৪৯তম অধ্যায়
আত্মার নানাত্ববাদ—সাধনার বিবিধ পথ
“সৰ্ব্বলোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা এই কথা কহিলে, মহর্ষিগণ পুনৰ্ব্বার তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘ভগবন্! ধৰ্ম্মের বিবিধ গতি দর্শন করিয়া আমাদের মোহ উপস্থিত হইয়াছে, সুতরাং কোন্ ধৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য, তাহা আমাদিগের কোনরূপেই বোধগম্য হইতেছে না। ইহলোকে কেহ কেহ দেহনাশের পর আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন, আবার কেহ কেহ কহেন যে, দেহের নাশ হইলেই আত্মার ধ্বংস হয়। কোন কোন ব্যক্তি আত্মার অস্তিত্ববিষয়ে সংশয় করেন এবং কোন কোন ব্যক্তির ঐ বিষয়ে কিছুমাত্র সংশয় নাই। শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদিগের মধ্যে কেহ কেহ আত্মাকে অনিত্য, কেহ কেহ নিত্য, কেহ কেহ ক্ষণভঙ্গুর, কেহ কেহ একমাত্র, কেহ কেহ প্রকৃতি ও পুরুষ এই দ্বিবিধ, কেহ কেহ প্রকৃতির সহিত মিলিত, কেহ কেহ পঞ্চবিধ ও কেহ কেহ বহুবিধ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন।
‘জ্যোতির্ব্বিদ পণ্ডিতেরা দেশ ও কালকে চিরস্থায়ী বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন, আবার কোন কোন ব্যক্তির মতে ঐ মত নিতান্ত হেয়; কেহ কেই জটাবল্কলধারী, কেহ কেহ মুণ্ডিত, এবং কেহ কেহ দিগম্বর হইয়া বিচরণ করিয়া থাকেন। তত্ত্বদর্শী ব্রাহ্মণগণের মধ্যে কেহ কেহ নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্য্য ও কেহ কেহ ব্রহ্মচর্য্যের পর গার্হস্থ্যধৰ্ম আশ্রয় করেন। কোন কোন ব্যক্তিকে ভোজনে আসক্ত ও কোন কোন ব্যক্তিকে ভোজন পরিত্যাগী হইতে দেখা যায়। কেহ কেহ কৰ্ম্মানুষ্ঠানের, কেহ কেহ কৰ্ম্মত্যাগের, কেহ কেহ মোক্ষের ও কেহ কেহ বিবিধ ভোগের সবিশেষ প্রশংসা করিয়া থাকেন। কোন কোন ব্যক্তি প্রভূত ধনলাভের বাসনা করেন এবং কোন কোন ব্যক্তি নির্ধন হইতে নিতান্ত অভিলাষী হয়েন। কেহ কেহ সতত ধ্যানাদির অনুষ্ঠান করেন এবং কোন কোন ব্যক্তির মতে ঐ সমুদয় নিতান্ত অলীক বলিয়া পরিগণিত হয়। কেহ কেহ সতত অহিংসা ধৰ্ম্মে নিরত থাকেন। আবার কেহ কেহ যারপরনাই হিংসাপরায়ণ হন। কেহ কেহ পুণ্যবান ও কেহ কেহ যশস্বী হইয়া কালহরণ করেন এবং কোন কোন ব্যক্তি পুণ্যকে অলীক বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। কোন কোন ব্যক্তিকে সদ্ভাবনিরত ও কোন কোন ব্যক্তিকে সংশয়মার্গে অবস্থিত দেখিতে পাওয়া যায়। কেহ কেহ দুঃখনিবৃত্তি ও কেহ কেহ সুখপ্রাপ্তির অভিলাষে ধ্যান করিয়া থাকেন। কেহ কেহ যজ্ঞের, কেহ কেহ দানের, কেহ কেহ তপস্যার, কেহ কেহ বেদাধ্যয়নের, কেহ কেহ সন্ন্যাসলব্ধ জ্ঞানের ও কেহ কেহ স্বভাবের প্রশংসা করিয়া থাকেন। কাহার কাহার মতে ঐ সমুদয় বিষয়ই প্রশংসনীয়, আবার কেহ কেহ ঐ সমুদয়ের মধ্যে একটিরও প্রশংসা করেন না।
“হে পিতামহ! আমরা ধৰ্ম্মের এইরূপ বিবিধ গতি-দর্শনে নিতান্ত বিমোহিত হইয়া সনাতনধৰ্ম্ম পরিজ্ঞাত হইতে নিতান্ত অসমর্থ হইয়াছি। ইহলোকে মানবগণ ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম্মাবলম্বী হইয়া ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম্মকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি যে ধৰ্ম্মাক্রান্ত হয়েন, তিনি সেই ধর্ম্মের অনুষ্ঠানেই সতত অনুরক্ত থাকেন। এই সমুদয় কারণবশতঃ আমাদিগের মন ও বুদ্ধি নানা দিকে ধাবমান হইতেছে; সুতরাং আমরা শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম্ম কি এবং সত্ত্বগুণের সহিত জীবাত্মার সম্বন্ধ কিরূপ, তাহা কোনরূপেই পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হইতেছি না; অতএব আপনি উহা সবিস্তর আমাদিগের নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”