৪৮তম অধ্যায়
সমরে কর্ণের উৎসাহ-প্ৰকাশ
কৰ্ণ কহিলেন, “কি আশ্চৰ্য্য! সমুদয় ধনুৰ্দ্ধরগণকেই ভীত ও সমরপরাঙ্মুখ দৃষ্ট হইতেছে। ঐ ব্যক্তি মৎস্যরাজই হউক বা অর্জ্জুন হউক, উহার নিকট ভয়ের বিষয় কি? যেমন বেলাভূমি সমুদ্রকে রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, তদ্রূপ আমি উহাকে অনুরোধ করিব, সন্দেহ নাই। মদীয় শরসমূহ শরাসন হইতে মুক্ত হইলে গমনশালী আশীবিষের ন্যায় কখনই প্রত্যাবৃত্ত হইবার নহে। যেমন পতঙ্গকুল পাদপসমূহ আচ্ছন্ন করে, তদ্রূপ আমার রুক্সপুঙ্খ [সুবর্ণপক্ষবিশিষ্ট] সুতীক্ষ্ন শরনিকর পার্থকে সমাচ্ছন্ন করিবে। এক্ষণে শত্রুগণ আহত [আঘাত দ্বারা শব্দিত] ভেরীরবের ন্যায় আমাদিগের শরাসনজ্যানির্ঘোষ ও তলশব্দ শ্রবণ করুক। ত্ৰয়োদশ বৎসর অতীত হইল, অর্জ্জুন আমাকে সংগ্রামে পরাজয় করিবার নিমিত্ত একান্ত সমুৎসুক হইয়াছে, অদ্য এই সংগ্রামে সাতিশয় উৎসাহ সহকারে অবশ্যই আমাকে প্রহার করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। মহাবীর ধনঞ্জয় মদীয় নিশিত শরনিকর সহ্য করিবার উপযুক্ত পাত্র। ঐ মহাবল-পরাক্রান্ত ধনুৰ্দ্ধর ত্ৰিলোকবিশ্রুত। আমিও উহা অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন নহি। অদ্য আকাশমণ্ডল কাঞ্চনময়-পক্ষাচ্ছাদিত মদীয় শরজালে সমাচ্ছন্ন হইয়া পতঙ্গকুলসঙ্কুলের ন্যায় বোধ হইবে।
“আজি আমি সমরে অর্জ্জুনকে সংহার করিয়া দুৰ্য্যোধনসমীপে পূর্ব্বপ্রতিশ্রুত ঋণ পরিশোধ করিব। আজি অৰ্দ্ধপথে বিচ্ছিন্ন শরসমূহে পুঙ্খ-সমুদয় আকাশচারী শলভ [পতঙ্গ]কুলের ন্যায় শোভমান হইবে। যেমন অঙ্কুশ দ্বারা মহাগজকে নিপীড়িত করে, তদ্রূপ আজি আমি মহেন্দ্ৰসমতেজাঃ ধনঞ্জয়কে বাণ দ্বারা ব্যথিত করিব। গরুড় যেমন সপকে অনায়াসে গ্রহণ করে, তদ্রূপ আজি আমি সর্ব্বাস্ত্রবেত্তা অতিরথ পার্থকে আক্রমণ করিব। যেমন সৌদামিনীসনাথ [বিদ্যুৎযুক্ত] জলধর পটল বারি বর্ষণ করিয়া প্রবল হুতাশনকে নির্ব্বাপিত করে, তদ্রূপ আজি আমি রথারোহণপূর্ব্বক শরজাল দ্বারা সেই শত্রুক্ষয়কারী মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডুতনয়কে সংহার করিব। যেমন পন্নগগণ বল্মীক [উইয়ের টিপি] মধ্যে বিলীন হয়, তদ্রূপ মদীয় শর-সমুদয় আজি অর্জ্জুনের শরীরে প্রবিষ্ট হইবে। পর্ব্বত যেমন কণিকার-পুষ্পে ব্যাপ্ত হইয়া থাকে, তদ্রূপ ধনঞ্জয় আজ সুতীক্ষ্ন সুবর্ণপুঙ্খ নতপর্ব্ব মদীয় শরনিবহে পরিবৃত হইবে। আমি মহর্ষিসত্তম পরশুরামের নিকট অস্ত্রশস্ত্র শিক্ষা করিয়াছি, সেই সকল অস্ত্রবলে ও স্বীয় বীৰ্য্যপ্রভাবে আমি অমরগণের সহিতও সংগ্ৰাম করিতে পারি। আজি অর্জ্জুনের ধ্বজাগ্রস্থিত বানর মদীয় ভল্লপ্রহারে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া ভীষণ নিনাদ করিতে করিতে ভূতলে নিপতিত হইবে এবং তত্ৰত্য অন্যান্য প্রাণীগণও মদীয় তীক্ষ্ন-শরপ্ৰহারে বিপন্ন হইয়া গগন-ব্যাপী ঘোরতর শব্দ করিতে করিতে ইতস্ততঃ পলায়ন করিবে। আজি আমি রথ হইতে অর্জ্জুনকে নিপাতিত করিয়া দুর্যোধনের চিরনিহিত হৃদয়শল্য সমূলে উন্মূলনা করিব। আজি কৌরবগণ পুরুষকারসম্পন্ন ধনঞ্জয়কে হতাশ্ব ও বিরথ হইয়া ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গমের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে অবলোকন করিবেন। এক্ষণে তাঁহারা গোধন লইয়া স্বস্থানে প্রস্থান অথবা স্ব স্ব রথে আরোহণপূর্ব্বক আমার সংগ্রাম-নিপুণতা সন্দর্শন করুন।”