যুদ্ধাৰ্থ শিশুপালের আস্ফালন
বৈশাম্পায়ন কহিলেন, প্রভূত-বিক্রমশালী চেদিরাজ ভীষ্মের বাক্য শ্রবণমাত্রেই বাসুদেবের সহিত সংগ্রাম করিবার মানসে তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, “হে জনার্দন! আমি তোমাকে আহ্বান করিতেছি, আমার সহিত সংগ্রাম কর। আইস, আদ্য তোমাকে পাণ্ডবগণ সমভিব্যাহারে যমালয়ে প্রেরণ করি। হে কৃষ্ণ! তুমি রাজা নহ; তুমি দাস, দুর্ম্মতি ও পূজার অযোগ্য পাত্ৰ, পাণ্ডবগণ বালকত্বপ্রযুক্ত ভূপালদিগকে অতিক্রম করিয়া তোমাকে পূজ্যাবৎ পূজা করিয়াছে, অতএব আমার মতে অনভিজ্ঞ পাণ্ডবগণকে বধ করা অবশ্য কর্তব্য।” শিশুপাল এই বলিয়া ক্ৰোধাভরে তর্জনগর্জন করিতে লাগিলেন। কৃষ্ণ শিশুপালের বাক্যাবসানে পাণ্ডবগণসমক্ষে মৃদুস্বরে সমস্ত ভূপতিবর্গকে কহিতে লাগিলেন, “হে ভূপতিগণ! এই সাত্বতীনন্দন আমাদিগের পরম শত্রু; এই দুরাত্মা সর্ব্বদা অনপকারী সাত্বতগণের অপকার চেষ্টা করিয়া থাকে। এই দুরাচার আমার পিতৃষ্বস্রীয় হইয়াও আমরা প্ৰাগজ্যোতিষপুরে গমন করিয়াছি জানিতে পারিয়া দ্বারকাপুর দগ্ধ করিয়াছিল। ভোজরাজ বিহারার্থ রৈবতক পর্ব্বতে গমন করিলে এই পাপিষ্ঠ তদীয় সহচরীগণের মধ্যে অনেককে বিনাশ ও অনেককে বদ্ধ করিয়া স্বপুরে গমন করিয়াছিল। আমার পিতার অশ্বমেধানুষ্ঠান-সময়ে বিয়োৎপাদন করিবার মানসে উৎকৃষ্ট রক্ষকগণপরিবৃত, পবিত্ৰ যজ্ঞশ্ব অপহরণ করিয়াছিল। এই দুরাত্মা নিতান্ত অননুরক্তা সৌবীরদেশগামিনী বিভ্ৰূপত্নীকে এবং কারুষের নিমিত্ত মায়া অবলম্বনপূর্ব্বক স্বীয় মাতুল বিশালাধিপতির কন্যা ভদ্রাকে অপহরণ করিয়াছিল। আমি কেবল পিতৃষ্বসার অনুরোধেই এই পাপাত্মার দুষ্কর্ম্মসকল এতাবৎকাল পৰ্য্যন্ত সহ্য করিয়াছি। দুরাত্মা শিশুপাল অদ্য ভাগ্যক্রমে সমুদয় ভূপতিগণসন্নিধানে সমুপস্থিত আছে। এই পাপশয় অদ্য আমার প্রতি যেরূপ অত্যাচার করিল, তাহা সমস্ত ভূপালগণ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিলেন এবং পরোক্ষে যাহা যাহা করিয়াছিল, তাহাও শ্ৰবণ করিলেন। এই দুরাত্মা অদ্য সমস্ত রাজমণ্ডল-সমীপে আমাকে অপমান করিয়াছে, অতএব কোনক্রমেই ইহার অপরাধ সহ্য করিব না। মূঢ়মতি শিশুপাল যমালয়ে যাইবার নিমিত্ত রুক্সিণীকে প্রার্থনা করিয়াছিল, কিন্তু অপাত্রের বেদশ্রবণপ্রার্থনার ন্যায় উহার ঐ প্রার্থনা বিফল হইয়াছিল।”
তখন সভাস্থ সমস্ত ভূপতিগণ শ্ৰীকৃষ্ণের বাক্য শ্রবণানন্তর শিশুপালকে যৎপরোনাস্তি নিন্দা করিতে লাগিলেন। চেদিরাজ, বাসুদেবের বাক্য শ্রবণ করিয়া অট্ট অট্ট হাস্য করিয়া তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! তুমি এই সভামধ্যে, বিশেষতঃ পার্থিবগণ-সমক্ষে রুক্মিণীকে মৎপুর্ব্বা [অন্যপূর্ব্বা—প্রস্তাবিত পাত্রের সহিত বিবাহ না হইয়া অন্যের সহিত যাহার বিবাহ হয়] বলিয়া কি কিছুমাত্র লজ্জিত হইলে না? হে মধুসূদন! তুমি ব্যতিরেকে অন্য কোন পুরুষাভিমানী ব্যক্তি স্বীয় পত্নীকে অন্যপূর্ব্বা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারে? কেহ কৃষ্ণ! শ্রদ্ধাপূর্ব্বক আমাকে ক্ষমা করিতে ইচ্ছা! হয় কর, না হয় করিও না; ফলতঃ তুমি ক্রুদ্ধ হইলে আমার কোন ক্ষতি নাই এবং প্রসন্ন হইলেও কোন লাভ নাই।”
ভগবান মধুসূদন দুরাত্মা শিশুপালের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া মনে মনে দৈত্যগর্ব্ববিনাশক স্বীয় চক্রাস্ত্ৰ স্মরণ করিলেন। স্মরণমাত্ৰেই চক্ৰ তাহার হস্তে উপস্থিত হইল। তখন ভগবান চক্ৰপাণি ভূপতিগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে মহীপালগণ! আপনারা শ্রবণ করুন, দুরাত্মা শিশুপালের মাতা পূর্ব্বে আমার নিকট প্রার্থনা করিয়াছিলেন যে, তোমাকে আমার পুত্রের শত অপরাধ মার্জনা করিতে হইবে; আমিও তাঁহার প্রার্থনায় সম্মত হইয়াছিলাম; তন্নিমিত্তই এতাবৎকাল পৰ্য্যন্ত উহাকে ক্ষমা করিয়াছি। এক্ষণে উহার একশত অপরাধ পরিপূর্ণ হইয়াছে; অদ্য উহাকে তোমাদিগের সমক্ষেই সংহার করিব।”
কৃষ্ণচক্রে চেদিরাজের শিরচ্ছেদ
অরতিনিসূদন মধুসূদন এই বলিয়া ক্রোধাভরে সুতীক্ষ্ন চক্ৰ দ্বারা চেদিরাজের মস্তকচ্ছেদন করিলেন। চেদিপতি বজ্রাহত পর্ব্বতের ন্যায় ভূপৃষ্ঠে নিপতিত হইলেন। তাঁহার কলেবর হইতে গগনচ্যুত সূৰ্য্যের ন্যায় সুমহৎ তেজঃপুঞ্জ সমুত্থিত হইয়া সর্ব্বলোকনমস্কৃত কমললোচন কৃষ্ণকে অভিবাদনপূর্ব্বক তদীয় শরীরে লীন হইল। ভূপতিগণ এই অদ্ভুত ব্যাপার অবলোকন করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। এইরূপে ভগবান বাসুদেব কর্তৃক শিশুপাল নিহত হইলে জগতে বিনামেঘে বারিবর্ষণ হইতে লাগিল, স্থানে স্থানে প্রজ্জ্বলিত বজ্রপাত হইতে লাগিল ও ভূমিকম্প হইতে লাগিল। তৎকালে অনেকানেক ভূপতিগণ জনার্দ্দনের অলৌকিক কর্ম্মদর্শনে বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া বাঙনিস্পত্তি করিতে পারিলেন না। কেহ কেহ ক্রোধাভরে করে করে পেষণ, কেহ বা ওষ্ঠদংশন করিতে লাগিলেন; কোন কোন মহীপতি নিভৃতে কৃষ্ণকে প্রশংসা করিতে লাগিলেন, অনেকে যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হইলেন; কেহ বা তদ্বিষয়ে ঔদাসীন্য অবলম্বন করিলেন। মহর্ষিগণ, মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ এবং কতিপয় ভূপতিগণ বাসুদেবের বিক্রম দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে স্তব করিতে লাগিলেন। তৎপরে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির মহাবীর দমঘোষনন্দনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করিবার নিমিত্ত স্বীয় অনুজগণকে আদেশ করিলেন। তাহারাও জ্যেষ্ঠভ্রাতার নির্দেশ প্রতিপালন করিলেন।
রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত
অনন্তর মহারাজ যুধিষ্ঠির মহীপাল শিশুপালের পুত্ৰকে চেদিরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। তদনন্তর বিপুলতেজাঃ পাণ্ডুনন্দন সেই সর্ব্বসমৃদ্ধিসম্পন্ন, পরমবিপুলপ্রীতিকর, প্রভূত ধনধান্যসংযুক্ত মহাক্ৰতু রাজসূয় নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন করিলেন। মহাবাহু বাসুদেব শার্ঙ্গ, চক্র ও গদা ধারণপূর্ব্বক আরম্ভ হইতে সমাপন পৰ্য্যন্ত ঐ যজ্ঞ রক্ষা করিলেন। ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির এইরূপে যজ্ঞসমাপনানন্তর অবভৃথস্নান করিলে পর সমাগত সমস্ত ভূপতিগণ তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিতে লাগিলেন, “হে ধর্ম্মজ্ঞ! আপনার সৌভাগ্যের পরিসীমা নাই; আপনি নির্বিঘ্নে সাম্রাজ্য প্রাপ্ত হইলেন এবং আজমীঢ়বংশীয় নৃপতিগণের যশোবৰ্দ্ধন করিলেন। আমরা আপনার মহাযজ্ঞে আসিয়া সর্ব্বপ্রকার কাম্যবস্তু উপভোগ করিলাম, এক্ষণে অনুমতি করুন, স্ব স্ব রাজ্যে প্রস্থান করি।”
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভূপতিগণের বাক্য শ্রবণানন্তর তাঁহাদিগের যথাবিধিপূজা করিয়া ভ্রাতৃগণকে কহিলেন, “হে ভ্রাতৃগণ! এই সমস্ত মহীপতিগণ প্রীতিপূর্ব্বক আমাদের নিকেতনে আগমন করিয়াছিলেন, এক্ষণে অনুমতিগ্রহণপূর্ব্বক স্ব স্ব রাজ্যে গমন করিতেছেন, তোমরা আমাদের রাজ্যসীমা পর্য্যন্ত ইঁহাদের অনুগমন কর।” ধর্ম্মচারী পাণ্ডবগণ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আদেশানুসারে
স্ব স্ব নগরাভিমুখে ভূপতিগণের সহিত এক এক জন গমন করিলেন।
প্রতাপশালী ধৃষ্টদ্যুম্ন বিরাটের, অর্জ্জুন মহাত্মা মহারথ দ্রুপদের, মহাবল-পরাক্রান্ত ভীমসেন ও ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্রের, যুদ্ধবিশারদ সহদেব মহাবীর সপুত্ৰ দ্রোণের, নকুল পুত্র-সহিত সুবলের, দ্রৌপদীনন্দনগণ ও সুভদ্রাতনয় পার্ব্বতীয় ভূপালগণ ও অন্যান্য ক্ষত্ৰিয়দিগের প্রত্যুদগমন করিলেন। তৎপরে সমুদয় ব্রাহ্মণগণ বিধানানুসারে পূজিত হইয়া স্ব স্ব নিকেতনে প্ৰস্থান করিলেন।
এইরূপে সমস্ত ভূপতিবর্গ ও ব্রাহ্মণগণও স্ব স্ব স্থানে গমন করিলে ভগবান বাসুদেব যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “হে কুরুবংশাবতিংশ! মহাক্রতু রাজসূয় সুসম্পন্ন হইয়াছে, এক্ষণে অনুমতি করুন, আমি দ্বারকায় গমন করি।” ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির শ্ৰীকৃষ্ণের বাক্য শ্রবণানন্তর তাহাকে কহিতে লাগিলেন, “হে গোবিন্দ! কেবল তোমার প্রসাদেই আমার রাজসূয় সম্পন্ন হইল; তোমার প্রভাবেই সমস্ত ক্ষত্ৰিয়গণ আমার বশীভূত হইলেন ও সর্বোত্তম উপহার লইয়া আমার সমীপে আগমন করিয়াছিলেন। হে মহাত্মন! এখন কি করিয়া তোমাকে বিদায় দিব? আমি তোমা ব্যতিরেকে এক মুহুৰ্তও প্রসন্নমনে থাকিতে পারি না। কিন্তু কি করি, তোমাকেও অবশ্য দ্বারকাপুরে গমন করিতে হইবে।” যুধীষ্ঠিরের বচনবসানে বাসুদেব তাঁহার সমভিব্যাহারে কুন্তীর সমীপে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে পিতৃষ্বসাঃ! আপনার পুত্ৰগণ সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। এক্ষণে অনুমতি করুন, দ্বারকায় গমন করি।” কৃষ্ণ এইরূপে কুন্তীর অনুজ্ঞাগ্রহণ করিয়া সুভদ্রা ও দ্রৌপদীকে সম্ভাষণপূর্ব্বক যুধিষ্ঠির-সমভিব্যাহারে অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া স্নান, জপ ও ব্রাহ্মণগণের স্বস্তিবাচন করিলেন।
তদনন্তর মহাবাহু কৃষ্ণ-সারথি দারুক মেঘবপুনামক মনোহর রথ যোজনা করিয়া কৃষ্ণসমীপে আনয়ন করিল। মহামতি বাসুদেব সেই গরুড়কেতন রথে সমুপস্থিত দেখিয়া প্ৰদক্ষিণপূর্ব্বক আরোহণ করিয়া দ্বারাবতী প্রস্থান করিলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভ্ৰাতৃগণসমভিব্যাহারে পদব্রজে তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। তখন কমললোচন কৃষ্ণ ক্ষণকাল রথবেগ সংবরণপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “হে রাজন। পর্জ্জন্য যেমন সমস্ত প্ৰাণীগণকে রক্ষা করেন, মহাদ্রুম যেমন পক্ষিগণকে আশ্রয় প্রদান করে, তদ্রুপ আপনি অপ্ৰমত্তচিত্তে নিত্য প্রজাদিগকে পালন করুন। অমরগণ যেমন ইন্দ্রকে আশ্রয় করেন, তদ্রুপ আপনার বন্ধুবৰ্গ আপনাকে আশ্রয় করুন।” এইরূপে বিবিধ কথাবসানে তাঁহারা পরস্পর অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্ব্বক স্ব স্ব আবাসে গমন করিলেন। যাদবপ্রবর কৃষ্ণ দ্বারাবতী গমন করিলে কেবল রাজা দুৰ্য্যোধন ও সুবলনন্দন শকুনি সেই দিব্য সভায় অবস্থান করিতে লাগিলেন।
শিশুপালবধ পৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।