৪৩তম অধ্যায়
অসাধারণ বিভূতিযুক্ত পদার্থের পরিচয়
“ব্রহ্মা বলিলেন, “হে মহর্ষিগণ! রজোগুণযুক্ত ক্ষত্রিয় মনুষ্যগণের; হস্তী বাহনগণের; সিংহ বনজন্তুগণের; মেষ গ্রাম্য পশুগণের; সর্প গৰ্ত্তবাসিদিগের; বৃষভ গোসমুদয়ের; পুরুষ স্ত্রীসমূহের; বধ জম্বু, অশ্বত্থ, শাল্মলী, শিংশপা, মেঘশৃঙ্গ ও কীচকবেণু [তলদা বাঁশ] বৃক্ষসমুদয়ের; হিমালয় পারিপাত্র, সহ্য, বিন্ধ্য, ত্রিকূট, শ্বেত, নীল, ভাস, কোষ্ঠবান, গুরুস্কন্ধ, মহেন্দ্র ও মাল্যবান পর্ব্বতদিগের; সূৰ্য্য উষ্ণ পদার্থ গ্রহসমুদয়ের; চন্দ্র ওষধি, ব্রাহ্মণ ও নক্ষত্রসমুদয়ের; যম পিতৃলোকের; সাগর নদীগণের; বরুণ জলজন্তুদিগের; অগ্নি পৃথিব্যাদি ভূতসমুদয়ের; বৃহস্পতি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের; বিষ্ণু বলবানদিগের; ত্বষ্টা রূপসমুদয়ের; শিব প্রাণীগণের; যজ্ঞ দীক্ষিত দেবতাদিগের; উত্তরদিক্ দিক্সমুদয়ের; কুবের রত্নসমুদয়ের এবং প্রজাপতিগণ প্রজাদিগের অধিপতি বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকেন। ভগবতী পার্ব্বতীকে কামিনীগণের মধ্যে এবং অপ্সরাগণকে বেশ্যাদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত করা যায়।
‘আমি সৰ্ব্বভূতের অধীশ্বর ও ব্রহ্মময়। এই ব্রহ্মাণ্ডমধ্যে আমার ও বিষ্ণুর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রাণী আর কেহই নাই। ব্রহ্মময় বিষ্ণু দেবতা, নর, কিন্নর, যক্ষ, গন্ধৰ্ব্ব, পন্নগ, রাক্ষস ও দানব প্রভৃতি সমুদয় প্রাণীর ঈশ্বর ও নারদাদি যোগিগণের পরম ঐশ্বৰ্য্যস্বরূপ। ব্রাহ্মণ উহাকে সতত হৃদয়মধ্যে দর্শন করিয়া পরমসুখ অনুভব করিয়া থাকেন।
‘ভূপতিগণ সতত ধৰ্মলাভের অভিলাষ করিয়া থাকেন; অতএব ধর্ম্মের হেতুভূত ব্রাহ্মণগণের ধৰ্ম্মরক্ষা করা তাঁহাদের সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। যে সকল রাজার রাজ্যমধ্যে সাধু ব্রাহ্মণগণ নিয়ত কষ্টভোগ করেন, তাঁহারা ইহলোকে নিতান্ত নিন্দনীয় ও পরলোকে নীচগতি প্রাপ্ত হয়েন। আর যেসমুদয় ভূপতির রাজ্যমধ্যে সাধু ব্রাহ্মণগণ সতত পরিরক্ষিত হয়েন, তাঁহারা উভয়লোকেই অতি উৎকৃষ্ট সুখভোগে সমর্থ হইয়া থাকেন।
‘অতঃপর আমি তোমাদিগের নিকট পদার্থসমুদয়ের অসাধারণ ধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। অহিংসা পরমধৰ্ম্মের, হিংসা অধৰ্ম্মের, অকস্মাৎ আবির্ভাব দেবতাদিগের, যজ্ঞাদিকৰ্ম্ম মনুষ্যগণের, শব্দ আকাশের, স্পর্শ বায়ুর, রূপ তেজের, রস জলের, গন্ধ ধরিত্রীর, বর্ণাত্মক শব্দ বাক্যের, সংশয় মনের, নিশ্চয় বুদ্ধির, ধ্যান চিত্তের, স্বপ্ৰকাশত্ব জীবের, প্রবৃত্তি কাম্যকর্ম্মের ও সন্ন্যাস জ্ঞানের অসাধারণ ধৰ্ম্ম। বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি জ্ঞানকে আশ্রয় করিয়াই সন্ন্যাসধৰ্ম্ম অবলম্বন করিবেন। যিনি সন্ন্যাসধর্ম্ম সম্যকরূপে প্রতিপালন করিতে পারেন, তিনিই মোহ, জরা, মৃত্যু ও সুখদুঃখাদি হইতে মুক্ত হইয়া পরমগতিলাভে সমর্থ হয়েন। এই আমি তোমাদিগের নিকট পদার্থসমুদয়ের অসাধারণ ধৰ্ম্মসমুদয় কীৰ্ত্তন করিলাম।
ইন্দ্রিয়-দেবতা ও গুণধর্ম্ম
‘অতঃপর যে যে দেবতার সাহায্যে যে যে ইন্দ্রিয়দ্বারা যে যে গুণ পরিগৃহীত হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। গন্ধ পৃথিবীর গুণ; উহা নাসিকাস্থিত বায়ুর সাহায্যে নাসিকাদ্বারা আঘ্রাত হইয়া থাকে। রস জলের গুণ; উহা জিহ্বস্থিত চন্দ্রের সাহায্যে জিহ্বদ্বারা আস্বাদিত হয়। রূপ তেজের গুণ; উহা নেত্রস্থিত আদিত্যের সাহায্যে নেত্ৰদ্বারা দৃষ্ট হইয়া থাকে। স্পর্শ বায়ুর গুণ; উহা ত্বক্স্থিত বায়ুর সাহায্যে ত্বক্দ্বারা অনুভূত হয়। শব্দ আকাশের গুণ; উহা কৰ্ণস্থিত দিকসমুদয়ের সাহায্যে কর্ণদ্বারা শ্রুত হইয়া থাকে। চিন্তা মনের গুণ; উহা হৃদয়স্থিত জীবের সাহায্যে প্রজ্ঞাদ্বারা সম্পাদিত হয়।
‘বুদ্ধি নিশ্চয়-জ্ঞানদ্বারা এবং মহত্তত্ত্ব চৈতন্যপ্রতিবিম্বদ্বারা অনুভূত হইয়া থাকে। আত্মার জ্ঞাপক কিছুই নাই। উহা নির্গুণ ও একমাত্র অনুভবস্বরূপ। প্রকৃতি, মহত্তত্ত্ব ও অহঙ্কার প্রভৃতি যাবতীয় উৎপন্ন পদার্থকে ক্ষেত্ৰশব্দে নির্দ্দেশ করা যায়। এক্ষণে আমি সেই ক্ষেত্রকে পুরুষ হইতে অভিন্ন বলিয়া পরিজ্ঞাত হইতেছি। পুরুষ ক্ষেত্রকে সবিশেষ অবগত আছেন বলিয়া ক্ষেত্রজ্ঞনামে অভিহিত হয়েন। ক্ষেত্রজ্ঞ আদিমধ্যান্তবিশিষ্ট অচেতন গুণসমুদয়কে অনায়াসে প্রত্যক্ষ করিয়া থাকেন; কিন্তু গুণসমুদয় বারংবার সৃষ্ট হইয়াও ক্ষেত্রজ্ঞকে অবগত হইতে পারে না। ক্ষেত্রজ্ঞ প্রকৃতি প্রভৃতি সমুদয় তত্ত্ব হইতে অতীত। উঁহাকে কেহই অবগত হইতে পারে না। উনি আপনি আপনার স্বরূপ অবগত হইতে পারেন; এই নিমিত্তই ধর্ম্মতত্ত্বকুশল পণ্ডিতেরা গুণসমুদয় ও বুদ্ধিকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ক্ষেত্রস্বরূপ হইয়া নির্দ্বন্দ্ব পরব্রহ্মে লীন হইয়া থাকেন।”