প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

৪২. লোকায়ত, তন্ত্র, সাংখ্য : অসুর-মত

লোকায়ত, তন্ত্র, সাংখ্য : অসুর-মত

এই প্রসঙ্গে আর একটি চিত্তাকর্ষক বিষয়ের উল্লেখ করা যাক। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি যে, তন্ত্রও শুধুমাত্র নারীপ্রধান ধ্যানধারণার পরিচায়ক নয়; দেহতত্ত্বের দিক থেকে এই চিন্তাধারাকে বস্তুবাদ আখ্যা দেবার প্রয়োজন আছে,—সে-বস্তুবাদ যতো আদিম, যতো অস্ফুট এবং জ্ঞানের দৈন্যে তা যতোই অসম্পূর্ণ ও মানব শৈশবের পরিচায়ক হোক না কেন। বস্তুত, গুণরত্ন প্রমুখের রচনায়, তন্ত্রের সঙ্গে লোকায়তর সম্পর্কমূলক যে-ইংগিত পাওয়া যায়, আমরা তার ব্যাখ্যা তন্ত্রের এই অফুট বস্তুবাদের দিক থেকেই পাবার চেষ্টা করেছি। অতএব, তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের যদি তত্ত্বগত সাদৃশ্য থাকে—সাংখ্য যদি তন্ত্রেরই অপেক্ষাকৃত মার্জিত ও দার্শনিক সংস্করণ হয়,—তাহলে সাংখ্যের সঙ্গে লোকায়তরও একটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। স্বভাবতই, আস্তিকদের রচনায় আমরা এই সম্পর্কটির ইংগিত প্রত্যাশা করবো না। কেননা, আদি-সাংখ্য অবৈদিক মতবাদ হওয়া সত্ত্বেও, উত্তরকালে তাকে আস্তিক করে নেবার এমন প্রবল চেষ্টা করা হয়েছে যে, সাংখ্যের আদিরূপটিই আমাদের কাছে অনেকাংশে অপরিচিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই, আস্তিক-সাহিত্যের বাইরেই আদি-সাংখ্যের সঙ্গে লোকায়তর সম্পর্কমূলক ইংগিত অনুসন্ধান করা যুক্তিসঙ্গত হবে।

সুখের বিষয়, অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত(৭৪৪) ইতিপূর্বেই এই বিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন যে, জৈন লেখকরা সাংখ্য এবং লোকায়তর মধ্যে খুব বড়ো রকমের কোনো তফাত স্বীকার করেননি।

After the treatment of the views of the lokayata nastikas, the Sutra-kritanga-sutra treats of the Samkhyas. In this connection Silanka says that there is but little difference between the lokayata and the Samkhya, for though the Samkhyas admit souls, these are absolutely incapable of doing any work, and all the work is done by prakriti which is potentially the same as the gross elements. The body and the so-called mind is therefore nothing but the combination of the gross elements, and the admission of separate purusas is only nominal. Since such a soul cannot do anything, and is of no use (akimcitkara), the Lokayatas flatly deny them.
সূত্রকৃতাঙ্গসূত্রে লোকায়ত নাস্তিকদের মত আলোচনার পর সাংখ্যমত আলোচিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে শীলাঙ্ক বলছেন, লোকায়ত ও সাংখ্যের মধ্যে সামান্যই প্রভেদ আছে; কেননা যদিও সাংখ্য-দর্শনে আত্মা স্বীকৃত হয়েছে তবুও সে-আত্মার পক্ষে কোনো ক্রিয়াই সম্ভব নয়—সমস্ত ক্রিয়াই প্রকৃতির এবং প্রকৃতি বলতে স্থলভূতেরই অব্যক্ত অবস্থা। অতএব, দেহ এবং তথাকথিত মন স্থলভূতের সংমিশ্রণ ছাড়া কিছুই নয় এবং স্বতন্ত্র পুরুষের স্বীকৃতিটা নামমাত্রই। এই আত্মা অক্রিয় ও অকিঞ্চিৎকর বলেই লোকায়তরা একে সরাসরি অস্বীকার করেছে।

জৈন গ্রন্থে লোকায়তর সঙ্গে সাংখ্যের এই যে-সম্বন্ধ নির্দিষ্ট হয়েছে, সাধারণত তার প্রতি উপযুক্ত গুরুত্ব অর্পণ করা হয় না। কিন্তু বাদরায়ণ যেভাবে সাংখ্যমতকে অচেতনকারণ-বাদ বা বস্তুবাদ বলেই সনাক্ত করতে চেয়েছেন এবং চরক-সংহিতায় পুরুষকে যে-ভাবে প্রকৃতিরই অব্যক্ত অংশ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলে আমরা হয়তো দেখতে পাবো, জৈন লেখকদের এই উক্তি আসলে অতিশয়োক্তি নয়।

লোকায়তর সঙ্গে তন্ত্র ও সাংখ্যের কোনো-একটা সম্পর্ক অনুসন্ধান করা যে একান্তই অসম্ভব নয় এখানে আমরা সে-বিষয়ে আরো কয়েকটি চিত্তাকর্ষক তথ্য উপস্থিত করবো।

প্রথমত দেখা যায়, লোকায়তকে নানানভাবে অসুর-মত বলে বর্ণনা করবার চেষ্টা করা হয়েছে। তার পিছনে নিশ্চয়ই লোকায়তকে নিন্দা করবার উৎসাহ ছিলো; কিন্তু তা সত্ত্বেও এরই মধ্যে কিছুটা ঐতিহাসিক তথ্যের আভাস থাকা অসম্ভব নয়।

আমরা ইতিপূর্বেই (পৃ. ৪৩৮) এ-বিষয়ে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের মতবাদ দীর্ঘভাবে আলোচনা করেছি। তিনি বলছেন, ছান্দোগ্য-উপনিষদের ইন্দ্র-বিরোচন-সংবাদে দেহাত্মবাদের—অতএব, লোকায়ত-মতের—পরিচয় পাওয়া যায়, এবং ছান্দোগ্যে এ-কথা স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যে, মতবাদটি অসুরদের মধ্যেই প্রচলিত ছিলো। এই তথ্য থেকে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত লোকায়ত-মতের সুমেরীয় উৎস-সংক্রান্ত প্রকল্পে পৌঁছতে চেয়েছেন। আমরা সে-প্রকল্পের সমালোচনা করেছি। কেননা, অসুর বলতে যে প্রাচীন সুমেরীয়দেরই বুঝতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাছাড়া, সৎকার-পদ্ধতির যে-সাক্ষ্যকে লেখক অতোখানি গুরুত্ব দিয়েছেন তার প্রকৃত তাৎপর্যও তাঁর প্রকল্পকে প্রতিষ্ঠিত করে না।

কিন্তু তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, ছন্দোগ্যের এই সূত্রটি কোন অর্থে লঘুমূল্য। আসলে, অসুর বলতে যাদেরই বোঝাক না কেন, ছান্দোগ্যের নির্দেশ অনুসারে আমরা লোকায়ত-মতকে তাদেরই মধ্যে পরিব্যাপ্ত বা আয়ত বলে অনুমান করতে পারি। তাছাড়া, লোকায়ত বলতে যে অসুর-মতই বুঝতে হবে এ-বিষয়ে প্রাচীন সাহিত্যে আরো নানান নির্দেশ পাওয়া যায়।

মৈত্রায়ণীয় উপনিষদ(৭৪৫) অনুসারে দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরগুরু শুক্রের রূপ ধারণ করে ইন্দ্রের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে অসুরদের মধ্যে এই ভ্ৰমাত্মক লোকায়ত-মত প্রচার করেছিলেন।

বিষ্ণুপুরাণেও(৭৪৬) মোটের উপর একই উপাখ্যান পাওয়া যায় : মায়ামোহ অসুরদের পতন ঘটাবার জন্যই তাদের মধ্যে এই লোকায়ত-মত প্রচার করেন।

লোকায়ত-মত যে আসলে অসুরদেরই মত এ-বিষয়ে আর একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় শ্ৰীমদ্ভগবদগীতায়(৭৪৭)। শ্ৰীভগবান বলছেন, “ইহলোকে দুইজাতি সৃষ্টি হইয়াছিল—দৈবী ও আসুরী। হে পার্থ, দৈবী বিস্তারপূর্বক বর্ণন করিয়াছি। এক্ষণে আসুরী শোনো”।

এই আসুরী বলতে কী মত বোঝায়? শ্ৰীধরস্বামী বলছেন, লোকায়ত—মত।

শ্ৰীমদ্ভগবদগীতাতেও এই আসুরী মতের বর্ণনায় অবশ্যই প্রায় চোদ্দ আনাই ঘৃণা ও বিদ্বেষ। কিন্তু তাছাড়াও অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক কথা পাওয়া যায়। আসুরী-মত অনুসারে—

অসত্যমপ্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরনীশ্বরম্।
অপরস্পরসম্ভূতং কিমন্যৎ কামহৈতূকম্॥(৭৪৮)

প্রথম পংক্তিটির অর্থ নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা থাকতে পারে। খুব সম্ভব এর অর্থ হলো ঈশ্বরের উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থে জগৎ সত্য নয়, কেননা ঈশ্বরই নেই। কিন্তু দ্বিতীয় পংক্তিটির অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট : জগৎ কামোদ্ভূত, স্ত্রী-পুরুষের মিলন-জাত।

আসুরী-মতের এই কথাটি কিন্তু আমাদের কাছে নতুন নয়। তন্ত্রের সৃষ্টিতত্ত্ব আলোচনায় আমরা এই মতেরই পরিচয় পেয়েছি, এই মতেরই পরিচয় আমরা পেয়েছি সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্বে : “যথা স্ত্রী-পুরুষসংযোগাৎ সুতোৎপত্তিস্তথা প্রধান-পুরুষ-সংযোগাৎ সর্গস্যোৎপত্তিঃ”।

শ্ৰীধরের কথা যদি ঠিক হয়—অর্থাৎ আসুরী-মত বলতে গীতায় যদি লোকায়ত-মতই বুঝিয়ে থাকে—এবং এই সৃষ্টিতত্ত্বই যদি আসুরী-মতের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়, তাহলে এরই সূত্র ধরে আমরা লোকায়ত, তন্ত্র এবং সাংখ্যের মধ্যে একটা সম্পর্ক খুঁজে পাই নাকি?

আরো কথা আছে। সাংখ্য-কারিকার শেষে ঈশ্বরকৃষ্ণ(৭৪৯) বলছেন, “এই পরম পবিত্র শাস্ত্র কপিল মুনি অনুকম্পা-পুরঃসর আসুরীকে প্রদান করিয়াছিলেন। আসুরী পুনরায় সেই শাস্ত্র পঞ্চশিখকে উপদেশ দেন এবং পঞ্চশিখ দ্বারা ইহা পরে বহুধা বিস্তৃত হয়।”

এখানে আসুরী ব্যক্তি-বিশেষের নাম, না, এর আর কোনো তাৎপর্য থাকতে পারে—সে-প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই খুব জোর করে দেওয়া যায় না। কিন্তু এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, বৌধায়ন(৭৫০) বলছেন, কপিল বলে এক অসুর ছিলেন, তিনি দেবতাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন এবং তিনি যে-উপদেশ দিয়েছেন তা সর্বের পরিত্যজ্য।

ঋগ্বেদের(৭৫১) ষষ্ঠ-মণ্ডলে অসুরদের বিরুদ্ধে ইন্দ্রের অভিযান-বৰ্ণনা পাওয়া যায়। তারই এক জায়গায় বলা হয়েছে :

ইন্দ্ৰ চয়মানের পুত্র অভ্যবতীর প্রতি অনুকূল হইয়া বরশিখের পুত্রগণকে সংহার করিয়াছিলেন। তিনি হরিয়ুপীয়ার পুর্বভাগে অবস্থিত বৃচীবানের বংশধরদিগকে বধ করেন, তখন পশ্চিমভাগে অবস্থিত (বরশিখের) শ্রেষ্ঠ পুত্র ভয়ে বিদীর্ণ হইয়াছিল(৭৫২)।

বৃচীবান কোনো অসুর-ট্রাইবের নাম হতে পারে(৭৫৩)। হরিয়ুপীয়া তাদেরই নগর, অর্থাৎ কোনো এক অসুর-নগর। এ-নগর কোথায় ছিলো? হরপ্পা আবিষ্কারের পর ডি.ডি. কোসাম্বী, রমেশচন্দ্র মজুমদার, বি.বি. রায় প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেছেন, খুব সম্ভব এই হলো ঋগ্বেদ-উল্লিখিত ওই অসুর-নগর। এম. হুইলারও(৭৫৪) এ-সম্ভাবনাকে অস্বীকার করছেন না—ওই হরিয়ুপীয়া আর হরপ্পা এক-হওয়া অসম্ভব নয়। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, জন মার্শাল দাবি করছেন, প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্যে প্রমাণ এ-নগরে মাতৃপ্রধান শাক্ত বা তান্ত্রিক ধ্যানধারণা প্রচলিত ছিলো। একেও কি অসুর-নগরে আসুরী-মতের সাক্ষ্য বলা যায়?

শুধু মাতৃপ্রধান বা শক্তিপ্রধান ধ্যানধারণাই নয়। ওই অসুর-মত বলতে যে অধ্যাত্মবাদ-বিরোধী অফুট বস্তুবাদই বোঝা হতো ঋগ্বেদেই(৭৫৫) তার ইংগিত পাওয়া যায়।

ত্বং মায়াভিরপ মায়িনোইধমঃ স্বধাভির্ষে
অধিশুপ্তাবজুহ্বত।
ত্বং পিপ্রোর্নৃমণঃ প্রারুজঃ পুরঃ প্ৰ
ঋজিশ্বানং দস্যুহত্যেদ্বাবিথ।
—তুমি (ইন্দ্র) মায়াসমূহের দ্বারা, যাহারা নিজেদের মুখে স্বধা (অন্নহবিঃ) প্রদান করিত, সেই মায়াবীদিগকে পরাজিত করিয়াছিলে; হে নরগণের রক্ষক, তুমি পিপ্রুর নগরগুলি ধ্বংস করিয়াছিলে এবং দস্যুদিগের হত্যালীলা হইতে ঋজুপথগামীদিগকে রক্ষা করিয়াছিলে।

এখানে যে অসুরদেরই উল্লেখ করা হয়েছে সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তারা নিজেদের মুখেই স্বধা প্রদান করতো। এ-কথার ব্যাখ্যায় সায়নাচার্য কৌষীতকী ও বাজসনেয়ীর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। কৌষীতকী বলেন, “অসুরা বা আত্মন্নজুহবুরুদ্ধাতেহগ্নেী তে পরাভবন্‌”—অর্থাৎ, অসুরের অগ্নিকে পরাভূত করিয়া নিজেদেরই হোম করিত। বাজেসনেয়ী বলেন, “দেবাশ্চ হ বা অসুরাশ্চাম্পর্ধন্ত ততো হাসুরা অভিমানেন কৰ্ম্মৈ চ ন জুহুম ইতি স্বেষ্বাবাস্যেষু জুহ্বতশ্চেরুস্তে পরাবভূবুঃ”—অর্থাৎ, দেবতা ও অসুরগণ পরস্পর স্পর্ধাযুক্ত হইল, তাহার পর অসুরেরা অভিমান ভরে ঠিক করিল, ‘আমরা কাহাকেও হোম করিব না’; এবং অতএব নিজেদের মুখে হবিপ্রদান করিয়া তাহারা ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল এবং অবমাননা করিল।

গুণরত্ন(৭৫৬) বলেছিলেন, চর্ব থেকেই চার্বাক নামের উৎপত্তি—গলচৰ্ব অদনে, ইত্যাদি। যদি তাই হয় তাহলে যে-অসুরেরা দেবতার উদ্দেশ্যে হবিপ্রদানের প্রতিবাদে নিজেদের মুখেই অন্নহবির বা স্বধা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলো তাদেরও চার্বাকপন্থী বলে সনাক্ত করবারই প্রলোভন হয় নাকি? এবং এই অসুরদের ধ্যানধারণাই যদি তন্ত্র ও সাংখ্যের সঙ্গে অভিন্ন হয় তাহলে এদিক থেকেও তন্ত্র ও সাংখ্যকেও লোকায়ত-মত বলেই গ্রহণ করবার সম্ভাবনা বাড়ে না কি?

 

এইভাবে তন্ত্র, লোকায়ত ও সাংখ্যের সম্পর্ককে বোঝবার চেষ্টা করলে আরো কয়েকটি বিষয়ের ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। প্রথমত সাংখ্যের সঙ্গে যোগ-এর সম্পর্ক। সাধারণত ধরে নেওয়া হয় যে, উত্তরযুগে এই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যদিও আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে কেউ কেউ(৭৫৭) এর বিপরীত কথা অনুমান করবার চেষ্টা করেছেন। তাদের সিদ্ধান্ত অনুসারে সাংখ্য ও যোগের মধ্যে প্রভেদটাই বরং উত্তরকালের অবদান। আমরা ইতিপূর্বেই যোগের উৎস সংক্রান্ত সমস্যার আলোচনা করবার চেষ্টা করেছি এবং দেখেছি যে, পরের যুগে যোগশাস্ত্র বলতে যাই বোঝাক না কেন, আদিম কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাস এবং জাতু-অনুষ্ঠানের মধ্যেই তার উৎস অনুসন্ধান করবার সুযোগ আছে। আমরা আরো দেখেছি যে, ওই আদিম কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাসের মধ্যেই তান্ত্রিক ধ্যানধারণা এবং আচারঅনুষ্ঠানের সূচনা দেখতে পাওয়া যায়। এবং এইদিক থেকে বুঝতে পারা যায়, তন্ত্রসাধনা ও যোগসাধনা আদিতে কেন পৃথক নয়। অপরপক্ষে, তন্ত্র এবং সাংখ্যের সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ যে, উভয়েরই এক উৎস অনুমান করবার সুযোগ আছে। অতএব আমাদের যুক্তির বর্তমান পর্যায়ে আমরা বলতে পারি যে, যে-কারণে তন্ত্রের সঙ্গে যোগের সম্পর্ক, সেই কারণেই সাংখ্যের সঙ্গেও যোগের সম্পর্ক আদি ও অকৃত্রিম। অতএব, সাংখ্যের সঙ্গে যোগের সম্পর্ক পরের যুগেই স্থাপিত হয়েছে এ-কথা মনে করবার সঙ্গত কারণ নেই। তার বদলে বরং অনুমান করা যায়, কৃষিকাজের আদিম পর্যায়ে তত্ত্বের দিকটি সাধনার দিক থেকে স্বাতন্ত্র্য লাভ করতে পারেনি—কালক্রমে হয়তো তত্ত্বের দিকটি স্বাতন্ত্র্য লাভ করে সাংখ্য-দর্শনে পরিণত হয়েছে এবং অনুষ্ঠানের দিকটি পরিণত হয়েছে স্বতন্ত্র যোগ সাধনায়। তারপর ক্রমশ আরো উত্তরকালের দার্শনিকদের প্রচেষ্টায়, এই সাংখ্য এবং যোগ উভয়ই আস্তিক, অর্থাৎ, বৈদিক ঐতিহ্যের অন্তর্গত এবং আধ্যাত্মিক, অর্থাৎ সেশ্বর মোক্ষশাস্ত্রে পরিণত হয়েছে— পুরুষের ত্রিতাপ-নাশই তখন সাংখ্যের উদ্দেশ্য। কিন্তু এতোখানি পরিবর্তনের পরও দুয়ের মধ্যে যে-আদিম সম্পর্ক, তা সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন হতে পারেনি।

 

তাহলে তন্ত্র, যোগ, সাংখ্য,—এবং ব্যাপক অর্থে লোকায়তিক ধ্যানধারণা,—এগুলির উৎস অনুসন্ধান করতে করতে আমরা যদি সুদূর অতীতে ফিরে যেতে পারি তাহলে কিসের পরিচয় পাবো? কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাস এবং জাদু-অনুষ্ঠান। তবুও তন্ত্র, সাংখ্য ও যোগ ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে শুধুমাত্র অতীতের ব্যাপার নয়; সাম্প্রতিক যুগেও এদের প্রভাব ব্যাপক ও গভীর। এ-ঘটনার ব্যাখ্যা কী? আমাদের দেশের বাধাপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক বিকাশ : সামগ্রিকভাবে দেশের মানুষ কৃষিকাজের প্রাথমিক পর্যায়কে পিছনে ফেলে খুব বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেনি। তাই সে-পর্যায়ের ধ্যানধারণা ও সাধনপদ্ধতির স্মারক এমন গভীর ও ব্যাপকভাবে সাম্প্রতিক যুগ পর্যন্ত টিকে থেকেছে। বর্তমানকালেও তান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রভাব প্রসঙ্গে আমরা ইতিপূর্বে দীর্ঘভাবে আলোচনা করবার চেষ্টা করেছি। বর্তমানে আমরা তার সঙ্গে শুধুমাত্র একটি কথা যোগ করতে চাই। আদিসাংখ্যকে যেহেতু তান্ত্রিক তত্ত্বেরই দার্শনিক সংস্করণ হিসেবে গ্রহণ করবার সুযোগ রয়েছে, সেইহেতু আমাদের দেশে আধুনিক যুগেও সাংখ্যদর্শনের বিপুল ও গভীর প্রভাবকে ব্যাখ্যা করবার জন্যে স্বতন্ত্র প্রকল্পের প্রয়োজন নেই।

“যখন গ্রামে গ্রামে, নগরে মাঠে জঙ্গলে শিবালয়, কালীর মন্দির দেখি, আমাদের সাংখ্য মনে পড়ে; যখন দুর্গা কালী জগদ্ধাত্রী পূজার বাদ্য শুনি, আমাদের সাংখ্যদর্শন মনে পড়ে”।

দুর্গা, কালী জগদ্ধাত্রী–দেবীনামের তালিকা নিশ্চয়ই দীর্ঘতর করা যায়। কয়েকটি নামের বিশ্লেষণ আমরা ইতিপূর্বে করেছি; অন্নপূর্ণা, শাকম্ভরী, ভগবতী। বঙ্কিমচন্দ্রের মন্তব্য অনুসারে এরা সকলেই সাংখ্যের প্রকৃতি। আমাদের যুক্তিও এদিক থেকে স্বতন্ত্র নয়। কেবল আমরা আরো বলতে চাই যে, সাংখ্যের ওই প্রকৃতিতত্ত্বকে, কিংবা এই দেবীগুলিকে ঠিকমতো বুঝতে হলে সমাজবিকাশের এমন এক স্তরে ফিরে যেতে হবে যেখানে মেয়েরা বড়ো, আর যে-পর্যায়ের মানুষদের ধারণায় নারীর উৎপাদিক-শক্তি আর প্রাকৃতিক উৎপাদিক-শক্তি একই সূত্রে বাধা এবং পরস্পরের উপর প্রভাবশীল। এই পর্যায়ের কথা আমাদের ঐতিহাসিকেরা এখনো সম্যকভাবে উদ্ধার করেননি; ফলে তন্ত্র ও সাংখ্যের অনেক আদিম তত্ত্ব আজো আমাদের কাছে রহস্যময় ও ভূর্বোধ্য। শুধু তাই নয়; সমাজবিকাশের সেই পর্যায়টি নিয়ে আধুনিক ঐতিহাসিকেরা যেদিন সম্যকভাবে বিচার করবেন, সেইদিন আমরা আরো স্পষ্টভাবে জানতে পারবো—

অনেক হাজার বছর আগে সিন্ধুসভ্যতার মানুষেরা, কোন্‌ আদিম বিশ্বাসের প্রভাবে ওই সব ছোটোছোটো পোড়ামাটির মাতৃমূর্তি গড়ায় মন দিয়েছিলো?

কোন আদিম বিশ্বাসের প্রভাবে, আজো আমাদের গ্রামাঞ্চলে এ-জাতীয় মূর্তি রচনার বিরাম নেই?

কোন আদিম বিশ্বাসের প্রভাবে, আমাদের বাংলা সাহিত্য শক্তি, ডোম্বী, রজকী, শবরী, নৈরামণি, সহজসুন্দরী প্রভৃতির মাহাত্ম্যে এমন ভরপুর হয়ে উঠেছিলো?

এই আদিম বিশ্বাস ও তার বাস্তব ভিত্তিকে যেদিন স্পষ্টভাবে চিনতে পারা সম্ভব হবে, সেইদিনই আমরা সাংখ্য-দর্শনের আদিরূপটির সমস্ত বৈশিষ্ট্যও হৃদয়ঙ্গম করবার পথে অগ্রসর হবো।

কিন্তু এই বিষয়গুলিকে সম্যকভাবে চিনতে হলে আমাদের নিজেদের মনের দুটি সংস্কারের সমালোচনা করবার সাহসও অর্জন করতে হবে। এক : পিতৃপ্রধান সমাজের সংস্কার—কেননা, তন্ত্র, সাংখ্য প্রভৃতি ধ্যানধারণায় মাতৃপ্রধান সমাজেরই স্বাক্ষর টিকে আছে। দুই : সাধারণভাবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের সংস্কারও। কেননা, তন্ত্র, সাংখ্য প্রভৃতি যে-ধ্যানধারণাকে ব্যাপক অর্থে আমরা এখানে লোকায়তিক বলে গ্রহণ করবার চেষ্টা করছি, সেগুলি শুধুই নারীপ্রাধান্যের পরিচায়ক নয়; তাছাড়াও এগুলি হলো প্রাক-অধ্যাত্মবাদী— এবং সেই অর্থে বস্তুবাদী—ধ্যানধারণাও। এবং আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো যে, এই জাতীয় ধ্যানধারণার প্রাক-অধ্যাত্মবাদী বা বস্তুবাদী দিকটির মধ্যে প্রাক্-বিভক্ত সমাজেরই প্রতিবিম্ব খুঁজে পাওয়া যায়।

————–
৭৪৪. S. N. Dasgupta op. cit. 3:527.
৭৪৫. মৈত্রায়নীয় উপনিষদ ৭.৮.৯ ।
৭৪৬. বিষ্ণুপুরাণ ৩.১৮.১৪-২৬।
৭৪৭. গীতা ১৬.৬ |
৭৪৮. ঐ ১৬.৮ ।
৭৪৯. কারিকা ৭০ ৷
৭৫০. SBE 14:260sq.
৭৫১. ঋগ্বেদ ষষ্ঠ মণ্ডল ।
৭৫২. ঋগ্বেদ ৬.২৭.৫।
৭৫৩. ঋগ্বেদ ৬.২৭.৬ দ্রষ্টব্য।
৭৫৪. M. Wheeler IC 18.
৭৫৫. ঋগ্বেদ ১. ৫১.৫ ৷
৭৫৬. গুণরত্ব : তর্করহস্যদীপিকা ৩০০।
৭৫৭. E. H. Johnston ES দ্রষ্টব্য ।