৪৬তম অধ্যায়
সঙ্কুলযুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে নরনাথ! ঐ যুদ্ধে বহু সহস্ৰ পদাতি মৰ্যাদা অতিক্রমপূর্ব্বক সংগ্রাম করিয়াছিল, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ করুন। ঐ সময় পুত্র পিতাকে, পিতার ঔরস পুত্ৰকে, ভ্রাতা ভ্রাতাকে, ভাগিনেয় মাতুলকে, মাতুল ভাগিনেয়কে ও সখা সখাকে জানিতে পারে নাই। ফলতঃ পাণ্ডবগণ উন্মত্তপ্রায় হইয়া কৌরবগণের সহিত সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। বহুসংখ্যক যুদ্ধবিশারদ বীর রথ লইয়া, রথীদিগকে আক্রমণ করিলে রথদ্বিারা রথ, রথেষাদ্বারা রথেষা [রথের ঈষা—রথদণ্ড], রথকৃবরদ্বারা রথকূবর [রথের চাকার খিল] ভগ্ন হইতে লাগিল। কোন কোন বীরপুরুষ পরস্পর জিঘাংসাপরবশ হইয়া তুমুল সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন, কতকগুলি রথ রথসন্নিপাতে [ভগ্নরথস্তূপে] অচল হইয়া পড়িল। মদম্রাবী মহাকায় কুঞ্জরগণ তোরণপতাকাশোভিত বেগবান শত্রুপক্ষীয় মহাগজসমুদয়ের দন্তযুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইল এবং পরস্পর পরস্পরের দন্তদ্বারা ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ হইয়া নিতান্ত ব্যথিতের ন্যায় চীৎকার করিতে লাগিল। হস্তিবিদ্যবিশারদ ব্যক্তিগণকর্ত্তৃক সুশিক্ষিত অপ্ৰভিন্ন [অক্ষত] মাতঙ্গগণ অঙ্কুশাহত হইয়া মদম্রাবী বারণগণের সম্মুখীন হইল। বহুসংখ্যক মহাগজ মাতঙ্গসমুদয়ের সম্মুখীন হইয়া বৃকের ন্যায় ধ্বনি করিয়া ইতস্ততঃ গমন করিতে লাগিল। সমাক শিক্ষিত মদাক্তগণ্ড [মন্দসিক্ত-গণ্ডদেশ] মহাগজগণের ঋষ্টি, তোমর ও নারাচদ্বারা নিরুদ্ধ ও মর্ম্মস্থলে আহত হইয়া কতকগুলি প্ৰাণত্যাগ করিয়া নিপতিত ও কতকগুলি ভয়ঙ্কর গর্জ্জন করিয়া চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল।
‘বিশালবক্ষা গজের পাদরক্ষকগণ পরস্পর হননেচ্ছয় ঋষ্টি, শরাসন, পরশু, গদা, মুষল, ভিন্দিপাল, তোমর, পরিঘ ও সুশাণিত খড়্গপ্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র ধারণপূর্ব্বক মহাবেগে ইতস্ততঃ গমন করিতে লাগিল। পরস্পরের প্রতি ধাবমান শূরগণের নরশোণিতলিপ্ত খড়্গসমুদয় সমধিক শোভা ধারণ করিল। বীরবাহু-ব্যক্তিগণকর্ত্তৃক নিক্ষিপ্ত নিশিত অসিমুদয় শক্রগণের মৰ্মে নিপতিত হইবার সময়ে তাহা হইতে তুমুল শব্দ বহির্গত হইল। গদামুষলরুগ্ন [গদা ও মূষলের আঘাতে পীড়িত] খড়্গাহত হস্তিদন্তবিদীর্ণকলেবর [হাতীর দাঁতের আঘাতে ভিন্নদেহ] ও গজমর্দ্দিত মানবগণ প্রেতসমুদয়ের ন্যায় দারুণস্বরে ইতস্ততঃ চীৎকার করিতে লাগিল। অশ্বারোহিগণ চামরভূষিত, মহাবেগসম্পন্ন, হংস সদৃশ শোভমান অশ্বসমুদয় লইয়া পরস্পরের প্রতি ধাবমান হইল। সেই সমুদয় মহাবীরকর্ত্তৃক নিক্ষিপ্ত সুবর্ণমণ্ডিত তীক্ষ্ন শরসমুদয় সৰ্পসমূহের ন্যায় নিপতিত হইতে আরম্ভ হইল। কোন অশ্বারোহী অশ্বের সহিত লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক বৃহৎ রথে উত্থান করিয়া রথিগণের শিরশ্ছেদন করিল; রথসমীপে সমুপস্থিত বহুসংখ্যক অশ্বারোহীকে নতপর্ব্ব ভল্লদ্বারা সংহার করিল। নবমেঘসন্নিভ, কনকভূষণমণ্ডিত, মত্ত মাতঙ্গগণ স্ব স্ব কুম্ভ ও পার্শ্বদেশ পাটিত হইলেও অশ্বসকলকে নিপাতিত করিয়া পদদ্বারা মর্দ্দন করিতে লাগিল। অনেকে প্রাসের আঘাতে নিতান্ত কাতর হইয়া চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। কোন কোন বীরপুরুষ আরোহিসহিত অশ্বগণকে ও কেহ কেহ বারণগণকে উন্মথিত করিয়া সহসা নিক্ষেপ করিতে লাগিল। করিগণ দন্তাগ্রদ্বারা আরোহীর সহিত তুরঙ্গমগণকে উৎক্ষিপ্ত ও রথসমুদয় মন্দিত করিয়া গমন করিতে লাগিল। কোনো কোনো প্রভূতমদশালী মহাগজ শুণ্ড ও চরণদ্বারা আরোহিসহিত অশ্বগণকে নিহত করিল। ভীষণ ভুজঙ্গসদৃশ তীক্ষক্ষ্ণ শরসমুদয় হস্তিগণের দন্তদ্বয়ের মধ্যভাগ, গাত্র ও পার্শ্বদেশে নিপতিত হইতে লাগিল। বীরগণের বাহুবিনিমুক্ত মহোল্কাসদৃশ শক্তিসমুদয় নর ও অশ্বগণের গাত্র এবং লৌহময় কবচসকল ভেদ করিয়া বহিৰ্গত হইতে লাগিল। বীরগণ দ্বীপিচর্ম্ম ও ব্যাঘ্রচর্ম্মে নিবদ্ধ কোষনিষ্কাশিত নির্ম্মল খড়্গসমুদয়দ্বারা শত্ৰুগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। কোনো কোনো হস্তী শুণ্ডদ্বারা অশ্বের সহিত রথসমুদয় আকর্ষণ ও নিক্ষেপপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে গমন করিতে লাগিল।
“হে মহারাজ! ঐ সংগ্রামে সহস্ৰ সহস্ৰ যোদ্ধৃগণ শক্তিবিদারিত, পরশুছিন্ন, হস্তিমর্দ্দিত, অশ্বাপদাহত ও রাথনেমিসংচ্ছিন্ন হইয়া কেহ। পুত্র, কেহ পিতা, কেহ ভ্রাতা, কেহ মাতুল, কেহ ভাগিনেয় ও কেহ কেহ অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদিগকে স্মরণপূর্ব্বক করুণস্বরে রোদন করিতে লাগিল। অনেকের নাড়ী বিকীর্ণ, ঊরু ভগ্ন, বাহু ছিন্ন ও পার্শ্ব বিদীর্ণ [ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত] হওয়াতে নিতান্ত কাতর হইয়া জীবিতলালসায় [প্রাণের মমতায়] ঘোরতর চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। কেহ কেহ পিপাসায় নিতান্ত অধীর ও ভূতলে পতিত হইয়া জল যাঞ্চা করিতে লাগিল। অনেকে রক্তাক্তকলেবর ও একান্ত ক্লিষ্ট হইয়া আপনাদিগকে ও মহাশয়ের [ধৃতরাষ্ট্রের] পুত্ৰগণকে নিন্দা করিতে প্ৰবৃত্ত হইল; কিন্তু সমোরোৎসাহী শূরাবর ক্ষত্ৰিয়গণ তৎকালে অস্ত্র পরিত্যাগ বা ক্ৰন্দন করিলেন না। তাহারা ক্ৰোধাভরে দশনদ্বারা ওষ্ঠ দংশন ও ভ্রুকুটি বন্ধনপূর্ব্বক পরস্পর অবেক্ষণ [কুটিল নিরীক্ষণ] করিয়া হৃষ্টচিত্তে তর্জ্জনগর্জ্জন করিতে লাগিলেন। অন্যান্য মহাবলপরাক্রান্ত সত্ত্বশালী বীরগণ শরাঘাতে একান্ত জর্জ্জরিত হইয়া ও তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন। অনেক বীরপুরুষ সংগ্রামে বিরত হইয়া অন্যের রথগ্রহণেচ্ছায় নিপতিত হইবামাত্ৰ শত্রুপক্ষীয় হস্তিগণের দন্তাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হইয়া কুসুমিত কিংশুকবৃক্ষের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল।
“হে মহারাজ! এইরূপে সেই বীরক্ষয়কারী মহাসংগ্রাম ক্রমে তুমুল হইয়া উঠিলে সৈন্যসমুদয়মধ্যে বহুতর ভীষণ শব্দ হইতে লাগিল। ঐ সময় পিতা পুত্ৰকে, পুত্র পিতাকে, ভাগিনেয় মাতুলকে, মাতুল ভাগিনেয়কে, সখা সখাকে ও বান্ধব বান্ধবকে নিধন করিতে প্ৰবৃত্ত হইল। এইরূপে সেই নির্ম্মাৰ্য্যাদ [রণনীতিলঙ্ঘনকারী] মহাভয়ঙ্কর সমরে কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণের ক্ষয় হইতে আরম্ভ হইল। পাণ্ডব সৈন্যগণ এই দিবসের যুদ্ধে ভীষ্মের নিকট কম্পিত হইতে লাগিল; মহাবীর ভীষ্ম সমুচ্ছিত, রজতময়, পঞ্চতারাসুশোভিত, তালকেতুরথে আরোহণ করিয়া মেরুস্থিত চন্দ্ৰমার ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।”