বসে আছি ক্লিভল্যান্ড বাস স্টেশনে। এই শহরে আমার চেনাশুনো কেউ নেই, তাই এখানে আর থাকা হবে না। যদিও ক্লিভল্যান্ডে বাঙালির সংখ্যা অনেক, বেশ ধূমধাম করে দুর্গাপুজো হয় শুনেছি।
আমি যদিও এদেশের দুর্গাপুজো দেখিনি একটাও, তবে অনেক গল্প শুনেছি। যুক্তরাষ্ট্রের সব বড় শহরেই বাঙালির দুর্গাপুজো হয়, কোনও-কোনও শহরে একাধিক। এখানকার বাঙালিরা পুজোর ব্যাপারটা বেশ আধুনিক করে নিয়েছে। পঞ্জিকার তোয়াক্কা করে না। যেহেতু ছুটি পাওয়ার কোনও উপায় নেই, তাই পশ্চিমবাংলার দুর্গাপুজোর দিনের কাছাকাছি কোনও শনি বা রবিবারে পুজো হয় এখানে। চারদিন ধরে নয়, একদিনেই। কোথাও নাকি পুজো হয় মোট চার ঘন্টা, প্রথম ঘন্টায় সপ্তমী আর চতুর্থ ঘন্টায় বিজয়ার কোলাকুলি। শাস্ত্রকাররা তো বলেই দিয়েছেন, প্রবাসে নিয়ম নাস্তি।
আমার ইচ্ছে এখন শিকাগো যাওয়ার। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নিউ ইয়র্কের দিকে চলে আসার পর আবার শিকাগোর দিকে ফিরে যাওয়াটা অনেকের কাছে পাগলামি মনে হতে পারে। কিন্তু বাসের সিজন টিকিট কেটে নিয়েছি, এখন এত বড় দেশটার যেখানে খুশি যেতে পারি। আমার আর অতিরিক্ত ভাড়া লাগে না।
চোখে কালো চশমা, হাতে একটা ছড়ি, মাথার চুল লালচে রঙের একজন প্রৌঢ় বলশালী সাহেব আমার পাশে এসে বসলেন। তারপর পকেট থেকে সিগারেট দেশলাই বার করে ধরাতে গিয়ে দেশলাই-এর পাতাটা পড়ে গেল মাটিতে। লোকটি নীচু হয়ে হাতড়ে-হাতড়ে দেশলাইটি খুঁজতে লাগলেন, কিন্তু ঠিক সেটা ছুঁতে পারছেন না। আমি দেশলাইটি তুলে দিলুম ওঁর হাতে।
লোকটি বললেন, থ্যাঙ্কস! আচ্ছা বলো তো, পাঁচ নম্বর গেটে যে বাসটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটা কি ডেট্রয়েটের?
আমি বললুম, না। ও বাসটা তো দেখছি সল্টলেক যাচ্ছে।
প্রৌঢ়টি বললেন, আমার বাসটা যে কোন গেটে আসবে, কখন ছাড়বে কিছুই বুঝতে পারছি না। আজকাল এই এক ফ্যাশান হয়েছে। অ্যানাউন্স করে না, বাস টাইমিং টিভি-তে দেখায়। তাতে আমার মতন লোকের কী সুবিধে হয়?
এবারে লক্ষ করলুম, লোকটির হাতের ছড়িটি সাদা রঙের। অর্থাৎ লোকটি অন্ধ।
সত্যিই তো, এখন অনেক জায়গাতেই টিভি-তে বাসের খবরাখবর দেখা যায় শুধু। তাতে আমাদের সুবিধে হলেও অন্ধদের কথা তো চিন্তা করা হয়নি।
আমি বললুম, আপনি কোথায় যাবেন? আমি জেনে দিতে পারি?
তুমি আমার জন্য এটুকু কষ্ট করবে? দ্যাটস অফুলি কাইন্ড অফ ইউ!
ঘুরে এসে জানালুম, ওঁর ডেট্রয়েটের বাস ছাড়তে আরও ঠিক এক ঘন্টা বাকি আছে। পাঁচ নম্বর গেটেই বাস ছাড়বে।
ভদ্রলোক আবার প্রচুর ধন্যবাদ জানিয়ে তারপর জিগ্যেস করলেন, তুমি কি ব্রিটিশ? তোমার উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছে–
আমি চমৎকৃত হলুম। আমার টুটো-ফুটো ইংরেজি শুনে এরকম কমপ্লিমেন্ট আগে আর কেউ দেয়নি।
–না আমি ভারতীয়। এ দেশের ভারতীয় নয়, ভারতের ভারতীয়।
লোকটি একটু চিন্তা করে বলল, তোমাদের ভারত এক সময় ব্রিটিশ কলোনি ছিল না? আমার মনে আছে, আমার গ্র্যান্ডফাদার তোমাদের দেশের খুব প্রশংসা করতেন। উনি ওঁর বাবার সঙ্গে আয়ারল্যান্ড ছেড়ে চলে এসেছিলেন এখানে। ওঁদের খুব রাগ ছিল ব্রিটিশদের ওপর।
–আপনারা আইরিশ?
–না, না, আমি আইরিশ নই। আমি অ্যামেরিকান। আমার পূর্বপুরুষ ছিল আইরিশ। অবশ্য, আয়ারল্যান্ড সম্পর্কে আমার মনে একটু দুর্বলতা আছে ঠিকই। এখন যে আয়ারল্যান্ডে মারামারি চলছে, সে জন্য আমি কনসার্নড় হয়ে পড়ি মাঝে-মাঝে।
–আপনি সিস্টার নিবেদিতার নাম শুনেছেন?
–সে কে?
–আগে নাম ছিল মিস মাগারেট নোবল। তিনি আমাদের দেশে গিয়ে হিন্দু হয়েছিলেন, আমাদের দেশের জন্য অনেক কাজ করেছেন।
–না, শুনিনি। আমি অনেক কিছুই জানি না। আমি বেশি লেখাপড়া জানা লোক নই। সারাজীবন কাজ করেছি একটা এক্সপ্লোসিভ ফ্যাক্টরিতে। এমনকী আয়ারল্যান্ড আমি কখনও দেখিনি। ঠাকুরদার কাছে গল্প শুনেছি শুধু। ভেবেছিলুম রিটায়ার করার পর সারা পৃথিবী ঘুরতে বেরুব, তখন একবার আয়ারল্যান্ডেও যাব। কিন্তু দু-বছর আগে অ্যাকসিডেন্ট হল, তাতে চোখ দুটো গেল। কোম্পানি অনেক টাকা দিয়েছে অবশ্য, কিন্তু আয়ারল্যান্ড আর আমার দেখা হবে না। তবে ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ, তিনি শুধু চোখ দুটো নিয়ে আমার প্রাণটা তো বাঁচিয়ে রেখেছেন–
বুঝলুম, ভদ্রলোক কথা বলতে ভালোবাসেন। চোখাচোখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে সব কথা না শুনলেও চলে। শুধু মাঝে-মাঝে হুঁ-হাঁ দিয়ে গেলেই হল। আমি সন্তর্পণে একটা গল্পের বই খুলতে যাচ্ছিলুম, এমন সময় তিনি জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা বলো তো, অন্ধ হয়ে থাকার চেয়ে কি একেবারে মরে যাওয়া ভালো ছিল?
এরকম অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। সুতরাং আমতা-আমতা করে ধোঁয়াটেভাবে বললুম, সেটা নির্ভর করে, কে কতটা জীবনকে ভালোবাসে–
ভদ্রলোক বললেন, আমি জীবনকে খুবই ভালোবাসি। শুধু বেঁচে থাকাই খুব সুন্দর। যখন কম বয়স ছিল, তখন মনে হত, মৃত্যুটা কিছুই না, যে কোনো সময় মরে গেলেই হয়। কিন্তু এখন বুঝতে পারি, মৃত্যুকে যতক্ষণ দূরে সরিয়ে রাখা যায়, ততই ভালো। তা ছাড়া, জানো, অন্ধ হলে এমন অনেক কিছু দেখতে পাওয়া যায় যা আমি আগে দেখিনি।
–যেমন?
–আমার স্ত্রী অ্যালাবামার মেয়ে। অ্যালাবামা কোথায় জানো?
–দক্ষিণ অঞ্চলে।
–এখানে কি কাছাকাছি কোনও নিগ্রো অর্থাৎ কালো লোক বসে আছে?
–আমি নিজেই তো কুচকুচে কালো।
–ভারতীয় কালো নয়, আমেরিকান কালো?
–না, এখানে আর কেউ বসে নেই।
–আমার স্ত্রী ওই কালোদের একদম দেখতে পারে না। আমার নিজেরও কিছুটা প্রেজুডিস ছিল। আমার মেয়ে একটা কালো ছেলের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করত, আমার ছেলের বন্ধুরা তাকে খুব ঠ্যাঙাল। তাতে আমরা খুশিই হয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারি। মাই গড, হোয়াট স্টুপিডিটি! মানুষের গায়ের রঙে কী আসে যায়? চোখ থাকতে সেটা বুঝতে পারিনি, সেজন্য এখন আমার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে।
এত সরল ব্যাখ্যা শুনে আমি ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারলুম না। আমি কালো লোক বলেই কি লোকটি আমায় খুশি করার জন্য এই কথা বললেন? অবশ্য ওঁর গলায় বেশ একটা আন্তরিকতা আছে।
লোকটি আসলে খুব সরলই। এর পরেও উনি এমন সব সাদামাটা কথা বলতে লাগলেন, যা আসলে খুব সার সত্য হলেও সেসব কথা আমরা আজকাল আর মুখে আলোচনা করি না। যেমন এর পরেই তিনি বললেন, আগে আমার খুব টিভি দেখার বাতিক ছিল। কারখানা থেকে বাড়ি ফিরেই আঠার মতন চোখ আটকে রাখতুম টিভি’র পরদায়। এখন আর টিভি দেখি না। তবে রেডিও শুনি। মাই গড, চারদিকে শুধু যুদ্ধের খবর আর খুনোখুনি। জীবন এত মূল্যবান, তবু মানুষ মানুষকে মারে কেন? ভগবান আমাদের জীবন দিয়েছেন, অথচ মানুষই তা নষ্ট করে দেয়।
এত সাদাসিধে আমেরিকানের সঙ্গে আগে আমার পরিচয় হয়নি। সুতরাং খানিকটা কৌতুকের সঙ্গেই আমি ওঁর কথা শুনতে লাগলুম।
হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে উনি আমায় জিগ্যেস করলেন, তুমি কি রিপাবলিক্যান?
আমি বললুম, আপনি ভুল করছেন, আমি এদেশের নাগরিক নই, বেড়াতে এসেছি মাত্র।
ভদ্রলোক আমার উত্তর গ্রাহ্য না করে বললেন, এই যে রেগান, তুমি একে সাপোর্ট করো? মাই গড, এ তো দেশটার সর্বনাশ করে ছাড়বে। তুমি জানো, এবারের বাজেটে শিক্ষার জন্য টাকা কমিয়ে দিয়ে সেই টাকা ঢালছে অস্ত্র বানাবার জন্য। ইস্কুলের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের খাবারের খরচ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। মাই গড, এ লোকটা কি বাচ্চাদেরও ভালোবাসে না? এ কি চায়, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় চর্চা ছেড়ে দিয়ে সবাই সেনাবাহিনীতে নাম লেখাবে?
এরকম আলোচনায় অংশগ্রহণ করা আমার পক্ষে রীতিবিরুদ্ধ হবে বলে আমি চুপ করে রইলুম।
ভদ্রলোক আবার বললেন, আমি কালকেই খবরে শুনলুম, নেভাডায় মাটির নীচে আবার একটি আণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এসব কীসের জন্য, বলতে পারো? আমরা আমেরিকানরা শান্তিতে থাকতে চাই। তুমি জানো নিশ্চয়ই, আমাদের সংবিধানে আছে আমরা কোনোদিনই অন্য দেশ আক্রমণ করব না। এটা আমি জানতুম না, রেডিয়োতেই একজন বলল। পেন্টাগানে কতকগুলো বাজপাখি বসে আছে, তাদের ডানায় ভর দিয়ে পৃথিবীটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়ার জন্য উড়ে চলেছে এই রিপাবলিকান রেগন! এটা আমি একদিন স্বপ্নে দেখলুম, জানো! মাই গড, ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা যুদ্ধ-বিরোধী শান্তি মিছিলের ওপর পুলিশ হামলা করেছে। এ রকম কথা আগে কখনও শুনেছ?
ভদ্রলোক তাঁর একটা হাত তুলে মাথার চুলে বুলোতে লাগলেন। কালো চশমা-পরা চোখ দুটি আমার দিকে ফিরিয়ে বললেন, আমি যে কারখানায় এতদিন কাজ করেছি, সেখানে অস্ত্র বানানো হয়। আমি নিজেও এতদিন তা বানিয়েছি। সেইসব অস্ত্র পৃথিবীর অন্য অন্য দেশে যায়। এখন আমি বুঝতে পারছি, আমার মতন আরও কত মানুষ অন্ধ হয়, মানুষের হাত-পা ভাঙে, প্রাণও যায়। মাই গড এটা এতদিন আমি খেয়াল করিনি, আমি এত বোকা ছিলাম!
তারপর ধরা গলায় তিনি বললেন, ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ, তিনি আমায় অন্ধ করেছেন বলেই এখন আমি এসব বুঝতে পারছি। আসলে, যাদের চোখ আছে, তারাই বেশি অন্ধ। তাই না, তুমি এ কথা মানো না?
আমি বললুম, আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল। আমার বাস এসে গেছে, আমি এবার উঠি?
–যুবক, তুমি কোথায় যাচ্ছ জিগ্যেস করতে পারি?
–আপাতত শিকাগো শহরে।
–যদি সময় পাও, পরশুদিন একবার ডেট্রয়েটে এসো। সেদিন ওখান থেকে আর একটা শান্তি মিছিল বেরুবে। তাতে যোগ দেওয়ার জন্যই আমি যাচ্ছি।
প্রৌঢ় এবারে তাঁর একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি সেই হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলুম। সেই হাতখানি বেশ আত্মীয়ের মতন উষ্ণ।