সভায় শিশুপালের ভীষ্মনিন্দা
শিশুপাল কহিতে লাগিলেন, “হে ভীষ্ম! পার্থিবগণকে বিভীষিকা প্রদর্শন করিয়া লজ্জিত হইতেছ না কেন? বৃদ্ধ হইয়া কি কুলদূষক [কুলের কলঙ্ককারক হইয়াছ? এক্ষণে স্থবিরাবস্থা উপস্থিত এবং সমস্ত কৌরবের প্রধান হইয়াছ; অতএব ধর্ম্মসঙ্গত বাক্য প্রয়োগ করাই তোমার উচিত। যেমন কোন বৃহৎ তরণীর পশ্চাদভাগে একখানি ক্ষুদ্র নৌকা বদ্ধ থাকে, যেমন একজন অন্ধ অন্য অন্ধের অনুসরণ করে, হে ভীষ্ম! তুমি যাহাদের অগ্রণী, সেই কৌরবেরাও সেইরূপ হইয়াছে, তাহার সন্দেহ নাই। বিশেষতঃ এই বাসুদেবের পূতনাঘাত প্রভৃতি ক্রিয়াসকল কীর্তন করিয়া আমাদিগের অন্তঃকরণে সমধিক বেদনা প্ৰদান করিলে। হে ভীষ্ম! তুমি অহঙ্কৃত ও বিচেতন হইয়া দুরাত্মা কেশবের স্তুতিবাদ করিতে ইচ্ছা করিতেছ। এক্ষণে তোমার জিহ্বা কেন শতধা বিদীর্ণ হইতেছে না? যাহাকে বালকেরাও ঘৃণা প্রদর্শন করে, তুমি জ্ঞানবৃদ্ধ হইয়া সেই গোপালের প্রশংসা করিতেছ। কৃষ্ণ বাল্যকালে শকুনি [পক্ষীর ন্যায় আকাশে উড্ডীন তৃণাবাৰ্ত্ত] এবং যুদ্ধানভিজ্ঞ অশ্ব ও বৃষভ নষ্ট করিয়াছিল, তাহার আশ্চৰ্য্য কি? চেতনাশূন্য কাষ্ঠময় শকট পাদদ্বারা পাতিত করিয়াছিল, তাহাই বা এত কি অদ্ভূত কর্ম্ম? বল্মীকপিণ্ডমাত্র গোবৰ্দ্ধন পর্ব্বতকে যে সপ্তাহ ধারণ করিয়াছিল, তাহাই বা কি বিস্ময়কর? এই ঔদরিক বাসুদেব পর্ব্বতোপরি ক্রীড়া করিতে করিতে যে রাশীকৃত অন্নভোজন করিয়াছিল, তাহা শ্রবণ করিয়াই সেই মুগ্ধস্বভাব গোপবালকেরা বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিল। এই দুরাত্মা বলবান কংসের অন্নে প্রতিপালিত হইয়া তাহাকে সংহার করিয়াছে, এই কাৰ্য্যেই বা কি বিস্ময়ের বিষয় আছে? হে কুরুকুলাধম ভীষ্ম! তুমি অধাৰ্মিক, এই নিমিত্ত তোমাকে কিছু উপদেশ প্রদান করিতেছি শ্রবণ কর! সাধু ব্যক্তিরা সুশীলাদিগকে এই প্রকারে অনুশাসন করিয়া থাকেন যে স্ত্রী, গো, ব্রাহ্মণ, অন্নদাতা, প্ৰতিজ্ঞা দ্বারা আশ্বাসিত ব্যক্তির উপর শাস্ত্রপাত করিবে না। তোমার [কৃষ্ণের কাৰ্য্যে প্রশংসার সহিত সমর্থনকারী ভীষ্ম] ত’ তৎসমুদয়েরই অন্যথা দৃষ্টি হইতেছে। হে কৌরবাধম! আমি যেন কিছুই জানি না, তুমি যেন বয়োবৃদ্ধ হইয়া জ্ঞানবৃদ্ধ হইয়াছ, এই মনে করিয়া বহুতর প্রশংসা করিয়া কেশবের মহিমার উল্লেখ করিতেছ। হে ভীষ্ম! তোমার বাক্যে গোঘাতী ও স্ত্রীহত্যাকারীকে কি পূজা করিতে হইবে না? এমন ব্যক্তি কোন প্রকারে প্ৰশংসাভাজন হইতে পারে? হে ভীষ্ম! তোমার কথাতেও সে আপনাকে প্রাজ্ঞেশ্বর ও জগদীশ্বর বলিয়া অভিমান করিতেছে, তোমার বাক্যসমুদয় মিথ্যা হইলেও তোমাকে কিছু করিতে চাহি না। স্তাবকের স্তব অত্যুক্তিদোষে দূষিত হইলেও তাহার চাটুকারিতার নিমিত্ত কেহই শাসন করে না। কারণ, যাহার যে প্রকার স্বভাব ভূলিঙ্গনামক শকুনির [কাকাদি পক্ষী যেমন ভূতলে নামিয়া ভূতলশায়ী সুপ্ত সিংহের দংষ্ট্রালগ্ন মাংস চঞ্চু দ্বারা ঠোকরাইয়া খাইতে যাওয়ায় তাহার দুঃসাহস প্রকাশ পায়, শিশুপাল বলিতেছে, ভীষ্মেরও তাহার প্রতি কটূকটাক্ষ তথাবিধ দুঃসাহস প্ৰকাশমাত্ৰ।] ন্যায় কে তাহার অনুবতী। হইয়া চলে? তুমি জঘন্যপ্রকৃতি অধাৰ্মিক ও সৎপথচ্যুত, অতএব তুমি যাহাদিগের মন্ত্রী, কৃষ্ণ যাহাদিগের পূজনীয়, সেই পাণ্ডবদিগের স্বভাব যে দূষিত হইবে, তাহার সন্দেহ কি? হে ভীষ্ম! ধর্মের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া তুমি যে সকল কর্ম্ম করিয়াছ, কোন জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ আপনাকে ধাৰ্মিক জানিয়া সেই প্রকার করিয়া থাকে? ধর্ম্মজ্ঞ কাশিরাজের কন্যা অন্যের প্রতি কামনা করিয়াছিল, তুমি প্রজ্ঞাভিমানী হইয়া কোন ধর্ম্মানুসারে তাহাকে অপহরণ করিলে? তোমার ভ্রাতা সৎপথানুবর্তী ছিলেন, সুতরাং তোমার অপহৃত কন্যাদিগের প্রতি অভিলাষ করিলেন না; তুমি এমনই ধাৰ্মিক যে, তোমার সম্মুখেই তাঁহাদের গর্ভে অন্য দ্বারা পুত্ৰ উৎপাদিত হইল। হে ভীষ্ম! তুমি ব্ৰহ্মচৰ্য্য অবলম্বন করিয়াছ বলিয়া সেরূপ ঘটিয়াছিল এমন মনেও করিও না। তোমার ধর্ম্ম কি? তুমি যে ব্ৰহ্মচৰ্য্য অবলম্বন করিয়াছ, তাহা মোহপ্রযুক্ত বা ক্লীবত্বপ্রযুক্ত, সন্দেহ নাই। হে ধর্ম্মজ্ঞ! আমি কুত্ৰাপি তোমার উন্নতি দেখিতেছি না। কারণ, তুমি যে ধর্ম্ম প্রকাশ করিয়াছ, কোন বিজ্ঞ ব্যক্তিই তদনুসারে চলে না। ইষ্ট, দান, অধ্যয়ন ও বহুদক্ষিণ যজ্ঞ, এ সমুদয়ে অপত্যফলের ষোড়শাংশও নাই; অপুত্রব্যক্তির ব্ৰতোপবাসাদি সমুদয় বিফল হয়, তাহার সন্দেহ নাই। তুমিও তাদৃশ অপত্যধনে বঞ্চিত, বৃদ্ধ ও কপট ধাৰ্মিক। তুমি জ্ঞাতিগণের নিকট হংসের ন্যায় সংহার প্রাপ্ত হইবে। [পুরাণবেত্তারা ‘হে পত্ররথ! কাম ক্রোধাদি দ্বারা অন্তরাত্মা অভিহিত হইলে পর রোদন করিতেছে’, ইত্যাদিরূপে যে গাথা গান করেন, হে ভীষ্ম! এক্ষণে সেই হংসের উপাখ্যান শ্রবণ কর। এক্ষণে প্রাজ্ঞ মনুষ্যেরাও এই প্রকার কহিয়া থাকেন]। পূর্ব্বকালে সমুদ্রপ্রান্তে ধর্ম্মভাষী অধর্ম্মচারী এক বৃদ্ধ হংস ছিল। সে পক্ষীদিগকে ‘ধর্মের অনুষ্ঠান কর, অধর্ম্মচারণ করিও না’, এই প্রকার উপদেশ প্রদান করিত, অন্যান্য সমুদ্রচারী পক্ষিগণ তাহাকে সত্যবাদী জ্ঞান করিয়া তাহার বাক্য শ্রবণ করিত এবং ইহার নিকট ধর্ম্মার্থের উপদেশ পাইয়াছি, এই ভাবিয়া তাহার আহার আহরণ করিত। তাহারা তাহার নিকটে আপনাপন অণ্ডসকল গচ্ছিত রাখিয়া চরিতে চরিতে সমুদ্রজলে নিমগ্ন হইত। পক্ষীরা তাহার বাক্যে বিশ্বাস করিয়া অনবহিত হইয়াছিল, কিন্তু দুরাত্মা হংস আপনার কাৰ্য্যে বিলক্ষণ মনোযোগী থাকিত। সে তদবসরে তাহাদের অণ্ডগুলি ভক্ষণ করিত, সেই সমুদয় ডিম্ব বিনষ্ট হইলে কোন প্রজ্ঞাবান পক্ষী সন্দিহান হইয়া সেই দুরাচারের পাপাচার দৃষ্টিগোচর করিয়া সাতিশয় দুঃখিতচিত্তে অন্যান্য পক্ষীদিগকে বিজ্ঞাপণ করিল। তাহারা সমীপবর্তী হইয়া প্ৰত্যক্ষদর্শন করিয়া সেই কপটাচারী মরালের প্রাণসংহার করিল। হে ভীষ্ম! তুমি সেই হংসের সমানধর্মী, নৃপতিগণ পক্ষিগণস্বরূপ, অতএব তাহারা ক্রুদ্ধ হইয়া তোমাকেও সেই প্রকার নিহত করিবে। এই অণ্ড ভক্ষণরূপ অশুচি কর্ম্ম তোমার বাক্যকে অতিক্রম করিতেছে।”