৪৯তম অধ্যায়
কর্ণকর্ত্তৃক ভানুদেবাদি বীরগণ বধ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর কর্ণ পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট ও যুধিষ্ঠিরসন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া কিরূপে লোকক্ষয় করিল? পাণ্ডবমধ্যে কোন বীর কর্ণকে নিবারণ করিল এবং সূতপুত্র কোন্ কোন্ বীরকে প্রমথিত করিয়া ধর্ম্মরাজের নিপীড়নে প্রবৃত্ত হইল? তুমি এক্ষণে আমার সমক্ষে তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবীর কর্ণ ধৃষ্টদ্যুম্নপ্রমুখ পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণকে সমরে অবস্থিত দেখিয়া সত্বর পাঞ্চালগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন হংসেরা যেমন মহাসাগরাভিমুখে গমন করে, তদ্রূপ পাঞ্চালগণ কর্ণকে দ্রুতবেগে আগমন করিতে দেখিয়া তাঁহার অভিমুখে গমন করিল। অনন্তর উভয়পক্ষে অসংখ্য শঙ্খধ্বনি ও ভয়ঙ্কর ভেরীশব্দ প্রাদুর্ভূত হইল এবং অনবরত শরনিপাতশব্দ, করিবৃংহিত, অশ্বহ্রেষিত, রথের ঘর্ঘর রব ও বীরগণের সিংহনাদ শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। যাবতীয় জীব-জন্তুগণ সেই ভীষণ শব্দ শ্রবণে অদ্রিদ্রুম পরিপূর্ণ অবনীমণ্ডল, সমীরণসমীরিত অষুদপরিশোভিত আকাশ এবং চন্দ্ৰসূৰ্য্য ও গ্রহনক্ষত্রপরিব্যাপ্ত স্বর্গ বিকশিত হইতেছে বিবেচনা করিয়া নিতান্ত ব্যথিত হইল। অল্পসত্ত্ব প্রাণীগণ প্রায় সকলেই কলেবর পরিত্যাগ করিল।
“অনন্তর মহাবীর কর্ণ একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সত্বর শরনিকর পরিত্যাগপূর্ব্বক সুররাজ যেমন অসুরগণকে সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ পাণ্ডবসৈন্যগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। তিনি পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া সপ্তসপ্ততি প্রভদ্রককে শরানলে দগ্ধ করিলেন এবং সুনিশিত পঞ্চবিংশতিশরে পঞ্চবিংশতি পাঞ্চালকে বিনাশ করিয়া অরাতিদেহবিদারণ সুবৰ্ণপুঙ্খ নারাচনিকরে সহস্র সহস্র চেদিদেশীয় বীরকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। তখন পাঞ্চালদেশীয় মহারথগণ সূতপুত্রকে সংগ্রামে অলৌকিক কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে দেখিয়া অবিলম্বে তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিলেন; মহাবীর কর্ণও সত্বর শরাসনে পাঁচ শর সন্ধান করিয়া তাঁহাদের মধ্যে ভানুদেব, চিত্রসেন, সেনাবিন্দু, তপন ও শূরসেনকে বিনাশ করিলেন। তদ্দর্শনে পাঞ্চালগণ হাহাকার করিতে লাগিল। তখন পাঞ্চালদেশীয় আর দশজন মহারথ কর্ণকে পরিবেষ্টন করিলে মহাবীর কর্ণ তাহাদিগকেও অবিলম্বে বিনাশ করিলেন।
ভীষণ সঙ্কুলযুদ্ধ—ভীমকর্ত্তৃক ভানুসেন বধ
“ঐ সময় কর্ণের পুত্র ও চক্ররক্ষক সুষেণ ও সত্যসেন প্রাণপণে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন এবং তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র পৃষ্ঠরক্ষক বৃষসেন যত্নসহকারে তাঁহার পৃষ্ঠরক্ষা করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, বৃকোদর, জনমেজয়, শিখণ্ডী, নকুল, সহদেব, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র এবং প্রবীর, প্রভদ্রক, চেদি, কৈকয়, পাঞ্চাল ও মৎস্যগণ সূতপুত্রকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত তাঁহার প্রতি ধাবমান হইয়া, বর্ষাকালে জলদজাল যেমন মহীধরের উপর বারি বর্ষণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ তাঁহার উপর বিবিধ অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন কর্ণের পুত্রগণ ও তাঁহার পক্ষীয় অন্যান্য বীরসকল তাঁহাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত সেই পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর সুষেণ ভল্লাস্ত্রে ভীমসেনের শরাসন ছেদন করিয়া সাতনারাচে তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন ভীষণ পরাক্রম ভীমসেন সত্বর এক সুদৃঢ় শরাশন গ্রহণ ও তাহাতে জ্যারোপণপূর্ব্বক সুষেণের কার্ম্মুক ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং ক্রোধভরে দশশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া নিশিত ত্রিসপ্ততিবাণে কর্ণকে বিদ্ধ করিলেন। তিনি তৎপরে দশশরে কর্ণের পুত্র ভানুসেনকে বিদ্ধ করিয়া সুহৃগণসমক্ষে ক্ষুরদ্বারা অশ্ব, সারথি, আয়ুধ ও ধ্বজসমভিব্যাহারে তাহার মস্তকচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ভানুসেনের সেই শশধরসদৃশ রমণীয় মস্তক ভীমসেনের ক্ষুরদ্বারা ছিন্ন হইয়া মৃণালভ্রষ্ট কমলের ন্যায় শোভা ধারণ করিল।
“অনন্তর মহাবীর ভীমসেন কৃপ ও কৃতবর্ম্মার কার্ম্মুক ছেদন করিয়া তাঁহাদিগকে ও অন্যান্য বীরগণকে শরনিকরে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন এবং তিনশরে দুঃশাসনকে ও ছয়শরে শকুনিকে বিদ্ধ করিয়া উলূক ও তাঁহার ভ্রাতা পতত্রিকে রথবিহীন করিলেন। তৎপরে তিনি সুষেণকে লক্ষ্য করিয়া ‘হা সুষেণ! তুমি এইবারে নিহত হইলে এই বলিয়া এক সায়ক গ্রহণ করিলে মহাবীর কর্ণ উহা সত্বর ছেদনপূর্ব্বক তিনশরে তাঁহাকে তাড়িত করিলেন। তখন মহাবীর ভীম আর একটি সুতীক্ষ্ণ শর গ্রহণ করিয়া কর্ণপুত্র সুষেণের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। মহারথ কর্ণ তৎক্ষণাৎ উহাও ছেদন করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর তিনি সুষেণকে রক্ষা ও ভীমসেনকে বিনাশ করিবার বাসনায় ত্রিসপ্ততিশরে বৃকোদরকে বিদ্ধ করিলেন। ঐ সময় মহাবীর সুষেণ ভারসহ শরাশন গ্রহণপূর্ব্বক পাঁচবাণে নকুলের বাহু ও বৃক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলে মহাবীর মাদ্ৰীতনয় বিংশতিশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া কর্ণের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন মহারথ সুষেণ দশশরে নকুলকে বিদ্ধ করিয়া ক্ষুরপ্রাস্ত্রে তাঁহার কার্ম্মুকক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর নকুল তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সত্বর অন্য এক শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক নয়শরে সুষেণকে নিবারণ করিলেন এবং তৎপরে অসংখ্যশরে দিঙ্মণ্ডল আচ্ছাদনপূর্ব্বক সুষেণের সারথিকে আহত ও তিনশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া তিনভম্নে তাহার কার্ম্মুক তিন খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন সুষেণ রোষভরে অন্য শরাশন গ্রহণ করিয়া নকুলকে ষষ্টি ও সহদেবকে সাতশরে বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে তাঁহারা বিনাশমানসে সায়কনিকরে পরস্পরকে প্রহার করিতে প্রবৃত্ত হইলে সেই যুদ্ধ সুরাসুরসংগ্রামের ন্যায় ঘোরতর হইয়া উঠিল।
সমরপীড়িত পাণ্ডবপলায়ন
“তখন মহাবীর সাত্যকি তিনশরে বৃষসেনের সারথিকে বিনাশ, একভল্লে শরাসন ছেদন, সাতশরে অশ্ব সংহার ও একবাণে ধ্বজদণ্ডছেদন করিয়া নিশিততিনশরে তাঁহার বক্ষঃস্থলে আঘাত করিলেন। বৃষসেন সাত্যকির শরাঘাতে প্রথমতঃ একান্ত অবসন্ন হইয়া মুহূর্ত্তকালমধ্যে পুনরায় উত্থিত হইলেন এবং সাত্যকিকে সংহার করিবার মানসে খড়্গ ও চর্ম্ম ধারণ করিয়া তাঁহার প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। মহাবীর সাত্যকি বৃষসেনকে মহাবেগে আগমন করিতে দেখিয়া সত্বর দশ বরাহকৰ্ণ অস্ত্রদ্বারা তাঁহার খড়্গ ও চর্ম্ম খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন দুঃশাসন বৃষসেনকে রথশূন্য ও আয়ুধহীন নিরীক্ষণ করিয়া স্বীয় রথে আরোপিত করিয়া অবিলম্বে অন্য একখানি রথ আনয়ন করাইলেন। মহারথ বৃষসেন সেই রথে আরোহণ করিয়া দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রকে ত্রিসপ্ততি, সাত্যকিকে পাঁচ, ভীমসেনকে চতুঃষষ্টি, সহদেবকে পাঁচ, নকুলকে ত্রিংশৎ, শতানীককে সাত, শিখণ্ডীকে দশ, ধর্ম্মরাজকে একশত ও অন্যান্য বীরগণকে বহুসংখ্যক শরে নিপীড়িত করিয়া কর্ণের পৃষ্ঠরক্ষায় প্রবৃত্ত হইলেন।
“ঐ সময় মহাবীর সাত্যকি দুঃশাসনকে নয়শরে বিদ্ধ এবং তাঁহার রথ ও সারথিকে বিনষ্ট করিয়া তাহার ললাটদেশে তিন শর নিক্ষেপ করিলেন। তখন মহাবীর দুঃশাসন পুনরায় অন্য সুসজ্জিত রথে আরোহণপূর্ব্বক সূতপুত্রের সৈন্যগণকে আচ্ছাদিত করিয়া পাণ্ডবগণের সহিত ঘঘারতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন।
“অনন্তর মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন দশ, দ্রৌপধীতনয়গণ ত্রিসপ্ততি, সাত্যকি সাত, ভীমসেন চতুঃষষ্টি, সহদেব সাত, শিখণ্ডী দশ, ধর্ম্মরাজ একশত এবং অন্যান্য বীরগণ অসংখ্যশরে সূতপুত্রকে বিমর্দ্দিত করিলেন। মহাবীর কর্ণও ঐ সমস্ত বীরের প্রত্যেককে দশ দশ শরে বিদ্ধ করিয়া সমরাঙ্গনে বিচরণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় আমরা সূতপুত্রের অস্ত্রবল ও হস্তলাঘব দর্শনে একান্ত বিস্ময়াবিষ্ট হইলাম। তিনি যে ক্রোধভরে কখন অস্ত্র গ্রহণ, কখন সন্ধান আর কখনই বা প্রয়োগ করিতে লাগিলেন, তাহা কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। তৎকালে সকলে কেবল তাঁহার বিপক্ষগণকে নিহত ও সমরাঙ্গনে নিপতিত নিরীক্ষণ করিল। ঐ সময় কর্ণের নিশিতশরনিকরে দিঙ্মণ্ডল, ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল পরিপূর্ণ হইয়া গেল এবং অম্বরতল রক্তবর্ণ অভ্রখণ্ডে সংবৃত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তখন মহাবীর সূতপুত্র শরাসনহস্তে নৃত্য করিয়াই যেন শত্রুগণ তাঁহাকে যাবৎসংখ্যক শরে বিদ্ধ করিয়াছিল, তদপেক্ষা তিনগুণ শরে তাহাদের প্রত্যেককে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় সহস্র সহস্র শরে নিপীড়িত করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ কর্ণের শরে অশ্বরথসমভিব্যাহারে সমাচ্ছন্ন হইয়া তৎক্ষণাৎ অবকাশ প্রদানপূর্ব্বক অপসৃত হইলেন।
“অনন্তর মহাবীর কর্ণ পাণ্ডবগণের করিসৈন্যমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক চেদিদেশীয় ত্রিংশৎ রথীকে বিনাশ করিয়া নিশিতশরনিকরে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তখন ভীমসেন প্রভৃতি পাণ্ডবগণ এবং শিখণ্ডী ও সাত্যকি ধর্ম্মরাজকে রক্ষা করিবার মানসে তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত কৌরবগণও দুর্নিবার কর্ণকে পরমযত্নসহকারে রক্ষা করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সমরাঙ্গনে নানাবিধ বাদ্যধ্বনি ও বীরগণের সিংহনাদ প্রাদুর্ভূত হইল। তখন যুধিষ্ঠিরপ্রমুখ পাণ্ডবগণ ও সূতপুত্র প্রভৃতি কৌরবগণ নির্ভীকচিত্তে পুনরায় সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন।”