৪৫তম অধ্যায় – কার্তিকেয় উৎপত্তিকথা
জনমেজয় কহিলেন, ভগবন। সরস্বতীর মাহাত্ম কীৰ্ত্তন করিলেন, এক্ষণে ভগবান কার্তিকেয় কোন স্থানে কিরূপে কাহাদের কর্ত্তৃক অভিষিক্ত হইয়া দৈত্যগণকে নিপাতিত করিয়াছিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন। উহা শ্রবণ করিবার নিমিত্ত আমার অতিশয় কৌতূহল হইতেছে।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! তুমি কৌরবকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছ; অতএব এই আনন্দজনক বৃত্তান্তে অবশ্যই তোমার কৌতূহল হইতে পারে। এক্ষণে মহাত্মা কার্তিকেয়ের মাহাত্ম ও অভিষেক কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বকালে অগ্নিমধ্যে দেবাদিদেব মহাদেবের রেতঃপাত হইয়াছিল। হব্যবাহন [অগ্নি] তাহার প্রভাবেই দীপ্তিশালী ও তেজস্বী হইয়াছেন। তিনি তৎকালে সেই অক্ষয় বীৰ্য্য বহন ও ধারণ করিতে নিতান্ত অসমর্থ হইয়া ব্ৰহ্মর নিয়োগানুসারে উহা গঙ্গাজলে পরিত্যাগ করিলেন। ভগবতী ভাগীরথীও সেই তেজোময় বীৰ্য্যধারণে অসমর্থ হইয়া উহা সুরপূজিত সুরম্য হিমালয়ের শরস্তম্বে [শরবনের গুচ্ছে] নিক্ষেপ করিলেন। তথায় সেই রেতঃপ্রভাবে কুমার সমুৎপন্ন হইলেন। কুমারের তেজঃপুঞ্জে ত্রিলোক সমাবৃত হইল। তখন পুত্রাভিলাষিণী ছয়জন কৃত্তিকা শরবনে সেই অপূৰ্ব্ব কুমারকে নিরীক্ষণ করিয়া ‘ইনি আমার পুত্র, ইনি আমার পুত্র’ বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন। ভগবান কুমার তাঁহাদের আগ্রহ দেখিয়া ষড়ানন হইয়া এককালে তাঁহাদিগের ছয়জনের স্তন্য পান করিতে লাগিলেন। দিব্যরূপা কৃত্তিকাগণ বালকের সেই অদ্ভুত প্রভাব দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। ভাগীরথী হিমালয়ের যে শিখরে ভগবান কুমারকে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, সেই শিখর সুবর্ণময় হইয়া শোভা পাইতে লাগিল। ঐ নিমিত্ত পৰ্ব্বতগণ কাঞ্চনের আকর হইয়াছে। হে মহারাজ! ঐ কুমারের নাম কার্তিকেয়। উনি ক্রমে ক্রমে শান্তপ্রকৃতি, তপোনিষ্ঠ, বলবীৰ্য্যসম্পন্ন ও চন্দ্রের ন্যায় প্রিয়দর্শন হইয়া উঠিলেন। মহাত্মা কার্তিকেয় সতত সেই সুবর্ণময় শরস্তম্বে শয়ান থাকিতেন। তথায় গন্ধৰ্ব্ব ও মুনিগণ তাঁহার স্তুতিপাঠ এবং নৃত্যবাদিত্ৰনিপূণা চারুদর্শনা দেবকন্যাগণ নৃত্য করিতেন। ঐ সময় নদীপ্রধানা গঙ্গা কুমারের উপাসনা ও বসুন্ধরা দিব্যরূপ ধারণপূর্ব্বক তাঁহাকে ধারণ করিতে লাগিলেন। সুরগুরু বৃহস্পতি তাঁহার জাতিকৰ্ম্মাদি নির্বাহ করিলেন। চারি বেদ, চতুষ্পদ ধনুৰ্বেদ, সমুদয় অস্ত্র এবং সরস্বতী, ইহারা মূৰ্ত্তিমান হইয়া তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইলেন।
হে মহারাজ! একদা মহাবল-পরাক্রান্ত কার্তিকেয় দেখিলেন যে, দেবাদিদেব মহাদেব অদ্ভুতদর্শন বিকৃতবেশধারী ভূতগণে পরিবেষ্টিত হইয়া শৈলপুত্রীর সহিত একাসনে আসীন রহিয়াছেন। ঐ ভূতগণের বদন ব্যাঘ, সিংহ, ভল্লুক, বিড়াল, মকর, বৃষ, হস্তী, উষ্ট্র, উলূক, গৃধ্র, গোমায়ু, ক্রৌঞ্চ, রুরু ও পারাবতের ন্যায়, এবং অনেকের শরীর শল্য[সজারু], গোধা [গোসাপ], গো ও মেষের ন্যায়, কেহ কেহ মেষসদৃশ, কেহ কেহ অঞ্জনপৰ্ব্বতসন্নিভ [কাল রঙের পাহাড়ের ন্যায়], কেহ কেহ ধবল পৰ্বতাকার ও কেহ কেহ গদা ও চক্রধারী। মহাত্মা কার্তিকেয় মহাদেবকে এইরূপে সমাসীন দেখিয়া তাঁহার সমীপে গমনে সমুদ্যত হইলেন। তখন সপ্তমাতা [গঙ্গাদি পূর্বোক্ত ছয় মাতা ও মাতৃস্থানীয় অগ্নি] পুত্রসমবেত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, বৃহস্পতি এবং সাধ্য, সিদ্ধ, বিশ্বদেব, বসু, রুদ্র, আদিত্য, ভুজগ, দানব, খগ, যাম, ধাম, নারাদি দেব, গন্ধৰ্ব্ব ও পিতৃগণ কুমারের দর্শনলালসায় তথায় সমাগত হইলেন।
অনন্তর যোগসম্পন্ন মহাবল-পরাক্রান্ত কুমার দেবাদিদেব পিনাকপাণির নিকট আগমন করিতে লাগিলেন। ভগবান ত্রিলোচন, পার্বতী, গঙ্গা ও হুতাশন তাঁহাকে আগমন করিতে দেখিয়া সকলেই মনে মনে চিন্তা করিবেন যে, এই বালক গৌরবপ্রযুক্ত অগ্রে আমারই নিকট আগমন করিবে। ভগবান কার্তিকেয় তাঁহাদিগের অভিপ্রায় অবগত হইয়া যোগবলে আপনার মূর্তি চতুৰ্দ্ধা বিভক্ত করিবেন। তখন তাঁহার কার্তিকেয়, বিশাখ, শাখ ও নৈগমেয় নামে চারিটি মূৰ্ত্তি হইল। উহাদের চারি জনেরই রূপ সমান। অনন্তর কার্তিকেয় রুদ্রের নিকট বিশাখ, পাৰ্ব্বতীর নিকট বায়ুমূর্তি, ভগবান শাখ অগ্নির নিকট ও নৈগমেয় গঙ্গার নিকট গমন করিলেন। সেই অদৃষ্টপূৰ্ব আনন্দকর লোমহর্ষণ ব্যাপার দর্শনে দেব, দানব ও রাক্ষসগণের মহা কোলাহল সমুত্থিত হইল। তখন ভগবান মহাদেব, পাৰ্ব্বতী, ভাগীরথী ও অনল পুত্রের প্রিয়কামনায় ব্রহ্মাকে প্রণিপাতপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ভগবান! আমাদিগের প্ৰিয়কাৰ্য্যসাধনের নিমিত্ত, এই বালককে উপযুক্ত আধিপত্য প্রদান করুন।” লোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা তাঁহাদের বাক্য শ্রবণ করিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, ‘আমি পূৰ্ব্বে দেব, গন্ধৰ্ব্ব, রাক্ষস, ভূত, যক্ষ, বিহঙ্গ ও পন্নগগণকে সমুদয় ঐশ্বৰ্য্য প্রদান করিয়াছি। এই বালকও সেই সমুদয় ঐশ্বৰ্য্যভোগের উপযুক্ত। এক্ষণে ইহাকে কোন ঐশ্বৰ্য্য প্রদান করি?” ভগবান কমলযোনি মূহূর্তকাল এইরূপ চিন্তা করিয়া দেবগণের হিতসাধনার্থ কাৰ্ত্তিকেয়কে সৰ্ব্বভূতের সৈনাপত্য প্রদানপূর্ব্বক প্রধান প্রধান দেবগণমধ্যে তাঁহার আধিপত্য সংস্থাপন করিলেন। অনন্তর ব্রহ্মাদি দেবতা ও গন্ধৰ্ব্বগণ কার্তিকেয়কে গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার অভিষেকাৰ্থ হিমালয়ের যে স্থানে ত্রিলোকবিশ্রুত, পরম পবিত্র সরস্বতী প্রবাহিত হইতেছে, তথায় সমুপস্থিত হইয়া উপবেশন করিলেন।