দুৰ্য্যোধনের সভাবিপ্ৰলম্ভ-উপহাসপাত্ৰতা
রাজা দুৰ্য্যোধন শকুনির সহিত উপবেশন করিয়া ক্ৰমে ক্রমে সেই সভা পৰ্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। তিনি তাহাতে যে-সকল অদৃষ্টপূর্ব্ব দিব্য চিত্ৰাদি বস্তু দেখিলেন, তাহা কখন হস্তিনানগরে দৃষ্টিগোচর করেন নাই। দুৰ্য্যোধন কোন সময়ে সভামধ্যে এক স্ফটিকময় স্থলে উপস্থিত হইয়া জলভ্ৰমে আপনার বসন উৎকর্ষণ [বস্ত্রের উৰ্দ্ধোত্তলন—হাঁটুর কাপড় গুটান] করিয়া দুর্ম্মনায়মান ও প্রবেশ-বিমুখ হইয়া সেই সভায় পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর জলভ্ৰমে সেই স্ফটিকময় স্থলে নিপতিত হইয়া লজ্জিত হইলেন। পরে তথা হইতে বিমুখ হইয়া নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক বিষন্নমনে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তদনন্তর স্থলভ্ৰমে স্ফটিকবৎ নির্ম্মল জলে ও পদ্মে সুশোভিত দীর্ঘিকাজলে সবস্ত্ৰ পতিত হইলেন। মহাবল ভীমসেন এবং তদীয় কিঙ্করগণ দুৰ্য্যোধনকে তদাবস্থ দেখিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন। পরে যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞানুসারে ভৃত্যেরা তাঁহাকে উত্তমোত্তম বস্ত্র আনিয়া প্রদান করিল। তিনি পুনরায় পূর্ব্বের ন্যায় স্থলভাগে জলের আশঙ্কা ও জলভাগে স্থলের আশঙ্কা করিয়া আগমন করিতেছেন দেখিয়া ভীম, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব সকলে উপহাস করিতে লাগিলেন। কোপনস্বভাব দুৰ্য্যোধন তাঁহাদের উপহাস সহ্য করিতে পারিলেন না বটে; কিন্তু তৎকালে আপনার মনের ভাব গোপনে রাখিলেন। তাঁহাদের প্রতি আর দৃষ্টিপাত করিলেন না। তিনি পুনরায় এরূপ ভ্রান্ত হইয়াছিলেন যে, পরিচ্ছদ উৎক্ষিপ্ত করিয়া উত্তরণবাসনায় স্থলভাগেই পদবিক্ষেপ করিলেন। তাহা দেখিয়া পুনরায় সকল লোক হাস্য করিয়া উঠিল। তিনি যে কেবল স্ফটিকময় সভাকুট্টিমেই প্রতারিত হইয়াছিলেন, এমন নহে, স্ফটিকভিত্তিতে দ্বার বিবেচনা করিয়া যেমন প্রবেশ করিতে উদ্যত হইলেন, অমনি আহতমস্তক হইয়া ঘূর্ণিত হইতে লাগিলেন। সেইরূপ অন্য স্থানে স্ফটিককবাটাপুটিত দ্বার হস্ত দ্বারা বিঘট্টিত করিতে করিতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া পতিত হইলেন।
পরে বিততাকার [বিস্তূত] অপর এক দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া পূর্ব্বের ন্যায় বিপ্ৰলম্ভ বিবেচনায় [প্রতারণা] তথা হইতে বিরত হইলেন। হে মহারাজ! রাজা দুৰ্য্যোধন এইরূপে বিবিধ প্রতারণায় প্রতারিত হইয়া রাজসূয় মহাযজ্ঞে সেই অদ্ভুত সমৃদ্ধি অবলোকন করিয়া যুধিষ্ঠিরের অনুজ্ঞাগ্রহণপূর্ব্বক হস্তিনানগরে প্রস্থান করিলেন।
দুৰ্য্যোধনের দুৰ্ম্মতিসূচনা
রাজা দুৰ্য্যোধন পাণ্ডবদিগের শোভাসমৃদ্ধি অবলোকনে পরিতাপিত হইয়া চিন্তাকুলিত-চিত্তে গমন করিতে করিতে তাঁহার দুৰ্ম্মতি উপস্থিত হইল। তিনি মহাত্মা কৌন্তেয়গণের মহান মহিমা, মহানুভবতা, পার্থিবগণের বশবর্তিতা এবং আবালবৃদ্ধবনিতাগণের হিতকারিতা দেখিয়া বিবর্ণ হইয়া উঠিলেন। ধৃতরাষ্ট্রনন্দন গমনকালে সেই অনুপম সভার শোভা চিন্তায় এমত নিমগ্ন হইয়াছিলেন যে, তাহার মাতুল তাহাকে পুনঃ পুনঃ সম্ভাষণ করিলেও তিনি তাহার সহিত আলাপ করিলেন না। সুবিলাত্মজ তাহাকে চঞ্চল দেখিয়া কহিলেন, “দুৰ্য্যোধন! তুমি কি নিমিত্ত এরূপ বিষন্নমনে গমন করিতেছ?” দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে মাতুল! মহাত্মা ধনঞ্জয়ের শস্ত্ৰপ্ৰতাপলব্ধ এই সসাগরা বসুন্ধরাকে যুধিষ্ঠিরের নিতান্ত বশংবদ এবং ইন্দ্ৰযজ্ঞসদৃশ সেই মহাযজ্ঞ নিরীক্ষণ করিয়া অমর্ষভরে দহ্যমান মদীয় শরীর গ্রীষ্মকালীন স্বল্পজল জলাশয়ের ন্যায় পরিশুষ্ক হইতেছে। দেখ, যখন বাসুদেব শিশুপালকে বিনষ্ট করিলেন, তখন সেই রাজসভায় এমন কোন ভূপতি ছিলেন না। যিনি তাহার চরণানুগত না হইয়াছিলেন। তৎকালে রাজগণ কৌন্তেয়কৃত পরিভাবানলে দহ্যমান হইয়াও অপরাধ ক্ষমা করিলেন, কিন্তু সে অপরাধ কে ক্ষমা করিতে পারে? পাণ্ডবগণের প্রতাপে কেশবকৃত সেই অযুক্তকর্ম্ম সম্পন্ন হইল এবং নৃপতিগণ বিবিধ রত্নজাত লইয়া করপ্ৰদ বৈশ্যের ন্যায় ধর্ম্মরাজের উপাসনা করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণের প্রতাপলব্ধ রাজলক্ষ্মীকে সেইরূপ প্ৰদীপ্যমান দেখিয়া আমি অমৰ্ষভরে নিতান্ত দাহ্যমান হইতেছি। হে মাতুল! অধিক কি বলিব, আমার এরূপ অন্তৰ্দাহ উপস্থিত হইয়াছে যে, আমি আর জীবনধারণা করিতে সমর্থ হইতেছি না। হয় প্রজ্জ্বলিত হুতাশনে প্রবেশ করিব, না হয় হলাহল ভক্ষণ করিয়া জীবন শেষ করিব; অথবা জলে প্রবেশ করিয়া এই বিষম জ্বালার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইব। কোন সত্ত্ববান পুরুষ শত্রুর উন্নতি এবং আপনার অবনতি অবলোকন করিয়া সহ্য করিতে পারে? আমি যখন তাদৃশী রাজশ্ৰী দেখিয়া পরিতপ্ত হইয়াও অদ্যপি সহ্য করিয়া রহিয়াছি, তখন আমি না স্ত্রী, না পুরুষ কিছুই নহি; কারণ, স্ত্রীলোক হইলে এরূপ যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইত না; পুরুষ হইলে প্রতিকার না করিয়া নিশ্চিত থাকিতে পারিতাম না। তাদৃশ রাজত্ব, তাদৃশী ধনসম্পত্তি এবং তাদৃশ যজ্ঞ নিরীক্ষণ করিয়া মাদৃশ কোন ব্যক্তি না সন্তাপিত হয়? বিশেষতঃ তাহাদিগের সেই রাজলক্ষ্মী অপহরণ করিতে আমার সামৰ্থ্য নাই এবং কেহই সহকারী নাই, এই নিমিত্তই আমি মৃত্যুচিন্তা করিতেছি। যুধিষ্ঠিরের সেই মহাজনোচিত পবিত্র রাজলক্ষ্মী নিরীক্ষণ করিয়া নিশ্চয় করিলাম, দৈবই প্রধান, পৌরুষ নিরর্থক; কারণ, আমি যাহাকে বিনাশ করিবার যত্ন করিলাম, সে দৈবের অনুকূলতা-প্রযুক্ত সমুদয় অতিক্রম করিয়া পুনর্ব্বার উন্নতির পথে আরোহণ করিল। পৌরুষাবলম্বী ধাৰ্ত্তরাষ্ট্রেরা দিন দিন হীন হইতে লাগিল। সেই শ্ৰী ও তাদৃশী সভা নিরীক্ষণে এবং রক্ষিগণের সেই পরিহাস শ্রবণে আমি অতিশয় পরিতাপিত ও অসহিষ্ণু হইতেছি, অতএব হে মাতুল! আমাকে প্ৰাণ-পরিত্যাগ অনুজ্ঞা করিয়া পিতাকে এই বৃত্তান্ত নিবেদন করিবে।”