ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

৪. অধ্যাপক ত্রিবেদী ও ডা. সাটিরা

অধ্যাপক ত্রিবেদী ও ডা. সাটিরা

০১. অনাহুত অতিথি

উদ্ভিদবিজ্ঞানী ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী কলকাতার কাছে গোলাপ কলোনি নামে শহরতলিতে ভুতুড়ে। বাড়ি বা হানাবাড়ি বলে অপবাদগ্রস্ত একটি পরিত্যক্ত অট্টালিকার উদ্যানের মধ্যে দৈবক্রমে আশ্চর্য-পাতা আবিষ্কার করেন। ওই গাছের পাতা চিবিয়ে খেলে অবিশ্বাস্য দৈহিক শক্তি লাভ করা যায়। কিন্তু সেই শক্তি সাময়িক, চিরস্থায়ী নয়। আশ্চর্য-পাতা আবিষ্কার করার পর থেকে ত্রিবেদী মশাই ক্রমাগত বিপদে পড়েছেন, তবে শেষ পর্যন্ত ওই সব বিপদ কাটিয়ে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন। এই গ্রন্থে লিখিত পূর্ববর্তী কাহিনিগুলি যে-সব পাঠকের পড়া আছে, তাদের কাছে অধ্যাপক ত্রিবেদীর দুর্ভোগের ইতিহাস অজানা নয়। এখন দেখা যাক অধ্যাপক মশাই-এর জন্যে আবার কোন্ নতুন বিপদ অপেক্ষা করছে…।

গবেষণাগারের মধ্যে একটি খালি বোতলের ভিতর অন্য একটি পাত্র থেকে রক্তবর্ণ তরল নির্যাস ঢালতে ঢালতে ত্রিবেদী আপনমনেই বলে উঠলেন, বিভিন্ন গাছের শিকড় ও লতা মিশিয়ে যে তরল পদার্থটি প্রস্তুত করেছি, গবেষণার ক্ষেত্রে এটিকে অত্যাশ্চর্য বিশেষণ দিলে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। তবে মনুষ্যসমাজের পক্ষে আমার এই আবিষ্কার শুভ হবে কি অশুভ হবে, তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। যদি বুঝতে পারি আমার এই আবিষ্কার মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণকেই ডেকে আনবে, তাহলে অবশ্য এই বস্তুটি যাতে জনসাধারণের হস্তগত না হয় সেই ব্যবস্থাই করব।

আচম্বিতে সনাতনের তীব্র কণ্ঠস্বর অধ্যাপকের চিন্তার জাল ছিঁড়ে দিল, বাবু, আপনাকে দুজন লোক ডাকতিসে- ঈসস!

গভীর চিন্তায় মগ্ন অধ্যাপক এমন চমকে উঠলেন যে, তাঁর হাত থেকে টেবিলের উপর পাত্রটা ছিটকে পড়ে উলটে গেল। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ত্রিবেদী ধমকে উঠলেন, এমন হঠাৎ করে কানের কাছে ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলি কেন? তোর গলা শুনে হাতের পাত্রটা টেবিলের উপর ফেলে দিলাম। ভাগ্যিস এটার মধ্যে যা ছিল তার সবটাই বোতলে ঢেলে ফেলেছি– নইলে সমস্ত জিনিসটা গড়িয়ে পড়ে পনের দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম পণ্ড করে দিত।

খুব দুঃখ-দুঃখ মুখ করে সনাতন ভুরু কুঁচকে বলে উঠল, ঈসস!

অধ্যাপক ত্রিবেদী খুব রগচটা মানুষ নন, সনাতনের মুখের ভাব দেখে আর তার কণ্ঠনিঃসৃত অব্যয় শব্দটি শ্রবণ করে তার মনে হল সনাতন বোধহয় যৎপরোনাস্তি দুঃখিত ও অনুতপ্ত, অতএব তার উত্তপ্ত মেজাজ তখনই ঠান্ডা হয়ে গেল এবং তিনি অনুভব করলেন অনুতপ্ত সনাতনকে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। অতএব গলার স্বর খুব নামিয়ে যথাসম্ভব কোমল-স্বরে ত্রিবেদী বললেন, যাক গে, তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। তবে জিনিসটা যদি বোতলের মধ্যে আগেই ভরে না ফেলতাম, তাহলে জিনিসটা বাইরে পড়ে গিয়ে আমার সব খাটুনি নষ্ট হত।

সনাতনের ভাবভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না, অত্যন্ত দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে সে আবার বলল, ঈস!

ত্রিবেদীর ভ্রূ কুঁচকে গেল, তখন থেকে ঈস, ঈস করছিস কেন? বললাম তো জিনিসটা বেঁচে গেছে, বিশেষ ক্ষতি হয়নি।

-কিন্তু জিনিসটা তো বাঁচলোনি বাবু।

–কী পাগলের মতো বকছিস? পাত্রটা ছিটকে পড়ে উলটে গেছে বটে, কিন্তু ওটার মধ্যে আর কোনো পদার্থ নেই। সব জিনিসটাই আগে-ভাগে আমি বোতলে ঢেলে রেখেছি।

আজ্ঞে, সেই কথাই তো বলছি। বোতলটা যে ফাটা!

য়্যাঁ! বলে কী! টেবিলের উপর বোতলটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন ত্রিবেদী- কী। সর্বনাশ! তার আবিষ্কৃত রক্তবর্ণ নির্যাসের একটি তরল স্রোত বোতলের গা বেয়ে টেবিলের কিছু অংশ লালে লাল করে দিয়েছে!

সনাতন এগিয়ে এসে বোতলটা তুলে ধরতেই ফাটা জায়গাটা নজরে এল। ফোঁটা ফোঁটা করে ফাটা জায়গা দিয়ে গড়িয়ে নামছে অধ্যাপক ত্রিবেদীর তরল আবিষ্কার। এই অভাবিত দুর্ঘটনায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন অধ্যাপক, কয়েক মুহূর্ত পরে নিজেকে সামলে এই মুহূর্তে যা করা উচিত সেটা ভেবে নিয়ে সনাতনকে কিছু বলতে গেলেন তিনি। কিন্তু তার নীরব কণ্ঠ সরব হওয়ার আগেই একতলা থেকে একটি উচ্চকণ্ঠের অভিযোগ ভেসে এল দোতলার গবেষণা কক্ষেওহে, কী-যেন নাম তোমার? মিঃ ত্রিবেদীকে ডেকে দাও। কতক্ষণ আর বসে থাকব?

আবার একবার চমকালেন ত্রিবেদী, এখন আবার কে ডাকতে এল?

–ওই যে দুজন লোক এসেছে, তারাই তো ডাকতিছে।

লোক এসেছে সেকথা বলবি তো হতভাগা, মুখ্যু কোথাকার!

আমি তো বলতেই এনু। তা আপনি বলতে দিলেন কই?

–যাক গে, যাক কি কাজ কর সনাতন। টমেটো সস-এর খালি বোতলের মধ্যে ফাটা বোতলের জিনিসটা ঢেলে রেখে ভর্তি বোতলটা ফ্রিজ-এর মধ্যে রেখে দে। আমি একবার বাইরের ঘরে গিয়ে দেখি এই অসময়ে কে জ্বালাতে এল।

.

০২. সুযোগ? না, দুর্যোগ?

 বাইরের ঘরে প্রবেশ করে ত্রিবেদী দেখলেন সেখানে সোফায় বসে তার জন্যে অপেক্ষা করছে দুই মূর্তি। তাদের মধ্যে একজনের পরনে নিখুঁত সাহেবি পোশাক, অপর ব্যক্তির দেহে রয়েছে একটি ডোরাকাটা রঙিন গেঞ্জি ও জি-এর রংচটা প্যান্ট। প্রথম ব্যক্তির নেকটাই ও স্যুট-এর সঙ্গে রং মিলিয়ে চরণের শোভা বর্ধন করছে একজোড়া চকচকে বুট জুতো। দ্বিতীয় ব্যক্তির পায়ে রয়েছে একজোড়া অযত্নে বিবর্ণ কোলাপুরি চটি। একনজর তাকালেই বোঝা যায় দুই ব্যক্তির শিক্ষা-দীক্ষা ও রুচিতে প্রচুর প্রভেদ। সাহেবি পোশাকে সজ্জিত ব্যক্তির চোখে-মুখে শিক্ষিত মানুষের বুদ্ধিমত্তার ছাপ সুস্পষ্ট। তার সঙ্গীর কেশহীন মস্তক, চোখ মুখ আর শরীরের উপর দৃষ্টিপাত করার সঙ্গে সঙ্গেই অনুমান হয় লোকটির মস্তিষ্কে শিক্ষা ও বুদ্ধির যথেষ্ট অভাব থাকলেও তার অত্যন্ত বেঁটে অথচ নিরেট পেশীপুষ্ট শরীরে রয়েছে আসুরিক শক্তি।

নির্বোধ মস্তিষ্ক আর শক্তিমান দেহ, ত্রিবেদী মনে মনে বললেন, দেহ আর মস্তিষ্কের এমন বিপরীতধর্মী সংমিশ্রণ খুবই বিপজ্জনক। এই লোকটি সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে।

ইতিমধ্যে ত্রিবেদীকে দেখে করজোড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সাহেবি পোশাক; তার সঙ্গী ডোরাকাটা গেঞ্জি প্রথমে আসন ত্যাগ করা দরকার মনে করেনি, কিন্তু প্রথমোক্ত ব্যক্তিকে। করজোড়ে দণ্ডায়মান দেখে তড়াক করে একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে সে হাতজোড় করল।

প্রথাগতভাবে অভিবাদন জানিয়ে ত্রিবেদী বললেন, নমস্কার, নমস্কার। আপনারা কি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?

সাহেবি পোশাক বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি মিঃ ত্রিবেদী।

-কিন্তু আমি তো আপনাদের ঠিক চিনতে পারছি না।

–আপনি আমাদের চেনেন না বটে, কিন্তু আমরা আপনাকে চিনি। তাই না গজু? ডোরাকাটা গেঞ্জি আর রংচটা জিনস্ পরিহিত গজু নামক খর্বাকৃতি দৈত্য একগাল হাসল,হে। হে! হে! আমাদের আপনি না চিনলেও আমরা আপনাকে চিনি। আর চেনাশুনাটা যাতে ভালো করে হয়, সেইজন্যই তো এলাম তাই না ডাঃ সাটিরা?

-ঠিক! ঠিক!

ডাক্তার সাটিরা! ত্রিবেদী সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, আমি ভেবেছিলাম আপনি বাঙালি!

আলবৎ বাঙালি, ডাঃ সাটিরা নামক ব্যক্তি দন্তবিকাশ করলেন, আমার পিতৃদত্ত নাম বিনয়ভূষণ সাঁতরা। হোপলেস! রট! একেবারে বাজে নাম। ওই নাম নিয়ে আর করে খেতে হত না। তাই ওটা বদলে নাম নিলাম ডাঃ বি.বি. সাটিরা, সংক্ষেপে ডাঃ সাটিরা।

আমতা আমতা করে ত্রিবেদী বললেন, ইয়ে কী বলে ডাঃ সাটিরা, দয়া করে অল্প কথায় আপনার বক্তব্য শেষ করুন। আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত।

নিশ্চয়, নিশ্চয় ডাঃ সাটিরা সহাস্যে বললেন, আমিও অল্প কথার মানুষ, অল্প কথায় আমার বক্তব্য রাখব। যারা বেশি কথা বলে, তারা বাজে কথা বলে-যারা বাজে কথা বলে, তারা কাজের মানুষ নয়- যারা কাজের মানুষ নয়, তারা অমানুষ। আর অমানুষদের আমি ঘৃণা করি। আপনি যদি–

-প্লিজ ডাঃ সাটিরা। অনুগ্রহ করে খুব অল্প কথায় আপনার বক্তব্য শেষ করুন।

 খুব অল্প কথা? ডাঃ সাটিরাকে কিঞ্চিৎ ভাবিত মনে হল, আচ্ছা, আমি খুউব অল্প কথায় আপনাকে সব বুঝিযে বলছি। আপনি যদি আমার কথা বুঝতে না পারেন, তাহলে আপনি আমায় বুঝিয়ে বলবেন যে আমার কথা আপনি বুঝতে পারেননি– আপনি যদি আমায় বুঝিয়ে না বলেন যে আমার কথা আপনি বুঝতে পারেননি, তাহলে আমি কী করে বুঝব যে আমার কথা আপনি বুঝতে পারেননি? বুঝেছেন? হাঁ করে তাকিয়ে আছেন কেন? যদি আমার কথা আপনার বুঝতে অসুবিধা হয়, তাহলে আবার গোড়া থেকে- কী হল?

দুই চোখ কপালে তুলে গজু বলল, কী হল ডাঃ সাটিরা? ত্রিবেদী স্যার হঠাৎ মাটিতে বসে পড়লেন কেন?

সত্যিই তাই। এতক্ষণ অতিথিদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন ত্রিবেদী। ভদ্রতাবশত তাদের আসন গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা উচিত ছিল, অতিথি অনাহূত এবং অবাঞ্ছিত হলেও তাদের দাঁড় করিয়ে রাখা অভদ্রতা। কিন্তু ইচ্ছা করে অভদ্রতা করেননি ত্রিবেদী, অতিথিদের তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে অসমাপ্ত গবেষণাকার্যে মনোনিবেশ করার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন বলেই তিনি তাদের বসতে অনুরোধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন, আর নিজেও দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন কিন্তু হঠাৎ তিনি ধপাস করে বসে পড়লেন মেঝের উপর।

এগিয়ে এসে উদ্বিগ্নকণ্ঠে ডাঃ সাটিরা বললেন, আপনি হঠাৎ মাটিতে বসে পড়লেন কেন? অসুস্থ বোধ করছেন নাকি? ডাক্তার ডাকব?

না, না, উপবিষ্ট অবস্থাতেই জড়িতকণ্ঠে ত্রিবেদী বললেন, ডাক্তার ডাকার দরকার নেই।

–তাহলে হঠাৎ মেঝের উপর চোখ উলটে বসে পড়লেন কেন?

–আপনার কথা শুনতে শুনতে মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল।

-ওটা সাময়িক দুর্বলতা। আপনি সোফায় উঠে বসুন… হ্যাঁ, এই তো সুস্থ হয়ে উঠেছেন। অতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা কইছিলেন বলেই আপনার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। এবার আরাম করে সোফায় বসে আমার কথা শুনুন। যেকথা বুঝিয়ে বলছি তা বুঝতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে–

বাধা দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন ত্রিবেদী, ডাঃ সাটিরা! প্লিজ! ওভাবে কথা বললে আমি এবার নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যাব।

–ও! আচ্ছা! তবে শুনুন, মিঃ ত্রিবেদী- সেদিন কপাটি প্রতিযোগিতায় আপনার খেলা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি, চমকিত হয়েছি। খ্যাংরা কাঠির মতো আপনার চেহারা, কিন্তু সাত-সাতটা জোয়ান ছেলে আপনাকে ধরে রাখতে পারে না। শুধু কি গায়ের জোর? যেমন ছোটার ক্ষমতা, তেমনি অফুরন্ত দম! শুনুন মশাই, এমন অদ্ভুত ক্ষমতাকে কপাটির মাঠে অপচয় করা অন্যায়, তাই—

-তাই কী?

–তাই আমি আপনাকে একটি চমৎকার সুযোগ দিতে এসেছি।

–সুযোগ? কিসের সুযোগ?

ডাঃ সাটিরার মুখে ফুটল দুর্বোধ্য রহস্যময় হাসি, তাঁর দুই চোখ জ্বলে উঠল, সামনে ঝুঁকে পড়ে গম্ভীর অথচ মৃদুস্বরে তিনি বললেন, কীসের সুযোগ? লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জনের দুর্লভ সুযোগ!

.

০৩. চক্রান্ত

কিছুক্ষণ কথা কইতে পারলেন না ত্রিবেদী। ডাঃ সাটিরার অভাবিত এবং কল্পনাতীত অদ্ভুত আচরণ তাঁকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে ত্রিবেদী বললেন, টাকার লোভ আমার নেই। আমি বিজ্ঞান ভবনে অধ্যাপনা করে যে অর্থ উপার্জন করি, তাতে আমার ভালো ভাবেই চলে যায়। তবে অনেক বেশি টাকা পেলে গবেষণার সুযোগ হয় বটে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করতে হলে আমাকে তো এখন যা করছি, সেসব ছেড়ে দিয়ে টাকার পিছনেই ছুটতে হবে। আপনি যে আমাকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা অথবা বিজ্ঞান-বিষয়ক অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত করে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগারের সুযোগ করে দিতে পারবেন এমন তো মনে হয় না। তবে আপনার প্রস্তাব না শুনে আমি কোনো মতামত

হঠাৎ দরজার কাছ থেকে ভেসে এল কণ্ঠস্বর, ভিতরে আসতে পারি?

কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে চোখ তুলতেই যাকে দেখতে পেলেন ত্রিবেদী, সেই ছেলেটি তাঁর পরিচিত, এই পাড়ারই বাসিন্দা। কপাটি প্রতিযোগিতায় ত্রিবেদীর অদ্ভুত কার্যকলাপে মুগ্ধ হয়ে গোলাপ কলোনির অধিকাংশ কিশোর ও যুবক তাঁর অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল- আগন্তুক যুবক অধ্যাপকের অনুরাগী ভক্তদের মধ্যে অন্যতম।

আগন্তুককে উদ্দেশ করে ত্রিবেদী বললেন, আরে, ঘোঁতন যে! কী মনে করে?… ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, ভিতরে এস।

-না স্যার, ভিতরে যাব না। অনেক কাজ আছে। আপনাকে সাবধান করতে এলাম।

সাবধান করতে এসেছ? কেন? কী জন্য? হঠাৎ সাবধান হওয়ার প্রশ্নই বা উঠছে কেন?

পাড়ায় ভীষণ চুরি হচ্ছে স্যার। আমরা অর্থাৎ পাড়ার ছেলেরা ঠিক করেছি সারারাত ধরে রোজই পাহারা দেব। রোজ-রোজ রাত জেগে পাহারা দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়; তাই আমরা ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে পালা করে পাহারা দেব বলে ঠিক করেছি। আজ যে দল পাহারা দেবে, সেই দলটার পরিচালনা করার ভার পড়েছে আমার উপর। আপনি স্যার, রাতে একটু সজাগ থাকবেন। যদি চোর আসে তাহলে চিৎকার করবেন। পাড়ায় বলা আছে কোনো বাড়ি থেকে বিপদের আভাস পেলে অন্যান্য বাড়ি থেকে চিৎকার করে সাড়া দেবে তাদের গলার আওয়াজ যাদের কানে যাবে, তারাও চাঁচাবে। আমরা যদি কাছাকাছি না-ও থাকি, তাহলেও চিৎকার শুনতে পাব। কারণ বাড়ি থেকে বাড়ি ছড়িয়ে পড়ে একসময় আওয়াজটা সারা পাড়াতেই ছড়িয়ে পড়বে। আর সেই সতর্কবার্তা শুনতে পেলেই আমরা ছুটে এসে সমস্ত এলাকা ঘিরে ফেলব। আমাদের সঙ্গে অনেকগুলো সাইকেল রয়েছে, কাজেই চোর কোনো বাড়িতে ঢুকে সহজে কাজ হাসিল করে সরে পড়তে পারবে বলে মনে হয় না। আচ্ছা স্যার, এখন চলি। আবারও বলে যাচ্ছি সাবধানে থাকবেন।

ঘোঁতন প্রস্থান করল। ডাঃ সাটিরা এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, এইবার মন্তব্য করলেন, যত সব উটকো ঝামেলা। হ্যাঁ, মিঃ ত্রিবেদী, আমি তাহলে আমার বক্তব্য শুরু করতে পারি?

দয়া করে সংক্ষেপে বলবেন।

–সংক্ষেপেই বলছি। যাদের প্রচুর অর্থ আছে, তাদের সম্পদের পরিমাণ কমিয়ে আমি আমার এবং দলের লোকের শ্রীবৃদ্ধি করতে চাই। মন্দ লোকে অবশ্য আমাদের সমাজবিরোধী, ডাকাত প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত করে, কিন্তু বাজে লোকের বাজে কথায় আমরা কান দিই না। উপযুক্ত কর্মীকে আমরা প্রচুর পারিশ্রমিক দিয়ে থাকি। আপনি আমাদের দলে এলে দলের শক্তি বাড়বে। লুঠের মাল বিক্রি করে যে-টাকা পাওয়া যাবে, তার চারভাগের এক ভাগ আপনাকে দেওয়া হবে। ভাগ্য যদি সদয় থাকে, আর আপনি যদি মন দিয়ে কাজ করেন, তাহলে তিন-চার মাসের মধ্যেই আপনি লাখ টাকা কামিয়ে নিতে পারবেন।

কিন্তু আমি, ইয়ে, মানে… কী বলে. আমি তো এসব কাজ জীবনে কখনো করিনি, ত্রিবেদী সভয়ে বলে উঠলেন, আর ইয়ে হয়েচে… মানে টাকা পয়সার উপর আমার তেমন লোভ নেই। আমায় মাপ করুন ডাঃ সাটিরা।

ডাঃ সাটিরার চোখে ভেসে উঠল নির্দয় হিংসার কুটিল ছায়া, কিন্তু কণ্ঠস্বর শিষ্টাচারে মার্জিত মধুর, মিঃ ত্রিবেদী, আপনি কি পারবেন আর না-পারবেন, সেই বিষয়ে আমার ধারণা খুবই স্পষ্ট… ওঃ! ওই যে ডাবওয়ালা যাচ্ছে, গজ ডাব নিয়ে আয়। বড়ো তেষ্টা পেয়েছে। দাঁড়া, দাঁড়া- মিঃ ত্রিবেদী, ডাব খাবেন নাকি?

দুর্বল স্বরে ত্রিবেদী বললেন, আজ্ঞে না।

অবশ্য এই মুহূর্তে ডাবের জল অথবা ঠান্ডা পানীয় জলের প্রয়োজন তিনি অনুভব করছিলেন, কিন্তু ডাঃ সাটিরার হাত থেকে খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করার প্রবৃত্তি তার ছিল না।

গজু গেল ডাব আনতে। একবার সেইদিকে তাকিয়ে আবার ত্রিবেদীর উপর দৃষ্টিপাত করলেন সাটিরা, গজু ডাব নিয়ে ফিরে আসুক। ডাবের জল পান করে আমি চলে যাব। আপনার মূল্যবান সময় আমি নষ্ট করব না। আমার মনে হয় ডাবের জল পান করতে আমার যেটুকু সময় লাগবে, সেই সামান্য সময়ের মধ্যেই আপনার বর্তমান সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের প্রয়োজন আপনি অনুভব করবেন।

ত্রিবেদী স্খলিতস্বরে বললেন, কিছু যদি মনে করেন, তাহলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?

-অবশ্যই, একটা ছেড়ে হাজারটা প্রশ্ন করুন, আমি কিছু মনে করব না।

–মানে, ইয়ে, ডাঃ সাটিরা

-বলুন, বলুন, অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন? দলে আসার আগে আপনি অনেক কিছুই জানতে চাইতে পারেন। সেটাই তো স্বাভাবিক। বলুন, কী জানতে চান?

–পাড়ার ব্যাপারগুলো বোধহয় আপনাদেরই কীর্তি?

–আপনি পাগল হয়েছেন, মিঃ ত্রিবেদী? এমন তুচ্ছ কাজে আমি এনার্জি নষ্ট করি না। আমার কথা হচ্ছে মারি তো গণ্ডার, লুঠি তো ভাণ্ডার। পাড়ার চুরি-টুরি হচ্ছে ছ্যাচড়াদের কাজ। এইসব কাজের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

ডাক্তার, খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল গজু, হাতে তার একটা বড়োসড়ো ডাব, ডাব এনেছি, এখনই খাবেন তো?

–হ্যাঁ। কেটে দে।

ত্রিবেদী দেখলেন ডাবের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা বোঁটা, অর্থাৎ ডাবের মুখ অক্ষত। তিনি বললেন, ডাবওয়ালাকে দিয়ে ডাবের মুখ কাটিয়ে আনা উচিত ছিল। এখন ডাব কাটবে কি করে? দেখি, বাড়ির ভিতরে যদি একটা কাটারি পাওয়া যায়।

কাটারি আনার জন্য সনাতনের উদ্দেশে বাড়ির ভিতর যাওয়ার উপক্রম করলেন ত্রিবেদী, কিন্তু তাঁকে বাধা দিয়ে ডাঃ সাটিরা বলে উঠলেন, আপনি ব্যস্ত হবেন না, মিঃ ত্রিবেদী। গজুর কাছে ছুরি আছে।

ছুরি! ছুরি কি হবে? ছুরি দিয়ে কি ডাব কাটা যায়?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, গজু বলল, ছুরি দিয়ে সব কিছুই কাটা যায়। মানুষ পর্যন্ত কাটা যায়, আর ডাব কাটা যাবে না?

-তার মানে? তুমি কি মানুষও কাটো নাকি?

–হে! হে! আপনি স্যার দারুণ মজার কথা বলতে পারেন। হে! হে! হে!

ত্রিবেদীর বিস্ফারিত দৃষ্টির সম্মুখে পকেট থেকে একটা চ্যাপ্টা বস্তু বার করল গজু খ করে একটা মৃদু শব্দ- পরক্ষণেই সেই চ্যাপ্টা জিনিসটার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল শাণিত ইস্পাতের ফলা! স্প্রিং-এর ছুরি!

ছুরিটার দিকে তাকিয়ে ত্রিবেদী ভাবতে লাগলেন তার কথার মধ্যে মজা কোথায় পেল গজু? নাকি, মানুষ কাটার ব্যাপারটাই তার কাছে মজার ব্যাপার! ত্রিবেদীর সর্বাঙ্গ হল ঘর্মাক্ত, ভীত দৃষ্টি মেলে তিনি দেখলেন ছুরি দিয়ে কচাকচ ডাবের মুখ উড়িয়ে দিল গজু, তারপর মুচকি হেসে ত্রিবেদীর দিকে তাকিয়ে ছুরিটাকে সজোরে বসিয়ে দিল ডাবের মুখে, ছিটকে পড়ল খানিকটা জল সদ্যছিন্ন ডাবের ছিদ্র থেকে।

ডাবটাকে ডাঃ সাটিরার দিকে এগিয়ে দিয়ে গজু বলল, জল খেয়ে ডাব ফেলে দেবেন না ডাক্তার। শাঁসটা আমি খাব।

এক নিঃশ্বাসে জল পান করে ডাবটা গজুর প্রসারিত হস্তে সমর্পণ করলেন সাটিরা।

 ত্রিবেদী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ডাবের খোলা কি ছুরি দিয়েই কাটবে?

না, না, গজুর তুরন্ত জবাব, ওতে ছুরির ধার নষ্ট হয়ে যায়। আমি ঘুষি মেরে ডাব ফাটাব।

 –আজ্ঞে হ্যাঁ, বিগলিত হাস্যে ডাঃ সাটিরা জানালেন, গজু তো ঘুসি মেরেই ডাব ফাটায়।

ডাঃ সাটিরার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই শ্রীমান গজুর বদ্ধমুষ্টি পড়ল ডাবের উপর, সশব্দে ভেঙে গেল ডাবের খোলা! ছুরিটা এইবার চামচের স্থান গ্রহণ করল, ভোলা থেকে শাঁস ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে গজু মুখে ফেলতে লাগল ছুরির সাহায্যে।

ত্রিবেদীর মুখ দেখে তার মনের ভাব আন্দাজ করতে পারলেন ডাঃ সাটিরা, আপনি অবাক হচ্ছেন মিঃ ত্রিবেদী? হাঃ! হাঃ! গজু ছুরি দিয়ে কতরকম কাজ করে ভাবতে পারবেন না। শাক-সবজি ফলমূল কাটে, মাংস খেতে হলেও ওই ছুরি দিয়ে কেটে ফর্ক অর্থাৎ কাটার বদলে ওইটা দিয়েই মাংসের টুকরো বিধে মুখে তোলে– এমনকি মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে মাছ খায় গজু ওই ছুরির সাহায্যে। তাছাড়া আত্মরক্ষার জন্যেও ওটা দরকার হয় মাঝে মাঝে।

–আত্মরক্ষার জন্য ছুরি? কারও সঙ্গে ঝগড়া হলে গজু বুঝি ছুরি চার্লিয়ে দেয়?

-আরে, না, জিভ কাটলেন ডাঃ সাটিরা, গজু খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ। কারও সঙ্গে যদি ঝগড়া হয়, কেউ যদি ওর গায়ে হাত তোলে, তাহলেও গজু পালটা মার দিতে চায় না, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মারমুখো লোকটাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে। তবে

-তবে? তবে কী? ত্রিবেদীর উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন।

–তবে সব কিছুরই তো শেষ আছে। গজুর ধৈর্যও অসীম নয়। তাই দু-এক সময় হাত চালাতে হয় নিতান্ত আত্মরক্ষার জন্য। এই তো কয়েকদিন আগে নটার শোতে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরছি, হঠাৎ কোথা থেকে এসে তিনটে গুণ্ডা রাস্তার মধ্যেই আমাদের ঘেরাও করে জানাল কয়েকদিন আগে যে কাজটা করে আমরা মাত্র লাখ পাঁচেক টাকা হাতে পেরেছিলাম, সেখান থেকে তিন লাখ টাকা তাদের সেলামি দিতে হবে। আবদারটা শুনুন– আমরা মাথা খাঁটিয়ে কাজ করলুম, পুলিশ আর জনগণের ঠ্যাঙানির ঝুঁকি নিয়ে প্রাণ বিপন্ন করলুম–আর ওরা কিছু না করেই ফোকটে তিন লাখ টাকা মেরে দেবে? বলুন, এটা অন্যায় নয়?

অবাক হয়ে ত্রিবেদী বললেন, এরকম হয় নাকি?

–হয়। একে বলে গুণ্ডা-সেলামি। ওদের এলাকায় কাজ করলেই নাকি সেলামি দিতে হবে। ওদের এলাকা মানে? এলাকা তো সরকারের, অন্যায় হলে সরকার দেখবে- তোমরা কে?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ত্রিবেদী ডাক্তারের ধারাবিবরণীতে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন, তারপর কী হল? গজু ছুরি বার করে ভয় দেখাতেই ওরা সরে পড়ল বুঝি?

না, না, প্রশান্ত হাস্যে বিস্তৃত হল ডাক্তারের ওষ্ঠাধর, গজু শুধু দুটো গুণ্ডাকে খুব আস্তে আস্তে ঘুসি মেরেছিল। আর একটা গুণ্ডা ছুরি বার করেছিল বলে তার হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিয়েছিল। বলব কি মশাই, তাতেই দুটো গুণ্ডা পাঁজর-টাজর ভেঙে অজ্ঞান। আর ছুরি হাতে গুণ্ডাটার নাকি হাত ভেঙে গিয়েছিল।

ছুরি দিয়ে ডাবের শাঁস মুখে ফেলে খুব দুঃখিত মুখে গজু বলল, আমি একহাতে কব্জিটা চেপে ধরেছিলাম, তাতেই লোকটার হাত থেকে ছুরি খসে পড়েছিল। আমি সেই ছুরিটা একবারও তুলে নিতে চেষ্টা করিনি। ডাক্তার সাহেব ভুল বলেছে, আমি ছুরি কেড়ে নিই নি।

ঠিক কথা, ডাক্তার মাথা নেড়ে গজুর কথায় সায় দিলেন, আমারই ভুল হয়েছে। ছুরিটা ওই লোকটার হাত থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু–

শঙ্কিতস্বরে ত্রিবেদী বললেন, কিন্তু? আবার কিন্তু কীসের? থামলেন কেন ডাঃ সাটিরা? দুজন অজ্ঞান, একজনের হাত ভেঙে ছুরি মাটিতে পড়ে গেছে, আপনারা নিশ্চয়ই চটপট জায়গাটা থেকে চলে এলেন?

কাঁচুমাচু হয়ে খুব বিনীত ভাবে ডাঃ সাটিরা বললেন, সেইরকমই আমাদের ইচ্ছে ছিল। কিন্তু যে-লোকটার হাত ভেঙে গিয়েছিল সেব্যাটা হাত চেপে ধরে এমন চাঁচাতে শুরু করল যে, আমাদের ভয় হল এখনই সেখানে লোকজন ছুটে আসবে, এমনকি পুলিশও উপস্থিত হতে পারে, তাই–

–তাই কী?

এবার আর ডাক্তার নয়, তাঁর সুযোগ্য সাগরেদ গজু বলে উঠল, তাই খুব আস্তে করে গলা টিপে লোকটাকে চুপ করিয়ে দিলাম।

বলো কি গজু! লোকটাকে গলা টিপে চুপ করিয়ে দিলে! তার মানে লোকটার দম বন্ধ হয়ে সে মারা পড়েছিল?

না, বোধহয়, গজুর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, ছুরিটা বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে বলল, খুব আস্তে গলা টিপেছিলাম তো, বোধহয় মারা যায়নি।

হ্যাঁ, মিঃ ত্রিবেদী, ডাঃ সাটিরা বললেন, খুনোখুনি আমরা পছন্দ করি না। তবে পরিস্থিতি সবসময় তো আমাদের অনুকূলে থাকে না। অবস্থা বিশেষে নিতান্ত বাধ্য হয়েই আমাদের কখনও কখনও অপ্রীতিকর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একবার একটা মা

এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ এক দারুণ হাঁচি দিলেন ডাঃ সাটিরা। হাঁচির ধাক্কা সামলে সবে তিনি মুখ তুলে কথা বলতে যাবেন, এমন সময়ে আবার হল হাঁচির আক্রমণ! পর পর পাঁচটি হাঁচি দিয়ে ম্রিয়মাণ ডাক্তার পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, হাঁচি বড়ো সাংঘাতিক জিনিস, বুঝলেন মিঃ ত্রিবেদী– কিছুতেই সামলানো যায় না।

ত্রিবেদী অপেক্ষা করতে লাগলেন, মুখে মুখে এখনই নিশ্চয় ডাঃ সাটিরা আবার তার ধারাভাষ্য শুরু করবেন। কিন্তু রুমালটা পকেটে রেখে ডাক্তার যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখনই ত্রিবেদী বুঝলেন এইবার তিনি প্রস্থানের উদ্যোগ করছেন ধারাভাষ্য অসমাপ্ত রেখে!

অসমাপ্ত ধারাভাষ্য ত্রিবেদীর মনে আতঙ্কের সঞ্চার করেছিল, তিনি বলে উঠলেন, আপনি বলছিলেন খুনোখুনি পছন্দ না করলেও অবস্থা বিশেষে কখনো কখনো আপনারা অপ্রীতিকর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। একবার একটা মা- পর্যন্ত বলেই হাঁচির ধাক্কায় আপনি থেমে গেলেন। আপনি কি বলতে চাইছিলেন ইচ্ছার বিরুদ্ধেই একবার একটা মানুষকে খুন করতে আপনারা বাধ্য হয়েছিলেন?

ইচ্ছার বিরুদ্ধেই অবশ্য খুনটা করতে বাধ্য হয়েছিল গজু, ডাঃ সাটিরা বললেন, তবে মানুষ নয়, মাসটিফ।

-মাসটিফ!

হ্যাঁ মাসটিফ। আপনি কি কখনো মাসটি কুকুর দেখেননি, মিঃ ত্রিবেদী?

কুকুর! প্রথমে ডাঃ সাটিরার বক্তব্য বুঝতে পারেননি ত্রিবেদী, তারপর তার বোপোদয় হল, বলেন কি ডাঃ সাটিরা! মাসটিফ কুকুর দেখেছি বৈকি! সে তো বাঘের ছোটোখাটো সংস্করণ! অ্যালসেশিয়ন বা ডোবারম্যান তো মাসটিফ-এর তুলনায় দুগ্ধপোষ্য শিশু!

-আপনি ঠিকই বলেছেন মিঃ ত্রিবেদী। ওই মাসটিফ কুকুরটা তেড়ে কামড়াতে এসেছিল আমাদের। তাই গজু নিতান্ত বাধ্য হয়েই ছুরি চার্লিয়েছিল। কুকুরটাকে মেরে ফেলার ইচ্ছা আমাদের ছিল না তাই না গজু?

-আজ্ঞে হ্যাঁ, গজু বলল, কুকুরটা যখন তেড়ে এল, তখন নিজেকে আর ডাক্তারকে বাঁচাতেই ছুরি চার্লিয়েছিলাম। কুকুরটার গলা এত নরম ছিল যে, আস্তে ছুরি চালাতেই তার গলা একেবারে দুর্ফাক হয়ে গেল। বিশ্বাস করুন ত্রিবেদী স্যার, কুকুরটাকে মেরে ফেলার ইচ্ছে আমার ছিল না।

কাঁচুমাচু হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে গজু বুঝিয়ে দিল মাসটিফ কুকুরের অপমৃত্যুতে সে যৎপরোনাস্তি দুঃখিত।

কিন্তু ত্রিবেদী এমন আধখানা বিবরণ শুনে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না, তিনি প্রশ্ন করলেন, কিন্তু মাসটিফ কুকুরটা হঠাৎ আপনাদের আক্রমণ করল কেন?

–আর বলবেন না। বিরক্তভাবে কাঁধ নাচিয়ে ডাঃ সাটিরা বললেন, কুকুরের মালিক মাসটিফকে লেলিয়ে দিয়েছিল যে!

লেলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কেন? বিনা কারণে কেউ কখনো কুকুর লেলিয়ে দেয়? বিশেষ করে মাসটিফ-এর মতো হিংস্র কুকুরকে?

আর বলবেন না মশাই। মাসটিফ-এর মালিকটা ছিল পাজির পাঝাড়া! আমরা খুব বিনীতভাবে তার আলমারির চাবিটা চেয়েচিলুম। চাবি তো দিলই না, উলটে কুকুর লেলিয়ে দিল। এরা কি ভদ্রলোক? ছ্যা, ছ্যা, ছ্যা!

ভদ্রলোকের ভদ্রতাবোধ নিয়ে ত্রিবেদী সংশয় প্রকাশ করলেন না, তিনি জানতে চাইলেন, কুকুরটাকে মারার পরে ভদ্রলোক চাবি দিতে নিশ্চয়ই রাজি হয়েছিলেন?

–না, মশাই। এক-একটা লোক ভারি তাঁদোড় হয়। এই যে চাবি দিচ্ছি বলেই ভদ্রলোক দেরাজ খুলে রিভলভার বার করলেন। কী অসভ্য মানুষ বুঝুন আমরা দু-দুজন ভদ্রলোক অতিশয় বিনীতভাবে তার আলমারির চাবি চাইলুম আর সে কিনা কুকুর লেলিয়ে দিল। তাতে সুবিধা হল না দেখে বার করল রিভলভার! আমরা তো তাকে অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখাইনি, আমাদের সঙ্গে লোকটা কীরকম দুর্ব্যবহার করল, ভেবে দেখুন।

লোকটা খুব দুর্ব্যবহার করেছে, একথা মানতে রাজি হলেন না ত্রিবেদী, আপনারা তার কুকুরটাকে ছুরি মেরে খুন করলেন। তারপর তার আলমারি খুলে তাঁকে সর্বস্বান্ত করতে চাইলেন, তখন যদি ভদ্রলোক রিভলভার বার করেন তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। যাই হোক, তিনি তো আপনাদের গুলি করেননি বা পুলিশে দেননি, তাহলে এই মুহূর্তে আপনারা আমার সামনে বহাল তবিয়তে উপস্থিত থাকতে পারতেন না।

কী যে বলেন স্যার, গজু হাসল, লোকটা নির্ঘাত আমাদের গুলি করত। ছুরি দিয়ে তো আর রিভলভারের মোকাবিলা করা যায় না। সেদিন আর একটু হলেই মারা পড়তাম।

বাঁচলে কি করে?

–ডাক্তার সাহেবই বাঁচালেন। ঝট করে পকেট থেকে নিজের রিভলভার বার করে এত তাড়াতাড়ি গুলি করলেন যে, ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার আগেই লোকটার হয়ে গেল।

–হয়ে গেল, তার মানে? লোকটাকে গুলি চার্লিয়ে মারলেন নাকি ডাঃ সাটিরা?

না, মিঃ ত্রিবেদী, ডাঃ সাটিরা হাসলেন, আমি মনে-প্রাণে অহিংস সহজে গুলি চালাই না। লোকটা যখন রিভলভার বার করল, তখন আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়েই তার কবজিতে একটা ফুটো করে দিলাম।

ত্রিবেদীর চোখে মুখে আতঙ্কের আভাস দেখে তাড়াতাড়ি তাকে সান্ত্বনা দিতে সচেষ্ট হলেন ডাঃ সাটিরা, ভেবে দেখুন, লোকটাকে খুন করে আমরা চাবিটা হাতিয়ে নিতে পারতুম, কিন্তু আমরা তা করিনি। ঘরের ভেতর খোঁজাখুঁজি করে চাবিটা বার করে কাজ হাসিল করলুম। চলে যাওয়ার সময়ে লোকটা চিৎকার করে তোক জমিয়ে ফেলতে পারে ভেবে শ্রীমান গজু তাকে গলা টিপে অজ্ঞান করতে বাধ্য হয়েছিল।

গজু তাড়াতাড়ি প্রতিবাদ জানাল, আমি খুব আস্তে গলা টিপেছিলাম এ কথাটা তো আপনি বললেন না, ডাক্তার!

–-হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব আস্তে গলা টিপেছিল গজু।

ডাঃ সাটিরা ও গজুর উদারতায় খুব মুগ্ধ হলেন না ত্রিবেদী। তিনি সভয়ে প্রশ্ন করলেন, ডাঃ সাটিরা, আপনি কি সবসময় পকেটে রিভলভার নিয়ে ঘোরেন? আমার সঙ্গেও কি আপনি রিভলভার নিয়ে দেখা করতে এসেছেন?

অত্যন্ত লজ্জিতভাবে ডাঃ সাটিরা বললেন, কিন্তু মিঃ ত্রিবেদী, আপনাকে তো আমরা রিভলভার তুলে ভয় দেখাইনি। পুলিশ তো বটেই, তাছাড়া আর দু-একটা ডাকাতের দল আমাদের শত্রু– কাজেই আত্মরক্ষার জন্য আমাকে রিভলভার রাখতে হয়।

খুব ভয়ে ভয়ে থেমে থেমে ত্রিবেদী বললেন, কিন্তু যাঁর কাছে আপনারা চাবি চেয়েছিলেন, সেই ভদ্রলোক তো ইচ্ছে করলেই আপনাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে পারতেন। তিনি রিভলভার বার করার পরে আপনি তাকে গুলি করেছিলেন। ভদ্রলোকের মধ্যে নিশ্চয় একটা ইতস্তত ভাবছিল। তিনি ভয় দেখাতে চেয়েছিলেন, গুলি চার্লিয়ে আপনাদের আহত বা নিহত করতে চাননি।

ত্রিবেদী স্যার, আপনি ডাক্তার সাহেবকে চেনেন না, গজু একগাল হাসল,লোকটার চোখ দেখেই আমরা বুঝেছিলাম ও আমাদের গুলি করবে। কিন্তু সে আমাদের দিকে রিভলভার তা করার আগেই ডাঃ সাহেব পকেট থেকে নিজের রিভলবার বার করে লোকটার ডান হাতের কবজি ফুটো করে দিলেন, ওর হাত থেক অস্ত্রটা পড়ে গেল আর আমরাও বেঁচে গেলাম… ত্রিবেদী স্যার, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না মনে হচ্ছে… ডাক্তার সাব, একবার আপনার কেরামতিটা ত্রিবেদী স্যারকে দেখিয়ে দিন তো।

পরক্ষণেই যা ঘটল, তার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না ত্রিবেদী, ডাঃ সাটিরার দক্ষিণ হস্ত একবার শূন্যে আন্দোলিত হয়েই আবার পকেটে ঢুকে গেল, সঙ্গে সঙ্গে সশব্দে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল কাঁচের গুঁড়ো! ত্রিবেদী দেখলেন মাথার উপর অবস্থিত দুটি বাহু-এর মধ্যে যথাস্থানে বিরাজ করছে একটিমাত্র বাহু, দ্বিতীয়টির হোল্ডার থেকে ঝুলছে অনুপস্থিত বালএর ভগ্নাংশ!

গজু দন্তবিকাশ করল, দেখছেন ডাক্তার সাহেবের হাতের টিপ? আপনি তো রিভলভারটাও দেখতে পাননি, ত্রিবেদী স্যার?

না, কালো মতো কি-যেন একটা দেখেছিলাম মুহূর্তের জন্য, তারপরই সেটা আবার ঢুকে গেল ডাঃ সাটিরার পকেটের মধ্যে, হতবুদ্ধি হয়ে বিভ্রান্ত ত্রিবেদী বললেন, কিন্তু কোনো আওয়াজ তো পেলাম না। বাশ্বটাকে যদি রিভলভার ছুঁড়ে ভাঙা হয়ে থাকে, তবে গুলির শব্দ পেলাম না কেন?

ওটাতে সাইলেন্সার লাগানো ছিল, তাই আওয়াজ হয়নি, উঠে দাঁড়ালেন ডাঃ সাটিরা, আজ আমরা চলি। তিনদিন পর গজুকে আপনার কাছে পাঠাব। এই তিনদিন আপনি চিন্তা করার সময় পাবেন। আমি অবশ্য নিশ্চিত জানি আপনি আমার প্রস্তাবে সায় দেবেন। নমস্কার। চল গজু।

.

০৪. বিপদের বেড়াজাল

দুই মূর্তি স্থানত্যাগ করার পরেও স্থির হয়ে বসে রইলেন অধ্যাপক ত্রিবেদী। একেই বোধহয় বজ্রাহত অবস্থা বলা হয়। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন ত্রিবেদী। তাঁর মাথার মধ্যে তখন চিন্তার আবর্ত

ডাঃ সাটিরা আমাকে একরকম হুমকি দিয়েই গেল। খুব কায়দা করে ডাব খাওয়া আর গল্প বলার ছল করে ছুরি আর রিভলভার দেখিয়ে গেল আমাকে। অর্থাৎ ওর প্রস্তাবে রাজি না হলে ওরা আমায় খুন করবে… আচ্ছা, গোলাপ কলোনি আর বাগনান ক্লাবের ছেলেদের কাছে সাহায্য চাইলে কেমন হয়?… না, ওরা ভাববে ত্রিবেদী স্যার ভয় পেয়েছে.. আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে… তাছাড়া ওরা তো সবসময় আমাকে পাহারা দিতে পারবে না, কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে সাটিরা আর গজু নির্ঘাত আমাকে পাকড়াও করে ফেলবে। ছুরি বা রিভলবার দরকার হবে না। গজু ব্যাটা যদি আস্তে গলা টিপে দেয়, তাহলেই আমি মারা পড়ব!… মহাবিপদে পড়লাম তো… এখন কী করা যায়?…

হঠাৎ ত্রিবেদীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আশ্চর্য-পাতা! ঠিক আশ্চর্য পাতা দিয়েই দুই শয়তানকে ঘায়েল করব। ছুরি ভোলার আগেই এক রদ্দায় গজুকে শুইয়ে দিয়ে ঝাঁপ দেব সাটিরার ঘাড়ে। রিভলভারে হাত দেওয়ার সুযোগই ডাক্তার পাবে না। আশ্চর্য-পাতার আশ্চর্য ক্ষমতা আমার দেহে আনবে অমানুষিক শক্তি আর বিদ্যুতের গতি।

বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের এক ঘুসি বসিয়ে আপন মনেই হেসে উঠলেন ত্রিবেদী, বাড়িতে আর আশ্চর্য-পাতা নেই। হানাবাড়ি থেকে কয়েকটা পাতা আগে নিয়ে আসি, তারপর দেখে নেব দুই শয়তানকে…

হানাবাড়ির ফটকে এসেই থমকে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী। বাড়ির ফটক আজ অরক্ষিত নয়, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক দারোয়ান! দারোয়ানের দেহ দারোয়ানসদৃশ হৃষ্টপুষ্ট, গোঁফজোড়া দস্তুর মতো জমকালো এবং তার হাতে রয়েছে এমন একখানা লাঠি, যার আঘাত মাথায় পড়লে সুন্দরবনের বাঘও অক্কা পাবে- নিতান্তই যদি সে মারা না পড়ে, তাহলেও চিরজীবন তাকে মাথাধরার অসুখে ভুগতে হবে।

ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ত্রিবেদীকে ইতস্তত করতে দেখে দারোয়ান বলল, এ বাবু, আপনি কুথায় যাইবেন?

ত্রিবেদী শুকনো ঠোঁটের উপর জিভ বুলিয়ে নিলেন, এই বাড়িতে কেউ তো থাকত না। তোমরা বুঝি ভাড়া নিয়েছ?

ভাড়া কেন লিবে? এ বাড়ি অনেকদিন পড়িয়ে আসে। এখনো বাবুর লেড়কার শাদি হয়েসেন। তাই ছোটোবাবু বহুজীকে লিয়ে এখানে থাকবেন। তা আপনি এখোন কুথায় যাইতেসেন?

-ইয়ে, আমি, মানে আমি কয়েকটা গাছের পাতা নিতে চাই।

–পাতা! পাতা লিয়ে কী হোবে?

ত্রিবেদী ঢোক গিললেন, ইয়ে কি বলে, ওই পাতার রস খেলে বাত সেরে যায়। আমার আবার বাতের ব্যথা আছে কিনা।

দারোয়ান একগাল হাসল।ছোঃ! উ পাতা-উতা খেয়ে কী হোবে? হামার কথা শোনেন। ডন আউর বৈঠক লাগান, বাত-ফাৎ কুছু থাকবে না– হাঁ।

ডন-বৈঠক?

হ্যাঁ, তিনশো ডন আউর পানশো বৈঠক লাগান রোজ। আপনার বাত জরুর সারিয়ে যাবে।

তিনশো ডন আর পাঁচশো বৈঠক! ত্রিবেদী দারোয়ানের মুখের দিকে চাইলেন, তিনশো ডন আর পাঁচশো বৈঠক দিতে গেলে বাত তো সেরে যাবেই, আমাকেও সরে যেতে হবে দুনিয়া থেকে।

কেয়া?

কিছু না, জোর করে মুখে হাসি টেনে আনলেন ত্রিবেদী, আমি বলছিলাম কি ইয়ে, দারোয়ানজি– তোমাকে দশটা টাকা পান খেতে দিচ্ছি, তুমি আমাকে ওই গাছটা থেকে কয়েকটা পাতা তুলে নিতে দাও।

সীতারাম! সীতারাম! দারোয়ান লাঠি বগলে চেপে দুই হাতে দুই কান স্পর্শ করল, তারপর জিভ কেটে বলল, হামি পান খায় না। আর উ তো ঘুষ আছে। হামার পিতাজি বলিয়েসেন, দেখো হনুমান, তুম্ কভি ঘুষ লিবে না। উ মহাপাপ আছে। ওহি লিয়ে আমি কাভি ঘুষ খায় না– হাঁ।

হতাশ ত্রিবেদী পিছু ফিরলেন, মনে মনে বললেন, এ তো দেখছি পিতৃভক্ত হনুমান। বলে ঘুষ খাব না। কিন্তু দারোয়ানজি ঘুষ না খেলে আমাকে যে খাবি খেতে হবে… ওঃ! ভালো কথা মনে পড়েছে–

ত্রিবেদীর মুখ আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তার মনে পড়ল যেখানে কপাটি খেলা হয়েছিল, সেইখানে মাঠের ধারে ঝোপের মধ্যে তিনি একটা আশ্চর্য পাতার গাছ দেখেছিলেন– যে-গাছটা অত্যন্ত সঙ্গীন মুহূর্তে তার ইজ্জত বাঁচিয়ে দিয়েছিল–

অভীষ্ট স্থানের উদ্দেশ্যে দ্রুতবেগে পা চালালেন তিনি…

কিন্তু জায়গাটায় পৌঁছে অবাক হয়ে গেলেন ত্রিবেদী। ঝোঁপ-জঙ্গল সব সাফ, কিছু নেই ওই সঙ্গে উধাও হয়েছে আশ্চর্য পাতার গাছ!… কিন্তু ব্যাপারটা কী হল? কয়েকদিন আগেও তো ত্রিবেদী এখানে প্রচুর ঝোঁপঝাড় আর আশ্চর্য-পাতার গাছটাকে দেখতে পেয়েছিলেন- এখন সব কিছু পরিষ্কার ঝোঁপঝাড়ের জায়গায় দেখা যাচ্ছে ঘাসে-ভরা একটা জমি আর সেই জমির উপর বসে আড্ডা দিচ্ছে একদল ছেলে-ছোকরা। ত্রিবেদী তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন; প্রশ্ন করলেন, জায়গাটা খুব পরিষ্কার দেখছি। এখানে বাড়ি উঠবে নাকি?

না, না, একটি ছেলে উত্তর দিল, বাড়ি-টাড়ি কিছু হবে না। জায়গাটা আমরাই পরিষ্কার করেছি, মানে–

তাকে বাধা দিয়ে আর একটি ছেলে বলে উঠল, তুই থাম। আমি বলছি। মানে আমরা একটা পল্লী সংস্কার সমিতি করেছি। প্রথমে এখানকার ঝোঁপ-জঙ্গল সাফ করে আমাদের কাজ শুরু হয়েছে। ঝোপঝাড়ে মশা হয়, সাপ থাকে–

ত্রিবেদী বললেন, বলা যায় না, দু-একটা বাঘও হঠাৎ এসে বাসা বাঁধতে পারে।

ঠাট্টা করছেন স্যার?

পাগল! পল্লী সংস্কার অতিশয় মহৎ কার্য। তা নিয়ে ঠাট্টা চলে? ত্রিবেদী হাসলেন, আচ্ছা ভাই, চলি। তোমরা পল্লীসংস্কার চার্লিয়ে যাও।…

বাড়ির পথে চলতে চলতে চিন্তা করছিলেন ত্রিবেদী, ভালো বিপদেই পড়লাম তো! দারোয়ানটা ধর্মপুত্তর যুধিষ্ঠির, বলে ঘুষ খাব না। পাড়ার ছেলেগুলো হয়েছে তেমনি কেন রে বাবা, দুদিন বাদে পল্লীসংস্কার করলে ক্ষতি কী ছিল? আমারই কপাল খারাপ। তবে তিনদিন সময় পাওয়া গেছে। ডা. সাটিরার সাগরেদ গজু আমার বাড়িতে হানা দেবে তিনদিন পরে তার আগেই আমি এখান থেকে সরে পড়ব।

হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে এল হেঁড়ে গলার চিৎকার, এই যে ত্রিবেদী স্যার?

 চমকে পিছন ফিরলেন অধ্যাপক, পরক্ষণেই তাঁর মুখ শুকিয়ে গেল, আরে! গজু যে! কোথায় গিয়েছিলে?

কোথাও যাইনি, স্যার। আসছিলাম।

আসছিলে? কোথা থেকে?

আজ্ঞে, আপনি যেদিক থেকে আসছেন, আমিও সেই দিক থেকে আসছি।

 তার মানে?

 মানে, আপনি যদি কোন বিপদে পড়েন, তাই দূর থেকে আপনার দিকে নজর রাখছিলাম। আপনি তো আমাদের দলে আসছেন, তাই হঠাৎ আপনি যাতে বিপদে না পড়েন, সেটাও তো। আমাদের দেখা উচিত।

কিন্তু হঠাৎ আমি বিপদে পড়ব কেন?

বিপদ-আপদের কথা কী বলা যায়, চোখ টিপে হাসল গজু, দু-দিন বাদেই তো আপনি আমাদের দলে আসছেন, তাই একটা কথা আপনাকে বলে যাই– ডা. সাটিরা আমায় গজু বলে ডাকে, কিন্তু ওই নামে ডাকা আমি পছন্দ করি না। আমার নাম গজানন সরখেল। আপনি আমায় গজানন বলেই ডাকবেন। আচ্ছা, চললাম।

লম্বা লম্বা পা ফেলে অদৃশ্য হল গজানন সরখেল। তার গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ত্রিবেদী, তারপর আবার বাড়ির পথ ধরলেন তার মাথার মধ্যে চিন্তার যন্ত্রটা আবার চলতে শুরু করল পালানো মুশকিল। সাটিরার হুকুমে গজু- না, না, গজানন- আমার উপর নজর রাখছে… ওর নজর এড়িয়ে পালাব কেমন করে? …নাঃ, আর ভাবতে পারছি না.. এই তো বাড়ি এসে পড়েছি। আগে একটু বিশ্রাম করি, তারপর বিপদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একটা উপায় বার করতেই হবে…।

দরজার সামনে এসে চমকে গেলো ত্রিবেদী, দরজাটা হাঁকরে খোলা! সনাতনকে একহাত নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে সশব্দে গৃহপ্রবেশ করলেন তিনি আর সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ের চমক! সোফায় বসে মুখের উপর বই তুলে যে-লোকটা বই পড়ছে, বই-এর আড়ালে তার মুখ ঢাকা পড়লেও রঙিন ডোরাকাটা গেঞ্জি আর রং-চটা জিনসের প্যান্ট দেখেই অতিথির স্বরূপ নির্ণয় করতে ত্রিবেদীর দেরি হল না।

চশমার ভিতর থেকে দুই চোখের দৃষ্টি যথাসাধ্য তীব্র করে চাইলেন ত্রিবেদী– ভুল হচ্ছে না তো?… নাঃ, সেই ডোরাকাটা গেঞ্জি আর জিনসের প্যান্ট। পা দুটো সেন্টার টেবিলের তলায় বলে দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু ত্রিবেদী জানেন ওই পা দুটোতে রয়েছে দুটো কোলাপুরী চটি।

একটু আগেই তার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেছে গজু অন্য একটা রাস্তা ধরে। যে রাস্তা দিয়ে গজু চলে গেছে, সেই রাস্তা ধরেও তাঁর বাড়িতে আসা যায় তবে তাতে অনেক বেশি সময় লাগার কথা। অথচ দেখা যাচ্ছে তার অনেক আগেই গজু পৌঁছে গেছে তার বাড়িতে! ত্রিবেদী বুঝলেন অন্য পথ ধরে খুব দ্রুত হেঁটে সে তাঁর আগেই এই বাড়িতে পৌঁছে গেছে। কিন্তু সনাতন তো বিশেষ পরিচিত না হলে কোনো লোককে মনিবের অনুপস্থিতিতে ঘরে বসায় না, তাকেই বা কোন মন্ত্রে বশ করল গজু? গজুকে দেখে কখনই খুব বইয়ের ভক্ত মনে হয়নি ত্রিবেদীর, সে হঠাৎ তার বৈঠকখানায় বসে পুস্তক পাঠে মনোনিবেশ করল কেন?

ত্রিবেদী একবার গলা খাঁকারি দিলেন, গজু বই থেকে মুখ সরাল না। একটু ইতস্তত করে ত্রিবেদী বললেন, এই যে গজু না, না, গজানন, তুমি যে এত বই ভালোবাসো তাতে জানতাম না। তা ইয়ে গজু না, না, গজানন বইটা বুঝি খুব ভালো? তাই ইয়ে, ওই বইটা মুখ থেকে সরিয়ে কথা কইতে কি তোমার খুব বেশি অসুবিধা হবে?

একটুও অসুবিধা হবে না। আপনি ছিলেন না বলে সদ্য কিনে-আনা ইংরেজি উপন্যাসটা পড়ছিলাম। পাঠকের মুখের উপর থেকে বই সরে এল কোলের উপর। আপনার সঙ্গে কথা কইতেই তো এসেছি।

ত্রিবেদী সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, এ কী! এ তো গজু নয়! এ তো দেখছি

–আপনি যাকে দেখছেন তার নাম গজু অথবা গজানন নয়, আমার একথা বোধ হয় আপনি বিশ্বাস করতে পারেন ত্রিবেদী মশাই।

-নিশ্চয় বিশ্বাস করতে পারি। কিন্তু আমি ভাবতেই পারিনি যে, মুখে আর কপালের ব্যান্ডেজ বেঁধে আমার ঘরে অসময়ে উপস্থিত হয়েছেন ময়ুখ চৌধুরী!… ব্যাপারটা কি বলুন তো? কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিল নিশ্চয় ব্যান্ডেজের ঘটা দেখে মনে হচ্ছে আপনি বেশ ভালোরকম জখম হয়েছেন। কি হয়েছিল ময়ুখবাবু?

-বলছি। তার আগে বলুন তো হঠাৎ আমাকে আপনি গজু বা গজানন নামক ব্যক্তি বলে ভুল করছিলেন কেন?

-ওই লোকটার পরনে ছিল আপনারই মতে ভোরাকাটা গেঞ্জি আর রংচটা জিনসের প্যান্ট! নিতান্তই কাকতালীয় ব্যাপার, ময়ুখ চৌধুরী বললেন, এইরকম ডোরাকাটা গেঞ্জি আর রংচটা জিনসের প্যান্ট দুর্লভ নয়। বহুলোক এগুলো পরে থাকে। দৈবাৎ আপনার গজু বা গজানন আর আমি এই পোশাক পরেছি পরস্পরের অজ্ঞাতসারে। এখন বুঝছি আমার মুখ ঢাকা ছিল বলেই আপনি আমাকে গজু বলে ভুল করেছেন।

শুধু মুখ নয়, আপনার দুই পা ছিল সেন্টার টেবিলের তলায়, ত্রিবেদী বললেন, পা দেখলেও বুঝতে পারতাম বৈঠকখানায় যিনি বসে আছেন, তিনি যে-ই হোন, অন্তত গজানন সরখেল নন।

পা দেখলে বুঝতেন কেমন করে? বলার সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের তলা থেকে পা টেনে এনে সোফার উপর সোজা হয়ে বসলেন ময়ূখ চৌধুরী।

ওই যে আপনার পায়ে রয়েছে একজোড়া মোকাসিন, ওই দুটো দেখেই বুঝতাম মোকাসিনের মালিক গজানন নয়, ত্রিবেদী বললেন, কারণ একটু আগেই তার সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়েছিল, সেইসময় তার পায়ে ছিল কোলাপুরী চটি। তার পায়ে চটি দেখতেই আমি অভ্যস্ত। হঠাৎ পায়াভারি হয়ে চটির পরিবর্তে মোকাসিন চড়িয়ে আমার বাড়িতে হানা দেবে কেন গজু–না, না, গজানন? তাই বলছি গেঞ্জি আর প্যান্ট এক ধরনের বলেই ভুল হয়েছে, কিন্ত আপনার শ্রীচরণ দর্শন করলেই বুঝতে পারতাম গজুর পরিবর্তে অন্য কোনো ব্যক্তি আমার বৈঠকখানা অলঙ্কৃত করেছেন। যাক গে, এবার বলুন আপনার কপালে আর গালে এতবড়ো ব্যান্ডেজ কেন? কী হয়েছিল?

–এমন কিছু নয়। একটু স্নেহের পরশ দিয়েছে হলুদ রাক্ষস।

–হলুদ রাক্ষস! সেটা আবার কেমন বস্তু?

–হলুদ রাক্ষস যে কেমন বস্তু তা আমিও জানি না। তবে তার স্পর্শসুখ আমি অনুভব করেছি।

-আপনার কথায় রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। ব্যাপারটা খুলে বলুন।

–বলছি। প্রফেসর বরেন্দ্রনাথ বসুকে আপনি নিশ্চয়ই জানেন?

–জানি মানে? বরেন তো আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে গবেষণাও করেছি।

–জানি। আপনার মত নাম-ডাক না থাকলেও উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিসাবে বরেন্দ্রনাথ বসুর যথেষ্ট খ্যাতি আছে। তিনি আপনাকে একটি চিঠি দিয়েছেন। আমি সেই চিঠি নিয়ে এসেছি। এই সেই চিঠি।

ময়ুখ চৌধুরীর হাত থেকে একটা খাম নিলেন ত্রিবেদী। খামের মুখ আঠা দিয়ে আটকানো এবং খামের উপর লেখা আছে অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী।

ত্রিবেদী খামটা ছিঁড়ে চিঠি পড়লেন, তারপর ময়ুখ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, শুনুন, বরেন কি লিখেছে- ভাই তিলু, চিঠি পাওয়া মাত্র চলে আসবে। হলুদ রাক্ষসকে নিয়ে ভারি মুশকিলে পড়েছি। ইতি বরেন।

চিঠি নামিয়ে রেখে ত্রিবেদী বললেন, যেতে পারলে তো ভালো হয়। কিন্তু বরেন যে একটা বাঘের মতো কুকুর পুষেছে, সেটার কথা মনে হলেই আর ওদিকে যেতে সাহস হয় না।

মাভৈঃ! ত্রিবেদী মশাই, মাভৈঃ! ময়ূখ চৌধুরী বললেন, বাঘের মতো কুকুর মানে, ডিকের কথা বলছেন তো? ডিক আর নেই। আপনি নির্ভয়ে বরেনবাবুর বাড়ি যেতে পারেন।

নেই। নেই মানে?

–নেই! মানে, নেই। হলুদ রাক্ষস তাকে খতম করে দিয়েছে।

–য়্যাঁ?

–হ্য, মশাই। ভয়ানক কাণ্ড। তবে শুনুন, গত বুধবার সন্ধের পর বরেনবাবুর বাড়ি গেছি আড্ডা দিতে। হঠাৎ শুরু হল ভীষণ বৃষ্টি। বরেনবাবু বললেন, এই বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি যাবেন কি করে? তার চেয়ে ময়ুখবাবু, আপনি এখানেই খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন। কাল সকালে বাড়ি যাবেন।

বরেনবাবুর প্রস্তাবে আপত্তি করলাম না। ভদ্রলোক বিপত্নীক, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। ছেলেমেয়েও নেই। বিজ্ঞান চর্চা করেই দিন কাটাচ্ছেন পরমানন্দে। অতএব আমার দিক থেকেও সঙ্কোচ করার কারণ ছিল না। খাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম দুজনে, তারপর শুয়ে পড়লাম। শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করার আগে অবশ্য ডিক একবার আমার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিল। কুকুরটাকে আমি ভালোবাসতাম। সে বোধহয় আমার মনোভাব বুঝতে পারত। সুযোগ পেলেই আমার কাছে এসে আদর কাড়ার চেষ্টা করত। সেই রাত্রেও বেশ কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে খেলা করে ডিক চলে গেল তার নিজস্ব জায়গায় আর আমিও বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম কিছুক্ষণের মধ্যে।

গভীর রাত্রে হঠাৎ কুকুরের তীব্র আর্ত চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে বাইরে আসতেই বরেনবাবুর সঙ্গে দেখা হল। তিনি আমাকে ঘরে ফিরে যেতে বললেন। আমি বরেনবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার হাতে রয়েছে একটা প্রকাণ্ড পিচকারি! আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বরেনবাবু আবার আমাকে নিজের ঘরে যেতে বললেন। আমি ইতস্তত করছি, হঠাৎ আবার ভেসে এল সেই আর্তনাদ! কুকুরের এমন যাতনাকাতর আর্ত চিৎকার আগে কখনো শুনিনি। ডিক-এর সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল, আর আর্তনাদ শুনে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। যে-ঘর থেকে আর্তনাদ ভেসে আসছিল, সেই ঘরটার দিকে ছুটে গেলাম। অন্ধকার ঘরে ঢুকে আনে টিপতে গেলাম, কিন্তু তার আগেই আমার মুখের উপর চাবুকের মতো কী-যেন একটা আছড়ে পড়ল, আর ভারসাম্য হারিয়ে মেঝের উপর ছিটকে পড়লাম আমি। শক্ত মেঝেতে মাথা ঠুকে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। জ্ঞান ফিরে আসতে দেখলাম বরেনবাবু আমার মুখে কপালে ঔষধ দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছেন। সকালবেলা তার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে চলে এলাম আপনার এই বাড়িতে চলে আসার আগে বরেনবাবুর কাছে শুনেছিলাম আমায় নাকি আক্রমণ করেছিল হলুদ রাক্ষস। মুখে আর কপালে ক্ষতচিহ্নগুলো তারই স্মৃতিচিহ্ন।

–আর ডিক? মানে বরেনের কুকুরের কি হল?

–ত্রিবেদী মশাই, ডিক-এর মৃতদেহ আমি দেখেছি। কুকুরটার চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, জিভটাও প্রায় আধ হাত বেরিয়ে এসেছিল মখের ভিতর থেকে মনে হয় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটেছে। আরও একটা আশ্চর্য ব্যাপার। তার সর্বাঙ্গে ছোটো ছোটো চক্রাকার ক্ষতচিহ্ন দেখেছি আমি। সমস্ত ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়।

-আপনার মুখে ব্যান্ডেজটা একবার খুলে দেখব ময়ূখবাবু? ভয় নেই, আবার ঠিক করে বেঁধে দেব।

-উঁহু, সাতদিনের আগে বরেনবাবু আমায় ব্যান্ডেজ খুলতে নিষেধ করেছেন। সাতদিন পরে ওঁর কাছে গেলে উনি নিজের হাতে আমার ব্যান্ডেজ খুলে দেবেন। বরেনবাবু বলেছেন সাতদিন বাদে নিশ্চয়ই ঘা শুকিয়ে যাবে। যদি না শুকায়, তাহলে যা ব্যবস্থা করা উচিত, তিনি তা করবেন। কিন্তু অন্য কারও সামনে তিনি আমায় ব্যান্ডেজ খুলতে নিষেধ করেছেন।

-ওঃ, তা সে যখন নিষেধ করেছে, তখন আমি আপনাকে ব্যান্ডেজ খুলতে অনুরোধ করব।

বরেনবাবু কিন্তু আমায় একটি অনুরোধ করেছেন। তার হলুদ রাক্ষসের কথা যেন আমি কোথাও না লিখি। আমি যে অধ্যাপক ত্রিবেদীর বিচিত্র কীর্তি নিয়ে একটি বই লিখছি সেকথা বরেনবাবু জানেন। তিনি বলেছেন অধ্যাপক মশাই যদি তার বাড়ি গিয়ে হলুদ রাক্ষসকে নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি থাকেন, তাহলে হলুদ রাক্ষসকে নিয়ে আমি কিছু লিখলে তিনি আপত্তি করবেন না।

–হলুদ রাক্ষসকে তো আপনি চোখেই দেখেননি। তাকে নিয়ে আর কী লিখবেন?

তাকে আমি দেখতে চাই না। শুধু তার স্পর্শের মহিমা অনুভব করেই আমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছে। আপনি তার সঙ্গে দেখা করলে সেই সাক্ষাতের বিবরণ ও পরিণাম আমি পাঠকদের সামনে উপস্থিত করতে পারি। আচ্ছা, আজ আমি চলি ত্রিবেদী মশাই। আপনি বোধহয় দু-এক দিনের মধ্যেই বরেনবাবুর বাড়ি যাচ্ছেন?

-যাওয়ার ইচ্ছা আছে। কিন্তু একটা বিপদের ভয় রয়েছে।

–বিপদ? ওঃ, হলুদ রাক্ষসের কথা ভাবছেন বুঝি?

–না, মশাই। হলুদ রাক্ষস কেমন বস্তু জানি না। তবে সে বোধহয় ডাঃ সাটিরা আর গজাননের চাইতে বেশি ভয়ানক নয়।

–ডাঃ সাটিরা! গজানন! তারা আবার কারা? একটু আগেই গজাননের কথা বলছিলেন না আপনি? যার গেঞ্জি আর প্যান্টের রং ঠিক আমার মতো!

হ্যাঁ। কিন্তু তার পোশাকের সঙ্গে আপনার পোশাকের মিল থাকলেও মানুষ হিসাবে তার সঙ্গে আপনার যথেষ্ট তফাত। লোকটা ভয়ংকর, মানুষ খুন করতে পারে হাসতে হাসতে।

-ও বাবা! আর ডাঃ সাটিরা?

–সে আরও সাংঘাতিক। ওদের কথা আর একদিন বলব ময়ূখবাবু।

–আচ্ছা, আজ তাহলে চলি ত্রিবেদী মশাই। নমস্কার।

–নমস্কার।

 ময়ুখ চৌধুরীকে বিদায় দিয়ে ত্রিবেদী আবার আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বন্ধুবর বরেনের ওখানে যাওয়া যায় কিন্তু গজুর চোখে ধুলো দিয়ে তিনি কি ওখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবেন? ত্রিবেদী একটু আগেই বুঝেছিলেন তাঁর অজ্ঞাতসারে তাকে সর্বদা নজরে রেখেছে গজু তার শ্যেনদৃষ্টিকে কি ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হবে?

বাবু, ত্রিবেদীর চিন্তাস্রোতে বাধা দিল সনাতনের কণ্ঠস্বর, আজ আমাকে ছুটি দিতে হবে। আমি একবার শ্যামবাজারে যাব, কাল বিকেলে ফিরব।

–ও! শ্যামবাজারে তোর সেই পিসির কাছে যাচ্ছিস বুঝি? আচ্ছা যা, কাল বিকেলেই চলে আসবি কিন্তু।

– আজ্ঞে হ্যাঁ।

 ত্রিবেদী দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন, সনাতনের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে যাব। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বাগচি মশাই-এর বাড়িতে দাবা খেলব। তারপর বাড়ি এসে খেয়ে ঘুম। ভোর পাঁচটায় উঠে বরেনের বাড়ি পালাব। অত সকালে বোধহয় গজু ব্যাটা পাহারা দেবে না।

সনাতনকে উদ্দেশ করে হাঁক দিলেন ত্রিবেদী, আমার রাতের খাবারটা তৈরি করছিস তো?

–নিশ্চয়। রান্না আর কিছুক্ষণের মধ্যি হয়ে যাবে।

–বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবিটা তোকে দিয়ে আমি বেরুব। তোর সময় হলে তালা বন্ধ করে যাবি। আর রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রাখতে ভুলবি না-বুঝেছিস? আমার আসতে বেশি রাত হতে পারে।

-আজ্ঞে হ্যাঁ, বাবু।

..অনেক রাত্রে বাগচি মশাই-এর বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ির পথ ধরলেন ত্রিবেদী! দাবার নেশা বড়ো বিশ্রী, রাত বারোটার সময় দুজনের খেয়াল হল এইবার ক্ষান্ত হওয়া উচিত। খুব জোরে জোরে হাঁটতে লাগলেন ত্রিবেদী এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়লেন বাড়ির দরজায়…

কিন্তু ও কী! ত্রিবেদী বিস্মিত চক্ষে দেখলেন তাঁর বাড়ির দোতলার একটি ঘরে আলো জ্বলছে! ত্রিবেদী জানতেন তার অনুপস্থিতিতে পাড়ার ঠাকুর চাকরদের জুটিয়ে তাসের আড্ডা বসায় সনাতন। আগে একবার তাকে নিষেধ করেছেন তিনি। আজ তিনি বেশি রাতে ফিরবেন শুনে সে হয়তো আজ্ঞার লোভ সামলাতে পারেনি, শ্যামবাজারে পিসির বাড়ি না গিয়ে বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে তাস খেলছে- ক্রুদ্ধ ত্রিবেদী মনে মনে স্থির করলেন সনাতনকে খুব একচোট বকাবকি করে তার বন্ধুদের এখনই তাড়িয়ে দেবেন, ত্রিবেদীর পদচালনা দ্রুত থেকে দ্রুততর হল।

দরজার কড়া ধরে নাড়তে গিয়ে ত্রিবেদী লক্ষ করলেন দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে রয়েছে। আস্তে ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। ত্রিবেদী রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন- হতভাগা সনাতন ভেবেছে কী! আড্ডা দিতে এমন মত্ত যে সদর দরজা ভিতর থেকে খিল তুলে বন্ধ করতে ও ভুলে গেছে! ক্রুদ্ধ ত্রিবেদী ঠিক করলেন এমন অবাধ্য আর অমনোযোগী চাকরকে তিনি রাখবেন না। আড্ডাধারীদের হাতে নাতে ধরে ফেলার জন্য তিনি পা টিপে টিপে দোতলায় উঠতে লাগলেন…

আলো জ্বলছিল খাওয়ার ঘরে। অন্ধকার বারান্দা দিয়ে আলো লক্ষ্য করে চলতে চলতে ত্রিবেদী ভাবতে লাগলেন এ বাড়িতে ঘরের তো অভাব নেই, তবে খাওয়ার ঘরে ওরা আড্ডা জমাতে গেল কেন? তবে কি সনাতন ও তার বন্ধুবান্ধব তারই ডাইনিং টেবিল আর চেয়ার সাজিয়ে ভোজনপর্ব চালাচ্ছে? ব্যাপারটা অনুমান করেই তাঁর তপ্ত মেজাজ আরও তপ্ত হয়ে উঠল, সনাতনকে জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্তটা মনে মনে একেবারে পাকা করে নিয়ে তিনি নিঃশব্দে ভোজনকক্ষের জানালায় উঁকি দিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলেন ভীষণভাবে

হ্যাঁ, ভোজনপর্বই চলছে বটে, ডাইনিং টেবিলে স্তূপাকার খাদ্য সাজিয়ে তৃপ্তি সহকারে যে দুই ব্যক্তি আহারে মনোনিবেশ করেছে, তাদের চেহারা দেখলে স্বয়ং গজাননও যে দস্তুরমতো ঘাবড়ে যাবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। দুজনের পোশাক একই রকম, কালো গেঞ্জি আর কালো প্যান্ট। দুজনেই যেমন লম্বা তেমনই চওড়া, তাদের কাঁধ, বুক আর হাতের মাংসপেশী বহু ব্যায়ামবীরেরই ঈর্ষার উদ্রেক করতে পারে। তাদের পা দুটো টেবিলের তলায় দৃষ্টির অন্তরালে ছিল বলে তাদের পদযুগল পাদুকা-সজ্জিত অথবা নগ্ন, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না কিন্তু পুরাতন রীতি-নীতি ত্যাগ করে চেহারাও যে বর্তমান পরিবর্তনশীল জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যথেষ্ট আধুনিক মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে, তাদের সাজসজ্জা দেখে সেকথা অনুমান করতে পারলেন ত্রিবেদী। পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে বেপরোয়া চুরির ঘটনায় গৃহস্থদের মধ্যে যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছে এবং যার ফলে পাড়ার ছেলেরা সারারাত ঘুরে ঘুরে পাহারা দেওয়ার সঙ্কল্প করেছে এরাই যে সেইসব চুরির জন্য দায়ী তা-ও বুঝতে পারলেন অধ্যাপক মশাই। আশ্চর্য-পাতা হাতের কাছে মজুত থাকলে ত্রিবেদী কি করতেন বলা যায় না, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় দুই নরদানবকে বাধা দিতে গেলে সেটা যে আত্মহত্যারই নামান্তর হবে, তা বঝেই সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট রইলেন ত্রিবেদী। তারা যদি পরিতোষ সহকারে ভোজ শেষ করে তারই চোখের সামনে তার জিনিসপত্র নিয়ে সরে পড়ে, তাহলে তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। একমাত্র ভরসা পাড়ার ভ্রাম্যমাণ রক্ষীদল ঘুরতে ঘুরতে তারা এদিকে এসে পড়লে ত্রিবেদীর পক্ষে চোরদের অগোচরে পাহারাদার দলটিকে দুই তস্করের খবর সরবরাহ করা কঠিন হবে না কিন্তু তস্করযুগল যে বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করবে না এবং রক্ষীদলের পক্ষেও যে অক্ষত দেহে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে না, এ বিষয়ে ত্রিবেদী ছিলেন নিশ্চিত।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ত্রিবেদীর পক্ষে যা করা উচিত, তিনি তা-ই করলেন, অর্থাৎ চোরদের অগোচরে জানালার ফাঁক দিয়ে তাদের উপর নজর রাখতে লাগলেন…।

মাংসের হাড় চিবোতে চিবোতে এক ব্যক্তি বলল, কাজ করতে এসে খাওয়াটা উপরি পাওনা হল। মুরগির মাংসটা খাসা বেঁধেছে রে!… ও কী রে! তুই আবার কিসের বোতল নিয়ে এলি?

অপর ব্যক্তি বলল, ঠান্ডা বাসকোর মধ্যে একটা টম্যাটো সস-এর বোতল ছিল। মাংসের সঙ্গে টম্যাটো সস তোফা জমবে।

–তাই নাকি? ঢাল, তবে।

অতিশয় উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ত্রিবেদী দেখলেন সদ্য আবিষ্কৃত যে তরল পদার্থটি তিনি একটা ফাটা বোতলে ভরেছিলেন এবং বোতলটার দুরবস্থা দেখে একটা টম্যাটো সস-এর খালি বোতলে তরল পদার্থটি ঢেলে সেটাকে রেফ্রিজারেটরের শীতল গর্ভে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন– সেই নির্যাসপূর্ণ বোতলটি ঠাণ্ডা বাসকোর ভিতর থেকে বার করে দুই চোর এখন গলাধঃকরণের আয়োজন করছে।

দ্বিতীয় ব্যক্তি বোতলটাকে একটা প্লেটের উপর উপুড় করতেই খানিকটা রক্তবর্ণ তরল পদার্থ প্লেটের শূন্য স্থানকে পূর্ণ করে দিল। সে দিক তাকিয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, এটা মোটেই টম্যাটো সস নয়। টম্যাটো সস এত পাতলা হয় না।

প্রথম ব্যক্তি বলল, ঠান্ডা বাসকোর মধ্যে যখন ছিল, তখন ওটা সস না হলেও খাবার জিনিস তো বটে। একটু চেখে দ্যাখ তো।

প্লেটটা তুলে একটা চুমুক দিয়েই দ্বিতীয় ব্যক্তি সোল্লাসে ঘোষণা করল, এ তো দারুণ জিনিস রে, পচা!

প্লেটটা এক চুমুকে খালি করে সে একটা গেলাস টেনে নিল, এটা গেলাসে ঢেলে খেতে হবে। সস-এর মতো ঘন আর আঠালো নয় জিনিসটা।.

পচা নামক ব্যক্তি বলে উঠল, তাহলে আর একটা গেলাসেও ঢাল। আমিও একটু চেখে দেখি কী-এমন দারুণ জিনিস।

তরল পদার্থটি আর একটি গেলাসে ঢালা হল। এক চুমুক খেয়েই টেবিল চাপড়ে পচা বলে উঠল, চুম্পী রে! এ তো জবর জিনিস! ঢাল ঢাল, ভালো করে ঢাল।…

গেলাসটা মুখ থেকে নামিয়ে হটাৎ সঙ্গীর দিকে তাকাল পচা তার ভুরু কুঁচকে গেছে, চোখ দুটো হয়ে উঠেছে লাল টকটকে,ওরে চুম্পী, খুব তো গিলছিস, সব গুছিয়ে নিয়েছিস তো?

ঘরের কোণে যে মস্ত মুখবাঁধা থলিটা পড়েছিল, তার ফুলে-ওঠা অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় অনেক নিরেট বস্তু ওই থলির ভিতর ভরে দেওয়া হয়েছে। সেইদিকে আঙুল দেখিয়ে চুম্পী বলল, সব ঠিক আছে। ইচ্ছে হলে তুই বাঁধন খুলে দেখতে পারিস।

–ওগুলো আর কী দেখব? একগাদা বাসন, কয়েকটা ফুলদানি আর হাবি-জাবি বিক্রি করে কটা পয়সা পাব? আলমারিটা তত খুলতে পারলি না। সেটা খুললে হয়তো সত্যিকার কিছু মালকড়ি পাওয়া যেত। নগদ টাকা পয়সা তো কিছুই পেলাম না।

আলমারি খোলার চেষ্টা তো করেছি। যে-চাবিটা দিয়ে সব তালা খোলা যায়, সেটাও তো লাগালাম আলমারি তবু খুলল না, লাভের মধ্যে চাবিটাই গেল ভেঙে।

-তা তো ভাঙবেই। এ তো জুতোর চামড়ায় উঁচ ঢোকানোর কাজ নয়, এ হল লোহার আলমারি। এখানে বাবা, চালাকি চলবে না।

খবর্দার পচা, ঠকাস করে হাতের গেলাস টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল চুম্পী, তার চোখ দুটিও তখন রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, কী বলতে চাস তুই?

–আমি বলতে চাই যে আলমারিটা লোহার তৈরি, চামড়ার নয়। চামড়াতে ছুঁচ ঢোকানো যত সহজ, লোহার আলমারির চাবি খোলা অত সহজ নয়।

হঠাৎ চামড়ার কথা উঠল কেন? ছুঁচের কথাই বা আসে কেন?

 –কি জানি, পচা মুখ টিপে হাসল, মনে হল তাই বললাম। তুই অত চটছিস কেন?

–ন্যাকামি হচ্ছে? কেন চটছি জানিস না? আমার বাবা মুচি, জুতো সেলাই করে। তার ব্যাটা আমি, চামড়ার জুতোয় ফোঁড় তুলে সেলাই দিতে পারব কিন্তু লোহার আলমারির তালা তোড়া আমার কম্ম নয়– এই কথাই তো বলতে চাস তুই?

–আমি এসব কথা বলিনি। আমি শুধু বলেছি লোহার আলমারির তালা ভাঙা সহজ নয়। জুতোর চামড়ায় ছুঁচের ফোঁড় দেওয়া তার চাইতে সহজ। তুই শুধু শুধু মেজাজ গরম করছিস। মেজাজ ঠাণ্ডা কর চুম্পী। কামকাজ করতে গেলে মেজাজ ঠান্ডা রাখতে হয় বুঝলি? নে, আর এক পাত্তর চল্।

বোতল থেকে ত্রিবেদীর আবিষ্কৃত তরল নির্যাস আবার পরিবেশিত হল দুটি গেলাসে… দুই চোর নীরবে সেই তরল বস্তু পান করতে লাগল… হঠাৎ চুম্পীর ওষ্ঠাধরে ফুটল হাসির রেখা, ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে সেই মৃদু হাসি ফেটে পড়ল সশব্দ অট্টহাস্যে হা! হা! হা! হা!

ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ সঙ্গীকে তীব্র দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল পচা, তারপর রূঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ এত হাসির ঘটা কেন রে?

–একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল– হা! হা! হা!

–কোন ঘটনা? কী ঘটনা? শুনি তো একবার?

ব্যাপারটা হয়েছিল কি জানিস, চুম্পী হাসতে হাসতে হাতের গেলাসে চুমুক দিল, এক ব্যাটা পকেটমার পকেট কাটতে গিয়ে ধরা পড়েছিল, তখন লোকে তাকে এমন ধোলাই দিল যে, তার একটা হাতই গেল ভেঙে। আমার বাপ মুচি, জুতো সেলাই করে হকের পয়সা খায়– কারও কোনোদিন ক্ষমতা হয়েছে আমার বাবার গায়ে হাত তোলার? সেটি আর বলতে হবে না, হ্যাঁ।

হাতের গেলাস এক চুমুকে খালি করে নামিয়ে রাখল পচা, তুই তো আমার বাবার কথা বলছিস? হ্যাঁ, বাবা পকেটমার ছিল। খুব ওস্তাদ পকেটমার। হঠাৎ একবার ধরা পড়ে গিয়েছিল। তাতে তোর কী? তোর বাপের পকেট মারতে গিয়ে তো ধরা পড়েনি।

আমার বাপের পকেট মারতে গেলে তোর বাপের হাত তত ভাঙতই, ঘাড়ও ভাঙত। আমার বাপ ছিল মস্ত জোয়ান। আমায় দেখে বুঝছিস না?

-হ্যাঁ, তোক দেখে তো বুঝতেই পারছি তোর বাপ কেমন জোয়ান ছিল। বন্ধু বলে কিছু বলি না, নইলে–

— নইলে কী করতি, বল?

–একটি থাপ্পড়ে তোর বদন বিগড়ে দিতাম।

–যা, যা। আর এক জন্ম ঘুরে আসতে হবে।

–তবে রে!

–তবে রে!

পরক্ষণেই শুরু হল শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই!–টেবিল উলটে পড়ল, চেয়ার ভাঙল, গেলাস। আর কাঁচের বাসন ভেঙে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল ভাঙা কাঁচের গুঁড়ো!.. কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল চুম্পী আর পচা নামক দুটি জীবন্ত বিভীষিকা অচৈতন্য হয়ে শুয়ে পড়েছে ঘরের মেঝের উপর তাদের গালে, কপালে, মাথায় দেখা দিয়েছে অনেকগুলো ছোটো বড়ো আল, তাদের ঠোঁট গেছে ফেটে, থেঁতলে গেছে নাক, বন্ধ-হয়ে যাওয়া চোখের চারপাশে কালো হয়ে জমে গেছে রক্ত!

ত্রিবেদী জানলা দিয়ে দৃশ্যটি উপভোগ করলেন, তারপর বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালেন। পাহারাদার ছেলেরা সারারাত পাহারা দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরবে, সুতরাং একসময়ে তারা এখানেও এসে পড়বে। উপরে খাওয়ার ঘরে যারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, ভোরের আগে যে তাদের জ্ঞান ফিরবে না এ বিষয়ে ত্রিবেদী ছিলেন নিশ্চিত। তিনি ছেলেদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন.

একটু পরেই ছেলেরা এসে পড়ল। লোক দুটির অবস্থা দেখে তারা চমকে গেল। একজন তো বলেই ফেলল, আমরা সবাই মিলে ঠ্যাঙালেও এদের এমন অবস্থা করতে পারতাম না। আপনি তো স্যার দারুণ জিনিস দেখছি।

আর একজন বলল, ত্রিবেদী স্যারের গায়ে যে জোর আছে সেকথা কি তুই আজ জানলি? সেদিন কপাটি ম্যাচে দেখলি না গদাই-এর মতো জোয়ানকে স্যার কেমন পটকে দিলেন?

–আরে সেটা হল খেলা। আর এটা যে সাংঘাতিক কাণ্ড, খুনোখুনি ব্যাপার। এদের এক-একটার চেহারা দেখেছিস? গদাই আর বাঘা মুকুন্দ এদের কাছে ছেলেমানুষ।

ওহে তোমরা এদের হাত-পা বেঁধে পুলিশে খবর দাও, ত্রিবেদী বললেন, জ্ঞান ফিরে এলে এরা কি করবে বলা যায় না।

আমাদের লোক চলে গেছে, এখনই পুলিশ নিয়ে ফিরে আসবে। ওদের জ্ঞান ফিরে এলে আবার আমরাই ওদের অজ্ঞান করে দিতে পারব। এতগুলো ছেলের হাত এড়িয়ে ওরা পালাতে পারবে না। এখন বুঝলাম এরাই এতদিন বাড়ি বাড়ি চুরি করেছে। আপনি ছাড়া অন্য কোনো লোক কি এদের ধরতে পারত? পাঁচ-সাতজন একত্র হয়েও এদের ধরতে পারত না মাঝখান থেকে হয়তো দু-একটা লাশ পড়ে যেত। এদের পাকড়াও করে আপনি পাড়ার লোকের ধনপ্রাণ দুই-ই বাঁচিয়েছেন স্যার।

…খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুলিশের ভ্যান উপস্থিত হল অকুস্থলে। তস্করযুগল তখনও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাদের ধরাধরি করে ভ্যানে ভোলা হল। ত্রিবেদীর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে পুলিশ অফিসার বললেন, শুনলাম আপনিই ওদের ধরেছেন? ভবিষ্যতে মেজাজটা একটু সংযত রাখবেন। লোকে দুটোকে তো প্রায় খুন করে ফেলেছেন।

ইয়ে, মানে, ত্রিবেদী আমতা আমতা করে বললেন, মেজাজ খারাপ হলে আমি নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারি না।

—ভবিষ্যতে সামলাতে চেষ্টা করবেন, নইলে একদিন খুনের দায়ে পড়ে যাবেন মশাই।

গাড়িতে ওঠার আগে পুলিশ অফিসার হঠাৎ ত্রিবেদীর দিকে ফিরলেন, তার গম্ভীর মুখে ফুটল হাসির আভাস, আপনাকে দেখলে কিন্তু মনেই হয় না আপনার শরীরে এমন ভীষণ শক্তি। আমরা পাঁচ-ছয় জন মিলেও এই ষণ্ডা দুটোকে এমনভাবে ঠ্যাঙাতে পারতাম না। আপনি বোধহয় মার্শাল আর্ট, অর্থাৎ ক্যারাটে, জুডো প্রভৃতি জানেন- তাই না?

ত্রিবেদী একটু হাসলেন, কথা কইলেন না।

অফিসারও হাসলেন, বুঝেছি, আচ্ছা চলি। আমার কথাটা মনে রাখবেন। আগেও বলেছি, আবারও বলছি– মেজাজ সামলে চলবেন, নয়তো একদিন নির্ঘাত খুনের দায়ে পড়বেন।

অফিসার লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠতেই পুলিশ-ভ্যান চলতে শুরু করল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অন্তর্ধান করল। ছেলের দলও ত্রিবেদীকে অভিনন্দন জানিয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেল। আজ রাতে যে আর পাহারা দেওয়ার দরকার হবে না, সেটা সকলেই বুঝেছিল।

ত্রিবেদী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এতক্ষণ পরে আবার তাঁর মস্তিষ্কে শুরু হয়েছে চিন্তার আলোড়ন, আমার নতুন আবিষ্কারটা আর পরীক্ষা করে দেখার দরকার হল না। চোর দুটোর উপরেই পরীক্ষা হয়ে গেল। মানুষের মন যখন বিষণ্ণ হয়, তখন সে ভেঙে পড়ে। আমি এমন কিছু আবিষ্কার করতে চেয়েছিলাম, যা মানুষকে শোক, দুঃখ, বিষাদ ভুলিয়ে আনন্দে মগ্ন করে দেবে। কিন্তু আমার আবিষ্কৃত এই নির্যাস দেখছি মানুষকে মত্ত করে দেয়, হিংস্র করে তোলে। নাঃ, আমার সব পরিশ্রমই ব্যর্থ হয়েছে, আবার নতুন করে গবেষণা শুরু করতে হবে। অনেক রাত হল, এবার শুয়ে পড়ি।

ত্রিবেদী দরজা বন্ধ করার উদ্যোগ করলেন, কিন্তু হঠাৎ তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল অন্ধকারে দণ্ডায়মান একটি লোকের দিকে তিনি দরজা খোলা রেখেই এগিয়ে গেলেন, কে? কে ওখানে?.. আরে গজু, না, না; গজানন যে! ওখানে দাঁড়িয়ে এত রাত্রে কি করছ তুমি?

না, মানে, গজানন সামনে এগিয়ে এল, এই আপনার যদি কোনো বিপদ হয়, তাই ভেবে

–আমার বিপদ হবে ভেবে রাত দুটোর সময়ে আমার বাড়ির কাছে এসেছে আমায় পাহারা দিতে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, মানে সেইজন্যেই- যদি আপনি বিপদে পড়েন তাই সাহায্য করার জন্যই এসেছিলাম।

-ও।

আচ্ছা ত্রিবেদী স্যার, গজু একবার মাথা চুলকে নিল, তারপর ব্যগ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করল, ওই লোক দুটোকে কি আপনিই পিটিয়েছেন স্যার?

-হ্যাঁ। তুমি তখন কি করছিলে?

-আপনি যখন ওদের পেটাচ্ছিলেন, তখন তো আমি এখানে ছিলাম না। আমি যখন এলাম, তখন লোক দুটোকে ভ্যানে তোলা হচ্ছিল। সেই সময় পুলিশ সার্জেন্ট আপনাকে মেজাজ সামলে চলতে বলছিল স্যার।

–এমনিতে আমার মেজাজ খুব ঠান্ডা। সহজে আমি রাগ করি না। কিন্তু হঠাৎ যদি কোনো কারণে মেজাজ বিগড়ে যায়, তখন আমার আর জ্ঞান থাকে না বুঝেছ?

-হ্যাঁ স্যার, বুঝেছি।

–আরও একটা কথা তোমায় বলে দিচ্ছি। আমার বিপদ নিয়ে যদি বেশি মাথা ঘামাও, তাহলে তুমিও বিপদে পড়বে। আমাকে কেউ সর্বদা চোখে চোখ রাখছে, একথা ভাবলেই আমার মাথায় খুন চেপে যায়- বুঝেছ?

–হ্যাঁ স্যার। না স্যার। মানে, আপনাকে আর কখনো পাহারা দেব না। ঠিক আছে স্যার; আপনি যা বলবেন তা-ই হবে।

শোনো গজু, ত্রিবেদী গজুর মুখের উপর তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন, তোমাকে গজানন বলে আমি ডাকতে পারব না। অত বড়ো নাম উচ্চারণ করতেই আমার কষ্ট হয়। ডাক্তার সাটিরার মতো আমি তোমায় গজু বলেই ডাকব। তুমি কিন্তু রাগ করতে পারবে না।

-না, না, সে কি কথা! আপনার উপর কখনো রাগ করতে পারি?… আচ্ছা স্যার, অনেক রাত হল আজ চলি, পরে দেখা হবে।

.

০৫. হলুদ রাক্ষস

এসো তিলু, বরেনবাবু সাদর অভ্যর্থনা জানালেন, ময়ূখবাবুর হাতে যে চিঠিটা পাঠিয়েছিলাম, সেটা পেয়েই ছুটে এসেছ বোধহয়?

হ্যাঁ। কিন্তু চিঠি পড়ে কিছুই বুঝতে পারলাম না, ত্রিবেদী বললেন, চিঠিতে জানিয়েছ কোন এক হলুদ রাক্ষসকে নিয়ে তুমি নাকি মুশকিলে পড়েছ; অথচ হলুদ রাক্ষস নামক বস্তুটা যে কী, সেকথা পরিষ্কার করে জানাওনি। ময়ুখবাবুর মুখে দেখলাম ব্যান্ডেজ বাঁধা। প্রশ্ন করে জানলাম হলুদ রাক্ষসের স্পর্শে তার মুখে জায়গায় জায়গায় যেসব ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তুমি নাকি স্বহস্তে ওষুধ দিয়ে সেইসব ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে আর সাতদিন আগে ওই ব্যান্ডেজ খুলতে নিষেধ করেছ। অতএব ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে যে, আক্রমণকারীর স্বরূপ নির্ণয়ের চেষ্টা করব, সেই উপায়ও ছিল না। ময়ুখবাবু আরও জানালেন তোমার কুকুর ডিক মারা পড়েছে ওই হলুদ রাক্ষসের হাতে। সব শুনে চলে এলাম তোমার কাছে। এখন এই হলুদ রাক্ষস সম্পর্কে আমার দারুণ কৌতূহল জেগে উঠেছে তুমি তো আর কাউকে এই বস্তুটির চেহারা দেখাওনি, আশা করি আমায় দেখবে।

আরে দেখাব বলেই তো তোমায় ডেকে পাঠিয়েছি। এসো, আমার সঙ্গে।

দোতলা বাড়ি, বরেনবাবু ভাড়াটে নন, তিনি নিজেই বাড়ির মালিক। ভদ্রলোক বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু বিয়ের দু-বছর পরেই তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। আত্মীয়রা তাঁকে আবার বিবাহের পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রথম পক্ষের কোনো সন্তান ছিল না, বরেনবাবুর তৎকালীন বয়সও ছিল খুব কম, স্বচ্ছন্দে তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারতেন। কিন্তু স্ত্রীর অকালমৃত্যু তাঁকে পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা এনে দিল– তিনি আর বিবাহ করলেন না, পূর্ণ উদ্যমে বিজ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করলেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসাবে বরেন্দ্রনাথ বস যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন। করেছিলেন, সুতরাং অধ্যাপক ব্রিলোকনাথ ত্রিবেদীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কিছুদিন পরেই তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠল বন্ধুত্বের বন্ধন। একজন বিপত্নীক, আরেকজন চিরকুমার- দুজনেই গবেষণা করেন উদ্ভিদ নিয়ে– অতএব বন্ধুত্বের বন্ধন দিনে দিনে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে উঠল। কোনো অসুবিধা বা সমস্যার উদ্ভব হলেই একজন আর-একজনকে স্মরণ করতেন। বর্তমানে ত্রিবেদী যে-বিপদে পড়েছিলেন, তা থেকে উদ্ধার লাভের জন্য বরেনবাবুর পরামর্শ গ্রহণ করার কথা ভাবছিলেন তিনি আর ঠিক সেই সময়েই তাঁকে ডেকে পাঠালেন বরেনবাবু।

বরেনবাবুর সঙ্গে দোতলার একটা তালাবন্ধ ঘরের সামনে উপস্থিত হলেন ত্রিবেদী। ঘরে তালা লাগিয়েছ কেন? ত্রিবেদী জানতে চাইলেন, এই ঘরেই বোধহয় হলুদ রাক্ষসকে বন্দি করে রেখেছ তুমি? কিন্তু দরজা খুললেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমায় আক্রমণ করবে না তো?

তালা খুলতে খুলতে বরেনবাবু বললেন, ঝাঁপিয়ে আক্রমণ করার ক্ষমতা হলুদ রাক্ষসের নেই। দরজার কাছে সে আসতে পারবে না। তুমি বেশি ভিতরে যেও না তিলু। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকো।

দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেন বরেনবাবু। ঘরের মধ্যে দুটি জানালার মধ্যে একটি বন্ধ, আর একটি আধখোলা। ওই আধখোলা জানলা দিয়ে সূর্যের আলো আসছে বটে, কিন্তু মস্ত বড়ো ঘরটা সেই স্বল্প আলোকে বিশেষ আলোকিত হয়নি। বদ্ধঘরে সূর্যকিরণের স্পর্শে অস্পষ্ট আলো-আঁধারির মাঝখানে একটি বৃক্ষজাতীয় বস্তুকে দেখতে পেলেন ত্রিবেদী। বৃক্ষ?–হ্যাঁ, গাছের গুঁড়ি আর বটের ঝুরির সঙ্গে ওই বস্তুটির সাদৃশ্য থাকলেও তার দেহকে জড়িয়ে পাতার বাহার কোথাও নেই। মেঝেতে বসানো একটা প্রকাণ্ড টবের ভিতর থেকে সটান ঘরের ছাতের দিকে উঠে গেছে প্রায় আট ফুট দীর্ঘ এক গাছের গুঁড়ি। সেই গাছের গুঁড়ির মাথা থেকে শাখা-প্রশাখা এবং পত্রপল্লবের পরিবর্তে নেমে এসেছে বটগাছের ঝুরির মতো অনেকগুলো ঝুরি বা শিকড়। পত্রপল্লবহীন ওই অদ্ভুত-দর্শন গাছটির রং উজ্জ্বল হলুদ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে গাছটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন অধ্যাপক ত্রিবেদী– এই তাহলে হলুদ রাক্ষস!

বরেনবাবু এগিয়ে গাছের সামনে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে অচল বৃক্ষ হঠাৎ অস্থির আন্দোলনে চঞ্চল হয়ে উঠল– দুটি দীর্ঘ বাহু বা শিকড় বরেনবাবুর দেহের উপর খেলে বেড়াতে শুরু করল– মনে হল গাছটি বরেনবাবুর সর্বাঙ্গে আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

ওই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেলেন ত্রিবেদী, ভালো করে দেখার জন্যে আর একটু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বিদ্যুৎবেগে দুটি শিকড় এগিয়ে এল তার দিকে! শিকড় দুটি বোধহয় নবাগতকে অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিল, কিন্তু বরেনবাবু বাদ সাধলেন চিৎকার করে বন্ধুকে, সাবধান করে এক প্রচণ্ড লম্ফত্যাগ করলেন তিনি এবং শিকড় দুটি ত্রিবেদীর কাছে পৌঁছনোর আগেই বন্ধুর কাছে পৌঁছে গেলেন- পরক্ষণেই বরেনবাবুর দুই হাতের ধাক্কা খেয়ে সশব্দে দরজার উপর ছিটকে পড়লেন ত্রিবেদী।

কোনোরকমে পতন থেকে আত্মরক্ষা করে ত্রিবেদী বন্ধুর দিকে ফিরলেন, ব্যাপার কী? আর একটু হলেই তো মাটিতে আছাড় খেতাম। কোনোমতে সামলে গেছি বটে, কিন্তু কনুইটা দরজায় লেগে এখনও টনটন করছে। তোমার কি হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গেল বরেন?

আমার মাথা খারাপ হয়নি, ক্রুদ্ধস্বরে বরেনবাবু বললেন, তোমার নিজেরই মাথার ঠিক নেই। তোমাকে বেশি ভিতরে আসতে নিষেধ করেছিলাম, তবু তুমি রাক্ষসটার আওতার মধ্যে এগিয়ে আসছিলে কেন?

-রাক্ষস। এই গাছটা তাহলে মাংসভুক? হ্যাঁ, পোকামাকড় ধরে খায় এমন গাছ আছে। জানি। কিন্তু আস্ত একটা মানুষকে খেয়ে ফেলতে পারে, এমন গাছের কথা কোথাও শুনিনি। তাছাড়া তুমি তো একটু আগেই ওর পাশে দাঁড়িয়েছিলে, ওর ওই শুড় না শিকড়- তুমিই জানো ওগুলো কি–ওইগুলো চার্লিয়ে গাছটা তোমায় আদর করছিল বলেই আমার কৌতূহল হয়েছিল, আরও সামনে গিয়ে ব্যাপারটা ভালো করে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমায় এমন একটি ধাক্কা মারলে যে

ধাক্কা মেরেছিলাম বলেই বেঁচে গেলে তিলু, বরেনবাবু বললেন, একবার যদি ও তোমায় জড়িয়ে ধরতে পারত, তাহলে আজ তোমার নিস্তার ছিল না।

-তাই নাকি? কিন্তু তোমায় তো দেখলাম রাক্ষসটা আদর করছিল।

-হ্যাঁ, আমায় ও চেনে। হয়তো গেছো বুদ্ধি দিয়ে ভালোবাসতেও পারে। আমিই তো ওকে খেতে দিই। তবে আমি ছাড়া কেউ ওর কাছে নিরাপদ নয়। আমার চাকর নিধিরাম মাঝে মাঝে ওকে খেতে দেয় বটে, কিন্তু ওর নাগালের মধ্যে কখনো যায় না। এক রাতে দরজায় তালা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, তাই আমার কুকুর দরজা খোলা পেয়ে ওই ঘরে ঢুকেছিল। সে আর জীবন্ত অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি।

ময়ূখবাবুর কাছে ডিকের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি। কিন্তু তার দেহটাকে তো নিটোল অবস্থাতেই দেখেছেন ময়ুখবাবু। কেউ কুকুরটার মাংস খেলে জন্তুটার দেহ হত ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত। সেরকম কিছু তো বলেননি ময়ুখবাবু।

–খুব নিটোল অবস্থায় দেখেছেন? তাহলে বলব ভদ্রলোকের পর্যবেক্ষণ-শক্তি নিতান্ত দুর্বল।

–না, না, ত্রিবেদী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, এবার মনে পড়েছে তিনি বলেছিলেন কুকুরটার মৃতদেহ দেখলে মনে হয় কেউ তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। এছাড়াও তার সর্বাঙ্গে ছোটো ছোটো ক্ষতচিহ্ন ময়ুখবাবুর চোখে পড়েছিল। কিন্তু গাছটা যদি মাংসভুক হত, তাহলে ডিকের শরীরে থাকত হাড়-পাঁজর বার করা গভীর ও রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন। কিন্তু ময়ুখবাবু দেখেছিলেন চাকার মতো গোল গোল ক্ষত, সেগুলো তেমন সাংঘাতিক কিছু নয়। কাজেই তোমার হলুদ রাক্ষসকে মাংসলোলুপ বলে মনে হয় না।

-না, ও মাংসলোলুপ নয়, রক্তলোলুপ!

–রক্তলোলুপ! হলুদ রাক্ষস রক্ত পান করে?

হ্যাঁ। ওই শিকড়গুলোর তলায় অজস্র চক্রাকার শোষকযন্ত্র আছে। শিকড় বা বাহু দিয়ে জড়িয়ে ওই শোষণযন্ত্র দিয়ে সে শিকারের দেহ থেকে রক্ত চুষে নেয়। অবশ্য ওই সঙ্গে শিকারের গলায় বাহু জড়িয়ে তার শ্বাসরোধ করার চেষ্টাও চলে। আমার কুকুর ডিককে ওই ভাবে শ্বাসরোধ করেই বধ করেছিল রাক্ষস।

–এই ভয়াবহ জীবটিকে তুমি সংগ্রহ করলে কোথা থেকে?

–জাপানি প্রফেসর তাগাসাকি বুবুলোনা আমাজন নদীর অববাহিকা থেকে এই জাতের দুটি গাছ সংগ্রহ করেছিলেন। একটি গাছ তিনি আমায় উপহার দিয়েছেন, আর একটি আছে তাঁর নিজস্ব সংগ্রহে।

তাগাসাকি বুবুসোনা! জাপানি বৈজ্ঞানিক। তিনি তাঁর যাবতীয় আবিষ্কারের নমুনা কি জনে জনে বিতরণ করছেন নাকি?

অর্থাৎ? সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন বরেনবাবু, আমি জানি তুমি বুবুসোনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তোমাকেও কি তিনি কিছু উপহার দিয়েছেন?

না, না, বিব্রত হয়ে পড়লেন ত্রিবেদী, আশ্চর্য-পাতার বিষয়টা তিনি এখনই ভাঙতে চাইছিলেন না, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আমাকে বুবুসোনা একটা নমুনা দেখিয়েছিলেন, কোনো কিছু উপহার দেননি। তবে বিজ্ঞানীরা কিছু আবিষ্কার করলে জনসাধারণের সামনে তা উপস্থিত করার আগে কারুকে বিশেষ কিছু জানাতে চান না, তাই বলছিলাম।

বাধা দিয়ে বরেনবাবু বললেন, হলুদ রাক্ষস আমার আবিষ্কার। আমার সৃষ্টি। বুবুসোনা নিমিত্ত মাত্র, কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আমার।

-বুঝলাম না।

-বুঝিয়ে দিচ্ছি। তাগাসাকি বুবুসোনা আমাজন নদীর অববাহিকা থেকে দুটি নতুন ধরনের গাছ আবিষ্কার করেছিলেন। ওই দুটি গাছ পতঙ্গভুক গোষ্ঠীর অন্তর্গত, ইতিপূর্বে তার অস্তিত্ব ছিল মানুষের কাছে অজ্ঞাত। আগেই বলেছি একটি গাছ তিনি আমায় উপহার দিয়েছিলেন। আমি সেই গাছটি নিয়ে নানাধরনের পরীক্ষা চার্লিয়েছি। বুবুসোনার গাছ পূর্ণবয়স্ক হলে চারফুট লম্বা হয়। আমার হলুদ রাক্ষস পূর্ণবয়স্ক হয়নি, এখনই তার দৈর্ঘ্য পাক্কা আট ফুট। না-জানি সে আরও কত বড়ো হবে। এই অত্যাশ্চর্য দৈর্ঘ্য ও মানানসই প্রস্থ কিন্তু গাছটার জন্মগত বৈশিষ্ট্য নয়, আমার আবিষ্কৃত বিভিন্ন ধরনের ওষুধ মেশানো তরল ও নিরেট খাদ্যের মহিমায় হলুদ রাক্ষস নামক এই দানবের জন্ম হয়েছে। অতএব আমি যদি নিজেকে এই বৃক্ষদানবের পিতা বলে দাবি করি, তাহলে দাবিটা বোধহয় নিতান্ত মিথ্যা বলা চলে না– তুমি কি বলো তিলু?

-ঠিক। এই রাক্ষসকে তুমিই জন্ম দিয়েছ, অতএব স্বচ্ছন্দে তুমি এর পিতৃত্ব দাবি করতে পারো। কিন্তু বরেন, এখন তুমি ওকে নিয়ে কি করতে চাও?

সেই বিষয়েই তো তোমার পরামর্শ চাইছি। হলুদ রাক্ষসের খিদে বা রক্তপানের তৃষ্ণা দিন দিন যেভাবে বেড়ে উঠছে, তাতে তার রসদ জোগানো আমার পক্ষে আর বেশিদিন সম্ভব হবে না। প্রথম প্রথম ব্যাঙ, গিরগিটি, ইঁদুর প্রভৃতি চার্লিয়েছি, এখন বোজ পাঁচ থেকে ছয়টি মুরগি দিচ্ছি, কিন্তু তাতে বোধহয় ওর তৃপ্তি বা পুষ্টি হয় না। খাদ্য ছাড়া বাসস্থানের সমস্যাও রয়েছে। যেভাবে ও বাড়ছে, তাতে বড়ো জোর বছর দুই ওই ঘরে ওকে রাখা যাবে। তারপর?

সরকারকে জানালে সরকার নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবে। আরও একটা কথা মনে হচ্ছে আমার ইঁদুর, বেজি প্রভৃতি জীব মানুষের আহার্য শস্য প্রচুর পরিমাণে নষ্ট করে;— সে ক্ষেত্রে হলুদ রাক্ষসের বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে মনুষ্যজাতিরও উপকার করা যায়।

তা হয়তো করা যায়। কিন্তু আমি এখনই আমার আবিষ্কার সরকারের হাতে তুলে দিতে চাই না। হলুদ রাক্ষস রক্তপায়ী জীব হলেও ভালোবাসতে জানে। ও আমায় ভালোবাসে, আমার কথা বুঝতে পারে। ওকে নিয়ে আমি আরও পরীক্ষা করতে চাই।

-তোমার কথা বুঝতে পারে? তাহলে ডিকের মৃত্যু ঘটল কেন?

–ডিক আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি আমি অকুস্থলে উপস্থিত হতে পারতাম, তাহলে ডিকের মৃত্যু হত না। কিন্তু আমি যখন অকুস্থলে হাজির হয়েছিলাম, তখন হলুদ রাক্ষস রক্তপানে উন্মত্ত। তাছাড়া ডিক কিছু নিরীহ জীব নয়, সেও আঁচড়ে কামড়ে গাছটাকে আহত করেছিল। রক্তপায়ী হলেও হলুদ রাক্ষসের শরীর অন্যান্য গাছের মতো শক্ত নয়, প্রায় কলাগাছের মতো নরম। ওঁর শুঁড় বা বাহুগুলো শক্ত রবাবের মতো, তবে ডিক-এর মতো শক্তিশালী হাউন্ডের ধারাল দাঁত হলুদ রাক্ষসের শুঁড় বা দেহকাণ্ডকে মারাত্মকভাবে জখম করতে সমর্থ। আহত হয়ে হলুদ রাক্ষস ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল, তার উপর সে তখন রক্তের নেশায় উন্মত্ত- ওই অবস্থায় তাকে নিবৃত্তি করে আমি ডিককে বাঁচাতে পারিনি।

ময়ুখ চৌধুরী বলছিলেন তুমি নাকি একটা পিচকারি হাতে ছুটে এসেছিলে?

হা, হলুদ রাক্ষসকে জব্দ করার জন্য আমি একটা নির্যাস আবিষ্কার করেছি। পিচকারিতে ওই তরল নির্যাস ভরা ছিল। পিচকারির সাহায্যে উক্ত তরল নির্যাস ছড়িয়ে দিলেই হলুদ রাক্ষস কাবু হয়ে পড়ে। গাছটা তখন অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে, তার পক্ষে সেই সময় আর শিকারকে আঁকড়ে রাখা সম্ভব হয় না। তবে আমাকেও সাবধান থাকতে হয়, নির্যাসের মাত্রা বেশি হলে রক্তপায়ী উদ্ভিদটির মৃত্যু হতে পারে তৎক্ষণাৎ। ডিক আমার আদরের কুকুর, তাকে বাঁচাতে ওই মারাত্মক ঔষুধ প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল, হলুদ রাক্ষস ডিককে ছেড়ে দিলেও তাকে আর বাঁচাতে পারলাম না। শ্বাসরোধ হয়ে কুকুরটার মৃত্যু হয়েছিল। উত্তেজিত অবস্থায় আমিও অতিরিক্ত নির্যাস ছড়িয়ে দিয়েছিলাম গাছটার উপর, ফলে গাছটাও বেশ কয়েকদিন নির্জীব হয়ে পড়েছিল। এক সপ্তাহ ধরে মুরগিরা তার চারপাশে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, তাদের স্পর্শ করতেও চায়নি হলুদ রাক্ষস। সবচেয়ে মজার কথা কি জানো? আমি যে তাকে আঘাত করেছি এটা বুঝলেও গাছটা আমার উপর কখনো প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করেনি। হলুদ রাক্ষস যে আমায় ভালোবাসে, অনেকবারই আমি তার অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি।

হলুদ রাক্ষস যখন এতই বুদ্ধিমান আর তোমাকে সে যখন ভালোবাসে, তখন আমাকে অমন মারাত্মক ধাক্কা না মেরে রাক্ষসটাকেই তো আক্রমণ করতে নিষেধ করা উচিত ছিল তোমার।

নিষেধ বুঝতে তার সময় লাগত। ততক্ষণে রক্তলোলুপ শোষণযন্ত্রগুলো তোমার শরীরে ছোটো ছোটো চক্রাকার ক্ষতের সৃষ্টি করত। আমার উপস্থিতিতে সে তোমাকে কখনই হত্যা করতে পারত না। কিন্তু অনর্থক তোমাকে কয়েকটা কুৎসিত ক্ষত নিয়ে ভুগতে হত। সেই দুর্ভোগ যাতে তোমায় ভুগতে না হয়, সেইজন্যেই ধাক্কা মেরেছিলাম। বুঝেছ তিলু?

বুঝলাম। আমি অবশ্য হলুদ রাক্ষসের মতো সর্বভুক নই, তবে এই মুহূর্তে আমার উদরেও ক্ষুধার অগ্নি অতিশয় জ্বলন্ত। এখন প্রায় এগারোটা, কাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত আমার পেটে এককাপ চা পর্যন্ত পড়েনি।

আরে ছি, ছি, সেকথা বলবে তো? আপাতত রুটি মাখন, ডিম আর চায়ের ব্যবস্থা করছি। তারপর দেখা যাক তোমার উদরের অগ্নিকে প্রশমিত করার জন্যে কোন কোন বস্তুর সমাবেশ ঘটানো যায়।

.

০৬. মৃত্যু আলিঙ্গন

মধ্যাহ্নভোজন বেশ গুরুতরই হয়েছিল। বরেনবাবুর ভৃত্য কয়েক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছে, এখনও ফেরেনি। ঘরের অন্যান্য কাজের সঙ্গে রন্ধনকার্যের ভারও ছিল তার উপর, কিন্তু তার অনুপস্থিতি ত্রিবেদীকে অসুবিধায় ফেলল না; কারণ, বরেণবাবু ছিলেন রন্ধনবিদ্যায় অতিশয় দক্ষ।

খাওয়া-দাওয়ার পর দুই বৈজ্ঞানিক যখন গল্পগুজব করছেন, তখন ত্রিবেদীর মনে হল বন্ধুকে একেবারে অন্ধকারে রাখা উচিত হবে না– ডা. সাটিরা ও গজানন ওরফে গজুর কথাটা বরেনবাবুকে খুলে বললেন ত্রিবেদী। ওই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আশ্চর্য-পাতা সম্বন্ধেও মুখ খুলতে বাধ্য হলেন তিনি। কপাটি খেলায় অসামান্য নৈপুণ্য প্রদর্শনে মুগ্ধ হয়ে ত্রিবেদীকে পূর্বোক্ত দুই সমাজবিরোধী সাগ্রহে দলে টানতে চেয়েছে এমন কথা বরেনবাবু কখনই বিশ্বাস করতেন না তাই আশ্চর্য-পাতার রহস্য বন্ধুর কাছে ব্যক্ত করেছেন ত্রিবেদী এবং বর্তমানে ওই পাতা আর পাওয়া যাচ্ছে না বলেই যে তাঁকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, সে কথাও বললেন। আগের রাতে যা ঘটেছে তার সম্পূর্ণ বিবরণ দিয়ে ত্রিবেদী বললেন, তাগড়া জোয়ান চেহারার চোর দুটোর দুরবস্থা দেখে গজু ব্যাটা ঘাবড়ে গেছে, আর সকলের মতো গজুও ভেবেছে ওদের ওই অবস্থার জন্য ত্রিবেদী স্যারই দায়ী। গজু আমাকে কপাটি প্রতিযোগিতার সময় ছয় সাতজন খেলোয়াড়কে ছিটকে ফেলে দিতে দেখেছে, কাজেই দুটো চোর যতই ষণ্ডা হোক, তাদের ঠেঙিয়ে আধমরা করার ঘটনা গজুর কাছে খুব অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়নি। তারপর পুলিশ অফিসার যখন বলে গেলেন মেজাজ সামলে না চললে ভবিষ্যতে আমায় খুনের দায়ে পড়তে হবে, তখন গজু বিলক্ষণ ভয় পেল। অবশ্য একমুঠো আশ্চর্য পাতা মুখে নিয়ে আমি যদি গজুর মহড়া নিতাম, তাহলে সে জীবনে কোনোদিন কোনো ভদ্র সন্তানকে ভয় দেখাতে সাহস পেত না, একথা আমি জোর গলায় বলতে পারি কিন্তু আশ্চর্য-পাতার সাহায্য ছাড়া আমি একেবারেই অসহায়। বুঝলে বরেন, তোমার এখানে পালিয়ে এসেছি কয়েকদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকব বলে। তারপর এখানে থাকতে থাকতেই হানাবাড়িতে ঢুকে– মানে, এখন আর হানাবাড়ি নয়– সেই বাড়ির বাগানে ঢুকে কেমন করে কিছু আশ্চর্য পাতা হস্তগত করা যায় সেই ফন্দি আঁটতে হবে। ওখান থেকে কিছু পাতা নিয়ে এলে কেউ খেয়াল করত না, কিন্তু এখন যে-দারোয়ান পাহারা দেয়, তার চোখে ধুলো দিয়ে হানাবাড়ির বাগান থেকে আশ্চর্য-পাতা সংগ্রহ করা বেশ কঠিন কাজ। তোমার কাছে আসার পরিকল্পনা আগেই করেছিলাম, খুব ভোরে উঠে গজুর সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে তোমার বাড়িতেই পালিয়ে আসব ভেবেছিলাম কিন্তু হঠাৎ ওই চোর দুটো এসে পড়ায় ঘটনার ধারা বদলে গেল। আমি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে আসি, তখন খুব ভালো করে নজর রেখেছি গজু হতভাগাকে কোথাও দেখতে পাইনি। তোমার এখানে যে আমি এসেছি, এটা ওদের জানা নেই। বেশ কিছুদিন আমি ওদের চোখের আড়ালে থাকলে ওরা আমার সম্পর্কে হতাশ হয়ে এলাকা ছেড়ে সরে পড়বে। সেই কটা দিন আমি তোমার বাড়িতেই অজ্ঞাতবাস করব ভাবছি। বাগচি মশাই-এর বাড়িতে টেলিফোন আছে, তাকে ফোন করে জানিয়ে দেব উনি যেন আমার কাজের লোক সনাতনকে জানিয়ে দেন যে, আমি কিছুদিন বাড়ি থাকব না- সনাতন যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। সব কথাই তোমায় আমি খুলে বললাম বরেন, এখন তোমার মতামত জানাও। আমি যা ভেবেছি সেইভাবে চললে বোধহয় শয়তান দুটোকে ফাঁকি দিতে পারব–তুমি কী বলো?

এতক্ষণ নীরবে বন্ধুর বক্তব্য শুনছিলেন বরেনবাবু, এইবার তিনি মুখ খুললেন, তিলু, তোমার কথায় বুঝলাম চোর দুটোর অবস্থা দেখে গজু ওরফে গজানন ভীষণ ভয় পেয়েছে। তার কাছে সবকিছু শুনে ডা. সাটিরাও যদি ঘাবড়ে যায়, তাহলে তুমি বেঁচে গেলে। কিন্তু সাটিরা কি ভয় পাবে? তোমার কি মনে হয়? তুমি ওদের দুজনকেই দেখেছ, চিনেছ। ওদের মনস্তত্ত্ব আমার চেয়ে তুমিই ভালো বুঝবে।

সাটিরা ভয় পাবে কি না বুঝতে পারছি না, চিন্তিতভাবে ত্রিবেদী বললেন, তবে এটা বুঝেছি সাটিরা হচ্ছে দলের মাথা, তার বুদ্ধিতেই সকলে চলে। গজুটা ষাঁড়ের মতো জোয়ান, কিন্তু মগজে বুদ্ধি নেই একফোঁটা- যাকে বলে বোকার বেহদ্দ। আশ্চর্য-পাতা হাতের নাগালে এলে গজুকে আমি ঘোল খাওয়াতে পারব এই বিশ্বাস আমার আছে; ওর ছুরিসমেত হাতখানা আমি আশ্চর্য-পাতার গুণে এক মোচড়েই ভেঙে দিতে পারব, কিন্তু–

কিন্তু বলে থামলে কেন তিলু?

কিন্তু ডাক্তার সাটিরা দস্তুরমতো ধূর্ত, আর হাতের রিভলবার সে ব্যবহার করতে পারে বিদ্যুদ্বেগে। ভাবতে পারো, এক মুহূর্ত টিপ করার সময় না নিয়ে আমার ঘরের একটা বা সে গুলি চার্লিয়ে উড়িয়ে দিল! এত তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রিভলভার বার করে গুলি চার্লিয়ে আবার পকেটেই অস্ত্রটাকে সে চালান করে দিল যে, আমি রিভলভারটাকে ভালো করে দেখতেই পেলাম না। শুধু মুহূর্তের জন্য তার হাতে কালো রং-এর কী-একটা জিনিস যেন দেখলাম আর ওই খণ্ড মুহূর্তের অবকাশে বস্তুটার স্বরূপ নির্ণয় করতেও আমি পারিনি। লোকটার রিভলভারে আবার শব্দ হয় না, সে সাইলেন্সর ব্যবহার করে। আশ্চর্য-পাতার সহায়তা পেলেও এমন ধূর্ত আর লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত দুবৃত্তের মোকাবিলা করা খুবই কঠিন। গজুটা নিরেট গাধা, কিন্তু সাটিরা দস্তুরমতো বিপজ্জনক। তবে ভরসার কথা যে, আমার বর্তমান ঠিকানা সে জানে না। এবার তার সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার বদলে ধৈর্যের পরীক্ষাই আমায় দিতে হবে। আশা করি সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি জয়লাভ করতে পারব।

আশা করা ভালো, কিন্তু আমি তোমায় আশ্বস্ত করতে পারছি না, তিলু। তুমি আমার পরামর্শ চেয়েছ বলেই বলছি, যে-কোনো সময়ে যে-কোনো জায়গায় সাটিরার সঙ্গে তোমার শুভদৃষ্টি ঘটতে পারে। গজুকে তুমি চেনো, কিন্তু গজু ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি যদি তোমাকে অনুসরণ করে তাহলে সেই লোকটিকে তুমি চিনবে কেমন করে? হয়তো আমার বাড়িতে তোমার উপস্থিতি গুপ্তচরের কল্যাণে সাটিরার অজানা নয়। এই মুহূর্তেই যে তার নিযুক্ত চর তোমার উপর নজর রাখছে না, এমন কথাও জোর করে বলা যায় না।

কী সর্বনাশ, আঁতকে উঠলেন ত্রিবেদী, তাহলে আমি কী করব? কোথায় যাব?

কোথাও যাওয়ার দরকার নেই,বরেনবাবু বললেন, সাটিরা যে তোমার বর্তমান আস্তানার খবর রাখে, এমন কোনো প্রমাণ আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। তুমি বড়ো বেশি নিশ্চিন্ত হচ্ছিলে, তাই একটা বিপজ্জনক সম্ভাবনার কথা তোমাকে জানিয়ে দিলাম। হয়তো তোমাকে কেউ অনুসরণ করেনি, হয়তো সাটিরা বা গজু তোমার বর্তমান আশ্রয়ের খবর রাখে না, কিন্তু যদি তোমার খবর তারা পেয়ে থাকে, তবু

বরেনবাবু উঠে দাঁড়ালেন, তবু এই মুহূর্তে তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। কাল থেকে তোমার উপর দিয়ে উত্তেজনার ঝড় ছুটছে, ক্লান্ত স্নায়ুকে এবার একটু বিশ্রাম দাও। তোমার আজ কর্তব্য হচ্ছে নিবিষ্টচিত্তে নিদ্রাদেবীর আরাধনা। সামনেই তোমার জন্য বিছানা প্রস্তুত রয়েছে, তোমাকে এই মুহূর্ত থেকেই শরীরের প্রতি কর্তব্য পালনের সুযোগ দিয়ে আমি চললাম আমার ঘরে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম গ্রহণের জন্য।

বন্ধুকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বরেনবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ত্রিবেদী এবার বিছানার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনুভব করলেন তাঁর সর্বশরীর এখন ওই বিছানায় আশ্রয়লাভের জন্য অধীর হয়ে উঠেছে- চেয়ার ছেড়ে উঠে তিনি পূর্বোক্ত শয্যার উপর শুয়ে পড়লেন এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার চেতনা…

সন্ধ্যার সময়ে ডাকাডাকি করে ত্রিবেদীর ঘুম ভাঙালেন বরেনবাবু। চা পান করতে করতে কিছুক্ষণ বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করলেন দুই বন্ধু, তারপর বরেনবাবু জানালেন বিশেষ কাজে তাকে একবার বাইরে যেতেই হবে। তবে রাত ন-টার মধ্যে নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে আসবেন, ওই কয়েকঘণ্টার অনুপস্থিতির জন্য বন্ধুবর যেন তাকে ক্ষমা করেন। ত্রিবেদী জানালেন, তার কোনো অসুবিধা হবে না, বরেনবাবুর লাইব্রেরিতে বসে তিনি স্বচ্ছন্দে কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারবেন।

বর্ষাকাল। মাঝে মাঝে মৃদু গম্ভীর গর্জনে আকাশ বুঝিয়ে দিচ্ছে যে-কোনো সময়ে বর্ষণ শুরু হতে পারে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টির ভয়ে কাজের মানুষ ঘরে বসে থাকতে পারে না, তাই আকাশের ক্রুদ্ধ সঙ্কেত তুচ্ছ করেই বেরিয়ে পড়লেন বরেনবাবু…

নটা, সাড়ে নটা নয়, প্রায় এগারোটার সময় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বরেনবাবু বাড়ি ফিরে এলেন। ত্রিবেদীর উদ্বিগ্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, তুমুল বর্ষণের ফলে শহরের বহু রাস্তাই এখন জলের তলায়। ওই সব রাস্তায় যানবাহন বন্ধ হয়ে গেছে। ওই রকম জলমগ্ন পথের উপর অবস্থিত একটি বাড়ির মধ্যে আটকে পড়েছিলেন বরেনবাবু। অবশেষে রাত বাড়ছে দেখে মরিয়া হয়ে তিনি বৃষ্টিপাতের মধ্যেই পথে নেমে পড়লেন এবং অনেকটা রাস্তা হাঁটুজল ভেঙে অগ্রসর হওয়ার পর অপেক্ষাকৃত উঁচু জমির উপর একটা ট্যাক্সি পেয়ে তার সাহায্যেই বাড়ি এসে পৌঁছোতে পেরেছেন।

বরেনবাবু ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টি ছাতার শাসন উপেক্ষা করে তাকে ভিজিয়ে দিয়েছিল। তলায় জলমগ্ন পথ এবং উপরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ তাকে বিলক্ষণ কাবু করে ফেলেছিল, কোনোমতে রাতের আহার শেষ করে ত্রিবেদীকে শুভরাত্রি জানিয়ে তিনি চলে গেলেন নিজস্ব শয়নকক্ষে…

ত্রিবেদী কিছুক্ষণ একটা বই নিয়ে সময় কাটালেন, তারপর আলো নিবিয়ে তিনিও শুয়ে পড়লেন। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে তিনি অনুভব করলেন তার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। সেই তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যেই একটা অজানা বিপদের আশঙ্কা হানা দিচ্ছিল তার মগ্ন চৈতন্যে… একবার তার মনে হল ডিক নামে যে মস্ত কুকুরটাকে তিনি সভয়ে এড়িয়ে চলতেন, এইসময় সে উপস্থিত থাকলে তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পারতেন… অবশেষে একসময়ে সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে নেমে এল সন্তাপহারিণী নিদ্রাদেবীর স্নিগ্ধ আশীর্বাদ, ঘুমিয়ে পড়লেন অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী…

গভীর রাত্রে ত্রিবেদীর ঘুম ভেঙে গেল কে যেন বন্ধ দরজায় ঘন ঘন করাঘাত করছে! বন্ধুর পরামর্শে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলেন ত্রিবেদী, এখন সেই রুদ্ধ দ্বারেই কেউ আঘাত করছে! সভয়ে বিছানার উপর উঠে বসলেন তিনি, প্রথমেই তার মনে হল ডা. সাটিরা আর গজুর কথা– নিচে সদর দরজা অবশ্য ভিতর থেকে বন্ধ, কিন্তু দুই শয়তান যদি গৃহপ্রবেশ করতে বদ্ধপরিকর হয়, তাহলে সদর দরজার খিল আটকে তাদের যে বাধা দেওয়া যাবে না, এ বিষয়ে ত্রিবেদী ছিলেন নিশ্চিত।

দরজায় করাঘাতের শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙে যেতেই ত্রিবেদী ভাবলেন কোনোরকমে সদর দরজার বাধা অতিক্রম করে এখন তার শয়নকক্ষের দরজাকেই আক্রমণ করেছে দুই দুর্বৃত্ত। অবিশ্রান্ত বর্ষণ আর ঘন ঘন বজ্রপাতের শব্দ ভেদ করে অন্য কোনো আওয়াজ নিদ্রিত প্রতিবেশীদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে কি না সন্দেহ। সুতরাং আক্রান্ত হলেও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা নেই।

আবছা অন্ধকারে চারিদিকে একবার দৃষ্টিকে চালনা করলেন ত্রিবেদী ঘরের মাঝখানে রয়েছে একটা টেবিল আর চারটি চেয়ার। ওই জিনিসগুলো টেনে এনে দরজার গায়ে ঠেকা দিয়ে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করা সম্ভব কিনা যখন ভাবছেন তিনি সেইসময় তাকে আশ্বস্ত করে দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এল বরেনবাবুর কণ্ঠস্বর, ওহে তিলু, দরজা খোলো। তোমার কুম্ভকর্ণের ঘুম দেখছি ভাঙতেই চায় না!

তড়াক করে উঠে দরজা খুলে ত্রিবেদী দেখলেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বরেনবাবু, হাতে তার মস্ত বড়ো একটা পিচকারি!

বিস্মিত ত্রিবেদী জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? এত রাত্রে হঠাৎ দরজায় ধাক্কা মেরে আমার ঘুম ভাঙালে কেন?

ভালো করে শোনো তিল, ভালো করে শোনো।

প্রথমে কিছু শুনতে পেলেন না ত্রিবেদী, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই বৃষ্টিপাতের শব্দ ছাপিয়ে আর একটা শব্দ ভেসে এল তার কানে কারা যেন অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না তাদের গলা থেকে বেরিয়ে আসছে অবরুদ্ধ আর্তস্বর! আর শব্দটা আসছে সেই তালাবদ্ধ ঘরটার ভিতর থেকে, যেখানে অবস্থান করছে রক্তলোলুপ হলুদ রাক্ষস!

বরেনবাবর মখের দিকে তাকালেন ত্রিবেদী।বন্ধর নীরব প্রশ্ন বঝলেন বরেনবাব।তিনিও নীরব থেকেই মাথা নেড়ে জানালেন ওই ঘর থেকেই শব্দটা আসছে বটে? বারান্দা পেরিয়ে বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন দুজনে-হা, অস্ফুট কাতর গোঙানি ভেসে আসছে ওই ঘরের ভিতর থেকে।

চাবি সঙ্গেই ছিল, তালা খুলে জোরে ধাক্কা মেরে দরজা খুলে দিলেন বরেনবাবু। বারান্দার আলো আগেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই আলো এসে পড়ল ঘরের ভিতর। সেই স্বল্প আলোতে দুই বন্ধুর চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়াবহ দৃশ্য—

হলুদ রাক্ষসের অনেকগুলো শুঁড়ের কঠিন আলিঙ্গনের মধ্যে স্থির হয়ে রয়েছে ডা. সাটিরা নিস্পন্দ দেহ, তার হাতের রিভলভার মেঝেতে পড়ে আছে এবং তার থেকে একটু দুরেই রাক্ষসের আলিঙ্গন থেকে মুক্তিলাভের আশায় ধস্তাধস্তি করছে গজু, তার হাতের ছুরিও খসে পড়েছে মেঝের উপর!

কয়েক মুহূর্ত দৃশ্যটা তাকিয়ে দেখলেন বরেনবাবু, তারপর দুঃখিতস্বরে বললেন, স্যুট পরা লোকটাই বোধহয় ডা. সাটিরা? তুমি নিশ্চিন্ত থাকো তিলু, সাটিরা আর কোনোদিনই তোমায় বিরক্ত করবে না… ওই বুঝি গজু? লোকটা খুব ষণ্ডা, তাই এখনও লড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওকেও বোধহয় বাঁচানো যাবে না। তবু দেখি একবার চেষ্টা করে।

ঘরে ঢুকে সুইচ টিপলেন বরেনবাবু। তীব্র উজ্জ্বল আলোতে ঝলমল করে উঠল ঘর। ত্রিবেদী দেখলেন আক্রান্ত হয়েও যে, দুই মূর্তি প্রাণপণে লড়াই করেছে, তার চিহ্ন রয়েছে রক্তপায়ী উদ্ভিদের সর্বাঙ্গে। হলুদ রাক্ষসের একটা বাহু ও মূল গুঁড়িটার কয়েকটা ছিদ্র থেকে ঝরছে একরকম ঘন সাদা তরল পদার্থের স্রেত (রক্ত?), স্পষ্টই বোঝা যায় সাটিরার রিভলভারের বুলেট থেকেই ওই ছিদ্রগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। গজুর গলা ও শরীরে যে শুড়গুলো জড়িয়ে রয়েছে, তার মধ্যে কয়েকেটা ছুরির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে- তবু তারা নাছোড়বান্দার মতো আটকে রয়েছে গজুর দেহে। দু-হাত দিয়ে গলা থেকে শুড়ের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে গজু, তার দুই চোখ ঠিকরে যেন বাইরে আসতে চাইছে।

বরেনবাবু এগিয়ে গিয়ে গজুর শরীর থেকে দুটো শুঁড় টেনে ছাড়াতে চেষ্টা করলেন। হলুদ রাক্ষস তার বন্ধন শিথিল করল না। বরেনবাবুর ভ্রূ কুঁচকে গেল, পিচকারিটা মেঝের উপর রেখে হলুদ রাক্ষসের বাহু ধরে সজোরে এক টান মারলেন। হলুদ রাক্ষসের যে শুড় বা বাহুটা গজুর গলা জড়িয়ে ধরেছিল, প্রবল আকর্ষণে সেটা খুলে গেল গলা থেকে সঙ্গে সঙ্গে গজুর ঘাড় ও গলা থেকে ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়ল তপ্ত রক্তের ধারা! ত্রিবেদী বুঝলেন শোষক যন্ত্রগুলি গজুর ঘাড় ও গলা ছেদা করে রক্তপান করছিল, বরেনবাবুর প্রচণ্ড আকর্ষণে বাহুর সঙ্গে সংলগ্ন শোষকযন্ত্রগুলিও সরে এসেছে তাই হঠাৎ ক্ষতস্থানগুলোর মুখ খুলে গিয়ে ছিদ্রপথে রক্তধারা ছিটকে পড়ছে বাইরে।

দুইহাতে বাহুটাকে চেপে রেখেই বরেনবাবু তীব্রকণ্ঠে বললেন, ছেড়ে দে রাক্ষস ছেড়ে দে! বলার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বাহুকে সবলে পা দিয়ে চেপে ধরলেন তিনি। ফল হল তৎক্ষণাৎ গজুকে ছেড়ে ওই দুটি বাহু সাপের মতো কিলবিল করে জড়িয়ে ধরল বরেনবাবুকে!

কী! এত বড়ো স্পর্ধা! ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠে পিচকারিটা মেঝে থেকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন বরেনবাবু।

তার চেষ্টা ব্যর্থ হল– আতঙ্ক-বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে ত্রিবেদী দেখলেন বরেনবাবুকে জড়িয়ে ধরেছে হলুদ রাক্ষসের আরও কয়েকটি বাহু! ছেড়ে দে! ছেড়ে দে আমাকে!বরেনবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন।

হলুদ রাক্ষস তার আদেশ পালন করল না। বরেনবাবুর দেহের উপর গুঁড়ে বন্ধনগুলো যে আরও কঠিন হয়ে চেপে বসছে, তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখেই তা বোঝা যাচ্ছিল। ত্রিবেদীর মনে হল সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় তিনি একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখছেন– দারুণ আতঙ্কে তার সর্বাঙ্গ হয়ে গেল অসাড়, নড়াচড়া করার ক্ষমতাও তার রইল না।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ তিলু? চিৎকার করে উঠলেন বরেনবাবু, পিচকারিটা তুলে নাও। রাক্ষসটা খেপে গেছে, ও এখন আমায় হত্যা করে রক্তপান করতে চায়। তাড়াতাড়ি করো; আমাকে বাঁচাতে চাও তো পিচকারি ছুঁড়ে ওর মর্মস্থানে আঘাত হানো। শুঁড়গুলো ছেড়ে ওর–

পরক্ষণেই একটা শুঁড় বরেনবাবুর গলা জড়িয়ে ধরে তাঁর কণ্ঠরোধ করে দিল।

বন্ধুর বিপন্ন কণ্ঠস্বর মুহূর্তের মধ্যে ত্রিবেদীর সম্বিৎ ফিরিয়ে দিল, তৎক্ষণাৎ সক্রিয় হয়ে উঠল তার বিকল স্নায়ু, নিচু হয়ে মেঝে থেকে পিচকারিটা তুলে নিলেন তিনি বন্ধুর অসমাপ্ত বাক্য থেকেই তাঁর বক্তব্য বুঝতে পেরেছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী- পিচকারি তুলে তিনি নিশানা স্থির করতে লাগলেন…

সপাৎ করে একটা সর্পিল বাহু তাঁর একটা পা জড়িয়ে ধরল, আর একটা বাহু বেষ্টন করল তার কোমর- ত্রিবেদী বিচলিত হলেন না, হলুদ রাক্ষসের বাহুবন্ধন তার শরীরে চেপে বসার আগেই তিনি গাছের মূল কাণ্ড বা গুঁড়ি লক্ষ্য করে পিচকারি ছুড়লেন। একটি তরল পদার্থ পিচকারির মুখ থেকে ছুটে গেল নির্ভুল নিশানায়। গাছের যে-জায়গাটা তরল পদার্থটি ভিজিয়ে দিয়েছিল, সেই জায়গা থেকে উঠে এল খানিকটা নীলাভ ধোঁয়া!

পিচকারির হাতলটা এবার সম্পূর্ণ টেনে নিয়ে সজোরে চাপ দিলেন ত্রিবেদী- তরল নির্যাসের ধারা গাছের গুঁড়িটাকে ভিজিয়ে দিয়ে আবার ছড়িয়ে দিল নীলাভ ধোঁয়ার কুণ্ডলী! ত্রিবেদী আবার হাতল টেনে সজোরে চাপ দিলেন, কিন্তু পিচকারির মুখ থেকে আর তরল মৃত্যুবাণ শত্রুর দিকে ছুটে গেল না- পিচকারির গর্ভ এখন শূন্য, তরল বস্তুটি নিঃশেষে ফুরিয়ে গেছে।

আর দরকার নেই তিলু বরেনবাবুর শরীর থেকে তখন খুলে গেছে শুড়ের বাঁধন, মেঝের উপর বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, সমস্ত নির্যাসটাই তুমি ঢেলে দিয়েছ। আর ঢেলেছ একবারে মর্মস্থানে। হলুদ রাক্ষসের মৃত্যু হয়েছে। সে আর কখনো কোনো প্রাণীর রক্তপান করতে চাইবে না।

মৃত্যু হয়েছে?

হ্যাঁ, প্রচুর পরিমাণে তীব্র বিষ মর্মস্থল ভেদ করেছে। ওই নিদারুণ আঘাত সামলে উঠতে পারেনি হলুদ রাক্ষস। আমার হাতে পিচকারি থাকলে গাছের গোড়ায় একটুখানি ছিটিয়ে দিতাম। তাতেই কাজ হত, গাছটা ওর শুড় বা বাহুগুলো গুটিয়ে নিত। ওকে হত্যা করার প্রয়োজন হত না।

অত পরিমাণ মেপে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তুমি বলেছিলে হলুদ রাক্ষস তোমায় ভালোবাসে। সে নাকি পিচাকরির বিষাক্ত নির্যাসে আহত হয়েও তোমাকে কখনো আক্রমণ করেনি; কিন্তু আজ যদি আমি পিচকারি ছুঁড়ে ওকে বধ না করতাম তাহলে হলুদ রাক্ষসের কবলে তোমার মৃত্যু ছিল অবধারিত। এই গাছটাকে হলুদ রাক্ষস নামটা তুমি ভালোই দিয়েছিলে। এমন সার্থকনামা জীব খুব কমই দেখা যায়। ওটা রাক্ষসের মতোই হিংস্র। রক্তলোলুপ। যে-কোনো কারণেই হোক, গাছটা আগে তোমায় আক্রমণ করেনি, আজ সুযোগ বুঝে শোণিত তৃষ্ণা নিবৃত্ত করতে ও তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তুমি মনে করেছ ও তোমায় ভালোবাসত? ফুঃ! রাক্ষসের আবার ভালোবাসা!

না, তিলু,বরেনবাবু দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লেন, গাছটা সত্যিই আমায় ভালোবাসত। কিন্তু গুলি আর ছুরিতে আহত হয়ে ওর হিংস্র স্বভাব আরও হিংস্র হয়ে উঠেছিল, তার উপর রক্তের নেশায় ও উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল, আপন-পর জ্ঞান আর ওর ছিল না। তুমি কি জানো না, সার্কাসের পোষা বাঘও অনেক সময় রিং মাস্টারকে হত্যা করে? হিংস্র শাপদের বন্য সংস্কার কিছুক্ষণের জন্য তাকে বিভ্রান্ত করে দেয়। তাই বলে তার ভালোবাসা কি মিথ্যে? না, তিলু, না।

একটু থেমে বরেনবাবু আবার বললেন, তবে তুমি না থাকলে আজ আমার মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। এতদিন পর আঘাতের যন্ত্রণা আর রক্তের নেশা যে ওকে সব কিছু ভুলিয়ে ক্ষিপ্ত করে তুলবে, আমি তা বুঝতে পারিনি। যাই হোক, এবার এই অনাহূত অতিথি দুটির দিকে নজর দেওয়া যাক।

..নজর দেওয়ার কিছু ছিল না। সাটিরার মৃত্যু হয়েছিল অনেক আগে। গজু প্রাণপণ যুঝেও শেষরক্ষা করতে পারেনি। হলুদ রাক্ষসের রক্তলোলুপ শুড়গুলো তার শরীর থেকে অনেক রক্ত শুষে নিয়েছিল, তার উপর শ্বাসনালীর উপরেও চাপ পড়েছিল সাংঘাতিক ত্রিবেদীকে উদ্দেশ্য করে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করে নীরব হয়ে গেল গজু ওরফে গজানন, তার মৃত্যু হল…

ওরা দুজনে ঘরে ঢুকল কী ভাবে, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল পর্যবেক্ষণের ফলে। জল নিষ্কাশনের যে পাইপটা হলুদ রাক্ষসের জানালার পাশ দিয়ে উপর থেকে নিচে নেমে গেছে, সেইটা অবলম্বন করেই উপরে উঠে এসেছে দুই মূর্তি, তারপর জানালার গরাদ কেটে ভিতরে প্রবেশ করতেই হলুদ রাক্ষসের কবলে পড়েছে।

সাটিরা আর গজু আমাকেই ধরতে এসেছিল বরেন, ত্রিবেদী বললেন, সাটিরা বুকের উপর রিভলবার ধরে আমায় কিডন্যাপ করত। তুমি বাধা দিলে তোমাকে হত্যা করতে সে কুণ্ঠিত হত না। হলুদ রাক্ষস আমাদের দুজনকেই বাঁচিয়েছে।

বাকি রাতটুকু ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার,বরেনবাবু ক্লান্তস্বরে বললেন, আজ রাতে বৃষ্টি মাথায় করে কয়েক মাইল হেঁটেছি, দুবার আছাড় খেয়েছি এবং দেহের উপর সহ্য করেছি হলুদ রাক্ষসের হামলা। এর উপর আবার পুলিশের ঝামেলা আমার সইবে না। রাতে ঘুমিয়ে শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দি। কাল সকালে পুলিশে খবর দিলেই চলবে। তুমিও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করে নাও, তিলু।

ত্রিবেদী বললেন, অগত্যা।