প্রাক-বিভক্ত সমাজ ও প্রাক-অধ্যাত্মবাদী চেতনা
লোকায়ত, তন্ত্র, সাংখ্য—আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাসের মধ্যেই এই ধ্যানধারণাগুলির উৎস, এবং এ-দেশের উৎপাদন কৌশলের বিকাশ অনেকাংশে বাধাপ্রাপ্ত বলেই অপেক্ষাকৃত অনুন্নত পর্যায়ের কৃষিকাজই এখানে প্রধানতম জীবনোপায় হয়েছে। ফলে তারই উপর প্রতিষ্ঠিত ওই ধ্যানধারণাগুলিই দেশের সংস্কৃতিতে বহু দীর্ঘদিন ধরে গভীর ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। লোকায়ত-মতকে এইদিক থেকেই লোকেষু আয়ত—অর্থাৎ, জনসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত—মনে করা যায়।
অপরপক্ষে, লোকায়তর আর একটি অর্থ আছে। শ্ৰীযুক্ত রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়(৭৫৮) যেমন বলছেন, ‘ইহলোক ঐ দর্শনের সর্বস্ব, তজ্জন্যই উহার ঐরূপ নামকরণ হয়’। মহামহোপাধ্যায় পঞ্চানন তর্করত্নের(৭৫৯) মতেও লোক—অর্থাৎ দৃশ্যমান ইহলোক—ব্যতীত, উত্তরকাল স্বীকার করে না বলেই এ-দর্শনের নাম লোকায়ত। সেণ্ট পিটার্সবার্গ অভিধানেও(৭৬০) লোকায়ত শব্দকে materialism বা বস্তুবাদ অর্থেই গ্রহণ করা হয়েছে।
তন্ত্রের দেহতত্ত্ব এবং সাংখ্যের প্রধানকারণবাদ এই দ্বিতীয় অর্থটির উপর আলোকপাত করে। মানবদেহের অনুরূপ হিসেবেই তন্ত্রে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে চেনবার প্রচেষ্টা দেখা যায়। ফলে উত্তরকালে তন্ত্রের উপর অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদের প্রলেপ যতোই পড়ক না কেন, তার আদিরূপটি ওই দেহবাদ বা বস্তুবাদই—সে-বস্তুবাদ যতো মূক, অব্যক্ত ও অচেতন হোক না কেন, যতোই অসম্ভব হোক না কেন তার বাস্তব জ্ঞানের দৈন্য। আদি-সাংখ্যের প্রধানকারণবাদ বা অচেতনকারণবাদ এই অফুট বস্তুবাদেরই পরিচ্ছন্ন দার্শনিক সংস্করণ, এবং বৈদান্তিক বা চেতনকারণবাদী চিন্তাধারার প্রধানতম প্রতিপক্ষ।
আমরা যে-চিন্তাধারাকে লোকায়ত বলে সনাক্ত করবার চেষ্টা করেছি বস্তুবাদ ছাড়াও তার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো নারীপ্রাধান্য বা মাতৃপ্রাধান্য। আমরা ইতিপূর্বেই এই বৈশিষ্ট্যটির ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছি। বর্তমানে আমরা লোকায়তিক চিন্তাধারার বস্তুবাদমূলক বৈশিষ্ট্যের আলোচনা উত্থাপন করবো।
আমাদের প্রধান প্রতিপাদ্য হবে, প্রাক্-বিভক্ত সমাজের স্বাক্ষর বহন করছে বলেই লোকায়ত-মত প্রাক-অধ্যাত্মবাদী, এবং সেই অর্থেই অচেতনকারণবাদ বা বস্তুবাদ। এবং আমাদের মূল যুক্তি হবে, চেতনকারণ-বাদ বা ভাববাদের যেটা বাস্তব ভিত্তি (material basis), প্রাক্-বিভক্ত সমাজে তার বিকাশ সম্ভব নয় অতএব সে-পর্যায়ের ধ্যানধারণাও চেতনকারণ-বাদ বা ভাববাদে পরিণত হবার সুযোগ পায় না। অর্থাৎ, লোকায়তর অচেতনকারণ-বাদকে বোঝবার উদ্দেশ্বেই আমাদের প্রধানতম আলোচ্য হবে চেতনকারণ-বাদের জন্মকাহিনী।
ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে চেতনকারণ-বাদের আবির্ভাব কাহিনী নিয়ে আলোচনা তোলবার আগে সাধারণভাবে চেতনকারণ-বাদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
চেতনকারণ-বাদের মূল কথাটা কী? চিন্তা বা ধারণা বা জ্ঞান বা মন বা ইন্দ্রিয়ানুভূতি—এককথায় কোনো-না-কোনো প্রকার চেতন-পদার্থই—চরম সত্য বা পরম সত্তা। যা-কিছু সত্য, যা-কিছু বাস্তব তা এর উপর নির্ভরশীল হিসেবে, এরই দাবি মিটিয়ে, তবে সত্য বা বাস্তব। অতএব তথাকথিত বহির্বাস্তব, চেতন-নিরপেক্ষ অর্থে সত্য নয়। চেতনা বা মানবসত্তার দাবি মেটানো-না-মেটানোর উপরই সবকিছুর সত্তা নির্ভরশীল।
অবশ্যই দর্শনের ইতিহাসে ভাববাদ বা চেতনকারণ-বাদের রূপ সর্বত্রই এক নয়। কিন্তু উপরোক্ত যুক্তিটিই চেতনকারণ-বাদমাত্রের মূল ভিত্তি। বিভিন্ন চেতনকারণ-বাদী দার্শনিক এই কাঠামোটির ভিতরেই বিভিন্নভাবে তাঁদের মন্তব্য ব্যক্ত করেছেন।
চেতনাই সর্বশক্তিমান,—অষ্টার মতো। মানুষের ধ্যানধারণায় এ-জাতীয় কথা আবির্ভাব হবার বাস্তব সর্ত কী? জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে সম্পর্ক বিচ্ছেদ; শুধু তাই নয়, জ্ঞানের তুলনায় কর্মকে হেয় বা নিম্নবৃত্তি বলে মনে করা। কেননা, কর্মের মধ্যে বহির্বাস্তবের অবধারিত যাথার্থ্যের অনিবার্য স্বীকৃতি(৭৬১); কর্ম বাদ দিয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞানের উপর নির্ভর করে সত্যনিরূপণের প্রচেষ্টা তাই বহির্বাস্তবের যাথার্থ-স্বীকৃতির দায়মুক্ত। তখন চেতনাই চরম সত্য, সর্বশক্তিমান, সর্বনিয়ন্ত।
আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি (পৃ. ৭৯–৮৬) আদিম প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্যানধারণা অনিবার্য ঐতিহাসিক কারণে এই পর্যায়ে পৌঁছতে পারে না। কেননা, উৎপাদন-কৌশলের দৈন্য বা অনুন্নতিই সে-সমাজের ভিত্তি—এই দৈন্যের দরুনই উদ্ধৃত্ত-উৎপাদন সম্ভব নয়, তাই উদ্ধৃত্তজীবী শ্রেণীর আবির্ভাবও সম্ভব নয়। শ্রমে অংশগ্রহণ করবার দায়িত্ব সকলেরই। আর তাই মানুষের ধ্যানধারণাও বহির্বাস্তবের যাথার্থ্য-স্বীকৃতির দায়মুক্ত নয়। উৎপাদনকৌশলের উন্নতির ফলে উদ্ধৃত্ত-উৎপাদন—এবং অতএব উদ্ধৃত্তজীবী শ্রেণীর আবির্ভাব—হবার পরই বহির্বাস্তব এই শ্রেণীর মনের চাহিদা মেটাতে বাধ্য হয়েছে আর তখন থেকেই মানুষের মাথায় এ-যুক্তির আবির্ভাব হয়েছে যে, মনের চাহিদাই—চেতনার চাহিদাই—সর্বশক্তিমান, জগৎ-নির্মাতা। মিশরের পুরোহিত-রাজ পিরামিডের কথা ভাবলেন, বহির্জগতে গগন-চুম্বী পিরামিড গড়ে উঠলো—বহির্জগৎ মনের দাবি মানলো। কেননা, যে লক্ষ মানুষের কায়িক শ্রম এই অসাধ্য-সাধন করতে পেরেছে তারা দাস, তারা হীন, তারা নীচ—সমাজের সদর-মহলে তাদের স্থান নেই, আর তাই সদর-মহলের ধ্যানধারণায় তাদের ওই অবদানটারও স্বীকৃতি নেই।
In the face of all these creations, which appeared in the first place to be products of the mind, and which seemed to dominate human society, the more, modest productions of the working hand retreated into the background, the more so, since the mind that plans the labour-process…was able to have the labour that had been planned, carried out by other hands than its own. All merit for the swift advance of civilization was ascribed to the mind…and so there arose, in the course of time, that idealistic outlook on the world which, especially since the decline of the ancient world, has dominated men’s minds.(৭৬২)
আমরা দেখেছি (পৃ. ৩১–৩৩) লোকায়তিকদের ধ্যানধারণা এইভাবে শ্রমের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পায়নি, কেননা বার্তা বা কৃষিকাজই তাদের কাছে প্রধানতম বিদ্যা। আর তাই তাদের চেতনাও মুক্তি পায়নি বহির্বাস্তবের যাথার্থ্য-স্বীকৃতির দায়িত্ব থেকে। প্রাচীন সমাজের সেই পর্যায়টি—মেয়েরা যখন কৃষিকাজ আবিষ্কার করে নিজেদের ফলপ্রসূতার অনুরূপ হিসেবেই প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতাকে বোঝবার চেষ্টা করছে, এবং নিজেদের দেহের উপমান হিসেবেই প্রকৃতিকেও বুঝতে চেষ্টা করছে—প্রকৃত-পক্ষে প্রাক্-বিভক্ত সমাজেরই একটি পর্যায়। এই কারণেই বার্তাকেন্দ্রিক ওই ধ্যানধারণাও প্রাক্অধ্যাত্মবাদী, এবং সেই অর্থে বস্তুবাদী—সে-বস্তুবাদ যতো অফুট ও প্রাকৃতই হোক না কেন।
লোকায়তিক অচেতনকারণ-বাদের তাৎপর্য বোঝবার আশায় আমরা অধ্যাত্মবাদ বা চেতনকারণ-বাদের উৎস নিয়ে আলোচনা তুলবো। ঘুরিয়ে বা নেতিমূলকভাবে হলেও এ-আলোচনা লোকায়তিক বস্তুবাদের উপর আলোকপাত করতে পারে। কেননা, ধ্যানধারণার ক্রমবিকাশের ইতিহাসে এই চেতনকারণ-বাদ যে-পর্যায়টিকে পিছনে ফেলে এসেছে সেই পর্যায়টিই হলো ওই লোকায়তিক প্রাক-অধ্যাত্মবাদ বা অফুট বস্তুবাদ।
কিন্তু যে-হেতু আমরা চেতনকারণ-বাদের আবির্ভাবকে শ্রেণীসমাজ-জনিত জ্ঞান ও কর্মের বিচ্ছেদের পরিণাম হিসেবেই বোঝবার চেষ্টা করবো, সেই হেতু আমাদের পক্ষে প্রথমে সাধারণভাবে শ্রেণীসমাজের উৎপত্তি-সংক্রান্তু ঐতিহাসিক নিয়মের পটভূমিটিকে মনে রাখা প্রয়োজন। উৎপাদনকৌশলের উন্নতিই আদিম প্রাক্-বিভক্ত সমাজ থেকে শ্রেণীবিভাগের দিকে অগ্রগতির মূল কারণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উৎপাদন-কৌশলের উন্নতির ঠিক কোন বৈশিষ্ট্যটি থেকেই মানবসমাজে ক্রমশ শ্রেণীবিভাগ পরিস্ফুট হয়ে উঠতে লাগলো? এঙ্গেলস্ দেখাচ্ছেন, পৃথিবীর সমস্ত মানবজাতির বেলাতেই হুবহু একরকম নয়। কোথাও বা কৃষিকাজের উন্নতি থেকে, আবার কোথাও বা পশুপালনের উন্নতি থেকে শ্রেণীবিভক্ত (ও রাষ্ট্রশক্তি-শাসিত) সমাজের উদ্ভব। কেননা, একদিকে যেমন কৃষিকাজের উন্নতি, অপরদিকে তেমনি পশুপালনের উন্নতি থেকেই মানুষের পক্ষে উদ্ধৃত্ত-উৎপাদনের ক্ষমতা প্রভূত পরিমাণে বেড়ে গেলো। (পৃ. ৩০০ দ্রষ্টব্য)।
আমেরিকার ইরোকোয়া নামের আদিবাসীরা কৃষি-উন্নতির পথ ধরেই প্রাক্-বিভক্ত সমাজের সীমারেখা পেরিয়ে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের দিকে অগ্রসর হবার উপক্রম করেছিলো; সেই অবস্থাতেই কলম্বাসের অনুগামীদের আক্রমণে তাদের অগ্রগতি নিরুদ্ধ হয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সিন্ধু-উপত্যকার ধুলোর নিচে এই অগ্রগতির কাহিনী নিশ্চয়ই ঢাকা পড়ে রয়েছে। কেননা, ওখানের প্রত্নতত্ত্বমূলক নিদর্শনগুলির মধ্যে একদিকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র-শক্তি এবং শ্রেণীশোষণের পরিচয়, আবার অপরদিকে দেখা যাচ্ছে কৃষিউৎপাদনই ছিলো ওই নাগরিক জীবনের প্রধানতম সম্পদ। দ্রষ্টব্য এই যে, ওই শ্রেণীশোষণ ও কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র-শক্তির পর্যায়ে পৌঁছেও সিন্ধুসভ্যতার মানুষগুলির চেতনা থেকে মাতৃপ্রধান ধ্যানধারণার স্মৃতি সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। অবশ্যই আদি-তন্ত্র ও আদি-সাংখ্যের মতো এই মাতৃপ্রধান ধ্যানধারণা তখনো প্রাক-অধ্যাত্মবাদ বা অচেতনকারণ-বাদের পর্যায়েই ছিলো কিনা, তা খুবই সন্দেহের কথা। বরং রাষ্ট্র-শক্তি ও শ্রেণীশোষণের পটভূমিকায় টিকে থাকবার সময় এগুলির পক্ষে অধ্যাত্মবাদী চেতনার অঙ্গীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তবুও মাতৃপ্রাধান্যমূলক ধ্যানধারণার সঙ্গে কৃষি-আবিষ্কারের সম্পর্ক যে কতো ঘনিষ্ঠ এবং মানবচেতনায় এই মাতৃপ্রধান ধ্যানধারণার প্রভাব যে কতো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, হরপ্পা-মোহেনজোদারোর প্রত্নতত্ত্বমূলক নিদর্শনগুলিই তার পরিচায়ক। অর্থাৎ, সিন্ধুসভ্যতা নিশ্চয়ই রাতারাতি গড়ে ওঠেনি; তার পিছনেও একটা দীর্ঘযুগের ক্রমোন্নতির ইতিহাস অনুমান করতে আমরা বাধ্য। সে-ইতিহাস নিশ্চয়ই কৃষিকাজ আবিষ্কার থেকে শুরু করে কৃষিকর্মের ওই অতোখানি উন্নত পৰ্যায় পর্যন্ত ব্যাপৃত, যে-পর্যায়ে পৌঁছে কৃষিজাত উদ্ধৃত্তের উপর নির্ভর করে অমন নগরজীবন ইত্যাদি গড়ে তোলা সম্ভবপর। অতএব অনুমান করবার সুযোগ আছে যে, সিন্ধু-উপত্যকায় যে-মাতৃপ্রধান ধ্যানধারণার পরিচয় পাই, তারও আদিরূপ আদি-তন্ত্রের মতোই প্রাক্-অধ্যাত্মবাদীই ছিলো, যদিও যে-পটভূমিকায় মাতৃপ্রধান ধ্যানধারণার এই স্মারকগুলি পাওয়া গিয়েছে, সেখানেও এগুলির পক্ষে ওই আদিম প্রাক-অধ্যাত্মবাদসূচক হবার সম্ভাবনা নিশ্চয়ই নেই।
তন্ত্রের দুটো দিক। মাতৃপ্রধান ও প্রাক্-আধ্যাত্মিক। কৃষি-আবিষ্কারজাত ধ্যানধারণা বলেই তা মাতৃপ্রধান। প্রাক্-বিভক্ত-সমাজ-জাত বলেই তা প্রাক্-আধ্যাত্মিক। কৃষি-আবিষ্কারের প্রাথমিক পর্যায়ে মানব-সমাজ শ্রেণী-বিভক্ত হয়নি।
অপরপক্ষে, প্রাক্-অধ্যাত্মবাদী ধারণামাত্রেই মাতৃপ্রধান হতে বাধ্য নয়। তার কারণ, প্রাক্-বিভক্ত সমাজমাত্রই কৃষিনির্ভর—বা অনুন্নত পর্যায়ের কৃষিনির্ভর—হতে বাধ্য নয়। এ-আলোচনার জন্য প্রাক্-বিভক্ত সমাজ ছেড়ে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের দিকে অগ্রসর হবার দ্বিতীয় পথটির কথা উত্থাপন করা প্রয়োজন।
আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি (পৃ. ৩০০–৩০২), বৈদিক মানুষদের ইতিহাস এই পথটির পরিচায়ক। পশুপালনের উন্নতির উপর নির্ভর করেই তারা প্রাক্-বিভক্ত সমাজ ছেড়ে শ্রেণীসমাজের দিকে অগ্রসর হতে পেরেছিলো। পশুপালন-নির্ভর সমাজ পিতৃপ্রধান, বৈদিক ধ্যানধারণাও তাই পুরুষ-প্রধান (পৃ. ৩২০—৩২৮)। কিন্তু পুরুষ-প্রধান এই ধ্যানধারণার আদিপর্যায়ের মধ্যে প্রাক-অধ্যাত্মবাদী চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় (পৃ. ১০২— ১১২ এবং পৃ. ১৫১–১৫২); সেই দিকটি হলো বৈদিক সমাজের প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ের স্বাক্ষর। কেননা, প্রাক্-অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণায় প্রাক্-বিভক্ত সমাজের প্রতিবিম্ব : কৃষি-নির্ভর প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্যানধারণা মাতৃপ্রধান, পশুপালন-নির্ভর প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্যানধারণা পুরুষপ্রধান–কিন্তু দুই-ই প্রাক্-অধ্যাত্মবাদী। এবং এইদিক থেকেই বুঝতে পারা সম্ভব, বৈদিক চিন্তাধারার সঙ্গে উত্তরযুগে লোকায়তিক চিন্তাধারার যতোই পার্থক্য থাকুক না কেন, বৈদিক চিন্তাধারারও প্রাক্-আধ্যাত্মবাদী অর্থে একটা লোকায়তিক অতীত ছিলো।
অধ্যাত্মবাদের আবির্ভাব-ইতিহাস প্রসঙ্গে আমরা এই বৈদিক ধ্যানধারণার ক্রমবিকাশ নিয়েই আলোচনা তুলবো। তার প্রধান কারণ হলো, প্রাক্-বিভক্ত সমাজ থেকে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের দিকে অগ্রগতির, —এবং তারই প্রতিবিম্ব হিসেবে প্রাক্-অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার পক্ষে অধ্যাত্মবাদে পরিণতির—সুবিস্তীর্ণ সাহিত্য ওই বৈদিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই মুলভ। পরবর্তী পরিচ্ছেদে আমরা প্রধানত তারই আলোচনা করবো।
————————
৭৫৮. বঙ্গদর্শন, শ্রাবণ ১২৮১।
৭৫৯. চতুর্দশ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের দর্শন শাখার সভাপতির অভিভাষণ।
৭৬০. সেন্ট পিটার্সবার্গ অভিধান দ্রষ্টব্য।
৭৬১. K. Marx C 177f. Contrast শঙ্কর : ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ১. ২. ৪ । কালীবর বেদান্তবাগীশ ১:১০৭ ৷
৭৬২. F. Engels DN 288-9.