৪৪তম অধ্যায় – সরস্বতী শাপমুক্তি জন্য মুনিগণের তপঃপ্রবৃত্তি
জনমেজয় কহিলেন, হে মহারাজ! সরিদ্বরা সরস্বতী রোষাবিষ্ট মহর্ষি বিশ্বামিত্র কর্ত্তৃক ঐরূপ অভিশপ্ত হইয়া সেই তীর্থে শোণিতধারা প্রবাহিত করিলে রাক্ষসগণ তথায় আগমনপূর্ব্বক পরমসুখে সেই রুধির পান করিয়া পরিতৃপ্ত হইয়া কখন হাস্য ও কখন নৃত্য করিতে লাগিল। কিয়ৎকাল অতীত হইলে কতকগুলি তাপস তীর্থপৰ্যটনক্রমে সরস্বতীতে আগমন করিলেন এবং সরস্বতীর অন্যান্য সমস্ত তীর্থে অবগাহন করিয়া পরিশেষে সেই শোণিতধারা-প্রবাহী তীর্থে সমুপস্থিত হইলেন। তথায় তাঁহারা সরস্বতীর জল শোণিতপরিপ্লুত[রক্তমিশ্রিত] ও বহুসংখ্যক রাক্ষসগণ কর্ত্তৃক নিরন্তর পীয়মান [পীত] নিরীক্ষণ করিয়া মহানদীর পরিত্রাণ-বাসনায় তাঁহাকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, “হে কল্যাণি! তোমার এই তীর্থ কি নিমিত্ত এইরূপ শোণিতময় হইয়াছে, আমরা তাহা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিতে একান্ত কৌতূহলাক্রান্ত হইয়াছি।” সরস্বতী মহর্ষিগণ কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কম্পিতকলেবরে তাঁহাদের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। তখন তাপসগণ সরস্বতীকে নিতান্ত দুঃখিত দেখিয়া কহিলেন, “ভদ্রে! আমরা তোমার অভিশাপবৃত্তান্ত শ্রবণ করিলাম; এক্ষণে সকলেই তোমার শাপশান্তি করিবার নিমিত্ত সবিশেষ যত্ন করিব।”
অরুণাতীর্থে রাক্ষসাদি দেহমুক্তিমাহাত্ম
হে মহারাজ! তাপসেরা সরস্বতীকে এইরূপ কহিয়া পরস্পর তাঁহাকে শাপবিমুক্ত করিবার পরামর্শ করিলেন এবং অতি কঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক বিবিধ নিয়ম ও উপবাস দ্বারা অচিরাৎ জগৎপতি পশুপতিকে প্রসন্ন করিয়া পবিত্র নদীর শাপশান্তি করিয়া দিলেন। তখন রাক্ষসেরা সরস্বতীকে তপোধনগণের তপোবলে পূৰ্ব্ববৎ প্রকৃতিস্থ ও প্রসন্ন-সলিলসম্পন্ন দেখিয়া অবিলম্বে তাঁহাদিগের শরণাপন্ন হইল এবং ক্ষুধায় একান্ত কাতর হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে সেই সমস্ত কৃপাপরায়ণ মুনিগণকে বারংবার কহিতে লাগিল, “হে তাপসগণ! আমরা শাশ্বত ধৰ্ম্ম হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়াছি, কিন্তু আমরা স্বেচ্ছানুসারে পাপানুষ্ঠান করি না। আপনাদিগের অপ্রসন্নতা নিবন্ধনই আমাদের পাপবৃদ্ধি হওয়াতে আমরা ব্রহ্মণরাক্ষস হইয়াছি। কামিনীগণ যেমন স্বভাবসিদ্ধ কামপরতন্ত্র হইয়া যোনিদোষকৃত পাপে লিপ্ত হয়, তদ্রূপ আমরা নৈসর্গিক ক্ষুধায় কাতর হইয়া বিবিধ পাপে জড়িত হই। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্ৰমধ্যে যাহারা ব্রাহ্মণগণের প্রতি দ্বেষ এবং ঋত্বিক, গুরু ও বৃদ্ধ লোকদিগকে অপমান করে, তাহারাও রক্ষসযোনি প্রাপ্ত হয়। হে দ্বিজগণ! আপনারা লোকদিগকে উদ্ধার করিতে সমর্থ, অতএব আমাদিগকেও পরিত্রাণ করুন।
হে মহারাজ! তাপসেরা রাক্ষসগণের বাক্য শ্রবণ করিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া তাহাদিগকে বিমূক্ত করিবার নিমিত্ত সরস্বতীকে স্তব করিতে লাগিলেন এবং কহিলেন যে, “এ স্থানে যে অন্ন কীটযুক্ত, উচ্ছিষ্ট, হিংসা ও কেশদূষিত, অস্পৃশ্যজাতিসৃষ্ট, পূতিগন্ধোপহত [পচা দুর্গন্ধাদিতে দূষিত] ও অশ্রুজলমিশ্রিত হইবে, রাক্ষসেরা তাহা অধিকার করিবে; অতএব বিবেচক ব্যক্তিগণ অতি যত্নসহকারে উক্ত প্রকার অন্ন পরিত্যাগ করিলেন। যে ব্যক্তি ঐরূপ দূষিত অন্ন ভোজন করিলেন, তাঁহার রাক্ষসান্ন আহার করা হইবে।” তাপসেরা এইরূপে রাক্ষসগণের আহার নির্দেশপূর্ব্বক উপস্থিত নিশাচরগণকে বিমুক্ত করিবার নিমিত্ত সরস্বতীকে অনুরোধ করিলেন। সরিৎপ্রধানা সরস্বতী তাপসগণের বাক্যানুসারে আপনার শাখা ব্রহ্মণহত্যাপাপনাশিনী অরুণা নদীকে তথায় প্রবাহিত করিলেন। রাক্ষসেরা সেই অরুণায় স্নান ও দেহত্যাগ করিয়া স্বর্গে গমন করিল। কিয়ৎকাল পরে দেবরাজ ইন্দ্রও ঐ বৃত্তান্ত অবগত হইয়া সেই তীর্থে অবগাহনপূর্ব্বক ব্রহ্মণহত্যাপাপ হইতে বিমুক্ত হইয়াছিলেন।
ইন্দ্রের ব্রহ্মবধ পাপ বিবরণ—অরুণামাহাত্ম
জনমেজয় কহিলেন, হে ব্ৰহ্মণ! সুররাজ ইন্দ্র কি নিমিত্ত ব্রহ্মণহত্যাপিতকে লিপ্ত হইয়াছিলেন এবং কিরূপেই বা এই তীর্থে অবগাহন করিয়া সেই পাপ হইতে বিমুক্ত হইলেন?
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পূৰ্ব্বে দেবরাজ ইন্দ্র দানবরাজ নমুচির সহিত নিয়ম সংস্থাপনপূর্ব্বক উহা লঙ্ঘন করিয়া ব্রহ্মণহত্যা-পাপে লিপ্ত হয়েন। আপনি সেই বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করুন। একদা দানবরাজ নমুচি ইন্দ্ৰভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া সূৰ্য্যরশ্মিমধ্যে প্রবেশ করিল। ইন্দ্র তদ্দর্শনে তাহার সহিত সখ্যভাব সংস্থাপনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে সখে! আমি সত্যই কহিতেছি, দিবসে বা রজনীতে তোমাকে বিনাশ করিব না এবং আর্দ্র বা শুষ্ক বস্তু দ্বারা তোমার প্রাণসংহারে প্রবৃত্ত হইব না।”
হে মহারাজ! অনন্তর একদা নীহারালে চতুর্দ্দিক সমাচ্ছন্ন হইলে দেবরাজ সলিলফেন দ্বারা নমুচির শিরচ্ছেদন করিলেন। তখন সেই ছিন্নমস্তক “রে পাপাত্মন! তুই মিত্রকে বিনাশ করিলি” এই বলিয়া দেবরাজের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইল। দেবরাজ সেই ছিন্নমস্তক হইতে বারংবার এইরূপ শব্দ নির্গত হইতেছে শ্রবণ করিয়া সন্তপ্তমনে পিতামহ ব্রহ্মার সন্নিধানে গমনপূর্ব্বক সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। তখন ত্রিলোকগুরু কমলযোনি তাঁহাকে কহিলেন, “হে পুরন্দর। তুমি অরুণাতীর্থে বিধানানুসারে যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক স্নান কর, তাহা হইলেই তোমার সমুদয় পাপ ধ্বংস হইবে। মহর্ষিগণ ঐ তীর্থকে অতিশয় পবিত্র করিয়াছেন। উহার ঐ স্থানে আবির্ভাব অতিশয় নিগূঢ় ছিল; কিন্তু সরিদ্বারা সরস্বতী স্বীয় সলিল দ্বারা উহাকে প্লাবিত করেন। হে দেবরাজ! ঐ অরুণা-সরস্বতী-সঙ্গমতীর্থ অতি পবিত্র। তুমি ঐ স্থানে যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক বিবিধ ধন দান ও স্নান কর, তাহা হইলে নিশ্চয়ই পাপ হইতে বিমুক্ত হইবে।” দেবরাজ ইন্দ্র পিতামহ কর্ত্তৃক এইরূপে অভিহিত হইয়া অরুণাতীর্থে উপস্থিত হইলেন এবং তথায় বিধানানুসারে স্নান করিয়া সেই দানববিনাশনিবন্ধন ব্রহ্মণহত্যা-পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া হৃষ্টান্তঃকরণে পুনরায় দেবলোকে গমন করিলেন। তৎপরে দানবরাজ নমুচির সেই ছিন্নমস্তকও ঐ তীর্থে স্নান করিয়া অক্ষয় লোক লাভ করিল।
হে মহারাজ! মহাত্মা বলদেব ঐ তীর্থে বিবিধ ধন দানপূর্ব্বক ধৰ্ম্ম লাভ করিয়া সোমতীর্থে গমন করিলেন। পূৰ্ব্বে ঐ তীর্থে ভগবান্ চন্দ্র রাজসূয় যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন। বিপ্রবরাগ্রগণ্য [ব্রাহ্মণসকলের শ্রেষ্ঠ] অত্রি তাঁহার যজ্ঞে হোতা হইয়া ছিলেন। ঐ যজ্ঞের অবসানে দেবগণের সহিত রাক্ষস ও অসুরদিগের ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইলে কার্ত্তিকেয় দেবগণের সেনাপতিপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া তারকাসুরকে সংহার করেন। ঐ তীর্থে যে স্থানে বটবৃক্ষ বিরাজিত আছে, তথায় সেনাপতি কার্ত্তিকে নিরন্তর অবস্থান করিতেন।