৪৪তম অধ্যায়
অস্ত্ৰস্বামীর সংবাদজিজ্ঞাসায় অর্জ্জুনের উত্তর
“পাণ্ডবগণের সুবর্ণনির্ম্মিত মনোহর আয়ুধ-সকল সমুজ্জ্বল রহিয়াছে দেখিতেছি; কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এক্ষণে যুধিষ্ঠির প্রমুখ সেই মহাত্মা পাণ্ডবগণ কোথায়? তাঁহারা অক্ষে পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হইয়া কোন্ স্থানে গমন করিয়াছেন, আমরা কিছুই শ্রবণ করি নাই। শুনিয়াছি, লোকবিশ্রুত স্ত্রীরত্ন পাঞ্চালীও তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারে বনপ্রয়াণ করিয়াছেন; কিন্তু সম্প্রতি তিনিই বা কোথায়?”
অর্জ্জুন কহিলেন, “আমি পার্থ অর্জ্জুন; রাজা যুধিষ্ঠির তোমার পিতার সভাসদ; ভীমসেন বল্লব নামে পাচক; নকুল অশ্বপাল ও সহদেব গোপাল হইয়া রহিয়াছে; যাহার নিমিত্ত দুরাত্মা কীচকের নিধন হইয়াছে তিনিই দৌপদী, সৈরিন্ধ্রীবেশে তোমার ভবনে কালযাপন করিতেছেন।”
উত্তর কহিলেন, “পার্থের যে দশটি নাম শ্রবণ করিয়াছি, আপনি যদি তাহা কীর্ত্তন করিতে সমর্থ হয়েন, তাহা হইলে আপনার সমুদয় বাক্যে বিশ্বাস করি।”
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে বিরাটতনয়! আমি পার্থের দশ নাম কীর্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ করা। অর্জ্জুন, ফাল্লুন, জিষ্ণু, কিরীটী, শ্বেতবাহন, বীভৎসু, বিজয়, কৃষ্ণ, সব্যসাচী ও ধনঞ্জয়।”
উত্তরবিশ্বস্তার জন্য অর্জ্জুনের দশনাম কথন
উত্তর কহিলেন, “মহাশয়! কি নিমিত্ত আপনার এই দশটি নাম হইল, যথার্থ করিয়া বলুন। আমরা শুনিয়াছি, মহাবীর পার্থের নাম অন্বর্থ; অতএব আপনি যদি ঐ সকল সবিশেষ নির্দেশ করিতে সমর্থ হয়েন তাহা হইলে আপনার বাক্যে আর কিছুমাত্র সন্দেহ রহিবে না।”
অর্জ্জুন কহিলেন, “আমি নিখিল জনপদ জয় করিয়া ধন সংগ্রহপূর্ব্বক তন্মধ্যে অবস্থিতি করি; এই নিমিত্ত আমার নাম ধনঞ্জয় হইয়াছে। আমি সমরাঙ্গনে রণবিশারদ বীরগণকে পরাজয় না করিয়া প্রতিনিবৃত্ত হই না, এই কারণে লোকে আমাকে বিজয় বলিয়া থাকে। যুদ্ধ করিবার সময়ে আমার রথে শ্বেতাশ্ব সংযোজিত হয়, এই নিমিত্ত আমার নাম শ্বেতবাহন হইয়াছে! আমি হিমাচল-পৃষ্ঠে উত্তরফলগুনী-নক্ষত্ৰযুক্ত দিবসে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, এই নিমিত্ত সকলে আমাকে ফাল্গুণ বলিয়া থাকে। আমি পূর্ব্বে মহাবল দাবানলেল সহিত ঘোরতর সমরসাগরে অবতীর্ণ হইলে দেবরাজ প্রসন্ন হইয়া আমার মস্তকে সূৰ্য্যসমুজ্জ্বল কিরীট প্রদান করেন, এই নিমিত্ত আমার নাম করাটী হইয়াছে।
আমি যুদ্ধস্থলে কদাপি বীভৎস কর্ম্ম করি নাই, এই নিমিত্ত দেবলোকে ও মনুষ্যলোকে আমার বীভৎসু নাম বিশ্রুত হইয়াছে। আমি বাম ও দক্ষিণ উভয়হস্তেই গাণ্ডীবধনু আকর্ষণ করিতে পারি, এই নিমিত্ত আমার নাম সব্যসাচী হইয়াছে। আমি এই সাগাম্বারা বসুন্ধরায় নির্ম্মল কর্ম্ম করিয়া থাকি, এই নিমিত্ত লোকে আমাকে অর্জ্জুন বলিয়া থাকে। যুদ্ধস্থলে সাহসপূর্ব্বক কেহ আমার সম্মুখে আগমন করিতে পারে না, আমি অতি দুৰ্দ্ধৰ্ষ শক্রকেও জয় করিয়া থাকি, এই নিমিত্ত আমার নাম জিষ্ণু হইয়াছে। আর বিশুদ্ধ কৃষ্ণবর্ণ বালক লোকের সাতিশয় প্রিয়, এই নিমিত্ত পিতা আমার নাম কৃষ্ণ রাখিয়াছেন।”
অনন্তর উত্তর অর্জ্জুনের এই সমস্ত বাক্য-শ্রবণে সাতিশয় বিস্মিত ও চমৎকৃত হইয়া অভিবাদনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে মহাবাহো! আজি আমার পরম সৌভাগ্য! আপনার সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া আজি চরিতার্থ হইলাম। আমি অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত যে সকল অযুক্ত কথা বলিয়াছি, তজ্জন্য আমার অপরাধ মার্জনা করিবেন। আপনি পূর্ব্বে যে সমস্ত অদ্ভুত কর্ম্ম করিয়াছেন, তন্নিমিত্ত আমার হৃদয়ে ভয়সঞ্চার না হইয়া বরং প্রীতিরই উদয় হইতেছে।”