অচেতন দেখি রথ ফিরায় সারথি।
ভীষ্ম ভঙ্গ দেখি ক্রোধে ধায় কুরুপতি।।
গজেন্দ্র চড়িয়া যেন ইন্দ্র দেবরাজ।
চতুর্দ্দিকে বেড়ি ধায় ক্ষত্রিয়-সমাজ।।
ঊনশত সহোদর বেষ্টিত চৌপাশে।
সবে অস্ত্র শস্ত্র পার্থ উপরে বরিষে।।
হাসিয়া অর্জ্জুন বীর করিয়া সন্ধান।
দুর্য্যোধনে প্রহার করেন দশ বাণ।।
কাটিয়া পাড়েন তার ভয়ঙ্কর ধনু।
কবচ কাটেন দুই, ছয় বাণে তণু।।
প্রহার করিল ভল্ল গজেন্দ্র-মস্তকে।
বজ্রাঘাতে যেন গিরিশৃঙ্গ শত মথে।।
পৃথিবীতে দন্ত দিয়া পড়িল বারণ।
লাফ দিয়া ভূমিতলৈ পড়ে দুর্য্যোধন।।
দুর্য্যোধন ভঙ্গ দেখি যত সহোদর।
পাছু নাহি চাহে সবে পলায় সত্বর।।
পাছু থাকি ডাকে ঘন পার্থ ইন্দ্রসুত।
কি কর্ম্ম করিস্ লোকে শুনিতে অদ্ভুত।।
সসৈন্যে পলাস্ সঙ্গে শত সহোদর।
বলাও ধরণী-মাঝে তুমি দণ্ডধর।।
যুধিষ্ঠির নৃপতির আজ্ঞাকারী আমি।
মোরে দেখি পলাইস্ হয়ে ক্ষিতিস্বামী।।
সসৈন্য পলায়ে যাস্ শৃগালের প্রায়।
এই মুখে রাজ্যভোগ ইচ্ছ হস্তিনায়।।
এতেক সহায় তোর গেল কোথাকারে।
মারিলে এখন আমি কে রাখিতে পারে।।
শত্রু নিজ বশ হলে, কে ছাড়ে মারিতে।
যদি মারি কোথা পথ পাবি পলাইতে।।
ছাড়িলাম লয়ে যাহ নির্লজ্জ জীবন।
ব্যর্থ নাম ধর তুমি, মানী দুর্য্যোধন।।
পলাইলি মম ভয়ে শৃগালের প্রায়।
এই মুখে গবী নিতে আসিলি হেথায়।।
পলায়িত জনে আমি না মারি কখন।
ভীমসেন হৈলে তোর নাশিত জীবন।।
অর্জ্জুনের এইরূপ কটুবাক্য শুনি।
ক্রোধে নেউটিল দুর্য্যোধন মহামানী।।
লাঙ্গুলে মারিলে যথা নেউটে ভুজঙ্গ।
অঙ্কুশ কর্ষণে যথা নেউটে মাতঙ্গ।।
নেউটিল দুর্য্যোধন, দেখি বীরগণ।
চতুর্দ্দিকে ধেয়ে পুনঃ আসে সর্ব্বজন।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপা অশ্বত্থামা শাল্ব কর্ণ।
দুঃশাসন মহাবল দুঃসহ বিকর্ণ।।
সহস্র সহ্স্র রথী বেড়িল অর্জ্জুনে।
চতুর্দ্দিকে নানা অস্ত্র বর্ষে ক্ষণে ক্ষণে।।
মুষল মুদগর জাঠি শূল ভিন্দিপাল।
আকাশ ছাইয়া সবে করে শরজাল।।
হাসিয়া অর্জ্জুন এড়িলেন দিব্য বাণ।
সবাকার দিব্য অস্ত্র কৈল খান খান।।
গজেন্দ্র মণ্ডলে যেন বিহরে কেশরী।
দানবগণের মধ্যে যেন বজ্রধারী।।
সিন্ধু-জল মধ্যে যেন পর্ব্বত মন্দর।
কুরুবল মথে পার্থ হয়ে একেশ্বর।।
কখন দক্ষিণ হস্তে কভু বাম করে।
ভৈরব মূরতি দেখি সংগ্রাম ভিতরে।।
গাণ্ডীবের মূর্ত্তি অস্ত্র বিনা নাহি দেখি।
লক্ষ লক্ষ অস্ত্র মারে দিন কার ঢাকি।।
পড়িল অনেক সৈন্য হয় রথ গজ।
পৃথিবী আচ্ছাদি পড়ে ছত্র রথধ্বজ।।
তথাপিহ কুরুকুল যুদ্ধ না ছাড়িল।
লক্ষপুর করি একা অর্জ্জুনে বেড়িল।।
অর্জ্জুনের মনে এই চিন্তা উপজিল।
জীয়ন্তে কৌরবগণ যুদ্ধ না ছাড়িল।।
পরকার্য্যে জ্ঞাতিবধ করিলে বহুত।
না জানি কি কহিবেন শুনি ধর্ম্মসুত।।
ছাড়ি গেলে, কৌরব কহিবে পলাইল।
কি উপায় করি, ইহা সমস্যা হইল।।
তবে ইন্দ্রদত্ত অস্ত্র হইল স্মরণ।
সম্মোহন নামে অস্ত্র মাহে রিপুগণ।।
মন্ত্রে অভিষেকি পার্থ মারিলেন বাণ।
মোহ গেল কুরুগণ, নাহি কার জ্ঞান।।
রথে রথী পড়ে, অশ্বে পড়ে আসোয়ার।
গজেতে মাহুত পড়ে, নিদ্রিত আকার।।
সর্ব্বসৈন্য মোহপ্রাপ্ত, দেখিয়া অর্জ্জুন।
উত্তরার বাক্য মনে হইল স্মরণ।।
উত্তরে বলেন তবে ইন্দ্রের নন্দন।
তব ভগ্নী মাগিয়াছে পুত্তলী বসন।।
অনিহ সবার বস্ত্র মস্তক হইতে।
যার যার চিত্র বস্ত্র লয় তব চিতে।।
ভীষ্ম দ্রোণ দোঁহার না দিবে অঙ্গে কর।
আর সবাকার বস্ত্র আনহ উত্তর।।
সবে মুগ্ধ হইয়াছে, নাহি তব ভয়।
যথাসুখে আন গিয়া, যাহা মনে লয়।।
পার্থের বচন শুনি উত্তর নামিল।
উত্তম উষ্ণীষ উত্তর বাছিয়া লৈল।।
দুর্য্যোধন কর্ণ দুঃশাসন আদি করি।
মুকুট করিয়া দূর কেশ মুক্ত করি।।
রথিগণে বসাইল গজের উপরে।
রথের উপরে বসাইল আসোয়ারে।।
এমত উত্তর করি বহু বহু জন।
পুনরপি উঠে রথে লইয়া বসন।।
পার্থের অদ্ভুত কর্ম্ম দেখি দেবগণ।
সুগন্ধি কুসুম বৃষ্টি করে সেইক্ষণ।।
অপূর্ব্ব হইল শোভা ধরণী-মণ্ডলে।
বিচিত্র কানন যেন বসন্তের কালে।।
পড়িল অনেক সৈন্য, লিখনে না যায়।
জীয়ন্তে আছিল যেই, সেও মৃতপ্রায়।।
ভয়ঙ্কর হৈল ভূমি, দেখি লাগে ভয়।
রক্ত মাংসাহারী ধায় সানন্দ হৃদয়।।
শৃগাল কুক্কুরগণ করে কোলাহল।
গৃধিনী শকুনি কাক ছাইল সকল।।
শোণিতে বহয়ে নদী, অতি বেগবতী।
হয় রথ পদাতিক ভাসে মত্ত হাতী।।
নাচয়ে কবন্ধগণ ধনুঃশর হাতে।
যোগিনী পিশাচ ভূত প্রেতগণ সাথে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-অর্ণব।
বিরাটপর্ব্বে অজ্ঞাতে বঞ্চিল পাণ্ডব।।
গবী-হরণ কাহিনী সুধাসিন্ধু মত।
শ্রবণে ঘুচয়ে তার পাপ তাপ যত।।
গো-রক্ষায় ধনঞ্জয়ের রণ অভিসার।
রণক্ষেত্রে চামুণ্ডা হইল আগুসার।।