৪৫তম অধ্যায়
কালচক্রের পরিচয়
“ব্রহ্মা বলিলেন, ‘হে ঋষিগণ! পণ্ডিতেরা জরা-শোক সমাক্রান্ত, ব্যাধিব্যসনসঙ্কুল, অনিয়মিত কালস্থায়ী, বিবিধাকারে পরিণত, সৰ্ব্বপাপের হেতুভূত, রজোগুণের প্রবর্ত্তক, দৰ্পের আধার, ত্রিগুণাত্মক, মৃত্যুর বশীভূত, ক্রিয়াকরণসংযুক্ত, মায়াময়, ভয়-মোহসমাকীর্ণ, কামক্রোধে পরিপূর্ণ, বাহ্যসুখাসক্ত, চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্ব নির্ম্মিত, সংসারকারণ, পাঞ্চভৌতিক জড়দেহকে কালচক্রস্বরূপ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। ঐ চক্র মনের ন্যায় ভীষণবেগে নিরন্তর লোকসমুদয়ে বিচরণ করিতেছে। বুদ্ধি উহার সার, মন উহার স্তম্ভ, ইন্দ্রিয়সমুদয় উহার বন্ধন, স্ত্রী উহার নেমি, শ্রম ও ব্যায়াম [ব্যাসদণ্ড] উহার নিঃস্বন, দিবা ও রাত্রি উহার পরিচালক, শীত ও গ্রীষ্ম উহার মণ্ডল, সুখ-দুঃখ উহার অর [চক্র], ক্ষুৎপিপাসা উহার কীলক [চাকা আটকাইবার খোঁটা], ছায়া ও আতপ উহার রেখা, পরিতাপ উহার বন্ধনপট্টিকা এবং লোভজনিত ইচ্ছা উহার নিম্নোন্নত প্রদেশে পতনজনিত আস্ফালন সেতু [উচ্চে-নীচে উঠা-পড়ার আশ্রয়স্থল]। এই কালচক্রই সমুদয় জগতের সৃষ্টি, সংহার ও রোধের কারণ। যে ব্যক্তি ঐ দেহরূপ কালচক্রের প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির হেতু সবিশেষ পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, তিনি সৰ্ব্বসংস্কারবিহীন, সুখদুঃখাদি বিবর্জ্জিত ও সৰ্ব্বপাপবিমুক্ত হইয়া পরমগতিলাভে সমর্থ হয়েন।
‘শাস্ত্রে গার্হস্থ্য, ব্রহ্মচর্য্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এই চতুৰ্ব্বিধ আশ্রম নির্দ্দিষ্ট আছে। গৃহস্থাশ্রম ঐ সমুদয় আশ্রমের মূল। পূর্ধ্বতন পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, বেদবিহিত শাস্ত্রসমুদয় অধ্যয়ন করা গৃহস্থ ব্রাহ্মণদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। সৎকুলসম্ভূত ব্রাহ্মণগণ সংস্কারসম্পন্ন হইয়া গুরুগৃহে ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বনপূৰ্ব্বক বেদাধ্যয়ন করিয়া গৃহে প্রত্যাগমন ও গার্হস্থ্যধৰ্ম্ম আশ্রয় করিবেন। স্বদারনিরত, শিষ্টাচারসম্পন্ন ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া শ্রদ্ধাসহকারে পঞ্চযজ্ঞের অনুষ্ঠান করা গৃহস্থ ব্রাহ্মণদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। উঁহারা দেবতা ও অতিথিদিগের অবশিষ্টান্ন ভোজন, যথাশক্তি বেদবিহিত কার্য্যের অনুষ্ঠান ও দান করিবেন। কদাপি নিষিদ্ধ দেশে গমন, নিষিদ্ধ বস্তু গ্রহণ, নিষিদ্ধ বিষয় দর্শন ও নিষিদ্ধ বাক্য ব্যবহার করিবেন না। যজ্ঞোপবীতসম্পন্ন শুক্লবস্ত্রধারী পবিত্র এবং দান ও তপানুষ্ঠানে অনুরক্ত হইয়া সৰ্ব্বদা শিষ্টসংসর্গে বাস করা উঁহাদের অবশ্য কর্ত্তব্য। উঁহারা শিষ্টাচারনিরত, জিতেন্দ্রিয় ও ব্রহ্মনিষ্ঠ হইয়া বেণুনির্ম্মিত যষ্ঠি ও জলপূর্ণ কমণ্ডলু ধারণ করিবেন। উঁহাদিগের অধ্যয়ন, অধ্যাপন, যজন, যাজন, দান ও পতিগ্রহ এই ছয় প্রকার কাৰ্য্য নির্দ্দিষ্ট আছে। তন্মধ্যে যজন, অধ্যাপন ও সাধুদিগের নিকট প্রতিগ্রহ—এই ত্রিবিধ কাৰ্য্যদ্বারা উহাদের জীবিকানির্ব্বাহ এবং দান, অধ্যয়ন ও যজ্ঞানুষ্ঠান—এই ত্রিবিধ কাৰ্য্যদ্বারা ধর্ম্মোপার্জ্জন হইয়া থাকে। জিতেন্দ্রিয়, ক্ষমাবান, সৰ্ব্বভূতে সমদর্শী, ধৰ্ম্মপরায়ণ ব্রাহ্মণগণের দান, অধ্যয়ন ও যজ্ঞানুষ্ঠানে অসাবধান হওয়া কদাপি বিধেয় নহে। নিয়মধারী পবিত্রস্বভাব গৃহস্থ ব্রাহ্মণগণ এইরূপ আচারপরায়ণ হইলে অনায়াসে স্বর্গলোক পরাজয় করিতে পারেন।”