৪১.
কিন্তু শানুর সব জারিজুরি খতম, যখন শুনল পরদিন ভোরবেলাই লঞ্চ ছাড়বে।
শানুর এখন অনুভব এল পায়ের তলায় মাটি না থাকা কাকে বলে।
রাত্রে কি ঘুমিয়েছিলেন ভবদেব!
মাঝে মাঝেই তো পাশের ঘর থেকে অস্পষ্ট একটু একটু আওয়াজ, খাটের বিছানায় পাশ ফেরার শব্দ শুনতে পেয়েছে শানু। প্রায় সারারাতই।
তার মানে শানুও সারারাত ঘুমোয়নি।
লঞ্চে উঠিয়ে দিতে এলেন সেক্রেটারিবাবু! এল কামিনী আর শানু।
ভবদেব কাদায় নামার আগে একবার বললেন, সাবধানে থাকিস! চিঠি দিস।
তাড়াতাড়ি মুখ ফেরালেন।
লঞ্চ ছাড়াটা ট্রেন ছাড়া নয়। অনেক সময় লাগল। দাঁড়িয়ে রইল শানু। অবশেষে একসময় ভোঁ দিয়ে ছাড়ল। ওই ভোঁ শব্দটা যেন শানুব বুকটাকে হিম করে দিয়ে গেল।
যতক্ষণ না লঞ্চটা চোখছাড়া হল, শানু নড়ল না। শেষে ছোট্ট কালো বিন্দুটাকে যখন আর দেখা গেল না, তখন ফিরে দাঁড়াল।
জগন্নাথ কাছাকাছি এসে পরম সান্ত্বনার গলায় বললেন, কোনও ভাবনা করবেন না জননী। আপনার কোনও অসুবিধে হতে দেব না।
হঠাৎ সারা শরীরটা কেঁপে উঠল শানুর। মনে হল প্রৌঢ় জগন্নাথবাবুর চোখের চাউনিটা বেড়ালের মতো। মনে হল ওঁর ওই মাতৃসম্বোধনটায় নির্মলতার অভাব রয়েছে।
কই, এই দুদিন তো এমন মনে হয়নি?
এখন শানু কী করবে?
শানু কি ওই জলে ঝাঁপিয়ে গিয়ে লঞ্চটাকে ধরে ফেলবে?
কিন্তু শানু কি সাঁতার জানে?
শানু সাঁতার জানে না, তবু শানু এমন একটা জায়গায় থাকতে এল, যেখানে পায়ের নীচে মাটির বদলে জল।
আসার আগে শানু বলেছিল, কলকাতা থেকে কতই বা দূরে? এখন শানুর মনে হল হাজার হাজার মাইল ব্যবধান। জল বড় নিষ্ঠুর। ওর কাছে কোনও ভরসা নেই।
.
৪২.
ভয়ংকর একটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরছিলেন ভবদেব। ধারণা করতে পারেননি বাড়ি এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই ভারটা এমন নিঃশেষে হালকা হয়ে যাবে।
লঞ্চ থেকে নেমে বাসে আসতে আসতে ভাবছিলেন, তিনি যদি তাঁর বাবার মতো একটা খাতা রাখতেন, তা হলে বাড়ি ফিরেই লিখে রাখতেন তাতে, আমরা কত অসহায়। যুগের কাছে অসহায়, সভ্যতার কাছে অসহায়, অসহায় একটা নকল প্রেস্টিজের কাছে। প্রতিনিয়ত এই অসহায়তার কাছে আত্মসমর্পণ করে চলেছি আমরা।
যেহেতু আমি নিজেকে শিক্ষিত সভ্য প্রগতিশীল মানুষদের একজন বলে মনে করতে চাই, তাই আমাকে এই নিরুপায় অসহায় অবস্থাকেই মেনে নিতে হবে।
আমি আমার যুবতী কুমারী মেয়েকে সাপ ব্যাঙ হাঙর কুমিরের মধ্যে একা রেখে চলে এলাম। উপায় কী? আমার একদার সহকর্মী দেবেশের কুমারী মেয়ে চাকরি নিয়ে আফ্রিকায় চলে গেছে। আমার মামাতো ভাইয়ের কুমারী মেয়ে একা পড়তে চলে গেল জার্মানিতে। আরও তো কতই ঘটে চলেছে। তবে? কী করে বলা যায় আমার মেয়েকে আমি এই হাতের কাছে একা রেখে আসতে খুব অসহায়তা অনুভব করছি। না এসব বলা যায় না। অথচ আমাদের দেশের জলে এখনও সাপ খেলে বেড়ায়। আমাদের দেশের একটা স্কুলের সেক্রেটারির স্ত্রী, মাস্টারবাবু আর মাস্টার দিদিমণির মধ্যে কোনও পার্থক্য খুঁজে পায় না বলে তাকে দেখে ঘোমটা দেয়। কারণ আমাদের খেলার মাঠে এখনও ঘাস-আগাছা কাঁটাঝোঁপ, তবু আমরা বল নিয়ে মাঠে খেলতে নেমে পড়েছি।
এখন বুঝতে পারছি কেন সত্যদেব সেন নামের মানুষটি সকলের অগোচরে বসে বসে খাতার পাতার মধ্যে তার বক্তব্যগুলো ভরে রাখতো। কারণ সব কথা বলে ফেলা যায় না।
খাতাটাকে হঠাৎ দেখে আমার অবাক লেগেছিল। বাবা এত কথা ভাবতে জানতেন? আমি তোকই কখনও–এখন আমার নিজেকেও দেখে অবাক লাগছে, এতসব কথা ভাবতে পারছি আমি। ভাববার অভ্যাস ছিল না কখনও। অফিসের ফাইলের কথা ভাবতে জানতাম, বাড়িতে কারও অসুখ হলে ভাবতাম, হয়তো কাগজে কোনও বিরক্তিকর খবর দেখলে তাৎক্ষণিক একটু ভাবনা। এর বেশি কী? কীসের বিনিময়ে কী পাওয়া যাচ্ছে এটা কোনওদিন ভেবেছি বলে মনে পড়ে না। অথচ আজ?
এমন অনেক কথাই ভারাক্রান্ত মনটাকে আরও ভারাক্রান্ত করে তুলছিল ভবদেবের। কিন্তু ভাবতে পারেননি বাড়িতে এসে দাঁড়ানো মাত্রই এতক্ষণকার সব ভার হাওয়ায় উড়ে যাবে।
.
৪৩.
ভার হালকা করার তো দুটো পদ্ধতি বলবৎ। এক হচ্ছে দাঁড়িপাল্লার ভারাক্রান্ত পাল্লাটা থেকে কিছু ভার নামিয়ে নেওয়া, দ্বিতীয়টা হচ্ছে অপর পাল্লাটায় অধিক বাটখারা চাপিয়ে দেওয়া। দেখা গেল ভবদেবের ভাগ্যদেবতা দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিয়েছেন।
চাপানো বাটখারাগুলোর চেহারা এই রকম–পাশাপাশি দুটো বাড়ির মধ্যে একটা বাড়ির পেনো নামের ছেলেটাকে তার প্রাণের বন্ধুরা বাড়ির ভিতর থেকে টেনে বার করে পিটিয়ে পাট করে ফেলা বাবদ পেনো এখন হাসপাতালের খাটে শুয়ে মৃত্যুর ক্ষণ গুনছে। পেনোর মা বাপের আর্ত চিৎকারে এ বাড়ির বাপী নামের ছেলেটা ছুটে অকুস্থলে পৌঁছে পেনোকে ওদের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে পিঠে ছুরি খেয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বদলা নেবার দিন গুনছে। এবং এ বাড়ির আর যে একটা ছেলে বদলে গিয়ে সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে ঘাড় গুঁজে বসে থাকত, তাকে আর কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরের মধ্যে না, ঘরের বাইরে না, পাড়ায় না, সম্ভাব্য কোনও জায়গায় না।
সে কি বৈরাগ্যের ভূমিকা নিয়ে স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ করেছে?না কি পেনোর মতো তারও প্রাণের বন্ধুরা অলক্ষ্যে অজ্ঞাতে লোকলোচনের বাইরে নিয়ে গিয়ে একই অবস্থা ঘটিয়েছে?
শানুনামের সেই ছোটখাট গড়ন শ্যামলা মেয়েটাকে একা জলের ধারে দাঁড় করিয়ে রেখে আসার গ্লানির ভার হালকা করে দেবার পক্ষে এই আয়োজনটাই কি যথেষ্ট ছিল না? হয়তো বা এতটাও না হলে চলত। কিন্তু
বন্দনার প্রবল বাষ্পেচ্ছ্বাসের কিছুটা কমলে স্ট্যাচু হয়ে যাওয়া ভবদেবের মুখ থেকে শুধু এই কথাটি বার হল, মাত্র দুতিনদিন আমি বাড়ি ছিলাম না–এর মধ্যে
বন্দনা আবার উথলে উঠলেন, আরও শুনতে বাকি আছে তোমার!
হ্যাঁ, হ্যাঁ আরও।
অনেক কান্নার ঢেউ সামলে, সেই আরওটা ব্যক্ত করতে সমর্থ হলেন বন্দনা। যার সারার্থ হচ্ছে অমৃতা নামের যে মেয়েটি এযাবৎ সমুদ্রের ওপারে পৌঁছে গিয়ে সুখের সমুদ্রে ভাসছিল, আর সেই সুখের সমুদ্রের অসীমতা জানাতে যখন-তখনই ডজন ডজন রঙিন ফটো পাঠাত মা-বাবাকে, তার প্রতিটি সুখের মুহূর্তটিকে ক্যামেরায় ধরে ফেলে হঠাৎ তার দীর্ঘ এক টেলিগ্রাম এসেছে। সেই সুখের জীবনে দাঁড়ি টেনে দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে একা চলে আসছে, কেউ যেন এয়ারপোর্টে থাকে।
উপসংহারে বলেছে, একটা জানোয়ারের সঙ্গে কতদিন বাস করা যায়?
কিন্তু এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে? বিধাতা নামক ভদ্রলোকটির রীতিই তো এই। তিনি যখন মাপান, উপরি উপরি চাপান। এ তো প্রবাদবাণী। প্রমাণিত সত্যগুলিই তো প্রবাদের বাণীতে পরিণত হয়। ভদ্র মানুষকে ওই চাপানগুলো ম্যানেজ করতেই হয়। আগামী পরশুই এয়ারপোর্টে যেতে হবে।
যেতে হবেই। সমস্যা হচ্ছে যাবে কে?
বন্দনার ডান হাত তত আপাতত ভাঙা।
বন্দনা ডুকরে উঠলেন, বাপীর এমন অবস্থা না হলে, সেই তো তার গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারত গো–কোনও শয়তানেরা তাকে
থাক! ভবদেব বললেন, কী হলে কী হত, বলে লাভ নেই। অমৃতা এভাবে চলে না এলে তো এ প্রশ্নও উঠত না। খোকাকে বলে দেখেছ?
খোকা?
বন্দনার কণ্ঠে বিরসতা, তার বউয়ের নার্স কামাই করছে, তার নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। ছুটি নিয়ে বাড়ি বসে আছে আর খিদমদগারি খাটছে। শুধু বাধ্য হয়ে টিপুর ব্যাপারে থানায় ডায়েরি করে এসেছে, ব্যস! তাতেই বউয়ের কত অসুবিধে হয়ে গেল।
আর এই খোঁজাখুঁজি?
সুকুমারই দৌড়ঝাঁপ করল। তাও নাকি আবার কাল রাত্তিরে হঠাৎ তার মেয়ের সর্দিজ্বর। ছোটন তো পাগল হয়ে উঠে সকালের মধ্যেই নিটি ডাক্তার আনিয়ে ছেড়েছে। আর তাকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
.
৪৪.
কোন কাজটা আগে করা দরকার? ভাবছিলেন ভবদেব।
খুড়তুতো ভাই কেঁদে এসে পড়ল, বড়দা, আমার সর্বনাশের কথা শুনেছেন তো?
ভবদেব আস্তে বললেন, এসেই শুনলাম।
বাপী দেবতা! ওকে বাঁচাতে নিজের গায়ে ছুরি খেয়েছে। সেই অবস্থায় হাসপাতালে যাবার আগে ওর খুড়ির হাতে টাকার কাঁড়ি ধরে দিয়ে গেছে, বড়দা! ওর পুণ্যেই যদি আমার পানু বাঁচে।
হাউহাউ করে চেঁচিয়ে উঠল বিশ্বদেব।
ভবদেব যেন বোকার মতোই তাকিয়ে দেখছিলেন, এ তাঁর সেই চিরকালের চেনা লোকটা না আর কেউ! ওর মুখের সেই কঠিন পেশিগুলো কোথায় গেল?
সাবধানে আস্তে ওর পিঠে একটা হাত রেখে বললেন, ঠিক হয়ে যাবে, ঠিক হয়ে যাবে।
নিজের স্বার্থের কথাই বলছি বড়দা! এই মানুষ আমরা। বাপীর আঘাত ডাক্তার বলেছে গুরুতর নয়, কিন্তু টিপু? তাকে কে কোথায় হাওয়া করে দিল। কাঁটা হয়ে আছি হয়তো হঠাৎ কোনওদিন খবরের কাগজে দেখা যাবে কোথায় কোন রেললাইনের ধারে কি কোন
ভবদেব ক্লিষ্টস্বরে বললেন, ও কথা থাক বিশু, চল পানুকে দেখে আসি।
বাপীর কাছে গিয়েছিলেন?
যাইনি। আজই যাব। পানুর কাছে তোমার সঙ্গে যাই।
আবার তো শুনছি অমৃতা নাকি
হ্যাঁ আমিও এসেই শুনেছি। দু-আড়াইটে দিন মাত্র বাড়ি ছিলাম না—
গভীর একটা নিশ্বাস ফেললেন।
তিনি বাড়ি থাকলেই কি এসব রক্ষা হত?
.
৪৫.
বাপীর পিঠে ব্যান্ডেজ, তবু বাপকে ঘরে ঢুকতে দেখে ঝপ করে উঠে বসল। আর বলে উঠল, পেনো বেঁচে আছে?
আছে। দেখে এলাম। ডাক্তার বলল একটু বেটার।
ঠিক আছে। তবে আমাকে একবার ছাড়ুক। বদলা না নিয়ে জল খাচ্ছি না।
ভবদেব শিউরে উঠলেন।
বাপীর মুখে এ কী হিংস্ররেখা।
গোপালের মতো মুখ, দেবদূতের মতো হাসি, সেই বাপী!
তাড়াতাড়ি বললেন, থাক বেশি উত্তেজিত হোয়ো না। ক্ষতিকর।
আবার শুয়ে পড়ল বাপী। খিঁচিয়ে বলল, বেপোটে ফেলে দিয়েছে, তাই! না হলে এখনও সেই শয়তান ছুঁচোটার লাশ পড়তে বাকি থাকে!
ভবদেব ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে বললেন, বাপী। তোদের জগৎটা হঠাৎ এত আলাদা হয়ে গেল কী করে? আর তো তোদের চিনতে পারছি না।
পারবেন না।
আবার উঠে বসল বাপী, জোর দিয়ে বলল, আপনাদের জগতের সঙ্গে আমাদের জগতের আসমান জমিন ফারাক।
এখন হাসপাতালের খাটে।
এখন বিশ্বনস্যাৎ হাসি হেসে নাকের সামনে দিয়ে বাহনের গর্জন তুলে বেরিয়ে যেতে পারবে না। সেই সাহসেই বোধহয় ভবদেব গভীর গম্ভীর গলায় বললেন, ওই জগতের রাস্তাটা চিনলি কী করে বল তো? সেই তো আমাদের মাঝখানে থেকেই বড় হয়ে উঠলি–
বাবার এই গভীর গম্ভীর স্বরটা বোধহয় বাপীকেও একটু গম্ভীর করল। বলল, ও আপনি বুঝবেন না।
আবার শুয়ে পড়ল।
বলল, কোথাও কোনওখানে টিপুর লাশ পাওয়া গেছে বলে শুনেছেন?
ভবদেব আবার শিউরে উঠলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি যাই।
আর সেই মুহূর্তে বাপী তার নিজস্ব ভঙ্গিতে হা হা করে হেসে উঠে বলল, যান।
.
৪৬.
যেখানে যে অবস্থাই ঘটুক, অবশ্য কর্তব্যের অমোঘ দাবি মানতেই হবে। ভবদেবকেই যেতে হবে তাঁর হৃতসর্বস্ব মেয়েকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে আসতে।
শানু জলের ধারে একা দাঁড়িয়ে।
টিপু নামের সেই ছেলেটাকে আর তার সিঁড়ির পাশের ঘরটায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, তবু অগ্রাধিকার আকাশপাড়ি দিয়ে ছুটে চলে আসা সেই মেয়েটার। কারণ সে একটা জানোয়ারের সঙ্গে ঘর করতে করতে ক্লান্ত হয়ে, নিজেকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে চলে আসছে। এই মুহূর্তে সে যেন তার প্রতি স্নেহের ঘাটতি অনুভব করে না বসে। কারণ এ দেশের মেয়ে। অভিমানী হবার অধিকার তার পুরোমাত্রায়।
আধুনিক সভ্যতা তাকে অনেক রীতিনীতি সংস্কার কুসংস্কার ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হলেও, দুর্ভাগ্য ঘটলে মেয়েকে পতিগৃহ থেকে পিতৃগৃহেই ফিরে আসতে হয়, এই চিরকেলে রীতিটাকে ভোলাতে পারেনি। ভোলাতে পারেনি অভিমানটা তার জন্মগত অধিকার।
অতএব থানায় খোঁজ নিতে যাওয়াটা মুলতুবি রেখে এয়ারপোর্টেই যাত্রার আয়োজন করছিলেন ভবদেব।
কিন্তু বন্দনা কাছে এসে আরও একটি অমোঘ কর্তব্যের কথা মনে পড়িয়ে দিলেন।
কাল থেকে নীরাকে তো একবারও দেখতে যাওনি, অমিকে আনতে যাবার আগে একবার খোকার ঘরটা ঘুরে এসো বাপু।
অনবরত কেঁদে কেঁদে বন্দনার চোখ দুটো ফুলেই আছে, মুখ কালচে। সেই দিকে তাকিয়ে দেখলেন ভবদেব। ভুরু কুঁচকে বললেন, ওটা এমন কী জরুরি হল? বললে তো ভালই আছে।
তা আছে। তবে তুমি নিজে গিয়ে তো খবর নাওনি।
ভবদেব সংক্ষেপে বললেন, সময় হবে না।
আহা, তুমি কি আর গল্প করতে বসবে! একবার যাওয়া নিয়ে কথা! না গেলে কথা হবে!
কথা!
ভবদেব তীক্ষ্ণই হলেন, কীসের কথা?
কীসের আর!
বন্দনা ক্লান্ত গলায় বললেন, কর্তব্যে ত্রুটির কথা!
তুমি এখনও এইসব কথাটথা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ?
না ঘামিয়ে উপায় কী? কোনটা না করলে চলছে? সুযোগ পেলেই খোকা শোনাতে ছাড়বে তার বউয়ের মরণ বাঁচন অবস্থা গেছে, কেউ ভাল করে খোঁজও নেয়নি?
তুমি নিচ্ছ না খোঁজ?
আমি? আমার আবার রেহাই আছে নাকি? দুবেলাই খোঁজ নিতে হচ্ছে। কী খাবে, কী না খাবে, সবই তো
ঠিক আছে। ওতেই হবে। আমি বেরোচ্ছি।
আঃ কী মুশকিল। একবার ঘুরেই এসো না। অমি এসে পড়লে আবার কী পরিস্থিতি ঘটবে ভগবান জানেন। দোষটা কাটিয়ে যাও। সবদিক থেকে চোরদায়ে ধরা পড়েছি তো আমরাই।
ভবদেব হঠাৎ যেন থমকে গেলেন। বললেন, আচ্ছা বলতে পারো, এই চোরদায়ে ধরা পড়াটা কেন?
কেন আর!
বন্দনা নিশ্বাস ফেলে বললেন, একদা এই সংসারটি পাতিয়েছিলাম বলে!
ভবদেব হঠাৎ উত্তেজিত হলেন, যেটা তাঁকে কদাচ হতে দেখা যায় না। বললেন, এ কাজটা বরাবর আমাদের পূর্বপুরুষরাও করে এসেছেন। কই, তাঁদের আচরণ দেখে তো মনে হত না, তাঁরা চোরদায়ে ধরা পড়েছেন।
আগের যুগের কথা বাদ দাও। তখন তো ঠিক উলটোই ছিল। তখন কনিষ্ঠজনেরাই সর্বদা চোরদায়ে ধরা পড়ে বসে থাকত! গুরুজনদের মেজাজের উপরই তাদের জীবন!
আশ্চর্য। বদলটা কখন হল বলো তো?
জানি না! দেখতে পাচ্ছি ছেলেবেলায় বড়দের কাছে জোড়হস্ত থাকতাম, এখন বুড়োবেলায় ছোটদের কাছে
থেমে গেলেন! উথলে উঠলেন।
বিছানা থেকে নেমে নীরা সোফায় এসে বসেছে! নীরার সামনের সেন্টারপিসের উপর একপ্লেট আঙুর। নীরা রং করা নখে তার থেকে একটি একটি করে তুলে নিয়ে মুখে দিচ্ছে। নীরার প্রসাধনমার্জিত মুখে এখন স্বাস্থ্যের লাবণ্যের আভাস। সুদেব কাছে বসে, নিরীক্ষণ করে দেখছে, কোনও আঙুরটার গায়ে বোঁটার কাঁটাটুকু লেগে আছে কিনা।
দরজায় এসে দাঁড়ালেন ভবদেব।
এই মুখে লাবণ্যে ঢলঢল ছবিটি দেখতে পেলেন।
অবাক হয়ে ভাবলেন, খুনটা তা হলে কোনও ব্যাপারই নয়। এই মেয়ে একটা খুন করেছে। হ্যাঁ। হ্যাঁ। করেছে! ভূদেব সেনের অজাত বংশধরকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেয়নি, নির্মমভাবে হত্যা করেছে। অথচ আশ্চর্যরকম অপাপবিদ্ধ মুখ নিয়ে বসে আছে। ওর মুখে অপরাধবোধের কোনও ছাপ নেই। নিজের জীবন পাবে বলে, অবলীলায় একটা জীবনকে শেষ করে দিয়ে দিব্যি নিশ্চিন্তে বসে বসে আঙুর খাচ্ছে! পরম নিশ্চিন্তে। জানে, তলিয়ে যাওয়া অন্ধকার থেকে কেউ বদলা নিতে আসতে পারে না।
ভবদেব ভাবলেন, কিন্তু কোনওদিনই কি পারবে না?
এর মানে!
চলে আসতে আসতে শুনতে পেলেন ভবদেব, হঠাৎ এসেই কিছু না বলে চলে যাবার অর্থ! আশ্চর্য।
এ স্বর ভবদেবেরই ছেলের।
.
৪৭.
অনেক সময় বিধাতাকে একচোখো বলা হয়ে থাকে বটে, তবে সেটা সবসময় ঠিক নয়। এ পাড়ায় যে একমাত্র এই সেন বাড়িটাতেই আকস্মিক বিপর্যয় ঘটেছে তা নয়। আরও আছে। শরৎ গুপ্তর বাড়ির ছাদে সেই প্যাণ্ডেলের জন্যে বাঁধা বাঁশের খাঁচাটার উপর আর বাণ্ডিল বাঁধা রঙিন কাপড়গুলো বিছোনো, হয়ে ওঠেনি, সেগুলোকে দড়ির বাঁধন খুলে খুলে নামিয়ে ফেলে ঠ্যালায় চাপিয়ে ফের চালান করে। দেওয়া হয়েছে যেখান থেকে এসেছিল সেখানে। রঙিন কাপড়ের বাণ্ডিলরা বাঁধনসুদ্ধুই ফেরত গেছে।
সানাইওলাকে বারণ করে পাঠাতে হয়েছে, বারণ করে পাঠাতে হয়েছে কেটারারকে। নিমন্ত্রিতদের বারণ করে পাঠাতে হয়েছে জনে জনে।
এখন গুপ্ত দম্পতি সর্বদা বাড়ির মধ্যে দুটি প্রস্তরখণ্ডের মতোই বসে আছেন চুপ করে। লোকের প্রশ্নের ভয়ে সহজে বাইরে বেরোচ্ছেন না।
ভদ্রা দুর্গাপুরে চলে গেছে।
কনের বাপ যাচ্ছেতাই করে গেছে এবং লোকের কাছে বলে বেড়াচ্ছে, হঠাৎ জানতে পেরেছে শরৎ গুপ্তর বাড়ি ভাল নয়, তার মেয়ের রীতিনীতি সন্দেহজনক, তাই সে নিজে থেকে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে।
যাক একটা নিশ্চিন্ত বোঝা যাচ্ছে কোনও শোকতাপের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু শরৎ গুপ্তর কাছে তো এ প্রায় মরণ শোকের তুল্যই।
কিন্তু এত সবের কারণটা কী?
কারণ?
কারণ হচ্ছে শ্রীশরৎ গুপ্ত যখন ছেলের আসার জন্যে ঘরবার করছিলেন, আর চোদ্দবার স্টেশনে ফোন করে জানতে চেষ্টা করছিলেন ট্রেন লেট কিনা, তখন ছেলের টেলিগ্রাম এল। ক্ষমা চেয়ে জানিয়েছে এখন বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আজই অফিসের কাজে বদলি হয়ে তাকে অন্যত্র যেতে হচ্ছে। এ কাজে ভবিষ্যৎ আছে। তা ছাড়া এই মেয়েকে বিয়ে করাও তার পক্ষে সম্ভব নয়।
ওই শেষ লাইনটাই যে প্রধান লাইন, তা বুঝতে বাকি থাকল না গুপ্ত দম্পতির। কাজেই ছেলের এই নির্মমতা আর মা বাপের প্রতি অভদ্র আচরণে ক্ষিপ্তচিত্তে মনে মনে মূল কারণকে শাপ-শাপান্ত করতে থাকলেন।
পার্থ-জননী এমন সন্দেহও ব্যক্ত করতে দ্বিধা করলেন না, ভবদেব সেনের ওই ছোট মেয়ের চাকরি করতে যাওয়াটা ভাঁওতা। পাড়ায় ওই গল্পটা রটিয়ে ভবদেব মেয়ে নিয়ে নির্ঘাত কোনওখানে গিয়ে লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা পার্থটার কাছে গছিয়ে দিতে গেছে। রেজিষ্ট্রি বিয়ে তো হাতের মুঠোয়। কাঠখড় তো পোড়াতে হয় না। তা নইলে যে মেয়ে স্বাধীন হয়ে বিদেশে চাকরি করতে যাচ্ছে, তার আবার বাপ ভাই পৌঁছতে যেতে দরকার লাগে? এই ফাঁকে পার্থবাবুও অন্যত্র বদলির কথাটি বলে নিয়েছেন। তার মানে কেউ যে ছুটে গিয়ে ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে আসবে, তার পথটিও বন্ধ।
উঃ! ছেলে হয়ে এত শত্রুতা করল পার্থ!
এতই যদি ইয়ে, তবে গোড়ায় বলিসনি কেন লক্ষ্মীছাড়া? মা বাপকে বাঁদর নাচ নাচালি! পয়সার বৃষ্টি, খাটুনির একশেষ, লোকের কাছে অভ্রম, আর ভয়ানক একটা শত্রু সৃষ্টি। কন্যেপক্ষও তো এইসব কষ্টেই পড়েছে, তবে তারা ছোবল হানতে ছাড়বে কেন? নিজেদের মান বাঁচাতেও হানা দরকার তাদের। এ রকম একটা এগিয়ে যাওয়া বিয়ে শেষ মুহূর্তে ভেঙে যাওয়ায় ঘরে-পরে এ পক্ষ ও পক্ষ কার না সন্দেহ হবে? অতএব?
অতএব লোকের সন্দেহ নিরসন করতে পাত্রের বাড়ির গায়েই কালি ছিটোনো সব থেকে নিরাপদ।
হাত-পা বাঁধা শরৎ গুপ্তর উপায় বা কোথা, এই রটনার বিরুদ্ধে চোখ রাঙিয়ে লড়াই করতে নামার? ভবদেবের ছেলেটার সেই মস্তানি মুরুব্বিয়ানার দৃশ্যটা তো মুছে ফেলা যাচ্ছে না? ওই নাকউঁচু হঠাৎ নবাব মস্তানটা কি প্রচার করে বেড়ায়নি তার বাহাদুরির গল্প?
বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটা অচেনা পাড়া থেকে দুটো খারাপ ছেলের সঙ্গে লারেলাপ্পা করে ঘোরা চন্দ্রাকে যে সে ধরে এনে তার বাপের হাতে সঁপে দিয়ে গেছে, এ খবর আর কার জানতে বাকি থাকবে? ওই মুখ পোড়ানো মেয়েটাকে তো এঁটে উঠতে পারছিল না তার মা। তার পৃষ্ঠবল ওই ছেলে দুটোও এমন মাসিমা বলে গলে পড়ত যে, তাদেরও কিছু বলা যেত না। নানাভাবে দিতটিতও কত কী! কী করে বলা যায় তাদের, তোমরা বাপু আর এসো না আমার বাড়ি।
তবে একটাই ভরসা ছিল পার্থর মার সবসময়ই একসঙ্গে দুটোতেই আসত বসত। দুজন থাকা মানেই কিছুটা প্রহরায় থাকা।
শরৎবাবু অবশ্য অন্দরমহলের এত খবর জানতে পারতেন না। কদাচও ওরা সদর দিয়ে ঢুকত না। ঢুকত পাশের প্যাসেজের দরজা দিয়ে বাসনমাজার চাতাল ডিঙিয়ে। পার্থর মা দেখেও দেখতেন না, যেন বুঝতে পারেননি। তা বেশি তো কিছু অসহ্যকর করত না ওরা। হয়তো নিজেরাই একঠোঙা তেলেভাজা, পিয়াজি, কি ডিমের পকৌড়া নিয়ে এসে মাসিমার পদপ্রান্তে নামিয়ে দিয়ে বলত, মাসিমা চা করছেন তো? কখনও বা অনন্তর দোকানের হিঙের কচুরি-আলুর দম। এরপর একটু চা পানান্তে যদি তারা তাস নিয়ে কি ক্যারম নিয়ে একটু হুল্লোড় করে, আপত্তি করা যায়? আহা চন্দ্রাটাও তো একা হয়ে গেছে। দিদি শ্বশুরবাড়ি, দাদা বিদেশে। লেখাপড়াতেও তো ইতি হয়ে গেছে। মাধ্যমিকটা ফেল করে ফেলে, সেই যে কী এক লজ্জার গোঁতে পেয়ে বসল মেয়েকে, আর কিছুতেই স্কুলে যেতে রাজি হল না।
তা করবেটা কী সারাদিন?
মাঝে মধ্যে একটু সিনেমা দেখতে যাবার ছাড়পত্র না পেলে? কোথায় যাচ্ছে, কোন হল-এ, দূরে না কাছে, অত কী জানতে যাবেন তিনি? পাড়ার সেনেদের ছেলেটাও তত থাকে সঙ্গে।
স্বামীর কাছে অনেক ঢেকে, কিছু রেখে চালিয়ে যাচ্ছিলেন মহিলা, হতভাগা পাজি নাকউঁচু ছেলেটা একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে গেল। কর্তার কাছেই কি কম অপদস্থ হতে হল? মা মেয়ে দুজনকে যাচ্ছেতাই করেছেন শরকুমার এবং মেয়ের বেরোনো বন্ধ করেছেন। খোদ আসামি ছেলে দুটোরও এ বাড়ি প্রবেশ নিষেধ ঘোষণা হয়েছিল, কিন্তু কোথা দিয়ে যে কী হয়ে গেল। একটা তো হাসপাতালের খাটে শুয়ে ধুকছে, আর অন্যটা ফেরার। কে আর প্রবেশ করতে আসছে?
তার সঙ্গে বাপী সেনের নিজের ছোট ভাইটাও ফেরার। কে যে কোথায় কী কলকাঠি নাড়ল। তবে হ্যাঁ গুপ্ত দম্পতি বাপীর দুর্গতিতে অনেকটা খুশি। বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে। গাড়ি কিনে বড্ড অহংকার হয়েছিল।
তবু সব মিলিয়ে যন্ত্রণার ভাগটাই বেশি! কী সুখের সংসারটি ছিল তাঁদের, বেশ একটি ছন্দে গাঁথা দিনরাত্রি। গিন্নি সংসার করে চলেছেন, কর্তা টাকা জমিয়ে চলেছেন। হঠাৎ যেন চিলের ডানার ঝাপটা লাগল।
ঘুরেফিরে মূল কেন্দ্রে গিয়ে ঠেকছে শানু নামের মেয়েটা। হ্যাঁ ওই হচ্ছে যত নষ্টের মূল। ছেলে যে ওকেই বিয়ে করে ছাড়বে, সেটা বুঝে ফেলে, খুব আহ্লাদের সঙ্গে না হলেও মেনে নিয়ে সদয় ব্যবহারই করেছেন তার সঙ্গে পার্থর মা। কিন্তু যখন ভদ্রতার কাছে শানু তার বাবার অন্য জামাইদের স্ট্যাটাস শুনিয়ে অহমিকা দেখিয়ে গেল, আর পার্থ রাগে অপমানে, ওর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে ফেলল, তখন তো নিশ্বাস ফেলেই বেঁচেছিলেন। একটা ছেলে, কত পাওনা-থোওনার আশা। পাড়ার মেয়েকে বিয়ে করলে সে সব হত? কিন্তু সব ঘুচে গেল, বাড়তি লাভ গালে-মুখে কালি।
শরৎ গুপ্ত অবশ্য বিশ্বাস করছেন না, ভবদেব সেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে পার্থর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আসতে গেছে। তবে গিন্নি যখন গায়ের জ্বালায় বকবক করেন, প্রতিবাদও করতে বসেন না। তাঁর তো এখন শাঁখের করাত। নিজের মেয়েকে নিয়ে যে কী করবেন তাই নিয়েই মাথার মধ্যে হাজার চিন্তা!
কাজেই বলা যায় না বিধাতা ব্যক্তিটি একচোখো।
.
৪৮.
ভবদেব ফিরে আসার পর রাত্রের দিকেই আবার স্কুল সেক্রেটারি জগন্নাথ চক্রবর্তী তাঁর স্কুলের দিদিমণির সুখসুবিধার কিছু হচ্ছে কিনা খবর নিতে এলেন। এবং পরদিন থেকেই যে স্কুল খুলবে তা জানিয়ে দিলেন।
এসেই বললেন, কামিনী একটু চা বানা বাবা।
শানু ফট করে দাঁড়িয়ে উঠল, কামিনী, তুমি থাকো, চাটা আমিই বানিয়ে আনছি।
সে কী! সে কী! তুমি কেন জননী! কেন, কামিনীর কি হাতে কুষ্ঠ হয়েছে?
শানু চমকে উঠল। এ রকম কথা কি সে জীবনে শুনেছে? শানু মনে মনে আরও শক্ত হল। বলল, আমি চা তৈরি করতে ভালবাসি।
রক্তদৃষ্টি সেক্তেটি বাবুর চোখের সামনে বসে থাকার চেয়ে কামিনীর অনেক ভাল কাঠ ভাঙা কয়লা ভাঙা, কিন্তু এটা তার সময় নয়, তাই, তবে যাই আপনার গুইচে দিইগে। বলে শানুর পিছু পিছু এগিয়ে গেল যেদিকে রান্নার ব্যবস্থা। সবই তো শূন্যের ওপর।
চা এবং বিস্কিট সাজিয়ে এনে শানু শান্ত গলায় বলল, আপনি আবার কষ্ট করে খবর নিতে এলেন কেন?
কী মুশকিল! আমার একটা চিন্তা আছে তো?
শানু আরও শান্ত ভাবে বলল, অনর্থক চিন্তা করতে যাবেন কেন? আমি যখন একা এখানে চাকরি করতে এসেছি, নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে চিন্তা করেই এসেছি। …তা ছাড়া স্কুলে তো দেখাই হতে পারে। খবর জেনে নেবেন। তেমন দরকার হয় একে দিয়েই বলে পাঠানো যাবে।
জগন্নাথ ভারীমুখে বললেন, তোমার বাবা আমাকে বিশেষ করে বলে গেলেন–দেখাশোনা করতে।
শানু মনে করতে চেষ্টা করল, এই লোক এর আগে তাকে তুমি করে কথা বলেছে কিনা। ..মনে পড়ল না। এ পর্যন্ত যা কিছু কথা হয়েছে বাবার সঙ্গে। শান্তিস্মিতা সেনের সঙ্গে সরাসরি নয়। এবং ওই অতি ঘনিষ্ঠ তুমি সম্বোধনটা কানে খট করে লাগার কারণও তাই।
শানু আরও শান্ত আর গম্ভীরভাবে বলল, আমার বাবার কাউকে কোনও অনুরোধ করার অভ্যাস নেই।
অভ্যাস নেই! বাঃ।
জগন্নাথ যেন শূন্যে পড়ে গেছেন।
হ্যাঁ আমার বাবাকে তো আমি জানি। শানু বলল, তা ছাড়া একটা কথা–স্কুলের টিচারকে স্কুল সেক্রেটারির আপনি করে কথা বলাটাই বোধহয় ভাল দেখায়। স্কুলের ত একটা প্রেস্টিজ থাকা উচিত।
ওঃ! আচ্ছা!
জগন্নাথ চায়ের শেষাংশ ও বিস্কিট দুখানা ফেলে রেখেই উঠে দাঁড়ালেন।
কামিনী কাল একবার আমার বাসায় যাবি বলে গটগটিয়ে সেই সিঁড়ি পথ দিয়ে নেমে গেলেন।
শানু ভাবল বুড়ো চটেছে। চটুক। পয়লা রাত্তিরেই বেড়ালটা কাটলাম।
জগন্নাথ চলে যাবার পর কামিনী দরজাটায় খিল ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, সেক্কেটেবাবু চটে আগুন।
ওমা কেন?
শানু অবোধ হল, শুধু শুধু চটবেন কেন?
আপনি আসতে মানা করলেন
আরে সে তো ওঁর ভালর জন্যেই। বুড়ো মানুষ, কেন কষ্ট করে আসতে যাবেন?
বুড়া?
কামিনী ফিক করে একটু হেসে বলল, বদমেজাজি! ছুতোয় নাতায় পরিবারকে ধরে ঠ্যাঙায়।
অ্যাঁ।
সেই তো কতা! …কুনোখানে কেউ নাই, ঘরে ফিরে শুদু-মুদুই বলবে, কে এয়েছেল? কার সাতে কতা কইতেছিলি? একটা ফেরো পড়ে থাকলে বলবে, কে জন খেয়েছেল এটায়? …বাস তারপরই ঠেঙানি!
চমৎকার! উনি কিছু বলেন না? ওনার স্ত্রী?
ওনার ইস্তিরি? বলবে কিচু? ভয়ে কাঁটা না? চরিত্তির ভাল না তো মানুষটার।
.
শানু রাত্রে মোমবাতি জ্বেলে মাকে চিঠি লিখল। মাকে আশ্বাস দিয়ে বদমেজাজি ভদ্রলোকের পরিবারকে ধরে ঠ্যাঙানোর কাহিনী কৌতুকের ভাষায় লিপিবদ্ধ করে খামের মুখ ভাল করে এঁটে হাতব্যাগে ভরে রেখে শুতে গেল।
ও ঘরে কামিনী নাক ডাকাচ্ছে।
দুটো রাত বাবা ছিলেন, কামিনী রান্নাঘরে শুয়েছিল। ওর নাক ডাকাটাও আগামী চিঠির বিষয়বস্তু করা যাবে বলে মনটা হালকা করতে চেষ্টা করল শানু, পেরে উঠল না। হঠাৎ ভীষণ একটা ভয়ে সারা শরীর যেন কাঠ হয়ে গেল। …এ কোথায় শুয়ে আছে শানু? ঢাকুরিয়ার ভবদেব সেনের আর বন্দনা সেনের ছোটমেয়ে?
দুটো কোলাপসিবল গেটের নিরাপত্তার মধ্যে দোতলা কোঠার সেই ঘরটার কথা মনে পড়ল শানুর। যে ঘরের অপর দেয়ালের ধারে মায়ের বিছানা। রাতে একবার জেগে উঠেছে দেখলেই মা সাড়া করছেন, কী রে? মশা কামড়াচ্ছে?
এখানে? এখানে যদি হঠাৎ ওই কাঠের দরজা ভেঙে বুনো শুয়োর ঢুকে পড়ে দাঁত বসাতে আসে? শানুর হাত পা কুঁকড়ে এল।
ভয়ের যে এমন যন্ত্রণা আছে, জানা ছিল না শানুর। …ভাগ্যের ওপর রাগ দেখিয়ে শানু এ কী করে বসল।…
চিঠিখানা শানু স্কুল বাড়ির গায়ের ডাক বাক্সে ফেলে দিল। শানু স্বপ্নেও ভাবতে পারল না এখানকার চিঠিরা ভায়া সেক্রেটারি ডাকঘরে পৌঁছয়।
.
৪৯.
এয়ারপোর্টে মেয়েকে চিনে বার করতে সময় লাগল ভবদেবের। …ঘাড় হেঁট সাফ করা চুল, শুধু কপালের উপর খানিকটা ঝালর, মেদবহুল ন্যাড়া দুখানা হাতের একটায় শুধু একটা চওড়া ব্যান্ডের ঘড়ি, চোখে ঢাউস একজোড়া রঙিন চশমা, গায়ে ঢোলা জ্যাকেট আর বেলবটস। খুদে যে বছর চারেকের মেয়েটার হাত চেপে ধরে প্লেনে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল, সেওতো সম্পূর্ণ অচেনা। তাকে তো ভবদেব চোখেও দেখেননি। …ফটো অবশ্য পাঠিয়েছে ঢের, তবু যে চিনতে সময় লাগল, সেটা হয়তো ভবদেবেরই অন্যমনস্কতা, অক্ষমতা।…
না কি সময়টা লাগল ভবদেবের ভেবে নিতে, এই আমার মেয়ে সেই অমৃতা। ছিপছিপে সুন্দরী লাবণ্যে উজ্জ্বল সেই অমৃতাকে কলেজ থেকে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ফিরতে দেখলেন ভবদেব।…সেই মেয়ের ঘাড়ের উপর প্রায় ভেঙে পড়া মস্ত একটা খোঁপা। খুলে ছেড়ে দিলে পিঠটা ঢেকে ফেলত সেই ঘন কালো চুলের গোছা।
.
এখন একেই মনে করতে হবে তোমার সেই মেয়েটা। …কিন্তু কে এ? একে কি আমি চিনতাম কখনও?…
তার মানে ভবদেবের আপন সন্তানেরা ক্রমশই তাঁর একেবারে অচেনা হয়ে যাচ্ছে।
.
৫০.
বন্দনারও কি মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রথমেই মনে হল না, কে এ? একে নিয়ে এখন ঘর করতে হবে আমাকে? সম্ভব হবে? শুধু কি সাজে? এর মুখের রেখাতেও যেন অদ্ভুত একটা বিজাতীয় ছাপ। ওর জীবনে দুঃখ এসেছে বলে, কাছে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া যাবে?
বন্দনার ভাগ্য।
এই তো কিছুদিন আগে নন্দনার এক মেয়ে এসে ঘুরে গেল। শাড়ি শাড়ি করে পাগল। নীরার শাড়িগুলো দেখে কেড়েই নেয় আর কি? ওকেই সঙ্গে করে বাজার ঘুরে শাড়ি কিনে নিল একগাদা!
বন্দনা হেসেছিলেন, ওখানে গিয়ে বিলোবি বুঝি?
আহা তা আর নয়। পরে বেড়াব, আর অপরের চোখ জ্বালাব। আমাদের শাড়ি দেখে না ওরা একদম মোহিত। একটা সিল্ক টাঙাইল তো একটা মেয়েকে প্রেজেন্টই করে ফেলতে হল। যা হ্যাঙলামি করছিল।
তা হলে শাড়িই পরিস ওখানে?
ওমা! বাঙালির মেয়ে শাড়ি পরব না? শাড়ির তুল্য সৌন্দর্য আছে। তবে হ্যাঁ অফিস-টফিস যাবার সময় গাড়ি-ফাড়ি চালাতে ওই কাঠখোট্টা পোশাকটাই পরি। সুবিধে। .তা বলে সবসময় না কি? .অফিসের বস এরও যা পোশাক আমারও তাই! বাজে লাগে।
এই কদিন আগেও তো নন্দনা আবার মেয়েদের জন্যে মুর্শিদাবাদী বিষ্ণুপুরী কটকী আরও কীসব কিনে নিয়ে গেল।
বলল, নিয়ে গেলে তো তিনজনের জন্যেই নিয়ে যেতে হবে।
.
আচ্ছা বন্দনার মেয়েই বা এমন বদলে গেল কেন?
তবু বন্দনা সাহসে ভর করে বললেন, হাত মুখ ধুয়ে এই কাঠখোট্টা পোশাকগুলো ছেড়ে একটু শাড়ি-টাড়ি পরে নে, আমি চা আনি।
শাড়ি! শাড়ি পরতেই হবে?
না পরলে তোকে যে বাপু আমার মেয়ে বলে মনেই হচ্ছে না।
আশ্চর্য। কোথায় যে আছ এখনও।… এখন ওসব পারা যাচ্ছে না। আমি একটু ঘুমোতে চাই!
এখন, এই অসময়ে?
ঘুমের আবার সময় অসময় কী? শরীর চাইছে।
তো তোর মেয়ে?
ওর যা খুশি করুকগে।
তা হ্যাঁ রে, এত দেখছি একবর্ণও বাংলা বোঝে না, ভাব জমাই কী করে?
ওঃ! অদ্ভুত! এখনও ঠিক সেই রকম আছ! বাবার কাছে দিয়ে দাওগে।
বন্দনা বললেন, তা নয় দিচ্ছি, কিন্তু কী খাবে-টাবে, একটু বলে দিবি তো!
বলে দিতে হবে? ইমপসিবল। বাচ্চা আবার কী খাবে? বাচ্চাদের যা খাদ্য তাই খাবে! আজেবাজে কিছু দিও না, ব্যস! ..কই আমার বিছানাটা?
ওমা সে কী! একটু কিছু না খেয়ে
প্লিজ মা! আমায় একটু ঘুমোতে দাও। যতক্ষণ ইচ্ছে ঘুমোবো, খাবার জন্যে ডাকাডাকি কোরো না।
গিয়ে শুয়ে পড়ল পাশের ঘরে পাতা বিছানায়, বিশাল দেহটাকে ধপাস করে ফেলে।
বন্দনার মনে হল, ওই খাটটা যেন খাট নয়, বন্দনার বুক। বিশাল একটা ভার এসে পড়ল তার উপর।
শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। এই মেয়ে থাকতে এল তাঁর কাছে। একে নিয়ে, অর্থাৎ এর পরিচর্যা করেই বাকি জীবনটা কাটাতে হবে তাঁকে। ..শানু বাড়িছাড়া, টিপুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বাপী ছুরি খেয়ে হাসপাতালে, বন্দনার জীবনের এইসব ঘটনাগুলো কি এর কাছে বলতে বসা সম্ভব? ও কি কান দেবে? বন্দনার গভীর যন্ত্রণাটা অনুভব করবে? করবে না, করতে পারবেই না।
দেখে মনে হচ্ছে ওর অনুভূতিটাই বুঝি হারিয়ে গেছে। তবে? বন্দনার জীবনের সঙ্গে বন্দনার মেয়ের হৃদয়ের যোগ কোথায়?
কিন্তু বন্দনারই বা তেমন অনুভূতি আসছে কই? বন্দনার মধ্যেই কি মেয়ের হৃদয়জ্বালার তাপ পৌঁছচ্ছে? বন্দনা কি মনে করছে না, যখন সুখের সাগরে ভেসেছে মা, তখন একবার আসবার ফুরসত হয়নি তোমার, এখন আমার শতেক জ্বালার উপর জ্বালা বাড়াতে তোমার দুর্ভাগ্যের বোঝা নিয়ে ঘাড়ে এসে পড়লে।…
অনুচ্চারিত কথার জন্যে ফাঁসির হুকুম হয় না এই যা।
ভবদেব এসে বললেন, এই সময়টুকুর মধ্যেই আমি ওকে দাদু বলতে শিখিয়ে ফেললাম, বুঝলে? শিশু জাতটার কোনও জাত নেই। ওদের সঙ্গে মিশতে পারলে অনেক দুঃখ কষ্ট কমে যায়। কিন্তু আর তো সময় নেই, থানায় যেতে হবে
বন্দনা কষ্টে বললেন, কোনও আশা কি দিচ্ছে?
দেবার ভান করছে। তবু যেতে তো হবেই। আমাদের মতো লোকেদের আর কোন পথটা জানা আছে বলো?
এত দুঃখের মধ্যেই একটু হাসলেন ভবদেব। বললেন, যেমন তোমার ঠাকুর।
এ আবার কী কথার ছিরি।
চমকে উঠলেন বন্দনা। বললেন, যা মুখে আসে বললেই হল?
কেন, ভুল কী বলেছি? ভেবে দেখো, ঠাকুরও তো তাই। কিছু না করুক তবু পায়ে পড়তে যাওয়া ছাড়া তো গতি নেই।
বন্দনা ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, এত দুঃখ জ্বালা, এত যন্ত্রণা, তবু তোমার নাস্তিকতা গেল না।
নাস্তিকতা কোথায়? অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখি বলেই তো তাঁর রীতিপ্রকৃতি দেখতে পাই।
বন্দনা রাগের আর ব্যঙ্গের গলায় বললেন, ঠাকুর দুর্নীতিরও পৃষ্ঠপোষক, কেমন?
বন্দনাকে রাগতে দেখে ভবদেবের হঠাৎ বেশ ভাল লাগল। কদিন তো শুধু কান্নার উপরেই আছে মানুষটা। অথচ এই রাগ রাগ ভাবটাই যেন ওকে ঠিক মানায়। রাগটাকে বাড়িয়েই দিতে ইচ্ছে হল। বললেন, হানড্রেড পারসেন্ট। সেই ভদ্রলোকটি দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা না করলে পৃথিবীর এই হাল হয়?
চমৎকার! মানুষের বাঁদরামিটা কিছু না, দোষ হল ঠাকুরের। শয়তানের কারসাজিকে ভগবানের কাজ বলে মনে কোরো না বুঝলে?
রাগ করেই চলে গেলেন বন্দনা ফুটফুটে নাতনিটার দিকে না তাকিয়েই।
কিন্তু যাবেন আর কোথায়? দৈনন্দিনের অমোঘ দায়ের কাছে শোক তাপ দুঃখ ভাবনা সবই পরাস্ত। মৃতদেহের কাছে বসেই চিন্তা করতে হয় জীবিতরা কখন কী খেতে পাবে। এই মুহূর্তে কী দেওয়া যায় তাদের।
রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাসে চড়ানো জিনিসটা পরীক্ষা না করেই গ্যাসটা নিভিয়ে দিয়ে বন্দনা আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছেলে বউয়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরদার একদিক থেকে ডাকলেন, খোকা।
ঝপ করে তো ঢুকে পড়া যায় না। সব সময়ই তো দুজনে গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে বসে থাকে।
নীরার এখনও সিঁড়ি ওঠানামা বারণ, তাই বন্দনাকেই খোঁজ নিয়ে যেতে হয়, তার জন্যে কী হবে না হবে। এই ছুতোতেই বউকে দেখতে আসার কর্তব্যটাও মেটে।
খোকা পরদাটা সরিয়ে ধরে দাঁড়াল।
নার্সটার্স ছোঁয় বলে বন্দনা রান্নাটান্নার সময় পরদাটা ছোঁন না।
নীরা এটা লক্ষ করে সুদেবের কাছে অবাক মন্তব্য করে, এত ভাবনা চিন্তা মনোকষ্ট, এত কান্নাকাটি, অথচ এই তুচ্ছ ব্যাপারটিতে ভুল হয় না। আশ্চর্য।
তা আশ্চর্য হলেও খোকা মার রীতিটা উড়িয়ে দেয় না।
বন্দনা ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা নিশ্বাস ফেললেন। সেই আঁতুড় ঘরের মতোই এতদিন আটকেও থাকলে বাছা, অথচ
খোকা আন্তরিক গলাতেই বলল, বোসো না।
পারিবারিক জীবনে জ্যেষ্ঠের যে একটা কর্তব্য আছে, সেটা কি সুদেব মনে মনে অনুভব করে না? করে এবং তার জন্যে কুণ্ঠাও আছে, কিন্তু কী করবে? তার যে হাত পা বাঁধা। পয়সা খরচ করেও নিয়মিত নার্স মিলছে না। ভিতরের কুণ্ঠাই খোকাকে নম্র আর আন্তরিক দেখতে করে তুলেছে। তবু বন্দনা বললেন, বসব নারে, আলু সেদ্ধ চড়িয়ে এসেছি। বউমা তোমার আজ কী করব? স্টুই খাবে, না এমনি মাছের ডালনা-টালনা–
নীরা খুব মিহি গলায় বলল, স্টু খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেছে বাবা।
তা সত্যি। এমনি তরকারিই খাও না হয় একটু।
টোস্ট খেয়ে খেয়েও তো
খোকা তাড়াতাড়ি বলল, হ্যাঁ তাই বলছিল! একঘেয়ে টোস্ট আর খেতে পারছে না। বরং হাতে গড়া রুটিই–একটু থামল, বলল, তোমার আবার খাটুনি বাড়ানো, তবে ডাক্তার বলেছে এখন একটু লুচিটুচিও খেতে পারে। গরম লুচিটাই তো ওর সব থেকে ফেভারিট।
নীরা আরও চিকন গলায় বলল, আঃ। তোমার কেবল বাজে কথা। না, না, রুটিই রাখবেন দুখানা। করবেনই তো সকলের জন্যে।
বন্দনা মনে মনে নিশ্বাস ফেললেন। কার জন্যেই বা কত করছি। বাপী নেই, টিপু নেই, শানু নেই। নিজে তো তিনি সকালের ভাত রেখে দেন দুটি করে, আটা ময়দা খেতে পারেন না। ওই যে একজন ঘাড়ে এসে পড়েছে তারই বা কী ধাত কে জানে।
তবু বললেন, কী যে বলো বউমা, দুখানা লুচি করতে কি ক্ষয়ে যাবে তোমার শাশুড়ি। খেতে নিষেধ না থাকলে, রোজই করে দিতে পারি।
মজা এই, এখন হঠাৎ বন্দনার পাশের ঘরে শুয়ে থাকা আপন গর্ভজাত সেই মেয়েটার থেকে ছেলের বউকেই বেশি কাছের মানুষ মনে হল। হোক সাজানো তবু তো কথাবার্তা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কয়।
বললেন, তোমার জন্যে তো ভাবি না। এখন তোমার মেম ননদটির জন্যেই ভাবনা। এসেই তো নাক ডাকাতে পড়েছে, কী খাবে-টাবে–
খোকা বিরক্ত ভাবে বলল, এত ভাবনার কী আছে? এই বাড়িতেই তো মানুষ হয়ে গেছে।
বন্দনার মনের মধ্যে অনেক উত্তর, তবু চুপ করেই চলে এলেন। উত্তর দেওয়া মানেই তো তিক্ততার সৃষ্টি।
এই জন্যেই শানু বলত, তোমাকে আর লোকে মানবে কী করে মা? সকলের কাছেই দাসখত লিখে রেখেছ।
কিন্তু বন্দনা তো মানা চান না, চান শুধু একটু স্বীকৃতি–একটু সহানুভূতি। তা সেইটুকুই বা সুলভ কই?