সোনার সীতা নির্ম্মাণ
সীতাদেবী রাখিয়া লক্ষ্মণ বীর নড়ে।
কান্দিতে কান্দিতে বীর নায়ে গিয়া চড়ে।।
নৌকায় হইয়া পার চড়িলেন রথে।
কোথা রাম বলি সীতা লাগিল কান্দিতে।।
কান্দিতে লাগিলা সীতা হইয়া ফাঁফর।
হেনকালে চতুর্দ্দিকে দেখে ভয়ঙ্কর।।
চারিদিকে চান সীতা দেখে বনময়।
শার্দ্দূল ভল্লুক দেখি পান বড় ভয়।।
উচ্চৈঃস্বরে কান্দে সীতা বনের ভিতর।
শিষ্য সঙ্গে আইলেন বাল্কীকি মুনিবর।।
সীতা-বনবাস পূর্ব্বে রচেছেন মুনি।
আসিয়া সীতার স্থানে জিজ্ঞাসে আপনি।।
জনকের কন্যা তুমি রামের গৃহিণী।
দশরথ-বহুয়ারী, মেদিনী-নন্দিনী।।
লোক-অপবাদে রাম পাইয়া তরাস।
বিনা অপরাধে তোমায় দিলা বনবাস।।
ত্রিভুবনে সাধ্বী নাই তোমার সমান।
অযোধ্যাকাণ্ডেতে আছে তাহার প্রমাণ।।
পরম আদরে সীতা লয়ে যান মুনি।
সীতায় রাখিল লয়ে যথায় ব্রাহ্মণী।।
সীতার রূপেতে তপোবন আলো করে।
মুনিপত্নী বলে লক্ষ্মী আইলা মোর ঘরে।।
জানকীরে মুনিপত্নী দিলা আলিঙ্গন।
সীতা প্রশংসিয়া বলে মধুর বচন।।
শুভদিন হৈল মাতা এলে মোর ঘর।
তোমা দরশনে মোর হরিষ অন্তর।।
সীতা বলে কর্ম্মদোষে আমার বর্জ্জন।
তোমা দরশনে মোর সফল জীবন।।
মুনিপত্নী সহিত রহেন তপোবন।
কান্দিয়া লক্ষ্মণ তবে চলিলা ভবন।।
সুমন্ত্র বলেন, শুন ঠাকুর লক্ষ্মণ।
পূর্ব্বের কাহিনী মোর হইল স্মরণ।।
বুড়া রাজার কথা এক পড়িয়াছে মনে।
রঘুবংশে সারথি আমি যাব অনরণ্যে।।
বাল্মীকি-কবিতা মোর কিছু পড়ে মনে।
বুড়া রাজার যজ্ঞ-কথা শুন সাবধানে।।
সপ্তদ্বীপের যত মুনি আসে রাজা স্থানে।
দশরথ-রাজার যজ্ঞের নিমন্ত্রণে।।
যজ্ঞশালে মুনিগণ যেকালে আসিবে।
সবে মেলি রাজারে যজ্ঞের চরু দিবে।।
যজ্ঞের ফলেতে রাজার চারি পুত্র হবে।
সুরাসুর অমরাদি সকলে কাঁপিবে।।
সর্ব্বগুণ ধরিবেক তোমার কুমার।
এক অংশে চারি পুত্র বিষ্ণু-অবতার।।
চারি পুত্রের পিতা তুমি শুন গুণধাম।
শত্রুঘ্ন লক্ষ্মণ ভরত আর যে শ্রীরাম।।
পিতৃসত্য পালিতে শ্রীরাম যাবে বন।
শূন্য ঘর পেয়ে সীতা হরিবে রাবণ।।
বান্ধিয়া সাগর রাম সৈন্য করে পার।
রাবণে বধিয়া সীতা করিবে উদ্ধার।।
এগার হাজার বর্ষ প্রজার পালন।
সাত হাজার বর্ষ পরে সীতার বর্জ্জন।।
দুর্ব্বাসা আসিয়া দ্বারে রহিলেন কোপে।
তোমারে বর্জিবে রাম সেই মুনির শাপে।।
এত শুনি মহারাজ হেঁট কৈল মাথা।
আমারে কহিল ব্যক্ত না কর এ কথা।।
আমারে নিষেধি রাজা গেল স্বর্গবাস।
তোমার নিকটে আমি করি যে প্রকাশ।।
সীতার লাগিয়া তুমি করহ ক্রন্দন।
তোমা হেন ভাই রাম করিবে বর্জ্জন।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত এই কহিনু লক্ষ্মণ।
শুনিয়া লক্ষ্মণ বীর বিরস বদন।।
লক্ষ্মণ কহেন তুমি কহিলে বৃত্তান্ত।
দেখিতে সীতার দুঃখ না পারি সুমন্ত্র।।
আগে কেন রাম মোরে না কৈল বর্জ্জন।
এড়াইতাম এই দুঃখ দেখিতে এমন।।
আপনার দুঃখ আমি সহিবারে পারি।
সীতার যন্ত্রণা আর দেখিতে যে নারি।।
এই কথাবার্ত্তা তবে কহে দুই জন।
অযোধ্যায় রাম কাছে গেলেন লক্ষ্মণ।।
কাঁদিতে কাঁদিতে বীর নামে নোঙায় মাথা।
শ্রীরাম বলেন সীতা থুয়েছি বাহিরে।
বড় লজ্জা হবে পুনঃ আনিলে সীতারে।।
সীতা না দেখিয়া ভাই না পারি রহিতে।
কেমনে সীতার শোক পাসরিব চিতে।।
আমার বচন শুন ভাই তিন জন।
রাত্রিতে সোণার সীতা করহ গঠন।।
জানকী আনিলে নিন্দা করিবে যে লোক।
দেখিয়া সোণার সীতা পাসরিব শোক।।
এতেক বলিয়া রাম করেন ক্রন্দন।
বিশ্বকর্ম্মা এলো তথা বুঝি তাঁর মন।।
শত মণ সোণা লয়ে দিল তার স্থান।
স্বর্ণ-সীতা বিশ্বকর্ম্মা করিলা নির্ম্মাণ।।
যেমন সীতার রূপ কিছু নাহি নড়ে।
সবে মাত্র এই চিহ্ন বাক্য নাহি সরে।।
সোণার সীতারে পরায় বস্ত্র আভরণ।
সুগন্ধি পুষ্পের মাল্য সুগন্ধি চন্দন।।
সীতা সীতা বলি রাম ডাকে নিরন্তর।
সীতা নহে রঘুনাতে কে দিবে উত্তর।।
একদৃষ্টে চাহেন সোণার সীতামুখ।
উত্তর না পেয়ে রামের বড় হয় দুখ।।
সাত হাজার বৎসর বঞ্চে সীতার সংহতি।
সোণার সীতা দেখিয়া বঞ্চিলা সাত রাতি।।
সাত রাত্রি বঞ্চিয়া রাম আইলা বাহির।
শ্রাবণের ধারা যেন চক্ষে বহে নীর।।
ভরত লক্ষণ শত্রুঘ্ন তিন জনে।
বাহির চৌতারে রাম বসিলা দেওয়ানে।।
পাত্র মিত্র বন্ধুবর্গ আইল রামস্থানে।
শূন্যময় দেখে রাম সীতার বিহনে।।
বিবাহ করিতে রামের নাহি লয় মন।
সম্মুখে সোণার সীতা রাখে সর্ব্বক্ষণ।।
পাত্র মিত্র বন্ধুবর্গ বুঝায় সকলে।
বিবাহ করহ রাম সকলেতে বলে।।
যথা যত রাজকন্যা আছে স্থানে স্থান।
শুনিয়া রামের গুণ করে অনুমান।।
সীতা হেন নারী যার না লাগিল মনে।
সে জনার মনোমত হইব কেমনে।।
কন্যাগণ এই যুক্তি করে নিরন্তর।
আর বিভা না করিবে রাম রঘুবর।।
সীতা সীতা বলি রাম ছাড়িলা নিঃশ্বাস।
গাহিল উত্তরকাণ্ডে কবি কৃত্তিবাস।।