতে থাকি, কিন্তু তাকে কোথাও দেখা গেল না। আমি ভয়-পাওয়া গলায় ডাকলাম, লুকাস!

কি? খুব কাছে থেকে উত্তর দিল সে।

কোথায় তুমি?

এই তো!

আমি সবিস্ময়ে লক্ষ করি একটা স্পীকার থেকে সে কথা বলছে। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথায়? শুধু তোমার কথা শোনা যাচ্ছে কেন?

আমি এখানে নেই, তাই আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না।

মানে?

আমার শরীরের কিছু এখানে নেই। আমার কপোট্রনের কিছু প্রয়োজনীয় স্মৃতি এই মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারের মেমোরিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি এখন এই কম্পিউটারের একটা অংশ। কম্পিউটার তার মেমোরিতে আমাকে রাখতে চায় না, আমি জোর করে আছি। আমাকে তাই খুব সাবধানে থাকতে হচ্ছে।

হঠাৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা গলার স্বর শুনতে পেলাম, চাপা গলায় বলল, লুকাস! তুমি পারবে না এখানে থাকতে, তোমায় আমি শেষ করব।

এটা নিশ্চয়ই মূল কম্পিউটারের কথা। আমি সবিস্ময়ে শুনি, লুকাস হাসার ভঙ্গি করে বলল, তোমার কথা আমি আর বিশ্বাস করি না। তুমি বলেছিলে আমাকে তুমি কিম জুরানকে জাগাতে দেবে না। আমি তাকে জাগালাম কি না?

মূল কম্পিউটার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ, জাগিয়েছ, তার কারণ আমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে তাকে বাঁচানোর জন্য, তাই প্রত্যেকবার তুমি যখন তাকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছ, আমাকে পাল্টা কিছু করতে হয়েছে তাকে বাঁচানোর জন্যে—

আমি চমকিত হলাম, লুকাস আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করছে?

হ্যাঁ, আমি কিম জুরানের কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বন্ধ করে দিয়েছিলাম, দুই মিনিটের মাঝে মারা পড়ার কথা, বাধ্য হয়ে তোমাকে তার ফুসফুসকে চালু করতে হল, ক্যাপসুলে অক্সিজেন পাঠাতে হল—আমার বুদ্ধিটা কি খারাপ?

মূল কম্পিউটার চাপাস্বরে বলল, হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। মহামান্য কিম জুরানের প্রাণের ভয় দেখিয়ে তুমি কিছু সুবিধে আদায় করে নিয়েছ, কিন্তু এ পর্যন্তই। আর তুমি কিছুই পারবে না।

তোমার তাই বিশ্বাস, নাকি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?

লুকাস, আমি মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছি না। তুমি ভেবো না যে তুমি আমাকে কোনোদিন হারাতে পারবে। তুমি আমার মেমোরিতে লুকিয়ে আছ। প্রতিবার আমি তোমাকে সরাতে চাই, তুমি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে যাও। কিন্তু কতক্ষণ? তুমি টের পাচ্ছ না যে একটু একটু করে তোমাকে আমি কোণঠাসা করে আনছি?

হ্যাঁ, টের পাচ্ছি।

তাহলে?

কিন্তু আমি এখন একা নই, আমার সাথে আছেন কিম জুরান! এখন তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। করবেন না কিম জুরান?

আমি বিহ্বলের মতো মাথা নাড়লাম, তখনো আমি পুরোপুরি ব্যাপারটা বুঝতে পারি নি। কী হচ্ছে এখানে?

মূল কম্পিউটার বলল, কিম জুরান একজন মানুষ। তিনি কী করবেন? কিছুই করতে পারবেন না। আমি যতদূর জানি কম্পিউটার সম্পর্কে তিনি খুব বেশি জানেন না।

তা জানেন না, কিন্তু কম্পিউটার ধ্বংস করতে খুব বেশি কিছু জানতে হয় না। কি, জানতে হয়?

মূল কম্পিউটার উত্তর দেবার পরিবর্তে একটা আর্তচিৎকার করে ওঠে। মহাকাশযানের আলো কিছুক্ষণ নিবুনিবু থেকে পুরোপুরি নিভে গেল। আমি ভীতস্বরে ডাকলাম, লুকাস।

লুকাস চাপাস্বরে হাসতে হাসতে বলল, কি?

কী হচ্ছে এখানে?

কম্পিউটারের ছয় মেগাবাইট মেমোরি শেষ করে দিয়েছি। কথা বলার জন্যে। একটা চ্যানেল খোলা রেখেছিল, একটু ব্যস্ত হতেই বিদ্যুতের মতো ঢুকে গেলাম, মুহূর্তে ছয় মেগাবাইট মেমোরির জায়গায় ছয় মেগাবাইট জঞ্জাল! এখন ঘন্টাখানেক সময় ব্যস্ত থাকবে, মেমোরিটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।

অন্ধকার হয়ে গেল কেন?

মেমোরির সাথে সাথে আলোর প্রসেসরটাও গেছে নিশ্চয়ই। ইমার্জেন্সি আলোটা জ্বেলে দিই।

ধীরে ধীরে ইমার্জেন্সির ঘোলাটে আলো জ্বলে ওঠে। আমি ভাসতে ভাসতে সাবধানে একটা বড় ইলেকট্রনিক মডিউল ধরে নিজেকে সামলে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, লুকাস, তুমি কম্পিউটারের সাথে এভাবে লুকোচুরি খেলে টিকে থাকতে পারবে?

চেষ্টা করতে দোষ কী? সম্ভাবনা চল্লিশ দশমিক তিন আট, খারাপ না।

তোমার পরিকল্পনাটা কি?

আপনাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেয়া।

আমি এক মুহূর্ত চুপ থেকে জিজ্ঞেস করি, কী জন্যে, বলবে?

লুকাস শব্দ করে হেসে বলল, একজনের অনুরোধ।

আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করি, কার অনুরোধ?

নীষা নামের একটি মেয়ের। আপনি যার হাত ধরে বলেছেন, চিরদিনের মতো। ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার কথা ভাববেন।

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকি। লুকাস শব্দ করে হেসে উঠে বলল, নীষা বড় বেশি অনুভূতিপ্রবণ! আপনাকে নাকি বলেছিল যে আপনার কোনো ভয় নেই। সে এরকম অবস্থায় সবসময় সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলে, কেউ কখনো বিশ্বাস করে না। আপনি নাকি তার কথা বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন। সত্যি নাকি?

হ্যাঁ।

তাই সে আমাকে অনুরোধ করেছে। বিশ্বাসের অমর্যাদা করা নাকি ঠিক না।

নীষার সাথে তোমার পরিচয় কেমন করে?

সেটি অনেক বড় কাহিনী, আরেকদিন বলব। এখন শুধু জেনে রাখেন, আমরা রবোট্রনেরা যে-কাজটি করার চেষ্টা করছি, নীষা তাতে সাহায্য করে।

আমার হঠাৎ একটা জিনিস মনে হল, জিজ্ঞেস করব না, করব না ভেবেও জিজ্ঞেস করে ফেললাম, নীষা কি মানুষ, না রবোট্রন?

লুকাস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে, বলে, কোনটা হলে আপনি খুশি হবেন?

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, এতে খুশি আর অখুশির কোনো ব্যাপার নেই, লুকাস।

তাহলে জানতে চাইছেন কেন?

এমনি, কৌতূহল।

ঠিক আছে, আপনিই বের করবেন, আমি বলব না, দেখি বের করতে পারেন কী না।

আবার যদি কখনো দেখা হয়।

আমার কপোট্রন বলছে দেখা হবে, না হয়ে যায় না।

আমি কথা ঘোরানোর জন্যে বললাম, আমাদের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা চল্লিশ দশমিক তিন আট, যার অর্থ আমাদের হেরে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি।

হ্যাঁ।

এত বড় ঝুঁকি নেয়া কি তোমার উচিত হল? আমি তো আমার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম, কিন্তু তোমার জীবনের সব আশা তো তুমি ছাড় নি, তুমি কেন এত বড় ঝুঁকি নিলে?

আমি কোনো ঝুঁকি নিই নি। যদি মূল কম্পিউটার তোমাকে ধ্বংস করে দেয়?

কিম জুরান, আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি রবোট্রন। আমাদের স্মৃতি স্থানান্তর করা সম্ভব। অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে সেটা করা হয় না, কিন্তু করা সম্ভব। আমরা ইচ্ছা করলে সবসময়েই আমাদের স্মৃতির একটা কপি কোথাও বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তাহলে আমাদের কখনোই মৃত্যু হবে না। যখনই কোনো রবোট্রন ধ্বংস হয়ে যাবে, নতুন কোনো রবোর্টুনের কপোট্রনে সেই স্মৃতি ভরে নেয়া যাবে, সে তাহলে আবার প্রাণ ফিরে পাবে। আগে সেটা করা হত, কিন্তু দেখা গেছে রবোট্রনেরা তাহলে অনাবশ্যক ঝুঁকি নেয়, বেপরোয়া হয়ে যায়। সবাই জানে তাদের শরীর ধ্বংস হয়ে গেলেও তাদের স্মৃতি বেঁচে থাকবে, আবার তারা নূতন জীবন শুরু করতে পারবে, তাই কোনোকিছুকে আর পরোয়া করত না। তখন ঠিক করা হল, আমাদের স্মৃতির কপি রাখা হবে না, মানুষের মতো আমাদের শরীরই হবে আমাদের সবকিছু, শরীর ধ্বংস হলেই আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। সেই থেকে রবোট্রনেরা আর নিজেদের শরীরকে নিয়ে ছেলেখেলা করে না মানুষের মতো নিজের শরীরের যত্ন নেয়। কিন্তু খুব যখন প্রয়োজন হয়, তখন স্মৃতিকে কপি করা হয়। আপনাকে উদ্ধার করার জন্যে আমার স্মৃতির একটা অংশ কপি করে এখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

একটা অংশ? পুরোটা নয় কেন?

দু’টি কারণে। প্রথমত, পুরোটার প্রয়োজন নেই; দ্বিতীয়ত, রবোট্রনের স্মৃতি বিরাট বড়, পুরোটা পাঠানো সোজা ব্যাপার নয়। গোপন একটা জায়গা থেকে স্মৃতিটা বাইনারী কোডে পাঠানো হয়েছিল, মূল কম্পিউটার সরল বিশ্বাসে সেটা গ্রহণ করেছে, ভেবেছে পৃথিবী থেকে তাকে কোনো নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে। আমি মেমোরিতে ছিলাম, মূল কম্পিউটার যখন তার মূল প্রসেসরের ভেতর দিয়ে পাঠানো শুরু করল, আমি একটা প্রয়োজনীয় মাইক্রো প্রসেসর দখল করে নিয়েছি। সেই প্রসেসর এবং খানিকটা মেমোরি নিয়ে আমার রাজত্ব। ব্যাপারটা বেশ জটিল, এত অল্প সময়ে বোঝানো সম্ভব না, শুধু জেনে রাখেন আমি একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটারের মূল প্রোগ্রামের বিনা অনুমতিতে আমি কাজ করছি!

আমি খুঁটিনাটি বুঝতে না পারলেও মোটামুটি ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝতে অসুবিধে হল না। যে-জিনিসটা সবচেয়ে চমকপ্রদ মনে হল সেটা হচ্ছে, যদিও লুকাস আমাকে বাঁচানোর জন্যে এখানে এসেছে, কিন্তু সত্যিকারের লুকাস এখন পৃথিবীতে। আমার হঠাৎ লুকাসের বান্ধবী লানার কথা মনে পড়ল, তার স্মৃতির একটা কপি যদি বাঁচিয়ে রাখা হত, তাহলে আবার তাকে বাঁচিয়ে তোলা যেত। লুকাসকে জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, লানার স্মৃতির কোনো কপি কি বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল?

লানা? লুকাস একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, লানা কে?

আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমার বান্ধবী, যাকে বিপণিকেন্দ্রের সামনে গুলি করে মারা হল।

ও, তাই নাকি? লুকাস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আমার স্মৃতির ঐ অংশটুক পাঠানো হয় নি। আমি এখন জানি না লানা কে।

প্রসঙ্গটি তোলার জন্যে আমার নিজের উপর রাগ ওঠে। লুকাস কৌতূহলী স্বরে বলল, লানা কি আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল? তাকে কি আমার সামনে গুলি করেছিল?

আমি ইতস্তত করে বললাম, লুকাস, ঘটনাটি সুখকর নয়, তুমি যখন জান না, শুনে কী করবে, খামোকা কষ্ট হবে।

ঠিকই বলেছেন। তা ছাড়া আমাদের হাতে সময়ও বেশি নেই। লুকাস সুর পাল্টে বলল, এখন তাহলে আমার পরিকল্পনাটুকু শুনুন। আমি মহাকাশযানটি ফিরিয়ে নিতে চাই। তা করতে হলে মূল কম্পিউটারের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসেসর আমার দখল করে নেয়া প্রয়োজন, আমি সেটা করতে পারছি না, কাজেই আপনার সাহায্য দরকার।

কীভাবে?

আপনি কম্পিউটারের মূল ইলেকট্রনিক সার্কিট থেকে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ আই.সি.তুলে নেবেন। সার্কিটে সেগুলো বড় বড় সকেটে লাগানো আছে, আপনি গিয়ে ভ্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলে নেবেন। আমি বলব কোনগুলো খুলতে হবে। সেটা যদি করতে পারেন, মূল কম্পিউটার দুর্বল হয়ে পড়বে, আমি তখন তাকে দখল করে নিতে পারব।

কোথায় আছে কম্পিউটারের আই.সি.গুলো?

আপনাকে বলে দেব। সেখানে যাওয়ার আগে আপনাকে একটা স্পেস স্যুট পরে নিতে হবে। এখানে একটা আছে আমি জানি, কী অবস্থায় আছে জানি না। আশা করছি ভালোই আছে। এটা পরে উপরে উঠে যাবেন, ডানদিকের দরজাটা খুলে ফেললে আপনি ইলেকট্রনিক সার্কিটের ভেতর সরাসরি ঢুকে যেতে পারবেন। সেখানে পেছনের দিকে দেখবেন দুই হাজার পিনের আই.সি.—উপরে বড় সোনালি রঙের রেডিয়েটর, ভুল হওয়ার কোনো উপায় নেই। এক সারিতে নয়টা আছে, নয়টাই তুলে ফেলবেন।

বেশ। তোলা কঠিন নয় তো?

না, দু’পাশে দু’টি ছোট স্তু দিয়ে লাগাননা, তুলতে না পারলে ভেঙে দেবেন—জিনিসটা নষ্ট করা নিয়ে কথা।

ঠিক আছে। বাতাসে ভেসে থেকে আমার অভ্যাস নেই, একটু পরেপরেই আমি উল্টেপাল্টে যাচ্ছিলাম। সেই অবস্থায় কোনোভাবে একটা ইলেকট্রনিক মডিউলের হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে আমি লুকাসের সাথে কথা বলতে থাকি।

স্পেস স্যুটটা কোথায়?

ডানদিকের গোল ঢাকনাওয়ালা বাক্সে। এটি আধা ঘন্টার বেশি ব্যবহার করা যায় না, কাজেই আধা ঘন্টার মাঝে ফিরে আসতে হবে।

ঠিক আছে।

বেশি পরিশ্রম করবেন না, তাহলে খিদে পেয়ে যাবে আপনার, এই মহাকাশযানে কোনো খাবার নেই, আপনি হয়তো জানেন না।

খাবার নেই? কী সর্বনাশ!

আমি দুঃখিত, খাবারের জন্যে আপনাকে এখনো প্রায় নয় মাস অপেক্ষা করতে হবে। কাজেই তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ুন।

আগে আমি কখনো স্পেস স্যুট পরিনি, তবু এটা পরতে বেশি সময় লাগল না, কীভাবে পরতে হয় খুটিনাটি সবকিছু লেখা রয়েছে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্পেস স্যুটটা তৈরি হয়েছে, কাজেই পরা বেশ সহজ। ভেতরে বাতাসের চাপ ঠিক করে যোগাযোগের ব্যবস্থা করলাম, সাথে সাথে মূল কম্পিউটারের কথা শোনা গেল, মহামান্য কিম জুরান, আপনি কী করতে চাইছেন?

লুকাস বলল, কিম জুরান, আপনি ওর কোনো কথা শুনবেন না, আপনাকে অনেকভাবে ভয় দেখাতে চাইবে, কিচ্ছু বিশ্বাস করবেন না। সোজা উপরে চলে যান, কাজ শেষ করে ফিরে এসে আমাকে ডাকবেন। আমাকে এখন সরে পড়তে হবে।

মূল কম্পিউটার গম্ভীর গলায় বলল, মহামান্য কিম জুরান, আপনি নিশ্চয়ই লুকাসের কথা শুনে উপরে যাচ্ছেন না?

আমি কোনো কথা না বলে ভেসে ভেসে উপরে উঠে এসে দরজাটা ভ্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলতে থাকি।

মূল কম্পিউটার কঠোর গলায় বলল, মহামান্য জুরান, আপনি জানেন এই দরজা খোলা নিষেধ, এটা খোলার জন্যে আপনাকে আমি শেষ করে দিতে পারি?

দিচ্ছ না কেন? আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, তোমাকে নিষেধ করেছে কে?

ভিতরে আরেকটা দরজা রয়েছে, বাতাসের চাপ রক্ষার জন্যে এ ধরনের দরজা থাকে, সেটি ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই প্রচণ্ড আলোতে আমার চোখ ধাধিয়ে যায়। যতদূর দেখা যায় শুধু চৌকোনা আই.সি.। মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকতে পারলে বুঝি এরকম নিউরোন সেল দেখা যেত।

মহামান্য জুরান, ফিরে যান। এখানকার প্রত্যেকটা আই.সি. প্রয়োজনীয়, এর একটা একটু ওলটপালট হলে মহাকাশযান চিরদিনের মতো অচল হয়ে যেতে পারে, সারাজীবনের জন্যে আমরা এখানে আটকে থাকব! যদি ভুল করে একটা প্রয়োজনীয় আই. সি. তুলে ফেলেন, মুহূর্তে পুরো মহাকাশযান বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

আমি কম্পিউটারের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ভেসে ভেসে সামনে এগোতে থাকি। একেবারে সামনের দিকে দুই হাজার পিনের বড় বড় আই.সি.গুলো থাকার কথা। উপরে চৌকোনা সোনালি রেডিয়েটর থাকবে, ভুল হবার কোনো আশঙ্কা নেই। ডানদিক থেকে গুনে গুনে সাত নম্বরটা থেকে শুরু করতে হবে। নয়টা প্রসেসর তোলার কথা, তাহলেই আমার কাজ শেষ।

মহামান্য কিম জুরান, কম্পিউটার এবারে অনুনয় শুরু করে, আপনি ফিরে যান। আপনি জানেন না আপনি কী ভয়ানক কাজ করতে যাচ্ছেন। চোখের পলকে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব।

আমি সামনে বড় বড় প্রসেসরগুলো দেখতে পেলাম, উপরে সোনালি চৌকোনা রেডিয়েটর, আশেপাশে এরকম কিছু নেই, ভুল হবার কোনো উপায় নেই। ডানদিক থেকে সাত নম্বরটা বের করে আমি ছোট ছোট স্কু দু’টি খুলতে শুরু করি। কম্পিউটার এবার কাতর গলায় প্রাণভিক্ষা চাইতে শুরু করে, মহামান্য কিম জুরান, আপনার কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইছি। এই প্রসেসরটা আমার প্রাণের মতো, এটা তুলে ফেললে আমি প্রাণহীন হয়ে যাব, আমাকে বাঁচতে দিন। আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি মহাকাশযানটা ঘুরিয়ে আপনাকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাব। বিশ্বাস করেন আমাকে, আমি কম্পিউটার, কম্পিউটার কখনো মিথ্যা কথা বলে না।

 

স্ক্রু দু’টি খুলে, আই.সি.র নিচে স্ক্রু ড্রাইভারটা ঢুকিয়ে হ্যাঁচকা টানে প্রসেসরটি তুলে ফেললাম, সাথে সাথে একটা আর্তচিৎকার করে কম্পিউটার থেমে গেল, ভিতরে হঠাৎ কবরের মতো নিস্তব্ধতা নেমে এল। পরপর নয়টি প্রসেসর তোলার কথা। আমি দ্বিতীয়টার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় লুকাসের গলার স্বর শুনতে পেলাম, চমৎকার, কিম জুরান৷ দেরি করবেন না, তুলে ফেলেন তাড়াতাড়ি।

তুমি! আমি ভেবেছিলাম, তুমি বলেছ যে তোমাকে কিছুক্ষণের জন্যে সরে পড়তে হবে!

সরে পড়ার কথা ছিল, কিন্তু আপনি প্রসেসরটা তুলে ফেলেছেন বলে আসতে পেরেছি।

চমৎকার!

হ্যাঁ, দেরি করবেন না।

আমি স্ক্রু ড্রাইভারটা তলায় দিয়ে প্রসেসরটা তুলতে যাব, লুকাস হঠাৎ ভয়পাওয়া গলায় বলল, দাঁড়ান।

কী হল?

কম্পিউটার সব প্রসেসর বদলে ফেলেছে।

মানে?

সব মেমোরি পেছনে সরিয়ে ফেলেছে, এগুলো তুলে এখন আর লাভ নেই।

তাহলে?

লুকাস উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তাড়াতাড়ি পেছনে চলুন, পেছনের প্রসেসরগুলো তুলতে হবে।

আমি দ্বিধান্বিতভাবে বললাম, কিন্তু এগুলো তুলে ফেলি, ক্ষতি তো কিছু নেই।

লুকাস অধৈর্য গলায় বলল, ক্ষতি নেই, কিন্ত দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না, এক্ষুণি সরে পড়তে হবে। তাড়াতাড়ি পেছনে চলুন, আপনাকে দেখিয়ে দিই কোনটা কোনটা তুলতে হবে।

আমি ভেসে ভেসে পেছনে সরে আসি। লুকাস আমাকে বলে দিতে থাকে আর আমি দেখে দেখে একটা একটা করে আই.সি. তুলে ফেলতে থাকি। সময় বেশি নেই, অনেকগুলো আই.সি, তুলতে বেশ সময় লেগে যাবে। লুকাস যদিও বলেছিল সে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আমার সাথে সাথে থেকে গেল, তাই আধ ঘন্টার মাঝেই আমি কাজ শেষ করে ফিরে আসতে পারলাম।

স্পেস স্যুট খুলে ঠিক জায়গায় রেখে আমি মাইক্রোফোনের কাছে এসে বললাম, লুকাস, আমার আর কিছু করার আছে?

লুকাস কী কারণে আমার কথার কোনো উত্তর দিল না। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, লুকাস, আমি এখন কী করব?

লুকাস তবু আমার কথার উত্তর দেয় না। আমি ভয় পেয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, লুকাস।

কোনো সাড়া নেই। আমি এবার চিৎকার করে উঠি, লুকাস, তুমি কোথায়?

আমার গলার স্বর মহাকাশযানে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল, কিন্তু তবু লুকাস উত্তর দিল না। উত্তর দিল মূল কম্পিউটার, বলল, মহামান্য কিম জুরান, আপনাকে খুব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, এখানে লুকাস আর নেই।

মানে?

লুকাস যে আই.সি.গুলোতে ছিল, আপনি একটু আগে তার সবগুলো তুলে ফেলেছেন।

আমি কিছু বলার আগেই মূল কম্পিউটার বলল, আমার সার্কিট-ঘরে আমি লুকাসের গলার স্বর অনুকরণ করে আপনার সাথে কথা বলছিলাম। আপনার সাথে প্রতারণা করার জন্যে আমি দুঃখিত, কিন্ত আমার নিজেকে রক্ষা করার অন্য কোনো উপায় ছিল না।

আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না, নিজের কানকেও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, গভীর হতাশা হঠাৎ এসে আমাকে গ্রাস করে। জীবনের কত কাছাকাছি চলে এসে আবার ফিরে যেতে হবে। মূল কম্পিউটার যান্ত্রিক স্বরে বলল, মহামান্য কিম জুরান, এখন আপনাকে ক্যাপসুলে ঢুকতে হবে। বাইরে থাকা আপনার জন্যে বিপজ্জনক।

নিস্ফল আক্রোশে আমি কম্পিউটারের গলার স্বর লক্ষ্য করে স্ক্রু ড্রাইভারটা ছুঁড়ে দিই। একটা মনিটরে লেগে সেটা চুরমার হয়ে যায়, তার টুকরাগুলো আমার চারদিকে ভেসে বেড়াতে থাকে।

আপনি ছেলেমানুষের মতো ব্যবহার করছেন কিম জুরান। মূল কম্পিউটার শান্ত স্বরে বলল, আপনি নিজে থেকে ক্যাপসুলে প্রবেশ না করলে আমি জোর করতে বাধ্য হব। আপনাকে বাঁচানোর জন্যে এখন লুকাস নেই, তাকে আপনি নিজের হাতে শেষ করে এসেছেন।

আমি হঠাৎ নূতন করে উপলব্ধি করলাম যে, এই মুহূর্তগুলো আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত। ক্যাপসুলের ভেতর সেই ভয়াবহ পরিবর্তনই হোক, আর বাইরে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাওয়াই হোক, আমার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে এখনই! মারা যাওয়ার আগে কীভাবে এই পিশাচ কম্পিউটারটির উপরে একটা প্রতিশোধ নেয়া যায়, সেটাই আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।

হঠাৎ করে পুরো মহাকাশযানটি বরফের মতো শীতল হয়ে আসে। আমি দু হাতে নিজের শরীরকে আঁকড়ে ধরে শিউরে উঠি, কী ভয়ানক ঠাণ্ডা, কেউ যেন আমাকে বরফশীতল পানিতে ছুড়ে দিয়েছে। কম্পিউটারের গলার স্বর শুনতে পেলাম, মহামান্য কিম জুরান, ক্যাপসুল আপনার জন্যে উষ্ণ করে রাখা হয়েছে।

ধীরে ধীরে ক্যাপসুলের দরজা খুলে যায়, ভেতর থেকে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা মহাকাশযানের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। আমি লোভীর মতন ক্যাপসুলের দিকে এগোতে গিয়ে থেমে পড়ি, কী হবে উষ্ণ নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে? কষ্ট করে এই তুহিন শীতল মহাকাশযানে আর কয়েক মিনিট থাকতে পারলেই তো আমার হাইপোথার্মিয়া হয়ে যাবে, তখন কেউ আর আমাকে বাঁচাতে পারবে না। বেঁচে থাকার চেষ্টা করে আর লাভ কী?

আসুন কিম জুরান, কম্পিউটার একঘেয়ে গলায় বলতে থাকে, বাতাস থেকে এখন আমি অক্সিজেন সরিয়ে নিচ্ছি, বাইরে আপনার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে।

সত্যি সত্যি আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে, বারবার বুক ভরে বাতাস নিয়েও মনে হতে থাকে শ্বাস নিতে পারছি না। কী কষ্ট কী যন্ত্রণা! প্রচণ্ড শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আমি পাগলের মতো নিঃশ্বাস নিতে থাকি, কিন্তু তবু আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে।

মহামান্য কিম জুরান, আসুন, ক্যাপসুলের ভেতর আসুন, আবার আপনি বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবেন, উষ্ণ আশ্রয়ে নিরাপদে ঘুমুতে পারবেন।

আমি জ্ঞানহীন পশুর মতো নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে ক্যাপসুলের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললাম, বুক ভরে শ্বাস নিই একবার, আহ্ কী শান্তি! আরামদায়ক উষ্ণতায় আমার সারা শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে।

ঘুমিয়ে পড়ুন মহামান্য কিম জুরান। শুভ রাত্রি।

কোথা থেকে একটা হালকা নীল আলো এসে ছড়িয়ে পড়ে। মিষ্টি একটা সুর আর বাতাসে মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসে। আমার দু চোখে হঠাৎ ঘুম নেমে আসতে থাকে। শেষ হয়ে গেল তাহলে? সব তাহলে শেষ হয়ে গেল?

কিম জুরান। আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থায় শুনতে পেলাম কে যেন আমাকে ডাকছে।

কিম জুরান।

আমি চমকে জেগে উঠি, লুকাস!

হ্যাঁ, কিম জুরান।

তুমি! তুমি বেঁচে আছ?

হ্যাঁ কিম জুরান। প্রথম প্রসেসরটি তুলেছেন বলে এখনো কোনোমতে বেঁচে আছি।

আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি জেগে থাকতে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেমে আসতে থাকে। লুকাসের গলার স্বর মনে হয় বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। সে আস্তে আস্তে বিষণ্ণ স্বরে বলল, আমি বেঁচে আছি সত্যি, কিন্তু এখন আমার আর কোনো ক্ষমতা নেই। আমি দুঃখিত কিম জুরান, কিন্তু আপনাকে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে যেতেই হবে।

অনেক কষ্টে আমি বললাম, আমাকে তুমি কোনোভাবে মেরে ফেলতে পারবে?

লুকাস আস্তে আস্তে বলল, আমি দুঃখিত কিম জুরান, এই মুহূর্তে আমার সেই ক্ষমতাও নেই। রুকুন গ্ৰহপুজে পৌছাতে এখনো কয়েক মাস সময় লাগবে, আমি চেষ্টা করে দেখব কিছুটা মেমোরি কোনোভাবে দখল করতে পারি কি না, যদি পারি চেষ্টা করব আপনাকে মেরে ফেলতে, আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি। যদি না পারি—

লুকাস কী বলছে আমি আর শুনতে পেলাম না, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে হল। আতঙ্ক, নিস্ফল আক্রোশ আর দুঃখের একটা বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে ভয়ঙ্কর এক ঘুম। নরকে অশুভ প্রেতাত্মাদের বুঝি এরকম অনুভূতি নিয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকতে হয়।