ধৃতরাষ্ট্রসমীপে দুৰ্য্যোধনের দৈন্যজ্ঞাপন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, সুবলনন্দন, শকুনি দুৰ্য্যোধনের অভিপ্ৰায় অবগত হইয়া প্রথমেই প্রজ্ঞাচক্ষু মহাপ্ৰাজ্ঞ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে গমন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “মহারাজ! দুৰ্য্যোধন বিবৰ্ণ, পাণ্ডুর, কৃশ, দীন ও চিন্তাপরবশ হইয়াছে; জ্যেষ্ঠ পুত্রের শত্রুজনিত অসহ্য গৃদয়শোক কেন অনুসন্ধান করিতেছেন না?” ধৃতরাষ্ট্র শকুনিপ্রমুখাৎ অবগত হইয়া দুৰ্য্যোধনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস দুৰ্য্যোধন! কি নিমিত্ত তুমি এত কাতর হইয়াছ, যদ্যপি আমার শ্রোতব্য হয়, তাহা হইলে প্ৰকাশ করিয়া বল। তোমার মাতুল কহিতেছেন যে, তুমি বিবৰ্ণ, পাণ্ডুর ও কৃশ হইয়াছ; কিন্তু চিন্তা করিয়াও তোমার শোকের কারণ দেখিতেছি। না। বৎস! প্রচুর ঐশ্বৰ্য্য তোমাতেই প্রতিষ্ঠিত, তোমার ভ্রাতৃগণ ও সুহৃদগণ অপ্রিয়াচরণ করেন না। রাজেচিত পরিচ্ছদ পরিধান ও পিশিতান্ন [সমাংস অন্ন-পোলাও] ভোজন করিতেছ, উত্তমোত্তম তুরঙ্গম তোমাকে বহন করিয়া থাকে; তবে তুমি কি দুঃখে বিবর্ণ ও কৃশ হইতেছ? মহামূল্য শয্যা, মনোহারিণী রমণী, শোভাসম্পন্ন গৃহ ও স্বচ্ছন্দবিহার এই সমস্ত বস্তু দেবতাদিগের ন্যায় তোমার ইচ্ছামাত্র সুলভ, তবে তুমি কি নিমিত্ত দীনের ন্যায় শোক করিতেছ?”
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে তাত! কেবল কালযাপন করিবার নিমিত্ত কাপুরুষের ন্যায় ভোজন, পরিধান ও উগ্ৰতর ক্রোধারণ করিয়াই সন্তুষ্ট রহিয়াছি; কিন্তু যে ব্যক্তি জগতক্ৰোধ হইয়া আপনার প্রজাগণকে বশীভূত রাখিতে পারে এবং অরিগণকে বশীভূত রাখিতে পারে এবং অরি-পরাভব হইতে মুক্তি ইচ্ছা! করে, সেই যথার্থ পুরুষ। মহারাজ! সন্তোষ শ্ৰী ও অভিমানকে নষ্ট করে আর যিনি অনুগ্রহ বা ভয়ের বশীভূত হইয়া চলেন, তিনি কখনও মহত্ত্ব প্রাপ্ত হন না। যেদিন যুধিষ্ঠিরের দীপ্যমান রাজলক্ষ্মী দৃষ্টিগোচর হইয়াছে, তদবধি আমার ভোগ্যবিষয় আর আমাকে পরিতৃপ্ত করিতে পারিতেছে না। আমি সপত্নীগণকে উন্নত ও আপনাকে হীন দেখিতেছি এবং যুধিষ্ঠিরের রাজলক্ষ্মী অদৃশ্য হইলেও আমার নয়নপথে স্পষ্টরূপে আবির্ভূত হইতেছে, এই নিমিত্তই আমি বিবৰ্ণ, পাণ্ডুর ও কৃশ হইয়াছি। যুধিষ্ঠির প্রতিদিন অষ্টাশীতিসহস্ৰ স্নাতক [ব্ৰহ্মচৰ্য্য হইতে যিনি সমাবর্তন করিয়াছেন] ও গৃহমেধ [গাৰ্হস্থ্য গ্রহণপূর্ব্বক বিবাহিত পত্নীতে সন্তানোৎপাদনকারী] কে এবং তাঁহাদিগের প্রত্যেকের জন্য নিযুক্ত ত্রিংশৎ দাসীকে ভরণপোষণ করেন। তাহার আলয়ে অন্যান্য দশসহস্ৰ ব্যক্তি স্বৰ্ণপাত্রে উত্তমান্ন ভোজন করিয়া থাকে, কাম্বোজেরা তাঁহাকে কদলীনামক মৃগের বিচিত্র চর্ম্ম, উৎকৃষ্ট কম্বল, শতসহস্ৰ হস্তী ও ধেনু, শতসহস্ৰ অশ্ব, ত্রিশত উষ্ট্র ও অশ্বতরী প্ৰদান করিয়াছে। সমস্ত রাজমণ্ডলী পূজোপকরণ সমভিব্যাহারে ইন্দ্রপ্রস্থে সমাগত হইয়া সেই পৃথক পৃথক রত্নজাত রাজসূয়-যজ্ঞে কৌন্তেয়কে উপহার দিয়াছে। অধিক কি বলিব, যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞে যাদৃশ ধনাগম হইয়াছে, আমি পূর্ব্বে কোন স্থানে সেরূপ নয়নগোচর বা শ্রবণগোচর করি নাই। সেই অসীম ধনরাশি সপত্নের হস্তগত দৰ্শন করিয়া চিন্তান্বিত হওয়াতে আমি সুখী হইতে পারিতেছি না। স্বর্ণময় কমণ্ডলুধারী শত শত পথিক ব্ৰাহ্মণ গোসমূহ-সমভিব্যাহারে প্রভূত বলি গ্রহণ করিয়া প্রবেশ করিতে না পারিয়া দ্বারদেশে দণ্ডায়মান রহিয়াছিলেন। আমরাঙ্গনারা যেমন অমররাজের নিমিত্ত মধু ধারণ করিয়া থাকে, রাজা যুধিষ্ঠিরের নিমিত্তও সেইরূপ ধারণ করিয়াছিলেন। বাসুদেব বহুরত্নবিভূষিত মহামূল্য শৈক্য [ভারবাহিত জল] ও প্রধান শঙ্খ গ্ৰহণ করিয়া যুধিষ্ঠিরকে অভিষেক করিলেন। শৈক্য লইয়া কেহ কেহ পূর্ব্বসাগরে, কেহ কেহ দক্ষিণ সাগরে, কেহ কেহ বা পশ্চিমসাগরে গমন করিল। উত্তর-সাগরে পক্ষী ব্যতীত কাহারও গতিবিধি নাই, কিন্তু হে পিতঃ! কেমন আশ্চর্য্যের বিষয় শ্রবণ করুন, অর্জ্জুন সেখানেও গমন করিয়া অপরিমিত ধন আহরণ করিয়াছে। লক্ষ ব্ৰাহ্মণের ভোজনক্রিয়া সম্পন্ন হইলে এক একবার শঙ্খনাদ হয়; এইরূপ শঙ্খধ্বনি প্রতিনিয়তই হইয়াছিল, আমি মুহুর্মুহুঃ শঙ্খনাদ শ্রবণ করিয়া রোমাঞ্চিত কলেবর হইয়াছিলাম। সভাস্থান দর্শনাভিলাষী পার্থিবগণে সমাকীর্ণ হইয়া, তারকাসঙ্কুল বিমল নভোমণ্ডলের ন্যায় সুশোভিত হইয়াছিল। পার্থিবগণ বৈশ্যের ন্যায় রত্নজাত লইয়া ধীমান যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞে দ্বিজাতিগণের পরিবেশক হইয়াছিল। মহারাজ! বলিতে কি, যুধিষ্ঠিরের যেরূপ রাজলক্ষ্মী, তাহা দেবরাজেরও নাই, যমরাজেরও নাই, বরুণেরও নাই এবং গুহকাধিপতিরও নাই। সেই শ্ৰী দেখিয়া অবধি আমার মন এরূপ পরিতপ্ত হইয়াছে যে, আমি আর শান্তিলাভ করিতে সমর্থ হইতেছি না।”
পাশদ্যূতে যুধিষ্ঠিরের আহ্বানপরামর্শ
দুৰ্য্যোধনের বাক্যাবসানে শকুনি দুৰ্য্যোধনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে সত্যপরাক্রম! পাণ্ডবে যে অনুপম রাজলক্ষ্মী দৃষ্টিগোচর করিয়াছ, তৎপ্রাপ্তির উপায় শ্রবণ করা। আমি অক্ষবিষয়ে অভিজ্ঞ, মর্ম্মজ্ঞ, পণজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞ; যুধিষ্ঠিরও দ্যূতপ্রিয়, কিন্তু তদ্বিষয়ে তাহার অভিজ্ঞতা নাই। ক্ষত্ৰিয়রীতানুসারে দ্যূতের বা রণের নিমিত্ত আহূত হইলে অবশ্য তাহাকে আসিতে হইবে, অতএব তাহাকে আহ্বান কর। আমি কপট ক্রীড়ায় পরাজয় করিয়া তাহার সেই দিব্য সমৃদ্ধি আনয়ন করিব সন্দেহ নাই।” দুৰ্য্যোধন শকুনির বাচনাবসান হইবামাত্র ধৃতরাষ্ট্রকে কহিলেন, “হে রাজন! অক্ষবিৎ গান্ধাররাজ দ্যূত দ্বারা পাণ্ডুপুত্রের রাজলক্ষ্মী হরণ করিতে উৎসাহিত হইয়াছেন, আপনি অনুমতি করুন।”
দ্যূতে বিদুরের অসম্মতি
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “মহাপ্রাজ্ঞ বিদুর আমাদের মন্ত্রী; আমি তাঁহার শাসনানুবর্তী; অতএব তাহার সহিত মিলিত হইয়া কিংকর্তব্যতার অবধারণ করিব। তিনি দূরদর্শিতাপ্রভাবে উভয় পক্ষের হিতকর ও ধর্ম্মানুগত মন্ত্রণা দিবেন।” দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে রাজেন্দ্ৰ! যদি বিদুর আগমন করেন, তারা হইলে আপনাকে নিবারণ করিবেন; আপনি নিবৃত্ত হইলে আমি নিঃসন্দেহ প্রাণত্যাগ করিব।” ধৃতরাষ্ট্র দুৰ্য্যোধনের বিনয়গর্ভ কাতরবাক্য শ্রবণ করিয়া তন্মতস্থ হইয়া অনুচরবর্গকে কহিলেন, “শিল্পীগণকে আনাইয়া স্থূণা সহস্ৰশোভিত শতদ্বারবিশিষ্ট লোচনলোভনীয় এক সভা নির্ম্মাণ করাও, পরে তাহা রত্নাস্তরণমণ্ডিত ও সুপ্ৰবেশ্য করিয়া আমাকে নিবেদন করিবে।” ধৃতরাষ্ট্র দুৰ্য্যোধনের পরিতাপশান্তির নিমিত্ত কেবল অপত্যস্নেহের অনুরোধে পূর্বোক্ত অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন, কিন্তু অক্ষক্রীড়া বহু দোষকর জানিয়া এবং বিদুরকে জিজ্ঞাসা না করিয়া কিছুই নিশ্চয় করা হইবে না, এই বিবেচনা করিয়া বিদুরের নিকট সংবাদ পঠাইয়া দিলেন। ধীমান বিদুর কলহের দ্বারস্বরূপ ও বিনাশের মুখস্বরূপ পাশক্রীড়ার সংবাদ শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ব্যগ্রতাসহকারে জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্রের নিকট গমন করিয়া পাদবন্দনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে রাজন! আপনার এই ব্যবসায়ে অনুমোদন করিতে পারি না; যাহাতে দ্যূতের নিমিত্ত পুত্ৰগণের পরস্পর বিরোধ উপস্থিত না হয়, তাহা করুন।” ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে বিদুর! যদি দেবগণ অপ্ৰসন্ন হন, তথাপি আমার পুত্ৰগণের মধ্যে কলহ হইবে না। আমি, তুমি, দ্রোণ ও ভীষ্ম সন্নিহিত থাকিতে কোন প্রকারে দ্যূত-জনিত অবিনয় ঘটিবার সম্ভাবনা নাই। তুমি অদ্যই তুর্ণাগামিতুরঙ্গযোজিত রথে আরোহণ করিয়া খাণ্ডবপ্রস্থ হইতে যুধিষ্ঠিরকে আনয়ন কর। হে বিদুর; আমার এ ব্যবসায় বলিও না, দৈবই প্রধান, দৈব হইতেই এই ঘটনা ঘটিতেছে।” ধীমান বিদুর এই প্রকার অভিহিত হইয়া চিন্তা করিতে করিতে দুঃখিতচিত্তে মহাপ্ৰাজ্ঞ ভীষ্মের নিকটে গমন করিলেন।