প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

৪১. সাংখ্য-দর্শনের উৎস

সাংখ্য-দর্শনের উৎস

অধ্যাপক জর্জ টমসনের উপরোদ্ধৃত বর্ণনা অত্যন্ত সহজেই আমাদের সাংখ্যদর্শনের কথা মনে করিয়ে দেয় না কি? সাংখ্য-কারিকার ভাষ্যে গৌড়পাদ(৬৯৪) বলছেন,

যথা স্বা-পুরুষসংযোগাং স্থতোংপত্তিস্তথা প্রধান-পুরুষসংযোগাৎসর্গস্তোংপত্তি।
—অর্থাৎ, যথা স্ত্রী ও পুরুষের সংযোগে সন্তানোৎপত্তি হয় সেইরূপ প্রধান-পুরুষের সংযোগে সৃষ্টির উৎপত্তি হয়।

অতএব, এইভাবে তন্ত্রের সৃষ্টিতত্ত্ব-প্রসঙ্গে অগ্রসর হয়ে আমরা স্বভাবতই সাংখ্য-দর্শনের সমস্যার সম্মুখীন হই। সাংখ্য-দর্শন এলো কোথা থেকে? সাংখ্য-দর্শনের উৎপত্তি কী?

 

সাংখ্যের উৎপত্তি-প্রসঙ্গে আধুনিক বিদ্বানেরা অনেক গবেষণা করেছেন এবং আমরা এ-বিষয়ে তাদের কাছ থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য পেয়েছি। তাদের সিদ্ধান্তাদির আলোচনায় আমরা একটু পরেই প্রত্যাবর্তন করবে এবং আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, তাদের এই গবেষণা সত্ত্বেও সাংখ্যের উৎপত্তি-সংক্রান্ত সমস্যা আজো অনেকাংশেই অমীমাংসিত হয়ে রয়েছে। তার প্রধান কারণ, সাংখ্যের আলোচনায় আধুনিক গবেষকেরা তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের সম্পর্কের ইংগিতগুলিকে—এবং মৌলিক তত্ত্বের দিক থেকে তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের গভীর সাদৃশ্যকেও—প্রায় সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষা করে থাকেন। অথচ, এই উপেক্ষা বস্তুনিষ্ঠার পরিচায়ক নয়। আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, আধুনিক গবেষকেরা যদি সাংখ্যের সঙ্গে তন্ত্রের এই সম্পর্ক ও মৌলিক সাদৃশ্যের দিককে উপেক্ষা না করতেন, তাহলে সাংখ্যের উৎস-সংক্রান্ত সমস্যা আজ আর এ-ভাবে অমীমাংসিত থাকতো না—যে-মাতৃপ্রধান চেতনার মধ্যে তন্ত্রের উৎস খুঁজে পাওয়া যায় তার মধ্যেই সাংখ্যের উৎপত্তিও আবিষ্কার করা অসম্ভব নয়।

প্রথমত, আমরা এ-বিষয়ে কয়েকটি ঐতিহাসিক ইংগিতের উল্লেখ করবে। তারপর, তন্ত্র এবং সাংখ্যের মধ্যে মৌলিক তত্ত্বগত সাদৃশ্যের আলোচনা তোলা যাবে। এবং তারপর আমরা সাংখ্যের উৎস-প্রসঙ্গে আধুনিক গবেষকদের বিভিন্ন মতামতের পর্যালোচনার চেষ্টা করবো।

তন্ত্র-সাহিত্যের বর্ণনায় আধুনিক বিদ্বান লিখছেন :

বারাহতন্ত্রে লিখিত আছে—এতদ্ভিন্ন বৌদ্ধ ও কপিলোক্ত অনেক উপতন্ত্র আছে। জৈমিনি, বশিষ্ঠ, কপিল, নারদ, গর্গ, পুলস্ত, ভার্গব, সিদ্ধ যাজ্ঞবল্ক্য, ভৃগু, শুক্র, বৃহস্পতি প্রভৃতি মুনিগণ অনেক উপতন্ত্র রচনা করিয়াছেন। তাহাদের আর সংখ্যা করা যায় না(৬৯৫)।

উপতন্ত্র-রচক এই কপিল ঠিক কে—সে-প্রশ্নের উত্তর আমরা নিশ্চয়ই জানি না। বারাহতন্ত্রে লিখিত ওই কপিলোক্ত উপতন্ত্রই যে সাংখ্য-দর্শন,—এমনতরো কথা অনুমান করবার পক্ষে নিশ্চয়ই কোনো জোরালে যুক্তি নেই। কিন্তু এখানে কয়েকটি চিত্তাকর্ষক ইংগিতকে অগ্রাহ্য করাও যুক্তিযুক্ত হবে না। যেমন, আমরা ইতিপূর্বে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করে দেখেছি যে, তান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রধানতম ক্ষেত্র বলতে বিশেষ করে বাংলা দেশই; এবং মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী(৬৯৬) সিদ্ধান্ত করছেন,

সাংখ্যমত কপিলের মত, চিরকাল প্রবাদ। কপিলের বাড়ি পুর্বাঞ্চলে, অর্থাৎ বঙ্গবগধচেরদিগের দেশে। গঙ্গাসাগর যাইতে কপিলাশ্রম আছে, কবতক্ষের ধারে কপিল মুনির গ্রাম। কপিলবাস্তুও কপিল মুনির বাস্তু। কারণ অশ্বঘোষ বলিতেছেন, গোতমঃ কপিলো নাম মুনিধর্মভূতাং বরং। তাহারই বাস্তুতে কপিলবাস্তু নগর। বাস্তবিকও কপিলকে কেহ ঋষি বলে না। তাঁহার নাম করিতে গেলেই বলে আদিবিদ্বান। বাল্মীকী যেমন আদিকবি, তিনিও তেমনি আদিবিদ্বান। শ্বেতাশ্বতরে তাহাকে “পরমর্ষি” বলা হইয়াছে, কিন্তু ভাব, ভাষা ও মত দেখিলে এখানিকে নিতান্ত অল্পদিনের পুস্তক বলিয়া বোধ হয়। …সাংখ্য ও যোগের যে সকল পুস্তক আছে সবগুলিই নূতন। …কিন্তু অশ্বঘোষের লেখা ও কৌটিল্যের উক্তি দেখিয়া সাংখ্য যে খুব প্রাচীন তাহা বেশ অনুভব হয়। সংহিতায় ও ব্রাহ্মণে আদিবিদ্বান কপিলের নামও নাই, গন্ধও নাই।…উপরের লেখা হইতে তিনটি কথা বুঝা যায় যে, সাংখ্যমত সকলের চেয়ে পুরাণ, উহা মানুষের করা এবং পুর্বদেশের মানুষের করা। উহা বৈদিক আৰ্য্যদের মত নহে, বঙ্গবগধ ও চেরজাতির কোন আদিবিদ্বানের মত।

তাহলে, শুধুই যে তন্ত্রসাহিত্যে তন্ত্র-রচক হিসেবে কপিলের নাম পাওয়া যাচ্ছে তাই নয়, প্রাচীন ভারতের ভৌগোলিক পরিবেশের দিক থেকেও তন্ত্রের এলাকা এবং সাংখ্যের এলাকা যে একই, এ-কথা অনুমান করবার অবকাশও রয়েছে।

এই প্রসঙ্গেই আরো একটি ইংগিতের কথা তোলা যায়। আধুনিক বিদ্বানের যদিও সকলেই স্বীকার করছেন যে, সাংখ্যমত খুবই প্রাচীন, তবুও এবিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, সাংখ্য-দর্শনের খুব বেশি প্রাচীন পুঁথিপত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রাচীনতম পুঁথি বলতে ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্য-কারিকা, আধুনিক বিদ্বানদের(৬৯৭) অনুমান অনুসারে তার তারিখ আনুমানিক ২০০ খৃস্টাব্দ। এই সাধু-কারিকার লেখক বলছেন, ‘কপিলমুনি এই শাস্ত্র আসুরিকে দেন, আসুরি তা পঞ্চশিখকে দেন এবং পঞ্চশিখ দ্বারা উহ। পরে বহুধা বিস্তারিত হন’(৬৯৮)। এবং এইভাবে শিষ্যপরম্পরায় প্রাপ্ত সাংখ্যমতকেই ঈশ্বরকৃষ্ণ আখ্যায়িকা ও বিচারভাগ বাদ দিয়ে সংক্ষিপ্তরূপে বিচার করলেন। কিন্তু যে-কথা বিশেষ চিত্তাকর্ষক বলে মনে হয় তা হলো, ঈশ্বরকৃষ্ণ এখানে ওই সাংখ্যমত বা সাংখ্যশাস্ত্রকে সাংখ্য না বলে ‘যষ্টিতত্ত্ব’ নামে অভিহিত করছেন(৬৯৯)। যষ্টিতত্ত্ব বলে এই চিত্তাকর্ষক শব্দটি আধুনিক বিদ্বানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং তারা অনুমান করতে চাইছেন, এ হলো সাংখ্যের কোনো এক বিলুপ্ত আদিগ্রন্থের নাম। কিন্তু সে-অনুমানে বাধা আছে। প্রথমত, ঈশ্বরকৃষ্ণের রচনায় এমন কোনো ইংগিতই নেই যার উপর নির্ভর করে আমরা এ-কথা অনুমান করতে পারি; বরং তার রচনা থেকে অনুমান করা সঙ্গত যে, ষষ্টিতন্ত্র কোনো গ্রন্থবিশেষের নাম না হয়ে সম্প্রদায়বিশেষের ধ্যানধারণার নাম। যদি তাই হয় তাহলে সে-সম্প্রদায়ের পক্ষে ওই তন্ত্র শব্দটি তান্ত্রিক অর্থেই গৃহীত হয়েছিলো কিনা তা ভেবে দেখবার অবকাশ নিশ্চয়ই আছে। এই প্রসঙ্গেই মনে রাখা যায় যে, ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে(৭০০) সাংখ্য-বাদীরা তন্ত্রান্তরীয়াঃ বলে উল্লিখিত হয়েছেন। এবং গুণরত্ব(৭০১) যে-দুটি সুপ্রাচীন সাংখ্যগ্রন্থের উল্লেখ করছেন তার মধ্যে একটির নাম হলো আত্ৰেয়তন্ত্র। এ-গ্রন্থ অবশ্যই বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু তার নামের সঙ্গে তন্ত্রশব্দের যোগাযোগ উপেক্ষণীয় নয়।

কিন্তু ষষ্টিতন্ত্র বলে ওই নামটি নিয়ে আরো প্রশ্ন ওঠে। সাংখ্যের নাম ষষ্ট তন্ত্র কেন? আধুনিক বিদ্বানেরা ২ অনুমান করছেন, সাংখ্যতে ষাটটি তত্ত্বের। পরিচয় পাওয়া যায়, তাই জন্যে। কিন্তু এ-অনুমান সম্পূর্ণ কৃত্রিম। প্রথমত মনে রাখতে হবে, এ-অনুমানের পিছনে যে ভ্রান্ত ধারণা থেকে গিয়েছে, তা হলো সংখ্যা শব্দ থেকেই সাংখ্য নামের উৎপত্তি। এই ভ্রান্ত ধারণার বশেই এককালে পণ্ডিতেরা মনে করেছিলেন যে, সাংখ্য-দর্শন পিথাগোরীয়-দর্শনেরই সমগোত্রীয়। কিন্তু পিথাগোরীয়-দর্শনের সঙ্গে সাংখ্যের কোনো তত্ত্বগত সম্পর্কই নেই; এবং সংখ্যা-নির্ণয় প্রচেষ্টা থেকেই যদি সাংখ্য নাম হয় তাহলে বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনের পক্ষেই সাংখ্য নাম অনেক বেশি প্রযোজ্য হওয়া উচিত ছিলো—কেননা, ওই সংখ্যা-নির্ণয় প্রচেষ্টা উক্ত দুটি দর্শনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রকট। মুখের বিষয় এইজাতীয় যুক্তির উপর নির্ভর করে আধুনিক বিদ্বানেরা ও আর সংখ্যা শব্দ থেকে সাংখ্যের উৎপত্তি অনুমান করতে চান না। কিন্তু দুঃখের বিষয় ‘ষষ্টিতন্ত্র’ বলে নামটির ব্যাখ্যায় তারা ওই ভ্রান্তির উপর নির্ভর করেই অগ্রসর হতে চান,—সাংখ্যে ষাটটি তত্ত্বের উল্লেখ আছে বলেই তার নাম ষষ্টিতন্ত্র। কিন্তু, সাংখ্যে ৬০টি তত্ত্বের উপদেশ সত্যিই নেই : প্রকৃতি, মহৎ, অহঙ্কার, ১১টি ইন্দ্রিয়, ৫টি তন্মাত্র, ৫টি মহাভূত এই ২৪ এবং পুরুষ, মোট পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব নিয়েই সাংখ্য দর্শন। ফলে, ৬০টি তত্ত্বের তালিকা দিয়ে ষষ্টিতন্ত্র নামটির ব্যাখ্যা খোঁজ করবার যে-সব প্রচেষ্টা করা হয়েছে সেগুলির। বেলায় প্রতিটি তালিকার কথা অবধারিতভাবেই কৃত্রিম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো একটি তালিকার সঙ্গেই অপর কোনো তালিকার মিল নেই এবং প্রতিটি তালিকাকে পরীক্ষা করলেই দেখা যায় যে, সেগুলির মূল উপাদান হলো তালিকাকারদের উদ্ভাবনী-শক্তি(৭০৪)। অতএব, আমরা সিদ্ধান্ত করতে চাই যে, তত্ত্বসংখ্যা নির্ণয়ের দিক থেকে যে-রকম সাংখ্য নামের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করা যায় না, সেই রকমই ষষ্টিযন্ত্র নামটিও নয়। অপরপক্ষে ষষ্টিতন্ত্র নামের পিছনে আর একরকম তাৎপর্যের আভাস পাওয়া অসম্ভব নয়। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি (পৃ. ৩৫০) আমাদের দেশে সন্তান-দায়িনী দেবীর নাম ষষ্ঠী এবং ষষ্টিক বা ষষ্টিকা বলতে আবার বৃহীধান্যও বোঝায়—সেদিক থেকে ষষ্টিতন্ত্র নামটির পিছনে কৃষিভিত্তিক ধ্যানধারণার—তন্ত্রের—আভাস খুঁজে পাওয়া অসম্ভব না হতেও পারে। এই প্রসঙ্গেই মনে রাখা দরকার যে, ক্ষেত্র এবং ক্ষেত্ৰজ্ঞ(৭০৫) বলে সাংখ্যের পরিভাষাগুলি অবধারিতভাবেই কৃষিজীবন থেকেই সংগৃহীত। অতএব, এ-জাতীয় ইংগিত থেকে অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে, যে-কৃষিভিত্তিক মাতৃপ্রধান সমাজজীবনকে তান্ত্রিক ধ্যানধারণার মধ্যে আমরা প্রতিফলিত হতে দেখেছি সাংখ্য-দর্শনের পিছনেও তারই স্মৃতির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, কিংবা, যা প্রায় একই কথা, আদিতে হয়তো তন্ত্র আর সাংখ্য সমগোত্রীয় ছিলো।

 

সুখের বিষয়, তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের সম্পর্ক প্রসঙ্গে এ-জাতীয় ক্ষীণ ও ভঙ্গুর ইংগিতই আমাদের একমাত্র সম্বল নয়। কেননা, উভয় ধ্যানধারণার মধ্যে তত্ত্বগত মৌলিক সাদৃশ্যও দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্যই, সে-কথা ভারতীয় দর্শনের সাধারণ পাঠ্য-পুস্তকে স্বীকৃত হয় না। অথচ, ওই সাদৃশ্যের দিকটা একটুও অস্পষ্ট নয়। মুখের বিষয়, যে-কথা পাঠ্যপুস্তকের লেখকদের চোখে পড়তে চায়নি, তা অত্যন্ত সহজেই শ্ৰীযুক্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের(৭০৬) দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে :

আবার সাংখ্যের প্রকৃতি-পুরুষ লইয়া তন্ত্রের সৃষ্টি। সেই তান্ত্রিক কাণ্ডে দেশ ব্যাপ্ত হইয়াছে। এই তন্ত্রের কৃপায় বিক্রমপুরে বসিয়া নিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ঠাকুর অবিরাম মদিরা উদরস্থ করিয়া, ধর্মাচরণ করিলাম বলিয়া পরম পরিতোষ লাভ করিতেছেন। সেই তন্ত্রের প্রভাবে প্রায় শতযোজন দূরে, ভারতের পশ্চিমাংশে কাণফোঁড়া যোগী উলঙ্গ হইয়া কদৰ্য উৎসব করিতেছে। সেই তন্ত্রের প্রসাদে আমরা দুর্গোৎসব করিয়া এই বাঙালা দেশের ছয় কোটি লোক জীবন সার্থক করিতেছি। যখন গ্রামে গ্রামে, নগরে মাঠে জঙ্গলে শিবালয়, কালীর মন্দির দেখি, আমাদের সাংখ্য মনে পড়ে; যখন দুর্গ কালী জগদ্ধাত্রী পুজার বাদ্য শুনি, আমাদের সাংখ্যদর্শন মনে পড়ে।

আমাদের দেশে তন্ত্রের প্রভাব যে কতো ব্যাপক, কিংবা, আমাদের দেশের আধুনিক পরিবেশে এই তন্ত্র যে কী বিকট বীভৎসতায় পরিণত হয়েছে তা দেখাবার জন্য আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের ওই মন্তব্য উদ্ধৃত করিনি। কেননা, এ-সব কথা আমরা ইতিপূর্বেই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। বর্তমানে, বঙ্কিমচন্দ্রের যে-মন্তব্যের প্রতি আমরা বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে চাইছি তা হলো, এই তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের সম্পর্কের কথা। তান্ত্রিক ধ্যানধারণা বা আচারঅনুষ্ঠানের পরিচয় দেখলে বঙ্কিমচন্দ্রের সাংখ্য-দর্শন মনে পড়ে; যদিও, সাংখ্যের প্রকৃতি-পুরুষ লইয়া তন্ত্রের সৃষ্টি কিনা এই প্রশ্ন আমাদের পক্ষে পরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে হবে।

মৌলিক তত্ত্বের দিক থেকে তন্ত্র আর সাংখ্যের সাদৃশ্য সত্যিই বিস্ময়কর। সাংখ্যের মতোই, প্রকৃতি আর পুরুষ নিয়েই তন্ত্রের তত্ত্ব, যদিও সম্প্রদায়ভেদে ওই প্রকৃতি আর পুরুষ তন্ত্রে নানান আখ্যা পেয়েছে—শিব ও শক্তি, রতি ও রস, প্রজ্ঞা ও উপায় ইত্যাদি। আবার, এই দু’য়ের মধ্যে তন্ত্র অনুসারে প্রকৃতিই প্রধান—তাই হিন্দু তান্ত্রিকেরা শাক্ত; তাই চর্যা-সঙ্গীতে চণ্ডালী, ডোম্বী, শবরী, যোগিনী, নৈরামণি, সহজসুন্দরী ইত্যাদির প্রাধান্য; তাই বৈষ্ণব-সহজিয়াদের বক্তব্য,

পুরুষের দেহ     ত্যাগ করিয়া
প্রকৃতি স্বরূপ হবে।
তবে হে জানিহ     রাধার স্বরূপ
হৃদয়ে দেখিতে পাবে॥
প্রকৃতি হইলে       প্রকৃতি মিলয়ে
পুরুষ দেহতে নাই।
আছয়ে পরেশ     শোধন করিলে
তুরিতে পারিবে ভাই॥(৭০৭)

তন্ত্রের মতোই, সাংখ্য-দর্শনেও প্রকৃতিই প্রধান। পুরুষ নেহাতই অপ্রধান এবং উদাসীন। এই কারণেই, প্রাচীনদের পরিভাষায় সাংখ্য হলো প্রধানকারণ-বাদ। প্রধান-কারণবাদ বলতে প্রাচীনেরা আবার জড়বাদ বা বস্তুবাদ বুঝতেন—আধুনিক পরিভাষায় materialism। স্বভাবতই, আধুনিক বিদ্বানেরা প্রকৃতি বলতে primordial matter বোঝেন। সেটা নিশ্চয়ই ভুল নয়; কিন্তু শুধু ওইটুকু বললে এই প্রকৃতিরই আর একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কথা অস্পষ্ট থেকে যাবে। কেননা, প্রকৃতি বলতে সাংখ্যে শুধুমাত্র primordial matter-ই বোঝায়, female principle-ও বোধায়। এদিক থেকে সাংখ্য-দর্শন শুধুমাত্র জড়বাদ বা বস্তুবাদ নয়, নারীপ্রাধান্যমূলক চিন্তার পরিচায়কও।

প্রকৃতি শব্দটি সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে স্ত্রীলিঙ্গ। ইহার নামান্তর প্রধান বা ‘অব্যক্ত’ স্ত্রীলিঙ্গ নয়। শব্দের লিঙ্গ দ্বারা তাহার বাচ্যবস্তুর লিঙ্গ সংস্কৃত ব্যাকরণে বুঝানো হয় না। এখানেও বাচক শব্দের লিঙ্গ খুব বড় জিনিস নয়; কিন্তু বাচ্যবস্তুটিকে স্ত্রীরূপেই সাংখ্য কল্পনা করিয়াছে। প্রকৃতি পুরুষকে মোহিত করে— যেমন নারী পুরুষকে বশ করে; প্রকৃতির ক্রিয়াও নারীর লাস্য ও হাস্য এবং হাব ও ভাবের অনুরূপ কল্পিত হইয়াছে। প্রকৃতিকে কোথাও লজ্জাশীলা বধু (কারিকা ৬/১), কোথাও নর্তকী (সূত্র ৩।৬৯) রূপে কল্পনা করা হইয়াছে। ইহার ফলে পুরুষ ও প্রকৃতির সম্বন্ধ ও সম্বন্ধ-বিচ্ছেদ উভয়ই নরনারীর সম্বন্ধ ও সম্বন্ধচ্ছেদের মতো ভাবা হইয়াছে। অনাদিকাল হইতে নর ও নারীর যে লীলা জগতে চলিয়া আসিয়াছে—কবি ও দার্শনিক যাহাকে অনেক সময় সনাতন— চিরসত্য—মনে করিয়াছেন, সাংখ্যের পুরুষ-প্রকৃতির লীলার বর্ণনায়ও যেন তাহাই মূর্তি পরিগ্রহ করিয়াছে। সাংখ্য কাব্য নয়, দর্শন। কিন্তু দার্শনিকের ভিতর কি কবিমন থাকিতে পারে না? গ্ৰীক দার্শনিক প্ল্যাতোর কি ছিল না? সাংখ্যের মনে উহা স্পষ্টত উপস্থিত থাকুক বা না-থাকুক, তাহার পরবর্তী চিন্তায় অনেকক্ষেত্রে পুরুষ-প্রকৃতির সম্বন্ধটাকে নরনারীর সনাতন সম্বন্ধের রূপক রূপেই দেখা হইয়াছে। ঐতিহাসিক প্রমাণের সাহায্যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মত এখানে কিছু উপস্থিত করিতে না পারিলেও ইহা বোধহয় বলা যায় যে, অর্ধনারীশ্বর বা হরগৌরীর যে কল্পনা পরবর্তী সাহিত্যে পাওয়া যায়, তাহাতে সাংখ্য দর্শনের ছায়া পড়িয়াছে। আর, বৈষ্ণব ধর্মের একটা দিকে রাধা-কৃষ্ণের যে কল্পনা পাওয়া যায়, তাহাও কি সাংখ্যের নিকট ঋণী হইতে পারে না? ভাবিবার মতো প্রশ্ন বলিয়া মনে হয়, তাই ইহাদের উল্লেখ এখানে করিলাম। ইতিহাস যদি কোনটি আগে কোনটি পরে নিশ্চিতভাবে বলিয়া দিতে পারিত, তাহা হইলে কে ঋণী এবং কে ঋণদাতা, এই প্রশ্নের মীমাংসা সহজেই হইয়া যাইত। কল্পনাগুলির সাদৃশ্য এত বেশি যে, কোনো একটা সাধারণ উৎস হইতে ইহার বিভিন্ন ধারারূপে বহির্গত হইয়াছে, ইহাও অচিন্তনীয় নয়।(৭০৮)

অধ্যাপক উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের এই মন্তব্যের জন্য আমরা তার কাছে বিশেষ ঋণী, কেননা সাংখ্যের উৎস ও বিকাশ নিয়ে বহু গবেষণা হলেও উল্লিখিত দিকটির প্রতি সাধারণত আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় না। কিন্তু দুঃখের বিষয় অর্ধ-নারীশ্বর ও রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেও অধ্যাপক ভট্টাচার্য এখানে তন্ত্রের কথা তুলছেন না, অথচ তন্ত্রের সঙ্গেই পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্বের দিক থেকে সাংখ্যের সাদৃশ্য সবচেয়ে প্রকট এবং আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠান এবং জাদুবিশ্বাস থেকেই তন্ত্রের উৎস। অতএব, অধ্যাপক ভট্টাচার্য এখানে যে ‘সাধারণ উৎসর’ ইংগিত করছেন, আমাদের যুক্তি অনুসারে তা হলো অনুন্নত পর্যায়ের বাস্তব জীবনসংগ্রামই। আমাদের এই যুক্তিটি ব্যাখ্যা করবার জন্য ধীরে ধীরে অগ্রসর হবো।

প্রথমত মনে রাখা দরকার, সাংখ্য যদিও পুরুষ-প্রকৃতির তত্ত্বের উপদেশ দিয়েছে তবুও এই দুয়ের মধ্যে প্রকৃতিই প্রধান—পুরুষ শুধু অপ্রধান নয়, উদাসীনও। এবং আমরা দেখলাম, এই প্রকৃতি বলতে শুধুই primordial matter বোঝায় না, female principle-ও বোঝায়। কথাটি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা আমাদের যুক্তি অনুসারে এই নারীপ্রধান ধ্যানধারণায় অনিবাৰ্যভাবেই নারীপ্রধান সমাজ-বাস্তবের প্রতিবিম্ব অনুমান করা যায়।

তাহলে, প্রশ্ন ওঠে, সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের স্থান ঠিক কী রকম? প্রথমত মনে রাখতে হবে, সাংখ্যের আদিরূপটি ঠিক কোথা থেকে সংগ্রহ করা যাবে, এ-বিষয়ে বিশেষজ্ঞ-মহলে বাদানুবাদ আছে। আমরা পরে সাংখ্যের উৎস সংক্রান্ত বিভিন্ন মতের আলোচনা-প্রসঙ্গে সে-প্রশ্নে প্রত্যাবর্তন করবো। আপাতত এইটুকু বলা দরকার যে, সাংখ্যের আদিরূপের পরিচয় শুধুমাত্র সাংখ্যপ্রবচন-সূত্র বা এমনকি, সাংখ্য-কারিকা থেকেও সংগ্রহ করবার চেষ্টা করলে ভুল হবে। তাই, পুরুষ সম্বন্ধে সাংখ্যের তত্ত্ব এই দুটি গ্রন্থের মধ্যে যেভাবে পাওয়া যায় তার উপর নির্ভর করে সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের স্থান বোঝা যাবে না। উত্তরকালে, প্রধানত সাংখ্য-প্রবচন-সূত্রের প্রভাবেই, আমাদের ধারণা হয়েছে যে, সাংখ্যে পুরুষ বলতে আত্মাই বোঝায়। তাই আধুনিক লেখকেরা প্রকৃতি ও পুরুষের ইংরেজী প্রতিশব্দ হিসেবে matter এবং soul এই ছটি কথা ব্যবহার করে থাকেন এবং অতি সহজেই ধরে নেওয়া হয় যে, সাংখ্য-মতে পরম-পুরুষাৰ্থ বা মুক্তি বলতে, বুঝি এই আত্মার ত্রিতাপনাশেরই ইংগিত করা হয়েছে; এ-ধারণাও সাধারণত স্বীকৃত হয়েছে যে, মুক্তি বা ত্রিতাপনাশের পদ্ধতি হিসেবে সাংখ্য ওই ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতি থেকে পুরুষ বা আত্মার স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি করবার উপদেশ দিয়েছে। আমরা একটু পরে দেখবো, এ-জাতীয় তত্ত্ব সাংখ্য-দর্শনের উপর বেদান্তর প্রভাবেরই পরিণাম।

আপাতত কথা হলো, সাংখ্য-দর্শনের আদি-রূপ অনুসারে পুরুষ বলতে আত্মা বা soul বোঝায়নি। কালক্রমে অবশ্যই সাংখ্যের পুরুষ আত্মাবাচক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো; কিন্তু এখানে আমাদের আলোচনাটা সাংখ্যের আদি-রূপ নিয়ে, এবং আদি-পর্বে সাংখ্যের ওই পুরুষ বলতে আত্মা বোঝাতো না—তার বদলে পুরুষমানুষই বোঝাতো। এ-বিষয়ে অধ্যাপক বেলভেলকার ও রানাডে(৭০৯) ইতিপূর্বেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ব্রাহ্মণগ্রন্থের ক্রিয়াকাণ্ড প্রসঙ্গে পুরুষ শব্দটির প্রয়োগ বিশ্লেষণ করে তাঁরা সিদ্ধান্ত করছেন :

This clearly shows that Purusa originally denoted the human being with its peculiar bodily structure and not any inner or spiritual entity in dwelling therein. (In the first and second group of our Upanisadic texts, this is almost the exclusive sense in which the term is used.)
অর্থাৎ, এ-থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, আদিতে পুরুষ বলতে দেহবিশিষ্ট মানবই বুঝিয়েছে—এই দেহাভ্যন্তরের কোনো আধ্যাত্মিক সত্তা নয়। (আমাদের পর্যায়বিভাগ অনুসারে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের উপনিষদগুলিতে পুরুষ শব্দ প্রায় সর্বত্রই একমাত্র এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।)

অবশ্যই, ব্রাহ্মণ-উপনিষদাদির মতো বৈদিক সাহিত্যের মধ্যেই সাংখ্যের আদিরূপটির সন্ধান পাওয়া যায় কিনা—এ-প্রশ্ন স্বতন্ত্র। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, আদিতে সাংখ্য বৈদিক আর্যদের মতো ছিলো না এবং আমরা পরে দেখবো, এ-বিষয়ে অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে এবং হেনরিখ জিমার প্রমুখ পাশ্চাত্যের বিদ্বানেরাও মহামহোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমত হবেন। এবং, আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে যারা বৈদিক সাহিত্যের উপরই নির্ভর করে সাংখ্যের উৎস ও বিকাশ সংক্রান্ত ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছেন তাদের সিদ্ধান্ত অনিবাৰ্যভাবেই অসম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু তা-সত্ত্বেও, আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো যে, সাংখ্যের আদিরূপটিকে পুনর্গঠন করবার উদ্দেশ্যে ওই বৈদিক সাহিত্যের ইংগিতগুলি—এবং বিশেষত বেদান্তসূত্রের উক্তিগুলিই—আমাদের কাছে অমূল্য; তার কারণ, বৈদিক চিন্তাধারার সামনে প্রধানতম প্রতিপক্ষ বলতে ছিলো সাংখ্য ধ্যানধারণা। সাংখ্য-প্রবচন-সূত্রে, এমন কি সাংখ্য-কারিকায়, সাংখ্যের যে পরিচয় পাওয়া যায় তার মধ্যে বৈদান্তিক চিন্তার সঙ্গে সাংখ্যের আপোষের চেষ্টাটাই প্রধান; অপরপক্ষে, উপনিষদাদি গ্রন্থের যেখানে সাংখ্যের উল্লেখ পাওয়া যায় সেখানে প্রধানতম চেষ্টা হলো, সাংখ্যের মূল তত্ত্বকে খণ্ডন করবার বা বৈদান্তিক তত্ত্বের চেয়ে ছোটো করে দেখাবার। তাই আদিতে সাংখ্য ভারতীয় চিন্তাধারায় অবৈদিক ঐতিহ্যের পরিচায়ক হলেও ওই উপনিষদাদি গ্রন্থের মধ্যেই পূর্বপক্ষবর্ণন হিসেবে সাংখ্যের যে-পরিচয় পাওয়া যায় তা থেকে সাংখ্যের আদিরূপটিকে অনুমান করবার অবকাশ আছে। এ-প্রশ্নের আলোচনায় আমরা পরে প্রত্যাবর্তন করবো। আপাতত আমাদের যুক্তি শুধু এইটুকুই যে, আদিতে সাংখ্যে পুরুষ অর্থে যে আত্মা বা soul বোঝায়নি—তার বদলে রক্তমাংসের পুরুষমানুষই বুঝিয়েছে,— অধ্যাপক বেলভেলকার ও রানাডের এই সিদ্ধান্ত ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ সাহিত্যের স্বাক্ষরের উপর নির্ভরশীল হলেও স্বীকারযোগ্য।

অতএব, সংক্ষেপে : প্রকৃতি আর পুরুষ নিয়েই সাংখ্যের মূল তত্ত্ব। কিন্তু প্রকৃতি বলতে শুধুমাত্র primordial matter-ই নয়, female principle-ও।  অপরদিকে, পুরুষ বলতে আদিতে soul বা আত্মা নয়; তার বদলে পুরুয়মানুষই।

এই প্রকৃতি এবং পুরুষের মধ্যে প্রাধান্য কিন্তু প্রকৃতিরই এবং এইদিক থেকেই আমরা দেখাবার চেষ্টা করছি যে, সাংখ্য-দর্শনে মাতৃপ্রাধান্যমূলক চেতনার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। অতএব এইখানে একটি মৌলিক সমস্যা ওঠে : সাংখ্য যদি সত্যিই মাতৃপ্রাধান্যমূলক ধ্যানধারণার পরিচায়ক হয়, তাহলে তার মধ্যে পুরুষের তত্ত্ব একান্তই কী ভাবে স্থান পেতে পারে? কিংবা, পুরুষ যদি একান্তভাবেই অপ্রধান এবং উদাসীন হয় এবং প্রকৃতির তত্ত্বই যদি সাংখ্যের প্রধান তত্ত্ব হয়, তাহলে এই সাংখ্যের মধ্যে পুরুষের কথা ওঠেই বা কেন?

প্রাচীন আচার্যরাও সাংখ্যের বিরুদ্ধে যে-আপত্তি তুলেছেন তার মধ্যেও এই সমস্যাটিরই পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। উদাহরণ-স্বরূপ বলা যায়, শঙ্করাচার্য(৭১০) সাংখ্য-মত খণ্ডনের যুক্তি হিসেবে বলছেন, যদিও সাংখ্যকারের অন্ধ ও পঙ্গুর বা লৌহ ও অয়স্কান্তের দৃষ্টান্ত দিয়ে পুরুষ আর প্রকৃতির সম্বন্ধটা ব্যাখ্যা করতে চান তবুও সে-ব্যাখ্যা স্বীকারযোগ্য হতে পারে না। শঙ্কর বলছেন, সাংখ্যবাদীরা দু’রকম দৃষ্টান্তের সাহায্যে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন। এক অন্ধ ও পঙ্গুর দৃষ্টান্ত : পঙ্গু প্রবৃত্তিশক্তিবিহীন হলেও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন এবং অন্ধ দৃষ্টিশক্তিবিহীন হলেও প্রবৃত্তিশক্তিসম্পন্ন—অতএব পঙ্গু অন্ধের উপর অধিষ্ঠিত হয়ে তাকে প্রবর্তিত করতে পারে। কিংবা, দুই? অয়স্কান্ত যেমন ‘স্বয়ং অপ্রবর্তমান থাকিয়াও লোহকে প্রবর্তিত করে, সেইরূপ পুরুষও প্রধানকে প্রবর্তিত করে।’ কিন্তু, উভয় দৃষ্টান্তই বিফল :

সে পক্ষে দোষ এই যে, প্রধানের স্বতন্ত্রতা বা স্বাধীন প্রবৃত্তি অঙ্গীকার করিতে হয়, অথচ পুরুষের প্রবর্তকত্ব স্বীকার করা যায় না। অবশ্যই তাহা সাংখ্যের পক্ষে দোষ—স্বীকৃতহানি দোষ। বিবেচনা কর, উদাসীন পুরুষ কিরূপে প্রধানকে প্রেরণ করিবে? পঙ্গুর বাকশক্তি প্রভৃতি আছে, তদ্বারা সে অন্ধকে প্রেরণ করিতে পারে; কিন্তু পুরুষের এমন কোন প্রবর্তক ব্যাপার নাই, যদ্বারা পুরুষ প্রধানকে কার্ঘ্যে প্রবর্তিত (কার্যোন্মুখ) করিতে পারেন। পুরুষ নিগুণ ও নিক্রিয়। তিনি চুম্বকের ন্যায় কেবলমাত্র সন্নিধানবলে প্রধানকে প্রবর্তিত করেন, এরূপ বলাও সঙ্গত নহে। তাহার সন্নিধান নিত্য—চিরকালই সমান—তদনুসারে প্রধানের প্রবৃত্তিও নিত্য ও সদা কাল সমান থাকা উচিত। দেখা যায়, চুম্বকের সন্নিধান অনিত্য। অর্থাৎ, কদাচিৎ (কখনো)। বিশেষতঃ তাহা পরিমার্জন ও ঋজুভাবে স্থাপনাদি অপেক্ষা করে। এই সকল কারণে পুরুষ ও চুম্বক উভয়ই অনুপন্যসনীয়, অর্থাৎ অযোগ্য দৃষ্টান্ত। আরও দেখো, প্রধান অচেতন ও পুরুষ উদাসীন। সে কারণে উক্ত উভয়ের সম্বন্ধ হওয়া অসম্ভব। সম্বন্ধ ঘটনা করায়— এমন তৃতীয় পদার্থ সাংখ্যমতে নাই।

শঙ্করাচার্যের এই যুক্তি সাংখ্যমতকে ধুলিসাৎ করে কিনা, সে-আলোচনা স্বতন্ত্র। কিন্তু, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এখানে তিনি সাংখ্য-মতের মূল অন্তঃবিরোধটির প্রতিই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন : “কথঞ্চোদাসীনঃ পুরুষঃ প্রধানং প্রবর্ত্তয়েং”—উদাসীন পুরুষ কীভাবে প্রধানকে প্রবর্তন করতে পারে?

এই অন্তঃবিরোধের কথা শুধুই যে প্রাচীন আচার্যদের চোখে পড়েছে, তাই নয়। আধুনিক বিদ্বানেরাও এ-বিষয়ে সচেতন হয়েছেন যে, সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের স্থান রয়েছে অথচ তা থাকবার যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে(৭১১) লিখছেন,—যদিও, দুঃখের বিষয়, এখানে তিনি সাংখ্যর পুরুষ শব্দ ব্যবহার না করে তারই প্রতিশব্দ হিসেবে soul কথাটি ব্যবহার করে বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে বোঝবার ব্যাপারে কিছুটা অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন,—

What place, however, in a system which holds such views is to be found for the soul (অর্থাৎ, পুরুষ)? Strangely enough, former scholars who made exhaustive investigations into the Samkhya system did not succeed in answering this question. They regard the soul (অর্থাৎ, পুরুষ) in this system as entirely superfluous, and hold that its founder would have shown himself much more logical if he had altogether eliminated it.
যে-দর্শনের এই জাতীয় মতবাদ, সে-দর্শনে পুরুষের স্থান কী হতে পারে? বিস্ময়ের কথা হলো, ইতিপূর্বে যে বিদানেরা সাংখ্য-দর্শন নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা করেছেন তারা এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাননি। তাদের মতে, এ-দর্শনে পুরুষের তত্ত্ব বাহুল্য মাত্র এবং তারা বলেন এ-দর্শনের প্রবর্তক যদি ওই পুরুষের কথা একেবারেই বাদ দিতেন তাহলে তিনি অনেক সুসঙ্গত কাজ করতেন।

অধ্যাপক গার্বে নিজে কীভাবে সাংখ্য-দর্শনে ওই পুরুষের স্থানকে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন, সে-প্রশ্ন অবশ্যই স্বতন্ত্র। কিন্তু তাঁর উক্তি থেকে এটুকু নিশ্চয়ই স্বীকার্য যে, আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে অনেকেই হৃদয়ঙ্গম করেছেন যে, ওই সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের কোনো স্থান থাকা যুক্তিযুক্ত নয়, অথচ তা রয়েছে। আমরা দেখাতে চাইছি যে, এইটিই হলো সাংখ্যের সবচেয়ে মূল আত্মবিরোধ।

এই জাতীয় আত্মবিরোধের ব্যাখ্যা কী? আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, মাতৃপ্রধান সমাজ-বাস্তবের মধ্যেই এমন এক স্ববিরোধ লুকিয়ে রয়েছে যা ওই মাতৃপ্রধান সমাজের প্রতিবিম্ব নারীপ্রধান দর্শনের মধ্যে এইভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। অতএব আমরা, আমাদের পদ্ধতি অনুসারে, সাংখ্য-দর্শনের এই বৈশিষ্ট্যটিকে বোঝবার আশায় মাতৃপ্রধান সমাজ-বাস্তবের আলোচনায় ফিরে যাবো।

আসাম-অঞ্চলে খাসিদের মধ্যে আজো মাতৃপ্রধান সমাজব্যবস্থা অনেকাংশেই অক্ষুন্ন রয়েছে।

Their social organization presents one of the most perfect examples still surviving of matriarchal institutions, carried out with a logic and thoroughness which, to those accustomed to regard the status and authority of the father as the foundation of society, are exceedingly remarkable. Not only is the mother the head and source and only bond of union of the family; in the most primitive parts of the hills, the Synteng country, she is the only owner of real property, and through her alone is inheritance transmitted. The father has no kinship with his children, who belong to their mother’s clan.(৭১২) এবং, অতএব—
The Khasis have a saying, ‘From the Woman sprang the clan.’ This does not leave much scope for the man. As a husband he is a stranger to his wife’s people, who refer to him curtly as a ‘begetter.’(৭১৩)
অর্থাৎ, খাসিদের সমাজসংগঠন হলো, আজো মাতৃপ্রধান ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ থাকবার একটি প্রায় নিখুঁত দৃষ্টান্ত; এ-ব্যবস্থা এতো যুক্তিযুক্তভাবে ও ভালো করে পালন করা হয় যে, যারা পিতার প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তিকেই সমাজের ভিত্তি বলে চিন্তা করতে অভ্যস্ত তাদের কাছে বিস্ময়কর বোধ হবে। শুধুই যে পারিবারিক ক্ষেত্রে মাতাই প্রধান ও একমাত্র বন্ধন তাই নয়, সিণ্টেঙ প্রদেশের মতো সবচেয়ে আদিম পার্বত্য অঞ্চলে সম্পত্তিতে প্রকৃত অধিকার শুধু মায়েরই এবং এই মাতৃত্বসূত্রেই উত্তরাধিকার প্রবর্তিত হয়। পিতার সঙ্গে সন্তানদের জ্ঞাতিসম্বন্ধ নেই; সন্তানেরা মাতৃগোত্রান্তর্গত।
এবং অতএব,
খাসিদের মধ্যে প্রবাদ আছে, ‘নারী থেকেই ক্লানের (গোত্রান্তর্গত সকলের) উদ্ভব’। ফলে, এ-ব্যবস্থায় পুরুষদের ভূমিকা বলতে খুব বেশি কিছু থাকবার কথা নয়। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর আত্মীয়দের কাছে সে আগন্তুক অনাত্মীয় মাত্র। স্ত্রীর আত্মীয়রা তাকে তাচ্ছিল্যভরে ‘জন্মদাতা’ বলে উল্লেখ করে।

অতএব, মাতৃপ্রধান সমাজে পুরুষের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে একটা অন্তর্দ্বন্দ্বের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। এই সমাজে একদিকে পুরুষ জন্মদাতা বলে স্বীকৃত। এটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা—নারীর সঙ্গে পুরুষের মিলন ঘটলে পরই সন্তানজন্ম সম্ভব হয়। আবার অপরদিকে কিন্তু এই পুরুষের সঙ্গে সন্তানদের কোনো আত্মীয়তা নেই; কেননা, সন্তানেরা মাতৃবংশের অন্তর্গত— তাদের জন্মদাতা পিতা তাদের কাছে স্বতন্ত্র গোত্রান্তর্গত আগন্তুক ব্যক্তিমাত্র। মাতৃপ্রধান সমাজে এটাও সমান প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই।

আমাদের যুক্তি হলো, সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের ভূমিকাটিকে কেন্দ্র করে যে-অন্তর্দ্বন্দ্বের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে মাতৃপ্রধান সমাজের পুরুষের ভূমিকাসংক্রান্ত ওই অস্তদ্বন্দ্বের প্রতিবিম্ব অনুমান করা যায়।

সাংখ্য একদিকে বলছে, প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের মিলনের দরুনই সৃষ্টি : “যথা স্ত্রী ও পুরুষের সংযোগে সন্তান-উৎপত্তি হয় সেইরূপ প্রধান-পুরুষের সংযোগে সৃষ্টির উৎপত্তি হয়।” আবার অপরদিকে সাংখ্য বলছে, প্রকৃতিই প্রধান—পুরুষ নেহাতই অপ্রধান এবং উদাসীন। এই দ্বিবিধ মনোভাব কী করে একইসঙ্গে থাকতে পারে তা বুঝতে আমাদের পক্ষে অসুবিধে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনেই যদি সৃষ্টি সম্ভব হয় তাহলে তা সত্বেও পুরুষ কেন এতোখানি গৌণ হয়ে যাবে? কিংবা, পুরুষ যদি সত্যিই অমন একান্তভাবে অপ্রধান ও উদাসীন হয় তাহলে সৃষ্টিব্যাপারে তার একান্তই কোনো ভূমিকা কী করে থাকতে পারে? প্রাচীন আচার্যরা তাদের নিজেদের পরিভাষায় সাংখ্যের বিরুদ্ধে এই আপত্তিই তুলেছেন। তারা দেখাচ্ছেন অন্ধ-পঙ্গু বা অয়স্কান্ত-লৌহের দৃষ্টান্ত দিয়েও সাংখ্য এই মূল অস্তদ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পেতে পারে না। এবং আধুনিক গবেষকদের মধ্যেও অনেকেই বলছেন যে, সাংখ্যদর্শন প্রবর্তক ওই পুরুষের কথাটুকু বাদ দিলেই অনেক সুসঙ্গত মনোভাবের পরিচয় দিতেন। আমাদের যুক্তি হলো, সাংখ্য-ধ্যানধারণার মধ্যে মাতৃপ্রধান সমাজের প্রতিবিম্ব খুঁজে পাওয়া যায় বলেই সে-সমাজে পুরুষের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে যে-অস্তদ্বন্দ্ব তাই সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের তত্ত্বকে কেন্দ্র করে ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ, মাতৃপ্রধান সমাজের মনোভাবটির দিক থেকে সাংখ্য-দর্শনের এই উভয় তত্ত্বেরই একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। এ-সমাজের মানুষ একদিকে দেখছে সন্তান-উৎপাদন ব্যাপারে পিতার একটা ভূমিকা রয়েছে, আবার অপরদিকে তারা দেখছে যে, তা সত্ত্বেও পিতার সঙ্গে সন্তানের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তারা ভাবছে, নারী থেকেই গোত্রের উৎপত্তি,—From the Woman sprang the clan; আবার অপরদিকে, অবজ্ঞাসূচকভাবে হলেও, পিতাকে–পুরুষকে—‘জন্মদাতা’ বলে স্বীকার করতে তারা বাধ্য হচ্ছে : refer to him curtly as a begetter.

এই মনোভাব নিয়ে এবং দেহভাণ্ডের অনুরূপ হিসেবেই যদি ব্রহ্মাওকে বোঝবার চেষ্টা করা যায়, তাহলে? তাহলে একদিকে যে-রকম বলতে হয় সৃষ্টির জন্য প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের একটা মিলন প্রয়োজন আবার অপরদিকে তা সত্ত্বেও বলতে হয় যে, প্রকৃতিই প্রধান, প্রকৃতিই সৃষ্টির আদিকারণ এবং পুরুষ শুধুই অপ্রধান নয়, উদাসীন, নির্লিপ্ত ও নিশ্চেষ্ট।

প্রশ্ন উঠতে পারে, দার্শনিক চিন্তাকে সমাজবাস্তবের এতোখানি হুবহু প্রতিবিম্ব মনে করবার চেষ্টাটা যান্ত্রিক, অতএব অবৈজ্ঞানিক, মনোভাবের পরিচায়ক কিনা? উত্তরে বলবো, দার্শনিক চিন্তার কাঠামোটা যে কতো গভীরভাবে সমাজবাস্তব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে তার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্বয়ং মার্ক্‌স্‌-এর(৭১৪) রচনাতেই দেখতে পাওয়া যায় :

…what would old Hegel say in the next world if he heard that the general (Allgemeine) in German and Norse means nothing but the common land (Gemeinland), and the particular, Sundre, Besondere, nothing but the separate property divided off from the common land 2 Here are the logical categories coming damn well out of “our intercourse” after all.

মাক্স-এর এ-উক্তি আমাদের বৈশেষিক দর্শনের সামান্য ও বিশেষ সংক্রান্ত সমস্যার উপর আলোকপাত করে কিনা, গবেষকেরা অবশ্যই তার আলোচনা তুলবেন। বর্তমানে আমাদের যুক্তি শুধু এইটুকু যে, হেগেল-দর্শনের সামান্য ও বিশেষ-এর মতো জটিল দার্শনিক ‘পদার্থে’র মধ্যে যদি এইভাবে সমাজবাস্তব প্রতিফলিত হয়ে থাকে তাহলে সাংখ্য-দর্শনের প্রকৃতির প্রাধান্য ও পুরুষের ঔদাসীন্যের মধ্যে মাতৃপ্রধান সমাজের প্রতিবিম্ব অন্বেষণ করা অন্তত আপাত-অযৌক্তিক মনোভাবের পরিচায়ক হবে না।

 

পুরুষের ভূমিকা সংক্রান্ত সাংখ্যের এই অন্তর্বিরোধ থেকে তান্ত্রিক ধ্যানধারণাও নিশ্চয়ই মুক্ত নয়। কেননা, প্রকৃতি আর পুরুষের তত্ত্ব নিয়েই তন্ত্র, এবং তন্ত্রেও প্রকৃতির প্রাধান্য এমনই প্রকট এবং তার পাশে পুরুষের ভূমিকা এতোই গৌণ যে, আপাত-দৃষ্টিতে এমন কি এ-কথাও মনে হওয়া অসম্ভব নয় যে, নেহাতই কৃত্রিম ও অসংলগ্নভাবে তন্ত্রে ওই পুরুষের কথা প্রবেশলাভ করেছে। তন্ত্রের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা এই অন্তর্দ্বন্দ্বের দিকটির কথা উত্থাপন করিনি। তার কারণ আমাদের মনে হয়েছিলো, সাংখ্য-প্রসঙ্গেই এই দিকটির আলোচনা তোলা যুক্তিযুক্ত হবে। মূল তত্ত্বের দিক থেকে সাংখ্যের সঙ্গে তন্ত্রের সাদৃশ্য সত্যিই বিস্ময়কর!

বস্তুত, এই কারণেই আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের উদ্ধত মন্তব্যটি থেকে শুরু করতে চেয়েছি। কেননা, তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের মৌলিক সাদৃশ্য সতিই বিস্ময়কর হলেও আরো বিস্ময়কর ঘটনা হলো আধুনিক বিদ্বানের সাংখ্যের উৎপত্তি সংক্রান্ত বহু আলোচনা করলেও এ-বিষয়ে তন্ত্রের সাক্ষ্যকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করে থাকেন। ফলে সাংখ্যের উৎস সংক্রান্ত নানারকম মতবাদ উদ্ভাবন করে তারা যেন তারই গোলকধাধায় পথ হারিয়ে যান, সমস্যাটি মোটের উপর রহস্যময়ই হয়ে থাকে। অপরপক্ষে, তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের গভীর সাদৃশ্যের কথা মনে রাখলে এবং তন্ত্রের উৎস-প্রসঙ্গে আমাদের যুক্তি স্বীকৃত হলে সাংখ্যের মতো ওই আপাত-বিস্ময়কর দার্শনিক চিন্তার উৎস আমাদের কাছে আর রহস্যময় হয়ে থাকে না।

আধুনিক গবেষকেরা সাংখ্যের উৎস-প্রসঙ্গে যে মতবাদ রচনা করেছেন আমরা একটু পরেই তার আলোচনায় প্রত্যাবর্তন করবো। তার আগে সাংখ্যের সঙ্গে তন্ত্রের সম্পর্কটাকে আরো একটু খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা দরকার।

প্রথমত, বঙ্কিমচন্দ্র যদিও সাংখ্যের সঙ্গে তন্ত্রের সম্পর্কটি দেখতে পেয়েছেন তবুও তার মতে এ-সম্পর্কের ব্যাখ্যা হলো, তন্ত্রের মূল তত্ত্বগুলি সাংখ্য-দর্শনের কাছ থেকেই পাওয়া : “সাংখ্যের প্রকৃতি পুরুষ লইয়া তন্ত্রের সৃষ্টি”। বস্তুত শুধু বঙ্কিমচন্দ্রই নন, ইউরোপীয় বিদ্বানেরাও শাক্ত ধ্যানধারণার ব্যাখ্যায় এ-জাতীয় একটা সহজ সমাধানকে গ্রহণ করাই নিরাপদ বোধ করেছেন। যেমন শাক্ত ধ্যানধারণা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে :

It has been supplied with a philosophical justification, being a popularised version of the Samkhya principle of the union of the soul of the universe (purusa) with the primordial essense (prakriti).(৭১৫)
অর্থাং, সংক্ষেপে, এই শাক্ত মতবাদ সাংখ্য-দর্শনের পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনের এক জনপ্রিয় সংস্করণ হিসেবে দার্শনিক ব্যাখ্যার মর্যাদাও লাভ করেছে।

আমাদের মন্তব্য হলো, আদি-আকৃত্রিম সাংখ্যের পুরুষকে soul ofthe universe আখ্যা দেওয়ার মতোই শাক্ত মতবাদকে সাংখ্যের জনপ্রিয় সংস্করণ বলে কল্পনা করাটাও ঐতিহাসিক বোধের পরিচায়ক নয়। আদিতে সাংখ্যের পুরুষ যে আত্মা বা soul বোঝায়নি, এ-বিষয়ে কিছু তথ্য আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি; যদিও কীভাবে এই পুরুষই ঔপনিষদিক চিন্তার প্রভাবে ক্রমশ আত্মা—এমনকি, উপনিষদের নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মাই—বোঝাতে শুরু করেছে সে-আলোচনা এখনো আমাদের পক্ষে বাকি আছে। কিন্তু তন্ত্রের ওই প্রকৃতি আর পুরুষের তত্ত্বের জন্য যে কোনো দার্শনিক সম্প্রদায়ের কাছেই ঋণী হবার প্রয়োজন নেই—অতএব সাংখ্যের কাছেও নয়-সে-কথা আমরা বিস্তারিতভাবেই আলোচনা করেছি। কেননা, আমরা দেখেছি যে, কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাস থেকেই তন্ত্রের শুধু মৌলিক তত্ত্বগুলিই নয়—এমনকি, আচারঅনুষ্ঠানের দিকগুলিও—অনিবাৰ্যভাবেই জন্মলাভ করেছে। এখানে আমরা তাছাড়াও আর একটি যুক্তির অবতারণা করতে চাই। যদিই বা ধরে নেওয়া যায় যে, তন্ত্রের ওই পুরুষ-প্রকৃতির তত্ত্ব সাংখ্যের কাছ থেকে গৃহীত হয়েছে, তাহলেও এইপ্রসঙ্গে আরো একটি মৌলিক সমস্যা বাকি থাকে : সাংখ্যের ওই পুরুষ-প্রকৃতির তত্ত্বই বা এলো কোথা থেকে? কপিল নামের জনৈক আদিবিদ্বানের মস্তিষ্ক থেকে? কিন্তু কপিল যে সত্যিই কে ছিলেন তা আমাদের জানা নেই। এমন কি, কপিল বলতে আদ্যিকালের কোনো এক নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বোঝাতো কি না তাও সন্দেহের কথা। অপরপক্ষে, ওই প্রকৃতি আর পুরুষের নারীবাচকত্ব আর পুরুষবাচকত্বের প্রতি উপযুক্ত গুরুত্ব দিলে এ-কথাই সন্দেহ করবার সুযোগ থাকে যে, সাংখ্যের মতো ওই আপাত-বিস্ময়কর দার্শনিক চিন্তাধারা একজন ব্যক্তিবিশেষের মস্তিষ্ক-প্রসূত না হওয়াই স্বাভাবিক —কৃষিবিদ্যার প্রাথমিক পর্যায়ে এ-জাতীয় কল্পনার অন্তত মূল কাঠামোটুকু সার্বভৌম এবং অনিবার্যও। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, প্রাচীন চীন এবং প্রাচীন মিশর ও মেসোপটেমিয়াতেও বিশ্বসৃষ্টিকে নর-নারীর মিলন-প্রসূত হিসেবেই বোঝবার চেষ্টা করা হয়েছিলো এবং অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন দেখিয়েছেন সে-চিন্তার বীজ আদিম সমাজের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। দুঃখের বিষয় আদিম সমাজের চিন্তাচেতনার দিক থেকে সাংখ্যের উৎসকে বোঝবার চেষ্টা আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে দেখা যায় না। ফলে সাংখ্যের উৎপত্তি-প্রসঙ্গে তারা যে-মতবাদগুলি প্রণয়ন করেছেন সেগুলি ঐতিহাসিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা এবার সংক্ষেপে সেই মতবাদগুলি বিচার করবো।

 

সাংখ্যের উৎস-প্রসঙ্গে আধুনিক বিদ্বানের যে-সব মতবাদ রচনা করেছেন তা নিয়ে আলোচনা তোলবার আগে আমাদের পক্ষে বলে নেওয়া প্রয়োজন, এ-বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্য বলতে ঠিক কী পাওয়া যায়, কিংবা ঠিক কোন ধরনের মালমশলার সাহায্যে আধুনিক বিদ্বানেরা তাদের ওই মতবাদগুলিকে নির্মাণ করবার চেষ্টা করে থাকেন।

প্রথমত, মনে রাখা দরকার, সাংখ্যদর্শনের নিজস্ব পুঁথিপত্র বলতে সত্যিই যৎসামান্য এবং সাংখ্যের প্রাচীনত্বের তুলনায় এই পুঁথিগুলি নেহাতই অর্বাচীন। মূল পুঁথি বলতে দুটি। এক : ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকা—তাতে মোট ৭২টি শ্লোক পাওয়া যায়। দুই : সাংখ্য-প্রবচন-সূত্র। যদিও এই সাংখ্যপ্রবচন-সূত্রকে কপিলের নিজস্ব রচনা বলেই উল্লেখ করা হয় তবুও আধুনিক বিদ্বানেরা ও নিঃসন্দেহেই প্রমাণ করেছেন যে, এই সূত্রগুলি নেহাতই অর্বাচন—আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত। তুলনায়, ঈশ্বরকৃষ্ণের কারিকা নিশ্চয়ই প্রাচীনতর—আনুমানিক দ্বিতীয় শতাব্দীর রচনা।

ঈশ্বরকৃষ্ণের কারিকার উপর দুটি খুব নামকরা ভাষা আছে। এক, গৌড়পাদের ভাষা—আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে রচিত। দুই, বাচস্পতিমিশ্রের সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী—আনুমানিক নবম শতাব্দীতে রচিত।

সাংখ্য-প্রবচন-সূত্রের উপর সবচেয়ে বিখ্যাত ভাষ্য বিজ্ঞানভিক্ষুর সাংখ্য-প্রবচন-ভাষ্য—অনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত। এই সাংখ্য-প্রবচন ভাষা, এমন কি সাংখ্য-প্রবচন-সূত্রও—যে সাংখ্য-দর্শনের মূল তত্ত্বগুলিকে অত্যন্ত প্রকটভাবে বিকৃত করেছে সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই; আমরা একটু পরে তার আলোচনা তুলবো। আপাতত এইটুকু কথাই পর্যাপ্ত হবে যে, সাংখ্য-প্রবচন-সূত্র বা বিজ্ঞানভিক্ষুর ভাষা থেকে সাংখ্যের আদিরূপটিকে সংগ্ৰহ করা সম্ভব নয়।

সাংখ্যের নিজস্ব সাহিত্য বলতে বাকি থাকে ঈশ্বরকৃষ্ণের কারিকা। কিন্তু, এ-কারিকাও যদি দ্বিতীয় শতাব্দীর রচনা হয় তাহলে তার মধ্যেও সাংখ্যের আদি-অকৃত্রিম রূপটির পরিচয় পাবার সম্ভাবনাও খুব বেশি নয়; কেননা, এ-বিষয়ে কোনো রকম সন্দেহের অবকাশই থাকতে পারে না যে, সাংখ্য-দর্শন অন্তত সনতারিখের দিক থেকে অনেক অনেক পুরোনো। এ-কথার পক্ষে নানান রকম প্রমাণ রয়েছে। যেমন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলছেন, “কৌটিল্য তিনটি মাত্র দর্শনের উল্লেখ করেন—সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত; কৌটিল্য ২৩০০ বৎসর পূর্বের লোক”। এবং “বৌদ্ধধর্ম সাংখ্যমত হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, এ-কথা অশ্বঘোষ একপ্রকার বলিয়াই গিয়াছেন। বুদ্ধদেবের গুরু আডার কলম উদ্রক দু’জনেই সাংখ্যমতাবলম্বী ছিলেন”। অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে(৭১৮) এমনকি অথৰ্ববেদ-এর মধ্যেও সাংখ্যের উল্লেখ খুঁজে পাচ্ছেন। তাছাড়া, উপনিষদাদি প্রাচীন সাহিত্যে সাংখ্য বা অন্তত সাংখ্যের মূল পরিভাষার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে—এই জাতীয় উল্লেখ থেকেই কয়েকজন আধুনিক বিদ্বান অনুমান করছেন যে, সাংখ্যের আদিরূপটিকে ওই উপনিষদাদি গ্রন্থ থেকেই অনুমান বা পুনর্গঠন করতে হবে। অতএব, সাংখ্যের নিজস্ব সাহিত্যের বাইরে সাংখ্যের বা সাংখ্য-দর্শনের মূল তত্ত্বগুলির পরিচয় প্রধানত কোথায় কোথায় পাওয়া যায় তা এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে।

উপনিষদে সাংখ্যের উল্লেখ হিসেবে আধুনিক বিদ্বানের প্রধানত নিম্নোক্ত নজিরগুলির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান :

কঠোপনিষৎ : ১,৩-১০ও১১॥২,৩-৭ও৮
শ্বেতাশ্বতরোপনিষং : ১,-৮ও১০॥৩-১২॥৪,-৫ও১০॥৫-২,৭ও৮॥৬,-১০,১৩ও১৬॥
প্রশ্নোপনিষৎ : ৪,৮॥
মৈত্রায়ণী উপনিষৎ : ২,৫॥৩,২-৫॥৪,৩॥৫,৩॥৬:৫,১০,১৯,২৮,৩০,৩৪,॥৭,১॥

এ-ছাড়া অবশ্যই মহাভারতের মধ্যে, বিশেষত শ্ৰীমদ্ভগবদগীতায়, সাংখ্যের সুদীর্ঘ উল্লেখ রয়েছে। এবং অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত বলছেন, চরকসংহিতায় সাংখ্যের যে-প্রাচীনতর রূপটির পরিচয় পাওয়া যায়, আধুনিক বিদ্বানেরা, দুঃখের বিষয়, তার প্রতি উপযুক্ত মনোযোগ দেন না। আমাদের মন্তব্য হলো, চরকসংহিতার সাক্ষ্য অবশ্যই মূল্যবান; কিন্তু এই প্রসঙ্গেই অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত—তথা আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে প্রায় সকলেই—অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি মূল্যবান সাক্ষ্যের প্রতি কিছুটা যেন উদাসীন। সেটি হলো, বেদান্তসূত্র। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের কাল-নির্ণয় অনুসারেও এই ব্রহ্মসূত্র খৃস্টপূর্ব ২০০-র পরে রচিত নয়; অপরপক্ষে চরকসংহিতা ৭৮ খৃস্টাব্দে রচিত। কিন্তু শুধুমাত্র এই সনতারিখের প্রাচীনত্বই নয়, আমরা একটু পরেই দেখাবার চেষ্টা করবো যে, এই ব্রহ্মসূত্রের সাক্ষ্যকে অগ্রাহ্য করেছেন বলেই আধুনিক বিদ্বানের একটি মূল ভ্রান্তির বশবর্তী হয়েছেন। সে-ভ্রান্তি হলো, উপনিষদে সাংখ্যের বা সাংখ্য-দর্শনের তত্ত্বগুলির নাম-উল্লেখ থেকেই তারা কল্পনা করেছেন যে, সেখানেই সাংখ্য-দর্শনের প্রাচীনতর রূপটির পরিচয় পাওয়া যেতে পারে। অথচ ব্রহ্মসূত্রের সাক্ষ্যকে অগ্রাহ্য না করলে তারা স্পষ্টষ্ট দেখতে পেতেন যে, বাদরায়ণের মতে উপনিষৎ বা বেদান্তের প্রধানতম প্রতিপক্ষ বলতে এই সাংখ্যদর্শনই অতএব উপনিষদে সাংখ্যের উল্লেখগুলি সাংখ্য-দর্শনের ব্যাখ্যা বা বর্ণনা নয়—তার বদলে আদি-সাংখ্যের খণ্ডন-প্রচেষ্টাই। অতএব, ব্রহ্মসূত্র থেকে সাংখ্যের প্রতি বেদান্ত বা উপনিষদের ভঙ্গিটিকে ভালো করে বুঝে নিয়ে তারপর উপনিষদের ওই অংশগুলির ব্যাখ্যা খোঁজা প্রয়োজন। আমরা পরে প্রধানত সেই পদ্ধতিই অবলম্বন করে অগ্রসর হবার চেষ্টা করবো।

মোটের উপর এই হলো সাংখ্য-দর্শনের আদিরূপকে পুনর্গঠন করবার মালমশলা। এগুলির কথা মনে রেখে এবার আধুনিক বিদ্বানদের সিদ্ধান্তগুলি পর্যালোচনা করা যাক।

অধ্যাপক ওল্ডেনবার্গ(৭২০) বলছেন, উপনিষদের মধ্যে—বিশেষত কঠ এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের কোনো কোনো উক্তির মধ্যেই—সাংখ্য-দর্শনের বীজ আবিষ্কার করা যায়। অতএর তার মতে, এ-বিষয়ে দুটি প্রচলিত সিদ্ধান্ত বর্জন করা প্রয়োজন। প্রথম সিদ্ধান্ত হলো, কপিল নামের জনৈক আদি-বিদ্বানই সাংখ্য-দর্শন প্রবর্তন করেছিলেন। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হলো, রিচার্ড গার্বে প্রমুখ কোনো কোনো আধুনিক গবেষক যেমন বলছেন, বেদ-বহির্গত মানুষদের চিন্তা-চেতনার মধ্যেই এ-দর্শনের উদ্ভব হয়েছিলো। উপনিষদের মধ্যেই সাংখ্য-দর্শনের বীজ আবিষ্কার করতে হলে এই উভয় সিদ্ধান্তকেই কেন পরিহার করা প্রয়োজন তার আলোচনা দীর্ঘ করবার দরকার পড়ে না। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, অন্যান্য প্রাচীন রচনায় সাংখ্যের যে-পরিচয় পাওয়া যায় তার সঙ্গে কঠ এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে পাওয়া সাংখ্য-দর্শনের সংস্করণটির মিল আছে কিনা? যদি না-থাকে তাহলে সেই অমিলের ব্যাখ্যা কী? অধ্যাপক ওল্ডেনবার্গ বলেন, শ্রীমদ্ভগবদগীতায় এবং ঈশ্বরকৃষ্ণের কারিকায় সাংখ্যের যে-রূপকে আমরা দেখতে পাই তার সঙ্গে কঠ ও শ্বেতাশ্বতর-তে পাওয়া রূপটির বৈষম্য আছে। এই বৈষম্যের ব্যাখ্যা হলো, কঠ ও শ্বেতাশ্বতর-র সংস্করণটিই সাংখ্যের আদি-সংস্করণ; উত্তরকালে দুটি স্বতন্ত্র পথে বিকশিত হতে হতে গীতায় ও কারিকায় সাংখ্য দুটি স্বতন্ত্র মূর্তি, ধারণ করেছে।

জে, ডাহলম্যান-এর(৭২১) মতে সাংখ্যের আদিরূপটিকে ঔপনিষদিক ঐতিহ্যের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়; কিন্তু সাংখ্যের এই ঔপনিষদিক সংস্করণটির সঙ্গে গীতায় পাওয়া সংস্করণটির অমিল নেই। অতএব উত্তরকালে সাংখ্যের বিকাশকে দুমুখে মনে করবার কোনো কারণ নেই। উপনিষদ আর গীতায় সাংখ্যের যে-পরিচয় পাওয়া যায় তাই উত্তরকালে পরিবর্তিত হয়ে কারিকার সাংখ্যে পরিণত হয়েছে।

ডাহলম্যানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে নানাবিষয়ে মতান্তর থাকলেও অধ্যাপক বেলভেলকার ও রানাডে(৭২২) উপরোক্ত বিষয়ে মোটের উপর তাঁর সঙ্গে একমত। অর্থাৎ, উপনিষদ ও গীতায় সাংখ্যের যে-পরিচয় পাওয়া যায় তার মধ্যে মূলতঃ কোনো পার্থক্য নেই এবং এই পরিচয়ই হলো সাংখ্যের আদি-অকৃত্রিম পরিচয়। অবশ্যই, এ-পরিচয়ের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে কঠ এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মধ্যে। অতএব, অধ্যাপক বেলভেলকার ও রানাডে সিদ্ধান্ত করছেন, “ওল্ডেনবার্গ যখন কঠ ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মধ্যে সাংখ্যের উৎস অনুসন্ধান করেন তখন আমরা মোটের উপর তার সঙ্গে একমত হই।”

ডক্টর ই. এইচ. জনস্টন(৭২৩) “প্রাচীন সাংখ্য” নামের বইতে সাংখ্যের উৎপত্তি সংক্রান্ত সমস্যার নতুন করে আলোচনা তুলেছেন। যদিও তিনি অধ্যাপক ওল্ডেনবার্গ-এর মতো শুধু কঠ এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মধ্যেই সাংখ্যের সূত্রপাত আবিষ্কার করতে রাজি নন, তবুও তিনি মোটের উপর ঔপনিষদিক সাহিত্যের মধ্যেই এ-সূত্রপাত দেখতে চান: কেবল শ্বেতাশ্বতর ও কঠ উপনিষদের বদলে তিনি বৃহদারণ্যক, ছান্দোগ্য এবং প্রশ্ন উপনিষদের সাক্ষ্যগুলির উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে চান।

আধুনিক বিদ্বান-মহলে উপনিষদ-সাহিত্যের মধ্যেই সাংখ্যের উৎস আবিষ্কার করবার আর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলো এ-বিষয়ে শ্রীযুক্ত জ্যাকবির(৭২৪) রচনাবলী। অন্যান্য কয়েকজন আধুনিক বিদ্বানের মতো জ্যাকবিও মনে করেন যে, সাংখ্য-দর্শনের উৎপত্তি বৌদ্ধধর্মের চেয়েও প্রাচীন এবং গীতায়— বা মহাভারতে—সাংখ্য-দর্শনের যে-পরিচয় পাওয়া যায় তার মধ্যে আদি অকৃত্রিম সাংখ্য-দর্শনের সঙ্গে বেদান্ত-দর্শনের সংমিশ্রণ চোখে পড়ে। তাহলে, প্রশ্ন ওঠে, সেই আদি-সাংখ্যের রূপ কী? জ্যাকবি এখানে তিনটি পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। এক : এপিক সাংখ্য—অর্থাৎ কিনা, মহাভারতে সাংখ্য-দর্শনের যে-সংস্করণটির পরিচয় পাওয়া যায়। দুই : ক্লাসিক্যাল সাংখ্য— অর্থাৎ কিনা, ঈশ্বরকৃষ্ণের কারিকায় সাংখ্য-দর্শনের যে-সংস্করণটির পরিচয় পাওয়া যায়। তিন : প্রাক্-ক্লাসিক্যাল সাংখ্য—অর্থাৎ কিনা, সাংখ্যের সেই আদি-রূপ, যার সঙ্গে বৈদান্তিক চিন্তাধারার সংমিশ্রণ হবার ফলেই শেষ পর্যন্ত ওই “এপিক সাংখ্য” বা সাংখ্যের শ্ৰীমদ্ভগবদগীতা সংস্করণটির উদ্ভব হয়েছিলো। জ্যাকবির কাল-নির্ণয় অনুসারে, এই প্রাক্-ক্লাসিক্যাল বা আদি-সাংখ্যের যুগ হলো খৃস্টপূর্ব ৮০০; তারপর, খৃস্টপূর্ব ৫০০ বরাবর তা ক্লাসিক্যাল-সাংখ্যের রূপ পরিগ্রহ করেছে। ওই প্রাক্-ক্লাসিক্যাল-সাংখ্য সম্বন্ধে জ্যাকবির কয়েকটি মন্তব্য অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। যেমন তিনি বলছেন, এই আদি-সাংখ্যের বক্তব্যটা উত্তরকালের মতো মোটেই অধিবিদ্যামূলক ছিলো না—জ্ঞানের বদলে কর্মের উপরই প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হতো এবং মার্জিত দার্শনিক-মহলের পরিবর্তে এই সাংখ্যের উপদেশ জনসাধারণের উদ্দেশ্যেই যে প্রচারিত হতো তা অনুমান করবারও যথেষ্ট কারণ আছে। জ্যাকবির এ-জাতীয় মন্তব্যের তাৎপর্য কেন গুরুত্বপূর্ণ সে-কথা পরে বোঝা যাবে। আপাতত প্রশ্ন হলো, তিনি যাকে ওই প্রাক্-ক্লাসিক্যাল বা আদি-সাংখ্য বলে উল্লেখ করতে চান তার পরিচয় কোথায় পাওয়া যাবে? উত্তরে জ্যাকবি বলছেন, উপনিষদ-সাহিত্যের মধ্যেই—তবে তা শ্বেতাশ্বতর বা কঠ উপনিষৎ নয়, তার বদলে ছান্দোগ্য-উপনিষদের ষষ্ঠাধ্যায়ের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ খণ্ডের মধ্যে, যেখানে উপদেশ দেওয়া হয়েছে যে, সৎস্বরূপ থেকে তেজ, অপ, ও অন্নের স্মৃষ্টি হরেছিলো, এই আদি দেবত্রয়ের মিশ্রণেই জগদ্যুৎপত্তি হয়েছিলো অতএব অগ্নি সূর্যাদি সমুদয় বস্তুতে আদি দেবত্রয়ের অবস্থিতি আছে।

 

 

তাহলে, আধুনিক বিদ্বান-মহলে এই হলো একজাতীয় সিদ্ধান্ত এবং এ-জাতীয় সিদ্ধান্তের মূল কথা হলো, ঔপনিষদিক সাহিত্যের মধ্যেই সাংখ্যের বীজ খুঁজে পাওয়া সম্ভব—যদিও অবশ্য ঠিক কোন উপনিষদের ঠিক কোন্‌ অংশের মধ্যে এই বীজ লুকোনো আছে, সে-প্রশ্নে উক্ত বিদ্বানের একমত নন।

কিন্তু এ-জাতীয় সিদ্ধান্ত স্বীকারযোগ্য হতে পারে না। ঔপনিষদিক সাহিত্যের মধ্যেই সাংখ্য-দর্শনের বীজ অন্বেষণ করা নিষ্ফল প্রচেষ্টায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। এ-মন্তব্যের চূড়ান্ত প্রমাণ অবশ্য ওই ঔপনিষদিক সাহিত্যের আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যই। কিন্তু সে-সাক্ষ্য বিচার করবার আগে আমরা বলতে চাই, ওই আধুনিক বিদ্বানের সাংখ্যের আদিরূপ সন্ধানের সময় এ-বিষয়ে বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের অত্যন্ত মূল্যবান ইংগিতগুলিকে অগ্রাহ্য করেছেন বলেই উপনিষদের মধ্যে কোথাও কোথাও সাংখ্য-দর্শনের পরিভাষা ব্যবহৃত হতে দেখে ভ্রান্তভাবে কল্পনা করেছেন যে, তার মধ্যেই প্রকৃত সাংখ্য-দর্শনের বীজ লুকোনো রয়েছে। তাই, উপনিষদের এই অংশগুলিকে বিশ্লেষণ করবার আগে আমরা এ-বিষয়ে বেদান্তসূত্র বা ব্রহ্মসূত্রের মূল্যবান ইংগিতগুলির উল্লেখ করবো।

প্রথমত, এ-বিষয়ে নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না যে, বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ঔপনিষদিক বা বৈদান্তিক চিন্তাধারাকেই সুসংহত ও সুসম্বদ্ধভাবে প্রকাশ করা। অতএব বলা যায় যে, উপনিষদের মূল দার্শনিক তত্ত্বের মুসংহত পরিচয় আমরা বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রের মধ্যেই খুঁজে পাবো।

এই উক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে কেউ বলতে পারেন, উত্তরকালে বিভিন্ন বৈদান্তিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এই ব্রহ্মসূত্রের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে প্রত্যেকেই মূল উপনিষদের নজির দেখিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, তার নিজস্ব ব্যাখ্যাটিই শ্রুতিসঙ্গত। এবং আমরা যদি এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কেই গোড়ার মতো সমর্থন করবার চেষ্টা না করি—যদি আমরা নৈর্ব্যক্তিকভাবে এই সম্প্রদায়গুলির যুক্তি ও উদ্ধৃতিকে বিচার করতে রাজি হই—তাহলে আমাদের পক্ষে এর মধ্যে কোনো একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কেই বৈদান্তিক চিন্তাধারার একমাত্র পরিবাহক বলে ঘোষণা করা উচিত হবে না। অতএব, আমাদের পূর্বপক্ষ অনুসারে, উপনিষদের মধ্যেই বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্বের সংমিশ্রণ রয়েছে; এজাতীয় বিভিন্ন তত্ত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করবার ফলেই আমাদের দেশে উত্তরযুগে বেদান্ত নাম নিয়েই বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিলো। তাই প্রাচীন আচার্যদের ধর্মমোহের কাছে কথাটা যতোই অপ্রীতিকর হোক না কেন, আধুনিক ঐতিহাসিকের পক্ষে এ-কথা স্বীকারযোগ্য যে, ব্রহ্মসূত্রের মধ্যেই ঔপনিষদিক চিন্তাধারা বলে কোনো একটিমাত্র নির্দিষ্ট চিন্তাধারার পরিচয় আবিষ্কার করবার প্রস্তাবটি অসঙ্গত।

এই যুক্তির উত্তরে আমরা বলবে, উপনিষদগুলিকে বিভিন্ন চিন্তাধারার সংমিশ্রণ হিসেবে দেখবার চেষ্টাটা ঐতিহাসিকভাবে সঙ্গত হোক আর নাই হোক, এ-বিষয়ে নিশ্চয়ই কোনো রকম সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না যে বিভিন্ন বৈদান্তিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একদিক থেকে যে-রকম দার্শনিক তত্ত্বের অমিল আছে অপরদিক থেকে আবার তেমনিই মৌলিক দার্শনিক তত্ত্বের মিলও আছে। এ-কথার সবচেয়ে সহজ দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ব্রহ্ম সগুণ না নিগুৰ্ণ এ-প্রশ্ন নিয়ে দুটি প্রধান বৈদান্তিক সম্প্রদায়ের মধ্যে দার্শনিক দ্বন্দ্ব যতোই থাকুক না কেন, চিন্ময় ব্ৰহ্মই যে জগৎকারণ সে-বিষয়ে উভয় সম্প্রদায়ই একমত। অর্থাৎ, বৈদান্তিক চিন্তার সাধারণ দার্শনিক কাঠামো বলতে একটিই, যদিও এই কাঠামোর মধ্যে নানাপ্রকার বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সম্প্রদায়গুলির মধ্যে মতপার্থক্য আছে। এবং বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রে আমরা বেদান্ত-দর্শনের ওই সাধারণ কাঠামোটিরই পরিচয় পাই। অতএব স্বীকার করা দরকার, সাধারণভাবে উপনিষদের দার্শনিক তত্ত্বকে চেনবার চেষ্টায় বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রই আমাদের কাছে প্রাচীনতম ও প্রামাণ্যতম—অতএব প্রধানতম—সহায়।

তাহলে, উপনিষদের মধ্যেই সাংখ্যের বীজ অন্বেষণ করা একান্তই সঙ্গত কিনা,—অর্থাৎ, ঔপনিষদিক চিন্তার সাধারণ কাঠামোটির মধ্যে সাংখ্যদর্শনের কোনো স্থান থাকা একান্তই সম্ভবপর কি না—এ-সমস্যার সমাধানে ব্ৰহ্মসূত্রের সাক্ষ্যই প্রধানতম বলে গৃহীত হওয়া উচিত। কিন্তু আধুনিক বিদ্বানের এ-বিষয়ে প্রায় সম্পূর্ণ উদাসীন এবং সেই ঔদাসীন্যই উপনিষদের মধ্যে সাংখ্য-দর্শনের বীজ আবিষ্কার সংক্রান্ত কল্পিত কাহিনীর মূল উপজীব্য। কেননা, ব্রহ্মসূত্রের সাক্ষ্য অনুসারে বেদান্ত দর্শনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ওই সাংখ্য-দর্শনই।

ব্রহ্মসূত্রে অবশ্যই বেদান্ত-দর্শনের আরো কয়েকটি দার্শনিক প্রতিপক্ষের খণ্ডন রয়েছে, কিন্তু সাংখ্যের বিরুদ্ধে দার্শনিক অভিযানের তুলনায় এগুলি গৌণ। স্বয়ং শঙ্করাচার্যও(৭২৫) এই কথাই বলেছেন। ব্রহ্মসূত্রের ওই সাংখ্য-খণ্ডনই প্রধান-মল্লনিবর্হণের মতো। অর্থাৎ, মল্লক্ষেত্রে প্রধান মল্লকে পরাস্ত করলেই যে-রকম অপেক্ষাকৃত অপ্রধানদেরও পরাস্ত করা হয় তেমনি যেসব যুক্তির সাহায্যে সাংখ্য খণ্ডিত হলো তারই সাহায্যে পরমাণুকারণবাদ প্রভৃতিও নিরস্ত বা খণ্ডিত হবে।

ব্ৰহ্মসূত্র রচনা করবার সময় বাদরায়ণ বারবার নানানভাবে ও নানানদিক থেকে এই সাংখ্য-দর্শনের দাবি খণ্ডন করবার প্রসঙ্গে ফিরে এসেছেন। বস্তুত, ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে পূর্বপক্ষ খণ্ডনের যে-কটি পদ্ধতি প্রচলিত আছে বাদরায়ণ তার প্রায় প্রতিটিরই প্রয়োগ করেছেন সাংখ্য-দর্শনের বিরুদ্ধে; তিনি যুক্তির সাহায্যে দেখাতে চাইছেন, সাংখ্যের প্রধান-কারণবাদ কিছুতেই স্বীকারযোগ্য নয়; তিনি লৌকিক দৃষ্টান্তের সাহায্যে দেখাবার চেষ্টা করছেন, সাংখ্যের পরিণামবাদ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না; তিনি শ্রুতির সাহায্যে প্রমাণ করবার চেষ্টা করছেন, সাংখ্য-দর্শন সর্বতোভাবে বেদবিরুদ্ধ। উপনিষদের ব্যাখ্যায় স্বয়ং বামরায়ণ যে-মতটিকে এতোবার এতোভাবে খণ্ডন করবার চেষ্টা করলেন উপনিষদোটর মধ্যেই সে-মতবাদের বীজ অন্বেষণ করা কী ভাবে সমর্থনযোগ্য হতে পারে? অতএব আমাদের যুক্তি অনুসারে, উপনিষদের মধ্যেই সাংখ্যা-দর্শনের বীজ আবিষ্কার করার প্রচেষ্টাটাই যে ভ্রান্ত সে-বিষয়ে চরম প্রমাণ হলো বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র।

আমরা একটু পরেই দেখতে পাবে, আধুনিক বিদ্বানের উপনিষদের যে-অংশগুলিতে সাংখ্যের বীজ আবিষ্কার করবার চেষ্টা করছেন, প্রকৃতপক্ষে সেগুলি সাংখ্য-দর্শনের খণ্ডন প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়; অতএব উপনিষদের দার্শনিক তত্ত্বের ব্যাখ্যায় বাদরায়ণ যে সাংখ্য-মত খণ্ডনের অতো আয়োজন করেছেন, তা আসলে উপনিষদের দর্শনের প্রতি তাঁর গভীর নিষ্ঠারই পরিচায়ক। এবং বাদরায়ণের প্রতি পরিপূর্ণ নিষ্ঠ বজায় রেখে শঙ্করাচার্য খুব জোর দিয়েই বলছেন যে, প্রকৃত বৈদিক ঐতিহ্যের মধ্যে সাংখ্য-দর্শনের কোনো স্থান নেই। এ-বিষয়ে শঙ্করাচার্যের উক্তিগুলি এখানে উল্লেখ করা অবান্তর হবে না।

শ্রুতিতে কপিলের নাম আছে। শঙ্করাচার্য(৭২৬) বলছেন, এই উল্লেখ থেকে বিশেষ কিছু প্রমাণ হয় না :

বিশেষত যে শ্রুতিটি কপিলমাহাত্ম্য বর্ণন করিতেছেন—কেবল সেই শ্রুতিটি দেখিয়াই কপিলমতের উপর শ্রদ্ধাস্থাপন করা উচিত হয় না। কারণ, কপিল শব্দটি ব্যক্তিবিশেষের বোধক নহে। (কপিল অনেক, তন্মধ্যে কোন কপিল সাংখ্য শাস্ত্র বলিয়াছেন এবং কোন কপিল বা শ্রুতি কর্তৃক প্রশংসিত হইয়াছেন, তাহারই বা স্থিরতা কি?) শ্রুতি কপিলের অপ্রতিহত জ্ঞান বর্ণনা করিয়াছেন সত্য, কিন্তু স্মৃতিশাস্ত্র সগরসন্তাননাশক বাসুদেব নামক অন্য কপিলেরও স্মরণ করিয়াছেন। সাংখ্যবক্তা কপিল ভেদজ্ঞানের উপদেশ করিয়াছেন, পরন্তু তাহা অবৈধ, অর্থাৎ বেদানুমোদিত নহে; সেজন্য তাহা অপ্রমাণ বা অগ্রাহ্য।

আবার(৭২৭),

কেবল প্রধান বলিয়াছেন বলিয়াই নহে, নানা জীব বলাতেও কপিলের স্মৃতি বেদবিরুদ্ধ এবং বেদানুযায়ী শাস্ত্র-বিরুদ্ধ।…বেদবিরুদ্ধ বিষয়ে স্মৃত্যনবকাশ প্রসঙ্গ (স্মৃতির আনৰ্থক্য) যে দোষ নহে, তৎপ্রতি অন্যহেতুও আছে।–
সাংখ্যস্মৃতিতে যে প্রধানের পর পরিণামাত্মক মহত্তত্ত্বের ও অহংতত্ত্বের উল্লেখ আছে, সেগুলি কিন্তু লোকে বা বেদে কুত্রাপি উপলব্ধি হয় না। ভূত ও ইন্দ্রিয়বর্গ লোক ও বেদ উভয়প্রসিদ্ধ; সুতরাংসেগুলির স্মরণ অযোগ্য নহে। কিন্তু প্রকৃতির পরিণাম মহৎ ও অহংকার—যাহা সাংখ্যাস্মৃতির কল্পিত, তাহা লোকে ও বেদে উভয়েই অপ্রসিদ্ধ। যেহেতু অপ্রসিদ্ধ সেই হেতুই তাহা স্বরণের অযোগ্য।

প্রশ্ন উঠতে পারে শঙ্করাচার্যের এই যে কথা—“কপিলস্য তন্ত্রস্য বেদবিরুদ্ধত্বং বেদানুসারিনমুবচনবিরুদ্ধত্বঞ্চ” ইত্যাদি, কিংবা “অ-লোক-বেদ-প্রসিদ্ধাত্বাত্তু মহদাদীনাং”, ইত্যাদি—এ কি তিনি সাংখ্য-দর্শনকে হেয় প্রতিপন্ন করবার উদ্দেশ্যে দেশের প্রকৃত ঐতিহকে অগ্রাহ্য করেই প্রচার করতে চাইছেন? তা বলা যায় না। কেননা, দেশের প্রকৃত ঐতিহ্য থেকে এ-বিষয়ে রিচার্ড গার্বে আরো প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। রিচার্ড গার্বের সিদ্ধান্তটি মূল্যবান, তাই আমরা সুদীর্ঘভাবে সে-সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করবো।

গার্বের নিম্নোক্ত মন্তব্যটি উদ্ধৃত করবার আগে বলে রাখা দরকার যে, তাঁর সিদ্ধান্ত অনুসারে সাংখ্য থেকেই বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি এবং সাংখ্য-প্রবর্তক কপিলের নাম থেকেই কপিলবাস্তুর নামকরণ হয়েছিলো। তাই তিনি বলছেন, পুরাণ, মহাভারতাদি গ্রন্থে কপিল সম্বন্ধে যে-সব নানাবিধ কাল্পনিক ও পরস্পর-বিরোধী তথ্য পাওয়া যায় সেগুলির মূল্য খুব বেশি নয়। অপরপক্ষে(৭২৮)–

কপিল সম্বন্ধে একমাত্র নির্ভরযোগ্য ঐতিহ্য হলো কপিলবাস্তু নামটি—যার অর্থ কপিলের বাসস্থান। ওই আদিবিদ্বানের সম্মানেই স্থানটির নামকরণ হয়েছিলো; কিন্তু তিনি সেখানে জন্মেছিলেন, না বাস করতেন সে-বিষয়ে কিছু জানা নেই। সাংখ্য-দর্শনের উৎপত্তি ঠিকমতো বোঝবার জন্য মনে রাখা দরকার যে, ভারতবর্ষের এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যপ্রভাব সবচেয়ে কম ছিলো বলেই এখানে বিশ্বের ও মানবসত্বার রহস্য শুধুমাত্র বুদ্ধি দিয়ে বোঝবার প্রথম প্রচেষ্টা সম্ভব হয়েছিলো। কেননা, সাংখ্য-দর্শনের যে-পুঁথিগুলি আমাদের সামনে রয়েছে তার মধ্যে শ্রুতির প্রতি যতোকিছু নির্ভরতা, তার সবটুকুই উত্তরকালে সাংখ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে; সাংখ্যের উপর এইভাবে গ্রথিত সমস্ত বৈদিক অঙ্গগুলিকে বাদ দিলেও সাংখ্য-দর্শনের কিছুমাত্র ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। মূল তত্ত্বের দিক থেকে সাংখ্য-দর্শন আদিতে বেদবাহ্য এবং ব্রাহ্মণ্য-ঐতিহ্য মুক্ত ছিলো এবং এখনো তাই হয়ে আছে। মহাভারতে (১৩, ১৩৭১২) সাংখ্য, যোগ, পঞ্চরাত্র এবং পাশুপত সম্প্রদায় থেকে স্বতন্ত্র হিসেবেই বেদের উল্লেখ দেখা যায়; এবং ১৩৭১১ শ্লোকে সর্ব-বেদের (অর্থাৎ, সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ) পাশে স্বতন্ত্র দুটি সনাতন সম্প্রদায় হিসেবেই সাংখ্য ও যোগের কথা বলা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহে যে-প্রভেদ এককালে নিশ্চয়ই বর্তমান ছিলো, এখানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। উত্তরকালে সাংখ্য-দর্শন যে আস্তিকদর্শনের অন্তর্গত হয়েছে তাতে বিস্ময়ের কারণ নেই; তার থেকে প্রমাণ হয়, সংযত সারল্যের গুণে সাংখ্য-দর্শন বেদান্তের অলৌকিকত্বের সামনে মাথা নোয়াননি; এবং ব্রাহ্মণেরাও, মূল্যবান তত্ত্বকথা গ্রহণ করতে পারবার ক্ষমতার দরুন, এই সাংখ্য-দর্শনকেও গ্রহণ করেছিলো। ……মৌখিকভাবে বেদকে স্বীকার করা এবং ব্রাহ্মণদের উৎসাহ—এই দুটি কারণই সাংখ্য-দর্শনের পক্ষে আস্তিক্যপদ লাভ করার পক্ষে পর্যাপ্ত ছিলো। (স্বাধীন তর্জমা)

আমরা একটু পরেই দেখতে পাবো, রিচার্ড গার্বের এই মহামূল্যবান মন্তব্যের মধ্যে দুর্বলতম অংশ বলতে শেষের কথাগুলিই। কেননা, সাংখ্য-দর্শনের পক্ষে আস্তিক্যপদ লাভের যে সহজ-সরল ব্যাখ্যা তিনি এখানে দিয়েছেন তা স্বীকারযোগ্য হতে পারে না। বস্তুত, নিজস্ব মৌলিক তত্ত্বগুলি বিসর্জন দেবার পরই সাংখ্য-দর্শন আস্তিক বলে স্বীকৃত হয়েছে : অর্থাৎ আদি-সাংখ্য এবং আস্তিক-সাংখ্য মোটেই এক নয়। সাংখ্য-দর্শনের ইতিহাসে এই গুণগত পরিবর্তনটির কথা রিচার্ড গার্বে একেবারেই স্বীকার করেন না।

আপাতত, আমাদের মন্তব্য হলো, গার্বের উদ্ধত মন্তব্যে সাংখ্য-দর্শনের আদি-অবৈদিকত্ব সংক্রান্ত যে-যুক্তি ও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা অগ্রাহ্য করবার কোনো কারণ নেই। এবং যদিও গার্বে নিজে বাদরায়ণের এবং অন্যান্য বৈদান্তিক আচার্যের মন্তব্যকে একেবারে গুরুত্ব দেননি, তবুও তাঁর সিদ্ধান্ত এঁদের বক্তব্যের বিরুদ্ধে যায়নি। কিন্তু বাদরায়ণের সাক্ষ্যকে গুরুত্ব না দেবার ফলে গার্বের নিজের সিদ্ধান্তের মধ্যেই স্ব-বিরোধিতা থেকে গিয়েছে; তার আলোচনায় পরে প্রত্যাবর্তন করা যাবে।

সাংখ্যের উৎপত্তি-প্রসঙ্গে আমরা যে-সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি তার পক্ষে প্রধানতম প্রয়োজন হলো আধুনিক বিদ্বানদের ওই মতবাদটি খণ্ডন করা, যে-মতবাদ অনুসারে উপনিষদের মধ্যেই সাংখ্য-দর্শনের বীজ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। অতএব আমরা সুবিস্তৃতভাবে সে-মতবাদের আলোচনা করলাম। সুখের বিষয়, বৃদ্ধসম্মতি হিসেবে রিচার্ড গার্বের নাম ছাড়াও এখানে আমরা আরো কয়েকজন আধুনিক বিদ্বানের নাম উপস্থিত করতে পারি যাঁদের সিদ্ধান্তের গুরুত্বকে অগ্রাহ্য করতে ভারতীয় দর্শনের ছাত্ৰ-মাত্রই দ্বিধা করবেন : মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং হেইনরিখ জিমার। মহামহোপাধ্যায়ের উক্তি আমরা ইতিপূর্বেই (পৃঃ ৫০৮) কিছুটা উদ্ধৃত করেছি; তাই এখানে জিমার-এর সিদ্ধান্ত আলোচনা করা যাক। সাংখ্য-মত প্রসঙ্গে জিমার(৭২৯) বলছেন :

সাংখ্যের তত্ত্বগুলি বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের অন্তর্গত নয়।…দুটি ধ্যানধারণার উৎস স্বতন্ত্র : সাংখ্য ও যোগ জৈনদের যান্ত্রিক দর্শনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত এবং এই জৈন চিন্তাধারাকে সুদীর্ঘ তীর্থঙ্কর পরম্পরার দিক থেকে আধা-ঐতিহাসিক এবং আধা-পৌরাণিকভাবে, প্রাচীন ভারতের এক সুদূর বন্য অ-বৈদিক যুগ পর্যন্ত পিছনে দেখতে পাওয়া যায়। অতএব, সাংখ্য আর যোগের মূল ধারণাগুলি অসম্ভব পুরোনো। তবুও, আস্তিক রচনায় এগুলির আবির্ভাব অনেক পরের ঘটনা—উপনিষদের অপেক্ষাকৃত নবীন অংশে এবং গীতায়-ই প্রথম এই ধারণাগুলির আবির্ভাব ঘটেছে এবং তাও বৈদিক দর্শনের মূল ধ্যানধারণার সঙ্গে ইতিমধ্যেই মিশ্রিত হয়ে। তীব্র প্রতিরোধের দীর্ঘ ইতিহাস উত্তীর্ণ হয়ে আর্যদের ব্রাহ্মণ মনের রুদ্ধ দরজা শেষ পর্যন্ত খুলে গেলো, এবং স্থানীয় সভ্যতা থেকে ইংগিত ও প্রভাব গ্রহণ করতে শুরু করলো। তারই ফলে দুটিঐতিহ্যের মিলন হলো। (স্বাধীন তর্জমা)

তাহলে জিমার এবং গার্বে উভয়েই সিদ্ধান্ত করছেন, সাংখ্য-যোগের মূল কথাগুলি আদিতে ভারতীয় আদিবাসীদের চিন্তাধারার,—অতএব অ-বৈদিক ঐতিহ্যের,—অন্তর্গত ছিলো এবং কালক্রমে তা বৈদিক ঐতিহ্য-দ্বারা গৃহীত হয়েছিলো। এ-সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই মূল্যবান, যদিও এ-সিদ্ধান্তের প্রকৃত তাৎপর্য দু’জন বিদ্বানের মধ্যে কেউই নির্ণয় করবার চেষ্টা করেনি। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দুটি স্বতন্ত্র ধারা প্রবাহিত হয়েছে। সেই দুটি ধারাকে আমরা আর্য ও অনার্য বা আর্য ও দ্রাবিড় বা বৈদিক ও অবৈদিক—যে-কোনো নামেই উল্লেখ করি না কেন, দুটি ধারার মধ্যে পার্থক্যটা জাতিগত নয়, তথাকথিত আর্যদের কোনো রকম সনাতন মনস্তত্ত্বজনিতও নয়। এই প্রভেদের মূলে ছিলো উৎপাদন পদ্ধতির মৌলিক প্রভেদ; পশুপালন-প্রধান অর্থনীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বৈদিক ধ্যানধারণা স্বভাবতই পুরুষ-প্রধান, কৃষিমূলক অর্থনীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত অ-বৈদিক ধ্যানধারণা স্বভাবতই মাতৃপ্রধান বা নারীপ্রধান। এই নারীপ্রধান ধ্যানধারণারই প্রকটতম উদাহরণ হলো তন্ত্র : তন্ত্রমতে প্রকৃতিই প্রধান, জগৎ বামোস্তৃত, অকৃত্রিম তন্ত্রের সাধনপদ্ধতিও বামাচার বা স্ত্রীআচার। আধুনিক বিদ্বানেরা যদি অনুমান করতে বাধ্য হন যে, আদিতে সাংখ্যমতও ওই অ-বৈদিক ঐতিহ্যেরই অন্তর্গত ছিলো, তাহলে স্বীকার করা প্রয়োজন যে, যে-ধ্যানধারণাগুলিকে আমরা ব্যাপক অর্থে তান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে থাকি, আদিতে সাংখ্য বলতে তারই অপেক্ষাকৃত দার্শনিক সংস্করণ বুঝিয়েছে। প্রাচীন-রচনায় আমরা এ-ইংগিত পেয়েছি যে, লোকায়তিক ধ্যানধারণা এবং ওই তান্ত্রিক ধ্যানধারণা অভিন্ন ছিলো এবং এই দুয়ের মধ্যে তত্ত্বগত সাদৃশ্যও ঠিক কোথায় তা আমরা তন্ত্রের দেহতত্ত্ব বিশ্লেষণ করে বোঝবার চেষ্টা করেছি : মানবদেহের অনুরূপ হিসেবে তন্ত্রে বিশ্বরহস্যকে বোঝবার চেষ্টা করা হয়েছে বলেই তার আদি-অকৃত্রিম রূপটির মধ্যে অধ্যাত্মবাদের বা ভাববাদের কোনো স্থান হয়নি। তাই, উত্তরযুগে ওই তান্ত্রিক ধ্যানধারণাগুলির উপর অধ্যাত্মবাদের আর ভাববাদের প্রলেপ যতোই মাখানো হোক না কেন, আদিতে এই ধ্যানধারণ লোকায়তিক বা বস্তুবাদীই ছিলো—সে-বস্তুবাদ আদিম বলেই অফুট, তুর্বল এবং অচেতন। বস্তুবাদের আদিম রূপটির—তথা, ওই প্রাক্‌-অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার—আলোচনা পরে তোলা যাবে। আপাতত আমাদের মন্তব্য হলো, সাংখ্যের আদিরূপটিকেও যদি একই বেদবাহ ঐতিহ্যের অন্তর্গত বলে স্বীকার করতে হয়, তাহলে তার উৎসকেও একইভাবে বোঝবার চেষ্টা করা প্রয়োজন। এই কারণে আমরা শুরুতেই সাংখ্যের সঙ্গে তন্ত্রের এ-সাদৃশ্যের প্রতি মনোযোগ দেবার চেষ্টা করেছি এবং আমরা দেখেছি, সাদৃশ্যের পরিচয় শুধুমাত্র কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক ইংগিতের মধ্যেই আবদ্ধ নয়—মূল দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকেও উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট! অবশ্যই সাংখ্য-দর্শনও যে আদিতে প্রাক-অধ্যাত্মবাদী ও লোকায়তিক বা বস্তুবাদী চেতনারই অঙ্গ ছিলো সে-বিষয়ে দীর্ঘতর আলোচনা এখনো বাকি আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে যাঁরা সাংখ্যকে অ-বৈদিক ঐতিহ্যের পরিচায়ক বলে ঘোষণা করলেন তাঁরাও তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তের প্রকৃত বৈজ্ঞানিক তাৎপর্যের দিকে অগ্রসর হতে পারেননি। অতএব, আমাদের পক্ষে তাদের যুক্তির প্রধান দুর্বলতাকে বিশ্লেষণ করেই অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয় হবে।
গার্বে এবং জিমার উভয়েই বলছেন, সাংখ্য-মত আদিতে অ-বৈদিক হলেও কালক্রমে তা বৈদিক ঐতিহ্যের মধ্যে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়েছিলো।

সাংখ্য-দর্শনের বৈদিক-ঐতিহা-স্বীকৃত সংস্করণটির পরিচয় হিসেবে গার্বে ভগবদগীতা ও উপনিষদের সেই অংশগুলিরই উল্লেখ করছেন যেগুলির নজির দেখিয়ে ওল্ডেনবার্গ-প্রমুখ বিদ্বানেরা উপনিষদের মধ্যেই সাংখ্য-দর্শনের বীজ আবিষ্কার করবার কল্পনা করেছিলেন। অতএব, এখানে অন্তত একটি বিষয়ে গার্বে ওবং ওল্ডেনবার্গ-এর মতের মিল দেখা যায়। বিষয়টি হলো, গীতা ও উপনিষদের আলোচ্য অংশগুলির মধ্যে প্রকৃত সাংখ্যমতেরই উল্লেখ আছে। আমাদের মন্তব্য হলো, সাংখ্য-বিচারে ব্রহ্মসূত্রের সাক্ষ্যকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছেন বলেই আধুনিক বিদ্বানের উপনিষদে সাংখ্য-দর্শনের খণ্ডনপ্রচেষ্টাকেই সাংখ্য-পরিচয় বলে কল্পনা করবার মতো ভ্রান্তিকে এতোখানি প্রশ্রয় দিতে পেরেছেন।

প্রথমত, বাদরায়ণ অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, বৈদিক সাহিত্যে সাংখ্য-দর্শনের অব্যক্তাদি পারিভাষিক শব্দ দেখলেই, সাংখ্য-চিন্তাধারা অনুমান করবার সুযোগ নেই :

আনুমানিকমপ্যেকেষামিতি চেন্ন, শরীররূপকবিন্যস্ত-গৃহীতের্দ্দর্শয়তি চ ॥১।৪।১

বৈদান্তিক আচার্যরা এই সূত্রটির ভাষ্য-রচনা করবার সময় স্বভাবতই আর বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন, শ্রুতিতে মহৎ, অব্যক্ত প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার দেখলেই সাংখ্য চিন্তাধারা কল্পনা করা যায় না। শঙ্কর(৭৩০) যেমন বলছেন;

সাংখ্য যে স্বতন্ত্র ত্রিগুণ অব্যক্ত প্রতিপাদন করে, সেই অব্যক্তই যে কঠশ্রুতিতে পঠিত হইয়াছে, এরূপ প্রত্যভিজ্ঞ জন্মে না। কঠশ্রুতিতে কেবল সাংখ্যের অব্যক্ত শব্দটি পঠিত হইয়াছে বলিয়া প্রত্যভিজ্ঞ জন্মে সত্য; কিন্তু তাহার অর্থের প্রত্যভিজ্ঞ জন্মে না। অর্থাৎ, যে অব্যক্তশব্দ সাংখ্য স্মৃতিতে ত্রিগুণ অচেতন পদার্থবিশেষের বোধক, কঠশ্রুতির অব্যক্তও যে সেই অব্যক্তই, এরূপ প্রত্যভিজ্ঞা-জ্ঞান জন্মে না। যাহা ব্যক্ত নয় তাহাই অব্যক্ত, এ-অর্থ বা এরূপ যোগার্থ লইয়া দুর্লক্ষ্য সূক্ষ্মতত্ত্বেও অব্যক্ত শব্দের প্রয়োগ হইতে পারে। অব্যক্ত-নামে কোনো রূঢ় (সর্ববিদিত) পদার্থ নাই। যাহা কেবলমাত্র সাংখ্যের রূচি, সাংখ্যের পরিভাষা, তাহা লইয়া বেদার্থ নিরূপণ হয় না।

বাদরায়ণের কাছে উপনিষদের তত্ত্ব এবং সাংখ্যের স্বরূপ—উভয় বিষয়ই সম্যকভাবে বোঝবার পক্ষে এই বিষয়টির গুরুত্ব অত্যন্ত মৌলিক। তাই তিনি একাধিকবার এ-কথা উত্থাপন করেছেন। পাছে সাংখ্যবিদ পণ্ডিতেরা উপনিষদের নজির দেখিয়েই ত্রিগুণাত্মক অচেতন প্রধানকে বা প্রকৃতিকেই, জগৎকারণ বলে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেন, এই আশঙ্কা নিরসনের জন্য তিনি বলছেন :

ঈক্ষতের্নাশব্দম্॥ ১।১।৫॥

ভাষ্যে শঙ্করাচার্য বলছেন :

সাংখ্যকল্পিত জড়রূপ প্রকৃতি বেদান্তশাস্ত্রে জগৎকারণরূপে স্থান পাইতে পারে না, অর্থাৎ বেদান্তশাস্ত্রে অচেতন প্রকৃতির জগৎকর্তৃত্ব প্রতিপন্ন হয় না। অথবা, সৃষ্টিবিষয়ক বেদান্তবাক্যের “অচেতন প্রধান জগৎকারণ” এরূপ অর্থও হয় না, অর্থাৎ প্রকৃতি বা প্রধান তদ্‌বাক্যস্থ পদের বাচ্য বা বোধ্য নহে। কেননা, যে জগৎকারণ, সে ঈক্ষিতা, এইরূপ শুনা যায়। যেহেতু ঈক্ষিতৃত্ব শুনা যায় সেইহেতু প্রধান অশব্দ,—অর্থাৎ শৌত শব্দের অপ্রতিপাদ্য।—ইত্যাদি, ইত্যাদি।

শুধু তাই নয়। সাংখ্য যে আদিতে বেদ-বিরুদ্ধ ছিলো তার প্রমাণ হিসেবে বাদরায়ণ প্রমুখ সাংখ্য-বিরোধী দার্শনিকদের উক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের কাছে একমাত্র প্রমাণ নয়। সাংখ্য-কারিকা প্রভৃতি গ্রন্থেও আদিসাংখ্যের এই স্পষ্ট বেদ-বিরোধিতার চিহ্ন থেকে গিয়েছে। এ-বিষয়ে শ্ৰীযুক্ত পুলিনবিহারী চক্রবর্তী(৭৩১) আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন :

খুব সম্ভব এমন এক যুগে কপিল-দর্শন প্রণীত হয় যখন বৈদিক যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়ার প্রবল প্রভাব ছিলো এবং সাধারণের বিশ্বাস ছিলো যে বিহিত-পদ্ধতিতে যজ্ঞ করলে যজমানের স্বৰ্গলাভ হবে। বৈদিক পুরোহিতের কাছে স্বৰ্গই ছিলো পরমপুরুষাৰ্থ। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সাংখ্য প্রবল প্রতিবাদ ঘোষণা করে এবং প্রমাণ করতে চায়, স্বর্গের কথা অমূলক এবং বৈদিক যাগযজ্ঞ অনর্থক। ‘দৃষ্টবদানুশ্রবিক:’ ইত্যাদি সাংখ্য-কারিকার দ্বিতীয় শ্লোকে তার প্রমাণ আছে। অবশ্যই কারিকা খুব প্রাচীন গ্রন্থ নয়; কিন্তু তবুও তা প্রাচীন ঐতিহ্যের বাহক। (স্বাধীন তর্জমা)।

তাহলে শুধু যে বৈদান্তিকেরাই বলছেন সাংখ্য বেদবাহ্য ও বেদ-বিরুদ্ধ তাই নয়, সাংখ্যের নিজস্ব সাহিত্য থেকেও আদি-সাংখ্যের বেদবিরোধিতার(৭৩২) পরিচয় মুছে যায়নি। এদিক থেকেও বেদান্তের মধ্যেই আদি-সাংখ্য আবিষ্কার অত্যন্ত অস্বাভাবিক প্রচেষ্টা হতে বাধ্য।

আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে যাঁরা উপনিষদের ভিতরেই সাংখ্য-চিন্তার পরিচয় পেয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই বাদরায়ণ এবং তার অনুগামী বৈদান্তিক আচার্যদের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে বলবেন, এইভাবে সাংখ্যের প্রধানকে ‘অশব্দ’ অর্থাৎ বৈদিক ঐতিহ্য বিরুদ্ধ বা বৈদিক ঐতিহ্য বহির্গত বলে প্রমাণ করবার চেষ্টাটা নেহাতই আত্মপক্ষ সমর্থনে গায়ের-জোরের কথা। কেননা, উপনিষদের অংশ-বিশেষে এবং গীতায় সাংখ্যের তত্ত্ব রয়েছে এবং অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই রয়েছে। অর্থাৎ, চলতি কথায় আমরা যাকে বলি ফ্যাক্ট—চোখের-সামনে থাকা বাস্তব সত্য—তা অস্বীকার না করে বাদরায়ণ বা বৈদান্তিক আচার্যদের কথা স্বীকার করা যায় না।

অতএব আমাদের পক্ষে এখানে ভালো করে দেখা দরকার, উপনিষদাদি গ্রন্থে সত্যিই কী আছে। প্রধানাদি সাংখ্য-দর্শনের পারিভাষিক শব্দ যে আছে সে-কথা বাদরায়ণও অবশ্যই অস্বীকার করবেন না। কিন্তু সাংখ্য-দর্শনের পারিভাষিক শব্দ থাকা মানেই সাংখ্যের দার্শনিক তত্ত্ব থাকা নয়। বস্তুত, উপনিষদাদির যে-অংশে আধুনিক বিদ্বানের সাংখ্যের নিদর্শন পাচ্ছেন বলে কল্পনা করেন সেগুলিকে বিচার করলে আমরা দেখতে পাই যে, আসলে সেখানে সাংখ্যের খণ্ডনই বর্তমান। এইটেই হলো আসল ফ্যাক্ট এবং এ-ফ্যাক্ট অগ্রাহ্য না করলে সবিনয়ে স্বীকার করতেই হবে যে, আধুনিক বিদ্বানদের তুলনায় বাদরায়ণ উপনিষদের প্রকৃত ঐতিহ্যের অনেক কাছে ছিলেন বলেই, উপনিষদরচকদের পদামুসরণ করে ব্রহ্মসূত্রের মধ্যে প্রধানকারণবাদ খগুনের প্রচেষ্টাকেই অতোখানি প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

উপনিষদাদির আলোচ্য অংশে ঠিক কী আছে? সাংখ্য-তত্ত্ব, না, সাংখ্যখণ্ডন? এ-প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সাংখ্যের আদি-অকৃত্রিম তত্ত্ব বলতে ঠিক কী বোঝায়, সে-বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। কোথা থেকে সে-ধারণা পাওয়া যাবে? আমাদের যুক্তি অনুসারে, ওই বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র থেকেই। তার কারণ, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে সাংখ্য-দর্শনের এর চেয়ে পুরোনো আর কোনো উল্লেখ আমরা পাই না। অর্থাৎ কিনা, সাংখ্য-মত হিসেবে বাদরায়ণ তাঁর ব্রহ্মসূত্রে ঠিক যে মতবাদটিকে খণ্ডন করছেন তাকেই সাংখ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন বলে স্বীকার করা প্রয়োজন। তা না হলে কল্পনা করতে হয়, বাদরায়ণ সাংখ্য নাম দিয়ে কোনো এক কল্পিত দার্শনিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিলেন। সে রকম একটা কল্পনা যে নেহাতই অসম্ভব, আশাকরি সকলেই তা মানবেন। সাংখ্য নিশ্চয়ই ব্রহ্মসূত্রের চেয়েও পুরোনো, ব্রহ্মসূত্র রচনাকালে সাংখ্য নিশ্চয়ই ভারতীয় চিন্তার ক্ষেত্রে প্রচুর প্রভাব বিস্তার করেছিলো; তা না হলে সাংখ্য-খণ্ডনে বাদরায়ণের অতোখানি উৎসাহের আর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কিন্তু সাংখ্যের দার্শনিক তত্ত্ব বলতে ঠিক কী বোঝাতে এ-বিষয়ে বাদরায়ণের রচনায় পূর্বপক্ষ হিসেবে বর্ণিত সাংখ্যের ওই পরিচয়টির চেয়ে পুরোনো আর কোনো পরিচয় আমাদের জানা নেই। তাই এই পরিচয়টির উপর নির্ভর না করে সাংখ্যের আদিরূপ সংক্রান্ত অন্য যে-কোনো মতবাদ দাড় করবার চেষ্টা করলে তা মনগড়া হবারই সম্ভাবনা। এই কথাটি স্বীকার করলে মানতে হবে, অন্যত্র আমরা সাংখ্যের যে-পরিচয় পাই—এমনকি সাংখ্য-কারিকা ও সাংখ্য-প্রবচন-সূত্র নামে উত্তরকালে রচিত সাংখ্যের ওই ছুটি পুঁথিতে সাংখ্য-দর্শনের যে-পরিচয় পাওয়া যায়—তার সঙ্গে আদি-অকৃত্রিম সাংখ্যের কতোখানি মিল আছে, এ-প্রশ্নের উত্তর পেতে হলেও আমাদের পক্ষে বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রে প্রত্যাবর্তন করে সেখানে সাংখ্যের যে-পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে তার সঙ্গে এগুলিকে মিলিয়ে দেখা দরকার। এবং উপনিষদাদির অংশ-বিশেষে সাংখ্য-দর্শনের পারিভাষিক শব্দের পরিচয় পেলেও আমাদের পক্ষে এই পদ্ধতি অনুসারেই বিচার করা প্রয়োজন যে, সেখানে সাংখ্য-তত্ত্ব না সাংখ্য-খণ্ডন—ঠিক কিসের নমুনা রয়েছে। কেননা, উপনিষদ যদিও অবশ্যই ব্রহ্মসূত্রের চেয়ে পুরোনো, তবুও উপনিষদে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়নি কোনটি সাংখ্য-মত এবং কোনটি সাংখ্য-মত নয়, ব্রহ্মসূত্রেই সর্ব প্রথম স্পষ্টভাবে সে-কথা বলে দেওয়া হয়েছে। এইভাবে, ব্রহ্মসূত্রে যেকথা স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে তারই আলোয়, উপনিষদে যে-কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি তা বোঝবার চেষ্টা করা ছাড়া আর উপায় কি?

বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রে সাংখ্য-মত হিসেবে নির্দিষ্ট কোন দার্শনিক তত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায়? প্রাচীনদের পরিভাষায় তার নাম হলো, অচেতনকারণ-বাদ বা প্রধান-কারণ-বাদ। অর্থাৎ, অচেতন বা জড় প্রকৃতিই জগৎকারণ। ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যায় শঙ্করাচার্য(৭৩৩) যেমন বলেছেন, “সাংখ্যের সিদ্ধান্ত এই যে, যেমন ঘটাদি মৃন্ময় পদার্থে মৃত্তিকারূপের অন্বয় থাকায় মৃত্তিকাজাতি সে-সকলের কারণ, তেমনি, যে-কিছু বাহ্য ও আন্তরিকভাবে (পদার্থ) আছে, সে সমস্তই সুখদুঃখমোহ রূপে অম্বিত থাকায় সুখদুঃখমোহাত্মক কোনো এক সামান্য পদার্থ সে-সকলের কারণ। সুখদুঃখমোহাত্মক সেই সামান্য পদার্থটি ত্রিগুণ ও মৃত্তিকাদির ন্যায় অচেতন”। সাংখ্য-দর্শনকে এই অর্থে বুঝেছিলেন বলেই স্বয়ং বাদরায়ণ সাংখ্য-খণ্ডনের একটি চূড়ান্ত যুক্তি হিসেবে বলছেন,

রচনানুপপত্তেশ্চ নানুমান্‌ম্‌ ॥২।২।১৷৷
প্রবৃত্তেশ্চ ॥২।২।২৷৷
ইত্যাদি, ইত্যাদি।

অর্থাৎ, অচেতন প্রধানের পক্ষে জগৎকারণ হওয়া সম্ভবই নয়, কেননা জগতে রচনা বা উদ্দেশ্য-সাধনের (purposiveness) পরিচয় আছে এবং তা অচেতন-জনিত হতে পারে না। এবং “রচনা দূরে থাকুক, রচনাসিদ্ধির জন্য যে প্রবৃত্তি—অমুকুল প্রচেষ্টা,—তাহাও অচেতন প্রধানের পক্ষে স্বাধীনভাবে হওয়ার সম্ভাবনা নেই।…হেতু এই যে, মৃত্তিকার ও রথাদি অচেতনের তাদৃশী বিশিষ্ট প্রবৃত্তি দেখা যায় না। মৃত্তিকাই হউক আর রথাদিই হউক, কুম্ভকারের ও রথবাহকের অধিষ্ঠান ব্যতীত আপনা হইতে কেহ কখনও মৃত্তিকাকে ও রথকে বিশিষ্ট কার্যাভিমুখ হইতে দেখে নাই।…যেহেতু, অনুমান সমর্থক দৃষ্টান্ত নাই, সেইহেতু অচেতনের প্রবৃত্তি অননুমেয়।…যেহেতু অচেতনের বিশিষ্ট কার্য প্রবৃত্তির অনুমান তুর্ঘট, সেইহেতুই অচেতন জগৎকারণের অনুমানও দুর্ঘট।”(৭৩৪)

জগৎকারণ হিসেবে অচেতন বস্তুকে স্বীকার করা একান্তই সম্ভবপর কিনা—এ-প্রশ্ন অবশ্যই স্বতন্ত্র। আধুনিক বস্তুবাদীরা নিশ্চয়ই বলবেন, তা সম্ভবপর এবং বাদরায়ণের উপরোক্ত যুক্তি সত্ত্বেও। আমাদের পক্ষে বর্তমানে এই সমস্যার আলোচনায় প্রবেশ করবার প্রয়োজন নেই। কেননা, এখানে আমাদের মূল সমস্ত হলো সাংখ্যের আদিরূপটিকে সনাক্ত করা। এবং সাংখ্যের বিরুদ্ধে প্রাচীনদের এ-জাতীয় যুক্তি থেকে আমরা অন্তত এটুকু অনুমান করতে পারি যে, আদিতে সাংখ্য শুধুমাত্র নিরীশ্বরবাদই ছিলো না, বস্তুবাদ বা জড়বাদও ছিলো। আধুনিক পরিভাষায় শুধুমাত্র atheism নয়, materialism-ও। তাই উত্তরকালে সাংখ্য-প্রসঙ্গে আমরা যে-সব অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী চিন্তার পরিচয় পাই, আদি-সাংখ্যের দিক থেকে সেগুলিকে অর্বাচীন ও প্রক্ষিপ্ত ধ্যানধারণার নমুনা বলেই অভিহিত করা প্রয়োজন।

এইখানে আমাদের মন্তব্যটি আরো স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। আমরা নিরীশ্বরবাদ ও বস্তুবাদের কথা একই সঙ্গে উল্লেখ করলাম, কেননা এ-দুয়ের মধ্যে একটা তত্ত্বগত যোগাযোগ আছে, যেমন তত্ত্বগত যোগাযোগ আছে অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদের মধ্যে। সাংখ্য যে আদিতে নিরীশ্বরবাদই ছিলো এবং পরে তার উপর জোর করে ঈশ্বরতত্ত্ব চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছিলো, এ-বিষয়ে আধুনিক বিদ্বানেরা বড়ো বেশি দ্বিমত হবেন না। এমন কি, আমাদের সনাতনপন্থী বিদ্বানেরাও তা স্পষ্টভাবেই স্বীকার করছেন। কিন্তু সাংখ্যে যে আদিতে সুস্পষ্ট জড়বাদও ছিলো এবং উত্তরযুগে সাংখ্যকারিকা ও সাংখ্য-সূত্রের মতো গ্রন্থেও ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী চিন্তাধারার যে-পরিচয় পাওয়া যায় তাও যে বিজাতীয় ও প্রক্ষিপ্ত ধ্যানধারণারই নমুনা মাত্র—এ-বিষয়ে আধুনিক বিদ্বানের সম্যকভাবে সচেতন নন। এর কারণ কী এবং কী ভাবে এই কারণেই তারা উপনিষদের মধ্যেও সাংখ্য-দর্শনের বীজ আবিষ্কার করবার চেষ্টা করেছেন, তার আলোচনা তোলা প্রয়োজন।

প্রথমত, সাংখ্যে ঈশ্বরের স্থান আছে কী? পণ্ডিত কালিবর বেদান্তবাগীশ(৭৩৫) লিখছেন :

…মহাভারত, ভাগবত ও পুরাণ, এই সকল গ্রন্থে কপিল সম্বন্ধে যেরূপ ইতিহাস প্রকটত আছে তাহা দেখিলে কপিল ঈশ্বরনাস্তিক ছিলেন বলা দূরে থাকুক, তিনি সম্পূর্ণ আস্তিক, ঈশ্বরের প্রধান ভক্ত বা অবতার না বলিয়া থাকা যায় না। কিন্তু তাহার গ্রন্থ দেখিলে অনুভব হয়, তিনি একজন ঈশ্বরনাস্তিকের অগ্রগণ্য।…প্রথম অধ্যায়ের ৯২ সূত্র “ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ”।
…ভাষ্যকার বিজ্ঞানভিক্ষু আভাস দিয়াছেন যে, এ-স্থলে ঈশ্বরাপলাপ করা কপিলের উদ্দেশ্য নহে; বাদীর মুখস্তম্ভ করাই তাহার উদ্দেশ্য। ঈশ্বর নাই বলিবার অভিপ্রায় থাকিলে “ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ” এরূপ না বলিয়া “ঈশ্বরাভাবাৎ” এইরূপ বিস্পষ্ট উক্তি করিতেন। ভাষ্যকার যাহাই বলুন, আমরা বুঝি “ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ”, “ঈশ্বরাভাবাৎ” ফলকল্পে তুল্য।

বেদান্তবাগীশ মহাশয় এখানে কপিলের গ্রন্থ বলতে সাংখ্য-সূত্রেরই উল্লেখ করছেন। এবং এই গ্রন্থে যে যে স্থানে “যে যে ভাবের ঈশ্বর সম্বন্ধীয় কথা আছে তাহা একত্রিত করিয়া” বিচার করবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মুস্কিল এই যে, তার উপরোক্ত মন্তব্যের সঙ্গে সাংখ্য-সূত্রের ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় অন্যান্য উক্তিগুলির সহজ সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না। এবং এই কারণেই বেদান্তবাগীশ মহাশয়কে শেষ পর্যন্ত উপরোক্ত উক্তিকে শুধরে বলতে হয়েছে যে, সাংখ্যের প্রকৃত কথাটা হলো, “নিত্য-ঈশ্বর নাই, কিন্তু জন্য-ঈশ্বর আছেন।”

এদিক থেকে অধ্যাপক গার্বের(৭৩৬) মন্তব্য আরো সংস্কারমুক্ত। তিনি দেখাচ্ছেন, প্রথমত সাংখ্য-সূত্র নামের গ্রন্থটিকে কপিলের রচনা বলে কল্পনা করবার কোনো কারণ নেই; এ-গ্রন্থের রচনাকাল চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী। বিজ্ঞানভিক্ষুর ভাষ্য আরো শ’ দেড়েক বছর পরের রচনা। এবং ওই সাংখ্য-সূত্রের মধ্যেও সাংখ্য-দর্শনের আদি অকৃত্রিম রূপটিকে দেখতে পাওয়া যায় না। কেননা, এই গ্রন্থের একটি মূল চেষ্টা হলো, সাংখ্য এবং উপনিষদের চিন্তাধারার মধ্যে মৌলিক প্রভেদকে অস্বীকার করা। গার্বে বলছেন, সাংখ্য-তত্ত্বের সঙ্গে ঈশ্বর এবং উপনিষদের ব্রহ্মের তত্ত্বের কোনো গরমিল নেই, কিংবা সাংখ্যের দিক থেকে স্বৰ্গলাভমুলক পুরুষার্থের কথায় অসঙ্গতি নেই—এর চেয়ে অসম্ভব অনুমান আর কিছুই হতে পারে না; অথচ, সাংখ্য-সূত্রকার সেই কথাটি প্রচার করবার জন্যেই বিস্তর অধ্যবসায়ের পরিচয় দিয়েছেন। বস্তুত, ওই সাংখ্য-সূত্রের মধ্যে বৈদান্তিক প্রভাব যে কতো প্রকট তার পক্ষে চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে গার্বে নিম্নোক্ত সূত্রটির উল্লেখ করেছেন :

আবৃত্তিরসকৃদুপদেশাৎ॥ সাংখ্যসূত্র : ৪,৩ ॥

অর্থাৎ, “যদি সকৃৎ শ্রবণে বিবেকজ্ঞান না হয় তবে তাহা বার বার শ্রবণ করিবে। (শ্বেতকেতু সাত বার শ্রবণের পর বিবেকজ্ঞান পাইয়াছিলেন)”। সাংখ্য-সূত্রের এই সূত্রটি যে একেবারে হুবহু ব্ৰহ্মসূত্রের (৪৷১।১) পুনরুক্তিমাত্র, সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। কিংবা, সাংখ্যসূত্রের পঞ্চম অধ্যায়ের ১১৬ সূত্র হলো :

সমাধিসুষুপ্তিমোক্ষেয়ু ব্ৰহ্মরূপতা॥

এ-তত্ত্ব যে খাঁটি বৈদান্তিক তত্ত্ব এবং এমন কি ‘ব্রহ্মরূপতা’ বলে পরিভাষাটিও যে অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই বেদান্ত-দর্শন থেকে গৃহীত হয়েছে, সেবিষয়েই বা সন্দেহের অবকাশ কোথায়? বলাই বাহুল্য, এ-জাতীয় কথা যদি সত্যিই সাংখ্য-দর্শনেরই প্রতিপাদ্য হতো তাহলে বাদরায়ণের পক্ষে বেদান্তদর্শনের প্রধানতম প্রতিপক্ষ হিসেবে সাংখ্যকেই খণ্ডন করবার অমন তাগিদ থাকতো না।

তাহলে এই সাংখ্য-সূত্র বলে পুঁথিটি নামে সাংখ্য হলেও বিজাতীয়,— অর্থাৎ বৈদান্তিক,—চিন্তাধারায় ভরপুর। এবং সাংখ্য সূত্রেরই যদি এই দশা হয়, তাহলে বিজ্ঞানভিক্ষুর ভাষ্য যে এ-বিষয়ে আরো অনেক চূড়ান্ত আপোসের পরিচয় দেবে সে-বিষয়ে আর বিস্ময়ের অবকাশ কোথায়? স্বভাবতই আদিসাংখ্যের নিরীশ্বরতাকে উড়িয়ে দেবার আশায় তাকে নানা রকম অত্যদ্ভুত যুক্তির অবতারণা করতে হয়েছে; অধ্যাপক গার্বে এই বিস্ময়কর যুক্তিগুলির তালিকা করে দিয়েছেন।

সাংখ্য যে আদিতে এই রকম নিরীশ্বরবাদই ছিলো,—অতএব আজকাল সাংখ্য-দর্শনের মধ্যে আমরা যে-সব আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গের পরিচয় পাই, সেগুলি যে উত্তরকালে সাংখ্যের উপর প্রক্ষিপ্ত ধ্যানধারণা মাত্র—এ-বিষয়ে স্পষ্টভাবে সচেতন হলেও আধুনিক বিদ্বানেরা আর একটি বিষয় সম্বন্ধে সম্যকভাবে সচেতন হননি। বিষয়টি হলো, আদি-সাংখ্য শুধুই নিরীশ্বরবাদ নয়, জড়বাদ বা বস্তুবাদও। এই বিষয়টি সম্বন্ধে সম্যকভাবে সচেতন নন বলেই আধুনিক বিদ্বানেরা সাধারণত সাংখ্য-দর্শনকে বস্তুবাদ না বলে দ্বৈতবাদ বা dualism আখ্যা দিয়ে থাকেন।

দ্বৈতবাদ বলা হয় কেন? কেননা, সাংখ্যে প্রকৃতি ছাড়াও পুরুষের তত্ত্ব রয়েছে এবং প্রকৃতি অচেতন-পদার্থ হলেও পুরুষ চেতন পদার্থ।

অতএব, আমাদের পক্ষে প্রশ্ন তোলা দরকার সাংখ্য-দর্শনে প্রকৃতি ছাড়াও ওই পুরুষের তত্ত্ব আছে বলেই কি তাকে বস্তুবাদ না বলে দ্বৈতবাদ বলা প্রয়োজন? উত্তরে আমরা বলতে চাই, অন্তত আদি-সাংখ্যকে এইভাবে দ্বৈতবাদ বলবার প্রয়োজন নেই। কেননা তা যদি থাকতো তাহলে বাদরায়ণ-প্রমুখ প্রাচীনের সে-তাগিদ অনুভব করতেন—অর্থাৎ, সাংখ্যকে সরাসরি অচেতনকারণ-বাদ না বলে তারা একে অচেতন-চেতন-কারণবাদ বা ওই ধরনের কোনো আখ্যা দিতে বাধ্য হতেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, প্রাচীনের সাংখ্যকে শুধুমাত্র অচেতনকারণ-বাদ আখ্যা দিতে কোনো রকম দ্বিধা বোধ করেননি। তার কারণ কি এই যে, তারা জানতেন না সাংখ্য-দর্শনে প্রকৃতি ছাড়াও পুরুষের তত্ত্ব আছে? নিশ্চয়ই জানতেন। কিন্তু তা ছাড়াও তাঁরা জানতেন যে, এই পুরুষের স্থান সাংখ্য-দর্শনের আদি-আকৃত্রিম ংস্করণটিতে এমনই গৌণ যে, তা থাকলেও যেন না থাকারই সামিল। কেননা পুরুষ অপ্রধান, পুরুষ উদাসীন। “কথঞ্চোদাসীন পুরুষঃ প্রধানং প্রবর্তয়েৎ?” —উদাসীন পুরুষ কী ভাবে প্রধানকে প্রেরণ করবে? এবং বৈদান্তিকের অত্যন্ত স্পষ্টভাষাতেই বলেছেন, এ-বিষয়ে সাংখ্য-দর্শনের অন্ধ-পঙ্গু বা লৌহঅয়স্কান্তের উপমা কোনোমতেই সন্তোষজনক হতে পারে না। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, আধুনিক বিদ্বানেরাও অনেকেই কী ভাবে সাংখ্য-দর্শনের মধ্যে পুরুষের স্থান নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন : ন্যায়সঙ্গতভাবে সাংখ্যতত্ত্বের সঙ্গে পুরুষের কোনো মৌলিক যোগাযোগ নেই, অথচ তা রয়েছে; জগৎকারণ অচেতন প্রকৃতি বা প্রধানের পাশে পুরুষের তত্ত্বটুকু বাস্তবিকই এতো গৌণ যে, সাংখ্য-দর্শনের প্রবর্তকের এটুকু বাদ দিলেই বরং আরো যুক্তিসঙ্গত মনোভাবের পরিচয় দিতেন। আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, আদিতে পুরুষ বলতে চেতন-আত্মার পরিবর্তে পুরুষমানুষই বোঝাতো এবং সাংখ্য-তত্ত্বের মধ্যে মাতৃপ্রধান সমাজবাস্তব প্রতিবিম্বিত হয়েছে বলেই সে-সমাজে পুরুষের স্থানকে কেন্দ্র করে যে-অন্তর্বিরোধ, তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় সাংখ্য-দর্শনের পুরুষতত্ত্বটি নিয়ে অন্তর্বিরোধের মধ্যে। আপাতত, সে-যুক্তির কথা বাদ দিয়েও আমরা দেখাতে চাইছি যে, সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের তত্ত্ব থাকা সত্ত্বেও আদি-সাংখ্যকে দ্বৈতবাদ মনে করা ঠিক হবে না; কেননা ওই প্রকৃতি ও পুরুষের মধ্যে গুরুত্ব সমান নয়—প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টির স্থান এমনই গৌণ ও অকিঞ্চিৎ যে, আধুনিক বিদ্বানেরা এমন কি একথাও মনে করেছেন যে, এই তত্ত্বটিকে বাদ দিলেই বরং সাংখ্যকারেরা আরো বেশি সুসংলগ্ন চিন্তার পরিচয় দিতেন।, এবং বাদরায়ণ প্রমুখ প্রাচীন বিদ্বানেরাও তর্ক করে বলেছেন, অচেতনকারণবাদ হিসেবে সাংখ্যের যেটা মূল দুর্বলতা (আমরা বলতে পারি বৈশিষ্ট্য) তা ওই উদাসীন পুরুষটির তত্ত্ব যোগ করেও খুব কিছু পরিবর্তিত হয় না। অতএব, প্রাচীন ও আধুনিক বিদ্বানদের এই যুক্তি যদি ঠিক হয় তাহলে, তত্ত্ব আছে বলেই সাংখ্য-দর্শনকে বস্তুবাদ বা materialism না বলে দ্বৈতবাদ বা dualism বলা যুক্তিসঙ্গত হবে না।

অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত(৭৩৭) ও প্রাচীন সাংখ্য সংক্রান্ত আর একটি অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেছেন যার তাৎপর্য আমাদের এই যুক্তিকে সম্যকভাবে সাহায্য করতে পারে। তিনি দেখাচ্ছেন, সাংখ্য-দর্শনের প্রাচীনতর একটি রূপের পরিচয় পাওয়া যায় চরক-সংহিতায়,—যদিও দুঃখের বিষয়, অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত বলছেন, আধুনিক বিদ্বানেরা এই রূপটির প্রতি এখনো উপযুক্ত মনোযোগ দেননি। অতএব প্রশ্ন হলো, চরক-সংহিতায় সাংখ্য-দর্শনের যে-পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে তার দিক থেকে প্রকৃতি ও পুরুষের সম্বন্ধ কী রকম? চরকের মতে, প্রকৃতিরই অব্যক্ত অংশটির নাম পুরুষ। প্রকৃতির যেটা বিকার বা পরিণামের দিক তার নাম ক্ষেত্র এবং প্রকৃতির যেটা অব্যক্ত দিক তার নাম ক্ষেত্ৰজ্ঞ : অব্যক্তমস্য ক্ষেত্রস্য ক্ষেত্ৰজ্ঞমৃষয়ো বিদ্যুঃ। অব্যক্ত এবং চেতনা একই। এই চেতনা বা অব্যক্ত-প্রকৃতি থেকে বুদ্ধি, বুদ্ধি থেকে অহংকার, অহংকার থেকে পঞ্চভূত এবং পঞ্চেন্দ্রিয়ের উৎপত্তি এবং সেই উৎপত্তিকেই আমরা সৃষ্টি আখ্যা দিয়ে থাকি।

অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের যুক্তি যদি ঠিক হয়,—অর্থাৎ, চরকসংহিতায় যদি সত্যিই সাংখ্য-দর্শনের কোনো প্রাচীনতর পর্যায়ের পরিচয় পাওয়া যায় এবং সেই পরিচয় অনুসারে সাংখ্যের পুরুষও যদি প্রকৃতিরই অব্যক্ত অংশমাত্র হয়,—তা হলে সাংখ্যের আদিরূপটিকে দ্বৈতবাদ না বলে বস্তুবাদ আখ্যা দেবার সম্ভাবনা অনেক বাড়ে না কি? এবং সাংখ্য-দর্শন এইভাবে মূলত বস্তুবাদী ছিলো বলেই ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী বৈদান্তিক চিন্তাধারার পক্ষ থেকে সাংখ্য-দর্শনকেই প্রধানতম প্রতিপক্ষ বলে গ্রহণ করবার তাগিদটাও অনেক ভালো করে বুঝতে পারা যায়।

 

 

সাংখ্য হলো অচেতনকারণবাদ, প্রধানকারণবাদ। সাংখ্যমতে পুরুষ নেহাতই অপ্রধান এবং উদাসীন। এই মূল কথা ক’টি মনে রেখে এবার আমরা উপনিষদের সেই অংশগুলির বিচার করবো যেগুলির মধ্যে আধুনিক বিদ্বানেরা সাংখ্য-দর্শনের বীজ আবিষ্কার করবার কল্পনা করেছেন। এ-জাতীয় অংশের তালিকা আমরা ইতিপূর্বেই তৈরি করেছি; এখানে সে-তালিকা থেকে কিছু কিছু নমুনা উদ্ধৃত করা যাক :

কঠোপনিষৎ থেকে :
ইন্দ্ৰিয়সমূহ হইতে ইন্দ্রিয়বিষয়সমূহ শ্রেষ্ঠ, ইন্দ্ৰিয়-বিষয়সমূহ হইতে মন শ্রেষ্ঠ, মন হইতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ এবং বুদ্ধি হইতে মহান আত্মা শ্রেষ্ঠ ॥ ১,৩,১০॥
মহং হইতে জগতের বীজরুপ অব্যক্ত শ্রেষ্ঠ, অব্যক্ত হইতে পুরুষ শ্রেষ্ঠ, পুরুষ হইতে শ্ৰেষ্ঠ আর কিছুই নাই; তিনি শেষ, তিনি পরা গতি ॥ ১, ৩, ১১ ॥ ইন্দ্ৰিয়সমূহ হইতে মন শ্রেষ্ঠ, মন হইতে সত্ত্ব শ্রেষ্ঠ, সত্ত্ব হইতে মহান আত্মা অধিক, মহৎ হইতে অব্যক্ত শ্রেষ্ঠ ॥ ২,৩,৭, ॥
অব্যক্ত হইতে ব্যাপক এবং অ-লিঙ্গ পুরুষ শ্রেষ্ঠ, যাহাকে জানিয়া জীব মুক্ত হয় এবং অমৃতত্ত্ব প্রাপ্ত হয় ॥ ২,৩,৮, ॥

শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ থেকে :
ঈশ্বর এই পরস্পরসংযুক্ত ক্ষর ও অক্ষর, ব্যক্ত ও অব্যক্ত সমুদয় বিষয় ধারণ করিয়া আছেন। আর অনীশ (অর্থাৎ ঈশ্বরত্ববিহীন) আত্মা ভক্ত ভাববশত: অবিদ্যাদি বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু দেবকে (অর্থাৎ ঈশ্বরকে) জানিয়া সমুদয় বন্ধন হইতে মুক্ত হয় ॥১,৮॥
প্রধান (অর্থাৎ প্রকৃতি) ক্ষর; হর (the soul, হিউমের তর্জমা) অমৃত ও অক্ষর। সেই ‘একঃ দেবঃ’ প্রকৃতি ও আত্মাকে নিয়মিত করেন। তাঁহার চিন্তন এবং তাঁহার সহিত সংযোগ ও একত্বদ্বারা অন্তে সম্পূর্ণরূপে সমুদয় মোহ নষ্ট হয় ॥১,১০॥
পুরুষ অর্থাৎ পরমাত্মাই মহান প্রভূ, ইনি অন্তঃকরণের প্রবর্তক, মুনির্মল পরমপদ প্রাপ্তির নিয়ন্তা, জ্যোতির্ময় ও অব্যয় ॥৩,১২॥
লোহিত-শুক্ল-কৃষ্ণা বহু প্রজার উৎপাদিকা এক অজার সহিত শয়ন করিয়া এক অজ উপভোগ করে; অপর আজ এই ভূক্তভোগ্যাকে পরিত্যাগ করে ॥৪,৫৷৷ মায়াকেই প্রকৃতি বলিয়া জানিবে এবং মায়ীকে মহেশ্বর বলিয়া জানিবে; তাহার অঙ্গসমূহ দ্বারাই এই সমস্ত জগৎ ব্যাপ্ত রহিয়াছে ॥৪, ১০৷৷
যে অদ্বিতীয় (পরমাত্মা) প্রত্যেক কারণ, সমুদয় রূপ এবং সমুদয় বীজের অধিষ্ঠাতা, যিনি সকলের অগ্রে প্রসূত ঋষি কপিলকে (= কনকবর্ণ হিরণ্যগৰ্ভ?) জ্ঞানদ্বারা পোষণ করেন এবং তাহাকে জন্মাইতে দেখিয়াছিলেন ॥৫, ২৷৷
যিনি (পরমাত্মা) গুণত্রয়যুক্ত হইয়া সুখদুঃখাদি ফলবৎ কর্ম করেন, তিনিই সেই কর্মের ফলভোগ করেন। তিনি নানারূপ ত্রিগুণ, ত্রিবত্মর্ণ হইয়া নিজকর্মবশে সঞ্চরণ করেন ॥৫, ৭৷৷
যিনি অঙ্গুষ্ঠমাত্র রবিতুল্যরূপ, যিনি সংকল্প ও অহংকারের সহিত মিলিত হইয়া বুদ্ধি ও আত্মগুণ সমন্বিত হইয়া লোঁহকণ্টকের অগ্রভাগের ন্যায় দৃষ্ট হন।॥৫, ৮॥
যে অদ্বিতীয় দেবতা উর্ণনাভের ন্যায় স্বভাবত প্রধানজাত তন্তুসমূহদ্বারা আপনাকে আচ্ছাদিত করিয়াছেন, তিনি আমাদিগের ব্রহ্মে প্রবেশ বিধান করুন ॥৬, ১০ ৷৷
যিনি নিত্যদিগের মধ্যে নিত্য, চেতনাবাদিগের মধ্যে চেতনাবান, যিনি একাকী অনেকের কাম্যবস্তুসকল বিধান করিতেছেন, সেই কারণরূপী দেবকে সাংখ্য-যোগ দ্বারা জানিয়া সাধক সমুদয় বন্ধন হইতে মুক্ত হন ॥৬, ১৩৷৷
(হিউমের(৭৩৮) তর্জমা অনুসারে এখানে সাংখ্য-যোগ discrimination and abstraction—প্রাচীন ভাষ্যকারদের অনুসরণ করেই হিউম এ-তর্জমা করেছেন)।
তিনি বিশ্বকৃৎ, বিশ্ববিৎ, স্বয়স্থ, কালের কর্ত, গুণী, সর্ববিৎ, প্রধানের ও ক্ষেত্রজ্ঞের স্বামী গুণের ঈশ্বর এবং সকলের স্থিতি, বন্ধন ও মোক্ষের কারণ ॥৬, ৮৬ ৷৷

একইভাবে, গীতা-বর্ণিত সাংখ্যও(৭৩৯) বাদরায়ণ-খণ্ডিত সাংখ্য নয়।

এখানে, একটি অত্যন্ত সরল প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন : বাদরায়ণ সাংখ্য-মত হিসেবে যে-অচেতনকারণবাদকে খণ্ডন করবার চেষ্টা করেছেন, উপনিষদের উদ্ভূত উক্তিগুলির মধ্যে কি সেই মতেরই পরিচয় পাওয়া যায়, ন, সেই মতকে চেতনকারণবাদের চেয়ে নিকৃষ্ট বলে প্রতিপন্ন করবার চেষ্টাই চোখে পড়ে? উপনিষদের ওই অংশগুলিতেও কি জগৎকারণ হিসেবে অচেতন প্রধানকেই চেনবার চেষ্টা করা হয়েছে? এখানেও কি পুরুষকে অপ্রধান এবং উদাসীন হিসেবে গৌণ জ্ঞান করা হয়েছে? নিশ্চয়ই নয়। বরং তার বিপরীত কথাই এই উক্তিগুলির মধ্যে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। কঠোপনিষদ বলছে, অব্যক্ত হইতে পুরুষ শ্রেষ্ঠ, পুরুষ হইতে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নাই। একি সাংখ্যের মত, না, সাংখ্যমত খণ্ডন? অন্তত, সাংখ্যমত হিসেবে বাদরায়ণ যে-মতটি খণ্ডন করছেন এখানে নিশ্চয়ই তার পরিচয় পাওয়া যায় না। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে যখন প্রধানকে ছোটো করে পুরুষ, পরমাত্মা, দেব ও ঈশ্বরের উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, যখন বলা হচ্ছে অদ্বিতীয় দেবতাই উর্ণনাভের ন্যায় আত্মস্বভাব প্রসূত প্রকৃতি দ্বারা নিজেকে আচ্ছাদন করেছেন—তখন কি আমরা সে-কথাকে সাংখ্যের উপদেশ বলে গ্রহণ করবো, না, সাংখ্যের অচেতনকারণ-বাদকে তুচ্ছ প্রতিপন্ন করে, চেতনকারণ-বাদকেই প্রতিষ্ঠা করবার আয়োজন বলে স্বীকার করতে বাধ্য হবো?

মনে রাখতে হবে, সাংখ্য-দর্শন মানে অব্যক্ত, মহৎ, প্রকৃতি, পুরুষ প্রভৃতি কয়েকটি দার্শনিক পরিভাষামাত্র নয়; তাই উপনিষদের মধ্যে ওই পরিভাষাগুলির পরিচয় পেলেই সাংখ্য-দর্শনের বীজ খুঁজে পাওয়া গেলে বলা যায় না। তার বদলে, সাংখ্য একটি নির্দিষ্ট দার্শনিক মতবাদ, যে-মতবাদটিকে খণ্ডন করবার জন্য বাদরায়ণ অতো রকমের আয়োজন করেছেন। সে-মতবাদ অনুসারে অচেতন প্রকৃতি বা প্রধানই জগৎকারণ; পুরুষ নেহাতই অপ্রধান এবং উদাসীন। এই কথাটি মনে রাখলে নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে যে, উপনিষদের মধ্যেই ওই সাংখ্যমতের বীজ খুঁজে পাওয়া সত্যিই যাচ্ছে না; তার বদলে সাংখ্যমত খণ্ডনেরই একটা প্রবল প্রচেষ্টা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অতএব, উপনিষদের এই সাক্ষ্যগুলি থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সাংখ্যমত শুধুই যে উপনিষদ-বিরুদ্ধ তাই নয়, তুলনায় প্রাচীনতরও। উপনিষদ রচনার আগে থাকতেই এই মতটি নিশ্চয়ই এদেশে প্রচলিত ছিলো; তা না হলে উপনিষদকারেরা কী করে এই মতকে এ-ভাবে খণ্ডন করবার চেষ্টা করলেন?

এদিক থেকে, শঙ্করাচার্য(৭৪০) যখন বলেন, উপনিষদের দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করবার জন্য সাংখ্যাদিমত খণ্ডনের একান্ত প্রয়োজন,—‘বেদান্তবাক্যানি ব্যাচক্ষাণৈঃ সম্যগ্‌দর্শনপ্রতিপক্ষভূতানি সাংখ্যাদিদর্শনানি নিরাকরণীয়ানীতি’— তখন তিনি নিশ্চয়ই আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে যারা বেদান্ত বা উপনিষদের মধ্যেই সাংখ্যের বীজ অনুসন্ধান করেন তাঁদের তুলনায় সাংখ্য ও উপনিষদ উভয় মতবাদকেই অনেক সম্যকভাবে বোঝবার সহায়তা করেন।

অধ্যাপক রিচার্ড গার্বের কথায় ফিরে আসা যাক। তিনি যখন সিদ্ধান্ত করছেন যে, সাংখ্য আদিতে অ-বৈদিক মত ছিলো, তখন আমরা তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহজেই একমত হতে পারি। বেদান্ত-সূত্রকারের সাংখ্য-খণ্ডনই এর একমাত্র প্রমাণ নয়। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি পশুপালন-নির্ভর বৈদিক সমাজ পুরুষ-প্রধান ছিলো বলেই বৈদিক চিন্তাধারাতেও এই পুরুষপ্রাধান্যের স্বাক্ষর পাওয়া যায়; অপরপক্ষে সাংখ্য-দর্শনের প্রধান বা

প্রকৃতি শুধুই অচেতনবস্তুবাচক বা material principle নয়, তাছাড়াও নারীবাচক বা female principle-ও। কিন্তু অধ্যাপক গার্বে সেইসঙ্গেই যখন বলেন, কালক্রমে এই সাংখ্য-দর্শনই উপনিষদাদির মধ্যে স্বীকৃত বা গৃহীত হয়েছিলো, তখন স্বভাবতই আমরা তার মন্তব্যটিকে মেনে নিতে অত্যন্ত সঙ্কোচ বোধ করি। কেননা, উপনিষদের চিন্তাধারা শুধুই ভাববাদী বা idealistic নয়, পুরুষপ্রধানও (পূঃ ১৫২)। অতএব, উপনিষদের চিন্তাধারার মধ্যে কালক্রমে সাংখ্য-মতের স্থান হওয়ার সম্ভাবনা সত্যিই সঙ্কীর্ণ। এবং উপনিষদের মধ্যে সাংখ্য-মত স্বীকৃত হবার নিদর্শন হিসেবে অধ্যাপক গার্বে উপনিষদের যে-অংশগুলির উল্লেখ করছেন, সেগুলিকে স্পষ্টভাবে বিচার করলেও আমরা দেখতে পাই যে, আসলে সেখানে সাংখ্যমত গ্রহণ করবার পরিবর্তে সাংখ্যমত খণ্ডন করবার প্রচেষ্টাটাই প্রকট। আমরা আরো বলতে চাই যে, অধ্যাপক গার্বের যুক্তি এখানে স্বপক্ষদোষদুষ্টও হয়েছে। কেননা, সাংখ্য যে আদিতে শুধু নিরীশ্বরবাদই নয়, বস্তুবাদও ছিলো—একথা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন। এবং একথা যদি ঠিক হয় তাহলে তাকে মানতে হবে যে, অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী উপনিষদের মধ্যেই কালক্রমে নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী সাংখ্য-দর্শনেরও স্থান হয়েছিলো।

আদিসাংখ্যকে যে বস্তুবাদী বলাই বাঞ্ছনীয়—একথা অধ্যাপক গার্বে কী ভাবে স্বীকার করছেন? বৌদ্ধদৰ্শনের আদিরূপটির সঙ্গে সাংখ্যের আদিরূপটির সাদৃশ্য দেখাবার উদ্দেশ্যে তিনি(৭৪১) বলছেন :

…it is a merit of Oldenberg to have emphatically pointed out the fact that primitive Buddhism does not yet know the often mentioned speculations on the nothingness of the world, but that, on the contrary, the idea of nothingness belongs to the later metaphysics of the Buddhists. The world of objects is, therefore, considered to be real by Buddha as well as by Kapila (c.f. Sutra I, 79; VI, 52); and this world of objects comprehends also the psychic organs and states according to the systems of both. As in Sankhya philosophy, even the highest internal processes, like thinking, volition, judging, etc., are mechanical functions of Matter, which are not to be ascribed to the Atman, but must be known to be anatman, so Buddha teaches, too, that… ‘sentiments, conceptions and cognition’ are anatta (= anatma).

সাংখ্য-মতে যদি চিন্তা, ইচ্ছা, বিচার প্রভৃতি মানসব্যাপারগুলিও অচেতনবস্তু বা matter-এরই যান্ত্রিক বিকাশমাত্র হয়,—যদি এগুলিও আত্মজনিত না হয়ে অনাত্মজনিতই হয়,—তাহলে বৌদ্ধ দর্শনের আদিরূপটির সঙ্গে তার সাদৃশ্য থাকুক আর নাই থাকুক, অন্তত উপনিষদের চিন্তার মধ্যে তার স্থান কষ্টকল্পিত হতে বাধ্য। কেননা, উপনিষদ মূলতই ভাববাদী এবং এই ভাববাদের সঙ্গে বস্তুবাদের সংঘর্ষই দর্শনের ইতিহাসে সবচেয়ে মৌলিক দ্বন্দ্ব(৭৪২)। এবং অধ্যাপক গার্বেও স্বীকার করেছেন যে, উপনিষদের চিন্তার সঙ্গে সাংখ্যের যে-বিরোধ, তা আসলে ভাববাদের সঙ্গে বস্তুবাদেরই মূল বিরোধ। অধ্যাপক গার্বে(৭৪২) বলছেন, “আমার মতে এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না যে, উপনিষদের ব্রহ্মন্‌-আত্মন্‌মূলক যে ভাববাদী মতবাদ,—যে-মতবাদ বেদ থেকেই শুরু এবং উত্তরকালে যা বেদান্ত দর্শনের কেন্দ্র হয়েছে—সেই মতবাদটি অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতবাদের তুলনায় প্রাচীনতর। এই ভাববাদ সংহত-রূপে এবং সোৎসাহে প্রচারিত হতে শুরু হবার পর এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সাংখ্য-দর্শনের উদ্ভব হয়েছিলো”।

বেদান্ত ভাববাদী, সাংখ্য বস্তুবাদী—দুয়ের মধ্যে মৌলিক প্রভেদ। উপরোক্ত উক্তির মধ্যে এই স্বীকৃতিটি অবশ্যই মূল্যবান। কিন্তু তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, আমরা দুয়ের মধ্যে উপনিষদের ভাববাদকেই প্রাচীনতর এবং সাংখ্যের বস্তুবাদকে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া-মাত্র বলে স্বীকার করতে বাধ্য। বরং, আমাদের পক্ষে নিছক ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে যেটুকু সংগ্রহ করা সম্ভবপর, তার সাক্ষ্য সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা, আমরা আগেই দেখেছি, উপনিষদ-সাহিত্যের মধ্যে—এবং বিশেষ করে ব্রহ্মসূত্রের মধ্যে—সাংখ্যমতের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রচেষ্টাটা স্পষ্ট; অপরপক্ষে সাংখ্যের কোনো গ্রন্থেই আমরা উপনিষদের চিন্তাধারার বিরুদ্ধে অভিযানের লক্ষণ দেখতে পাই না। অবশ্যই, এ-কথা ঠিক যে, ষষ্টিতন্ত্র প্রভৃতি সাংখ্যের আদি গ্রন্থগুলি বিলুপ্ত হয়েছে এবং সাংখ্য-সূত্র ও এমন কি সাংখ্যকারিকাও অনেক পরের রচনা বলেই এগুলির মধ্যে সাংখ্যের আদিরূপটির পরিচয় নেই। সাংখ্যের আদিগ্রন্থ উদ্ধার করা সম্ভব হলে তার মধ্যে বৈদান্তিক ভাববাদের বিরুদ্ধে সচেতন অভিযানের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যেতো কিনা সে-কথা কল্পনা করেও কোনো লাভ নেই। হয়তো যেতো; কিন্তু তার থেকেই প্রমাণিত হতো না যে, উপনিষদের ভাববাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সাংখ্য-দর্শনের সূত্রপাত হয়েছিলো। কেননা, তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের সাদৃশ্যের দিক থেকে এবং সাংখ্যকে তন্ত্রেরই দার্শনিক সংস্করণ হিসাবে চেনবার দিক থেকে, আমরা যে-কথা বোঝবার চেষ্টা করছি তা হলো সাংখ্য আগে না উপনিষদ আগে,—এই তর্কই অনেকাংশে ভ্রান্তিপ্রসূত। আসলে বেদান্ত ও সাংখ্য— দুটি চিন্তাধারা বৈদিক ও অবৈদিক হটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতির পরিচায়ক। এবং বৈদিক ও অবৈদিক এই দুটি সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্যকে আধুনিক বিদ্বানের অনেক সময় নিছক জাতিগত পার্থক্যের দিক থেকে বোঝবার চেষ্টা করে ভুল করেছেন; কেননা, এই দুটি সংস্কৃতির মধ্যে যে-পার্থক্য, তার সঙ্গে জাতিগত পার্থক্যের সম্পর্ক থাকুক আর নাই থাকুক, অন্তত নিছক জাতিগত পার্থক্য হিসেবে তার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করা যায় না। আমরা ইতিপূর্বেই দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, তান্ত্রিক ও বৈদিক ঐতিহ্যের মধ্যে যে-মৌলিক পার্থক্য তার ব্যাখ্যা উৎপাদন-পদ্ধতির পার্থক্যের দিক থেকেই খুঁজে পাওয়া সম্ভবপর : পশুপালন-প্রধান জীবন বলেই বৈদিক সমাজ পুরুষ-প্রধান এবং বৈদিক সমাজের প্রতিফলন হিসেবে বৈদিক চিন্তাধারাও পুরুষ-প্রধান। অপরপক্ষে কৃষি-নির্ভর মাতৃপ্রধান সমাজের প্রতিফলন হিসেবে, তান্ত্রিক চিন্তাধারা শক্তিপ্রধান বা মাতৃপ্রধান। তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের সাদৃশ্য যদি সত্যিই মৌলিক হয় তাহলে বৈদান্তিক চিন্তাধারার সঙ্গে সাংখ্য-মতের বিরোধটিকেও এই দিক থেকেই বোঝবার অবকাশ থাকে নাকি?

অবশ্যই এখানে আর একটি প্রশ্ন উঠবে। সাংখ্যের প্রকৃতি বলতে শুধুমাত্র female principle নয়; material principle-ও। তাই নারীপ্রধান্য ও পুরুষ-প্রাধান্যমূলক প্রভেদ ছাড়াও সাংখ্য ও বেদান্তের মধ্যে বস্তুবাদ-বনাম-ভাববাদের দিক থেকে যে-তফাত—তার ব্যাখ্যা উপরোক্ত উক্তির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না।

এই বস্তুবাদের দিক থেকে এখানে নতুন সমস্যাও ওঠে। বৈদান্তিক বা উপনিষদের চিন্তাধারা যতো চূড়ান্ত ভাববাদীই হোক না কেন, তারও একটা অতীত ছিলো এবং সেই অতীতটিকে পরীক্ষা করলে আমরা দেখতে পাই লোকায়তর মতোই একরকম প্রাকৃত বস্তুবাদী ধ্যানধারণার ধ্বংসস্তুপের উপর বৈদান্তিক ভাববাদের আবির্ভাব ঘটেছে, যদিও সেই প্রাকৃত বস্তুবাদের সঙ্গে লোকায়তিক বস্তুবাদের মূল প্রভেদ হলো এ-বস্তুবাদ পুরুষ-প্রধান চেতনার অঙ্গ, তন্ত্র ও সাংখ্যের মতো নারীপ্রাধান্যের পরিচায়ক নয়। বৈদিক ঐতিহ্য অতি দীর্ঘ; সংহিতা থেকে শুরু করে উপনিষদ পর্যস্ত সহস্রাধিক বছর ধরে রচিত হয়েছে তার সাহিত্যিক নিদর্শন। এবং এই সহস্রাধিক বছরের সাহিত্যিক নিদর্শন হুবহু একই ধ্যানধারণার পরিচায়ক নয়; এ-সাহিত্যের প্রাচীনতর অংশে ভাববাদের পরিচয় নেই এবং সেদিক থেকে পুরুষপ্রধান চিন্তার পরিচায়ক হলেও লোকায়তর মতোই তা অফুট বস্তুবাদই। সেই অস্ফূট ও আদিম বস্তুবাদের ধ্বংসস্তুপের উপরই কালক্রমে উপনিষদের ভাববাদের আবির্ভাব হয়েছে। অতএব এদিক থেকে বলা যায়, উত্তরকালে বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকের যে-বস্তুবাদী চিন্তাকে অমন ঘৃণার চোখে দেখতে শিখেছিলেন, সেই বস্তুবাদই তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে—বৈদিক ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাতাদের কাছে—সত্যের মর্যাদা পেয়েছিলো। কামাচার অর্থে বামাচার প্রসঙ্গেও আমরা ইতিপূর্বে (পৃ. ১০৩—১১২) এই বৈশিষ্ট্যটিই লক্ষ্য করেছি। আমরা দেখেছি, এই কামাচার বা বামাচার মানবোন্নতির প্রাচীন পর্যায়ের জাদুবিশ্বাসেরই পরিচায়ক; তার মূল কথা হলো প্রাকৃতিক উৎপাদনকে মানবীয় প্রজননের অনুকরণেই আয়ত্তে আনবার কল্পনা। বৈদিক ঐতিহে সেই জাদুবিশ্বাসের স্মারক থেকেই প্রমাণিত হয় এ-ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাতার মানবোন্নতির সেই প্রাচীন পর্যায়েই জীবন-যাপন করতেন, যদিও তাদের অর্থনীতি মূলতই বা প্রধানতই পশুপালন-নির্ভর ছিলো বলেই, এ-জাদুবিশ্বাস শুধুই পুরুষপ্রধান নয়, লোকায়তিক বামাচারের তুলনায় অনেকাংশেই গৌণ। কারণ, ওই লোকায়তিক সংস্কৃতি মূলতই কৃষিনির্ভর, এবং কৃষিকাজের তুলনায় পশুপালনের ক্ষেত্রে জাদুবিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে কম (পৃ. ৩৪২—৩৪৭)।

তাহলে, কালক্রমে লোকায়তর সঙ্গে বৈদান্তিক ধ্যানধারণার যতো প্রভেদই দেখা যাক না কেন, এই বৈদিক ঐতিহ্যেরও যেটা প্রাচীনতম পর্যায় তার সঙ্গে লোকায়তিক চিন্তার সাদৃশ্য দেখা যায়। আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, এই সাদৃশ্যের মূল কারণ হলো উভয়েই প্রাক্-বিভক্ত সমাজের—এবং অতএব প্রাক-অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার—পরিচায়ক : বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকের ওই প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্বংসস্তুপের উপর গড়ে তুলেছিলেন শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, এবং তারই প্রতিবিম্ব হিসেবে তাদের ধ্যানধারণায় আবির্ভাব হয়েছিলো অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদের। কিন্তু সে-ভাববাদের নিচে, প্রাক্-বিভক্ত সমাজের স্মৃতি বহন করে একটা অস্ফুট বস্তুবাদের ইতিহাস চাপা পড়ে আছে, এবং প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্যানধারণার স্মৃতি হিসেবেই তার সঙ্গে লোকায়তিক চিন্তাধারার ওই সাদৃশ্য। বৈদিক সাহিত্যে ওই প্রাক্-বিভক্ত সমাজের স্মৃতি হিসেবেই গণ ও ব্রাত্যের কীরকম গৌরবময় অতীতের পরিচয় পাওয়া যায় তার আলোচনা আমরা ইতিপূর্বেই করেছি (পৃ: ২২৯—২৩২)।

ওই প্রাক্-বিভক্ত সমাজ ও তার প্রাক্ অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার আলোচনায় পরে প্রত্যাবর্তন করা যাবে। তার আগে লোকায়ত, সাংখ্য ও তন্ত্রের কথাটা আরো ভালো করে দেখা যাক।

——————-
৬৯৪. সাংখ্যকারিকা ২১, গৌড়পাদভাষ্য।
৬৯৫. বিশ্বকোষ ৭:৫০৭ |
৬৯৬. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : বৌদ্ধধর্ম ৩৭ ৷
৬৯৭. H. Zimmer PI 282–সাংখ্যকারিকাকে লেখক আরো পরে (পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি ) রচিত বলে বিবেচনা করেন। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও (বৌদ্ধধর্ম ৩৮) একই মত পোষণ করেন।
৬৯৮. সাংখ্যকারিকা ৭০।
৬৯৯. ঐ ৭১।
৭০০. শঙ্করাচার্য : ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২.৪.৯ ।
৭০১. S. N. Dasgupta HIP 1:213.
৭০২. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade HIP 2:412.
৭০৩. Ibid. 2:413f.
৭০৪. H. H. Wilson SK 160.
৭০৫. P. B. Chakravarti ODSST দ্রষ্টব্য I
৭০৬. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : রচনাবলী (সাহিত্য-সংসদ ) ২:২২২ ।
৭০৭. মণীন্দ্রমোহন বস্তু : সহজিয়া সাহিত্য ৫২ ৷
৭০৮. উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য : ভারতদর্শনসার ১৪৯-৫০ ।
৭০৯. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op. cit. 2:428.
৭১০. ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২.২.৭ । নিয়োস্থত তৰ্জমা কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:১৪০ ।
৭১১. ERE 11:191.
৭১২. P. R. T. Gurdon K xix-xx.
৭১৩. G. Thomson SAGS 153.
৭১৪. K. Marx. & F. Engels C 210.
৭১৫. ERE 6:706.
৭১৬. R. Garbe SPB Preface ix.
৭১৭. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : বৌদ্ধধর্ম ৩৭।
৭১৮. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op cit. 2:415.
৭১৯. S.N. Dasgupta op. cit. 1:213.
৭২০. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op. cit. 2:418f.
৭২১. Ibid. 2:420f.
৭২২. Ibid. 2:426f.
৭২৩. E. H. Johnston Es.
৭২৪. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op cit. 2:416.
৭২৫. ব্রহ্মসূত্রভাষ ২. ১, ১২ । তর্জমা—কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:৪৭।
৭২৬. ঐ ২, ১, ১ । তৰ্জমা—কালীবর বেদাস্তবাগীশ ২৮।
৭২৭. ঐ। কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:১০।
৭২৮. R. Garbe IACOPVMCSS Preface xx-xxi.
৭২৯. H. Zimmer PI 281.
৭৩০. ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ১. ৪.১। তর্জমা—কালীবর বেদান্তবাগীশ ১:৪৯৭।
৭৩১. P. B. Chakravarti ODSST 4.
৭৩২. Ibid.
৭৩৩. তর্জমা—কালীবর বেদাস্তবাগীশ ২:১২৩-৪।
৭৩৪. তর্জমা—কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:১২৮।
৭৩৫. কালীবর বেদান্তবাগীশ : সাংখ্য-দর্শনম্ ২২১-২।
৭৩৬. R. Garbe SPB Preface দ্রষ্টব্য।
৭৩৭. S. N. Dasguta op. cit. 1:213.
৭৩৮. R. Hume TPU.
৭৩৯. বরং আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি (পৃ. ৫৩৬ ), গীতা-বর্ণিত অসুরমতের সঙ্গেই সাংখ্যের আদিরূপের সংযোগ অনুমান করা যায়। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত মতটিই যদি আদি-অকৃত্রিম সাংখ্য হতো তাহলে অবশ্যই বাদরায়ণ সাংখ্য-খণ্ডনের জন্য অতো আয়োজন করতেন না ।
৭৪০. ব্ৰহ্মসূত্রভাষ্য ২. ১. ২.।
৭৪১. R. Garbe IACOPVMCSS Preface xii.
৭৪২. F. Engels LF 19.
৭৪৩. R. Garbe op. cit. Preface xix.