৪১.
মহাজ্ঞানী সূত বললেন, গন্ধমাদন গিরিশৃঙ্গের পাশে উপরের দিকে সমৃদ্ধি সম্পন্ন এক গণ্ডিকা আছে। এর শুধুমাত্র পূর্ব-পশ্চিমের বিস্তার বত্রিশ হাজার যোজন এবং দৈর্ঘ্যে অর্থাৎ উত্তর-দক্ষিণে চৌত্রিশ হাজার যোজন। সেখানে কতিপয় সকর্মশীল প্রাণী বাস করেন। এঁরা কেতুমাল নামে পরিচিত। কেতুমাল পুরুষেরা অত্যন্ত বলবীর্যসম্পন্ন ও কালানলের মতো প্রখর। স্ত্রীলোকেদের বর্ণ উৎপলের মতো এবং তারা সকলেই প্রিয়দর্শিনী। সেখানে একটি ছয়বাস পূর্ণ বিরাট পনস বৃক্ষ আছে। ব্রহ্মসূত কামচারী মনের মতো গতিসম্পন্ন ঈশ্বর এবং কেতুমালনিবাসী প্রাণীরা এই স্বর্গীয় ফলের রস পান করে থাকেন। এর ফলেই তারা অযুত বৎসর জীবিত থাকেন।
গন্ধমাদনের উপরিস্থিত এই গণ্ডিকার মতো মাল্যবান পর্বতের পূর্বদিকেও আরও একটি বিস্তৃত ও দীর্ঘ গণ্ডিকা আছে। সেখানে নিত্য আনন্দিতচিত্ত ভদ্রাশ্বগণ বাস করেন। সেখানে এক নয়নাভিরাম সালবন এবং কয়েকটি মহাবৃক্ষ আছে। এই মহাবৃক্ষগুলি কালা নামে অভিহিত হয়ে থাকে। ভদ্রাশ্ব পুরুষেরা শ্বেতবর্ণের ও মহাবলবীর্য সম্পন্ন হয়ে থাকেন, তুলনায় স্ত্রীলোকেরা চন্দ্রপ্রভা চন্দ্রবর্ণা বলা যেতে পারে। ভদ্রাশ্ব রমণীর অঙ্গলাবণ্য কুমুদতুল্য এবং তারা অতিশয় সুন্দরী ও প্রিয়দর্শিনী হয়ে থাকেন। তাদের আনন পূর্ণচন্দ্রের মতো, শরীর চন্দ্রের মতো শীতল, এবং সারা গায়ে পদ্মের মতো সুগন্ধ। তারা একবারে দশ সহস্র বৎসর নিরাময় আয়ু ভোগ করে থাকেন। কালারস পান করে তারা যৌবনকে একইভাবে ধরে থাকেন।
ব্ৰহ্মবাদী ঋষিরা বললেন, হে সূতবর, পর্বত নদী দেশ জনপদ–এসব কিছুই যথাযথভাবে কীর্তিত হয়েছে। এবিষয়ে কোনো কিছুই আর অব্যক্ত নেই। এখন আপনি সেখানকার অধিবাসীদের প্রমাণ, বর্ণ ও সম্ভোগ বিষয়ে কিছু বলুন।
ত্রিকালদর্শী সূত বললেন, চতুর্মহাদ্বীপবাসীগণের বর্ণ ও আয়ুষ্কাল আমি যথাযথভাবে বর্ণনা করছি, শুনুন। পূর্বপূর্ব কল্পের সিদ্ধগণ দ্রাশ্বগণের যে যে লক্ষণ নির্দেশ করেছেন, হে কীৰ্তিবর্ধন ঋষিগণ, আমি তা বিস্তারপূর্বক কীর্তন করছি, মন দিয়ে শুনুন।
দেবকূটগিরির বিষয়ে আমি পূর্বেই আলোচনা করেছি। পূর্বকথিত এই বিখ্যাত গিরির পূর্বদিকে পঞ্চকুলাচল নদী ও জনপদ সম্বন্ধে যেমন শোনা গেছে এবং দেখা গেছে–আমি অনুরূপ বর্ণনা করছি। পঞ্চকুলপর্বত বলে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে শৈবাল, বর্ণমালা, কোরঞ্জ, শ্বেতবর্ণ ও নীল এই পঞ্চশৈল এদের থেকে উদ্ভূত আরও শতশত সহস্র সহস্র পর্বত এই ভূলোকে আছে। পর্বত মিশ্রিত জলপদগুলি নানাবিধ প্রাণী নানাজাতীয় নৃপ ও পর্বতে পরিকীর্ণ।
প্রাচীন পণ্ডিতগণ ওই সব জনপদগুলিকে নৃপতি নামধেয় পরাক্রান্ত সমৃদ্ধিশালী শ্রেষ্ঠ পুরুষদের মনোহর বাসস্থান বলে বর্ণনা করেছেন। পর্বতের অন্তর্নিবিষ্ট সম ও বিষম ভূমিভাগে এই সমস্ত বিবিধ রাষ্ট্র ও জনপদ গড়ে উঠেছে। এরকম কয়েকটি লোকঅধ্যুষিত জনপদের নাম হল–সুমঙ্গল, চন্দ্রকান্ত, তট, শুদ্ধ, সুনন্দন, বজ্রক, নীলমৈলেয়, হৌলেয় বিজয়াস্থল, শম্ভব, মহানেত্র, শৈবাল, শুষ্কল, কুমুদ, কাশমণ্ড, পর্ণভৌম, হারভৌমক, হেমভূমক, মহাস্থল, মহাকাল, সুকাশ, সেমাসঙ্গ, বাতারংহ, কুশূলজ, পরিবার পরাচক, মেদক, বৎসক, এক বরাহ, বিটশৌণ্ড, শঙ্খতা, উত্তর, কৃষ্ণভৌম, সুভৌম ও মহাভৌম প্রভৃতি।
আদিকাল থেকে ত্রিলোকখ্যাত হিমজলবাহিনী মহাপুণ্যা মহানদী মহাগঙ্গায় অবস্থান করে আসছে। এই মহাগঙ্গা হতে যেসব নদী বিনির্গত হয়েছে, তারা হল–হংসবসতি, শাখাবহতী, সোমনদী, মহাব, চক্রা বরকা কৌশিকী, সুরসা, সোমাবর্তা, আপগোত্তমা, হরিতোয়া, মেষা, অঙ্গারবাহিনী, কাবেরী, শতদা, বনমালা, বসুমতী, পদ্মাবতী, চম্পা, সুবর্ণা, সুব, পঞ্চগঙ্গা, বপুত্মতী, মণিব, ব্রহ্মাভোগা, বিনাশিনী, কৃষ্ণতোয়া, পুন্যদা নাগপদী, শৈবলিনী, ক্ষীরোদা, অরুণাবতী, মণিতটা, বিষ্ণুপদী, হিরণ্যবাহিনী, নীলা, কন্দমালা, সুরাবতী, বামেদা পতাকা ও বৈতালী, এই সমস্ত নদীই গঙ্গার মতো নায়িকা রূপে পরিকীর্তিত। এছাড়া আরও অনেক শত সহস্র ক্ষুদ্র নদী আছে। পূর্বদ্বীপবাহিনী এইসব নদী পুণ্যবহতী বলে কীর্তিত হয়েছে। এইসব নদীর মান কীর্তনকেও পবিত্র কর্ম বলে জ্ঞান করা হয়।
প্রচুর সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ও জনপদ সমন্বিত এই দ্বীপরাষ্ট্র নানা বৃক্ষবনে পরিপূর্ণ নানা পর্বতে সুবেষ্টিত, নানা নরনারীগণে সমাকীর্ণ, সেখানে নিত্য আনন্দ ও সুমঙ্গল বিরাজ করছে। এই রাজ্য বহু ধনধান্যে পরিপূর্ণ। নানা নৃপতি দ্বারা পালিত শত শত লোকের দ্বারা কীর্তিত এবং নানা রত্নের আরকস্থল।
এই দ্বীপবাসী পুরুষেরা সকলেই সুবর্ণ অথবা শঙ্গা বর্ণের অধিকারী। সকলেই বিশালাকায় মহাবলবীর্যধারা এবং বর পুরুষশ্রেষ্ঠ। এই দ্বীপবাসী মহাভাগ প্রজাবৃন্দ দেবতাদের সাথে সহজ সম্ভাষণ দর্শন ও উপবেশন করে থাকেন। এঁদের বিশেষ কোনো ধর্মাধর্ম নেই। এঁদের সাধারণ আয়ু দশ সহস্র বৎসর। এখানে অহিংসা ব্রত এবং সত্য বাক্যই প্রাকৃতিক নিয়ম বলে পরিগণিত। তাঁরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পরম ভক্তিভরে দেবাদেব শংকর ও পরমবৈষ্ণবী গৌরীদেবীর উদ্দেশ্যে যাগযজ্ঞ–পূজা নমস্কারে সতত নিযুক্ত থাকেন।
.
৪২.
সূত বললেন, হে মহান দ্বিজবৃন্দ, ভদ্রাশ্ব বর্ষের নৈসর্গিক নিয়ম আপনাদের সামনে যথাযথভাবে বললাম। এবার কেতুমালবর্ষের বিবরণ বিস্তৃতভাবে শ্রবণ করুন।
কেতুমালবর্ষের পশ্চিমদিকে সাতটি কুলাচল, কতিপয় নদী ও কতকগুলি জনপদ আছে। এবার তাদের কথা বিস্তারিতভাবে বলছি শুনুন। কেতুমালবর্ষের সাতটি কুলপর্বত হল–বিশাল, কম্বল, কৃষ্ণ, জয়ন্ত, অশোক, বর্ধমান এবং হরিপর্বত। এইসব কুলপর্বত থেকে আরও বহু শতত সহস্র কোটি কোটি পর্বত উদ্ভূত হয়েছে। এইসব পর্বতে মিশ্রিত হয়ে আছে। নানা জাতি সমাকীর্ণ অনেক নৃপতিপালিত নানাবিধ পরাক্রান্ত ও পৃথিবীখ্যাত জনপদ আছে। পর্বতগুলির সমস্থান ও বিষমস্থান–উভয় স্থানেই এই জনপদগুলি গড়ে উঠেছে। এরকম বিভিন্ন নামধারী কয়েকটি রাষ্ট্রে বিবিধ গো, মনুষ্য ও কপোতাদি সন্নিবেশিত হয়েছে। কোথাও আবার ভ্রমরকুল সুখে গুঞ্জন করছে। এইসব প্রসিদ্ধ রাষ্ট্রগুলি হল–করম্ভ, কূটক, শ্বেত, সুবর্ণকটক, স্তাবক, ক্রৌঞ্চ, সুমোল, কৃষ্ণাঙ্গ, মণিপুঞ্জক, তট, কম্বল, মৌষীয়, সমুদ্ৰান্তরক, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণপাদ, চিতা, কপিল, কণিকা, উগ্র, করাল, গোজ্বাল, করঞ্চভ, করবাট, হীনাম, মহিষ, বনপাতক, কুমুদাভ, মহোৎকট, শুকনামস, মহানাস, পীতাস, কজভূমিক, সঙ্গম, পান্ডুভৌমিক, কুবের, বাহ, যমজ, জঙ্গ, বগ, বীচাঙ্গ, মহাঙ্গ, রাজীব, কোকিল, মধুরেয়, সুরোচক, পিত্তল, কাঁচল, শ্রবণ, মত্তকাসিক, গোদ, বাড়, কুলাবণ্য, বর্জিত, সোদয় ও অলক প্রভৃতি।
কেতুমালবর্ষের মহাভাগ অধিবাসীবৃন্দ যে যে পবিত্র মহানদীর জল পান করে থাকেন, সেইসব মহানদীর তীর বা ঘাট সুন্দরভাবে বাঁধানো একম কিছু মহানদী হল–কম্বলা, বকুলা, বিকীর্ণা, শিখিমালা, তামসী, শ্যামা, সুমেধা, ভীমা, দর্ভাবতী, ভদ্রানদী, শুকনদী, পলাশা, মহানদী, কুসাবতী, প্রভঞ্জনা, দক্ষা, কাঞ্চী, শাকবতী, চন্দ্রাবতী, সুমূলা, ঋষভা, সমুদ্রমালা, চম্পাবতী, একাক্ষা, পুণ্যোদা, ভাততী, সীতোদা, পাতিকা, ব্রাহ্মা, বিশালা, পীবরী, কুমকারী, রুথা, মহিষী, মানুষী ও দণ্ডা, এছাড়াও বহু দেবর্ষিসেবিতা সিদ্ধপূজিতা পুণ্যসলিলা পাপনাশিনী মঙ্গলা শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ নদী আছে। পূর্বোক্ত রাজ্যের অধিবাসীবৃন্দরাই এই সব মঙ্গলদায়িনী নদীর জল পান করে থাকেন।
নানা জলপদে স্ফীত, নানা রত্নে বিভূশিত, মহাপর্বতে শোভিত, নিত্য আনন্দিত, মঙ্গলবার ধনধান্যে সমৃদ্ধ কেতুমাল নামে এই যে পশ্চিম দ্বীপ-তা কিন্তু কেবল সুকর্মা ব্যক্তিদেরই নিবাসস্থান। এই দ্বীপের চারিদিকেই অধিবাসীবৃন্দের আলয় গড়ে উঠেছে।
হে ঋষিগণ, কেতুমাল দ্বীপের নৈসর্গিক বিবরণ এখানেই শেষ হল।
.
৪৩.
মহাঋষি শংশপায়ন বললেন, আপনার কাছে পূর্ব ও পশ্চিমের দ্বীপদুটির কথা জানলাম, এবার আপনি বিস্তারিতভাবে উত্তর ও দক্ষিণ বর্ষের নৈসর্গিক রূপ এবং সেখানকার অধিবাসীদের বিষয়ে যথাযথভাবে বলুন।
লোমহর্ষক বললেন, শ্বেতশৈলের দক্ষিণে এবং নীলশৈলের উত্তরেও একটি বর্ষ আছে। এর নির্মল যশাঃ এখানকার অধিবাসীবৃন্দ রত্তি প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। এরা অজর এবং দুর্গন্ধ বর্জিত। এই রমণকবর্ষে যে দিব্য বটবৃক্ষ আছে, প্রধানত তার ফলের রস পান করেই ওই বর্ষনিবাসীগণ দশ সহস্র এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পঞ্চদশ শত বৎসর জীবন ধারণ করে থাকেন। এই দীর্ঘ। আয়ুমধ্যে তাদের কখনও কোনো দুঃখ ভোগ করতে হয় না। এঁরা সর্বদা আনন্দিত থাকেন।
শ্বেত শৈলের উত্তরে এবং শৃঙ্গবান শৈলের দক্ষিণে হিরণ্যক বর্ষ বিদ্যমান রয়েছে। এই হিরণ্যক বর্ষে যেসব প্রাণীরা জন্মগ্রহণ করেন, তারা সকলেই সকল ঋতুতেই মহাবল সুতেজষ্ক কামপ্রিয় সত্ত্বগুণাধিকারী ধনী এবং প্রিয়দর্শন হয়ে থাকেন। এখানকার অধিবাসীরা অমিততেজা। একাদশ সহস্র একশত পঞ্চাদশ বৎসর পর্যন্ত এঁরা জীবিত থাকতে পারেন। অর্থাৎ এঁরা প্রমাণ আয়ুকাল পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারেন। হিরণ্যবতী নামক মহানদী হিরণ্যকবর্ষকে চতুর্দিকে প্লাবিত করেছে। এই বর্ষে ‘লকুচ’ নামে এক মহাবৃক্ষ জন্মে, ইহা ষটরসময়। এরই ফলরস পান করে হিরণ্যক বর্ষব্যাপী জীবনধারণ করেন।
পূর্বোক্ত শৃঙ্গবান শৈলের তিনটি উচ্চ এবং বিস্তৃত শৃঙ্গ আছে। এক একটি শৃঙ্গের এক একটি বিশেষত্ব আছে। প্রথমটি মণিময়, দ্বিতীয়টি হিরন্ময় এবং তৃতীয়টি সর্বরত্বময়। তবে একটি বিষয়েই শৃঙ্গগুলির মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তিনটি শৃঙ্গই ভবনশোভিত।
উত্তর সমুদ্রের দক্ষিণাংশে কুরু নামে একটি সিদ্ধসেবিত বর্ষ আছে। এই কুরুবর্ষের কোথাও কোথাও সর্বকামফলপ্রদ রমণীয় বৃক্ষ আছে। এইসব বৃক্ষফল গন্ধ-বর্ণ-রস-এ অতুলনীয়। এই বৃক্ষফল থেকে ক্ষরিত উত্তম মধু পান করে কুরুবর্ষের মানুষেরা জীবনধারণ করে থাকেন। এছাড়াও সেখানে পুষ্পফলময় একপ্রকার বৃক্ষ আছে। এইসব বৃক্ষ ও তার ফল থেকে সদা সর্বদাই উত্তম অমৃততুল্য ষট রসময় ক্ষীর ক্ষরিত হয়ে চলেছে। এগুলিও এখানকার অধিবাসীবৃন্দের প্রিয়।
কুরুবর্ষের ভূমিতল মণিমণ্ডিত। খুবই সূক্ষ্ম স্বর্ণ বালুকণায় তা সমাকীর্ণ হয়ে আছে। এই ভূমির সর্বাংশই সুখস্পর্শ। এখানে কোনো পঙ্ক বা ক্লেদ নেই। প্রধানত দেবলোকচ্যুত শুভ মানুষেরাই কুরুবর্ষে জন্মগ্রহণ করে থাকেন। এঁদের কোনো রোগ-শোক নেই। সকলেই শুভ্রযশঃ সম্পনান ও স্থির যৌবন, এখানকার রমণীরা অতিমনোহর ও প্রিয়দর্শিনী। তারা একসঙ্গে মিথুন প্রসব করেন। এই ক্ষীরীবৃক্ষের অমৃততুল্য ষ-রসময় ক্ষীর পান করে অস্তিত্ব রক্ষা করে মিথু একদিনেই জন্ম নেয় এবং দুজনেই সমানভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাদের স্বভাব ও রূপ সমপ্রকার হয়। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা একই কালে তাদের মৃত্যু হয়। এই মিথুনেরা চক্ৰবাকের সমর্থ। এঁরা পরস্পর অনুরক্ত ও রোগশোক রহিত হয়ে নিত্য সুখে কালযাপন করে থাকেন।
কুরুবর্ষীয় পুরুষেরা ত্রয়োদশ সহস্র একশত পঞ্চদশ বৎসর সুখে জীবন কাটান। এঁরা কখনোই পরস্ত্রী সম্ভোগ করেন না।
এই যে কুরুবর্ষ, এর উত্তরদিকে শৈলশ্রেষ্ঠ জারুধির উত্তরভাগে যেখানে যা কিছু প্রাকৃতিক নিসর্গ চিত্র আছে, তা আপনাদের কাছে বিস্তারপূর্বক বলছি, শ্রবণ করুন।
এখানে চন্দ্রকান্ত ও সূর্যকান্ত নামে দুটি সমুন্নত ও বিশালাকৃতি কুলপর্বত আছে। এই দুটি পর্বতেই সিদ্ধ ও চারণ সেবিত। এই পর্বতদ্বয়ে বহু কন্দর, গুহা, নিঝর, কুঞ্জবন, চিত্রিত সানুদেশ, অসংখ্য ধাতু, পুষ্প, মূল ও ফল আছে। এই দুই কুলপর্বতের মধ্যে দিয়ে ভদ্রসোমা নামে এক মহানদী প্রবাহিত হয়েছে। ভদ্রসোমা ছাড়াও কুরুবর্ষদ্বীপে কুরু অধিবাসীবৃন্দে স্থান পান ও অবগাহনের নিমিত্ত আরও অনেক মুরসা প্রসন্নসলিলা নদী আছে। এক একটি নদী এক একটি দ্রব্য বহন করে চলেছে। কোনো নদী মধুবাহিনী তো কোনো নদী মধ্যবাহিনী, আবার কোথাও হয়তো মৃত বা দধিবাহিনী শতহুদা মহানদী প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এখানে যত ধরনের ফলমূল আছে সবই গন্ধ, বর্ণ, রসে সেরা, অমৃত স্বাদময় এই বিবিধ ফলগুলির মহাগন্ধ এত তীব্র যে পঞ্চ যোজন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে। এছাড়া এই দ্বীপরাজ্যে নানা বর্ণ নানা জাতের সুখ-স্পর্শ সহস্র সহস্র পুষ্প ফুটে থাকে। এখানে একটি অন্নময় পর্বর্তও আছে।
হে দ্বিজেন্দ্রগণ, এই করুদ্বীপে তমাল ও অগুরুগন্ধ ও চন্দনের বন আছে। বনস্থলী প্রফুল্ল ও ভ্রমরগুঞ্জনে মুখরিত। এছাড়া আরও অসংখ্য বৃক্ষগুল্ম-লতাসমৃদ্ধ সুখময় বর্ণ আছে। এইসব বনপথ একদিকে যেমন ভ্রমরগীতে গুঞ্জিত তেমনি দ্বিজগণের বেদমন্ত্রে মুখরিত। এছাড়া এখানে কমলবনে সমৃদ্ধ সহস্র সহস্র সরোবর এবং ভক্ষ্য ও পেয় বস্তুতে সমৃদ্ধ অসংখ্য রমণীয় বিহারভূমি আছে। বিহারভূমিগুলি রম্য ও গুণসম্পন্ন। বহুবিধ পুষ্পমাল্যে অনুলেপিত, বিচিত্র শয়নাসনে বিভূষিত ও সুখশ্রাবী বিহগকূজনে মুখরিত হয়ে এই বিহার ভূমিগুলি সকল ঋতুতেই সুখ প্রদান করে থাকে। এই বিহার ভূমিগুলি নিয়মিত মণি ও সুবর্ণ দ্বারা পরিষ্কৃত হয়। এর স্বল্পব্যবধানে স্থানে স্থানে বহু ক্রীড়াস্থান শিলাগৃহ, বৃক্ষগৃহ, রমণীয় কদলী গৃহ, সুখময় ও সহস্র লতাগৃহ গড়ে উঠেছে। এছাড়া বিহাক্ষেত্রের চতুর্দিকে মণিজালাবৃত সুবর্ণ গবাক্ষ সুবর্ণ ও মণিবিচিত্র সহস্র সহস্র বরণীয় মহাবৃক্ষ আছে। এখানকার শত শত ভূমি ও গৃহ বিশুদ্ধ শঙ্খের মতো শ্বের শুভ্রবর্ণ। নানা আকারের সূক্ষ্ম ও সুখকর বস্ত্র এবং মৃদঙ্গ বেণুপণ বীণা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের বহুল ব্যবহার আছে। বিহারভূমির কল্পবৃক্ষগুলি শতসহস্র দেবভক্ষ্য ফল প্রসব করে। নগরের বিভিন্ন উদ্যানে বৃক্ষগুলি চোখে পড়ে। অগনন নরনারী অধ্যুষিত এই নগরগুলিকে কেন্দ্র করে এক-একটি আনন্দপূর্ণ সমৃদ্ধি সম্পন্ন দ্বীপ গড়ে উঠেছে। কুরুবর্ষে এরকম বহু দ্বীপ আছে। নানা পুস্পসুরভিত মন্থর পবন দ্বীপগুলিকে সবসময় মথিত করে রাখে।
কুরুবর্ষ দ্বীপ নিত্য-সুখকর ও অত্যন্ত রমণীয় কেবলমাত্র স্বর্গভ্রষ্ট মানুষেরাই এখানে জন্মলাভ করে থাকেন। উত্তমগুণযুক্ত হওয়ায় ভূমিস্থিত এই স্থান স্বর্গের চেয়ে কাঙিক্ষত হয়ে উঠেছে। ভিন্ন ধরনের মানুষেরা বসবাস করেন। যেমন পূর্বতীরে শ্যামবর্ণ মানুষেরা আর পশ্চিমতীরে শ্যাম ও ধ্বলকান্ত মানুষের বসবাস। পূর্বকুলজাত মানুষেরা “চন্দ্রকান্ত” এবং পশ্চিমকুলজাত মানুষেরা, “সূর্যকান্ত” নামে অভিহিত হয়ে থাকেন এঁরা সকলেই দেববল পরাক্রমশালী ও উত্তম তেজের অধিকারী হওয়ায় জগতে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হন। এঁরা ইচ্ছেমতন ইতস্তত বিহার করে বেড়ান। বলয় অঙ্গদ কেয়ুর হার ও কুণ্ডলে ভূষিত, মালা বিচিত্র মুকুট ও আচ্ছাদন বস্ত্রে সুসজ্জিত এইসব অধিবাসীবৃন্দের যৌবন কোনোদিন বিগত হয় না। এঁরা সুপ্রিয় ও প্রিয়দর্শন। এঁরা অজর-অসর বহু সহস্র বৎসর এঁরা সহজেই জীবিত থাকতে পারেন। কুরুবর্ষবাসী রমণীরা কখনোই সন্তান প্রসব করেন না। তাই এঁদের বংশক্ষয় অথবা বংশবৃদ্ধি কোনোকিছুই হয় না। এখানে মহাবৃক্ষগুলি থেকেই মিথুন জন্মায়।
কুরুবর্ষবাসীরা সকলেই সাধারণ বিত্তের অধিকারী এবং সকলেই মমত্ব বর্জিত। এঁদের কাছে ধর্মাধর্ম বলে কিছুই নেই। ব্যাধি, জরা, দুর্মেধা বা ক্লান্তি কোনো কিছুই এঁদের ভোগ করতে হয় না। আয়ুষ্কাল পূর্ণ আপনা হতেই বিনষ্ট হয়ে যান এঁরা সকল প্রকার দুঃখবোধহীন ও অত্যন্ত সুখী।
উত্তরকুরুদ্বীপের পাশে একটি স্থান আছে। যেখান থেকে সাগরের তরঙ্গ দেখতে পাওয়া যায় সেখানে নাগ ও অসুরেরা বাস করেন। এখান থেকে পঞ্চ সহস্র যোজন দূর চন্দ্রদ্বীপ নামে অপর একটি স্থানে চন্দ্রমণ্ডল ও দেবগণ বিরাজ করেন। এই চন্দ্রদ্বীপের আকৃতি মণ্ডলাকার। এর পরিধি সহস্র যোজন পরিমিত স্থান জুড়ে রয়েছে। স্থানটির বিস্তার দশ যোজন এবং উচ্চতা শত যোজন। দ্বীপটি নানাবিধ পুষ্প ফুলে শোভিত ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ। সিদ্ধচারণ সেবিত এমন একটি শ্রেষ্ঠ পর্বত এখানে আছে, যার প্রভা ও কান্তি যথাক্রমে ‘চন্দ্র এবং কুমুদের সঙ্গে তুলনীয়।
এই পর্বত শ্বেতমণি বৈদূর্য্যমণি ও কুমুদে চিত্রিত। বহু চন্দ্রলক্ষণে সুসম্পন্ন। এবং বহু বিচিত্র উদ্যান অনেক নিঝর বিস্তৃত সানুদেশ, গুহা ও বিবিধ কুঞ্জে অলংকৃত। এই সিদ্ধসেবিত পর্বত থেকে কেটি উত্তমগুণ সম্পন্ন পবিত্র সলিলা নদী নির্গত হয়েছে। নদীটির নাম চন্দ্রবর্তা। এই তরঙ্গিনী নদীটির জল চন্দ্রের কিরণের মতো নির্মল। এরই অনতিদূরে নক্ষত্র অধিপতি চন্দ্রের নিবাসস্থল। এখানে গ্রহনায়ক চন্দ্র সর্বদা অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। দ্যুতিমান, চন্দ্রের নামেই পর্বতটি ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামে বিখ্যাত। স্বর্গ মর্তে এই চন্দ্রদ্বীপ তাই মহাদ্বীপ বলে বিখ্যাত। যেখানে যে সমস্ত, প্রজারা বাস করেন, গুণগত দিক দিয়ে তারা সকলেই চন্দ্রের তুল্য। প্রত্যেকেরই পূর্ণ চন্দ্রের মতো মুখ, নির্মল মন এবং আচরণে শুদ্ধচার প্রকাশ পায়। চন্দ্রদেব স্বয়ং তাঁদের অধিদেবতা। তার কারণেই চন্দ্রদ্বীপবাসীগণ অত্যন্ত ধার্মিক, সৌম্য, সত্যসন্ধ, তেজস্বী ও সদাচারী হন। এদের আয়ুষ্কাল দশ শতবর্ষ।
পশ্চিমদ্বীপের পশ্চিমদিকে চারি সহস্র যোজন আয়তন বিশিষ্ট একটি সমুদ্র আছে। তার অপর পারে নানাবিধ পুষ্পে শোভিত মণ্ডলাকার এক দ্বীপ আছে। নাম ভদ্রাকর। এর পরিধি দশ সহস্র যোজন। এই দ্বীপ প্রভূত পরিমাণ ধনধান্যে সমৃদ্ধ এবং অনেক নৃপতি কর্তৃক প্রতিপালিত। এই দ্বীপ নিত্য-আনন্দিত পর্বতরাজিতে স্ফীত সজ্জিত। বায়ুদেবতার নানা রত্নখচিত এক ভবন এই দ্বীপের মহিমা বর্ধিত করেছে। এই মন্দিরভবনে বিগ্রহবান বায়ুদেবতা সমস্ত পূর্বেই পূজিত হয়ে থাকেন। এই দ্বীপবাসী বৃন্দের অধিদেবতা হলেন স্বয়ং বায়ু। অধিবাসীরা সকলেই তপ্তকাঞ্চন বর্ণের অধিকারী। এই দ্বীপে যে সকল মহাভাগ্য প্রজারা বাস করেন তারা প্রত্যেকেই কনভূষণে সজ্জিত। বিচিত্র বস্ত্রমাল্যধারী বীর্যবান, সদানন্দ এবং সত্যসন্ধ, এঁদের কোনো দুঃখ ভোগ করতে হয় না। এঁদের আয়ুষ্কাল পঞ্চশত বৎসর।
ধীমান সূতপূত্রের কথকতা সমাপ্ত হলে নৈমিয় অরণ্যবাসী সেইসব ব্রহ্মবাদী ঋষিরা আরও কিছু শুনবার অভিলাসে সূতপূত্রের কাছ তাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন।
তাদের জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তরে সূত বললেন; হে ঋষিবৃন্দ, ভারত যুগে পরম তত্ত্বজ্ঞ ঋষিরা এই ভাবেই বৰ্ষসমূহের নৈসর্গিক অবস্থা দেখে ছিলেন, এবার আমি আপনাদের কাছে তার কি বর্ণনা করব?
ঋষিরা অনুরোধ করলেন, হে প্রাজ্ঞবর, যে বর্ষে স্বায়ম্ভবী প্রভৃতি চতুর্দশ মন প্রজাদের সৃষ্টি করেছিলেন, সেই ভারবর্ষের কথা আমরা জানতে ইচ্ছা করি, হে সত্তম, আপনি সেই বিষয়ে আমাদের কিছু বলুন।
এই কথা শুনে সূতপুত্ৰ পুরাণজ্ঞ লোমহর্ষণ সমহিত হয়ে বিশুদ্ধ আত্মা সেই ঋষিবৃন্দের উদ্দেশ্যে বিস্তারিত ভাবে আবার বলতে লাগলেন, হে ঋষ্যিগণ এর আগে আমি কুরুবর্ষের নৈসর্গিক অবস্থার কথা আপনাদের কাছে যথাযথভাবে বর্ণনা করেছি। এমন ভারতবর্ষের বিষয়ে বিস্তারিত বলছি শুনুন। পুণ্যতীর্থ হিমালয়ের দক্ষিণদিকে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত যেসব জনপদ আছে, প্রথমেই আমি তাদের বিস্তৃত বিবরণ দিচ্ছি।
হিমালয়ের দক্ষিণে এবং সমুদ্রের উত্তরে এই ভারতবর্ষ বিরাজমান। শুভাশুভ ফলোদয় এই ভারতবর্ষ মধ্যমবর্ষ নামেও ততোধিক পরিচিত। এখানকার প্রজারা “ভারতী” নামে প্রসিদ্ধ প্রজাদের ভরণ করতেন বলে, মনুকে ভরত বলা হয়। অতএব, ভরত মনু কর্তৃক প্রতিপালিত বলেই এই বর্ষ ভারতবর্ষ নামে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। মনে রাখবেন, এই ভারতবর্ষ ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোথাও কর্মানুসারে স্বর্গ, মোক্ষ এবং মধ্যম এই তিন প্রকার ফল লাভ করা যায় না।
ভারতবর্ষকে নয়টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগ পরস্পরের থেকে সুস্পষ্ট ব্যবধানে অবস্থিত। এর ফলে এর এক ভাগ থেকে অন্যভাগে যাওয়া কষ্টসাধ্য তো বটেই এ দুঃসাধ্য। নয়ভাগে বিভক্ত এই দেশগুলি হল– ইন্দ্রদীপ, কসেরুসান, তাম্রপাদি, গভস্তিমান, নাগদ্বীপ, গান্দভ, সৌম্য, বারুণ এবং ভারত। নবম এই দ্বিপটি সাগরবেষ্টিত। এর উত্তর-দক্ষিণে বিস্তার হল সহস্র যোজন, কুমারিকা, থেকে গউনা পর্যন্ত এর দৈঘ্য। এই নবম দীপটি উত্তরদিকে সামান্য বক্রভাবে অবস্থান করছে। নবম দ্বীপটির এক একটি প্রান্তে এক একটি জাতি বাস করেন। এই দ্বীপের অন্তভাগে বাস করেন ম্লেচ্ছ প্রজাতির লোকেরা। পূর্ব প্রান্তে বাস করেন কিরাতেরা, পশ্চিম প্রান্তে যবনরা। এর মধ্যভাগে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রের সমাবেশ ঘটে গেছে। এঁরা যথাক্রমে যজ্ঞ, আরাধনা, যুদ্ধ, বাণিজ্য ও পরিচর্যাকে জীবিকা হিসাবে গহণ করেছেন, যদিও এঁদের নিজেদের মধ্যে যথাসম্ভব পারস্পরিক সামাজিক ব্যবহারও সুপ্রচলিত আছে। এই ব্রাহ্মণাদি চারটি বর্ণ–অপবর্গ লাভের নিমিও যথাবিধি সংকল্পপূর্বক নিজের নিজের ধর্মানুষ্ঠানে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ্ম–এই চতুবর্গ লাভ করে থাকেন।
ভারতবর্ষের এই নটি খণ্ড সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, যিনি এই বক্ৰায়তনশীল নবম দ্বীপমাণ্ডকে অধিকার করতে পারবেন, ভূলোলাকে তিনিই সম্রাট বলে কীর্তিত হবেন; এই ভাবে তিনি এ মর্ত্যলোকে সম্রাট আন্তরিক্ষলোকে বিরাট এবং অন্য কোনো উচ্চ লোকে স্বরাট বলে অভিহিত হয়ে থাকেন।
এ হল ভারত দ্বীপের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা। হে দ্বিজবৃন্দ এবার আমি বিস্তারিতভাবে আবার নতুন করে ভারতবর্ষ সম্পর্কে বলব। এই ভারত ভূখণ্ডে মহেন্দ্র, মলয়, শক্তিমান, ঋক্ষ, বিন্ধ্যা, পরিপাত্র প্রভৃতি সাতটি প্রধান কুলপর্বত আছে। এই প্রধান কুলপর্বতগুলির সন্নিকটে আরও সহস্র সহস্র অভিজাত; সর্বগুণশালী, বিপুল বিচিত্রমান পর্বত আছে। যেমন-পর্বত শ্রেষ্ঠ মৈনাক, বৈভার, মন্দর, দর্দুর, কোলাহল, সুরস, বৈদ্যুৎ, বাতন্ধম, পাণ্ডুর, গৌধন, গণ্ডপ্রস্থ, কৃষ্ণপর্বত পুষ্পগিরি, উজয়ন্ত, রৈবতক, শ্ৰী, কারু ও কুটশৈল প্রভৃতি এছাড়াও আরও অনেক স্বল্ডজীবী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্বত আছে। এই পর্বত সমাকীর্ণ স্থানগুলিতে আর্য ও ম্লেচ্ছ জাতির লোকেরা নিয়মিত ভাবে সহাবস্থান করেন।
এই পর্বতময় দেশগুলিতে যেসব নদী প্রবাহিত হচ্ছে, তারা সবাই হিমালয়ের পাদনি ঋঃসৃত। আর্য ও ম্লেচ্ছ জাতির লোকেরা এই নদীগুলির জলই পান করেন। গউনা, সিন্ধু, সরস্বতী, গোমতী, শতদ্রু, চন্দ্রভাগা, যমুনা, সরযূ, ইরাবতী, বিতস্তা, কুহুত, বাহুগ, বিপাশা, দেবিকা, তৃতীয়া, ধূতপাপা, দৃষদ্বভী, কৌশকী, নিশাচারী, গণ্ডকী, ইক্ষু ও লোহিত।
এই নদীগুলি ছাড়াও পরিপাত্র পর্বত থেকে নিঃসৃত নদীর জলও অধিবাসীরা ব্যবহার করেন, পরিপাত্র পাদনিঃসৃত নদীগুলি হল–বেদস্মৃতি, বেদবতী, বৃত্রঘী, সিন্ধু, বর্ণাশা, চন্দনা, সদানীরা, মহী পরা, চমতী, বিদিশা, রেবতী, শিপ্রা, অবন্তী প্রভৃতি এভাবে ঋক্ষ পর্বতের পাদনিঃসৃত নদীগুলি হল–শেন, মহানদী, নর্মদা, সূবহা, দ্রুমা, মন্দাকিনী, দসার্ণা, চিত্রকূট, তমসা, পিম্পলা, শ্রোণী, করতোয়া, পিশঅচিকা, নীলোৎপলা, বিপাশা, জম্বুলা, বালুবাহিনী সিতেরজা, ভক্তিমতী মক্ষণতন, ত্রিদিবা প্রভৃতি।
বিন্ধ্য পর্বত থেকেও কিছু পূত জলবাহী নদীর উদ্ভব ঘটেছে। সেগুলি হল–পয়েষ্ণী, নির্বিন্ধ্যা, মদ্রা, নিথিধা, বেন্থা, তাপী, বৈতরণী, শিতিবাহু কুমুদ্বতী, তোষ, মহাগৌরী, দুর্গা, অন্তঃশিলা ইত্যাদি। আবার গোদাবরী, ভীমরথী, কৃষতা, বৈণী, তুঙ্গভদ্রা, সুপ্রয়োনা কাবেরী,–এই নদীগুলি সহ্য পর্বতের পাদদেশ থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণাপথের পথে চলে গেছে। মলয় পর্বতের নদীগুলিও মঙ্গলকর এবং হিমজলবাহী, মহেন্দ্র পর্বত থেকে জন্ম হয়েছে ঋষিকুল্যা, ত্ৰিসামা, ইহ্লা, ত্রিদিবা, লাঙ্গুলিনী ও বংশধারা নদীর। শব্দিমাল পর্বত থেকে জন্ম ঋষিকা ও পলাশিনী নদীর।
নবম দ্বীপমণ্ডকে বিধৌত করে বয়ে চলা এই সমস্ত নদীই কিন্তু গঊনার মতো স্বচ্ছসলিলা, সমুদ্রগামিনী, মাতৃস্বরূপিণী ও পাপশিলী, এইসব নদীর আবার একাধিক উপনদী আছে। সংখ্যার বিচারে তাদের মোট সংখ্যা শত সহস্রের অধিক।
এইসব বড়ো বড়ো স্রোতস্বতা নদীর ধারে ধারে বেশ কয়েকটি মধ্যদেশীয় জনপদ গড়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে কুরু, পাঞ্চাল, শ, জাঙ্গল, শূরসেন ভদ্রাকার, বেবি, বৎস্য, শতপথে শ্বর, কুসস্ত, কুল্য, কুন্তল, কাশী, কেশেল, কলিঙ্গ প্রথম, মগধ ও বৃক উল্লেখযোগ্য।
গোদাবরী নদী সহ্য পর্বতের উত্তরপ্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এখানে গড়ে উঠেছে সারা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ, মনোরম একটি প্রদেশের। তার নাম গোবর্ধন, পুরাকালে বিষ্ণু অবতার সীতাপতি রামচন্দ্র এটি নির্মাণ করেছিলেন। পরে রামচন্দ্রের প্রতি প্রীতিবশত, তাঁর সুখানুভবের জন্য ভরদ্বাজ মুনি বৃক্ষ ওষধি প্রভৃতি দিয়ে এই প্রদেশস্থিত এক উদ্যানময় স্বর্গ রচনা করেছিলেন।
বাহ্লীক, বাঘধান, আধার, কালতোষক, শুদ্র পল্লব, অপরীত, চর্মমণ্ডিক, গান্ধার, যবন, সিন্ধু, সৌবীর, মদ্রক, শক, হূণ, কুলিন্দ পারদ, হারহুণ, রমন, কেকয়, রূদ্ধককট ও দশমালিক–এইসব দেশগুলিতে ক্ষত্রিয়দের উপনিবেশ গড়ে উঠেছে, তবে এখানে বৈশ্য ও শূদ্রদেরও বসবাস আছে।
ভারতবর্ষের চারিটি দিকে কত শত শ্রেষ্ঠ দেশ আছে, এবার আমি তাদের নামোল্লেখ করছি। কম্বোজ, কাশ্মীর, দরদ, বর্বর, চান, তুষার, অঙ্গল্যেকিক, পল্লব, ক্ষতোদর, আত্রেয়, ভরদুর্তি প্রস্থল, কসেরুক, লম্বাক, স্তনপ, পীদিক, জুহড়, অপগ, অলিমদ্র, কিরাতজাতি, তোমর হংসমাগ, অঙ্গন, চুলিক, আহুক, উৰ্ণা, দেব ভারতের উত্তরদিকে অবস্থিত পাণ্ড্য, কেরল চৌল্য, কুল্য, কেসতুক, মূষিক, কুনাস, বনবাসক, মহারাষ্ট্র, মহিষত, বর, পুলিন্দ, ঐষীক, আষ্ট্য কলিঙ্গ, আভীর, বিন্ধ্যমূকি, বৈদর্ভ, দণ্ডক, সৌনিক, মৌলিক, অশমাষ, ভোগবর্ধন, মৈন্দিক, কুন্তল, অন্ধ্র, উদ্ভিদ ও নলকলিক– এগুলিকে নিয়ে ভারতবর্ষের দক্ষিণাত্যের জনপদ গড়ে উঠেছে, এবার পূর্বদিকে যেসব দেশ আছে। তাদের নাম বলছি শুনুন–প্রাগর্জোতিষ, পৌন্ড্র, বিদেহ, অন্ধ্রবার্ক, গোনান্দ, আন্তগিরি, সুজরক, বঙ্গ, প্রবঙ্গ, মন্দ, মালবর্ণিক, ভার্গব, ব্রহ্মোত্তর প্রবিজয়, তাম্রলিপ্তক, মাল, মগধ ইত্যাদি। সবশেষে পাশ্চাত্য জনপদগুলির বিষয়ে শুনুন–কোলবন, দুর্গ, তালিকট, তাপস, তুরসিত, পুলেয়, সুরাল, সুশরিক ও রূপস, এছাড়াও নর্মদা নদীর তীরবর্তী জনপদগুলিও ভারত ভূখণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশে এই সবদেশ সম্পরীত নামে পরিচিত। নর্মদা নদীর তটস্থিত, এরকম কয়েকটি সম্পূরিত জনপদ হল–কচ্ছীয়, আনর্ত, অকূদ, ভারু কচ্ছ, নাসিক্যাদি দেশ, শ্বাশত, সমাহেয়, সুরাষ্ট্র প্রভৃতি, হে ঋত্বিগণ এবার বিন্ধ্য পর্বতের পার্বত্য সানুদেশে উদ্ভূত দেশগুলির কথা শুনুন–অনুশ, উৎকল, উত্তম, অবন্তি, কোশল, কিস্কিন্ধক, করুষ, মলিব, মেকল, দশর্ণ, গোসল, ত্রৈপুর, তুম্বর, বৈদিশ, তুক, ষাটসূর, নিষেধ, তুণ্ডিনের, ভোজ, জীতিহোত্র।
এই উপরিলিখিত দেশগুলি বিন্ধ্যাচলে অবস্থিত, সবশেষে পর্বতশ্রিত দেশগুলির কথা বলে ভারতবর্ষের দেশ সমূহের কথা সমাপ্ত করব। এই পর্বশ্রিত দেশের মধ্যে কুপথ, খস, কিরাত, বর্ণ প্রবারণ, তঙ্গন, তামস, দব নিগহর, ত্রিগত, বহুদবত, মালব, হূণ, হংসমার্গ উল্লেখযোগ্য।
এবার আমরা ভারত সম্পর্কিত পরবর্তী আলোচনা আরম্ভ করছি। ভারতবর্ষের চারিটি যুগ, যথা–সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। আমি এখন পর পর এদের কথা বলছি, শুহন এই কথা শুনে মৈমিষারাণ্যবাসী ঋষিরা সেইসব বিষয়েও আরও কিছু শোনবার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তারা লোমহর্ষনকে বললেন, আপনি ভারতবর্ষের প্রকৃতি ও অবস্থান সম্পর্কে যেমন মহাতত্ত্বহ বিবৃতি দিলেন, অনুরূপভাবে কিম্পুরার বর্ষ ও হরিবর্ষ বিষয়েও তথ্য প্রদান করুন।
ঋষিগণ এইভাবে জিজ্ঞাসা করায় মহাতা সূত ওইসব দ্বিজবৃন্দ দ্বারা নির্দিষ্ট প্রশ্নানুসারে পুরাণ সম্পর্কে আরও বহু জ্ঞানগর্ভ তথ্যালোচনা করতে লাগলেন, সূত বললেন, আপনাদের যে বিষয়ে শুনবার ইচ্ছা হয়েছে, সে বিষয়ে আনন্দের সাথে শুনুন।
কিশুরুষ বর্ষের অধিবাসীরা জন্মমাত্রই অপ্তকাঞ্চন প্রভার অধিকারী হতেন। এরা সকলেই বিশুদ্ধ চিত্ত ও রোগশোকহীন কিম্পুরূষ বর্ষে নন্দনবনের মতো এক বিশাল প্লক্ষ বন ছিল, এই বনের পূর্ণপ্রদ প্লক্ষ বৃক্ষি একপ্রকার অমৃততুল্য মধু বহন করত। কিশুরুষ নাগরিকরা সেই বৃক্ষফলের উত্তম রস পান করে জীবনধারণ করতেন। তারা সাধারণ নিয়মেই সহস্র বৎসর আয়ুভোগ করতেন। তাদের বর্ণ ছিল সুবর্ণের মতো বিশেষ করে রমণীরা অপসার মতো মোহময় রূপের অধিকারিণী ছিলেন। কিম্পুরুষ বর্ষের পর হরিবর্ষের কথা বলছি; হরিবর্ষে যেসব মানুষ জনমান, তাঁরা সকলেই দেবরাশ কান্তার অধিকারী এবং দেবলোকচ্যুত। জীবনধারণের জন্য এরা সবাই ঈক্ষুরস পাণ করতেন, জরা কোনোদিন এঁদের গ্রাস করত না, তাই এঁদের কোনোদিন জরাজীর্ণ হতে হয়নি। এরা সানন্দে স্থির যৌবনবস্থায় একাদশ সহস্র বৎসর বেঁচে থাকতেন, হরিবর্ষে জন্মপ্রান্ত দেবলোকচ্যুত মানুষের। সকলেই মহারজত প্রভার অধিকারী ছিলেন।
এর আগে ইলাবৃত বর্ষ নামে মধ্যবর্তী একটি বর্ষ সম্পর্কে আপনাদেরকে বলেছি, ইলাবৃত। বর্ষে সূর্যের তাপ ছিল না। মানুষেরা জীর্ণ হতেন না। সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্ররাজি-সব সময় অপ্রকাশিত হয়ে থাকত। ইলাবৃত বর্ষের অধিবাসীরা পদ্মবর্ণ ও পদ্মপ্রভাবিশিষ্ট ছিলেন। এঁদের চোখ ছিল ঠিক যেন পদ্মপত্রের মতো। এঁরা জন্মাতেনও পদ্মপত্রের সুগন্ধ নিয়ে, কমলসৌরভ এইসব মানুষেরা জম্বুফলের রস আহার হিসাবে গ্রহণ করতেন এঁরা ছিলেন মনস্বী। প্রধানত দেবলোক বিচ্যুত হয়েই তাঁরা এই বর্ষে জন্মান; অজর ও অমর এইসব মানুষেরা তাই পুরো আয়ুষ্কাল ধরে ভোগ্যবস, তু এবং সকর্মের ফল ভোগ করতেন। এই বর্ষের মানুষে ত্রয়োদশ সহস্র বৎসর আয়ুষ্কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতেন। ইলাকৃত বর্ষটি মেরুর চারিপাশে নয় হাজার পরিমাণ স্থান জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। এই বর্ষের সামগ্রিক বিস্তার ছত্রিশ হাজার যোজন, এর আকৃতি চতুষ্কোণ এক শরাবের মতো। মেরুর পশ্চিম দিকে যে ইলাবৃত বর্ষের নয় হাজার যোজন স্থান আছে, সেখানে প্রায় চৌত্রিশ হাজার যোজন স্থান জুড়ে গন্ধমাদন পর্বত আছে। এই পর্বতের উত্তর দক্ষিণের বিস্তার নীল থেকে সিন্ধাচল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পর্বত ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে চল্লিশ সহস্র যোজন উচ্চ। এর মধ্যে হাজার যোজন পৃথিবীর মধ্যে রয়েছে। এবং পর্বতটির বিস্তার দুই হাজার যোজন,
মেরুর পূর্বভাগেও গন্ধমাদনের মতো দীর্ঘ মাল্যবান নামক পর্বত আছে। এর অবস্থান নীল শৈলের দক্ষিণে এবং নিষধ শৈলের উত্তরে। এইসব শৈলসমূহের মধ্যে অতি উচ্চ মহামেরু বিরাজমান। এই পর্বতের ভূগর্ভস্থ অংশে পরিমাণ অন্যান্য পর্বতের মতো এবং এর দৈর্ঘ্য বরাবর বিস্তৃত প্রায় নিয়ুত দশ হাজার যোজন। মনে করা হয় সমুদ্র ও পথিবী মণ্ডলাকার হওয়ায় পাশ্ববর্তী চতুষ্কোণ পর্বতগুলো দৈর্ঘ্যহীন হয়ে পড়েছে।
ইলাবৃত বর্ষকে চারিদিক দিয়ে বেষ্টন করে এর মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কম্বুরসবাহিনী একটি নদী। এই নদীর জল গুটিভাউ। কাজলের মতো কৃষ্ণবর্ণ, মেরুর দক্ষিণ ভাগে এবং নিষধ শৈলের উত্তর দিকে এক বিশাল সনাতন জম্বুবৃক্ষ আছে, বৃক্ষটির নাম সুদর্শন। সিদ্ধচারণ সেবিত এই বৃক্ষটি নিত্য পুষ্পেফলে পরিপূর্ণ থাকে। এই জম্বুবৃক্ষের নাম অনুসারেই এই দ্বীপ জম্বুদ্বীপ নামে পরিচিত লাভ করেছে। সবদিক থেকেই এই বৃক্ষরাজের উচ্চতা স্বর্গস্পর্শী বলেই তত্ত্বদশী ঋষিরা নির্ণয় করেছেন, এই মহামের পরিমাণ শত সহস্র যোজন। আর কেবল এর ফলের পরিমাণই আট শত একষট্টি অরতিন। এই জম্বুফল যখন মাটিতে পড়ে তখন, ভয়ংকর শব্দে পৃথিবী কেঁপে ওঠে। সেই পরিপক্ক-জম্বুফলের রস নদীরূপে প্রবাহিত হয়ে মেরুকে প্রদক্ষিণ করে আবার জম্বুবৃক্ষের নীচে প্রবেশ করেছে। জম্বুদ্বীপের অধিবাসীর সেই নদীর জল পান করেন বলে কোনোদিন জরাগ্রস্ত হন না। তারা সদানন্দ লাভ করেন, এই দ্বীপবাসীদের চক্ষুর ক্লান্তি নেই, নেই কোনো মৃত্যুভয়ও।
এই নদীতীরে জাম্বুনদ নামে একপ্রকার সুবর্ণ পাওয়া যায়। এটি দেখতে ইন্দ্রগোপ কীটের মতো ভাস্বর। এ দ্বারা দেবতাদের ভূষণ প্রস্তুত হয়। বলা হয়ে থাকে সমস্ত বর্ষের বৃক্ষরসি অপেক্ষা এই জম্বুদ্বীপের জম্বুফলের রস কল্যাণ। এই রস শুষ্ক ও শুভ্র হয়ে দেবতাদের ভূষণোপযোগী সুবর্ণে পরিবর্তিত হয়। এই জম্বুদ্বীপের অধিবাসীদের মলমূত্র নানা দিকে বিক্ষিপ্ত হলেও ঈশ্বরের অনুগ্রহে ভূমি সেসব গ্রাস করে থাকে।
পবিত্র হিমালয় শৃঙ্গে সমস্ত রাক্ষস, পিশাচ ও যক্ষেরা এবং হেমকূট শৃঙ্গে গন্ধগণ বাস করে থাকেন। নিষধ পর্বতে শেষ, বাসুকি, তক্ষক প্রভৃতি নাগজাতি এবং মহামেরুতে তেত্রিশ জন যজ্ঞিক দেবতা বাস করে থাকেন। বৈদূৰ্য্যমণ্ডিত নীলাচল শৃঙ্গে শ্রেষ্ঠ সিদ্ধ ও ব্রহ্মবাদী ঋষিদের বসবাস, শ্বেত শৈলে দৈত্যদানবদের বসবাস, পর্বতশ্রেষ্ঠ শৃঙ্গবান পিতৃগণের বিচরণ স্থান রূপে প্রসিদ্ধ। বিভিন্ন ভাগে–অবস্থিত এই ন’টি বর্ষে বহু স্থাবর ও গমনশীল প্রাণী বাস করে থাকেন। এখানে যেসব মানুষ ও দেবতারা বসবাস করেন তাদের বহুল বৃদ্ধি দৃষ্টিগোচর হয়, যদি কেউ শ্রদ্ধার সাথেও এঁনাদের সংখ্যা নিরুপণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তবুও তার পক্ষে কোনোমতেই তা সম্ভব নয়।
ব্রহ্মবাদী সূত আবার বলতে শুরু করলেন, হিমালয় পর্বতের বামদিকে কৈলাস নামে এক পবিত্র পর্বত আছে, সেখানে রাক্ষস আর অপ্সরাদের সাথে শ্রীমান ধনপতি কুবের স্বয়ং বাস করেন। কৈলাস পাদ থেকে নিঃসৃত শারদ মেঘকান্তি শীতল মঙ্গলকর পুণ্যজনক ও কুসুমপূর্ণ এক দিব্য সরোবর এখানে আছে। এই সরোবর থেকে দেবানুগ্রহপ্রাপ্ত শুভ মন্দাকিনী স্রোতস্বিনী উৎপন্ন হয়েছে। এই নদীর তীর বরাবর এক বিশাল আনন্দজনক বন আছে।
এছাড়া কৈলাস পর্বতের উত্তর-পূর্বকোণে দিব্যঔষধিযুক্ত হেমরত্নময় বিধিত ধাতুচিত্রিত এবং শুভ্রবর্ণ রত্নতুল্য পর্বত আছে, পর্বতটির নাম চন্দ্রপ্রভ। এর পাদদেশেই অচ্ছেদ নামে এক বিশাল ও দিব্য সরোবর আছে। এর থেকে অচ্চেদা নামে নদী উৎপন্ন হয়েছে। এই নদীর তীরে চৈত্ররথ নামে এক দিব্য কানন গড়ে উঠেছে। পূর্বে উক্ত মন্দাকিনী এবং এই অচ্ছোদা নদী সংলগ্ন ভূমমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মহাসাগরে প্রবেশ করেছে। এছাড়া এই চন্দ্ৰপ্ৰভ পর্বতে কক্ষ সেনাপতি মণিভদ্র তার একান্ত অনুগ ক্রর গুহ্যকদের সাথে বাস করেন।
কৈলাস পর্বতের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মলঃশিলাময় এক দিব্য পর্বত আছে; নাম পিশজি পর্বত। এই পর্বত নানা মঙ্গলকর প্রাণী ও ঔষধিতে পরিপূর্ণ। ওই পর্বতের পাশে লোহিত নামে সূর্যতুল্য স্বর্ণ শৃঙ্গ বিশিষ্ট এক বিশাল পর্বত আছে। ওই পর্বতের পাশে লোহিত নামেই এক বিশাল দিব্য সরোবর আছে। সেই সরোবরের বরফগলা জল থেকে লৌহিত্য নামে এক পবিত্র মহান সৃষ্টি হয়েছে। এই লৌহিত্য নদীর তীরভূমিতে রোগশোকদিবর্জিত এক বৃহ্য দেববন আছে; এখানে পূর্বোক্ত চন্দ্ৰপ্ৰাৎ পর্বতের সংযজেন্দ্রিয় এক যক্ষ তার অনুগত সৌম্য ও সুধামিক গুহ্যকগণের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে বাস করেন।
কৈলাস পর্বতের দক্ষিণ দিকে বিবিধ ঔষধি লতায় সমাকুল ত্রিশৃঙ্গবিশিষ্ট অঞ্চল নামে এক পর্বত আছে। পর্বতটি বৃত্রকাঅজুরী থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই পর্বতে নানা ত্রুর স্বভাবের প্রাণী আছে। ওই পর্বতের সন্নিকটে বৈদ্যুৎ নামে আরও একটি সর্বধাতুময় বিশলি পর্বত আছে। মানস নামে সিন্ধুসেবিত এক দিব্য সরোবর এর পাদদেশে আছে, এই মানস সরোবর থেকে উদ্ভূত হয়েছে, লোকপাঠনী পুণ্যসলিলা সরযু নদী। সরযুর তীরে বৈভ্রাজ নামে এক প্রসিদ্ধ বন আছে। সেখানে ব্রহ্মপাত নামে এক অমিতবিক্ৰম রাক্ষস তার অন্তরিক্ষচারী শত শত ভয়ংকর রাক্ষসদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে বাস করেন। ব্রহ্মপাত শ্রেষ্ঠ কুবের অনুচর; প্রহেতুতনয় ও বশেন্দিয় রাক্ষস।
কৈলাস গিরিশিখরের পশ্চিমদিকে পৃথিবীর সকল প্রধান প্রধান প্রাণী ও ঔষধিলতাকীর্ণ সুবর্ণ ধাতুময় অরুণ নামে পর্বত অবস্থান করছে। এর পাশেই মেঘাকৃতি অপর একটি সুদৃশ্য পর্বত আছে। পর্বতটির নাম মুঞ্জবান। এর সুবর্ণমণ্ডিত সুউচ্চ শীর্ষদেশ শুভ্র বর্ণের শিলাজালে সমাবৃত্ত পর্বতটি এতই উন্নত যে মনে হয় যেন স্বর্ণময় শত শৃঙ্গ দিয়ে স্বর্গকে স্পর্শ করতে চাইছে, পর্বতটি হিমাস্নগ্ধ, দেখে মনে হয় ঠিক যেন মহাদিব্য দুর্গশৈল, নীললোহিত গিরিশ এই পর্বতে বাস করেন, শৈলোদ নামে এক পুণ্য সরোবর তার চরণ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, আর সেই সরোবর থেকে শৈলেদা নদী চক্ষু ও সীতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লবণ সমুদ্রে প্রবেশ করেছে। শৈলেদা নদীর তীরে সুরভি নামে এক প্রসিদ্ধ দিব্য বন আছে।
কৈলাস শৈলচূড়ার উত্তর দিকে নানা মঙ্গলকর প্রাণী ও জীবনদায়ী ঔষধিতে পরিপূর্ণ হরিতালম্ব এক শুভদা পর্বত আছে। গৌর নামে সেই পর্বতটি সুবর্ণ শৃঙ্গ বিশিষ্ট সুবিশাল, দিব্য ও মণিময়। এই গৌর পর্বতের পাদদেশে বিন্দু নামে এক রমণীয় সরোবর আছে। সরোবরটির আয়তন চোখে মাপা যায় না। সরোবরটি যেমন শুভ তেমন কাঞ্চন বালুকাময়। এই বিন্দু সরোবরের তীরে রাজর্ষি ভগীরথ গঙ্গার আরাধনা করবার জন্য বহু বৎসর বাস করেছিলেন। তিনি সংকল্প করেছিলেন যতদিন না তার পূর্বপুরুষেরা গঙ্গাজলে পবিত্র হয়ে স্বর্গে যাবেন ততদিন তিনি ওই স্থান ত্যাগ করবেন না। এই স্থানের মহিমা বলে শেষ করা যাবে না। প্রথমতঃ এখানেই চন্দ্রমণ্ডল হতে উদ্ভবা ত্রিপথগামিনী দেবী ভাগীরথী প্রথম প্রতিষ্ঠিত হন এবং সপ্তভাগে বিখ্যাত হন। দ্বিতীয়তঃ এখানেই বহু মণিময় যজ্ঞীয় যুপ ও হিরন্ময় দেবী বিদ্যমান। সর্বোপরি দেবরাজ ইন্দ্র’ এখানেই অন্যান্য দেবতাদের সাথে যজ্ঞ করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
এখানে ত্রিপথগামিনী গঙ্গা সম্পর্কে ক’টি কথা আপনাদের বলব, রাত্রিকালে আকাশপৃষ্ঠে নক্ষত্রমণ্ডলের পিছনে যে ভাস্বর বর্ণ ছায়াপথ দেখা যায়, সেই ছায়াপথই হল ত্রিপথগামিনী গঙ্গা। ঐ গঙ্গাদেবী যখন আন্তরিক্ষলোক ও স্বর্গলোক প্লাবিত করে পৃথিবীতে আসতে উদ্যত হলেন, তখন তীব্র বেগসহ মহাদেবের মস্তকে পতিত হয়ে যোগমায়ায় অবরুদ্ধ হন। এই অবস্থায় বেগবতী গঙ্গা সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে কিছু কিছু জলবিন্দু পৃথিবীতে এসে পড়ে। এইসব উৎক্ষিপ্ত জলবিন্দু সংযোজিত হয়েই সৃষ্টি হয়েছে বলেই গৌর পর্বতের পাদভূমিস্থিত এই সরোবরটি বিন্দু সরোবর নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
এদিকে তরঙ্গিনী গঙ্গাকে গর্বিত মহাদেব বেশ সহজেই তাঁর জটাজালে আবদ্ধ করলেন। রুদ্ধ গঙ্গাদেবী মহাদেবকে বিক্ষিপ্ত করার জন্য মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি ঠিক করলেন, আমি প্রথমে স্রোতের বাহুল্যে শংকরকে আলোড়িত করব। এবং তারপর পৃথিবী ভেদ করে পাতালে প্রবেশ করব, কিন্তু সর্বজ্ঞ ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, দেবাদিদেব মহাদেব গঙ্গাদেবীর এহেন অভিপ্রায়ের কথা জানতে পারলেন।
তাই তিনিও দেবীর ক্রর অভিসন্ধি ব্যর্থ করার জন্য গঙ্গা নদীকে স্বীয় অঙ্গে বিলুপ্ত করলেন বলে সংকল্প করলেন। বিপুল জলরাশির তুমুল স্রোতের বিষয়ে গঙ্গাদেবীর অহংকারের কথা জানতে পেরে রুদ্রদেব রোষমুক্ত হলেন, সবেগে পৃথিবীতে পতনোন্মুখ গঙ্গানদীকে মস্তকে অবরুদ্ধ করে রাখলেন, এই সময়ে মহাদেব তাঁর সামনে ধমনীব্যস্ত ক্ষীণ ক্ষুধাব্যাকুল দুর্বল ইন্দ্রিয় রাজা ভগীরথকে দেখতে পেলেন। তিনি ভগীরথকে দেখামাত্র স্মরণ করতে পারলেন–এই রাজা পূর্বেও গঙ্গার মর্ত্য অবতরণের জন্য তপস্যার মাধ্যমে আমাকে প্রীত করেছিলেন এবং আমিও বরদান করেছিলাম। মহাদেব যদিও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে গঙ্গাদেবীকে চিরদিন নিজের মস্তকে ধারণ করে রাখবেন কিন্তু ব্রহ্মার বচন শুনে এবং অনেকাংশে ভগীরথের উগ্র তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তিনি নিজের ক্রোধ সংবরণ করলেন, এবং নিরূদ্ধ গঙ্গাকে নিজ তেজে বিসর্জন দিলেন।
এইভাবে বিসর্জিত হয়ে গঙ্গার সেই সুতীব্র স্রোত সাত ভাগে বিভক্ত হল। নলিনী, হৃদিনী এবং পাবনী নামে এই তিনটি স্রোত পূর্বদিকে এবং সীতা, চক্ষু ও সিন্ধু নামে এই তিনটি স্রোত পশ্চিম দিক অভিমুখে প্রবাহিত হল। আর ভগীরথী নামে সপ্তম স্রোতটিকে স্বক্ত মহাত্মা ভগীরথ দক্ষিণ দিকে নিয়ে এলেন; এইভাবে সপ্তধারা বিভক্ত গঙ্গানদী লবণসাগরে প্রবিষ্ট হলেন। এই হিমবর্ষ উল্লিখিত সাতটি ধারার দ্বারা প্লাবিত হয়েছে।
যদিও ইন্দ্রদেব যথাকালে সমস্ত দেশ বর্ষণ করে থাকেন তাও কিন্তু সরোবর থেকে উৎপন্ন এই সাতটি শুভঙ্করী গঙ্গাধারা ম্লেচ্ছ প্রায় বিভিন্ন দেশকে প্লাবিত করে এগিয়ে চলেছে এদের মধ্যে সীত নদী সিন্ধি, কুকু, চীন, বধর, যবন, দ্রুহ, কুন্তি, রুষ, অঙ্গলোকবর প্রভৃতি দেশকে বিধৌত করে ও সিন্ধুমেরুকে, দুইভাগে বিভক্ত করে পশ্চিম সাগরে পতিত হয়েছে; চীন, মরু, তঙ্গন, সর্বলিক, সখ্রিং তুষরে, লম্পাক, পহ্নব, দরদও শক–এই দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চক্ষু নদীও পশ্চিম সাগরে গিয়ে মিশেছে। পশ্চিমবাহিনী সর্বশেষ নদী সিন্ধু দরদ, কাশ্মীর, গান্ধার হ্রদ, শিবপৌর, বরপ, ইন্দ্রহাস, বসতি, বিসর্জয়, সৈন্ধব, রন্ধকারক, ভ্রমর, আভীর, রোমক, শুনামুখ ঊর্ধ্বমেরু এইসব দেশে প্রবাহিত হয়েছে।
দক্ষিণবাহী গঙ্গানদী কিন্নর, কলাপগ্রাম, গান্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, বিদ্যাধর, উরগ, পারদ, সীগল, ক্ষ, বিত, পুলিন্দ্য করু, ভরত, পাঞ্চাল, কাশী, মৎস্য, মগধ, অঙ্গ, ব্রাহ্মোতর, বঙ্গ, তাম্প্রলিপ্ত প্রভৃতি আর্য জনপদের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু বিন্ধ্য পর্বতের কাছে এর গতি রুদ্ধ হওয়ায় তা লবণ সাগরে গিয়ে মিশেছে। পূর্বোল্লিখিত হৃদিনী পূর্বদিক বরাবর, প্রবাহিত হয়ে ক্রমে ক্রমে নিষাদ, ধীবর, ঋষিক, নীল মুখ, কেরল, উষ্ট্ৰকৰ্ণ, বিয়াবি কালের বিবর্ণ, স্বর্ণভূষিত ঘুমার দেশে প্লাবন ঘটিয়ে পূর্বসাগরের জলে গিয়ে মিশেছে। অপথ, ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবর, ঘরপথ, ইন্দ্রশঙ্কুপথ, উদ্যান, মস্কারের মধ্যজগ ও কুর্থী প্রাবরণ জনপদগুলি পূর্ববহিনী পাবনী নদীর গতিপথের মধ্যে পড়ে, শেষে এই নদী ইন্দ্রদ্বীপের কাছে লবণ সাগরে এসে পড়ল।
একইভাবে পূর্ববাহিনী নলিনীও তীব্রবেগে প্রবাহিত হয়ে তোমর, বহুদক, হংসমার্গ প্রভৃতি পূর্বদিকস্থ দেশগুলিকে প্রথমে প্লাবিত করে, বহু ভূধর ভেদ করে, আবার ও কর্ণবিররণ, অশ্বমুখ, বালুকাময় শৈলমেরু ও বিদ্যাধর প্রভৃতি দেশ প্লাবিত করে নেমি মণ্ডলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে পূর্ব সাগরে প্রবেশ করেছে, এই সাতটি প্রধান নদী থেকে বহু নদী ও উপনদী উদ্ভূত হয়েছে, আর তার প্রতিষ্টতে আরও বেশি জলপ্লাবনের জন্য ইন্দ্রদেবও যথাসম্ভব বারিবর্ষণ করে থাকেন।
বস্কোকসারা নদীর তীরে হরিশৃঙ্গ নামে একটি সুসন্ধিত ও জলমগ্ন পর্বত আছে। এখানে সুবিক্রম নামে এক যজ্ঞশীল বশেন্দ্রিয় বিদ্বাণ, অমিতবলশালী কুবেরানুরে বাস করতেন। একইসঙ্গে অগস্ত্যগণ, বিদ্বান ও ব্রহ্মরাক্ষসদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আরো চারজন কুবেরের অনুচরে সেখানে বাস করতেন। তারা গুণ গরিমায় সুবিক্রমের সমতুল্য ছিলেন। এঁদের ধর্ম, অর্থ ও কামবিষয়ক সমৃদ্ধি ছিল। পরস্পরের দ্বিগুণ। হেমকূট পর্বতের সায়ন সরোবর থেকে মনস্বিনী ও জ্যেতিষ্মতী নামে দুটি পশ্চিমবাহিনী নদী উদ্ভূত হয়েছে। দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষে এরা দুজনেই পশ্চিম সাগরে পতিত হয়েছে আর পুণ্যদায়িনী জন্ধু নদী উদ্ভূত হয়েছে। মেরুর পশ্চিমদিকস্থ চন্দ্ৰপ্ৰভ হ্রদ থেকে নীলাচলে পয়োদ নামে একটি পুণ্যদা নামে দুটি নদী উৎপন্ন হয়েছে।
শ্বেত পর্বতের পাদদেশে আছে উত্তর মানস নামে এক পুণ্যসলিলা সরোবর। এর থেকে জ্যোৎস্না ও মৃগকান্তা নামে দুটি সরোবর উৎপন্ন হয়েছে, এই শ্বেত পর্বতে রুদ্রকান্ত নামেও একটি সরোবর আছে। সরোবরটির জল অত্যন্ত মধুময় ও পবিত্র। এতে বিভিন্ন বর্ণের পদ্ম, নানারকমের মৎস্য ও বিভিন্ন পক্ষী বিচরণ করেন। এই সরোবরটি রুদ্রনির্মিত বলে জ্ঞেয়, এই মনোজ্ঞ সরোবরটি বহু কল্পবৃক্ষে সমাকীর্ণ, এছাড়াও এই শ্বেতপর্বতে পদ্ম, মৎস্য ও পক্ষীতে শোভিত। রুদ্র, জয়া প্রভৃতি বারোটি সমুদ্রতুল্য বিখ্যাত সরোবর আছে। এইসব সরোবর থেকে শান্তা ও মাধবী নামে দুটি নদী উদ্ভূত হয়েছে।
মনে রাখবেন, কিম্পুরুষাদি অপরাপর যেসব বর্ষ আছে সেগুলোতে বর্ষণদেবতা বৃষ্টি বর্ষণ করেন না। এখানে যেসব বড়ো নদী প্রবাহিত হয় তাদের জলেই গাছপালা, বৃক্ষাদি জন্মে, বৃদ্ধি লাভ করে। ঋষজ, দুন্দুভি ও ধ্রু নামে তিনিটি মহাপর্বত পূর্বদিকে আয়ত হয়ে ক্রমে অবনত হতে হতে লবণ সমুদ্রে প্রবেশ করেছে। চন্দ্র, কঙ্কা, প্রাগ ও বিশাল অগ্নিশৈল চতুষ্টয় পশ্চিম সীমা বরাবর উত্তরদিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ সাগরে গিয়ে মিশেছে। সোমক্ত বরাহ ও নারদ শৈল একইভাবে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে লবণ সমুদ্রে পতিত হয়েছে। চক্র, বলাহক, মৈনাক–এই তিনটি শৈলশিরা দক্ষিণ সাগর পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। এদের মধ্যে চক্র ও মৈনাক শৈলের মধ্যে সংবর্তক নামে একটি আগ্নেয়গিরি বিরাজমান রয়েছে। সেই সংবর্তক বা বড়বামুখ নামে অগ্নিদেব সমুদ্রের জল পান করেন বলে তাকে “সমুদ্রপ” নামেও অভিহিত করা হয়। পূর্বেল্লিখিত ঋষভ প্রভৃতি দ্বাদশ শৈল মহেন্দ্রর কাছ থেকে পক্ষচ্ছেদের ভয়ে ভীত হয়ে লবণ সাগরে প্রথমে অন্তর্হিত হয়। পরে সেখান থেকে তাদের উত্থান ঘটে। তাঁরা চন্দ্রমণ্ডলে যায়। এই কারণেই শুক্লপক্ষের চন্দ্রে একটি কৃষ্ণবর্ণ শশকাকৃতি চিহ্ন দেখা যায়।
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণনুসারে আমি ভারতবর্ষের নয়টি বিভাগের কথা আপনাদের বলেছি। কিন্তু অন্যান্য পুরাণদিতে অন্যরকম বিভাজন বা বিন্যাস লক্ষ্য করা যায়। এইসব পুরাণমতে ভারতবর্ষে ধর্ম, অর্থ ও কাম, আরোগ্য, আয়, প্রমাণ–এসব গুণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময় ভারত প্রমুখ বর্ষে আরোগ্যাদি গুণযুক্ত নানা জাতীয় প্রাণীগণ যথাভাগে বাস করবেন। এই পৃথিবী ওই বৰ্ষসমূহকে ধারণ করেছেন।
ধীমান সূত আবার বলতে শুরু করলেন, দ্বিজবৃন্দ শুনুন, ভারতবর্ষের দক্ষিণে মহাসমুদ্রের অভ্যন্তরে দশ হাজার যোজন দূরত্ব অতিক্রম করে নানা পুষ্পফল শোষিত এক কূলপর্বত বিরাজমান থাকতে দেখা যায়। পর্বতটির নাম বিদ্যুত্বান পর্বত। দৈঘ্য বরাবর পর্বতটির বিস্তৃতি তিন হাজার যোজন ও প্রস্থে এক হাজার যোজন এই পর্বতের উপরিস্থিত ভূমিভাগ বিদ্যুত্বান দ্বীপ নামে পরিচিত। স্বভাবতই দ্বীপটি বহুবিধ শৃঙ্গশ্রেণীতে অলংকৃত হয়ে আছে। ওই দ্বীপ সুমধুর স্বচ্ছসলিল সহস্র সহস্র ব্যাপী নদী বিদ্যমান রয়েছে।
বিশাল বিশাল নানা আকারের এক যুক্ত শত সহস্র নগর আছে। পর্বতটিতে প্রতিটি নগরই সমৃদ্ধিবান নরনারীতে পরিপূর্ণ, পরস্পর সুসম্বন্ধ এই সব নগর পর্বতের অন্তর্গত এবং এইসব নগরে প্রবেশ করতে হয় তলদেশ দিয়ে। এইসব নগর দীর্ঘশ্মশ্রুধারী নীলমেঘবর্ণ বিশিষ্ট কিছু সংখ্যক মানুষ বাস করেন। এঁরা বানরের মতো ফলমূল খেয়ে থাকেন। এঁরা সেবা পারয়ণ, ধর্মনিষ্ঠ অথচ শৌচাচার বর্জিত। এঁদের দেহের পরিমাণ এক জানুমাত্র এবং আয়ুর পরিমাণ আশি বছর। এইভাবে ক্ষুদ্রাবয়ব মানুষের দ্বারা এই সকল অন্তঃদ্বীপগুলি আনুপূর্বিক ব্যাখ্যাত হয়েছে।
আমি যে সমস্ত অন্তর দ্বীপের বিষয়ে আলোচনা করছি, তাদের আয়তন ও বিস্তার যথাসম্ভব কুড়ি, ত্রিশ, পঞ্চাশ, ষাট, আশি, একশো ও হাজার যোজন বলে জ্ঞান করবেন। এই সব অন্তরদ্বীপের মধ্যেই হাজার হাজার “বহিন” নামে দ্বীপপর্বত ও আরও বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ আছে। কয়েকটি প্রসিদ্ধ দ্বীপ হল– অঙ্গদ্বীপ, যবদ্বীপ, মলয়দ্বীয়, শউখদ্বীপ ও বরাদ্বীপ। এগুলি বহু প্রাণী আশ্রিত ও নানা রত্নের আকর। দ্বীপছয়টি জম্বুদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত, এদের মধ্যে প্রথমে আমি অঙ্গ দ্বীপ বিষয়ে আলোচনা করছি।
নদী, শৈলশ্রেণী ও বনাঞ্চলে সমাকীর্ণ অঙ্গ দ্বীপটিকে চারিদিক দিকে লবণ সাগর বেষ্টন করে আছে। দ্বীপটি আয়তনে অতি বিস্তৃত। পৃথিবীতে বিদ্যমান নানা সংঘ ও ম্লেচ্ছ প্রাণীবর্গ বাহুল্য দেখা যায়। সুবর্ণ, প্রবাল ও নানাবিধ দুর্মূল্য রত্নের আকর, এই দ্বীপে চক্র নামে এক শ্রেষ্ঠ পর্বত আছে। এই পর্বতে বহু নিঝর ও বন্দর বর্তমান এখানে একটি গিরিগুহা আছে যা নানা প্রাণীতে পরিপূর্ণ। এই চক্র নামক মহাগিরি নাগদেশের মধ্যভাগে বিরাজ করছে। পর্বতটির উভয়প্রান্ত সাগর স্পর্শ করেছে।
দ্বিতীয় হল যবদ্বীপ, এই দ্বীপও নানা দুষ্প্রাপ্য রত্নের আকর। নানা ঋতুময় ‘দ্যুতিমান নামে এক পর্বত এই দ্বীপে আছে। এই পর্বতের পাদদেশ থেকে অনেক পবিত্র স্বচ্ছ সলিলা নদীর জন্ম হয়েছে।
মলয় দ্বীপ বহু মণিমাণিক্য, রত্ন, সুবর্ণ, চন্দন ও মুক্তাদির আকর। এই দ্বীপে নানা ম্লেচ্ছ জাতির অধিক্য আছে। বহু নদী ও পর্বতের উদ্ভব স্থান মলয় পর্বত অসম্ভব শ্রীমণ্ডিত ও রৌপের আঁকা। এই পর্বতশ্রেষ্ঠটি “মহামলয়” নামেও বিখ্যাত। এছাড়া মলয়দ্বীপে মন্দর নামে অপর একটি পর্বত আছে। মন্দর পর্বতে দেবাসুর বন্দিত অরস্ত্যমুনির পবিত্র আশ্রম আছে। এছাড়াও মলয় পর্বতের স্বর্ণময় পাদদেশে সিদ্ধসেবিত দ্বিতীয় একটি আশ্রম আছে, আশ্রমটি নিকুঞ্জ, তৃণ ও পুষ্প বলে সমৃদ্ধ হওয়ায় স্বর্গ অপেক্ষা বিশিষ্টতা লাভ করেছে। সেখানে প্রতিটি পর্বে স্বর্গের অবতরণ ঘটে গেছে। ত্রিকূট শৈল নানাধাতুভূষিত অনেক যোজন উচ্চ বিচিত্র সানুদেশ ও বর্ণময় গুহাশোভিত-এর রমণীয় শৃঙ্গে ‘লঙ্কা’ নামে এক মহাপুরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিত্য আনন্দিত ও চির সমৃদ্ধ এই মহাপুরীর প্রাচীর ও তোরণগুলিও সুবর্ণনির্মিত। শৃঙ্গদেশের শতযোজন বিস্তীর্ণ ও ত্রিশ যোজন দীর্ঘ স্থান জুড়ে এই মহাপুরীটি গড়ে উঠেছে। নগরটি রম্য প্রাসাদ মালায় ও বল্লভিতে সুসজ্জিত। এখানে যথেচ্ছ রূপধারী বলদৃপ্ত রাক্ষসেরা বাস করেন। এঁরা সুরদ্বেষা। এই স্থান মানুষের অগম্য বলে কমলও মনুষ্য দ্বারা পীড়িত হয় না।
এই মহাদ্বীপের পূর্ব তীরে নদনদীপতি গোকর্ণ। শংকরের এক মহান আলয় আছে। আর আছে শত যোজন বিস্তীর্ণ প্রকটি ম্লেচ্ছ অধ্যুষিত রাজ্য। এই রাজ্যেই শঙ্খ নামে পর্বত আছে। বিধৌত শঙ্খের মতো শুভ্রকান্তি এই পুণ্য পর্বতটিতে বহু পুণ্যবান মানুষেরা একসঙ্গে বাস করেন। এই পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়েছে শঙ্খলাগা নামে এক মহাপুণ্য নদী। শতম পর্বতেই শঙ্খমুখ নাগরাজের সুশোভন আলয় রয়েছে।
এইরকমেরই অপর একটি দ্বীপ হল কুমুদ দ্বীপ। দ্বীপটি অশেষ কল্যাণকর। নানা পুণ্যে ধন্য, নানা গ্রামে সমাকীর্ণ ও নানা রঙের রথের আকর এই দ্বীপের অধিবাসীরা মহাদেব ভগিনী দুষ্ট চিত্ত বিনশিল্পী কামদা দেবীর পূজা করে অভীষ্ট লাভ করে থাকেন। বরাহ দ্বীপে বহুবিধ নদী, ফুলফলভরা অনেক কন্দব গুহা, বন ও নিঝর শোভিত বরাহ নামে এক সুবিশাল শিলাময় রমণীয় পর্বত আছে। এই পর্বত থেকে পুণ্যতীর্থরঙ্গিনী বারার্থী নামে এক বরদা নদীর জন্ম হয়েছে। তাই এই দ্বীপটি ধনধান্যে সমৃদ্ধ। দ্বীপের মানুষজনও অতিধার্মিক। বরাহ দ্বীপে বহুসংখ্যক ফ্লুেছের বসবাস। তাঁরা বরাহ রূপী প্রভুবিষ্ণু দেবতাকেই পূজার্চনা করে থাকেন। অন্য কোনো দেবতা তাদের আরাধ্য নন।
হে ঋষিবৃন্দ, এই যে আমি ভারতবর্ষের চতুর্দিকের ছয়টি অনুদ্বীপের কথা বললাম, সেগুলো ছাড়াও দ্বীপের দেশ ভারতবর্ষের দক্ষিণেও অসংখ্য দ্বীপরাজ্য আছে। এক অখণ্ড সমুদ্র যেমন অগণন সমুদ্র ফেনায় মণ্ডিত হয়, ঠিক তেমনভাবেই অখণ্ড ভারতবর্ষও বহু খণ্ড দ্বীপে বিমণ্ডিত। যেমন জম্বুদ্বীপের মধ্যে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ আছে তেমনি অনান্য মহাদ্বীপের মধ্যেও বহুবিধ দ্বীপ ও অন্তরদ্বীপ আছে। এরকম বহুসংখ্যক অনুদ্বীপে সন্নিবেশিত হয়ে পূর্বোক্ত চারটি মহাদ্বীপ মেরুর চারিদিকে অবস্থান রয়েছে। পুরাণ তত্ত্ব মহর্ষি সূত বললেন, হে দ্বিজোত্তমগণ, আমি এমন প্লক্ষ দ্বীপের বিষয়ে সংক্ষেপে এবং তত্ত্বনিষ্ঠভাবে আপনাদের কাছে বলব। আপনার মন দিয়ে শ্রবণ করুন।
প্লক্ষ দ্বীপের বিস্তার জম্বুদ্বীপের দ্বিগুণেরও বেশি। আর আয়তন জম্বুদ্বীপের বিস্তারের তিনগুণ। লবণ সমুদ্র এই দ্বিপন্তে চারদিক থেকে বেষ্টন করে আছে। এখানে বহু পূণ্যপদ জনপদ আছে। প্রজারা বহুকাল আয়ু ভোগ করেন। কারোর ব্যধির ভয় নেই। দুর্ভিক্ষও হয় না। দ্বীপের সর্বত্র সমৃদ্ধির লক্ষণ স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, প্লক্ষ প্রভৃতি সাতটি দ্বীপের প্রত্যেকটিতেই ঋজু অথচ আয়তকার করে প্রতিদিকে সাতটি পর্বত আছে। প্লক্ষ দ্বীপে যে সাতটি পর্বত আছে, তাদের নাম হল গোমেদক, চন্দ্র, নারদ, দুন্দুভি, সোমক, সুমনা ও বৈভ্রাজ। এবার এদের বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা আপনাদের বলব। প্লক্ষ দ্বীপের প্রথম পর্বত হল গোমেদক, পর্বতটির এহেন নাম থেকেই এই স্থান “গোমেদষ্ক বর্ষ” রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। দ্বিতীয় পর্বত হল সর্ব ঔষধিবৃক্ষলতা পূর্ণ চন্দ্র, এখানে দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয় দেবতাদের চিকিৎসার জন্য ঔষধি রোপণ করেছেন। তৃতীয় হল নারদ পর্বত, পর্বতটি এত উচ্চ যে দুর্গশৈল বলে ভ্রম হয়। এই পর্বতে নারদ ও পর্বত মুনি দুজনেই জন্মেছিলেন। চতুর্থ পর্বতের নাম দুন্দুভি। পুরাকালে দেবগণ এই পর্বতে আরোহণ করে “শব্দ মৃত্যু” নামে ভীষণ এক দুন্দুভি আহরণ করতেন, সে থেকে এই পর্বতের নামকরণ হয়েছে দুন্দুভি। পঞ্চম পর্বতের নাম সোমক। সোমক পর্বতের গোপন গুহায় পুরাকালে দেবতারা অমৃত সঞ্চয় করে রেখেছিলেন। মাতৃআজ্ঞা পালনের জন্য গরুড় প্রমাণ থেকেই সেই অমৃত হরণ করেছিল।
সুমনা হল প্লক্ষ দ্বীপের ষষ্ঠ পর্বতের নাম। এর অপর নাম হল ঋষভ। বরাহবতার নারায়ণ এখানেই দেবত্রাস হিরণ্যাক্ষকে বধ করেছিলেন। সপ্তম এবং সর্বশেষ পর্বত হল বৈভ্রাজ। পর্বতটির স্ফটিকের মতো নির্মল স্বচ্ছতা ও দ্যুতি আছে। কিরণজালে দীপ্যমান বলেই এই পর্বতের বৈভ্রাজ নাম রাখা হয়েছে।
এবার উল্লিখিত পর্বতগুলি দ্বারা যে যে বিভক্ত হয়েছে তার নামগুলো বলছি, গোমেদক পর্বত দ্বারা শান্তি ভয় বর্ষ, চন্দ্রপর্বতদ্বারা শিকর বর্ষ, নারদ পর্বত দ্বারা সুমোদর বর্ষ, দুন্দুভি পর্বতদ্বারা আনন্দ বর্ষ, ঋষভ পর্বত দ্বারা ক্ষেমকবর্ষ এবং বৈভ্রাজ পর্বত দ্বারা ধ্রুব বর্ষ বিভজিত হয়েছে। এইসব বর্ষগুলিতে দেব, গন্ধর্ব ও সিদ্ধগণকে চারগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দে বিহার করতে দেখা যায়। উপরোক্ত সাতটি বর্ষেই সমুদ্রগামিনী গঙ্গা সদৃশ সাতটি নদী প্রবাহিত হয়ে গেছে। এবার আমি ওইসব নদীর নামগুলো ক্রমানুসারে বলছি, নদীগুলি হল–অনুজ্ঞা, সমতী, বিপাশা, ত্রিদিব, ক্ৰমু অমৃতা ও সুকৃতা। এই সাতটি প্রধান নদী থেকে অন্যান্য সহস্র নদীর উৎপত্তি ঘটেছে,–প্রধান নদী থেকে উৎপন্ন অন্যান্য নদীগুলি হল–শুভা, শান্তভয়া, প্রমোদা, রেবকা, আনন্দ, ক্ষেমকা ও ধ্রুবা। এই সমস্ত নদীগুলি ইন্দ্রের প্রদত্ত বর্ষণের দ্রাব্য পরিপূর্ণতা লাভ করে ক্রমে বেগবতী হয়ে দীর্ঘ যাত্রাপথ অতিক্রম করে সাগরাভিমুখে প্রবাহিত হয়। প্লক্ষ দ্বীপের অধিবাসীবৃন্দ এই সমস্ত নদীর জল পান করে থাকেন।
স্মরণে রাখবেন, পূর্বোল্লিখিত সপ্তবর্ষে যে সকল প্রজারা বাস করেন, তারা সকলেই বর্ণাশ্রম মেনে চলেন ও আচারনিষ্ঠ। তারা সকলেই রোগব্যধিমুক্ত ও অতিবলবান। ঐ সাতটি বর্ষে কিন্তু ভারতবর্ষের মতো ক্রমান্বয়ে চারটি যুগের আবির্ভাব ঘটে না। সেখানে সর্বদা একটাই যুগ বিরাজ করে, তা হল ত্রেতাযুগ।
প্লক্ষ দ্বীপ থেকে আরম্ভ করে পঞ্চম যে শক দ্বীপ পূর্বোক্ত দেশবিধানুসারে অবস্থিত সেই শক দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত দ্বীপপুঞ্জে সদা সর্বদা ত্রেতাযুগ তুল্য একটি কাল বিদ্যমান থাকে। স্বভাবতই এখানকার অধিবাসীরা কমপক্ষে পাঁচ বছর পর্যন্ত জীবিত থাকেন। এঁরা রূপবান, সুসজ্জিত ও বলবান হয়ে থাকেন, এককথায় লক্ষদ্বীপ থেকে শুরু শাক দ্বীপ পর্যন্ত যা বিরাজ করে তা হল–সাম্য, শন্তিবল, রূপ, আরোগ্য এবং ধর্ম।
হে দ্বিজোত্তমগণ, প্লক্ষ দ্বীপ হল বিশাল, সব দিক দিয়েই শ্রীযুক্ত। ধনধান্যে পরিপূর্ণ। নানাবিধ দিব্য ফলমূল ও ঔষধি এবং বনস্পতিতে শোভিত। সহস্র সহস্র গ্রাম্য ও আরণ্যক পশুতে পরিবৃত। এই দ্বীপের মধ্যে জম্বু বৃক্ষের মতোই প্লক্ষ নামে এক মহাবৃক্ষ বিরাজমান। সেই বৃক্ষের নামানুসারেই দ্বীপটির নামকরণ হয় প্লক্ষ। এই দ্বীপস্থিত সমৃদ্ধ জনপদগুলির মধ্যে ভগবান স্থানু বিশেষভাবে পূজিত হয়ে থাকেন। এই প্লক্ষ দ্বীপ নিজ বিস্তারের দ্বিগুণ ইক্ষু সমুদ্রের দ্বারা চারিদিক থেকে বেষ্টিত হয়ে আছে। এতক্ষণ আমি আপনাদের কাছে প্লক্ষ দ্বীপের সন্নিবেশদিক্রমে বললাম। সংক্ষেপে এবং আনুপূর্বিক ভাবে শাশ্মল দ্বীপের বিষয়ে বলছি।
প্লক্ষ দ্বীপ থেকে তৃতীয় হল শাশ্মল। এই দ্বীপ অপরাপর সাতটি দ্বীপের মধ্যে শ্রেষ্ঠত। এর বিস্তার প্লক্ষ দ্বীপের দ্বিগুণ। এই দ্বীপও চারিদিক থেকে ইক্ষু সমুদ্রবেষ্টিত হয়ে আছে। শাশ্মল দ্বীপেও সাতটি মণিভূষিত রত্নপ্রসূ বর্ষ পর্বত আছে। আছে সাতটি রত্ন প্রসবিণী নদী। সেই সপ্ত পর্বতের মধ্যে প্রথম পর্বতের নাম কুসুম সর্বধাতুময় অসংখ্য শৃঙ্গ ও প্রকট শিল্পজালে সুবিন্যস্ত এই পর্বতটি সূর্য সমদ্বীপ্তিমান। দ্বিতীয় গিরিশৃঙ্গের নাম উন্নত। হরিতালময় অসংখ্য শৃঙ্গযুক্ত এই পর্বতটি দেখলেই মনে হয় যেন আকাশকে আবৃত করে অবস্থান করছে। তৃতীয় পর্বতটি বলাহক নামে প্রসিদ্ধ। এই পর্বতটিও মালতীলতায় আবৃত হয়ে অঞ্জনময় শৃঙ্গগুলিকে ঊর্ধ্বে তুলে আকাশকে আবৃত করে অবস্থান করছে। চতুর্থ পর্বত দ্রোণ বিশল্যকরণী, মৃতসঞ্জীবনীর মতো মহাশক্তিশালী ঔষধিলতার এই পর্বত পরিপূর্ণ হয়ে আছে। পঞ্চতম পর্বত কঙ্ক যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনি উচ্চতাতেও বিরাট, দিব্য পুষ্পফলে ও বৃক্ষাদি লতায় পর্বতশৃঙ্গটি সমাবৃত হয়ে আছে। মেঘের মতো আকৃতিবিশিষ্ট ষষ্ঠ পর্বতটির নাম মহিয। সপ্তম ও বিশেষ পর্বত ককুমান। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র ককুমানের শৃঙ্গ দেশে রত্নকনকাদি বর্ষণ করে থাকেন। আর ব্রহ্মা সেইসব রত্ন সংগ্রহ করে প্রজাদের মধ্যে বণ্টন করেন। সংক্ষেপে এই হল শাশ্মল দ্বীপের সাতটি মণি ভূষিত পর্বতের কথা, এবার কোন্ পর্বতের কোন্ বর্ষ তা বলছি,
কুমুদ পর্বতের শ্বেতবর্ষ, উন্নত পর্বতের লোহিত বর্ষ, বলাহক পর্বতের জীমূত বর্ষ, দ্রোণ পর্বতের হরিৎবর্ষ, কঙ্ক পর্বতের বৈদ্যুৎ বর্ষ, মাহিয় পর্বতের মানস বর্ষ, এবং কুকুমান পর্বতের সুপ্র বর্ষ। শাশ্মল দ্বীপ এই সাতটি বর্ষেই বিভক্ত।
হে পুণ্যাত্মা ঋষিবৃন্দ। এই উল্লিখিত বর্ষগুলিতে যে যে নদী আছে, এবার আমি তাদের বিষয়ে বলছি। সোনী, তোয়া, বিতৃষ্ণা, চন্দ্রা, শুল্কা, বিমোচণী ও নিবৃত্তি উপরিউক্ত সাতটি বর্ষে এই সাতটি নদী প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এই সমস্ত নদী থেকে আরও সহস্র সহস্র নদী উৎপন্ন হয়েছে। তাদের সংখ্যা নির্ণয় করা সকলের পক্ষেই দুরুহ ব্যাপার।
সংক্ষিপ্তাকারে শাশ্মল দ্বীপের বিষয়ে আর বিশেষ কিছুই বলার নেই। প্লক্ষ দ্বীপের মতো। এক বিপুল স্কন্ধ শাশ্মল বৃক্ষের কারণেই ঐ দ্বীপ শাশ্মল দ্বীপ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এবার অন্যান্য দ্বীপের কথা বলছি, শুনুন, প্রথমে চতুর্থ দ্বীপ হিসেবে খ্যাত কুশ দ্বীপের কথা বলছি।
কুশ দ্বীপের আয়তন শাশ্মল দ্বীপের দ্বিগুণ অর্থাৎ প্লক্ষ দ্বীপের চতুগুণ, এটি চারিদিক থেকে সুরা সাগরে বেষ্টিত। কুশ দ্বীপে যে সাতটি বর্ষ পর্বত আছে, তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি। উল্লিখিত সাতটি পর্বতের মধ্যে প্রথম হল অতি উচ্চ বিদ্রূপ। দ্বিতীয় তৃতীয় মেঘের মতো। দীপ্তমান দ্যুতিমান। চতুর্থ পুষ্পবান, পঞ্চম কুশেশয়, ষষ্ঠ হবি এবং সপ্তম মান্দার। প্রসঙ্গত, জলের অপর নাম হল মন্দ। সমুদ্রমন্থনকালে এই মন্দর পর্বত দ্বারা জলের বিদারণ ঘটেছিল। সেই কারণে এই পর্বতের নামকরণ করা হয় মন্দব। এইসব পর্বতসমূহের প্রধান বিশেষত্ব হল–ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ এদের যতটা বিস্তৃত আছে, তার থেকে দ্বিগুণ ভূমধ্যে নিহিত আছে। ক্রমানুসারে কুশ দ্বীপস্থিত বৰ্ষসমূহের নাম বলি– উদ্ভিদ বর্ষ, বেণুমাদল বর্ষ, স্বৈরযাকার বর্ষ, লবণ বর্ষ, রতিমল বর্ষ, প্রভাকর বর্ষ এবং কপিশ বর্ষ।
এই সপ্তবর্ষ পর্বতেই একটি দৃশ্য লক্ষিত হয় যে, দেবতা ও গন্ধব্যগণ একত্রে বিচরণ করছেন ও খেলা করেছেন। তবে এই সাতটি বর্ষের কোনোটিতেই দস্যু বা ম্লেচ্ছ জাতির বসবাস নেই। এখানকার লোকরা সকলেই গৌরবর্ণা। যথাকালে এঁরা মৃত্যুপ্রাপ্ত হয়। কুশ দ্বীপের এই সাতটি বর্ষে যে সাতটি নদী আছে তারা হল–ধূতপাপা, শিবা, পবিত্রা, সমিতি, সুতি, গর্ভা ও মহী। এছাড়া এই সাতটি প্রধান নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে–আরও শত সহস্র বেগবতী নদী। এরা সকলেই ইন্দ্রের কাছ থেকে বর্ষণপ্রাপ্ত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
হে ঋষিতল, কুশ দ্বীপের সন্নিবেশ বর্ণনা করলাম। এবার ক্রৌঞ্চ দ্বীপের বিবরণ দিচ্ছি, শুনুন।
ক্রৌঞ্চ দ্বীপের বিস্তার কুঞ্জ দ্বীপের দ্বিগুণ আয়তনে সমান ঘৃত সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত। এই দ্বীপে যে সাতটি বর্ষ পর্বত আছে, তাদের নামগুলি হল– ক্রোঞ্চ, বামনক, পুণ্ডরীক, দিব্যবৃত, দিবিন্দ, দুন্দুভিস্বন ও অন্ধকারক। এই সাতটি পর্বতই রত্নমণ্ডিত ফলময় ও নানাবিধ গুণসম্পন্ন বৃক্ষলতায় আবৃত। এরা পরস্পর দ্বিগুণ এবং এদের বিঙ্কম্ভ অর্থাৎ ভূগর্ভনিহিত ভাগও পরস্পর দ্বিগুণ। ঐ সাতটি বর্ষপর্বত এক একটি বর্ষকে নির্দিষ্ট করেছে। যেমন–ক্রৌঞ্চ পর্বতের কুশল বর্ষ, বামন পর্বতের মনোনুগবর্ষ, অন্ধকারকের উষ্ণবর্ষ, এইভাবে চতুর্থ হল প্রাবরক, পঞ্চম অন্ধকারক, ষষ্ঠ মুনি এবং সপ্তম দুন্দুভিস্বন।
ক্রৌঞ্চ দ্বীপের এই সমস্ত বর্ষ সিদ্ধ ও চারণগণে পরিপূর্ণ। উল্লিখিত সাতটি বর্ষের মধ্যে দিয়ে গৌরী, কুমুদ্বতী, সন্ধ্যা, বক্রি, মনোজ্ঞা, খ্যাতি ও পন্ডরীকা নামে সাতটি নদী যথাক্রমে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। লোকমুখে এরা সকলেই গঙ্গা নামে খ্যাত। এইসব নদী সমুদ্রগামিনী, এছাড়া আরও বহু নদী আছে যারা প্রচুর জলপূর্ণ হয়ে নিকটবর্তী সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। এইসব এই শ্রীময় ক্রৌঞ্চ দ্বীপ নিজের সমান বিস্তৃত দধিমণ্ড সাগরে বেষ্টিত হয়ে আছে। ক্রৌঞ্চ দ্বীপের প্রজারা সকলেই গৌরবর্ণ ও প্রিয়দর্শন।
এতক্ষণ পর্যন্ত প্লক্ষ প্রভৃতি দ্বীপসমূহের কেবল আনুপূর্বিক সৃষ্টিকরা। এখানকার প্রজাদের সৃষ্টি ও সংহারের কথা শতবর্ষ সময় দিলেও যথাযথভাবে বলার সামর্থ্য আমার নেই। অতএব এই প্রসঙ্গ ত্যাগ করছি। আসুন শাক দ্বীপের সন্নিবেশের কথা যথাযথভাবে বর্ণনা করি। আপনার মান শ্রবণ করুন।
শাকদ্বীপ বিস্তারে ক্রৌঞ্চ দ্বীপের দ্বিগুণ। এই শাক দ্বীপ ক্রৌঞ্চদ্বীপ বেষ্টনকারী দধিমণ্ড সমুদ্রকে বেষ্টিত করে অবস্থান করছে। শাক দ্বীপের জনপদগুলি সমৃদ্ধি, পবিত্রতা ও পুণ্যের প্রতীক। এদ্বীপে কোথাও কোনোদিন দুর্ভিক্ষ হয় না। প্রজাদের জীবনে জরাব্যাধির কোনো ভয় নেই। তারা রোগহীন, সবল শরীরে দীর্ঘকাল জীবনধারণ করে থাকেন। অন্যান্য দ্বীপের মতে শাকদ্বীপেও অতীব শুভ্র বর্ণ তদুপরি মণিমণ্ডিত সাতটি বর্ষপর্বত আছে। তাদের কনকপাদদেশ থেকে উদ্ভূত সাতটি রত্নবাহী স্রোতস্বিনী,–এই বর্ষপর্বতের নামগুলি হল–উদর, জলধার, রৈবতমত, শ্যাম, অস্ত, আম্বিকেয়, কেশরী। এই পর্বতগুলি খুব সুন্দরভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত।
পূর্বদিকে বিস্তৃত প্রথমবর্ষ পর্বত উদর অবস্থান করছে। এই পর্বতের সুবর্ণমুখ শৃঙ্গদেশ দেবর্ষি ও গন্ধর্বদের নিবাসযোগ্য। এখানে মেঘেরা বর্ষণের জন্যই উদিত হয় এবং অন্তর্হিত হয়। এই পর্বতের পশ্চিমদিকে রয়েছে জলাধার নামে এক সুবিশাল পর্বত। দেবরাজ ইন্দ্র নিয়মিত এই পর্বত থেকে জল গ্রহণ করে থাকেন এবং প্রজাদের উপকারের জন্য বর্ষাকালে আবার তা বর্ষণ করে দেন। এর পশ্চিমে আছে নিত্য প্রতিষ্ঠিত বৈরতক পর্বত। স্বয়ং পিতামহ ব্রহ্মা এর সৃষ্টি করেন। নক্ষত্ররূপিণী রেবতী এখানে বিরাজ করছেন, এর পশ্চিমে আছে শ্যাম নামে এক মহাগিরি। প্রজাদের শ্যামরূপ এই মহাগিরি থেকেই এসেছে। রজতবর্ণ অস্ত শৈলকন্যা পর্বতের পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছে আর তার পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছে অম্বিকেয় পর্বত। এই পর্বত শ্রেষ্ঠ হিমঘর ও গিরি দুর্গতুল্য। সর্ব ঔষধিসমৃদ্ধ কেশরী পর্বত সকল পর্বতের শেষে আম্বিকের পর্বতের পশ্চিমে অবস্থান করে আছে। এই পর্বত থেকে সদাই মুক্ত বায়ু। প্রবাহিত হয়ে থাকে।
এবার পূর্বোক্ত বর্ষ পর্বতসমূহে বিভক্ত বর্ষসমূহের কথা বলছি।
উদয় পর্বত দ্বারা বিভক্ত বর্ষকে বলা হয় উদয় বর্ষ। এই পর্বতের অপর নাম. জলদ। দ্বিতীয় জলাধার পর্বত বিভক্ত বর্ষের নাম সুকুমার। তৃতীয় বৈরতক পর্বত বিভক্ত বর্ষ কৌমার। শ্যাম পর্বত বিভক্ত বর্ষটি চতুর্থ বর্ষ মণিচক, অস্ত পর্বত সিক্ত পঞ্চমবর্ষ মেদাক, সপ্তম কেশর পর্বত বিভক্ত বর্ষটি হল মহাম।
অন্যান্য দ্বীপের মতো শাক দ্বীপের পূর্বোল্লিখিত সাতটি বর্ষে যে সাতটি প্রধান নদী প্রবাহিত হচ্ছে, তারা সকলেই সমুদ্রগামিনী ও গঙ্গা নামে খ্যাত। ক্রমানুসারে এই সাতটি নদী হল সুকুমারী নামান্তরে অলুপ্তা, দ্বিতীয় কুমারী, তৃতীয়টি তটতীর নন্দা নামান্তরে পার্বতী, চতুর্থ শিবেতিকা নামান্তরে ত্রিদিবা, পঞ্চম ইক্ষু নামান্তরে ক্রতু। ষষ্ঠ রেণুকা যা স্থানান্তরে মৃতা নামেও পরিচিত এবং সপ্তম নদী গভস্তী। এই সব কটি নদীর জলই মঙ্গলপ্রদ জলে পরিপূর্ণ।
শাক দ্বীপনিবাসী নাগরিকেরা প্রফুল্ল চিত্তে এর জল পান করে থাকেন। সাতটি নদীতে আরও বহু সহস্র নদী মিশেছে। ইন্দ্রের বর্ষণ ধারা লাভ করে এইসব নদী সর্বদাই জলপূর্ণ হয়ে থাকে, আমার পক্ষেও এই সমস্ত পুণ্যপ্রদ শ্রেষ্ঠ নদীগুলির নাম এবং পরিমাণ নিশ্চিত করে বলা সামর্থ্যের অতীত কার্য।
হে শাংশপায়ন, বিস্তীর্ণ এই দ্বীপটি চক্রের মতন গোলাকার। প্রভূত জলসমৃদ্ধ নদী মণি, ধাতু, বৃক্ষশোভিত মেঘতুল্য পর্বতশ্রেণী এবং বিবিধ প্রকার সমৃদ্ধ জনপদ নিয়ে দ্বীপটি গড়ে উঠেছে। ধনধান্যময় এই দ্বীপটির দিকে দিকে ছড়িয়ে আছে বৃক্ষ, পুষ্প ও ফলের বিচিত্র সম্ভার। এই দ্বীপে পূর্বোক্ত পর্বত বিভক্ত যে সাতটি বর্ষ আছে, তাদের সমৃদ্ধ জনপদগুলিতে বর্ণাশ্রম প্রথা পালিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ জনপদগুলি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র–এই চতুবর্গে পরিপূর্ণ। শুধু তাই হব, এখানে কোনো বর্ণ সংকর্ষ ও আশ্রমসাংকর্য নেই। অর্থাৎ শাক দ্বীপে মিশ্রজাতি ও মিলিত আশ্রম নেই। এখানকার প্রজারা ব্যভিচার বর্জিত এবং ধর্মপরায়ণ, তাই এঁরা একান্ত সুখী। এঁদের মধ্যে লোভ, ঈর্ষা, অসূয়া, কপটতা, অধৈর্য–এসব কিছুই দেখা যায় না। এঁদের এইসব গুণ এতটাই স্বাভাবিক যে এর কোনো বিপর্যয় ঘটেনি, এই দ্বীপের কল্যাণদায়ী গুণ এত প্রবল যে এখানকার অধিবাসীদের সিদ্ধ, গন্ধর্ব ও দেবগণদের সাথে খেলা ও ভ্রমণ করতে প্রায়ই দেখা যায়।
শাক দ্বীপের ধার্মিক প্রজারা নিজ ধর্মানুসারেই পরস্পকে রক্ষা করে থাকেন। এর সাতটি বর্ষের কোনোটিতেই দণ্ডদাতা, দণ্ডবিধান বা দণ্ডণীয় বলে কিছুই নেই। এমনকি দেশ শাসনের জন্যেও রাজকরের ব্যবস্থা নেই। এই দ্বীপবাসী প্রজাদের বিষয়ে এই পর্যন্তই বলা যায়।
হে ঋষিগণ, এবার আমি সপ্তম দ্বীপ সম্বন্ধে কিছু তথ্য বিবৃতি দিচ্ছি।
বিস্তারে শাক দ্বীপের দ্বিগুণ বিস্তৃতি সম্পন্ন দ্বীপ হল পুস্কর। বহিঃসীমা বরাবর এই দ্বীপকে পরিবেষ্টিত করে আছে ক্ষীর সমুদ্র। এই দ্বীপে অন্যান্য দ্বীপের মতো সাতটি করে পর্বত নেই কেবল একটিমাত্র বিচিত্র মণিময় অত্যুচ্চ শিখর শোভিত শ্ৰীসমৃদ্ধ পর্বত আছে। পর্বতটির নাম মহাশিব। এর পূর্বভাগে। অতিমনোহর বিচিত্র সানু এক শৈলচূড়া আছে। শৈলচূড়াটির চারিদিকের মণ্ডলাকার পরিধি পঁচিশ সহস্র যোজন। এই দ্বীপের পূর্বাধ জুড়ে মানসোত্তম নামে এক পর্বত বিস্তৃত রয়েছে। মানসোত্তমের উচ্চতা চৌত্রিশ সহস্র যোজন। সমুদ্রতীরে অবস্থিত পর্বতটিকে দেখলে মনে হয় যেন নবেদিত সূর্য, এই দ্বীপের পশ্চিমার্ধ জুড়ে বিরাজ করত মানস পর্বত। সুউচ্চ এই পর্বত মণ্ডলাকার পরিধি পঞ্চাশ সহস্র যোজন। এই মহাসানু মানস পর্বত একক হলেও নিজ সন্নিবেশ বশতঃ দুই ভাগে বিভক্ত এবং সুস্বাদু স্বচ্ছসলিল সাগরে পরিবৃত হয়ে আছে। বিস্তারের পরিমাণে ইহা পুস্কর দ্বীপের বিস্তারের সমান এদের মধ্যে মহাবীত নামে যে বর্ষ তা মানস পর্বতের বাইরের দিকে অবস্থিত।
আর দ্বিতীয় যে ধাতকী খণ্ড নামে বর্ষ, তা মানস পর্বতের মধ্যভাগে অবস্থিত। মহাবতী ও ধাতকী খণ্ড–উৎসরূপেই অনেক সুখ, আয়ু ও রূপ বর্তমান, এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে ছোটো বড়ো উচ্চ নীচ ভাব নেই, এঁরা সকলেই রূপে গুণে শীলে সমান। পুস্কর দ্বীপের এই বর্ষে বঞ্চনা, ঈর্ষা, চৌর্য্য, ভয়, নিগ্রহ, দণ্ড, দণ্ডনীতি, সত্য কিন্তু ধর্ম-অধর্ম, লোভ, পরিগ্রহ, বার্তা, পশুপণ্য বাণিজ্য ইত্যাদি কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। বর্ণ-শ্রমবাহিত ব্যবহার, অসৌজন্য, বেদ-এর, দণ্ডবিধি, শুশ্রূষা বা শিল্প–কোনো কিছুরই এখানকার জনমানসে কোনো প্রভাব পড়ে না। এখানে কোনো পদবি নেই। শীত বা উষ্ণতা নেই। এখানে বছরের কোনো সময়েই বর্ষা হয় না। এখানকার নাগরিকগণ উদ্ভিজ্জ খাদ্য এবং গিরি প্রস্রবণের জল পান করে জীবনধারণ করে থাকেন। এখানকার প্রজারা উত্তর করুষের প্রজাদের মতো সর্বকালেই জরা-ক্লান্তি রোগ-শোক বিবর্জিত হয়ে বহুবিধ সুখানুভূতি উপভোগ করে থাকেন। এঁদের আয়ুষ্কাল, দশ হাজার বছর। এঁরা সিদ্ধ মানবী। এঁরা দেবানুগ্রহে প্রভূত সুখ ও আরোগ্যের অধিকারী।
মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে পুস্কর দ্বীপের সকল জ্ঞাতব্য তথ্য বিষয়ে আলোচনা করলাম,–আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে এই পুস্কর দ্বীপ স্বাদুজলবিশিষ্ট সমুদ্রের দ্বারা চারিদিক থেকে বেষ্টিত হয়ে আছে। এই বেষ্টনকারী সমুদ্রের আয়তন পুস্কর দ্বীপের সমান, এইভাবে সাতটি দ্বীপদেশই নিজের নিজের সমান বিস্তার সম্পন্ন সাতটি সমুদ্র দ্বারা পরিবৃত হয়ে আছে। অর্থাৎ দ্বীপের অন্তরবর্তী সাগর ও দ্বীপ সমান বিস্তার বিশিষ্ট। এইভাবে দ্বীপ ও সাগরসমূহের পারস্পরিক পরিমাণ বৃদ্ধির হার ধারণা করে যেতে হবে। জোয়ারের সময় সাগরের জল সম্যকরুপে উদ্ৰিক্ত অর্থাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে বলে এই সুবিস্তৃত জলভাগের নাম সমুদ্র।
চতুর্বিধ প্রজা ও ঋষিগণ যেখানে বাস করেন, তার নাম বর্ষ। ঋ’ ধাতু থেকে যেমন ঋষি, তেমনভাবে শক্তিবর্ধক ‘বৃষ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হওয়ায় উল্লিখিত বৰ্ষসমূহে শক্তির প্রবৃদ্ধি হয়ে থাকে। এই জন্যই এদের নাম বর্ষ। পূর্বোল্লিখিত বৰ্ষসমূহে প্রজারা অত্যন্ত সুখপ্রদ জীবন অতিবাহিত করে থাকেন।
শুক্লপক্ষের চন্দ্রের যতই বৃদ্ধি ঘটে, সমুদ্রেরও ততই স্ফীতি ঘটতে থাকে। আবার কৃষ্ণপক্ষে চন্দ্র যতই ক্ষীণ আকার ধারণ করে, সমুদ্রও তত ক্ষীণ হয়ে যায়। এই ঘটনাকে পাত্ৰমধ্যস্থ জলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অগ্নিসংযোগে পাত্রের জল যেমন স্ফীত হয়ে ওঠে চন্দ্ৰযোগে সমুদ্রের জল তেমনভাবেই উদ্ৰিক্ত হয়, এবং চন্দ্র ক্ষীণ হলেও সমুদ্রের জলও ক্ষীণ হীনবল হয়ে পড়ে। এইভাবে কৃষ্ণ ও শুক্লপক্ষে পর্যায়ক্রমিক ভাবে সমুদ্রজল কখনও অন্ন, কখনো বা অতিরিক্তভাবে হ্রাস-বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষ ও শুল্কপক্ষের চন্দ্রের অস্ত বা উদয়ের সাথে সমুদ্রেরও যথাক্রমে ক্ষয় ও বৃদ্ধি হতে থাকে। সমুদ্রের এই পর্যায়ক্রমিক হ্রাস বৃদ্ধি যখন চরম অবস্থায় উপনীত হয়, তখন সেই হ্রাসবৃদ্ধির পরিমাণ একশো পনেরো অঙ্গুল পরিমাণ বিশেষ হয়। সমুদ্রের এইসব বিভিন্ন পর্বেই তার জলের ক্ষয়বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হতে থাকে। প্রসঙ্গত, দুই দিকে জল থাকে বলে ‘দ্বীপ’ নামকরণ হলেও প্রকৃতপক্ষে দ্বীপের চারিদিকেই জল থাকে আবার উদককে ভারণ করে বলে সমুদ্রের আরেক নাম ‘উদধি’।
যে-কোনো নামকরণের ক্ষেত্রেই এধরনের কোনো না কোনো কারণকে পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। যেমন–যার পর্বত নেই, তাকে ‘গিরি বলে আর যার পর্বত আছে, তাকে ‘পর্বত’ বলা হয়ে থাকে। পূর্বোক্ত দ্বীপগুলির ক্ষেত্রেও এধরণের কোনো না কোনো কারণকে লক্ষ্য করা যায়। শাল্মল দ্বীপে শাশ্মলি নামে এক মহাবৃক্ষকে পূজা করা হয়। কুশদ্বীপেও একটি কুশস্তম্ভ আছে। সেই অনুসারেই এই দ্বীপদুটি যথাক্রমে শাল্মলি ও কুশ দ্বীপ নামে চিহ্নিত হয়েছে। আবার ক্রৌঞ্চ দ্বীপের মধ্যজনপদে ক্রৌঞ্চ নামে এক বিশাল পর্বত আছে। শাক দ্বীপে বিরাজ করছে শাক নামে এক বৃক্ষ। পুস্কর দ্বীপেও রয়েছে সুমহান বষ্টবৃক্ষ অবস্থান। এই বটবৃক্ষ্যটি পুস্করবাসীদের দ্বারা বিশেষভাবে পূজিত হয়ে থাকে। পুস্করে ত্রিভুবনেশ্বর সর্বলোকবন্দিত মহান দেবতা ব্রহ্মার পূজার্চনা হয়। তিনি সেখানে সাধ্যদের সাথে বাস করেন। সেখানে দেবতারা তেত্রিশ জন মহর্ষির সাথে দেবাদিদেব দেবশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মার পূজা ও উপাসনা করে থাকেন। জম্বুদ্বীপে প্রচুর পরিমাণে বিবিধ রত্ন উৎপাদিত হয়।
পূর্বোল্লিখিত প্লক্ষ প্রভৃতি দ্বীপগুলিতে বসবাসকারী প্রজারা দ্বিগুণ পরিমিত ব্ৰহ্মাচার্য, সত্য, দর্ম আরোগ্য ও আয়ুসম্পন্ন হয়ে থাকেন। তারপর যে সমস্ত দ্বীপ আছে সেগুলিতে তার চেয়ে দ্বিগুণ পরিমিত ব্রহ্মচর্য, আয়ু–ইত্যাদি এবং তারপরে দ্বীপগুলিতে একইভাবে উত্তরোত্তর দ্বিগুণ পরিচিত ব্রহ্মচর্য, আয়ু ইত্যাদি দৃষ্ট হয়।
পুস্কর দ্বীপের যে দুটি বর্ষের কথা বলা হয়েছে, সেখানে স্বয়ং ত্রিভুবনেশ্বর ব্রহ্মদণ্ডের সাহায্যে ভগবান বিষ্ণু ও মহাদেবের সাথে সজ্জনপরিবৃত প্রজাবৃন্দকে রক্ষা করে থাকেন। সেখানে মহাবল দায়ী ছয়রসযুক্ত বিবিধ ভোজ্য বস্তু বিনা আয়োজনে নিজে নিজেই উৎপন্ন হয় এবং এখানকার প্রজারা সেইসব সুস্বাদু ভোগ্য বস্তু সবসময় ভোজন করেন।
পুস্কর দ্বীপের বহিঃসীমা বরাবর মধুর জলময় যে বিশাল সমুদ্র দ্বীপটিকে চারদিক থেকে বেষ্টন করে আছে, সেই পরে এক শোভন কাঞ্চন ভূমি আছে। এই কাঞ্চন ভূমির বিস্তার সপ্তদ্বীপ পৃথিবীর থেকেও বেশি। এটি একশিলায় নির্মিত এবং লোকবাসবর্জিত। কাঞ্চন ভূমির শেষ সীমানায় প্রকাশ ও অপ্রকাশময় মণ্ডলাকার লোকালোক পর্বত বিরাজমান। পর্বতটির উচ্চতা ও বিস্তার দশ সহস্র যোজন। এর অধভাগে যে আলোক আছে, তাকে ‘লোক’ বলা হয়। বাইরের যে অধভাগে আলোক নেই তাকে “আলো” বলে। এই দুইয়ে মিলে তাই “লোকালোক’ নাম দেওয়া হয়েছে। বলয়াকার লোকালোকের যে অর্ধভাগ আলোকময় সেখানে লোকালয় গড়ে উঠেছে এবং যে অর্ধভাগ আলোকবিহীন তা লোক নিবাসের অযোগ্য।
লোকনিবাসের উপযুক্ত যে স্থানটি “লোক” বলে পরিচিত সেই আলোকদীপ্ত স্থানটি জল দিয়ে চারিদিক থেকে আবৃত। আবার “অলোক বলে জ্ঞাত লোকবাসের অযোগ্য অন্ধকারময় স্থানটি; তারপর অন্তকে আবৃত করে অবস্থিত অন্য একটি স্থান এবং এই অন্তস্থিত সপ্তদ্বীপ পৃথিবী; এবং ভুঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জন, তপং ও সত্য এই সাতটি লোক–এইসবের সম্মিলিত রূপই হল সপ্তলোক পরিচয়। এর পরেই লোকান্তর স্থান। শুক্লপক্ষের প্রথমেই যেমন পশ্চিমদিকে প্রতিবিম্বত চন্দ্রকে দেখা যায়, পূর্বোক্ত অন্ত ও সেইরকম। অব্যয়াত্মক কারণের ঊর্ধ্ব, অধঃ এবং বক্রদেশে এই রকম সহস্ৰকোটি অন্ত বিরাজ করছে। এই প্রাকৃত কারণগুলি নিজ অপেক্ষা দশগুণ অধিক স্বজাতীয় পরস্পর থেকে উৎপন্ন, পরস্পর দ্বারা সমাবৃত ও বিধৃত হয়ে অবস্থান করছে। অর্থাৎ ভূত প্রাকৃত কারণ অপেক্ষা কারণ দশগুণ অধিক, তার থেকে যার উদ্ভব ঘটেছে, তা-ই আবার তার দ্বারা আবৃত ও বিধৃত হয়ে অবস্থান করছে।
এই অন্তকে চতুর্দিকে ঘন জলবিশিষ্ট সমুদ্র-বেষ্টন করে আছে। এর ফলে অন্তটি স্থির হয়ে আছে। কারণ ঘনজল অন্তটিকে স্থান পরিবর্তন করতে দিচ্ছে না। এই ঘনজলের বাইরে আবার বক্রাকার ও মণ্ডলাকৃতি মনতেজ বিদ্যমান রয়েছে। এই তেজ ঘনজলকে ধরে রেখেছে। সেই কারণেও ঘন জল স্থির হয়ে আছে। এই মনতেজ হল একপ্রকার লৌহগুড়াকৃত মণ্ডলাকৃতি বহ্নিবিশেষ থাকে ঘনবায়ু চতুর্দিকে থেকে ধরে রেখেছে, আর তাই সেই মণ্ডলাকার বহ্নি অঞ্চল হয়ে অবস্থান করছে। এই নিয়মানুসারে ঘন বায়ু আকাশ দ্বারা, আকাশ ভূতদি দ্বারা, ভূতাদি মহানের দ্বারা এবং মহান অনন্ত অব্যক্ত অর্থাৎ প্রকৃতি দ্বারা পরিবেষ্টিত ও বিধৃত হয়ে আছে, এই অনন্ত অব্যক্ত অতিসূক্ষ্ম। এর আদি নেই, বিনাশ নেই।
উল্লিখিত অন্ত ও আবরণ সমূহের পরে সহস্র সহস্র যোজন দূরে যে ঘোর আলম্বনহীন অনাময় দেশ আছে তা আলোকবিহীন হওয়ায় অন্ধকারাবৃত। এই স্থান নিরালোক নামে প্রসিদ্ধ। এই স্থানটি সীমালা ও দেশশূন্য এবং দেবতাদেরও জ্ঞানের অগোচর বলে এখানে কোনো ধরনের পর্থিব ব্যবহারই অনুসৃত হয় না। আকাশ ও অন্ধকার যেখানে শেষ হয়েছে সেই সীমানায় মঙ্গলময় মহান প্রজাপতি দেবদেব ব্রহ্মার এক বিশাল ও ভাস্বর মন্দির আছে। শ্রুতি অনুসারে এই দিব্য স্থান, দেবগণেরও অগম্য। যেসব লোক চন্দ্র ও সূর্যের আলোকে আলোকিত, তার জগতের কাছে সংশয়াতীত ভাবে ‘লোক’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। পন্ডিতদের কাছে এইসব লোক সুবিদিত।
হে দ্বিজোত্তমগণ, এই পৃথিবীতে সাতখানি রসাতল স্থান, সাতটি ঊর্ধ্বতল স্থান একটি কক্ষনিকেতন স্থান, সাত প্রকার বায়ুর স্থান, পাতাল থেকে স্বর্গ পর্যন্ত স্থান–এই কটি স্থানে মোট পাঁচ প্রকার গতি আছে। এই সংসার সাগরই জগতের গতির প্রমাণ। জগতের এই যে বিচিত্রধর্মী প্রবাহ গতি, এর কোনো আদি অন্ত নেই। এই প্রবাহ থেকে অসংখ্য জন্মের সমুদ্ভব ঘটেছে। চলমান এই গতি কোথাও কোনো অবস্থাতেই থামতে চায় না। আরও শুনুন, পূর্বেল্লিখিত যে বহুবিস্তৃত ভৌতিক সৃষ্টি, তাও অতীন্দ্রিয়। হে প্ৰজ্ঞাশ্রেষ্ঠবৃন্দ, এই পৃথিবীতে অগ্নি আপ্ত, তমঃ, বায়ুমহান ঈশ্বরের ক্ষয়, পরিমাণ অথবা কোনো অন্ত নেই, অর্থাৎ অন্যভাবে বলা যায় এঁদের বাস্তবিক ক্ষয়াদি না থাকায় এঁরা সর্বদাই অনন্ত নামে জ্ঞাত। ইতিপূর্বে আপনাদের সমীপে শিব নামক মহান দেবতার বিষয়ে বিস্তরিত ভাবে কীর্তন করেছি। তার সম্পর্কে বলা হয় তিনি সর্বগত। তিনি ভূমি, রসাতল, আকাশ, অনল, পবন, নিখিল সমুদ্র ও স্বর্গ সর্বস্থানে পূজিত হয়ে থাকে, শুধুমাত্র একাগ্র তপস্যার দ্বারাই এই মহাদ্যুতি পুরুষকে জানা যায়। এই মহাযোগী মহাশ্বরের অঙ্গ বহুধাবিভক্ত। তিনি লোকসমূহে “প্রভুলোকেশ” রূপে বহুভাবে পূজিত হয়ে থাকেন।
এই প্রকার পরস্পরোৎপন্ন বিকারগুলি অধির আধেয়ভাবে থেকে নিজের নিজের বিকার ধারণ করে। পৃথিবী প্রভৃতিতে সমস্ত বিকার পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং পরস্পর অধিকগুণ সম্পন্ন। অর্থাৎ কারণ অপেক্ষা কার্যে অধিক গুণ দেখা যায়। এঁরা পরস্পর পরস্পরের মধ্যে ভীষণভাবে প্রবৃষ্ট থাকে বলে প্রত্যেকেই স্থির ভাবে অবস্থান করছে। প্রথমে পৃথিবীর সব কিছুই অবিশেষভাবে থাকে। তখন এতে কোনো বিশেষ গুণ থাকে না। পরে পরস্পরের মধ্যে যুক্ত হয়ে বিশেষ তাপে পরিণত হয়। পৃথিবী থেকে শুরু করে বায়ু পর্যন্ত অর্থাৎ পৃথিবী, জল ও বায়ু এই তিনটি পদার্থ গুণের উপচয় ও অপচয় বসত পরস্পর পরিচ্ছিন্ন হয়। এভাবেই এরা বিশেষ আখ্যা লাভ করে। এছাড়া একপ্রকার পদার্থ আছে যারা সূক্ষ্ম। এর ফলে তাদের পরিচ্ছেদ নির্ণয় সম্ভব হয় না।
উল্লিখিত পৃথিবী, জল প্রভৃতির চারিদিকে আলোক আছে। আর ওইসব ভূতগম আলোক পরিচ্ছিন্ন হয়ে আকাশে অবস্থান করছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যেমন একটি বিশাল পাত্রের মধ্যে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাত্র একে অন্যের স্থানধিকার না করেও অবস্থান করতে পারে, আনেকটা সেরকম ভাবেই আকাশতলে আলোক ও পৃথিবী প্রভৃতি ভূতগণ পরস্পর অবস্থান করতে পারে, অনেকটা সেরকমভাবেই পৃথিবী, জল তেজ ও বায়ু–এই চারটি ভূত পরস্পরের স্থান কখনোই অধিকার করে না। এই চারিটি ভূত যতখানি স্থান অধিকার করে আছে, ঠিক ততখানি স্থান পর্যন্তই, জীবজ উৎপত্তি ঘটে থাকে। প্রাণীদের পূর্বজন্মের সর সংস্কার এইসব ভূতেই নিহিত থাকে। এইসব ভূতের বাইরে উৎপত্তি বলে কোনো পদার্থ নেই, অর্থাৎ যখন পৃথিবী প্রভৃতি ভূতসমূহ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা লাভ করে, তখন সেই অবস্থান্তর প্রাপ্তিতেই উৎপত্তি বলা হয়। অতএব হে পণ্ডিতগণ, পরিচ্ছিন্ন বিশেষজ্ঞ কার্যস্বরূপ এবং অপরিচ্ছিন্ন মহদাদিদের কারণস্বরূপ বলে জ্ঞান করবেন। . হে দ্বিজবৃন্দ, এই আমি পুরাণজ্ঞ সূতপুত্র সপ্ত দ্বীপা ও সমুদ্রবেষ্টিতা বসুমতীর সকল সন্নিবেশের বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে এবং যথাযথভাবে বললাম। বিস্তার ও মন্তলের আকারে আকারিত এই যে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড– একে প্রধান অর্থাৎ প্রকৃতির একদেশিক আংশিক পরিণাম রূপে বিবেচনা করা হয়। এই জগৎ ব্রহ্মাণ্ডে স্বয়ং ভগবান অধিষ্ঠিত এবং এখানে সপ্তবিধ ভূতবর্গ পরস্পর সন্নিবিষ্ট হয়ে বিরাজ করছে।
আমি ভূমণ্ডলের সন্নিবেশের কথা এই পর্যন্তই বলতে পারি। সবকিছু আমি আপনাদের কাছে ব্যক্ত করলাম। এবার যে সপ্ত প্রকৃতি পরস্পরকে ধারণ করে বিরাজ করছে, তাদের সম্পর্কে বলতে উৎসাহ বোধ করছি। এই সপ্ত প্রকৃতির সংখ্যা নির্ধারণ করা যায় না, এরা বক্রভাবে, ঊর্ধ্বভাবে ও নিম্নভাবে অবস্থান করছে। দিব্যমণ্ডলের যতখানি স্থান জুড়ে তারকাজির সন্নিবেশ এবং যতখানি সীমানার সন্নিবেশ।ততখানিই পৃথিবীর অনুমণ্ডল বলে বিবেচিত হয়।
.
৪৪.
সূত বলতে লাগলেন–হে ঋষিগণ, এবার আমি অধোভাগ ও ঊর্ধ্বভাগের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে বলছি, শুনুন।
।পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, জল ও তেজ–এই পাঁচটি অসংখ্য ধাতুময় এবং ব্যাপকরূপে প্রসিদ্ধ। সর্বপ্রাণীর আধারস্বরূপ এই ধরণী জননীস্বরূপা। এই ধরণীতে বহু নগর, বহু অধিষ্ঠান, বহু জনপদ, বহ নদনদী, পাহাড় ও বহু জাতি আছে। বহুবিস্তৃতা এই পৃথিবী, নদনদী, সমুদ্র, ক্ষুদ্র পর্বত, ভূমধ্যসিত জল সর্বসম্ভব যোগ্য সর্বলোকখ্যাত অগ্নি এই সবকিছুই সর্বাত্মক ও অনন্ত। অসংখ্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল, নিরালম্ব, রম্য আকাশ, আকাশজাত বায়ু–এই দুটিও সর্বব্যাপী ও অনন্ত রূপে প্রসিদ্ধ। পৃথিবীর নীচে জল, জলের নীচে পৃথিবী, তার নীচে আকাশ, আকাশের নীচে আবার পৃথিবী এবং পৃথিবীর নীচে আবার জল–এইভাবে অনন্ত জল আকাশাদি পঞ্চ ভূতের সীমানা কেউই নির্ণয় করতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে পুরাকালে দেবতারা যা বলেছিলেন তা নিশ্চিতরূপে শুনে রাখুন। তারা বলেছিলেন, “ভূমি, জল ও আকাশ প্রভৃতি পরম্পরা অর্থাৎ ধারবাহিকরূপে অবস্থিত এবং সপ্ত সাতকের এদের অবিস্থিতি ধারার অবসান ঘটেছে। সপ্তভাগে অবস্থিত প্রত্যেক রসাতলের আয়তন দশ সহস্র যোজন এবং প্রত্যেক রসাতলেই একমাত্র তল বিদ্যমান। পণ্ডিতগণ এক একটি রসাতলকে বহু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
এই সাতটি রসাতলের প্রথম হল অতল, দ্বিতীয় সুতল, তৃতীয় অতিবিস্তৃত নিতল, চতুর্থ গভস্তল, পঞ্চম মহাতল, ষষ্ঠ শীতল এবং সপ্তম পাতাল। প্রত্যেক রসাতলে ভূমির বর্ণ পরিবর্তিত হতে থাকে, যেমন–প্রথম রসাতলের ভূমি কৃষ্ণবর্ণ, দ্বিতীয় রসাতলের ভূমি পাণ্ডুবর্ণ এবং এইভাবে যথাক্রমে রক্তবর্ণ, পীতভূমিময়, শর্করাময়, শিলাময় ও সুবর্ণময়।
হে ভূর্লোকশ্রেষ্ঠ দ্বিজগণ, শুধু ভূমিবর্ণে নয়, এক একটি রসাতলে একেক কুলের সমাবেশ ঘটে গেছে। যেমন, কৃষ্ণভূমিময় এবং রসাতলে ইন্দ্ৰ শত্ৰু অজুরেন্দ্র নসুষি, মহানাদ শঙ্কু, কবন্ধ, মিদ্ধলাদ, ভীমরক্ষা, শৃলদণ্ড রাক্ষস, লেহিতাঙ্গ কলিঙ্গ, স্বপদ, মহাত্মা ধন প্রস্তরে মাহেন্দ্র ছাড়াও কালীয়নাম কুলিক নাগ প্রভৃতি দানব, রাক্ষস ও নাগগণের আনন্দমুখর জনগণে পরিপূর্ণ সহস্র সহস্র নিবাসপুরী বিরাজ করছে।
দ্বিতীয় রসাতলে দৈত্যশ্রেষ্ঠ সুরক্ষঃ, মহাজম্ভ, প্রত্যয়, হয়গ্রীব, কৃষ্ণ, নিকুম্ভ, শঙ্খ, গোমুখ, নীল, মেঘ, ক্রমণ করুপাদ, মহোবীর রাক্ষস, কম্বল নাগ, অশ্বতরং রুদ্রপুত্র মহাত্মা, তক্ষুখের নিবাসসস্থান প্রতিষ্ঠিত, এরা ছাড়াও এই দ্বিতীয় রসাতলে নাগ, দানব ও রাক্ষসদের সহস্র সহস্র পুরী বিদ্যমান।
পীতভূমিময় তৃতীয় রসাতলে মহাত্মা প্রহ্লাদ, অগ্নিমুখ, তারকাখ্য শিশুমার, রাক্ষস চলন, রাক্ষসরাজ কুম্ভিল, খর হেমকনাগ, পামরক, মণিমন্দ্র কপিল, নাগপতি নন্দ ও বিশালের পুরী প্রতিষ্ঠিত আছে। এই সবপুরী আনন্দিত জনগণে সমাকুল।
এইভাবে রসাতলের এই তৃতীয় তলেও নাগ, দানব আর রাক্ষসদের সহস্র সহস্র পুরী বিদ্যমান। চতুর্থ রসাতলে আছে দানবসিংহ মহাত্মা কালনেমি, গজকর্ণ, কুঙ্কুরে, রাক্ষসে মুমলি ও বৃকবক্রেয় আলয় এবং বিনতাতনয় পক্ষীরাজের বহু সহস্র যোজন বিস্তৃত পক্ষীনগর। যোজন যোজন ব্যাপী শর্করা ভূমিক্ষয়। পঞ্চম রসাতলে দানবশ্রেষ্ঠ দৈত্যসিংহ ধীমান বিরোচন ও লোকনাথ, ধীমান রাক্ষস বিদ্যুৎজিহু, দেবদ্বেষী রাক্ষস মহামেঘ, নাগবর্মা, স্বস্তিক ও জয়ের পুরী এবং নাগ, দানব ও রাক্ষসের সহস্র সহস্র নগরী।
ষষ্ঠ রসাতলে রয়েছে দৈত্যপতি কেশরী, সুপবা, সুলোমা, মহিষ ও রাক্ষসপতি মহাত্মা উৎক্রোমণ। এখানেই মহেন্দ্রময় সুরমাপুত্র শতমস্তক আনন্দিত নাগরাজ বাসুকি অবস্থান করছেন। এইভাবে শিলাময় এই প্রখ্যাত ষষ্ঠতলে নাগ, দানব ও রাক্ষসদের সহস্র সহস্র নগরী গড়ে উঠেছে।
সবেশেষে সপ্তম রসাতলের কথা বলবো। এটা হল সমস্ত রসাতলের শেষের তল। সেখানে বলির বহুনরনারী পূর্ণ প্রমোদবহুল পুরী আছে। এই পুরী বহু দেববিদ্বেষী উদ্ধত অসুর এবং সর্পে পরিপূর্ণ। মুচুকুন্দ দানববরের বিরাট এক নগর আছে এখানে। অসংখ্য নাগ, দানব, দৈত্য এবং রাক্ষসদের সহস্র সহস্র নিবাসপুরীতে অকীর্ণ সপ্তম রসাতল। রক্ত পদ্মাক্ষি ধৌতশঙ্খের মতো উদর ও বিশাল শরীরযুক্ত নীল বসন পরিহিত মহাবহু বিশাল বিশাল সর্প ও বিচিত্র মাল্যধারী অনন্তদেব, সুবর্ণচুড়ার মতো শ্বেতশুভ্র এবং দ্বীপ্তিমান সহস্র সহস্র বদলে শোভিত হয়ে বিরাজ করছে।
এখানে দুরন্ত জ্বালাময় ‘অগ্নির মতো তেজময় জিহ্বায় পরিশোভিত হওয়ায় অনন্তদেবকে দেখে মনে হয় যেন শিখাবিশিষ্ঠ বহ্নিমালায় বিচ্ছুরিত কৈলসশিখর! স্নিগ্ধ মণ্ডলাকার আনন্দদেবের দ্বিগুণী ভূত সহস্র সহস্র নয়ন যেন বলয়সূর্যের মতো। তাম্রবর্ণ শ্বেতপর্বতের শৃঙ্গাপরে যেমন তরুণ অদিত্যের দ্যুতি শোভা পায়, তেমনি কুন্দ ও ইন্দ্রের মতো শুভ্রবর্ণ অনন্তদেবের শিরোভঙ্গে অক্ষমালা শোভামান। শয়নাসনে ফণাকরাল দ্যুতিমান আনন্দদেব পৃথিবীর উপর বিস্তীর্ণ সহস্র শিখরে পর্বতের সঙ্গে বিরাজ করছেন। স্বয়ং মহাভাগ মহাভোগী মহাবল অসংখ্য মহানাগ এই মহানাগপতি মহাতেজা দেবতাকে উপাসনা করেন। অনন্তনাগের অপর নাম শেষনাগ। তিনি হলেন সমস্ত সাপেদের রাজা, তার মহাদ্যুতিময় রূপ দেখলে মনে হয়, যেন বিষ্ণুভক্তি সর্পতনু ধারণ করে রসাতল সীমান্ত পর্যন্ত বিরাজমান।
মনে রাখবেন, এই সাতটি রসাতল দেবতা, অসুর, মহানাগ এবং রাক্ষসদের নিবাসরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এরপরও আরও কিছু স্থান আছে। কিন্তু সে সমস্ত স্থান আলোকবিহীন, সিদ্ধ ও সাধুদের অগম্য, এমনকি দেবতাদেরও অজ্ঞাত ও ব্যবহারবর্জিত। হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ, মহাত্মা প্রাজ্ঞ ঋষিগণ এইভাবেই পৃথিবী, অগ্নি, জল, বায়ু ও আকাশের মহত্ত্ব বর্ণনা করে থাকেন এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।
পূর্বকথনের সূত্র ধরে সূত বললেন, এরপর আমি সূর্য ও চন্দ্রের গতির বিষয়ে বলতে ইচ্ছা প্রকাশ করছি। মণ্ডলাকারে অবস্থিত এই সূর্য ও চন্দ্র পরিভ্রমণ করতে করতে নিজ নিজ প্রভাপুঞ্জে সপ্তসমুদ্র ও সপ্তদ্বীপ সমন্বিত পৃথিবীর অধভাগ প্রকাশ করতে থাকেন। পৃথিবীর অপর যে অর্ধবাহ্য ভাগ সেখানেও সূর্য ও চন্দ্র পর্যায়ক্রমে পৃথিবী প্রকাশ করতে থাকেন।
ব্যাসের পরিমাণে বিচার করে দেখলে স্বর্গকে পৃথিবীর তুল্যই বলা চলে। যেহেতু সূর্যদেব পুরভ্রমণরত অবস্থায় এই ত্রিলোক প্রকাশ করে থাকেন, এই কারণে তিনি ‘অব’ ধাতু থেকে উৎপন্ন ‘রবি’ নামেও সমধিখ্যাত।
এরপর আমি চন্দ্ৰসূর্যের পরিমাণের বিষয়ে বলছি। ভারতবর্ষই হল এমন একমাত্র পূজ্যবর্ষ যেখানে ‘মহ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ‘মহী’ শব্দের প্রয়োগ হয়ে থাকে। এই ভারতবর্ষের আয়তন সুবিশাল।
এবার সূর্যের যোজন বিস্তৃত মঙ্গলের বিষয়ে বলছি, শুনুন। সূর্যের নিজের বিস্তার নয় সহস্র যোজন। আর এর মঙ্গলাকার পরিধির বিস্তার হল সূর্যের নিজের বিস্তারের তিনগুণ। আবার এই সূর্যের বিস্তার ও মঙ্গলাকার পরিধি থেকে দ্বিগুণতর বিস্তার ও পরিধি সম্পন্ন হল চন্দ্র। সপ্তদ্বীপযুক্ত ও সপ্তসাগর বেষ্টিতা পৃথিবীর নিজের বিস্তার এবং এর মঙ্গলাকার পরিধির বিস্তার; উভয়ই বহু বহু যোজন। এই বিষয়ে কিছু কিছু তত্ত্বালোচনা আমি আগেও বলেছি।
এই পর্যন্ত পৃথিবী প্রভৃতির পরিমাণাদির বিষয়ে যা কিছু বললাম সবই পুরাণে উল্লেখ করা আছে। এখন পৃথিবীর বর্তমান অধিষ্ঠাতা দেবতাদের সাথে সাথে অতীত অধিষ্ঠাতা দেবতাদের বিষয়েও বলব। অভিমান অর্থাৎ অধিষ্ঠাতৃত্বহীন যেসব, অতীত দেবতা, তারা নাম-রূপ ইত্যাদিতে বর্তমান কালের অভিমান প্রবণ দেবতাদের সমান। তাই আমি বর্তমান কালের অভিমানী দেবতাদের সাথে পৃথিবীর এবং স্বর্গের বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে আলোচনা করব।
এই পৃথিবীর বিস্তার পঞ্চাশ কোটি যোজন। এর মেরুদেশীয় স্থানগুলোও একই রকম প্রমাণ বিশিষ্ট। ঋষিরা যোজনা পরিমাণন থেকে সেই পৃথিবীর পরিমাণ বিস্তার বর্ণনা করেছেন। মেরুর মধ্যস্থান থেকে প্রতিদিকে এই পৃথিবীর বিস্তারের পরিমাণ এগারো কোটি এক লক্ষ উননব্বই যোজন এবং পৃথিবীর বিস্তার পঞ্চাশ সহস্র যোজন। এই সপ্তদ্বীপযুক্তা সপ্তসমুদ্রা বিশিষ্ট পৃথিবীর মেরুর চতুর্দিকে যে বিস্তার, তা হল, তিনকোটি এক লক্ষ উনআশি যোজন। মনে রাখবেন; পৃথিবীর মেরুপ্রদেশের বিস্তার অপেক্ষা পৃথিবীর অন্তের মঙ্গলাকার পরিধির বিস্তার তিন গুণ বেশি। যোজনাগ্রের পরিমাণ এগারো কোটি এক লক্ষ সাঁইত্রিশ সহস্র যোজন। এইভাবে পৃথিবীর অঙ্গের মঙ্গলের প্রমাণের কথা বলা হয়েছে। আকাশলোকে তারকা অগ্নিবেশের মঙ্গলাকার পরিধির পরিমাণ যেমন, পৃথিবীর সন্নিবেশের মঙ্গলাকার পরিধিও সেইরকম। পৃথিবীর ব্যাসের পরিমাণ যতখানি, সপ্তলোক ও স্বর্গের ব্যাসের পরিমাণ ততখানি, এইসব পৃথিবীর যোজনব্যাপী বিশাল বিস্তার সম্পর্কিত জ্ঞতব্য বিষয়।
এত গেল পৃথিবীর পরিমাণের কথা-এরই মধ্যে সমস্ত লোক ও সপ্তদ্বীপা পৃথিবী অবস্থান করছে। এই যেসব লোকের বিষয়ে উল্লেখ করছি, এরা অনেকটা মঙ্গলকারে ছত্রের মতো পর পর ওপরে ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। এই লোকসমৃহে বহু প্রাণী বাস করে। ছত্রাকৃতি এই সাতটি লোক হল– ভূঃ, ভূবঃ, স্বঃ, মহঃ, জন, তপঃ ও সত্য। অর্থাৎ ভূলোকের ওপর ভূবলোক, তার ওপরে স্বর্গলোক। এই রকম একের পর এক ছত্রের আকারে ওপরে ওপরে অবস্থান করছে। এইসব লোক দশগুণেরও বেশি সূক্ষ্ম কারণাত্মক পদার্থ সমূহকে নিজ নিজ আবরণ বিশেষের দ্বারা ধূত হয়ে অবস্থান করছে।
এই অঙ্গ চতুর্দিক থেকে ঘন সমুদ্র দ্বারা সন্নিবেষ্টিত হয়ে আছে। সমগ্র পৃথিবীমঙ্গলই এই ঘনজলে বিধৌত হয়ে আছে। আর সেই ঘনসমুদ্র যেন ঘনতেজে বিধৃত হয়ে আছে। তারপর সেই মনতেজঃ মূলে চতুর্দিক থেকে ঘনবাতের দ্বারা, ঘনবাত আকাশের দ্বারা, আকাশ মহাত্মা ভূতাদি দ্বারা, ভূতাদি ‘মহত’ তত্ত্বের দ্বারা, মহৎ অনন্ত অব্যয় প্রধানের দ্বারা আবৃত হয়ে আছে। ঘনাতেজকার তির্যক মঙ্গলটি বাইরে ও ওপরে এবার লোকপালদের পুর সমূহের বিষয়ে আলোচনা করা যাক। পরে জ্যোতিঃ সমূহের। প্রচারের প্রধান বিষয়ে বলব।
বস্কোকসারা নামে অশেষ পুণ্যপ্রদ সুবর্ণ নির্মিত মহেন্দ্র ভবনটি মেরুর পূর্বদিকে ও মানসের শিখরদেশে স্থাপিত হয়েছে। সূর্যপুত্র যম অর্থাৎ মহর্ষি ধ্বৈস্বত মেরুর দক্ষিণদিকে ও মানসের শিখরদেশে এক নগরে বাস করেন ধীমান বরুণ সেখানে তার এক রম্য নিকেতন আছে। মেরুর পশ্চিমদিকে ও মানসের শিখরদেশে অবস্থিত অনুপম এই বরুণভবনটি সুখা নামে পরিচিত। মেরুর উত্তরদিকে ও মানসের শিখরদেশে বিভাবরী নামে যমেরপুরী আছে সবদিক দিয়ে এই পুরী মহেন্দ্রের পুরীর সঙ্গে তুলনীয়।
মানস পর্বতের উত্তর পৃষ্ঠদেশে চারিদিকের ধর্মব্যবস্থা ও লোক সংরক্ষণের জন্য লোকপালগণ অবস্থান করেন। এই লোকপালদের ওপর দিয়ে দক্ষিণদিকে যাবার সময় সূর্যের অবস্থা বারে বারে পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রথম অবস্থায় সূর্যদেব ক্ষিপ্ত বাণের মতো অগ্রসর হতে থাকেন এবং জ্যোতিষচক্র অবলম্বনে সম্মুখাভিমুখে চলতে থাকেন। সূর্য যখন অমরাবতীর মাঝখানে আসেন, তখন ‘সংযমন’ নামে যমপুরীতে তার উদয় হয়। সেই সময় তাকে ‘সুখা’ বা বারুণীপুরীতে উদিত হওয়ার মতো দেখায়। সূর্য যখন বারুণীপুরীতে উদিত হয়, তখন ‘বিভা’ নামক কুবের পুরীতে অর্ধরাত্র ও ‘মাহেন্দ্র’ পুরীতে সূর্যাস্ত হয়। সেই একই সময় দক্ষিণ-পূর্বদিকে অপরাহ্ন হতে থাকে অথচ দক্ষিণ পশ্চিম দিকে তখনও পূর্বাহ্ন, উত্তর দিকে শেষরাত্র এব, উত্তর-পূর্ব দিকে পূর্বরাত্র অর্থাৎ রাত্রির প্রথম পাদ দৃষ্ট হয়, এইভাবে সুখাপুরীতে উদয়কালে সূর্য উত্তর ভুবন সমূহে বিরাজ করেন। আবার সুখায় যখন মধ্যাহ্নকাল অনুষ্ঠিত হয়, তখন এই হিসাবে বিভিন্ন জায়গায় সূর্যকে বিভিন্ন অবস্থায় দেখা যায়। ‘বিভাবরী’ নামক সোমপুরীতে তখন প্রথম সূর্যোদয় ঘটে। সেই একই সময় অমরাবতীতে অর্ধরাত্র, সোমপুরী বিভাবরীতে মধ্যাহ্নকাল এবং যমপুরীতে সূর্যাস্ত ঘটে থাকে। একইভাবে মহেন্দ্রর ‘অমরাবতী’তে যখন সূর্যের উদয় ঘটে তখন সংযমনপুরে অর্ধরাত্র, ও বরুণপুরীতে সূর্যের অস্ত সূচিত হয়। সূর্য অলাতচক্রের মতো শীঘ্রগতিতে ঘুরতে থাকে আর তার, সাথে সাথে অন্যান্য নক্ষত্রপুঞ্জ ও পরিভ্রমণ করতে থাকে, এইভাবে সূর্য দক্ষিণায়নের চারপাশে ভ্রমণ করেন এবং এইভাবেই সূর্যের বারবার উদয় ও অস্তাগমন ঘটতে থাকে।
ভ্রমণরত সূর্য পূর্বাহ্নকালে ও অপরাহ্নকালে দুটি দেবালয়কে এবং মধ্যাহ্নকালে একটিমাত্র দেবালয়কে রশ্মিতপ্ত করে। উদরের পর থেকে সূর্যরশ্মিজালের প্রখরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। মোটামুটি মধ্যাহ্নকাল পর্যন্ত তারা খুব তাপ দেয়। তারপর আবার রশ্মিজাল হ্রাস পেতে থাকে। হ্রাস পেতে পেতে একসময় সূর্য অস্ত যায়। এই উদয় ও অস্তানুসারেই পূর্ব ও পশ্চিমদিক নির্মিত হয়। সূর্য সামনের দিকে যতটা, পেছনে ও পাশেও ঠিক ততটাই তাপ দেয়, যেদিকে সূর্যকে উদিত হতে দেখা যায় অর্থাৎ যে দিকে উদয় ঘটে; তাকে বলে পূর্বদিক আর যেদিকে সূর্য অস্তমিত হয় সে দিকটা হল পশ্চিম।
সূর্যের পরিভ্রমণ পথে সবার উত্তরে আছে সুমেরু আর সর্ব দক্ষিণে লোকালোক পর্বত। রাত্রিকালে সূর্য অতি দূরে সময় করে এবং পৃথিবী দ্বারা আবৃত হয়ে থাকে। এসময় সূর্যরশ্মির অন্তধান ঘটে বলে তাকে খালি চোখে দেখা যায় না। গ্রহ, নক্ষত্র, তারা এবং সূর্যের ক্ষেত্রেও যখন তাদের তেজ বর্ধিত হতে থাকে, কেবলমাত্র তখনই তাদের দেখা যায়, কিন্তু যখন তারা অনূদিত থাকে অর্থাৎ অস্তাবস্ক্রীয় অবস্থায় তাকে তখন তার দৃশ্যমানতা হয় না। অগ্নি ও জলের ছায়া শুক্লবর্ণ এবং পৃথিবীর ছায়া কৃষ্ণবর্ণের হয়ে থাকে।
উদয়ের সময়ে অনেক দূরে থাকে বলে সূর্যের রশ্মিজাল দেখা যায় না। রশ্মিজালের অভাবে সূর্যকে রক্তিম বর্ণ দেখায়। ফলে তাতে উষ্ণতাও থাকে না, যে যে স্থান সূর্য রেখা দ্বারা অবস্থান করেন, সেই সব স্থানেই সূর্যকে দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি সহস্র যোজন ঊর্ধ্বে গমন করলেও সূর্যকে দেখা যায় না। সূর্য যখন অস্ত যায়, তখন তার প্রভাপুঞ্জের একাংশ অগ্নিতে প্রবেশ করে। এজন্য রাত্রিবেলা দুর থেকে অগ্নি প্রকাশ পায়। পরে যখন আবার অগ্নি উদিত হন তখন অগ্নির প্রভাপুঞ্জ অস্তমিত হয়ে সূর্যের মধ্যে প্রবেশ করে। সেই জন্যই সূর্য অগ্নি সহযোগে দিনেরবেলায় তাপ দেয় এবং সেই জন্যই সেই সময় তার প্রকাশ ও উষ্ণতা অনুভূত হয়। এই দিনেরবেলায় এবং রাত্রিবেলায় সূর্যতেজ ও অগ্নিতেজ পরস্পর পরস্পরের মধ্যে প্রবেশ করে এবং পরস্পর পরস্পরকে বর্ধিত করে।
যখন ভূমির উত্তর ও দক্ষিণ বিভাগে সূর্যের উদয় ঘটে, তখন রাত্রি জমধ্যে প্রবেশ করে। রাত্রির প্রবেশের ফলে দিনেরবেলায় জলের রং তাম্রবর্ণ থাকে। তারপর আবার যখন সূর্য অস্ত যায়, তখন দিন জলের মধ্যে প্রবেশ করে। তাই দিনের প্রবেশের কারণে রাত্রিবেলায় জলের রং শুক্লবর্ণ হয়। এইভাবে ক্রমযোগনুসারে ভূমির উত্তরার্ধ ও দক্ষিণার্ধ ভাগে সূর্যের উদয় এবং অস্তকালে দিন ও রাত্রি পর্যায়ক্রমে জলে প্রবেশ করে। জলের বর্ণ পরিবর্তন করে। এই যে দিনে সূর্যের প্রকাশ ও রাত্রিতে অন্ধকারের প্রকোপ ঘটে, এ কারণে দিনের আর এক নাম, ‘সূর্য প্রকাশ এবং রাত্রির অরেক নাম ‘তাপসী। সেই কারণে সূর্যের ওপর নির্ভর করে দিন ও রাত্রি ঘটে থাকে।
এইভাবে সূর্য যদি জলমধ্যে ভ্রমণ করে, তখন একমূহুর্তে সূর্য পৃথিবীর ত্রিশভাগ পরিক্রমা করে। এই এক মুহূর্তকাল মধ্যে পৃথিবীর যতখানি দুরত্ব সূর্য অতিক্রম করে তার পরিমাণ হল এক লক্ষ একত্রিশ সহস্র যোজন, একে সূর্যের “মৌতৃর্তকী গতি” বলা হয়।
এই মৌতূর্তিকী গতিতে সূর্য ক্রমশ দক্ষিণদিকে এগিয়ে আসে এবং মাঘ মাসে দক্ষিণদিকের প্রান্তভাগে এসে উপস্থিত হয়। দক্ষিণদিকে আসতে সূর্যকে নয় কোটি এক লক্ষ পঁয়তাল্লিশ সহস্র যোজন পথ অতিক্রম করতে হয়। সূর্যের গতি অহোরাত্র একই রকম থাকে। এরপর সূর্য দক্ষিণ দিক থেকে পিছিয়ে আছে। তিনি বিষুবস্তিত হয়ে ক্ষীরোদ সমুদ্রের উত্তর সীমান্তে চলে আসেন।
এবার বিষুবমণ্ডলের পরিমাণ বিষয়ে যথাতত্ত্ব জ্ঞান প্রদান করছি শুনুন। বিষুবমণ্ডলের বিস্তারের পরিমাণ হল তিন কোটি একশত সহস্র একাশি যোজন, শ্রাবণ মাসে ‘চিত্রভানু’ নাম গ্রহণ করে সূর্য উত্তর দিকে সরে যান। সে সময় তিনি ষষ্ঠ শাকদ্বীপের উত্তর প্রান্তের সমস্ত দিক ভ্রমণ করে। উত্তরদিকের এই মণ্ডলের পরিমাণ এক কোটি আশি নিযুত আটান্ন যোজন।
উত্তরদিকস্থ ভাগের নাম ‘নাগবিথি’, দক্ষিণভাগের নাম ‘অজবীথি’, নাগবীথিতে অভিজিৎ, অজবীথিতে মূলা, উত্তরাষাঢ়া ও পূর্বষাঢ়া এবং পূর্বে স্বাতীর উদয় হয়ে থাকে। এই দুটি কাষ্ঠার মধ্যে ব্যবধান একলক্ষ একত্রিশ শত তেত্রিশ যোজন পরিমাণ। এই দুটি কাষ্ঠার মধ্যে এই যে যোজন পরিমাণ ব্যবধান তা এইভাবে যোজন দ্বারাই পরিমিত হয়ে থাকে। এবার দুই কাষ্ঠা ও দুই রেখার উত্তর ও দক্ষিণভাগে যে যোজন পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়ে আছে, তা শুনুন।
এদের প্রত্যেকের পারস্পরিক ব্যবধান হল একাত্তর নিযুত এক সহস্র পঁচাত্তর যোজন। দুই কাষ্ঠার বাহ্য ও আভ্যন্তর ভেদে দুটি রেখা বিদ্যমান। এর মধ্যে উত্তরায়নকালে সূর্যদেব অভ্যন্তর ভাগ এবং দক্ষিণায়ন কালে বাহ্যভাগ পরিভ্রমণ করে থাকেন। এই উত্তর ও দক্ষিণের ভ্রমণ স্থান একশত আশি মণ্ডল যোজন পরিমান এদের সংখ্যা হিসাবের কথা বললেন। আপনাদের কাছে বিষয়টি আরও প্রাঞ্জলে হয়ে উঠবে। যেমন–যোজন মণ্ডলের পরিমাণ হল একুশ সহস্র দুইশত একুশ যোজন। যোজন পরিমিত এই যে মণ্ডল এর নাম ‘বিঙ্কম্ভ’। সময়ে সময়ে এই বিঙ্কম্ভ আবার বক্রও হয়ে থাকে। মণ্ডল ক্রমানুসারে সূর্যদেব প্রতিদিন এই সমস্ত স্থান পরিভ্রমণ করেন।
তবে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণ ভেদে সূর্যের গতির তারতম্য ঘটতে দেখা যায়। উত্তরায়ণের সময় কুম্ভকারের চক্রের মধ্যভাগের মতো সূর্য মন্দ গতিতে আবর্তন করে। এই জন্য একই যোজন পরিমাণ স্থান অতিক্রম করতে দক্ষিণায়নের তুলনায় অনেক দীর্ঘ সময় ব্যয়িত হয়। উত্তরায়ণকালীন সূর্যের এই মন্দ গতির ফলে আঠারোটি মুহূর্তে একদিন হয়। আবার ভ্রমণকালের এই একদিনের মধ্যে দিনের বেলার সাড়ে ছয়টি নক্ষত্র এবং আঠারোটি মুহূর্তে এবং রাত্রিকালে আরও সাড়েছয়টি নক্ষত্র পরিভ্রমণ করে। অন্যদিকে দক্ষিণায়ণকালে সূর্যের গতি কুম্ভকারের চক্রের প্রাপ্তভাগের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সে সময়ে শীঘ্র আবর্তনের ফলে অল্পকাল সময়ের মধ্যেই সূর্য অনেক বেশি প্রকৃষ্ট স্থান অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। এই দক্ষিণায়নকালে সূর্য দিনেরবেলায় বারাটি মূহুর্তে সাড়ে ছয়টি নক্ষত্র এবং রাত্রিবেলায় আঠারোটি মুহূর্তে সাড়ে ছয়টি নক্ষত্র ভ্রমণ করে থাকে।
উভয় কাষ্ঠার মধ্যে মণ্ডল ভ্রমণের সময়ে সূর্যের মন্দগতি ও শীঘ্রগতি অনুসারে পর্যায় ক্রমিক ভাবে দিন ও রাত্রি অনুষ্ঠিত হতে থাকে। দক্ষিণায়নের সমর দিনের বেলায় সূর্যের শ্রীঘ্রগতি ও রাত্রিবেলায় মন্দগতি লক্ষ্য করা যায়। গতিবিশেষের এই তারতম্যের ফলে দিন ও রাত্রিতে বিভক্ত করে সূর্য সম্ভবে ও বিষমভাবে বিচরণ করে থাকেন।
লোকালোক পর্বতের চতুপার্শ্বে যে সকল লোকপাল গণ অবস্থান করেন, তাঁদের ওপরে অগস্ত্য গতিবিশেষ অনুসারে দিন ও রাত্রি বিধান করে বেগে বিচরণ করতে থাকে। লোকালোক শৃঙ্গের উত্তরে বৈশানর পথের বাইরে দক্ষিণ নাগবীথীতে ইনিই। লোক গণ্ডারক’ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। সূর্যপ্রভা এখানে সব জায়গায় সমানভাবে পতিত হয়। লোকালোক শৃঙ্গটি দশ সহস্র যোজন উন্নত। এর সব অংশ সমানভাবে দৃষ্ট হয় না। কিছু অংশ প্রকাশিত এবং কিছু অংশ অপ্রকাশিত থাকে।
এই সুউন্নত পর্বতশ্রেষ্ঠর অভ্যন্ত ভাগে সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি নিত্য প্রকাশমান এই জন্য পর্বতটির অভ্যন্তরভাগ ‘লোক অর্থাৎ প্রকাশিত বলে চিহ্নিত করা হয়। আর অপর অংশকে “নিরালোক” বা অপ্রকাশিত বলা হয়। এই লোক ভাগটি মাত্র একপ্রকার কিন্তু নিরালোক ভাগ বহু প্রকার। যে সময়ে সূর্যলোকালোক পর্বতের শৃঙ্গে-পড়ে অবস্থান করেন, সেই সময়কে সন্ধ্যা বলা হয়। এই সন্ধ্যা আবার ‘উষা’ ও ‘ব্যষ্টি’ এই দ্বিবিধ নামে প্রচারিত। রাত্রিকালীন সন্ধ্যার নাম ‘উষা’ এবং দিবাকালীন সন্ধ্যার নাম ‘বৃষ্টি’ উভয় সন্ধ্যাকালে যেসব পাপাত্মা রাক্ষস সূর্যদেবকে গ্রাস করেন তারা অক্ষয় দেহের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও প্রজাপতির আদেশে শাপগ্রস্থ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
পূর্ব কালে সন্দেহ নামে পরিচিত তিন কোটি সংখ্যক রাক্ষস প্রতিদিন সূর্যোদয়ের কামনায় প্রার্থনা করতেন। তারপর যখন সূর্য উদিত হত, সেইসময় নিপীড়ক দুরাত্মা রাক্ষসেরা সূর্যকে ভক্ষণ করার ইচ্ছা পোষণ করতেন। এর ফলে তাদের সাথে সূর্যের এক দারুণ লড়াই শুরু হত। তখন এই অবস্থার অবসানকল্পে প্রজাপতি ব্রহ্মা, বরেণ্য দেবগণ ও অতি সৎ ব্রাহ্মণগণ নিবিষ্ট মনে সন্ধ্যার উপাসন করতে থাকেন। তারা ওঁ-কার ও ব্রহ্মসংযুক্ত গায়ত্রী দ্বারা অভিমন্ত্রিত মহাজল বজ্ররূপ ধারণ করে এবং অমস্ত সূর্যগ্রাসী মহাজল বজ্ররূপ ধারণ করে এবং অমস্ত সূর্যাগ্রাসী দৈত্যকুল বিনষ্ঠ হয়। কিন্তু সেইদিন থেকে মহাতেজবান মহাদ্যুতিময় পরাক্রমী সূর্যের শতসহস্র যোজন ঊর্ধ্বে উদয় শুরু হয়। এবং সেই একই সময়ে কৃতার্থ বালখিল্য এবং মরীচি প্রভৃতি মুনি ও পুণ্যবান ব্রাহ্মণগণে পরিবৃত হয়ে তেজোময় ভগবান সূর্যের প্রয়াণ ঘটে।
পনেরো নিমেষে এক কাষ্ঠা ত্রিশ কাষ্ঠায় এক কলা, ত্রিশ কলায় এক মুহূর্ত এবং ত্রিশ মুহূর্তে এক এক দিবারাত্র গণিত হয়। দিবসের হ্রাসবৃদ্ধি অনুসারে এইসব মুহূর্তাদির সময় পরিমাণ ও সন্ধ্যার প্রাতঃকাল বলে। দিনের পাঁচ ভাগ সময় প্রাতঃকাল রূপে পরিগণিত হয়। প্রাতঃকালের পরে তিন মুহূর্ত পর্যন্ত সময় হল মধ্যাহ্ন কাল। মধ্যাহ্ন কালের পর তিন মুহূর্ত পর্যন্ত অপরাহ্ন কাল। অপরাহ্ন কালের পরবর্তী তিন মুহূর্ত কাল সায়াহ্ন কাল। এইভাবে তিন মুহূর্ত-বিভাগ অনুসারে একটি সমগ্র দিন, পঞ্চাদশ অর্থাৎ পনেরো মুহূর্ত বলে নির্দিষ্ট হয়ে আছে। সূর্যের বিষুবরেখার অবস্থান কালে এইভাবে পঞ্চদশ মুহূর্তে দিন গণনা করা হয়। দিন ও রাত্রি উভয় বেলাতেই তার কম পঞ্চাদশ মুহূর্ত হয়ে থাকে। কেবলমাত্র দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়ণের সময়ে দিন ও রাত্রি এই কাল বিভাগের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে থাকে। কেন না দক্ষিণায়ন বা উত্তরায়ণ যাই-ই হোক না কেন, ওই উভয় ক্ষেত্রে কখনও দিবাভাগ রাত্রিকে গ্রাস করে আবার কখনও রাত্রি দিবা ভাগকে গ্রাস করে।
পনেরো দিনে এক পক্ষ, দুই পক্ষে এক মাস, দুই মাসে এক ঋতু, তিন ঋতুতে এক অয়ন এবং দুই অয়নে এক বৎসর গণনা করা হয়। নিমেষাদি দ্বারাও কাল গণনা করা হয়ে থাকে, যেমন- পনেরো নিমেষে এক কাষ্ঠা হয়ে থাকে, আবার ত্রিশ কলায় এক কাষ্ঠা এবং একশো ষাট মাত্রাতেও এক কাষ্ঠা হয়ে থাকে। চার হাজার আটশো মাত্রায় বিদ্যুতি হয়ে থাকে। চারশো নব্বই বৈদ্যুতি এক বৈধ যুগ হিসেবে গণ্য হয়। একে চরাংশও বলা হয়ে থাকে। এই বিভিন্নতার জন্য নলিকা-কেই কারণ রূপে বিবেচনা করা হয়। সম্বৎসরাদি পাঁচটি বিভাগ চার প্রকার পরিমাণে হয়ে থাকে। এই পাঁচটি বিভাগের মধ্যে প্রথম বিভাগের নাম সম্বৎসর, দ্বিতীয় পরিবৎসর, তৃতীয় ঈদ্বৎসর, চতুর্থ অনুবৎসর এবং পঞ্চম কাল বৎসর। একটি যুগে সূর্যের একশো কুড়ি পৰ্বকাল পূর্ণ হয় এবং এক হাজার আটশো ত্রিশটি সূর্যোদয় অর্থাৎ সারন দিন অতিবাহিত হয়। যুগ কালের ঋতু সংখ্যা হল ত্রিশ, অয়ন সংখ্যা দশ এবং মাসের সংখ্যা আট। এরকম তিনটি অহোরাত্র একত্রিত হয়ে এক সৌরমাস হয়ে থাকে। সমস্ত ভুবন পরিক্রমা করে আসতে সূর্যের একশো তিরাশি দিন সময় লাগে। এই সময়কাল সৌর, সৌম, নক্ষত্র, সারন, এই চারটি পর্বে বিভক্ত। পুরাণেই এই নির্দেশ দেওয়া আছে।
শ্বেতদ্বীপের উত্তরদিকে এমন একটি পর্বত আছে যার তিনটি শৃঙ্গই নেভস্তলকে স্পর্শ করেছে। এই জন্যই এই পর্বতটি শৃঙ্গবান নামে সর্বলোকে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। অবশ্য পর্বতটি আরও তিনটি নামেও কীর্তিত হয়ে থাকে। যথা–একমার্গ, বিস্তার ও বিষ্কম্ভ। শৃঙ্গবান পর্বতটির ওই ত্রিশৃঙ্গ তিনটি আলাদা আলাদা ধাতু দ্বারা নির্মিত। প্রথম শৃঙ্গটি সুবর্ণমণ্ডিত, দক্ষিণ শৃঙ্গটি কৌল্যমণ্ডিত এবং তৃতীয় শৃঙ্গটি স্ফটিকপ্রভা বিশিষ্ট। এর মধ্যে উত্তর শৃঙ্গটি সর্বোত্তম। এটি সর্বরত্নে পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
শরৎ ও বসন্ত কালের মধ্যবর্তী সময়ে সূর্য মধ্যম গতি অবলম্বন করে। এ সময় মন্দগতিতে চলতে চলতে সূর্য যখন বিষুবরেখা শৃঙ্গের ওপরে অবস্থান করে তখন পৃথিবীতে দিন ও রাত্রি সমান হয়। ওই সময়ে ভগবান সূর্যের মহারথে নিযুক্ত দিব্য হরিবর্ণ অশ্বগুলিকে পদ্মরাগের মতো রক্তবর্ণ কিরণ লিপ্ত বলে মনে হয়। যদি মেঘ ও তুলারাশির শেষ ভাগে সূর্যের উদয় হয়, তবে দিন ও রাত্রি উভয়ই পনেরো মুহূর্ত করে হয়ে থাকে। যে সময় সূর্যদেব কৃত্তিকার প্রথম অংশে আসেন, সেই সময় চন্দ্র বিশাখার চতুর্থাংশে আছে বলে জানবেন। সূর্য যখন বিশাখার তৃতীয় অংশে যান, তখন চন্দ্র কৃত্তিকার শিরোভাগে আছেন বলে জানবেন। মহর্ষিগণ এই সময়কে বিষুবকাল বলে অভিহিত করে থাকেন। সূর্য ও চন্দ্র দ্বারা এই বিষুবকাল নির্দেশিত হয়ে থাকে। বিষুবকালে যখন দিন ও রাত্রি সমান হয়, তখন পিতৃগণ বিশেষত ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে দানাদি কর্ম অতি অবশ্যই করা উচিত। কারণ ব্রাহ্মণরাই হলেন দেবতাদের মুখপাত্র স্বরূপ। ব্রাহ্মণগণ ছাড়াও ঊনরাত্র, আর্মস, কলা, কাষ্ঠা, মুহূর্ত, পৌর্ণমাসী অর্থাৎ পূর্ণিমা, অমাবস্যা, সিনীবালী, কুহু, রাকা ও অনুমতি–এদের উদ্দেশেও অনুরূপ শ্রদ্ধার সঙ্গে দানকার্য করা বিধেয়।
বছরের বারো মাসের মধ্যে তিন-তিন ব্যবধানে পর্যায়ক্রমে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণ ঘটে থাকে। বৎসরের শুরুতে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ আষাঢ়, ও শেষে মাঘ ফাল্গুন ও চৈত্রে সূর্যের উত্তরায়ণ চলে এবং শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ এই ছয়মাস দক্ষিণায়ণ চলে। হে মহাত্মা ব্রহ্মপুত্রগণ, এইভাবে সম্বংসরাদি পঞ্চাব্দ ও ধাতুগুলিকেও জানতে হবে। ধাতুগুলিকে ‘অন্তরা’ নামেও ডাকা হয়ে থাকে।
এতক্ষণ আমি আপনাদের যে সমস্ত তত্ত্বজ্ঞান প্রদান করলাম, তা অতিমূল্যবান। মানুষ এইসব জ্ঞান লাভ করার পরে আর দৈবকার্যে ও পিতৃকার্যের প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে না। এই কারণে পুণ্যকামী প্রজারা সর্বত্রগামী ‘বিষুবতত্ব’ কে সর্বদা স্মরণ করে থাকেন। অমাবস্যাদি যে ঋতুসুখ পর্বের অন্তর্গত তা থেকে দেব ও পিতৃগণের হিতকারক বিষুবকাল উৎপন্ন হয়।
আগেই উল্লেখ করেছি, যে সমস্ত স্থান আলোকে প্রকাশিত হয়, সেইসব স্থান ‘লোক’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। লোক ও আলোকের মধ্যবর্তী স্থানে লোকপালক লোকপাল গণ অবস্থান করেন। তাদের মধ্যে কেবল চারজন মহাত্মা লোকপাল প্রলয়কাল না আসা পর্যন্ত অবস্থান করেন। কয়েকজন খ্যাতনামা লোকপাল হলেন–সুধামা, বৈরাজ, কর্দম, শঙ্কপ, হিরণ্যলোমা, পজন্য, কেতুমাল ও জাতনিশ্চয়। এরা প্রত্যেকই শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্বজ্ঞানবর্জিত, নিরভিমান, তন্দ্রাবিহীন ও পরিগ্রহ হীন।
অগস্ত্যের উত্তরদিকে, অজবীথীর দক্ষিণে এবং বৈশ্বানর পথের বাইরে পিতৃযান নামে একটি পথ। আছে। সেই পিতৃযান পথের পথে পথে প্রজাবান ও প্রজাবর্ধক অগ্নিহোত্র মুনিরা বসবাস করেন। দক্ষিণ পিতৃযানে বসবাসকারী এই সব মুনিরা পৃথিবীর বিপুল ভার বহন করেন। তারা আশীর্বাদের দ্বারা ঋত্বিক সুলভ কর্ম সম্পাদন করেন। এরা প্রজাসৃষ্টিতেও একই রকম অভিলাষী, এঁরা প্রজাবৃদ্ধি, তপস্যা, মর্যাদা, শাস্ত্রচর্চা প্রভৃতির দ্বারা বিচলিত ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেন। এঁদের মধ্যে পূর্ববর্তী মুনিরা পরবর্তী মুনিদের স্থানে জন্মলাভ করেন। অর্থাৎ পরবর্তী মুনীদের মৃত্যু হলে পূৰ্ব্বতী মুনিরা আবার তাদের স্থানে আবির্ভূত হন। এইভাবে পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন অনুসারে এইসব অগ্নিহোত্র মুনিরা প্রলয়কাল পর্যন্ত অবস্থান করে থাকেন।
চন্দ্রমণ্ডল ও তারকামণ্ডল সূর্যের দক্ষিণমার্গে অবস্থান করছে। এখানে প্রায় অষ্টআশি সহস্র শ্মশানবাসী মুনি বাস করেন। লোকব্যবহার ভূতারম্ভকর্ম, ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রকৃতি, মৈথুন ইত্যাদি কায়কৃত কার্যাবলী ও বিষয় সেবা দ্বারা এঁরা সিদ্ধপ্রাপ্ত হন এবং শ্মশান অবলম্বন করেন। এই সমস্ত প্রজাভিলাষী শ্মশানবাসী মুনিগণ শেষবার দ্বাপর যুগে সত্যভূমিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
‘দেবযান’ নামে পরিচিত নাগবীথীর উত্তরদিকে ও সপ্তর্ষিমণ্ডলের দক্ষিণে যে পথ রয়েছে তা ‘সূর্যের উত্তরপথ’ বলে অভিহিত হয়ে থাকে। এই পথে বিমলচিত্ত, সিদ্ধ ব্রহ্মচারীরা বাস করে থাকেন। এরা সর্বদাই পাপ ভয়ে ভীত ও মৃত্যুঞ্জয় হয়ে থাকে। এইসব ঊর্ধরেতাঃ মুনিদের সংখ্যাও অষ্টআশি সহস্র, তাঁরাও প্রলয়কাল পর্যন্ত উত্তরপথেই অবস্থান করেন। এঁরা যে সমস্ত শুদ্ধাচার পালন করেন সেই কারণহেতুই এঁরা প্রলয়কাল পর্যন্ত অমরত্ব লাভ করে থাকেন। এ-ই হল এঁদের ত্রৈলোক্য অবস্থান কাল। অন্তর্বর্তী সময়ে এঁরা অন্যমার্গে গমন করেন না। কিন্তু ব্রহ্মহত্যা বা অশ্বমেধ প্রভৃতি পাপপুণ্য অনুষ্ঠান পালন করলে এই সব ঊর্ধরেতা মুনিদেরও প্রলয়ান্তে ক্ষয় হয়ে থাকে।
ওপরে বর্ণিত এই ঊর্ধরেতা ঋষিদের বিচরণক্ষেত্র হল উত্তরভাগে অবস্থিত ধ্রুবলোক। এই লোক আকাশমার্গে সমুজ্জল হয়ে আছে। এই স্থান তৃতীয়লোক বলেও বর্ণিত হয়ে থাকে। বিষ্ণুপর পরমপদ এই ধ্রুবলোক। যেতে পারলে আর শোকাদি থাকে না। এই লোকে কেবল ধার্মিক মাধকরা বাস করে থাকেন।
.
৪৫.
মহাজ্ঞানী পুরাণজ্ঞ সূত বললেন, স্বায়ম্ভর সৃষ্টির সময়কার অতীতে ঘটিত ও ভবিষ্যতে ঘটিতব্য ঘটনাগুলির ব্যাখ্যান এখানেই সমাপ্ত হল। এবার আমি এসবের আনুমানিক বিবরণ দেব।
সূতকণ্ঠের এই ভাষণ শুনে সেইসব ব্রহ্মবাদী মুনিঋষিরা তাকে সূর্য, চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহদের বিষয়ে সর্বপ্রকার সঞ্চারণ বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। ঋষিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে লোমহর্ষক, আপনি আমাদের বলুন কীভাবে এইসব জ্যোতিষ্ক পদার্থ বক্র ও পরস্পর পৃথকভাবে ভ্রমণ করে? এরা কি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভ্রমণ করে নাকি কেউ এদের দিয়ে ভ্রমণ করায়? হে সাধুর্বর, এ বিষয়ে আমরা অধিক কিছু জানতে ইচ্ছা করি, আপনি আমাদের বিস্তারিতভাবে সবকিছু বলুন।
সূতপুত্র লোমহর্ষক বললেন, এই বিষয়টি সম্পর্কে যা কিছু আমার জানা আছে, সে সবই বলছি। এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেও প্রজাদের সম্মোহিত অবস্থা হয়।
আকাশ মণ্ডলের চারিদিকে বিস্তৃত রয়েছে শিশুমার পুচ্ছ। এই পুচ্ছমধ্যে উত্তান পাদপুত্র মেধাভৃতধ্রুব নামে এক নক্ষত্র আছে। এই ধ্রুব নিজে যেমন ভ্রমণ করে, তেমনি সূর্য, চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহরাজিকেও ভ্রমণ করায়। কারণ ধ্রুব নক্ষত্র ভ্রমণ করতে থাকলে অন্যান্য নক্ষত্রগুলোও সেই ধ্রুব নক্ষত্রকে চক্রের মতো অনুসরণ করে।
বাস্তবিক অর্থে ধ্রুব নক্ষত্রের গতি অনুসরণ করেই সূর্য, চন্দ্রমা, তারা, নক্ষত্র ও গ্রহ ভ্রমণ করতে থাকে। তারা বায়ুস্তূপরূপে রঞ্জু দিয়ে ধ্রুব নক্ষত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আছে। সুতরাং ধ্রুব থেকেই তাদের যোগ-বিয়োগ, অস্ত-উদয়, কাল সঞ্চারণ উৎপাত, দক্ষিণাপন, উত্তরায়ণ, বিষ্ণুবর্ত ও গ্রহবর্ণ সংঘটিত হয়ে থাকে। এছাড়া বর্ষা, গ্রীষ্ম, শীত কিংবা রাত্রি, সন্ধ্যা, দিন ইত্যাদি যা কিছু প্রাকৃতিক পরিবর্তন এবং শুভাশুভাদি সবকিছুই ধ্রুব থেকেই হয়ে থাকে। এমনকি গ্রহাদি সকলও ধ্রুব দ্বারা অধিকৃত, সূর্য পর্যন্ত ধ্রুব দ্বারা আবৃত হয়ে থাকেন। এইভাবে আবৃত্ত থাকার কারণেই সূর্য দীপ্তিকিরণ ও কলাগ্নি স্বরূপ হয়ে, দিবাকর হতে পেরেছেন এবং পরিবর্তন সাপেক্ষে দীপ্তিপুঞ্জের দ্বারা চারিদিক আলোকিত করছেন। হে বিপ্রশ্রেষ্ঠগণ, শুনে রাখুন, সূর্যই সর্বব্যাপী বায়ুযুক্ত কিরণজালে সমগ্র জগতের জল গ্রহণ করে থাকেন। সূর্যযোগ চন্দ্র থেকে যে জল নিঃসৃত হয়, তা প্রথমে চন্দ্রের অগ্রভাগে অবস্থান করে। তারপর বায়ুস্রোতের জোরালো আঘাতের ফলে মেঘসমূহের দ্বারা সেই জল পৃথিবীতে বর্ষণ করে। অর্থাৎ প্রথমে জল উৎক্ষিপ্ত হয়, তারপর আবার সেই জল উৎসস্থলে বা নীচে ফিরে আসে। এই ভাবে নানা প্রকারে জল পরিবর্তিত হতে থাকে। বিশ্বব্যাপী এই যে মায়ার খেলা চলছে, এসবই প্রাণীদের প্রতিপালনের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বচরাচর এই মায়া দ্বারা ব্যাপ্ত হয়ে আছে, সূর্যই এসব কিছুর মূল। তাই সূর্যকে বিশ্বেশ্বর বিধাতা, বিষ্ণু, সমগ্র লোকের প্রভু, দিবাকর, লোকস্রষ্টা ঈশ্বর, সহস্রাংশু প্রজাপতি, প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
আকাশে বিরাজিত চন্দ্র থেকেই এই সর্বলৌকিক জল নিঃসৃত হয়। সে কারণে সমস্ত দৃশ্যমান জগৎ “সমাধার” নামে কীর্তিত হয়ে থাকে। সূর্য থেকে উষ্ণতা এবং চন্দ্র থেকে শীতলতার উৎপত্তি ঘটে থাকে। এই কারণে সূর্যকে ‘উষ্ণবীর্য এবং চন্দ্রকে ‘শীতবীর্য’ বলা হয়ে থাকে। এই চন্দ্র ও সূর্যই কিন্তু আমাদের জগৎকে ধারণ করে রেখেছে।
হে দ্বিজোত্তমগণ, গঙ্গা নদীর বিষয়ে আমি আপনাদের আগেও বলেছে। এই পবিত্র গঙ্গা নদীকে সোমের আধারস্বরূপ কল্পনা করা হয়। গঙ্গা অন্যান্য মহানদী সমূহের মধ্যে অগ্রণী।
সমস্ত প্রাণীর শরীরে জলরাশি সঞ্চিত হয়ে আছে। চরাচরাদি অগ্নিজালে দগ্ধ হবার সময়ে সেই সঞ্চিত জলরাশি ধূম্ররূপে বায়ুতে মিশে যায়। তাই থেকে মেঘ জন্মায়। এই মেঘই হল সকল জলরাশির উৎস স্থান। সূর্যকিরণ ভূতবর্গের দেহ থেকে জল গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে রশ্মিসমূহের দ্বারা জল গৃহীত হয়। এছাড়া সমুদ্র থেকেও বায়ু সংযোগের মাধ্যমে সূর্য জল গ্রহণ করে থাকে। সূর্য রশ্মির তেজ ঋতুভেদে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। শুক্লরশ্মিজাল সমূহের মাধ্যমে মেঘ থেকে শুক্লজলরাশিই সিঞ্চিত হয়ে থাকে ও মেঘস্ফিত জলরাশি বায়ু দ্বারা চালিত হয়। তারপর আবার বায়ুবশেই সমস্ত প্রাণীর মঙ্গলের জন্য ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। সমস্ত প্রাণীর বৃদ্ধি যাতে ঠিকমতো হয়, তাই বৎসরের মধ্যে ছয়মাস বর্ষণ হয়ে থাকে। মেঘের গর্জন কিংবা বিদ্যুতের অগ্নি–এই দুটি ঘটনার নিমিত্ত বায়ু ক্ষরণ হয় বলেই ক্ষরনার্থক মিশ্র ধাতু থেকে মেঘ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। উৎপত্তি অনুসারে মেঘকে তিনভাগে ভাগ করা যায়–আগ্নেয়, ব্রহ্মাজ ও পঙ্কজ। আমি এই তিন প্রকারের মেঘের উৎপত্তি সম্পর্কে আপনাদের সবিশেষ বলব।
আগ্নেয় মেঘের উৎপত্তি হয় সমুদ্র থেকে। এই মেঘ ‘অনর্জ’ নামেও সমধিক প্রসিদ্ধ। আগ্নেয় মেঘের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল–শৈত্য, গতিময়তা ও প্রবহন ওই মেঘ থেকেই এদের উৎপত্তি। এই পৃথিবীতে অনেক মাতঙ্গগামী মহিষ ও শূকর প্রভৃতি জন্তু জন্মায়, বিচরণ করে, ও রমণ করে থাকে। মেঘকেই এই সমস্ত জীবের উৎপত্তির কারণ স্বরূপ বলা হয়। এজন্য মেঘের অপর নাম জীমূত’। এই জীমূত মেঘের কিন্তু বিদ্যুৎ গুণ নেই। এবং এই জীমূত মেঘ জলধারায় লম্বিত হয়ে বর্ধিত হয়। এক ক্রোশ বা অর্ধ ক্রোশ স্থান জুড়ে এই মেঘের বর্ষণ হয়ে থাকে। বিশেষ করে গগনস্পর্শী সুউচ্চ পর্বতের শিখরদেশে ও নিতম্ব দেশে আগ্নেয় মেঘসষ্ণুতে বর্ষণ ও রক্ষণ হয়ে থাকে। বলাকা শ্রেণীর গর্ভধারণ করায় বলে এই মেঘ ‘বলাকা গৰ্ভদ’ নামেও সমধিক প্রসিদ্ধ। এইসব মেঘ শব্দহীন মহাকাৰ্য ও প্রবাহের বশীভূত।
দ্বিতীয় প্রকার মেঘ হল ব্রহ্মাজ মেঘ। ব্রহ্মার নিঃশ্বাস বায়ু থেকে উৎপন্ন হয় বলে এর এরকম নামকরণ হয়েছে। এই মেঘের গর্জন ব্রহ্মার খুব প্রিয়। এই মেঘ বিদ্যুৎ গুণযুক্ত হওয়ায় বর্ষণের সময় প্রবল শব্দ করতে থাকে। এই শব্দ শ্রবণ করে ভূমির অঙ্কুরোদগম ঘটে, ভূমি রাজ্যভিষিক্তা রাজ্ঞীর মতো পুনর্যৌবন লাভ করে। এই নবযৌবনবতী ভূমির প্রতি জীমূত মেঘের স্বতঃস্ফুর্ত প্রীতির সঞ্চার ঘটে। ফলে তা ওই ভূমির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে তার ওপরে বারিবর্ষণ ঘটায়। এর ফলে তা থেকে বিবিধ প্রাণীর জীবন সঞ্চার হয়ে থাকে। ব্রহ্মাজ মেঘ ‘প্রবাহ’ নামক দ্বিতীয় বায়ু অবলম্বন করে থাকে। এবং সপাদ এক যোজন অর্থাৎ সওয়া এক যোজন স্থান জুড়ে বর্ষণ ও ধারাসার দান করে থাকে।
পক্ষ থেকে যেসব মেঘের উৎপত্তি ঘটে, তাদের পক্ষজ মেঘ বলা হয়। এদেরকে ‘পুষ্করাবর্তক’ নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। অনেক কাল পর্বতরা যথেচ্ছগামী এবং খেয়ালী প্রকৃতির ছিল। তাই প্রাণীদের মঙ্গল কামনায় দেবরাজ ইন্দ্র এইসব মহাতেজাঃ যথেচ্ছ গামী পার্বতদের পক্ষ ছেদন করেন। সেই কর্তিত পক্ষ থেকে একটি বৃহৎ জলভরা মেঘ উৎপন্ন হয়। সেই কারণে পক্ষ মেঘের নাম শুষ্করাবর্তক রাখা হয়েছে। এই সব অতিঘোরতর মেঘ নানারকম রূপ ধারণ করতে পারে। এইসব মেঘ ‘তৃতীয়মেঘ’ নামেও উল্লিখিত হয়ে থাকে।
মেঘ সম্পর্কিত আলোচনায় একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। যারা সাধারণভাবে অংশ থেকে উৎপন্ন, তারাও মেঘ বলেই প্রসিদ্ধ। ধূম নির্বিশেষে সমস্ত মেঘেরই পক্ষ মেঘ অনেক রূপ ধারণ করে মহীতলাকে পূর্ণ করে, ও পরবায়ুকে প্রবাহিত করায়। সেই কারণে এই ধরনের মেঘ দেবতাদের আশ্রিত এবং কল্পসাধক। পরিবর্ধক। এই সমস্ত মেঘের মধ্যে পর্জন্যই শ্রেষ্ঠ মেঘ। তাই চারপ্রকার মেঘকেই দিগগজ বলে।
গজ, পর্বত, মেঘ ও সর্পদেব কুল ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু এক জলই এদের উৎপত্তির কারণ। গর্জন্যও শীতদ্ভূত দিগগজরা হেমন্তকালে সমস্ত শস্যের বৃদ্ধির জন্য তুষারবৃষ্টি ঘটিয়ে থাকে।
‘পরিবহ’ বায়ুকে বায়ুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা হয়। এই বায়ু হল ভগবান স্বরূপ, আকাশস্থিতা বিদ্যাস্বরূপা বিপুলোদক স্বর্গপথপ্ৰবাহিণী পুণ্যসলিল দিব্য গঙ্গাকে এই পরিবর্ত বায়ু-ই ধারণ করে থাকে। ওই স্বচ্ছসলিলা গঙ্গার উচ্ছ্বাস সঞ্জাত জল দিগজেরা নিজেদের স্কুল খুঁড় দিয়ে গ্রহণ করে জলকণা রূপে দূরে নিক্ষেপ করে। এই নিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণাকে ‘নীহার’ বলা হয়।
উত্তরদিকে অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণভাগে ‘হেমকূট’ নামে একটি পর্বত আছে। ওই পর্বতের পাদদেশে পুন্ডু নামে এক নগর আছে। পুন্ডু নগরে প্রচুর পরিমাণে তুষারগলা জল এসে পড়ে।
হিমশৈলের তুষারাবৃত শিখর দেশ বায়ু প্রবাহের মাধ্যমে তা মহাগিরিতে সেচিত হয়। হিমালয় গিরিশালা অতিক্রম করার পর অন্যান্য ভূখণ্ডের বৃদ্ধির জন্য ওই জল এদিকে আসে। এইভাবে উত্তরোত্তর মেঘ ও জলের বৃদ্ধি ঘটায়।
সূর্যই বৃষ্টিরাশির স্রষ্টা হিসেবে নির্দিষ্ট হয়ে থাকেন। সূর্য ধ্রুব দ্বারা বেষ্টিত হয়ে থাকেন। ফলে সূর্য ও ধ্রুব উভয় থেকেই বৃষ্টি হয়ে থাকে বিপরীত দিকে। বায়ু ধ্রুব দ্বারা আবেষ্টিত হয়ে বৃষ্টির সংহার ঘটায়। সূর্য থেকে সমস্ত নক্ষত্রমণ্ডল নিঃসৃত হবার পর তারা আবার ধ্রুব পরিবেষ্টিত সূর্য মধ্যে প্রবেশ করে।
এরপর আমি সূর্যরথের সন্নিবেশ সম্পর্কে যথাসম্ভব তত্ত্ব প্রদান করছি, শুনুন।
ভগবান সূর্য যে রথে চড়ে ভ্রমণ করেন, এককথায় তার তুলনা মেলা ভার। রথটিতে একটি চক্র, পাঁচটি অর, তিনটি নাভি, পথের অন্ধকার বিনাশী ছয় প্রকার নেমি আছে। একাধিক পর্বে বিভক্ত এই রথ সুবর্ণ দ্বারা নির্মিত হয়েছে। মহাতেজস্বী এইরকম প্রোজ্জ্বল রথেই ভগবান সূর্য পরিভ্রমণ করেন। ইষাদণ্ড প্রমাণানুসারে এই রথের বিস্তার পরিমাণ দশ সহস্র যোজন, এবং দৈর্ঘ্য পরিমাণ এর দ্বিগুণ। এই রথের স্রষ্টা হলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। প্রথম অবস্থায় কাঞ্চনময় এই দিব্য রথ সঙ্গহীন থাকে। তারপর প্রয়োজনানুসারে রথটিতে অতিবেগবান অশ্বদের যোজিত করা হয়। এই রথে অশ্বরূপ ছন্দোরাজি নিয়োজিত আছে। সূর্যরথের পূর্বোক্ত প্রত্যঙ্গগুলি সম্বৎসারের অবয়ব রূপে কল্পিত হয়ে থাকে। যেমন সূর্যের নাভি হল দিন, যা এখানে এক চক্র হিসাবে নিরূপিত হয়েছে। ঋতুরা হল তাঁর পঞ্চ অর এবং ছয় ঋতু এর ছয়টি নেমি, অব্দ হল বর্তনীড়, অয়ন দুটি হল কবীর। মুহূর্তগুলো হল বন্ধুর সমূহ, কলানিচয় হল শয্যা, সমস্ত কাষ্ঠা হল যোনি, ক্ষণসমূহ ঈষাদণ্ড, নিমেষ সমূহ অনুকর্য। এছাড়া সমস্ত লবকে ঈষা রূপে জ্ঞান করতে হবে। রাত্রিকে স্বীকার করতে হবে বরূথ রূপে। দিন হল এর সদান্নত ধ্বজ। অর্থ ও কোম হল যুগাক্ষ কোটি, ছন্দোরূপী সাতটি অশ্ব সুবর্ণময় সূর্য রথকে বহন করে চলে। অশ্বগুলি হল–গায়ত্রী ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ, জগতী পংক্তি, বৃহতী ও উষ্ণিক, অক্ষে চক্র নিবদ্ধ থাকে আর সেই অক্ষ আবার ধ্রুবের সাথে আবদ্ধ থাকে। অক্ষ যেমন চক্রের সাথে ঘোরে, তেমনি ধ্রুব অক্ষের সাথে ঘোরে। এককথায় বলা যায় ধ্রুব দ্বারা চালিত হয়েই ওই অক্ষ চক্রের সাথে ঘোরে।
সূর্যরথের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে এইরকম বিরল সন্নিবেশ ঘটে গেছে এবং এর সংযোগভাগে উজ্জ্বল রং সংসিদ্ধ হয়ে আছে। এই জন্যই আকাশপথে সূর্যকে এত দ্রুত বেগে গমনাগমন করতে দেখা যায়। রথের দুই রশ্মি রথের যুগ ও অঙ্গকোটির সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। ধ্রুবের ভ্রমণ ক্রমে ক্রমে চক্র ও যুগের দুটি রশ্মিও সমান তালে ভ্রমণ করতে থাকে। তখন তার সঙ্গে সঙ্গে আকাশচারী রথের মণ্ডলও আবর্তন করতে থাকে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে, সূর্যরথের দক্ষিণভাগে যুগ ও অক্ষকোটি নিবদ্ধ রয়েছে। দ্বিচক্রের শ্বেতরঙ্গুর মতো ওই দুটি পদার্থ ধ্রুব দ্বারা গৃহীত হয়ে থাকে। এর ফলে ধ্রুব ভ্রমণ করতে থাকলে ওই রশ্মি দুটি ভ্রমণ করতে থাকে। একই সময় যুগ ও অক্ষকোটি ওই রশ্মি দুটিকে এবং বার্তোমি ওই রথকে অনুসরণ করে। লক্ষ্য করলে দেখবেন কীলক অর্থাৎ কাঠের গোঁজে কোনো রঞ্জুকে আবদ্ধ করলে তা সবদিকে ঘোরে। একই নিয়মে সূর্যমণ্ডলের উত্তরায়ণের সময়ে ওই রশ্মিদুটি হ্রাস পায় এবং দক্ষিণায়ন কালে বৃদ্ধি পায়। ধ্রুব দ্বারা গৃহীত রশ্মিদুটি সূর্যকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণের টানে সূর্য তাদের মাঝখানে মণ্ডলক্রমে ভ্রমণ করতে থাকে। রশ্মিদুটি যতক্ষণ পর্যন্ত ধ্রুব দ্বারা মুক্ত না হয় ততক্ষণ সূর্যকে দুই কাষ্ঠার মাঝখানে পরিভ্রমণ করে যেতে হয়। এইভাবে সূর্য আশিশত মণ্ডল ভ্রমণ করে ফেলেন, তারপর বাইরের দিকের মণ্ডল বেষ্টন করে তির বেগে ভ্রমণ করতে থাকেন।
.
৪৬.
পূর্ব প্রসঙ্গের সূত্র ধরে সূত্র বলতে লাগলেন, এই অনিন্দ্যসুন্দর সূর্যরথে সূর্যদেব একা নন, আদিত্য দেবতা, ঋষি, গন্ধর্ব, অপ্সরা, যক্ষ, গ্রামমীন, সর্প ও রাক্ষস–সকলেই অধিষ্ঠিত আছে। ধাতা ও অর্যমা, পুলস্ত্য ও পুলই প্রজাপতি, বাসুকি ও সংকীর্ণার নামে দুই সর্প, গায়কশ্রেষ্ঠ তুমুর ও নারদ, ক্রতুস্বলা ও পুঞ্জিকস্বলা নামে দুই অপ্সরা, রথকৃচ্ছ ও তপোর্য নামে দুই যক্ষলতা, হোত ও প্রহেতি নামে দুই রাক্ষস এবং পূর্বোক্ত আদিত্য দেবতা প্রভৃতি সপ্তগণ চৈত্র ও বৈশাখ মাসব্যাপী সূর্যমণ্ডলে পর্যায়ক্রমে অবস্থান করেন। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে মিত্র ও বরুণ নামে দুই দেবতা সূর্যমণ্ডলে বাস করেন। এছাড়া অত্রি ও বশিষ্ট এই দুই ঋষি, তক্ষক ও রম্ভ নামে দুই সর্প, মেনকা ও সহজন্যা নামে দুই অপ্সরা, হাহা ও হুহু এই দুই গন্ধর্ব, রথস্বন ও রথচিত্র নামে দুই যক্ষ, পৌরুষেয় ও ধব নামে দুই রাক্ষস সমস্ত জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাস ধরে সূর্যমণ্ডলে অধিষ্ঠান করে থাকেন, শ্রাবণ ও ভাদ্রমাসে যথাক্রমে ইন্দ্র ও বিবস্বান দেবতা, অঙ্গিরা ও ভৃগু ঋষি, এলার্ন ও শঙ্খপাল নামে সর্প, বিশ্বাবসু ও উগ্রসেন নামে দুই গন্ধর্ব প্রতি ও তরুণ নামক যক্ষ, প্রশ্নেচা ও নিম্নেচা নাম্নী দুই তাপরূপা অপ্সরা, সর্প ব্যাঘ্র ও শ্বেত নিশাচর এবং আদিত্য দেবাদি সপ্তগণ সূর্যদয়ে সাড়ম্বরে অবস্থান করে থাকেন। আশ্বিন ও কার্তিক মাসে সূর্যরথে অধিষ্ঠান করেন। ভরদ্বাজ ও গৌতম ঋষি, বিশ্বাবসু ও সুরভি গন্ধর্ব, সুষেন যক্ষ, আপ ও বলাত রাক্ষস, সেনানী সেনজিৎ ঐরাবত ও ধনঞ্জয় নামক সর্প, সুন্দরী শ্রেষ্ঠা বিল্বাচী ও ঘৃতাচী নাম্নী অপ্সরা এবং লোকবলিত পর্জন্য ও পুষা দেবতা। হেমন্ত ঋতু এলে সূর্যমণ্ডলে বাস করতে আসেন অংশ ও ভগ নামে দুই দেবতা, ঋষিবর কশ্যপ ও ঋতু, মহাপদ্ম ও কর্কোটক নামে দুই সর্প, চিত্রসেন ও ঊর্ণায়ু নামে দুই গন্ধর্ব ঊর্বশী ও বিচিত্তি নামে দুই অপ্সরা, তাক্ষ্য অরিষ্টনেমি যক্ষ এবং দুই মহাবলবান রাক্ষস বিদ্যুৎ ও ফুর্জ। এরপর আসে শীত ঋতু। যে সময় সূর্য মণ্ডলের অধিকার চলে যায় ত্বষ্টা ও বিষ্ণু নামে ঋদ্ধ দুই দেবতা, জমদগ্নি ও বিশ্বামিত্র নামে দুই ঋষি, কদ্রুপুত্র কম্বল ও অশ্বতর নামক দুই সর্প, তিলোত্তমা ও রম্বা নামে দুই অপ্সরা, ধৃতরাষ্ট্র ও সূর্যবৰ্চ্চা নামে দুই গন্ধর্ব, ঋতজিৎ ও সত্যজিৎ নামে দুই লোক বিখ্যাত যক্ষ ব্রহ্মোপেত ও যজ্ঞোপেত নামে দুই কৃতবিদ্য, দক্ষ প্রমুখের হাতে। শীতকালে এঁরাই সূর্যরথে অবস্থান করেন।
এই উল্লেখিত বারোটি সপ্তকের মধ্যে যাঁরা স্থানাভিমানী তারা নিজ নিজ তেজে সূর্যদেবের উত্তম তেজের আরো বেশি বৃদ্ধি ঘটান। ঋদ্ধ মুনিগণ প্রসিদ্ধ স্তোত্রের দ্বারা সূর্যের বন্দনা করেন। গন্ধর্ব ও অপ্সরাগণ নৃত্যগীতের দ্বারা সূর্যের উপাসনা করেন। যক্ষ্য ও ভূতবৃন্দ সূর্যরথের রশ্মি যোজনা করেন। সর্পগণ সূর্যদেবকে বহন করেন, রাক্ষসগণ তাকে অনুগমন করেন, বালখিল্যগণ উদয়াবধি সূর্যের পরিচর্যা করে তারপর তাকে সসম্মানে অস্তাচলে নিয়ে যায়।
এইভাবে উপাসক দেবতারা যার যেমন সাধ্য–যেমন–বীর্যধারী তপস্যা, যোগবল, সত্য, ধর্ম ও বল, তিনি তদনুসারে সূর্যদেবের সেবা করেন। পরিবর্তে সূর্যদেবও তাদের প্রদত্ত সেই সেই বীর্যাদি দ্বারা পুষ্ট হয়ে সমধিক তাপ প্রদান করেন। দেবতা, অপ্সরা, যক্ষ, গন্ধর্ব, ঋষি, সর্প ও রাক্ষসগণ–এঁরা প্রত্যেকেই একাদিক্রমে দুই দুই মাস কালব্যাপী সূর্যমণ্ডলে অবস্থান করেন। ক্ষমতা অনুযায়ী তাপ দেন, বর্ষণ করেন, আলো দেন, প্রবাহিত হন ও সৃষ্টি করেন। কথিত আছে, এঁরা প্রাণীকুলকে অশুভকর্ম হতে বিদূরিত করেন। এঁরা দুরাত্মা মানুষদের মঙ্গল হতে দেন না। অবশ্য কোথাও কোথাও সাধু সজ্জন ব্যক্তিদের অমঙ্গলও হরণ করেন। এঁরা যথেচ্ছগামী, দিব্য বিমানে চড়ে যখন যেখানে খুশি যেতে পারেন। এঁদের গতি পবন গতিতুল্য। এঁরা প্রতিদিন সূর্যদেবের সাথে নির্দিষ্ট দূরত্ব ভ্রমণ করেন। এঁরা মন্বন্তর না আসা পর্যন্ত সমস্ত প্রাণীদের সকল প্রকার দুর্যোগ হতে রক্ষা করেন। এবং এই অন্তর্বর্তী সময়ে কাম্য বর্ষণ ও তাপ দিয়ে প্রজাবৃন্দের মনে আনন্দ প্রদান করেন। এঁরা স্থানাভিমানী, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ–এই ত্রিকালের বিভিন্ন মন্বন্তরে এঁরা সেই পূর্ব নির্ধারিত স্থানেই অবস্থান করেন। এইভাবে ওই সপ্তকবৃন্দ চোদ্দটি মন্বন্তরেই সূর্যকে আবেষ্টন করে বাস করে থাকেন।
কালের গতি ও ঋতুভেদে সূর্যরশ্মির পরিবর্তন ঘটে থাকে। গ্রীষ্ম, বর্ষা বা হিমকালে যথাক্রমে উষ্ণতা, বৃষ্টিপাত ও শীতলতা প্রদান করে ভগবান সূর্যদেব মনুষ্যগণ, দেবগণ ও পিতৃগণের তৃপ্তি বিধান করে থাকেন। এইভাবে সূর্যদেব একদিকে যেমন অমৃতের দ্বারা দেবতাদের প্রীত করেন, তেমনি শুক্লপক্ষে সুষুম্ন রশ্মি দিয়ে প্রতিদিন চন্দ্রকে বর্ধিত করেন। কৃষ্ণপক্ষে দেবতাগণ সেই সোমরস আকণ্ঠ পান করেন। দেবতাদের দ্বারা এইভাবে প্রীত হবার ফলে কৃষ্ণপক্ষ ক্রমশ ক্ষয় পেতে থাকে। শেষে চন্দ্রের মাত্র দুটি কলা অবশিষ্ট থাকে। চন্দ্র সেই অবশিষ্ট দুই কলার রশ্মিসমূহের দ্বারাই ক্ষরিত হতে থাকলে পিতৃগণ সেই সুধাময় চন্দ্রকে পান করতে শুরু করেন। দেবতাগণ ও সৌম্যরাও সেই একইভাবে কব্য পান করে থাকেন।
সূর্যদেব তাঁর প্রখর রশ্মি সমূহের সাহায্যে মহীর জল আহরণ করে আবার তা পৃথিবীতে বর্ষণ করেন এবং পৃথিবী প্লাবিত হয়। এর ফলে ওষধির বৃদ্ধি ঘটে। মর্তবাসী প্রজাগণ অন্নাদি ভক্ষণ করে নিজেদের ক্ষুধা নিবৃত্তি করে থাকেন, প্রাচীন পন্ডিতগণের হিসাব অনুযায়ী দেবতাগণ অমৃত পানের মাধ্যমে এক পক্ষ, পিতৃগণ স্বধাপানের মাধ্যমে এক মাস এবং মনুষগণ অন্নভোজনে সবসময় বিপুল তৃপ্তি লাভ করে থাকেন। এইভাবে একচক্র রথে চড়ে সূর্যদেব নিয়ত অতিবেগে ভ্রমণ করতে থাকেন। সাতটি ভদ্র অক্ষত অশ্বকে নিজের দিব্য রথযানে রোজিত করে দিনরাত সাগরান্ত, সপ্তদ্বীপ তিনি ভ্রমণ করতে থাকেন। সূর্যদেবের রথচক্রের সামনে গায়ত্রী প্রভৃতি সপ্ত চন্দ্রই অবিনাশী হরিবর্ণ সপ্ত অশ্ব রূপে বিরাজ করে। এরা মাত্র একবারই রথে যযাজিত হয়। এরা ইচ্ছা মতন বিবিধ রূপ ধারণ করতে পারে। এরা অমিত, এরা মনের গতির চেয়েও দ্রুতগতি সম্পন্ন। এরা অব্যয় এবং ঈশ্বর অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী। এই সপ্ত অশ্ব প্রতিদিন, আশিশত মণ্ডল বিস্তৃত ভূমণ্ডল পরিভ্রমণ করতে পারে, এই সপ্তাশ্ব কল্পের আদিতে রথে যোজিত হয়েছিল। তারপর থেকে দিনরাত তারা সূর্যমণ্ডলের বাইরে ও ভেতরে সূর্যদেরকে বহন করে চলেছে। প্রলয়কাল না-আসা পর্যন্ত তারা এই কাজই করতে থাকবে। এই প্রলয়কাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মহর্ষিগণ প্রসিদ্ধ ও মনোহর বচনে সূর্যদেবের স্তব করে যাবেন। গন্ধর্ব ও অপ্সরারা নৃত্যনাট্য গীতে তাঁর সেবা করবেন। আর দীননাথ ভগবান সূর্য, এইসব ভ্রাম্যমান অজেয় অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে ভ্রমণ করে যাবেন, এসবই বিধি নির্দিষ্ট।
সূর্যদেবের মতো একই ভাবে নক্ষত্র ও চন্দ্রও এক একটি নির্দিষ্ট কক্ষকে আশ্রয় করে ভ্রমণ করতে থাকেন। সূর্যরশ্মির মতো চন্দ্রকিরণেরও অবস্থাভেদে ক্রমান্বয়ে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। চন্দ্রের রথ অশ্ব ও সারথি সহ জলগর্ভ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। চন্দ্ররথের উভয় পাশে তিনটি করে চক্র ও একশত করে অর আছে। চন্দ্ররথের অশ্বগুলি শুক্ল বর্ণ বিশিষ্ট ও অতি উত্তম। এই অশ্বগুলিও সূর্যরথের অশ্বের মতো মনের গতির চেয়ে দ্রুতগতিময়। চন্দ্ররথের অশ্বগুলিও মাত্র একবার করেই তার রথের সঙ্গে যোজিত হয়। এইভাবে এক এক করে দশটি কৃশ অশ্ব যুগান্ত পর্যন্ত চন্দ্রকে বহন করে যাবে। চন্দ্রের রথে যোজিত সকল অশ্বই শ্বেতাভ ও শঙ্খের মতো দীপ্তিমান। এরা চক্ষুঃশ্রবা অর্থাৎ এরা চোখের সাহায্যে শোনে। ক্রমান্বয়ে যোজিত চন্দ্রের দশটি অশ্বের নাম হল–যযু, ত্ৰিমনু, বৃষ, রাজী, বল, বাম, তুরণ্য, হংস ব্যোমী ও মৃগ। স্বর্গলোকে এরাই চন্দ্রনাথকে দিনরাত বহন করে চলেছে। ভ্রমণকালে চন্দ্রদেব দেবগণও পিতৃগণের দ্বারা পরিবৃত হয়ে থাকেন।
শুক্লপক্ষের শুরু থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিদিন সূর্যদেব সামনের দিক থেকে চন্দ্রকে ক্রমে ক্রমে পূর্ণ করে ফেলেন। আবার কৃষ্ণপক্ষে দেবতারা যখন চন্দ্রকে পান করতে থাকেন, যখন চন্দ্ৰ ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে, তখন সূর্যদেব সেই ক্ষয়মান চন্দ্রের বৃদ্ধি ঘটান। সূর্যদেব সুষুম্ন নামক একটি রশ্মি দিয়ে প্রতিদিন এক এক ভাগে চন্দ্রকে পূর্ণ করেন। এইভাবে পূর্ণ হতে হতে পনেরো দিনের দিন চন্দ্রের সকল কলা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। সূর্য হতে নির্গত এই সুষুম্না রশ্মির দ্বারা শুধু যে চন্দ্রের কলাগুলি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় তাই নয়, চন্দ্রের শুক্লকগুলিও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এইভাবে কৃষ্ণপক্ষে চন্দ্রের হ্রাস ও শুক্লপক্ষে চন্দ্রের বৃদ্ধি ঘটে থাকে। সেই কারণেই প্রতি পূর্ণিমাতে চন্দ্রকে শুক্লবর্ণ ও পূর্ণমণ্ডল বলে মনে হয়। অর্থাৎ রসসারময় চন্দ্রদেব প্রতি শুক্লপক্ষে বর্ধিত হয়ে থাকে। তারপর কৃষ্ণপক্ষের আগমনে দেবতারা সেই শুধাময় জলময় চন্দ্রকে পান করতে থাকে। দ্বিতীয় থেকে চতুর্দশী পর্যন্ত এই পানপর্ব অব্যাহত থাকে। বাকি অর্ধমাসে চন্দ্রদেব আবার সূর্যতেজে অমৃতময় হয়ে ওঠেন। তখন সেই অমৃতরস পান করার জন্য সকল দেবগণ, পিতৃগণ ও মহর্ষিগণ পূর্ণিমা রাতে পরম নিষ্ঠা সহকারে তার উপাসনা করতে থাকেন। কৃষ্ণপক্ষের প্রারম্ভে সূর্যদেবের সামনেই দেবগণ ও মহর্ষিগণ চন্দ্রের কলা পান করতে থাকায় সেই অমৃতময় চন্দ্রের সমস্ত কলা ক্রমশ ক্ষয় হয়ে যেতে থাকে। অবশ্য শুক্লপক্ষে আসার পর তা আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে। এইভাবে প্রতিবার অর্ধমাস ধরে চন্দ্রসুধা পান করতে করতে দেবগণ অমবস্যায় উপনীত হন। তারপর যখন চন্দ্রকলার মাত্র পনেরো ভাগ অবশিষ্ট থাকে তখন সেই অপরাহ্নেই সেই অবশিষ্ট চন্দ্রসুধা পান করার জন্য দেবগণ চন্দ্রদেবের উপাসনা আরম্ভ করে দেন। দেবতাদের পান করার পর অবশিষ্ট মাত্র দুটি চন্দ্রকলা থেকেই অবিশ্রান্ত কিরণরাশির মধ্যে দিয়ে সেই ঘোর অমাবস্যায় চন্দ্রসুধামৃত নিঃসৃত হতে থাকে। পিতৃগণ একমাস কাল ধরে তা পান করে দেহ-মনে হৃষ্ট হন। সেইসব সুধীভোগী সৌম্য, বহির্ষদ, অগ্নিদ্বত্তা ও কব্য নামে প্রসিদ্ধ।
হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ, পিতৃসৃষ্টিতে যা সংবৎসর কব্য নামে পরিচিত, পণ্ডিতগণ তাকেই পঞ্চাব্দ বলে অভিহিত করে থাকেন। যা সৌম্য ঋতু তাকেই দ্বিজগণ বহিষদ মাস ও অগ্নিদ্বারী ঋতু বলে থাকেন।
পঞ্চদশী তিথি না-আসা পর্যন্ত সুধাময় চন্দ্র পিতৃগণের দ্বারা একনাগাড়ে পীত হতে থাকেন। পঞ্চদশী তিথিতে চাঁদের ক্ষয় সম্পূর্ণ হয়। ওই সময় পর্যন্ত অমাবস্যা চলে। তারপরেই আবার তা পূর্ণ হতে আরম্ভ করে। এইভাবে প্রতি ষোড়শ দিনে পক্ষ আরম্ভের পূর্বে চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে। প্রধানত সূর্যের কারণেই তার অর্থাৎ চন্দ্রের এই হ্রাস-বৃদ্ধি।
এবার আমি আকাশমার্গে স্থিত তারা, রাহু ও অন্যান্য গ্রহরাজির রথসমূহের বিষয় বর্ণনা করছি।
সোমগ্রহের অত্যন্ত শ্রীযুক্ত কাঞ্চনময় একটি রথ আছে। রথটি আটটি অশ্বযুক্ত। এই অষ্ট অশ্বগুলি নিতান্তই নিঃসঙ্গ, সর্বত্রগামী, অগ্নিসম্ভূত এবং লোহিতবর্ণ বিশিষ্ট। এই সুবর্ণযুক্ত রথ সকল ও বক্র চক্রশালী। শ্রীমান কুমার সোম এই রথে আরোহণ করে সরল ও বক্রপথে ভ্রমণ করেন।
সোমপুত্র বুধ গ্রহের রথ শুভ্রকান্তি বিশিষ্ট অত্যন্ত তেজোময় এবং জলময়। এতে বিশঙ্গ বর্ণের আটটি অশ্ব নিয়োজিত আছে। অশ্বগুলি বায়ুগতি সম্পন্ন। বুধ রথটি সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সুসজ্জিত এবং এতে বাণাধরা, পতাকা ও ধ্বজা আছে। সর্বোপরি এই রথটির চালকের সামনে এক দিব্যকান্তি সুমহান সারথি বিরাজমান।
শুক্রগ্রহের রথে শ্রীময়তায় ও তেজে সূর্য রথের সঙ্গে তুলনীয়। শ্বেত, পিশঙ্গ, সারঙ্গ, নীল, পীত, লোহিত, কৃষ্ণ, হরিৎ, পৃষত ও পৃষিও নামে দশটি অকৃশ অশ্ব শুক্ররথে যোজিত আছে। এইসব অশ্ব মহাবাগ এবং বায়ুগতিসম্পন্ন।
অঙ্গিরাসূত শ্রীমান বিদ্বান বৃহস্পতি যে রথে চড়ে চতুর্দিক পরিভ্রমণ করেন, সেই রথটিও সুবর্ণময়। এতে আটটি দিব্য রক্তবর্ণ অশ্ব নিয়োজিত আছে। অশ্বগুলির গতি বায়ুগতিসম্পন্ন। বৃহস্পতি দেব আচার্য। তিনি এক বছর পর্যন্ত সর্বাধিক একটি নক্ষত্রে বাস করেন। তারপর তিনি অন্য গ্রহের উদ্দেশ্যে বায়ুবেগে চলতে থাকেন। এর ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটতে দেখা যায় শনৈশ্চর গ্রহের ক্ষেত্রে। শনৈশ্চর গ্রহটি বিচিত্রবর্ণ বিশিষ্ট। আকাশ সস্তৃত অশ্ব নিয়োজিত একটি লৌহনির্মিত রথে চড়ে ধীর গতিতে শনি গ্রহ চলতে থাকেন।
স্বর্ভানু রাহুর রথ মনের মতো গতিসম্পন্ন। আটটি কৃষ্ণবর্ণের অশ্ব রাহুর রথে নিয়োজিত আছে। এরা একবার যোজিত হয়ে রাহু গ্রহের তমোময় রথ প্রলয়কাল পর্যন্ত বহন করে চলে। আদিত্য থেকে নির্গত হবার পর রাহু চন্দ্রের বিভিন্ন পর্বে প্রবেশ করে থাকেন, তারপর চন্দ্র থেকে আবার বিভিন্ন পর্বের মাধ্যমে সূর্যের কাছে ফিরে ফিরে আসে। রাহুর মতো কেতুর রথের অশ্ব সংখ্যাও আট। তবে এরা বায়ুর মতো বেগযুক্ত। এদের দেহের বর্ণ একইসঙ্গে ধূমের মতো ধূসর ও গদর্ভের মতো অরুণ বর্ণের হয়ে থাকে।
হে অসীম জ্ঞানধিকারী ব্রাহ্মণগণ, এ যাবৎ আমি যত গ্রহ ও তাদের রথারে কথা বললাম, সেইসব রথাশ্বগুলি বায়ুরশ্মি যারা ধ্রুব নক্ষত্রে নিবদ্ধ হয়ে আছে। এইসব বায়ুরশ্মি অদৃশ্য অবস্থায় থাকে। তবু তাদের প্রবল আকর্ষণে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় এইসব গ্রহাদি যথানিদিষ্ট পথে ভ্রমণ করে যেতে থাকে। এইভাবে পারস্পরিক আকর্ষণে বায়ুরজ্জবদ্ধ অবস্থায় সূর্য, চন্দ্র, গ্রহাদি, তারকাপুঞ্জ সকলেই ভ্রমণরত অবস্থায় ধ্রুব নক্ষত্রে নিবদ্ধ হয়ে আকাশমার্গ ভ্রমণ করছে।
নদীর জলে ভাসমান নৌকাকে, তা সে যত বড়োই হোক, নদীর জল বহন করে নিয়ে যায়। ঠিক তেমনি ভাবে আকাশমার্গস্থিত দেবালয়গুলিকে বায়ুরজ্জ্ব বহন করে নিয়ে যায়। এই জন্য আকাশে দেবতাদের দেখা যায়। এই আলোচনা প্রসঙ্গে হে দ্বিজবৃন্দ, আপনাদের জানিয়ে রাখছি আকাশলোকে যতগুলো তারা আছে, ততগুলো বায়ুরজ্জও আছে। তারকাগুলি ধ্রুব নক্ষত্রে নিবদ্ধ থেকে ভ্রমণ করতে করতে ধ্রুব নক্ষত্রকেও ভ্রমণ করায়। বলতে পারেন, তৈলপেষক যন্ত্র যেমন দণ্ড প্রকৃতিকে ভ্রমণ করায়, তেমনি বায়ুও জ্যোতিষ্ক মণ্ডলকে ভ্রমণ করায়। বায়ু জ্যোক্কি মণ্ডলকে বহন করে, তাই বায়ুর নাম প্রবহ। বায়ু দ্বারা চালিত হয়ে এই মণ্ডল অলাত চক্রের মতো আচরণ করে। শুধু ধ্রুব নক্ষত্র মন্ডলই নয়, তারাময় শিশুমার নক্ষত্রও আকাশমার্গে স্থির হয়ে থাকে। এই জ্যোতিষ্ক অত্যন্ত পুন্যপদ। রাত্রিকালে একে দর্শন করলে দিনের সমস্ত পাপ মুক্ত হওয়া যায়। এবং আকাশলোকে যতগুলো তারা শিশুমারের আশ্রিত ততবর্ষকাল দীর্ঘজীবন লাভ করা যায়। শিশুমার শাশ্বত। তাকে বিভিন্ন রূপে জানতে হলে গভীর মনোনিবেশের প্রয়োজন। উত্তানপাদ-এর উত্তর হনু, ধর্ম এর মস্তক এবং যজ্ঞ এর অধর। এর হৃদয়ে দেবদেব নারায়ণ এবং পূর্ব-পাদদ্বয়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ে বিরাজ করছেন। বরুণ ও অর্যমা এর পশ্চিম উরুদেশ, সাংবৎসর-এর জননেন্দ্রিয় এবং মিত্র এর আপন আশ্রয় করে আছে। এর পুচ্ছদেশে অবস্থান করছেন অগ্নি ও মহেন্দ্র। আকাশলোকে বিরাজমান চারটি তারা–শিশুমার, কশ্যপ, মরীচি ও ধ্রুব, এরা কখনও অস্ত যায় না।
এই জটিল আলোচনার সারসূত্র হিসেবে আমি বলতে পারি, নক্ষত্ররাজি বা চন্দ্র, সূর্য, গ্রহগণ– যাই-ই হোক, এরা সকলেই একটি চন্দ্রকে আশ্রয় করে ঘূর্ণনরত উন্মুখ এবং পরস্পর পরস্পরের অভিমুখে অবস্থিত। ধ্রুব, কশ্যপ ও অগ্নি এই তিন তারকার মধ্যে আবার ধ্রুব শ্রেষ্ঠ। এই ধ্রুব নক্ষত্র একাই মেরু পর্বতের শীর্ষে ভ্রমণ করতে দেখা যায়। অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ গ্রহ-তারকাদি সকলেই শ্রেষ্ঠ মেধীভূত ধ্রুবকে অনেক সময়ই আকাশপথে প্রদক্ষিণ করে থাকে। এই ধ্রুব নিম্নমুখ অবস্থায় জ্যোতিশ্চক্রকে সদা সর্বদা আকর্ষণ করতে করতে মেরুকে আলোকিত ও প্রদক্ষিণ করে থাকে।
.
৪৭.
শংশাপায়ন বললেন–এত পর্যন্ত শ্রবণ করে পুণ্যব্রতা মুনিগণের হৃদয়ে সংশয়ান্বিত হয়ে উঠল। তারা আবার লোমহর্ষণ সূতকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভগবান, আপনি যে সমস্ত নক্ষত্র ও গ্রহের কথা বললেন, যে সবই প্রসিদ্ধ তখন আপনি দেবগৃহ কীরকম, জ্যোতিষমণ্ডলই বা কীরকম–এইসব বিষয়ে বিস্তারিত বলুন।
মুনিবরদের আগ্রহী, বাক্য শুনে সূত প্রীত হলেন। তিনি বললেন, এ বিষয়ে মহাপ্রাজ্ঞ জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যাক্তিরা যেমন বলেছেন, আমি আপনাদের কাছে সেই ভাবেই সব কথা ব্যক্ত করব। প্রথমেই আমি দেবগণ ও চন্দ্র ও সূর্যের গৃহ কেমন তা বর্ণনা করব। দিব্য, ভৌতিক ও পার্থিব এই তিন রকম অগ্নির উৎপত্তি বিষয়েও বলব। আপনারা শ্রবণ করুন।
অব্যক্তজন্মা ব্রহ্মার রজনী অতিক্রান্ত হয়ে প্রভাত হলেও এই বিশ্বচরাচর নৈশ অন্ধকারে আবৃত ও অব্যাকৃত ছিল। এই বিশ্বচরাচরের চতুর্ভূত অবস্থায় যে অগ্নি বিরাজ করে, তাকে পার্থিব অগ্নি বলে। আদিকাল থেকে এই অগ্নিই সূর্যকে তাপ প্রদান করে। সূর্যকে তাপ দানকারী এই অগ্নি শুদ্ধ। এর নাম বৈদ্যুত। বৈদ্যুত অগ্নির কিছু কিছু নিজস্ব লক্ষণ আছে। এই বৈদ্যুত অগ্নি তিন প্রকার বৈদ্যুত, সৌর, সূর্য। বৈদ্যুত অগ্নিময়। এই অগ্নিজাত কিরণের সাহায্যেই সূর্য ভূ-পৃষ্ঠ থেকে জল আকর্ষণ করে আকাশে দীপ্ত হতে থাকে। জলে একে নির্বাপিত করতে পারে না। মানুষের কুক্ষিস্থ অগ্নি হল জাঠরাগ্নি। অগ্নি মণ্ডালাকার শুক্ল বর্ণযুক্ত ও নিরুম্মা। অগ্নিতে প্রকাশিত অগ্নি হল সৌর। রাত্রিবেলা সূর্য অস্ত গেলে সূর্যপ্রভা অগ্নিমধ্যে প্রবেশ করে। তাই তখন সৌরদ্যুতি দূর থেকে প্রকাশ পেতে থাকে। কিন্তু যে মুহূর্তে সূর্যের উদয় হয়, সেই মুহূর্তে আগ্নেয় উষ্ণতা আবার সূর্যের মধ্যে প্রবেশ করে। সেইজন্যই দিনেরবেলা সূর্য তাপ দান করে থাকে।
সৌর আগ্নেয় অবস্থায় প্রকাশ ও উষ্ণতা নামক অগ্নির যে তেজ, সেই দুই তেজ পরস্পরের মধ্যে প্রবেশ করে সকাল-সন্ধে নিজেদের বর্ধিত করে চলেছে। পৃথিবীর উত্তরার্ধ ও দক্ষিণার্ধ, যেখানে যে সময়ে সূর্যোদয় হয়, সেখানে তখন রাত্রি জলমধ্যে প্রবেশ করে সেইজন্যই সব জায়গায় জল দিনমানে তাম্রবর্ণ হয়। তারপর আবার সূর্যাস্ত হয়, তখন দিন জলে প্রবেশ করে। তাই রাত্রিকালে জল ভাস্বর ও শুক্লবর্ণ হয়ে ওঠে। এইভাবে সূর্যের উদয় ও অস্ত যাবার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে দিন ও রাত্রি জলমধ্যে প্রবেশ করতে থাকে।
উদিত সূর্য যখন তাপের বিচ্ছুরণ ঘটায় তখন পবিত্র পার্থিব অগ্নি কিরণের সাহায্যে জল পান করতে থাকে। এই অগ্নি কুম্ভকার। ওই অগ্নির নাম সহস্রপদ। কারণ ওই পবিত্র পার্থিব অগ্নি সহস্রপাদ অর্থাৎ কিরণের সাহায্যে চারিদিকের সাগর, নদী, কূপ, মরু, স্থাবর ও জঙ্গম প্রভৃতি সকল বস্তুর রস আকর্ষণ করে। আবার যে সূর্য হিরন্ময় সেই সূর্য সহস্র-রশ্মিচ্ছটা বর্ষা, শীত ও উষ্ণতা সৃষ্টি করে। এদের মধ্যে নাড়ী, নূতনা, অমৃতা, বন্দনা, চিত্রমূর্তি, বন্দি ঋতনা প্রভৃতি নামে চারশো সংখ্যক রশ্মি অবিরাম বৃষ্টিবর্ষণ করে। এছাড়া চন্দ্রা নামে তিনশত পীতবর্ণময়, হিমবাহ রশ্মি আছে এইসব রশ্মি থেকে হিম অর্থাৎ শীতলতার সৃষ্টি হয়। আছে শুক্ল নামে তিনশত সংখ্যক আহ্লাদজনক শুক্লবর্ণ বিশিষ্ট রশ্মিগুচ্ছ। এই শুক্লরশ্মিগুলি উষ্ণতা সৃষ্টি করে এবং মনুষ্য পিতৃ ও দেবগণকে পালন করে, তবে যে-কোনো ধরনের রশ্মিই হোক না কেন, সূর্যরশ্মি মাত্রেই মনুষ্যগণ, পিতৃগণ ও দেবগণকে ঔষধ, স্বধা, ও অমৃত দান করে তৃপ্ত করে। এর প্রভাবে তারা বল লাভ করে থাকেন। এইভাবে অগ্নিময় সূর্যের সহস্র সহস্র রশ্মি লোকাৰ্থ সাধকরূপে বিভিন্ন ঋতুতে জল, হিম ও উষ্ণতা দান করে থাকে। তবে ঋতুভেদে সূর্যের অগ্নিপ্রদায়ী রশ্মি সংখ্যার হেরফের ঘটে থাকে। যেমন–বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে সূর্য তার তিনশত সংখক রশ্মির সাহায্যে উত্তাপ দান করে, বর্ষাকালে ও শরৎকালে চারিশত রশ্মি দ্বারা বৃষ্টি বর্ষণ করে এবং হেমন্তকালে ও শীতকালে পুনরায় ওই তিনশত সংখ্যক রশ্মির সাহায্যে হিম দান করে থাকেন।
এই যে শুক্ল ভাস্কর সূর্যমণ্ডল, ইহাই গ্রহ, নক্ষত্র ও চন্দ্রের প্রতিষ্ঠা ক্ষেত্রেও উৎসস্থল স্বরূপ। চন্দ্র হলেন নক্ষত্রদের অধিপতি। এইসব নক্ষত্র, গ্রহ ও চন্দ্র চন্দ্র থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। একইভাবে সূর্য হলেন গ্রহদের অধিপতি। এর বাইরে অবশিষ্ট পঞ্চগ্রহ ঈশ্বর ও কামরূপী বলে বিখ্যাত। সূর্য যেমন অগ্নিময়, চন্দ্রও তেমনি জলময় রূপে কীর্তিত হন।
এবার আমি অপরাপর গ্রহদের বিষয়ে বলিছ, শ্রবণ করুন।
ভগবান নারায়ণ জ্ঞানীদের কাছে বুধ গ্রহ বলে বন্দিত হন। পৃথিবীতে বিরাজিত স্বয়ং প্রভু স্বরূপ যে রুদ্র দেবতা, তিনি মন্দগামী মহাগ্রহ শনৈশ্চর নামে খ্যাত। দেবসেনাপতি মহেশপুত্র কার্তিক হলেন মঙ্গলগ্রহ। দেবগুরু বৃহস্পতি ও অসুরগুরু শুক্রাচার্য–এঁরা দুজনেই প্রজাপতির পুত্র। এঁরাও ভানুমান নামে দুই মহাগ্রহ হয়ে আছেন। দৈত্য ও মহেন্দ্র–এই দুজনের ওপর এঁদের আধিপত্য সন্দেহাতীত, আদিত্য যে এই ত্রিভুবনের মূল এ বিষয়ে কারো মনেই কোনো সন্দেহ নেই।
হে বিপ্ৰেন্দ্ৰবৃন্দ! রুদ্র, ইন্দ্র, উপেন্দ্র চন্দ্র, বিপেন্দ্র এবং অন্যান্য যে সব দ্যুতিমান স্বর্গবাসী দেবতারা আছেন, তাঁদের সকলের সার্বলৌকিক তেজ ও দ্যুতির মূল কারণ হলেন সর্বাত্মা, সর্বলোকেশ ও পরমদৈবত সূর্য। এই জগতে প্রকাশ পাচ্ছে এমন সবকিছুই সূর্য থেকেই জন্মাচ্ছে এবং সূর্যের মধ্যেই লয় পাচ্ছে। পুরাকালেও লোকসমূহের ভাব ও অভাব–দুইই আদিত্য থেকে নিঃসৃত হয়েছিল। আসলে সূর্য একটি প্রখর দীপ্তিসম্পন্ন ভুবনবিখ্যাত সুগ্রহ। তাই সবকিছুই তার মধ্যে লয় পেয়েও বারে বারে জন্মগ্রহণ করে। ক্ষণ, মুহূর্ত, দিবস, নিশা, পক্ষ, মাস, সংবৎসর, ঋতু, যুগ এই যেসব কালের নির্ণয়, এসব সূর্য ছাড়া অসম্ভব। এই বিষয়গুলির ওপর আরও আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত রয়েছে। যেমন ঋতু বিভাগ না হলে পুষ্প, ফল, মূল, শস্য, ঔষধি প্রভৃতি কিছুই সৃষ্টি হতে পারে না। অতএব সেই সূর্য কাল অগ্নি এবং দ্বাদশাত্মা প্রজাপতি। সেই সূর্য একটি সার্বলৌকিক তেজোরশ্মি। যা জগৎ বায়ুকে পাশে, ওপরে ও নীচে থেকে তাপিত করছে।
পূর্বেই আমি আপনাদের কাছে সূর্যের সহস্র রশ্মির কথা বলেছি। এত রশ্মির মধ্যে কেবল সাতটি রশ্মি হল শ্রেষ্ঠ। এই সাতটি রশ্মিই গ্রহাদির উৎস। এই সাতটি রশ্মির নামগুলি হল–সুষুন্ম, হরিকে, বিশ্বকর্মা, বিশ্বশ্রবা, সম্পদবসু, অর্বাবসু ও স্বরাট। এই সাতটি রশ্মি সুনির্দিষ্ট দিক থেকে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট গ্রহকে উত্তপ্ত করে থাকে যথা–সুষুম্ন নামে সূর্যরশ্মি তির্যক ও উধ্বদিক থেকে ক্ষীণ শশীকে বর্ধিত করে তোলে। হরিকেশ নামে সূর্যরশ্মি নক্ষত্রাদির দ্যুতির কারণ। এই রশ্মি নক্ষত্রদের আদি উৎস, বিশ্বকর্মা নামে সূর্যরশ্মি বুধ গ্রহকে দক্ষিণ দিকে বর্ধিত করে। বিশ্বশ্রবা নামক সূর্যরশ্মি শুক্রগ্রহের সকল জ্যোতির উৎস। সম্পদ বসু ও অর্বাবুস নামে সূর্যরশ্মি যথাক্রমে লোহিত গ্রহ ও বৃহস্পতির উৎস। আর স্বরাট নামে সূর্যরশ্মি শনিগ্রহকে আলোকিত করে রেখেছে। এইভাবে সূর্যের সহস্র রশ্মির প্রভাবে গ্রহ, নক্ষত্র ও তারকরাশি বর্ধিত হচ্ছে। জ্যোতিঃপ্রভা দিক থেকে এরা কেউ ক্ষীণ হয় না, তাই এদের নক্ষত্র বলে। এইসব ক্ষেত্র রশ্মি দ্বারা পূর্বে পতিত হয়। তারপর সূর্য নক্ষত্রত্ব লাভ করলে এইসব ক্ষেত্রকে অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করেন।
যারা সুকর্ম দ্বারা উত্তীর্ণ হয়েছেন, তারা সুকর্মের শেষে কোনো একটি গ্রহকে আশ্রয় করে তারকা রূপে বিরাজ করেন। এরা শুক্লবর্ণের বলেই এদের তারকা বলা হয়।
অগ্নির দিব্য, পার্থিব ও ভৌতিক অবস্থা দ্বারা নৈশ তেজ ও অন্ধকার আদান অর্থাৎ গ্রহণ করে বলে সূর্যকে আদিত্য বলা হয়। স্পন্তনার্থক “সু” ধাতু থেকে “সূর্য” শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। তেজ ও জলকে স্পন্দিত করে বলে সূর্যকে “সবিতা”ও বলা হয়ে থাকে। সূর্যের মতো চন্দ্র শব্দটিরও একাধিক অর্থ আছে। যেসব ধাতু আহ্লাদ, শুক্লত্ব, অমৃতত্ব ও শীতত্ব প্রভৃতি অর্থকে পরিস্ফুট করে, সেইসব ধাতু থেকেই চন্দ্র শব্দটির উৎপত্তি। তবে গোলাকার কুম্ভের মতো আয়তন বিশিষ্ঠ সূর্যমণ্ডল শুক্ল ও ঘনতেজোময় হলেও চন্দ্রমণ্ডল ঘন জলাত্মক। এবং তা সূর্যমণ্ডলের সাথে সন্নিবিষ্ট অবস্থায় থাকে। সমস্ত .. মন্বন্তরেই সকল গ্রহ, নক্ষত্রাদি সেইখানে আশ্রয় নেয়। তাতে দেবগণেরাও প্রবেশ করেন। সেই দেবগণের গৃহ অতিসূক্ষ্ম। সূর্য সৌর স্থান, চন্দ্র চান্দ্র স্থান শুক্র শৌক্র স্থান, ষোলটি দীপ্তির অধিকারী প্রতাপবান বৃহস্পতি বৃহৎ স্থান, মঙ্গল লৌহিত স্থান এবং শনৈশ্চর স্থান অবলম্বন করে থাকেন। এইসব স্থান রবিরশ্মি যোগ প্রকাশ পেয়ে থাকে।
সূর্যমণ্ডলের বিস্তার সাতাশ সহস্র যোজন। এর পরিমাণ নয় সহস্র যোজন। তবে সূর্যের পরিব্যাপ্তি থেকে চন্দ্রের পরিব্যাপ্তি বিষ্কম্ভ দ্বিগুণ বিস্তৃত। চন্দ্র ও সূর্যের আয়তনের সমান হয়ে রাহু তাঁদের নীচে গমন করেন। তারপর পৃথিবীর ছায়ায় সন্নিবিষ্ট অবস্থায় মণ্ডলাকারে পরিভ্রমণ করতে থাকেন। রাহুর স্থান বৃহৎ এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। রাহুস্থানটি পূর্ণিমায় সূর্য থেকে নির্গত হয়ে চন্দ্রমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং প্রতি অমাবস্যায় চন্দ্র থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করে আকাশে স্বয়ং দীপ্তি পায় বলে রাহুর অপর নাম স্বর্ভানু।
ভার্গবের পরিমাণ চন্দ্রের ষোড়শ ভাগ। ভার্গব থেকে বৃহস্পতি একপাদহীন। বৃহস্পতি থেকে মঙ্গল ও শনি একপাদহীন। শনি ও মঙ্গল থেকে বুধ একপাদহীন। যেসব নক্ষত্র কান্তিময় তারা বিস্তার ও মণ্ডলে বুধের সমতুল্য। দেখা গেছে বিস্তার ও মণ্ডলের দিক থেকে মঙ্গল ও শনি থেকে বুধ একপাদহীন। হে দ্বিজোশ্রেষ্ঠগণ, চন্দ্রের সাথে প্রায়শই নক্ষত্রদের যোগ হয়। তারা ও নক্ষত্ররা পরস্পর পরস্পর থেকে হীন এবং এদের মণ্ডল পরিমাণ চোদ্দো যোজনের অধিক। এখানে অর্ধমণ্ডলের কম পরিমাণ মণ্ডল নেই; এর একটি থেকে অপরটি আরও নিকৃষ্ট। এদের ওপরে আছে সৌর, অঙ্গিরা ও বক্র নামে তিনটি গ্রহ। এই তিনটি হল ধীরগামী গ্রহ। এদের নীচে আছে সূর্য, সোম, বুধ ও ভার্গব নামে চারটি মহাগ্রহ। এই চারটি মহাগ্রহ অতীব দ্রুতগামী। পণ্ডিতগণ হিসেব করে দেখেছেন আকাশমণ্ডলে যত কোটি তারা আছে তত কোটি নক্ষত্র আছে। নক্ষত্রগুলির পরিক্রমণপথ শ্রেণীবিভাগ অনুসারে বিন্যস্ত। এই নক্ষত্রদের পরিক্রমণ পথে উচ্চ ও নীচ ভাবে অয়নানুসারে সূর্যের গমন ঘটে থাকে। পূর্ণিমা দিবসে চন্দ্র উত্তরায়ণ মার্গে থাকলে বুধগ্রহ বৌধ স্থানে রাহু রাহু স্থানে এবং নক্ষত্রনিচয় নক্ষত্র স্থানে প্রবেশ করে।
কল্পের আদিকালে স্বয়ম্ভু স্বয়ং গ্রহনক্ষত্রাদি সৃষ্টি করেছিলেন। এইসব গ্রহ নক্ষত্রনিচয়ের স্থানসমূহ প্রলয় পর্যন্ত একইভাবে অবস্থান করবে। এইসব স্থান অতীতের সাথে অতীত হয়েছে। ভবিষ্যতের সাথে ভবিষ্যৎ এবং বর্তমানের সাথে বর্তমান হয়ে আছে। একথা নির্দিষ্ট হয়ে আছে যে বৈবস্বত মন্বন্তরে অদিতির পুত্র বিবস্বান সূর্য হবেন, দ্যুতিমান ধর্মপুত্র সোমদেব হবেন বসু, ভৃগুসূত শুক্রাচার্য হবেন দেবাচার্য এবং মনোহর ত্বিষিপুত্র হবেন বুধ। কিন্তু বিকল্প থেকে অগ্নির জন্ম হলো। তিনি লোহিতাপতি– যুবা রূপে জন্ম নিলেন। দক্ষায়ণগণ হলেন নক্ষত্রগামী। সিংহীকাপুত্র রাহু হলেন প্রাণিসন্তাপক অসুর। এতক্ষণ পর্যন্ত যেসব স্থানের কথা বলা হল চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র হলেন সেইসব স্থানের অভিমানিনী দেবতা।
সহস্ররশ্মিময় সূর্যের জলময় স্থানও অগ্নিময় স্থান দুইটি শুক্রবর্ণের। মনোহর পঞ্চরশ্মির স্থান শ্যামবর্ণের। ষোড়শ রশ্মিময় শুক্রের স্থান জলময়। দ্বাদশ রশ্মিময় বৃহস্পতির স্থান বৃহৎ আকার ও হরিৎ বর্ণ বিশিষ্ট। নররশ্মিময় মঙ্গলের স্থান জলময় ও লোহিত বর্ণ। অশ্ব রশ্মিময় বুধের স্থান জলময় ও কৃষ্ণবর্ণ। একরশ্মি বিশিষ্ট তারকারাশির স্থান জলময়। সে প্রাণিদের তাপ প্রদান করে। আর সবশেষে রাহুর জলময় স্থান। এরা সকলেই পুণ্যশ্লোকের আশ্রয়স্থল। এদের সকলের বর্ণ শুক্ল। কল্পরম্ভ কালেই বিধাতা পুরুষ এদের নির্মাণ করেছেন।
উচ্চতাবশত সূর্যকে এই পৃথিবীলোক থেকে অতিব্যক্ত কিরণমালার মতো দেখায়। কিন্তু পূর্ণিমা বা অমাবস্যার দিনে সূর্য যদি দক্ষিণমার্গে অবস্থান করেন এবং ভূমিরেখায় আবৃত হয় তাহলে তাকে আর যথাকালে যথাস্থানে দেখা যায় না, সূর্য তখন অতি শীঘ্র অস্তমিত হন। একই নিয়মে চন্দ্র যখন উত্তরমার্গে অবস্থান করেন তখন সেই অমাবস্যায় চন্দ্রকে যথাস্থানে দেখা যায় না। নক্ষত্রসমূহের গতির পরিপ্রেক্ষিতে সূর্য ও চন্দ্র উভয়ই বিষ্ণুবৎ সংক্রান্তির দিন উদিত ও অস্তমিত হন। পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় তারা অজ্যোতিশ্চক্রের অনুসরণ করে থাকেন। সূর্য যখন দক্ষিণ মার্গে বিচরণ করেন তখন সমস্ত গ্রহরাজির অধধাদেশে তাকে দেখতে পাওয়া যায়। একসময় সূর্যেৰ ঊর্ধ্বদেশে চন্দ্র নিজের অত্যুজ্জ্বল মণ্ডলকে বিকৃত করে সঞ্চরণ করে থাকেন। সে-সময় সমস্ত নক্ষত্রমণ্ডলকে চন্দ্রের ঊর্ধ্বদেশে অবস্থান করতে দেখা যায়। এসময় দেখা যায় নক্ষত্রের ঊর্ধ্বদেশে রয়েছে বুধ, বুধের ঊর্ধ্বদেশে বৃহস্পতি, বৃহস্পতির উর্ধ্বে শনি এবং শনির ঊর্ধ্বে সপ্তর্ষিমণ্ডল অবস্থান করছে। সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঊর্ধ্বে ধ্রুব নক্ষত্রকে বিরাজ করতে দেখা যায়। এই যে তারকা গ্রহ বা নক্ষত্রের অবস্থান বিষয়ে বললাম এরা সকলেই কিন্তু দুই শত সহস্র যোজন ঊর্ধ্বে অবস্থান করে থাকে। গ্রহগণ, চন্দ্র ও সূর্য দিব্য তেজোদীপ্ত রূপ পরিগ্রহ করে আকাশলোকে নক্ষত্রদের সাথে মিলিত হন এবং নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে পরিভ্রমণ করে। গ্রহ, নক্ষত্র ও সূর্য যথাক্রমে নীচ, উচ্চ ও মৃদুভাবে বিরাজিত। এরা যখন পরস্পর মিলিত বা বিচ্ছিন্ন হয়, তখনও এরা একই সাথে প্রজাদের দেখে থাকে। এরা পরস্পরের অবলম্বনে পরস্পরের সাথে মিলিত হয়। পণ্ডিতরা প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, তারা নিঃসন্দেহে জানেন যে এদের মিলনে সংকর অর্থাৎ মিশ্রণ ঘটে না।
পৃথিবী, জ্যোতিষ্কমণ্ডল, দ্বীপমালা, সমুদ্রসমূহ, পর্বতরাজি, বর্ষ ও নদী বিষয়ক সন্নিবেশের কথা, যা কিছু আমি জ্ঞেয় হয়েছি সবই আপনাদের কাছে ব্যক্ত করলাম। উল্লিখিত সকল স্থানেই প্রাণীরা বাস করতে থাকে। এইসব গ্রহরা বহু বহুকাল পূর্বে নক্ষত্র থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। চাক্ষুষ মন্বন্তরে বিশাখা নক্ষত্রে আবির্ভূত হওয়ার পর সূর্য এইসব গ্রহদের মধ্যে প্রধান বলে বিবেচিত হতে লাগল। ধর্মপুত্র রশ্মিময় চন্দ্র বিশ্বাবসু নামে কৃত্তিকায় জন্ম লাভ করলেন, ষোড়শ রশ্মিযুক্ত ভৃগুপুত্র শুক্র পুষ্যা নক্ষত্রে উৎপত্তি লাভ করে সূর্যের নীচে অবস্থিত তারা ও গ্রহরাজির ওপর আধিপত্য করতে লাগল। দ্বাদশরশ্মিযুক্ত ঙ্গিরাপুত্র বৃহস্পতি ফাল্গুনী নক্ষত্রে উদ্ভূত হয়ে জগৎগুরু বলে বন্দিত হলেন। দেবদেব প্রজাপতির ঔরসে আষাড়া গর্ভে উৎপন্ন হলেন নবরশ্মিযুক্ত লোহিতাঙ্গ মঙ্গল। শনি রাহু ও কেতু গ্রহের জন্মবিষয়ে কিছু শ্রুতিবাক্য প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে সপ্তরশ্মিসমন্বিত শনি সূর্যের ঔরসে রেবতীর গর্ভে জন্মলাভ করেছেন। আর চন্দ্রসূর্যপীড়ক রাহু ও কেতু রোহিনী নক্ষত্রে সমুৎপন্ন হয়েছেন। হে দ্বিজোত্তমবৃন্দ, আপনারা ভার্গব প্রভৃতি গ্রহদের ‘তারাগ্রহ’ বলে জ্ঞান করবেন, জন্মনক্ষত্র পীড়িত থাকলে গ্রহরা প্রতিকূল হয় এবং গ্রহভোগ সময়ে সেই দোষ তাদের স্পর্শ করে। আদিত্যকে এইসব গ্রহের মধ্যে আদি বলে মান্য করা হয়। এছাড়া তারকামণ্ডলের মধ্যে শুক্র, কেতুদের মধ্যে ধূমকেতু, নক্ষত্রদের মধ্যে বিষ্ঠা, অয়নদের মধ্যে উত্তরায়ণ, বর্ষদের মধ্যে সংবৎসর, ঋতুমধ্যে শিশির, মাস মধ্যে মাঘ, পক্ষ মধ্যে শুক্ল, তিথি মধ্যে প্রতিপদ, দিনরাত্রির মধ্যে দিন, এবং মুহূর্তের মধ্যে আদ্য মুহূর্তকে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়।
কালবিদ পণ্ডিতগণ চক্ষুর নিমেষ প্রভৃতিকে কাল বলে ঘোষণা করেছেন। সূর্যের গতি বিক্ষেপে বিষ্ঠা থেকে শ্রবণা পর্যন্ত ব্যাপ্ত পাঞ্চ বার্ষিক যুগ চক্রের মতো পরিবর্তিত হয়ে থাকে। এই নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দু বলে সূর্যকে কাল বলে অভিহিত করা হয়। আপনারাও একে ঈশ্বর বলে জ্ঞান করবেন। ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ–এইচারিভূতের প্রবর্তক ও নিবর্তক হলেন সূর্য। স্বয়ং স্বয়ম্ভ ঈশ্বর লোকব্যবহারের জন্য এই জ্যোতিশ্চক্রের সন্নিবেশ নির্মাণ করেছেন, এই জ্যোতিশ্চ শ্রবণা নক্ষত্রে উৎপত্তি লাভ করে ধ্রুব নক্ষত্রে স্থির হয়ে আছে। সন্নিবেশটি চতুর্দিকে বৃত্তাকার। এই জ্যোতিশ্চক্র সৃষ্টি করার সময় ভগবান কিছু সুনির্দিষ্ট সত্য প্রকাশের কথা চিন্তা করেছিলেন, এই জ্যোতিশ্চক্র হল প্রকৃতির আশ্রয়। অভিমানীও সত্ত্বস্থিত এবং প্রকৃতির অদ্ভুত পরিণাম বিশেষ মনুষ্যলোকে বসবাসকারী কোনো প্রাণীই এইসব জ্যোতিষ্ক পদার্থের গমনাগমন চর্মচক্ষু দিয়ে অবলোকন করতে পারেন না। কেবলমাত্র সিদ্ধ প্রাজ্ঞ পণ্ডিতেরাই আগম, অনুমান, প্রত্যক্ষ ও উপপত্তি বলে অত্যন্ত নিপুণভাবে ও ভক্তিবশে এই যাতায়াত যথাযথ ভাবে নির্ধারণ করতে পারেন। চক্ষু, শাস্ত্র, জল, লেখ্য ও গণিত-কে জ্যোতিশ্চক্রের গণনার হেতু বলে স্বীকার করা হয়েছে।
.
৪৮.
সুব্রত ঋষিগণ বললেন–হে তপোধন, আপনি যথাযথভাবে আমাদের বলুন কোন্ কালে কোন্ মহাদীপ্ত দেশে ব্রহ্মজ্ঞ শ্রেষ্ঠদের এই উত্তম আখ্যান বিবৃত হয়েছিল?
প্রত্যুত্তরে সূত বুললেন–হে ব্রতচারী দ্বিজবরগণ, আপনাদের জ্ঞানস্পৃহা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সহস্র বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠেয় সত্রযজ্ঞে জগৎপ্রাণ বায়ুর কাছে এ বিষয়ে যেমন শ্রবণ করেছি, আপনাদের তেমনই বলব।
শুভ্রশিখর শোভিত শৈলরাজ হিমালয়ের উত্তরদিকে বহু পবিত্র সরোবর, নদী ও হ্রদ আছে, এরই মাঝে যেসব পুণ্য উদ্যান, তীর্থস্থান ও দেবালয় গড়ে উঠেছে সেখানে দেবভক্ত মহাত্মা ব্রতনিষ্ঠ মুনিঋষিরা যথাযথ নিয়ম অবলম্বন করে ঋক, যজুঃ ও সামমন্ত্র, নৃত্যগীতাদি সহযোগে অর্চনা, প্রণব মন্ত্র ওঙ্কার উচ্চারণ ও নমস্কারের মাধ্যমে সর্বদা শিবের পুজো করে থাকেন। সংযত আত্মা সম্পন্ন দেবতারা মনে করেন জ্যোতিশ্চক্র যখন নিজ ব্যাপারে প্রবৃত্ত হয় তখন সূর্য মধ্যদেশে অবস্থান করেন। একদিন পূর্ব বিধিমতো দেবতারা যখন জ্যোতিশ্চক্র সম্পর্কে তাদের বিশ্বাসের কথা আলোচনা করছিলেন, তখন সতত গতি সমীরণ সেখানে উপস্থিত হয়ে নীলকণ্ঠ-কে নমস্কার জানালেন। সে সময় সেখানে বালখিল্য নামে প্রসিদ্ধ সুর্যের অন্যতম সহচারী, ব্রতচারী, বায়ুপত্র ও অম্বুমাত্রভোজী ঊর্ধরেতাঃ সহস্র সংখ্যক মুনি উপস্থিত ছিলেন। তারা বায়ুকে বললেন–হে পবন সত্তম! আপনি এক্ষণে যে নীলকণ্ঠ শব্দটি উচ্চারণ করলেন, আমরা তার গুহ্য ও পূর্ণ বিবরণ শুনতে ইচ্ছা পোষণ করছি। ও হে প্রভঞ্জন, কোন্ কারণে অম্বিকাপতি মহাদেবের কণ্ঠ নীল বর্ণ ধারণ করেছিল, আপনার মুখনিঃসৃত বাক্য থেকে আমরা তা আরও ভালোভাবে জানতে ইচ্ছা করি। হে সমীরণ, আপনার উচ্চারিত সকল বাক্যই সার্থক। কেননা বায়ু বর্ণের উচ্চারণস্থানে প্রবেশ করলেই বাক্যের প্রকাশ হয়ে থাকে। হে পবন-সত্তম, আপনার থেকেই প্রথমে জ্ঞান ও পরে উৎসাহের প্রবর্তনা হয়। আপনার স্পন্দনেই বর্ণমালার ব্যবহার। এমনকি যেখানে বাক্যের ব্যবহার নিবৃত্ত হয়, যেখানে দেহবন্ধ দুর্লভ হয়, সেখানেও আপনার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। হে সদানীল! হে সমীরণ! হে সর্বত্রগামী! আপনি ভিন্ন আর অপর কোনো দেবতা যথেচ্ছগামী নন। হে অনিল! এই জীবলোকের সবকিছুই আপনার প্রত্যক্ষ। আপনিই সম্যকভাবে সেই বাচস্পতি মনোনায়ক ঈশ্বরকে জানেন। আপনি আমাদের বলুন, কীভাবে তার কণ্ঠের এই রূপবিকার সম্ভব হল? আমাদের এই সনির্বন্ধ অনুরোধ আপনি রক্ষা করুন দেব!
সেইসব শুদ্ধাত্মা সংযতাত্মা ঋষিপ্রবরদের স্তুতিবাক্য শ্রবণ করে লোকপ্রণম্য মহাতেজোময় বায়ু প্রীত হলেন। তিনি বললেন, এই ঘটনার সূত্র নিহিত আছে পুরাকালের ঘটনার ইতিবৃত্তে, আমি সে বিষয়ে যথাতত্ত্ব জ্ঞান প্রদান করছি।
পুরাকালে সত্যযুগে বেদার্থ নির্ণয়ে তৎপর এক ধর্মাত্মার জন্ম হয়েছিল। তার নাম বশিষ্ঠ। তিনি ছিলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র। একদিন এই মহাপ্রাজ্ঞ বশিষ্ঠের সাথে মহিষাসুর নারীদের নয়নারঞ্জন দূরকারী, ক্রৌঞ্চের জীবনহারক, পার্বতীর হৃদয়নন্দন, ময়ূরবাহন মহাবল কীর্তিকেয়র, সাক্ষাৎ হল। পরম ভক্তিভরে কার্তিকেয়কে প্রণাম জানিয়ে বশিষ্ঠ মুনি তাকে দেবাদিদের কণ্ঠের রূপবিকার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন–হে উমাগৰ্ভজাত সূত! হে হরানন্দদায়ক কার্তিকেয় আপনাকে প্রণাম জানাই। আপনি অগ্নিগর্ভ, গঙ্গাগৰ্ভ, শরগর্ভ ও কৃত্তিকাপুত্র, আপনাকে প্রণাম। হে দ্বাদশনেত্র, হে ষড়ানন, আপনাকে প্রণাম, এইভাবে বিধি প্রকারে ময়ূরবাহন মহাসেনের স্তব করে বশিষ্ঠ কুমার কার্তিকেয়কে প্রশ্ন করলেন, হে মহাভাগ, আমি আপনার অতি-বিশ্বস্ত ও সংযত ভক্ত। দেবাদিদেবের কুন্দ ধবল কণ্ঠে এই যে বর্ণাবিকার দেখা যাচ্ছে, তা কীভাবে হল প্রভু? আমি আপনার একান্ত ভক্ত, আপনি যদি পাপনাশক সেই পবিত্র মঙ্গলকথা শেষ পর্যন্ত বিবৃত করেন, তাহলে আমি সাতিশয় আনন্দিত হব।
মহাত্মা বশিষ্ঠের এই অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে সেই মহাতেজাঃ দৈত্যদলনাশী দেবতা বললেন–হে বাগীশ্রেষ্ঠ, আমি যা কিছু জানি যথাতত্ত্ব আপনাকে বলছি, শ্রবণ করুন। বাল্যকালে জননী উমার স্নেহার্দ্র সান্নিধ্য বসে যা কিছু শুনেছি, সব বলছি। ঘটনাকালে পত্নী পার্বতীর সাথে সেই মহাত্মা দেবপুরুষের কী কী বাক্যালাপ হয়েছিল, আপনার প্রীতি উদ্রেকবশত তা কীর্তন করব।
কৈলাসশিখর। ত্রিভুবনের সকলের পরম কাঙিক্ষত ও পবিত্র দেবস্থান। নানা ধাতুতে বিচিত্রিত এই শৈলশিখর অতি-রমণীয়। চক্রবাকশোভিত, নানা দুষ্প্রাপ্য বৃক্ষলতায় পরিকীর্ণ এই শিখরদেশ নিত্য ভ্রমরের সংগীতে মুখর। ধারাধৌত কন্দরগুলি মত্ত ক্রৌঞ্চ ও ময়ুরের ধ্বনিত মন্দ্রিত। অপ্সরা ও কিন্নরগণ এখানে সোল্লাশে বিরাজমান। স্থানটি সিদ্ধবারণসেবিত। জীবনজীবক গুল্মলতায় আচ্ছন্ন। কোকিলকূজন বা দূর থেকে ভেসে আসা ধেণুরবে কৈলাসের পরিবেশ অভিভূত। এখান হস্তীকুল গজাননের ভয়ে ভীত হয়ে গিরিকন্দরে প্রবেশ করে। এখানে দেববনিতারা লতার দোলায় দুলে দুলে খেলা করে। তাদের শ্রুতিমধুর বীণাবাদ্যের ধ্বনিতে স্থানটি যথাসম্ভব মুখরিত। এখানকার মন্দিরগুলি মুখবাদ্য আর ক্রীড়া ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে আছে। সংলগ্ন শিখরপ্রদেশ পতাকালম্বিত দোলা ও ঘণ্টার ধ্বনিতে আকুল হয়ে পড়েছে। এছাড়া ক্রীড়ারত গণপতিদের করালবদন, ভয়াবহ হাসি এবং বিচিত্র দেহগন্ধ সকলের কাছে সন্ত্রাসজনক হয়ে উঠেছে। এখানকার শিলাতল হীরে আর স্ফটিক দিয়ে তৈরি। এই যে মনোরম শান্ত ধার্মিক স্থান, এখানেই ভূতপতি দেবাদিদেব বিরাজ করেন। তাকে বেষ্টন করে রয়েছে অগণন ভূতবৃন্দ। তাদের কেউ বাঘ, কেউ সিংহমুখ, কেউ গজ, কেউ অশ্বমুখ। কেউ কেউ উগ্র শৃগালমুখ। কেউ আবার হ্রস্ব, কেউ শ্ৰী দীর্ঘ, কেউ লম্বোদর। কারোর জানুদেশ হ্রস্ব, কারোর ওষ্ঠ লম্বমান। এরা কেউ তালজঙ্ঘ, কেউ গোকর্ণ, কেউ এককর্ণ বা মহাকর্ণ বা অকর্ণ। আবার কেউ কেউ বহুপাদ, মহাপাদ, একপাদ, বা পাদহীন, কেউ বহুমস্তক, কেউ মহামস্তক অথবা একমস্তক বা মস্তকবিহীন, এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বহুনেত্র, মহানেত্র, একনেত্র ও নেত্রবিহীন।
সেই কৈলাস শিখরের বিশুদ্ধ মনি-মুক্তোরত্নে ভূষিত, সুবর্ণমণ্ডিত শিলাতলে আসীন মহাদেবকে আপনারই মতে কৌতূহলবরে গিরিরাজকন্যা পার্বতী জিজ্ঞাসা করলেন, হে ভূত, ভবেশ্বর ভগবন, বৃষভধ্ব মহাদেব, আপনার কণ্ঠদেশে মেঘবর্ণ নীল অঞ্জনপুঞ্জের মতে এ কী শোভমান? আপনার কণ্ঠের এই যে নীলত্ব– যা অতি-স্পষ্ট নয়, আবার অতি-শুভ্র নয়, এর কারণ কী প্রভূ? আমি খুব কৌতুহলী হয়ে পড়েছি, আপনি আমাকে এসব কিছু যথার্থ কারণ দর্শান।
পার্বতীপ্রিয় শংকর পত্নীর কাছে এরকম কৌতূহলপূর্ণ বাক্য শুনে মঙ্গলযুক্ত কথা বলতে লাগলেন। তিনি বললেন–বরাননে, তোমার স্মরণে আছে, পুরাকালে দেব-দানব কর্তৃক ক্ষীর সমুদ্র মন্থনকালে প্রথমে কালানলের মতো বিষ উগত হয়েছিল। সেই বিষের বিধ্বংসী তেজে দেব ও দৈত্যরা বিষণ্ণ বদনে প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে যান। মহাদ্যুতি ব্রহ্মা সেই ভীত ত্রস্ত মন্থনরত সুরাসুরদের দেখে বললেন–হে মহাভাগ, বলুন আপনারা কীসের ভয়ে ভীত হয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছেন। আমি আপনাদের জন্য আটপ্রকার গুণৈশ্বর্য সৃষ্টি করেছি। হে সুরসমগণ, কেউ কি সেই ঐশ্বর্য থেকে আপনাদের বঞ্চিত করেছে? হে সংযমাত্মা দেবগণ, আপনাদের এত উদ্বিগ্ন বোধ করছি। কেন?
আপনারা ত্রিলোকেশ্বর। আপনাদের কোনা মনস্তাপ থাকতেও পারে না। তবে কি আমার সৃষ্ট প্রজাবর্গের মধ্যে থেকেই কেউ আপনাদের আজ্ঞা লঙ্ঘন করার দুঃসাহস করেছে?
আপনারা সকলে দিব্য বিমানে আরোহণ পূর্বক, যথাইচ্ছা গমন করতে পারেন, আপনারা সর্বদা কর্মবিপাক অনুসারে আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক বিষয়ে প্রজাদের প্রবর্তিত করতে পারেন। তাহলে এমন কি ঘটনা ঘটল যাতে আপনারা সিংহমর্দিত মৃগদের মতো ভয়োদ্বিগ্ন হয়ে আছেন? কী আপনাদের দুঃখ? কী জন্য এ সন্তাপ? কোথা থেকেই বা এত ভয় পেয়েছেন? কেনই বা আমার কাছে এসেছেন? এইসব বিষয়ে যথাশীঘ্র সম্ভব যথাযথ বর্ণনা দিন।
ব্রহ্মার আশ্বাসবাণী শুনে সেই মহাত্মা দেবগণ বললেন–হে মহাঋষি, আমরা সুরাসুররা যখন সমবেতভাবে সমুদ্রমন্থন করছিলাম, তখন নীল মেঘের মতো, সর্প ও প্রমত্ত ভ্রমরের মতো বা বলতে পারেন কালান্তক অগ্নির মতো ঘোর বিষ উদগত হতে শুরু করে। এই বিষের তীব্রতা এমনই যে মনে হচ্ছিল যে কালমৃত্যু অথবা যুগান্তে উদিত সূর্যের তেজ অথবা ত্রিলোক থেকে বিচ্ছুরিত আভা ছড়িয়ে পড়ছে। কালানদের মতো সেই বিষ উথিত হল, তখন সেই বিষভার গ্রহণ করে জনার্দনের রক্তাভ গৌরবর্ণ অঙ্গ কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করল। আমরা, উপস্থিত দেবতারা, রক্তগৌরাঙ্গ জনার্দনকে কৃষ্ণাঙ্গ দেখে খুবই ভীত হয়ে পড়েছি। তাই এর আশু সমাধানের জন্য আপনার শরণাগত হয়েছি।
দেবতাদের আবেদন শুনে লোকপিতামহ নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি সকলের হিতকামনায় অভিমত পোষণ করলেন–হে দেবগণ, হে তপোবন সুব্রত ঋষিগণ, আপনারা সকলে আমার বচন শ্রবণ করুন; মহাসমুদ্র মন্থনকালে এই যে কালানতুল্য বিষ সর্বপ্রথমে উত্থিত হল, তা ‘কালকূট’ নামে খ্যাত। ওই বিষ উদ্ভূত হওয়া মাত্র জনার্দন কৃষ্ণাঙ্গ হয়ে গেছেন কারণ শংকর ভিন্ন বিষ্ণু বা আমিও বা অন্য কোনো দেবপুঙ্গ ওই বিষের তীব্রতা সহ্য করতে সমর্থ নন। তাঁর মহিমা অপার। ওই কাল বিয়ের দহনজ্বালা থেকে বিশ্বের প্রাণীদের তিনি রক্ষা করতে, সৃষ্টি রক্ষা করতে, আসুন, আমরা সকলে মিলে বন্দনা করি। এই বলে সেই অযোনিসম্ভব পদ্মযোনি লোকপিতামহ ব্রহ্মা স্তব করতে শুরু করলেন, হে পিনাকপাণি ব্রজপানি, ত্রৈলোক্যনাথ, ভূতনাথ-আপনাকে নমস্কার। হে বিরূপাক্ষ, আপনি অনেক নেত্রশালী, আপনাকে নমস্কার। আপনি দেবশত্রুদের সংহারকারী, আপনি ত্রিনয়ন, তাপস, ব্রহ্মা, রুদ্র ও বিষ্ণু–আপনাকে নমস্কার, আপনি সাংক্যযোগ ভূতগ্রাম, মদনের অঙ্গনাশক, কালের কাল, রুদ্র, সুরেশ্বর, দেবদেব–আপনাকে প্রণাম। কপর্দী, করাল, শংকর, কপালী, বিরূপ, একরূপ, শিব, বরদ, ত্রিপুরারি, বন্দ্য, মাতৃপতি, বুদ্ধ, শুদ্ধ মুক্ত কেবল, কমনুহস্ত, দিগম্বর, শিখণ্ডী, ত্রিলোকবিধাতা, চন্দ্র, বরুণ, অগ্র, উগ্র, বিপ্র, অনেক চক্ষুঃ–আপনাকে শতকোটি প্রণাম। রজ-সত্ত্ব-তমঃ, অব্যক্তযযানি, নিত্য, অনিত্যরূপ, নিত্যনিত্য, ব্যক্ত, অব্যক্ত, চিন্তা, অচিন্ত্য চিন্ত্যাচিন্ত্য, ব্যক্তাব্যক্ত–আপনাকে নমস্কার। হে উপাপ্রিয়, শর্ব, মন্দিচক্রাঙ্কিত, পক্ষ-মাস-অধর্মস, সংবৎসর, বহুরূপ, মুণ্ড দণ্ডী বরূষী, ধ্বজী, রথী, যমী, ব্রহ্মচারী, ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, পুরুষ, ঈশ্বর আপনাকে নমস্কার। আপনি যথাকালে ভক্তদের দুঃখ নাশ করেন। আপনি নরনারায়ণ, আপনাকে সহস্র সহস্র প্রণাম জানাই। দেবাদেব শংকর, এইসব মহিমাবর্ধক, স্তবগানে কীর্তিত করে আপনাকে প্রণাম জানাই।
বরাননে এইভাবে পিতামহ ব্রহ্মার পৌরহিত্যে দেবতারা বার বার আমার স্তবগান করলেন। তারা এই ভাবে স্তব করায় আমার প্রতি তাদের সে ভক্তি প্রকাশিত হল, তাতে আমি অত্যন্ত প্রসন্ন হলাম। তাই সূক্ষ্মযোগের আতিশয্যবশত এই আমি অচিন্দ্য দেবাদিদেব আমার কেশকলাপ গঙ্গাজলে সিক্ত করলাম। তখন আমার মস্তকে শোভিত চন্দ্র আর ব্যক্ত ভাবে প্রকাশ পেল না। এইভাবে বিবিধ স্তব স্ত্রোত্র, বেদবেদাঙ্গময় বাক্যে, আমার স্তব করার ফলে আমি লোককর্তা সুমহাত্মা ব্রহ্মার প্রতি যারপরনাই প্রীত হলাম। আমি তাকে সম্বোধন করে সূক্ষ্ম কথায় বললাম, হে ভগবান! হে ভূতভব্যেশ! হে লোকনাথ জগৎপতি সুব্রত ব্রাহ্মণ! আপনার সুমিষ্ট স্তুতি আমাকে প্রীত করেছে। বলুন, আমাকে লোকহিতার্থে কী করতে হবে?
চতুরানন ব্রহ্মা এই কথা শুনে স্মিত হেসে বললেন–হে ভূত! ভব্যনাথ পদ্মলোচন ভগবান কারণেশ্বর, আমাদের সহায় হোন। দেবতা ও অসুরেরা সাগরমন্থন শুরু করলে অতীব নীল মেঘবর্ণ কালাগ্নিতুল্য এক ঘোর বিষের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। সে তো বিষ নয়, যেন কালমৃত্যু! তাতে যেন মিশে আছে যুগান্ত সূর্যের তেজ! যেন ত্রিলোকবিচ্ছুরিত সেই সূর্যাভয় চতুর্দিক বিচ্ছুরিত হচ্ছে। মন্থনজাত প্রথম উপঢৌকন রূপে এই কালানল বিষ দেখে আমরা সবাই ভীত ও উদ্বিগ্নচিত্ত হয়ে পড়েছি। হে মহাদেব, তাই আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, মানুষের হিতার্থে আপনি ওই বিষ পান করুন। আপনিই হলেন এই বিষের প্রথম ভোক্তা। প্রভু, এই বিশ্বসংসারে আপনিই শ্রেষ্ঠ। মহাদেব, এই ত্রিভুবনে আপনি ভিন্ন আর কেউ নেই যিনি এই বিষ সহ্য করতে পারেন।
পরমেষ্ঠী ব্রহ্মার সেই বচন শুনে আমি চিন্তান্বিত। আমি বললাম–তথাস্তু। বরাননে, আর ক্ষণমাত্র মুহূর্ত দেরী না করে আমি ব্রহ্মার আদেশকে শিরোধার্য করলাম। এবং সেই অনুসারে প্রাণঘাতী সেই বিষ পান করতে শুরু করলাম। বরবৰ্ণিনি, বিষ পান করার ফলে দেখতে দেখতে আমার কণ্ঠ কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, যেন লেলিহান নাগরাজ তক্ষককেই বুঝি কণ্ঠে ধারণ করেছি। এরপর লোকপিতামহ মহাত্মা ব্রহ্মা বললেন–হে রক্ষাকর্তা শংকর মহাদেব, কালকূট আপনার কণ্ঠে উপনীত হয়েছে। নীলবর্ণ কণ্ঠে শোভা পাচ্ছে তার।
হে গিরিরাজ নন্দিনী! হে বরাননে, এই করে ব্রহ্মবচনানুসারে দেব, দৈত্য, ভূত, পিশাচ, সর্প, রাক্ষস যক্ষ গন্ধর্ব সকলের সাক্ষাতে সেই ঘোর বিষ আমি কণ্ঠে ধারণ করলাম। সেই থেকে আমার নাম নীলকণ্ঠ।
ওহে পর্বতরাজপুত্র, সেই উগ্র তেজ কালকুটকে কণ্ঠে ধারণ করছি দেখে দেবাসুররা বিস্মিত হয়ে উঠলেন। তখন সমস্ত দেবতা দৈত্য, উরগ, রাক্ষস সকলে কৃতাঞ্জলী হয়ে বললেন, অহো! হে দেবাদিদেব, আপনার বল-বীর্য, পরাক্রম অতীব বিস্ময়করা। আপনার প্রভুত্ব, আপনার যোগফল বিস্ময়কর গঙ্গাজলে সিক্ত আপনার মুক্তকেশ। আপনিই বিষ্ণু, আপনিই চতুরানন, আপনিই মৃত্যুবরদ! আপনিই সূর্য চন্দ্র ভূমি সলিল যজ্ঞ ও সূক্ষ্ম পুরুষ, সূক্ষ হতে ও সূক্ষ্মতর আপনার রূপবৈভব। আপনি বহ্নিপবন আপনি এই চরাচরের কর্তা এবং প্রলয়কালের সংহর্তা। আমার উদ্দেশ্যে এইসব বহুবিধ স্তুতিবাক্যের বিচ্ছুরণ করে নতমস্তকে আমাকে প্রণাম করে সেইসব মহাত্মাদেবতারা নিজ নিজ দিব্য বিমানে আরোহণ পূর্বক অনিয়ন্ত্রিতবেগে সুমেরু গিরিশৃঙ্গের দিকে প্রস্থান করলেন।
হে দেবী নীলকণ্ঠ আখ্যান লোকবিখ্যাত কথা। ইহা অতি-গুহ্য কথা, পুণ্য থেকে পুণ্যতর। স্বয়ং স্বয়ম্ভু সেই পুণ্য পাপনাশক কথা বলেছেন। যিনি ব্রক্ষা থেকে উদ্ভূত এই কথা নিত্য শ্রবণ করেন, তার বিপুল ফললাভ হয়।
হে বরারহে, স্থাবর-জঙ্গমে যত বিষ আছে, সব তার শরীর স্পর্শ লাভ করা মাত্রই বিনষ্ট হয়ে যাবে, এছাড়া এই কথা যিনি শুনবেন তার ঘোর অশুভ উপশমিত হয়, দুঃস্বপ্ন দূর হয়, সে ব্যক্তি রমণীদের মধ্যে প্রিয় হন, সভায় রাজার প্রিয় হন, তার গৃহে অতুল সম্পদ নিত্য বিরাজ করে। বরাননে, সেই ব্যক্তি ইচ্ছামতন নারীশরীর রমণ করতে পারেন। সেই ব্যক্তি ইচ্ছামাত্র নীলকণ্ঠ, হরিৎশ্মশ্রু, শশিশেখর, ত্রিশূলপাণি, ত্রিনেত্র, বৃষন, পিনাকধারী ও নন্দী–এদের সমান পরাক্রমশালী হতে পারেন। আকাশের মাঝে বায়ু যেমন অব্যাহত গতিতে চলে বেড়ায়, তিনি-ও তেমনি আমার আদেশে সর্বলোক বিচরণ করতে পারেন। সেই ব্যক্তি প্রলয় পর্যন্ত আমার মতো বলশালী হয়ে থাকবেন।
হে বরারোহে, যেসব ব্যক্তি এই কথা শোনেন, এবার তাদের ইহলোক ও পরলোকের গতির কথা বলব, যেমনু ব্রাহ্মণ বেদলাভ করেন, ক্ষত্রিয় পৃথিবী জয় করেন, বৈশ্য ব্যবসায় লাভবান হন এবং শূদ্র জীবন ধরে সুখী থাকেন। রোগগ্রস্ত ব্যক্তি রোগ থেকে এবং বদ্ধ ব্যক্তি বন্ধন থেকে মুক্ত হন। গর্ভিনী পুত্র লাভ করেন, কন্যা সৎচরিত্র পতি লাভ করেন, ইহলোক বা পরলোকের নষ্ট দ্রব্য আবার ফিরে পাওয়া যায়। শত সহস্র গো-দানে যে ফল মেলে বিভু ঈশ্বরের এই দিব্য বচন শুনেও সেই একই ফল লাভ হয়। যে ব্যক্তি নিত্যদিন একটি শ্লোক অথবা অর্ধশ্লোক অথবা শ্লোকের একটি চরণ বা অর্ধচরণ পাঠ করেন, তিনি জীবনান্তে রুদ্রলোক লাভ করেন।
গুহাপ্রিয় নন্দিচক্রাঙ্কিত উমাত্রিয় শশিশেখর দেবীর কাছে এই পাপনাশক দিব্য কথা বিবৃত করে দেবীর সাথেই বৃষপৃষ্ঠে আরোহণ করে কিষ্কিন্ধ্যা পর্বত গুহার দিকে চলে গেলেন।
এই সমুদয় বৃত্তান্ত বিবৃত করে জগৎপ্রাণ পবন সত্তম বায়ুও আদিত্য পথে চলে গেলেন। তার মুখনিঃসৃত এই সুলক্ষণ লোককথা শ্রবণ করে জ্ঞান-অভিলাষী সুব্রত ঋষিগণ ধন্য হলেন।
.
৪৯.
ধর্মপ্রাণ ঋষিদের জিজ্ঞাসার কোনো অন্ত ছিল না। তার পুনরায় পুরাণজ্ঞ লোমহর্ষণকে বললেন, হে বাগ্মীবর, আপনি আমাদের বলুন–গুণ, কর্ম ও প্রভাবের বিচারে এই বিশ্বসংসারে কোন ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ? এইসব আশ্চর্য কথা আমরা আরও ভালোভাবে শুনতে ইচ্ছা করি।
মহর্ষি সূত বললেন, এ সম্বন্ধে মহেশ্বরের মহাত্মময় এক অতি-পুরাতন ইতিহাস আছে। বহু পূর্বে ত্রিলোকবিজয় সম্পূর্ণ করার সময় দেবাদেব বিষ্ণু এটি কীর্তিত করেছিলেন।
পুরাকালে একবার ত্রৈলোক্যাধিপতি মহাতেজঃ বলিকে অবরূদ্ধ করেন। সঙ্গী দৈত্যরা পলায়ন করলেন। কার্যসমাধা করে শচীপতি সন্তুষ্টি লাভ করলেন। ইন্দ্রাদি সকল দেবগণ এই বিপুল জয়লাভের সৌভাগ্য প্রদায়ক প্রভুর স্তুতি করলেন। তিনি তখন ক্ষীর সমুদ্রের কাছে বিশ্বরূপাত্মা রূপে বিরাজ করছেন। দেবাদিদেবের গুণকীর্তন করার জন্য সিদ্ধ, চারণ, ব্রহ্মর্ষি, যক্ষ, গন্ধর্ব, অপ্সরা দেবর্ষি, নাগ, নদী ও পর্ব, সকলেই তার কাছে গিয়ে স্তব করতে লাগলেন। তারা বলতে লাগলেন, এই জগতের ধাতা আপনি, কর্তাও আপনি। প্রভো! আপনিই লোকসমূহ সৃষ্টি করেছেন। আপনার প্রসাদে ত্রিলোক অব্যয় কল্যাণলাভ করেছে। আপনি সমস্ত অসুরকুলকে পরাজিত করেছেন, দুরাত্মা বলিকে অবরূব্ধ করেছেন। আপনাকে যতখানি রক্ষাকর্তা প্রজাপালক বলে বোধ হয় আপনি তার থেকে অধিক সংবেদনশীল।
সিদ্ধগণ, মহাঋষিগণ এবং দেবতাদের দ্বারা স্তুত হয়ে পুরুষোত্তম বিষ্ণু এখন দেবতাদের উদ্দেশে বললেন, হে সুরসমগণ, আপনারা কিঞ্চিৎ ধৈৰ্য্য অবলম্বন করুন। যে লোকহিতকর কর্মের বশে আপনারা আমার গুণকীর্তন করছেন, সে বিষয়ে আরও কিছু আপনাদের জ্ঞেয় হওয়া উচিত। আমি সাধ্যমতো আপনাদের কারণ বিবৃত করছি, শুনুন।
সর্বভূতের স্রষ্টা ও সংহারক কালনির্মাতাও প্রভুস্বরূপ স্বয়ম্ভ প্রজাপতি ব্রহ্মাই মায়ার সহায়তায় এই দৃশ্যমান লোকসমূহের সৃষ্টি করেছেন। তারই অনুগ্রহে এই আদিসিদ্ধি সম্ভব হয়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন অব্যক্ত পুরাকালে যখন অন্ধকার ত্রিলোককে গ্রাস করেছিল, তখন ভূতগণকে উদরে স্থাপিত করে এই আমি সহস্র শীর্ষ ভূতাত্মা সহস্রাক্ষ সহস্রপাদ বিষ্ণু শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম হাতে ক্ষীর সমুদ্রের বিমলোদকে শায়িত ছিলাম। এমন সময়ে দূর থেকে এক পুরুষকে দেখতে পেলাম। তিনি চতুর্মুখ মহাযোগী কৃষ্ণাচর্মধারী কমণ্ডলু বিভূষিত এক অমিত প্রভাময় দেবতা। তার নিজের দীপ্তি শত সূর্যের সঙ্গে তুলনীয়। তিনি নিজের তেজেই তেজস্বী। নিমেষ মধ্যে সর্বলোক প্রণম্য সেই পুরুষোত্তম ব্রহ্মা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? কোথা হতেই বা এখানে এসেছেন? কেনই-বা এই সমুদ্র মধ্যে অবস্থান করছেন? আমি প্রজাপতির কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমি এই জগৎ-চরাচরের কর্তা, স্বয়ম্ভ ও বিশ্বতোমুখ। ব্রহ্মা আত্ম পরিচয় দেওয়ার পর আমি তাকে বললাম, এই সৃষ্টিকে আমি রক্ষা করে চলেছি। এই চরাচরের আমিই কর্তা। আমি বারংবার এই চরাচরের সৃষ্টি করি আর পরক্ষণেই সংহার করি। এই তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে তুমুল বাগবিতণ্ডা শুরু হল এবং আমরা দুজনেই যেকোন মূল্যে পরস্পরের ওপর কর্তৃত্ব করতে চাইলাম। বলা যায় পরস্পরের জয়াভিলাষী হয়ে উঠলাম।
এমন সময় উত্তর দিশাতে এক জ্বলন্ত জ্বালা আমাদের দৃষ্টিগোচর হল। সেই জ্বালার বিশালতা দেখে আমাদের দুজনের মনেই বিস্ময় জন্মাল। সেই জ্বালার তেজে আমাদের সমস্ত পুণ্য জ্যোতি ম্লান হয়ে গেল। ক্রমে ক্রমে সেই আদ্যন্ত অদ্ভুত বহ্নিশিখা বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমি ও ব্রহ্মা, দুজনেই তৎক্ষণাৎ সেই জ্বালার কাছে ছুটে গিয়ে দেখলাম, স্বর্গ-মর্ত্যকে অবদমিত করে সেই জ্বালা মণ্ডল অবস্থান করছে। তার মধ্যে শোভা পাচ্ছে বিপুল প্রভাবিশিষ্ট এক লিঙ্গ। লিঙ্গটি কেবল একটি স্থান বিশেষেই অবস্থান করছে। লিঙ্গটি অব্যক্ত, অতি-দীপ্ত অথচ সুবর্ণ বা শিলা বা রজত নির্মিত নয়। লিঙ্গটি অনির্দেশ্য, অচিন্ত্য, বারবার ব্যক্ত-অব্যক্ত, মহাতেজাঃ মহাঘোর ও শীঘ্র বর্ধনশীল। আগ্নেয় দীর্ঘায়িত লিঙ্গটি বিক্ষিপ্ত ও সর্বভূতের পক্ষে ভয়ংকর। স্পষ্ট অনুধাবন করলাম, এই ঘোররূপী লিঙ্গের আদি-অন্তকে জানা স্বর্গ ও পৃথিবীকে ভেদ করার মতোই কঠিন কাজ।
জ্বালাময় লিঙ্গের এই অতি-দীপ্ত ভয়ংকরতা প্রভু-ব্রহ্মাকেও একইভাবে বিস্ময়াভূত করল। ব্রহ্মা আমাকে বললেন, আপনি অতন্দ্রিত হয়ে এই লিঙ্গের অধোদেশে গমন করুন। আমি ঊর্ধ্বদেশের দিকে প্রস্থান করছি। আমরা এইভাবেই এই মহাত্মা লিঙ্গের রহস্যভেদ করতে পারব।
তখন আমরা দুজন ঊর্ধ্ব ও অধোদেশে গেলাম। আমি সহস্র বৎসর অর্ধেদেশে সন্ধান করেও কোনো অন্ত খুঁজে পেলাম না। আমি নিসন্দেহে ভীত হয়ে পড়লাম। একইভাবে ব্রহ্মাও উধ্বদেশে গিয়ে কোনো সীমানা খুঁজে পেলেন না। তিনিও অতিশয় শ্রান্ত হয়ে পড়লেন। অগত্যা দুজনেই সেই মহাসমুদ্রের কাছে ফিরে এলাম। আমরা দুজনেই বিস্ময়াবিষ্ট হলাম। সেই জ্বালাময় মহান মহাত্মার মায়ায় মোহিত হলাম। এক সময় তার বিপুলতায় সংজ্ঞা পর্যন্ত হারালাম। পুনরায় সেই সর্বতোমুখ, সর্বজ্ঞ চরাচরের সৃষ্টি ও নিধনকারী অব্যয় প্রভুর ধ্যানে মগ্ন হলাম। আমরা কৃতাঞ্জলী হয়ে সেই শূলপানি, শর্ব, মহাভৈরবনাদ, ভীমরূপ ও দ্রংষ্ট্ৰী, সকল জীববিনাশক, অব্যক্ত অব্যয়কে ধ্যান করতে শুরু করলাম। তাকে প্রণাম করে তার স্ততি বশে বললাম, হে দেব, হে দেবাদিদেব, হে নরগণের প্রভু! আপনাকে প্রণাম। আপনি পরমেশ্বর। পরম ব্রহ্মা, অক্ষর, পরমপদ, বামদেব, রুদ্র, স্কন্দ, শিব ও প্রভু নিঃশংসয়ে জেনেছি আপনিই শ্রেষ্ঠ।
আপনি মহান্ত, শাশ্বত, সিদ্ধযোনি ও সর্বজগতের প্রতিষ্ঠা। আপনাকে প্রণাম। আপনি যজ্ঞ, আপনি বষটকার, আপনি ওঁঙ্কার, আপনি পরাৎপর, আপনি স্বাহাকার নমস্কার সর্বকর্মের সংস্কার, স্বধাকার, জাপ্যব্রত ও নিয়ম আপনাকে প্রণাম। হে সর্বজ্ঞ ভগবান, আপনি বেদনোক ও সর্বতোভাবে দেবস্বরূপ। আপনি আকাশের শব্দ, আপনি প্রাণীদের অব্যয় কারণ। আপনি পৃথিবীর গন্ধ, জলের রস, তেজের রূপ। আপনাকে নমস্কার। আপনি মহেশ্বর, বায়ুর স্পর্শ ও চন্দ্রমার দিব্যদেহ। হে দেবেশ, আপনি তো প্রাজ্ঞ, আপনি জ্ঞান ও প্রকৃতির বীজস্বরূপ। আপনি সর্বভূতের কর্তা, কাল, মৃত্যু ও সর্ব বিনাশক যম। আপনি এই ত্রিলোক ধারণ করে আছেন। আপনি প্রণম্য, আপনিই তো ভূমিতলে প্রজাদের সৃষ্টি করেছেন। আপনিই তো ভূমিতলে প্রজাদের সৃষ্টি করেছেন। তাদের কাছে পূর্ববদনে ইন্দ্ৰত্ব প্ৰকষ্ট করেছেন, দক্ষিণ বদনে লোকসমূহের ক্ষয়সাধন করেছেন, পশ্চিম বদনে বরুণত্ব প্রকাশ করেছেন। আপনার উত্তর মুখে সৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত। অতএব হে দেব, আপনি লোকেদের অব্যয় কারণরূপে বহু প্রকারে বিরাজ করেন। আপনাকে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।
হে দেবেশ! অশ্বিনীকুমার দ্বয়, আদিত্য, বসু রুদ্র, মরূৎ, সাধা, বিদ্যাধর নাগ, চারণ, তপোবন বালখিল্য মহাত্মা তপোসিদ্ধ, সুব্রত ও ব্রতনিরত পুরুষগণ–এঁরা সকলেই তো আপনার থেকেই প্রসূত হয়েছে। এমনকি কুহু, ক্রিয়া, সীতা, উমা গায়ত্রী, সিনীবালী, লক্ষ্মী, কীর্তি, ধৃতি, মেধা, লজ্জা, ক্ষান্তি, বপুঃ, স্বধা, তুষ্টি, পুষ্টি, বাগদেবী সরস্বত, সন্ধা, রাত্রি–হে দেবেশ আপনার থেকেই উৎপন্না হয়েছেন। আপনি অযুত সূর্য প্রভার অধিকারী, সহস্র চন্দ্রকান্তির অধিকারী। পর্বতরূপধারী সর্বগুণাকর। আপনাকে সহস্র সহস্র নমস্কার। পটিশরূপধারী, চর্মবিভূতিধারী, পিণাকপাণি রুদ্রও সায়ক চক্রধারী আপনি-আপনাকে প্রণাম। হে মদন মথন! হে ভস্মভূষিত তণু! আপনি সুবর্ণ বস্ত্রধারী, সুবর্ণবাহু, সুবৰ্ণরূপ সুবর্নাভ–আপনাকে প্রণাম। আপনার বিচিত্র সহস্র নেত্র। হে হিরণ্যরেতঃ হিরণ্যবর্ণ, হিরণ্যগর্ভ–আপনাকে প্রণাম। হে হিরণ্যমালী, হিরণ্যদায়ী, হিরণ্যবাহী, হিরণ্যপথ আপনাকে প্রণাম, হে ভৈরবনাদনাদী, ভৈরব বেগবেগ দেবদেব শংকর! হে নীলকণ্ঠ–দিব্যসহস্যরবাহু, নৃত্যবাদ্য প্রিয় আপনাকে শতকোটি প্রণাম।
ভীমরূপ সর্বতোমুখ মহামতি শূলপানি এইভাবে বিবিধ ভাষণে স্তুত হয়ে ব্যক্ত হলেন। কোটি কোটি সূর্যপ্রভার অধিকারী হয়ে সেই মহাযোগী দেবতা তীব্রতার সঙ্গে দীপ্তি পেতে লাগলেন। এইভাবে অবিভাষিত হয়ে সেই মহেশ্বর মহাদেব সন্তুষ্ট হলেন। তাকে দেখে মনে হল যেন তিনি কোটি কোটি মুখ বিস্তার করে সবকিছুকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছেন। নানা ভূষণ ভূষিত নানা চিত্র বিচিত্রকলেবর নানা মাল্য গন্ধশোভিত সেই একগ্রীব একটজঠা দেবেশ্বর শূল, দণ্ড ও কৃষ্ণাজিন ধারণ করে বিকট হাসিতে আকাশমণ্ডল পরিপূর্ণ করলেন। মহাত্মা বৃষভাসনের সেই বিকট হাসিতে আমরা ভীত হয়ে উঠলাম। তখন সেই মহাযোগী বললেন, হে সুরসত্তমযুগল, আমি আপনাদের দুজনের প্রতিই সম্যক্ প্রীত হয়েছি।
আমার এই দুর্লভ মহামায়াকে দর্শন করুন। মনু থেকে সমস্ত ভয় ত্যাগ করুন। আপনারা হয়তো বিস্মৃত হয়েছেন যে, পুরাকালে আপনারা দুজনে আমার গাত্র প্রসূত ছিলেন। লোক পিতামহ ব্রহ্মা আপনি ছিলেন আমার দক্ষিণবাহু আর মহাত্মা বিষ্ণু ছিলেন আমার বামবাহু। আপনাদের প্রতি স্তবস্তুতি অর্চনায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। তাই আপনাদের দুজনকে ইচ্ছেমতো বরদান করতে ইচ্ছা করি।
তখন প্রহৃষ্ট চিত্তে নিষ্পাপ পুরুষ ব্রহ্মা আমি স্বয়ং মহাদেবের চরণে প্রণত হয়ে বললাম, হে দেব, হে সুরেশ্বর যদি আপনি প্রকৃতই আমাদের প্রতি প্রীত হন এবং যদি প্রকৃতই বরদান করতে চান, তবে এই বর দিন যেন আপনার প্রতি আমাদের নিত্য ভক্তি থাকে।
ভগবান শ্রীমান শংকর বললেন, তবে তাই হোক। আপনারা পৃথিবীতে বিবিধ প্রজা সৃষ্টি করুন। এই বলে ভগবান অন্তর্হিত হলেন।
পূর্ব কথন সাঙ্গ করে সমবেত মহিমাকীর্তক দেবতাদের উদ্দেশ্য করে সহস্রাক্ষ বিষ্ণু বললেন, এতক্ষণ সেই যোগীর সুপ্রভাবে আমি আপনাদের কাছে এইসব কথা বললাম। সেই মহেশ্বরই এই বিশ্বের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। আমরা নিতান্তই হেতুমাত্র, শিবসংজ্ঞক এই রূপ অজ্ঞাত, অব্যক্ত, অতিন্ত্য এবং অদৃশ্য। যাঁদের জ্ঞানচক্ষু আছে, কেবলমাত্র তারাই তাঁকে দর্শন করেন। তাঁরা সাহায্যেই জ্ঞানচক্ষুগণ সূক্ষ্ম ও অচিন্ত্যকে দর্শন করে থাকেন। আমি সেই দেবাধিপতিকে প্রণাম জানাই। হে মহাদেব, হে মহেশ্বর, হে সুরাসুরশ্রেষ্ঠ মনোহংস, আপনাকে প্রণাম!
সূত বললেন–বিষ্ণুকণ্ঠে শিবমহিমা শুনে সব দেবতারা হৃষ্টমনে নিজের নিজের গৃহে প্রস্থান করলেন। আপনারাও স্মরণে রাখবেন, মহাত্মা শিব শংকরের উদ্দেশ্যে যিনি প্রণাম নিবেদন করেন, যিনি সেই মহাত্মা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে স্তব পাঠ করেন তিনি সমস্ত কাম্য বস্তু লাভ করবেন, পাপ থেকে মুক্ত হবেন। মহাদেবের অনুগ্রহে সেই প্রভু বিষ্ণু সনাতন ব্রহ্মাকে এই যা কিছু বলেছিলেন, আমি লোমহর্ষণ সূত মহেশ্বরের বলসহ সবকিছু আপনাদের কাছে ব্যক্ত করলাম।
.
৫০.
পরম আগ্রহ ভরে মহর্ষি শাংশপায়ন বললেন–সূত আপন সর্বজ্ঞ। আপনি আমাদের কাছে কীভাবে ইলার পুত্র রাজা পুরূরবা প্রতি মাসে অমাবস্যায় স্বর্গে গমন করতেন এবং কীভাবেই বা পিতৃতর্পণ করতেন, তা কীর্তিত করুণ।
সূত প্রত্যুত্তরে বললেন, শাংশপায়ণ, যেভাবে আদিত্যের সাথে ইলাপুত্র পুরূরবা এবং মহাত্মা চন্দ্রের সংযোগ ঘটে থাকে, আমি তা যথাতত্ত্ব বর্ণনা করব। যেভাবে পক্ষান্তরে জলময় চন্দ্রের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে, যেভাবে দেবকাল ও পিতৃকালের নির্ণয় করা হয়, যেভাবে চন্দ্র থেকে অমৃত প্রাপ্তি ঘটে, যেভাবে ইলাসূত পুরারবা পিতৃতর্পণ করেছিলেন এবং যেভাবে পীতচন্দ্র পিতৃগণের ও কব্যাগ্নি দর্শন ঘটেছিল সেইসব ঘটনার উৎস পুর্বানুসারে এবং ক্রমানুসারে বিবৃত করব।
যখন অমাবস্যার রাত্রিতে চন্দ্র ও সূর্য নক্ষত্রের সাথে মিলিত হয়ে এক মণ্ডলে বাস করে, সেই সময় মহারাজ পুরূরবা চন্দ্র-সূর্যকে দর্শন করার জন্য স্বর্গে গমন করেন। সেখানে মাতামহ ও পিতামহকে অভিবাদন জানিয়ে কিছুকাল অবস্থান করেন। এভাবে প্রতি অমাবস্যায় মহারাজ পুরূরবা স্বর্গে অবস্থানপূর্বক চন্দ্রের সাথে সযত্নে পিতৃগণের উপাসনা করেন। তারপর পুরূরবা সূর্যে এক কলা অপেক্ষা করে দেখতে থাকেন। কীভাবে চন্দ্র থেকে পনেরোটি কলায় সুধামৃত নিঃসৃত হয়ে থাকে। রাজেন্দ্র পুরূরবা প্রতি কৃষ্ণপক্ষে চন্দ্রকিরণের সাথে তা থেকে সদঃক্ষরিত মধু ও সুধা দিয়ে পিতৃগণের তর্পণ করেন সেই সাথে তিনি সৌম্য, বহির্ষদ, কাব্য, অগ্নিদাত্ত প্রমুখেরও তর্পণ করেন।
অগ্নি নামে যে ঋতু উক্ত হয়েছে, তাই-ই হল সংবৎসর। এই সংবৎসর থেকেই সকল ঋতুর আবির্ভাব ঘটেছে। আবার ঋতুগণ থেকে আর্তবের উদ্ভব ঘটেছে। অর্ধমাস নামক আর্তবগণ হলেন পিতা এবং তারা অব্দের পুত্র। পিতামহ, মাস ও ঋতু-এঁরাও অব্দপুত্র। প্ররিতামহগণ, দেবগণও পঞ্চাব্দগণ হলেন ব্রহ্মার পুত্র। সোম থেকে সৌমের এবং কবি থেকে কাব্যের জন্ম হয়েছে। সৌমোৎপন্ন দেবগণ উপহূত হয় সোমরস পান করেন।
কবিজাত কাব্যগণ উপহৃত হয়ে আজ্য পান করেন। পিতৃগণ আবার তিন প্রকারের হয়ে থাকেন। যথা–কাব্য, বহিষদ ও অগ্নিধাত্ত। আর গৃহস্থ, যজ্বা, অগ্নিধ্বাত্ত, আর্তব, অষ্টকাপতি ও কাব্য এবং পঞ্চাব্দ এঁরা সকলেই বহির্ষদ নামে খ্যাত। এঁদের সাংবৎসর হল অগ্নি, পরিবৎসর হল সূর্য, ইম্বৎসর হল সোম, অনুবৎসর হল বায়ু এবং রুদ্র হল বৎসর। এঁরা আবার কিছু কিছু পঞ্চাব্দ ও যুগাত্মক-এ বিভক্ত। তাঁরা হলেন লেখ, উত্মাপ, ও দিব্যকীর্তা। তারা প্রত্যেক মাসের অমাবস্যায় স্বর্গে অবস্থান করে সুধাপান করে থাকেন। সোম বা চন্দ্র থেকে প্রতি মাসে সুধা নির্গত হয়। এই গলিত সুধারস সোমপায়ী পিতৃগণের কাছে অমৃততুল্য। এই চন্দ্ৰসুধারুপ অমৃত দিয়েই পুরূরবা পিতৃগণর তর্পণ করতেন। সোম থেকে সমুৎপন্ন এই অমৃতকে ‘সুধা’ ও ‘মধু’ নামে অভিহিত করা হয়। কৃষ্ণপক্ষে দেবগণ চন্দ্রের পনেরোটি কলাকে এক এক করে পান করেন। এইভাবে এক মাস কাল ধরে অমৃত পান করার পর দেবগণ চতুর্দশ কলায় উপনীত হন। দেবগণের দ্বারা এক একটি করে কলা গৃহীত হবার পর অমাবস্যার নির্দিষ্ট দিনটিতে চন্দ্র পঞ্চদশ কলায় অবস্থান করেন। অমাবস্যার দিনে চন্দ্রের কলাসমূহ সুষম্না দ্বারা আপ্যায়িত হয়। পিতৃগণ দ্বিকলা পরিমিত কাল পর্যন্ত চন্দ্ৰসুধা পান করেন। তারপর পানের ফলে চন্দ্র ক্ষয় পেতে থাকে। সূর্য তখন সেই ক্ষয়িত চন্দ্রকে সুষুম্না নামক রশ্মি দ্বারা আপ্যায়িত করে। চন্দ্রকলা সকল নিঃশেষিত হবার পর এইভাবে চন্দ্রকে আবার বর্ধিত করা হয়। সুষুম্না রশ্মির দ্বারা বাধিত চন্দ্রের কৃষ্ণকলায় ক্ষয় ও প্রতিদিন শুক্লকলার বৃদ্ধি হয়ে থাকে। এইবাবে সূর্যের সুষুম্না রশ্মির প্রভাবে চন্দ্রের কলা বৃদ্ধি পেতে পেতে পৌৰ্ণর্মসীতে শুক্লবর্ণ ধারণ করে এবং পরিপূর্ণ মণ্ডল হয়। শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের পরিবর্তনে এইভাবে পর্যায়ক্রমে চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধি হয়ে থাকে। এই পিতৃমান পরিপূর্ণ চন্দ্র ক্রমে ‘ইষৎসব’ নামে বিখ্যাত হয় এবং পনেরোটি সুধামৃতধারার সঙ্গে চন্দ্রপথ অতিক্রম করে।
এবার আমি পর্ব ও পর্বসন্ধি বিষয়ে বিস্তৃত বর্ণনা প্রদান করব।
আখ ও বাঁশ গাছের পর্বগ্রন্থি আছে, আপনারা দেখেছেন। ঠিক সেইরকম শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ হল অর্ধমাসের পর্ববিশেষ। পূর্ণিমা ও অমাবস্যার ভেদে যে গ্রন্থি বা সন্ধি আছে তা হল অর্ধমাস পর্ববিশেষ। পূর্ণিমা ও অমাবস্যার ভেদে যে গ্রন্থি বা সন্ধি আছে তা হল অধর্মসস্বরূপ এবং তাই-ই পর্ব। তৃতীয়া থেকে সেই পর্বের আরম্ভ শুরু হয়। পৰ্বারম্ভের সেই দিন থেকে অগ্ন্যানক্রিয়া করতে হয়। সায়াহ্নে প্রতিপাদ হলে সেই কাল ‘পৌর্ণমাসিক’ বলে নিরূপিত হয়। সূর্য যদি ব্যাতীপাতে অবস্থান করে তাহলে যুগান্তরে লোখোর্ধ এবং যদি যুগান্তরে উদিত হয় তাহলে চন্দ্রের লোখোৰ্দ্ধ হয়ে থাকে, পৌর্ণমাসী ব্যতীপাতে চন্দ্র ও সূর্য পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। যে সময়ে তাকে সীমান্তে দেখা যায়, তাকেই বলা হয় ব্যাতীপাত। ব্যাতীপাত দ্বারাই ক্রিয়াকাল নির্ণীত হয়।
চন্দ্র শুক্লপক্ষীয় রজনীতে পূর্ণতা লাভ করে। এই নাম পূর্ণিমা, এই পূর্ণিমাকে পিতৃগণ দেবগণের সাথে একসঙ্গে দেখে থাকেন। সেইজন্য অনুমতি নামের পূর্ণিমাকে প্রথমা বলা হয়। আবার যেহেতু পৌর্ণমাসীতে চন্দ্রের দীপ্তি খুবই বৃদ্ধি পায়, তাই পণ্ডিতেরা এই পূর্ণিমাকে ‘রাকা’ বলে অভিহিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। যে রজনীতে চন্দ্র ও সূর্য এক নক্ষত্রে অবস্থান করে তাকে বলে অমাবস্যা। পূর্ণিমার পনেরো দিন পর যে রাত্রি আসে তাকে অমাবস্যা বলে। যে কালে অমাবস্যার পর্ব সন্ধিগুলিতে দুটি করে লব থাকে, সেই কালকে দুই অক্ষরযুক্ত কুহু নামে চিহ্নিত হয়ে থাকে। যদিও লুপ্তচন্দ্রা তবুও অমাবস্যা মধ্যসূর্যের সাথে মিলিত হয়। দিনের অধভাগ থেকে রাত্রির অর্ধভাগ পর্যন্ত সময় সূর্যের সাথে মিলিত হবার পর চন্দ্র শুক্লপক্ষের প্রতিপদে সূর্যমণ্ডল থেকে হঠাৎ মুক্ত হয়। প্রভাতে দুই মুহূর্তের মিলনকে সঙ্গম বলে। মধ্যাহ্নকালে সূর্য এখান থেকেই নিষ্ক্রান্ত হয়। প্রতিপদে, চন্দ্র সূর্যমণ্ডলে থেকে বিযুক্ত হয়। বিমুক্ত সূর্যমণ্ডল ও চন্দ্রমণ্ডলের মধ্যবর্তী কালই সেই আহুতি ও বষট্ ক্রিয়ার কাল যে অমাবস্যা তাকে এই পর্বের ঋতুমুখ বলে জানবেন। ক্ষীণ চন্দ্রযুক্ত কৃষ্ণপক্ষে অমাবস্যাই দিবাপর্ব। এই জন্যই অমাবস্যার দিনে সূর্যকে দেখা যায়। লোকমান্য ও প্রাজ্ঞ পণ্ডিতেরা চন্দ্রের সেইসব কলাকে তিথি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা দান করেছেন। তখনও পর্যন্ত সূর্য ও চন্দ্র এরা দুজনেই পরস্পরকে দেখে থাকে। এরপর ক্রমে সূর্যমণ্ডল থেকে চন্দ্র নির্গত হতে থাকে। দিন ও রাত্রি মিলিয়ে চন্দ্র দুই লব মাত্র সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করে। সেই কালকে ‘আহুতি ও বষট্ক্রিয়ার কাল’ বলা হয়ে থাকে। কোকিলের ডাক অনুসারে চিহ্নিত এই অমাবস্যার কালটি কুহু নামেও পরিচিত হয়ে থাকে। সিনীবালী পরিমাণ অনুযায়ী ক্ষীণ চন্দ্র অমাবস্যার দিবাভাগে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করে।
পর্বের কাল পর্বের তুল্য। সূর্য ও চন্দ্রের ব্যাতীপীতে সেই উভয় পূর্ণিমা সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রতিপদ ও পঞ্চদশীতে দ্বিমাত্রা পরিমিত পর্বকাল হয়ে থাকে। কুহু ও সিনীবালীতে সমস্ত পৰ্বকাল দ্বিলব পরিমিত হয়ে থাকে। চন্দ্র নির্মল হলে পৰ্বকালও কলাতুল্য হয়। এই পর্বসন্ধিসমূহে রাত্রির সেই শুক্লপক্ষ হয়ে থাকে এবং পূর্ণমণ্ডল শ্রীমণ্ডিত চন্দ্ৰ উপরঞ্জিত হয়। ক্রমে পঞ্চদশীতে চন্দ্র বৃদ্ধি লাভ করে। তাই তখন হয় পূর্ণিমা, এইভাবে একটু একটু করে পঞ্চদশ দিনে চন্দ্রে পঞ্চদশ কলাই পূর্ণ হয়। সে কারণেই চন্দ্রের পঞ্চদশ কলাই পূর্ণ হয়। সে কারণেই চন্দ্রে কেবলমাত্র পঞ্চদশ কলাই আছে, যোড়শ কলা নেই। আর এই একই কারণে পঞ্চদশীতে অর্থাৎ অমাবস্যার দিনে চন্দ্রের অত্যন্ত ক্ষয় হয়।
পূর্বোক্ত পিতৃগণ এইভাবে সোম পান করে বৃদ্ধি পেয়ে থাকেন। আপনারা আর্তব, ঋতু ও অব্দদেরও দেবতাদের মতো জ্ঞান করবেন। এরপর আমি আমাদের মাংস শ্রাদ্ধ ভোক্তা পিতৃগণের বিষয়ে বলব। চর্মচক্ষু দিয়ে তো একেবারেই নয়, এমনকি প্রসিদ্ধ তপস্যার দ্বারাও তাদের গতি, সত্ত্ব, শ্রাদ্ধপ্রাপ্তি, অমৃতলাভ, পুনরাগমন বিষয়ে জানা যায় না। এঁরা হলেন শ্রাদ্ধদের নামক পিতৃগণ, এঁদের আপনারা লৌকিক বলেই জানবেন। দেব, সৌম ও যজ্বা এঁরা সকলেই অযোনিসম্ভব। এরা সকলেই দেবপিতৃগণকে পালন করে থাকেন। মনুষ্যপিতৃগণ কিন্তু দেবপিতৃগণ থেকে ভিন্ন। এঁরা হলেন লৌকিক পিতৃগণ, পিতা পিতামহ প্রপিতামহ–সকলেই সোমরস দিয়ে যজ্ঞ করেন, তাই এঁদের সকলকেই ‘সোমবান’ বলা হয়। এঁদের মধ্যে যাঁরা যজ্বা, তাদের নাম বহির্ষদ। এঁরা বিভিন্ন কর্মে নিযুক্ত থেকে দেহসম্ভব না হওয়া পর্যন্ত তৃপ্তিলাভ করে থাকেন। এই লৌকিক পিতৃগণের মধ্যে কিছু আছেন যাঁরা হোম ও যাগাদি শ্রৌতকর্মের অনুষ্ঠান করে থাকেন। এছাড়া তারা আশ্রম ধর্মাচরণবশে প্রস্থান অর্থাৎ সংসার যাত্রায় ব্যবস্থিত থাকেন। এঁদের অগ্নিম্বাও বলে অভিহিত করা হয়, অন্যান্য যেসব পিতৃগণ শ্রদ্ধাবণত চিত্তে ব্রহ্মচর্য্য, তপস্যা, যজ্ঞ, প্রজাবৃদ্ধি, শ্রদ্ধা, বিদ্যা ও দান–এই সাতটি কাজে নিযুক্ত থাকেন, তারা কখনও অবসাদগ্রস্ত হন না, এঁরা একেবারে দেহপাত না হওয়া পর্যন্ত এইকাজে ব্যাপৃত থাকেন। জীবনান্তে এঁরা সোমপায়ী দেবগণ ও দেবতুল্য পিতৃগণের সাথে স্বর্গে গিয়ে সেখানে প্রীতিলাভ করেন এবং পিতৃগণের উপাসনা করেন। যাগাদি ক্রিয়াশীলদের মধ্যে যাঁদের সন্তান আছে তারা প্রশংমার্থ রূপে চিহ্নিত হয়েছেন। তাদের বংশধর ও বান্ধবরা তাদের উদ্দেশে নিরাপদান করলে তা গ্রহণ করে মাংসশ্রাদ্ধভোক্তা পিতৃগণ বিশেষ তৃপ্তি লাভ করেন। এই মনুষ্যপিতৃগণ মাসে মাসে শ্রাদ্ধভোজন করেন। কর্মনিযুক্তদের মধ্যে আরও এক শ্রেণীর পিতৃগণ আছেন। তারা সংকীর্ণ বলে খ্যাত। এঁরা সকল প্রকার আশ্রম ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট, স্বাহা ও স্বধাবর্জিত হয়ে থাকেন, এঁদের মধ্যে আরও অনেক নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয়। এঁরা অদ্ভুত দেহধারী, দুরাত্মা, যমালয়ে প্রেতস্বরূপ, বিবস্ত্র, বিবর্ণ, কিন্তু দীর্ঘকায় ও অতিশয় শুষ্ক প্রকৃতির এঁরা ক্ষুধাতৃষ্ণায় পীড়িত অবস্থায় ইতস্তত বিচরণ করেন। এবং যাতনাময় স্থানে অবস্থানপূর্বক নিজ নিজ কর্মফল অনুসারে ফল ভোগ করে থাকেন। এঁরা এতটাই পিপাসার্ত থাকেন যে সবসময় নদী, সরোবর, তরাগ ও দীঘির খোঁজে ঘুরে বেড়ান। ক্ষুধাবশে তারা পরান্নে লিপ্সু হন। বিভিন্ন যাতায়াত স্থানে তারা স্থান পেয়ে থাকেন। পরে শাল্মলী, বৈতরণী, করম্ভবালুকা, অসিপত্রবন এবং শিলাসম্পেষণ–এইসব নরকস্থানে নিজের নিজের কর্মফল ভোগের জন্য পতিত হন। এই সমস্ত সহস্র দুঃখময় স্থানের দক্ষিণদিকে ভূমির ওপরে বিস্তৃত দুর্ভে তিনটি পিণ্ড দান করা হয়। পিতৃগণের বান্ধবেরা লোকান্তর প্রাপ্ত ওইসব পিতৃগণের নাম ও গোত্র উল্লেখ করে ওই তিনটি পিণ্ড তাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। এর মাধ্যমে বান্ধবেরা প্রেতস্থানে অধিষ্ঠিত পতিতদের তৃপ্তিবিধান করে। পিতৃগণের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাঁরা যাতনাস্থানে উপস্থিত না হয়ে কর্মানুসারে এই পৃথিবীতেই পশু থেকে শুরু করে স্থাবর পর্যন্ত নানা জাতীয় তির্যগযোনিতে জন্মলাভ করেন। জীবিতাবস্থায় সেই সেই জাতির লোকেরা যেসব দ্রব্য আহার করেন, শ্রাদ্ধে নিবেদিত অন্নাদিত্ত সেইসব দ্রব্যরূপে পরিণত হয়ে তাদের কাছে এসে পৌঁছায়। যদি যথাকালে যথা নিয়মে উপস্থিত সৎপাত্রকে বিধিমত অন্নদান করা হয়, তাহলে লোকান্তরপ্রাপ্ত বান্ধবেলা সেখানেই থাক না কেন, সেই অন্ন ভাগ পেয়ে থাকেন। সহস্র সহস্ৰ সংখ্যক গাভীদের মধ্যে থেকে যেমন কোন একটি গোবৎস বিশেষভাবে তার মা-কে খুঁজে নেয়, ঠিক তেমনিভাবে শ্রাদ্ধবাসরে পিতৃগণের উদ্দেশ্যে মন্ত্রপূর্বক নিবেদিত অভীষ্ট ভোজ্য সেই সেই পিতৃগণের কাছে গিয়ে পৌঁছে যায়।
দেবকুমার সনৎ ছিলেন প্রেতকুলের গতাগতি বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞ। তিনি নিজে দিব্য চক্ষুতে সবকিছু দর্শন করে তবেই প্রেতজনের শ্রাদ্ধসম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। বহ্বীক, উত্মপ ও দিব্যকীর্ত্য নামে প্রেতদের কথাই তিনি আলোচনা করেছেন। কৃষ্ণপক্ষ এঁদের কাছে দিন, আর শুক্লপক্ষ রাত্রি। তাই শুক্লপক্ষে এঁরা নিদ্রা যান। মনুষ্য ও দেবের মধ্যে দেবপিতৃগণের প্রীতিতেই মনুষ্য পিতৃগণ প্রীতিসুধা লাভ করেন।
পিতৃগণবিষয়ক কীর্তন এখানেই সমাপ্ত হল। পুরাণে সোমপায়ী পিতৃগণ সমন্ধে এইসকল তত্ত্বই বিবৃত হয়েছে। পুরাণনুসারে সূর্য, সোম, পিতৃগণ, ইলাপুত্র পুরূরবার সমাগম, সুধামৃত লাভ, পিতৃগণের তৃপ্তি, পূর্ণিমাকাল ও অমাবস্যাকাল এবং পিতৃগণের স্থান বিষয়ে সবকিছুই সংক্ষেপে বর্ণনা করেছি। এই সৃষ্টি আমরা চর্মচক্ষে প্রত্যক্ষ করছি, এ হল অনাদি অনন্ত, এতক্ষণ এর বিশ্বরূপ অর্থাৎ সমগ্র রূপের একাংশ মাত্রের কথা বলা হল। মনে রাখবেন, এই একাংশে পরিমাণ নির্ণয় করাও কিন্তু সহজ কথা নয়। তাই মঙ্গলকামী ব্যক্তি এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে এই সৃষ্টির কথা আনুপূর্বিক বললাম। এর অধিক আর কিছুই আমার বলা নেই।