প্রতীক্ষা, সন্দেহ, ত্রাস
কর্নেল দুহাঁটুতে হাত রেখে কুঁজো হয়ে সাপটিকে দেখছিলেন। বুনো ফুলের একটি জাঁকালো ঝোপ এক টুকরো ধ্বংসস্তূপের গা ঘেঁষে গজিয়ে উঠেছে। তার ভেতর চকরাবকরা ছায়া। সেখানে চিত্রবিচিত্র ছোট্ট সাপটি কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। প্রাকৃতিক ক্যামফ্লেজের ফলে সাপটির অস্তিত্ব টের পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু কর্নেল প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে জানেন, চেনেন। প্রকৃতির কাছাকাছি হলেই তার যেন একটি বাড়তি ইন্দ্রিয় শামুকের শুড়ের মতো খুলির ভেতর সন্তর্পণে উত্থিত হয়। বিভীষিকারও সৌন্দর্য আছে প্রকৃতিতে, সাপটি দেখতে দেখতে ভাবছিলেন কর্নেল। বৃষ্টিধোয়া নিসর্গে এখন যত উজ্জ্বলতা, তত বিভীষিকা দুহাত নিচে বন্যার জল দুলছে। সাপটি এবং বন্যা দু-ই প্রকৃতির সৌন্দর্য ও বিভীষিকার যুগপৎ প্রতীক বলা চলে। তবে প্রকৃতি জীবিত ও মৃতে ফারাক করে না। ওই রক্তাক্ত মৃতদেহগুলিও এখন প্রকৃতির অন্তর্গত হয়ে গেছে। রক্ত ও কান্নার পৃথক মূল্য দেয় না প্রকৃতি।
পেছনে একটু শব্দ। কর্নেল দ্রুত সোজা হলেন। ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখলেন, ক্লারা।
ক্লারা হাসল। আপনি সম্ভবত ভয় পেয়েছিলেন!
পেয়েছিলাম। কর্নেল স্বীকার করলেন। কিন্তু তুমি এভাবে একা ঘুরে বেড়িও না। ভারতীয় প্রকৃতি খুব বিপজ্জনক। এ তোমাদের সাজানো-গোছানো হাতেগড়া মার্কিন প্রকৃতি নয়। এর নিজস্বতা আছে, ক্লারা! প্রচণ্ডরকমের নিজস্বতা!
কর্নেল হাসছিলেন। ক্লারা সিরিয়াস হয়ে বলল, কিছুটা বুঝতে পেরেছি। এই নিজস্বতা আমাকে আকর্ষণ করছে। এ একটা আশ্চর্যজনক আদিমতা। এর ভেতরে ঢুকতে চাই। ভেতরে আপাতত একটি সাপ আছে। কর্নেল ঝোপটির দিকে আঙুল দেখালেন। দেখতে পারো!
ক্লারা উৎসাহে ঝুঁকে গেল। কিন্তু সাপটিকে দেখতে পেল না। কর্নেল উঁকি মেরে দেখে বললেন, হুঁ, লুকিয়ে পড়েছে। সরে এসো। আর শোনো, এভাবে একা ঘুরো না। প্রদোষ কোথায়?
ক্লারা কয়েক পা সরে একটু ফাঁকায় দাঁড়িয়ে বলল, বাইনোকুলার নিয়ে ওদিকে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে। ত্রাণকারীদের নৌকা খুঁজছে। দারোগামহাশয় আদেশ দিয়েছেন, চারদিকে সকলে ত্রাণকারীদের নৌকা খুঁজবে। আমি চাই, ত্রাণকারীদের নৌকা দেরি করে আসুক। কারণ আমার কাছে বিষয়টি অত্যন্ত উপভোগ্য।
কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একটি চুরুট বের করে লাইটার জ্বেলে ধরালেন। তারপর ক্লারার দিকে ঘুরলেন। ক্লারা, আমার মনে হয়, তোমার প্রদোষের কাছে যাওয়া উচিত। সে তোমার জন্য উদ্বিগ্ন হতে পারে।
ক্লারা শক্ত মুখে বলল, হবে না। আমার স্পষ্ট বলা উচিত, সে আমাকে আর পছন্দ করছে না।
কর্নেল আস্তে বললেন, এ তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
তথাপি আপনাকে জানাতে চাই। আপনি শুনুন। আমি কিছু লুকিয়ে রাখা সঠিক মনে করি না।
কর্নেল অবাক হয়ে তাকালেন। ক্লারাকে রাগী দেখাচ্ছিল। বললেন, বলো ক্লারা!
ক্লারা চাপাস্বরে বলল, কাল বিকেলে একটা ঘটনা ঘটেছিল। প্রদোষ যদিও বলল, শাওনি তাকে ব্ল্যাকমেল করছে, আমি বিশ্বাস করিনি। প্রদোষকে আমি জানি। সে শাওনিকে একা পেয়ে অসভ্যতা করে থাকবে। সে আমাকে বিবাহ করে সুখী হয়নি। সে প্রকৃতপক্ষে একজন মেমসাহেব অর্জন করতে চেয়েছিল। ভারতে সে এটি একটি কৃতিত্ব হিসাবে দেখাতে চেয়েছে। একটি খেলার সামগ্রী মাত্র! এবং আমি জানি, ভারতীয় মাত্রেই এতে গৌরবান্বিত বোধ করে।
কর্নেল হাসলেন না। আর গম্ভীর হয়ে বললেন, বুঝলাম।
এখনও বুঝতে পারেননি! ক্লারা তেতো মুখে বলল। আমার কথাটা ভেবে দেখুন। আমি কী চেয়েছিলাম? একজন ভারতীয় পুরুষকে। প্রদোষ আমাকে ইওরোপীয় পোশাকে দেখতে চায়। আমার এই ভারতীয় নারীর পোশাক তার সহ্য হয় না। আমরাও সহ্য হয় না প্রদোষের ইওরোপীয় পোশাক।
হুঁ–বুঝলাম।
ক্লারা একই সুরে বলল, আমি প্রকৃত ভারতীয় পূজা দেখতে চেয়েছিলাম। প্রদোষ তার মামার বাড়িতে পূজা দেখাতে নিয়ে এল। বন্যায় এই দ্বীপে আটক হলাম। প্রদোষের গাড়ি ভেসে গেল। এখন বুঝতে পারছি, তার উদ্দেশ্য ছিল সগৌরবে মামার বড়িতে একটি খেলার সামগ্রী প্রদর্শন। কারণ সে এই আটক অবস্থার মধ্যে সর্বদা আমাকে ইওরোপীয় পোশাক পরতে বলছে। সুতরাং আমার সিন্ধান্ত, আমি ত্রাণকারীদের নৌকা এলে আপনার সঙ্গে কলিকাতা ফিরে যাব। তারপর–
কর্নেল হঠাৎ বললেন, শাওনি প্রদোষকে ব্ল্যাকমেল করেছিল বললে?
ক্লারা নিষ্ঠুর মূর্তিতে বলল, প্রদোষই তাকে হত্যা করেছে বলে আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে।
হুঁ! কিন্তু পুঁতিকে?
প্রদোষের পক্ষে অসম্ভব নয়। পুঁতির দিকেও তার চোখ পড়েছিল সম্ভবত।…ক্লারার চোখে জলের ফোঁটা দেখা গেল। আস্তে বলল, আমি তার চরিত্রের ইতিহাস কতটুকু জানি? শুধু এইটুকু আভাস দিতে চাই, সে একজন অতিশয় কামুক পুরুষ।
বলেই ক্লারা চলে গেল। গাছপালা-ঝোপজঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। কর্নেল ফের ঝুঁকে গেলেন ফুলন্ত ঝোপটির দিকে। সাপটিকে খুঁজতে থাকলেন।…
ব্ৰজহরি গাছের শেকড়ে বসে জলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ডানদিকে কিছুটা দূরে কুকুরটিকে ছিঁড়ে খাচ্ছে এক ঝক শকুন। ভাবছিলেন, কর্নেলসায়েব লোকটির মাথা এখনও ঠাণ্ডা আছে। বাদবাকি সবাই প্রায়ই প্রায় পাগল হয়ে গেছে। ব্ৰজহরির নিজের অবস্থাও তাই সেটা বুঝতে পারছেন। এই যে হাটাৎ-হঠাৎ মনে হচ্ছে জলে ঝাঁপ দিতে, সেটাও পাগলামির লক্ষণ বলা চলে। জোর করে ইচ্ছেটাকে ঠেকিয়ে রাখছেন। কখনও ইচ্ছে করছে শকুনগুলোকে ঢিল ছুঁড়ে তাড়ান। বড় চাচামেচি করছে ব্যাটাচ্ছেলেরা! আবার তখনই মনে হচ্ছে, বেশ্যা মেয়েটাকে অমন করে তুলে এনে পাশের ঘরটাতে রাখা হল, মেমসায়েবের দরদ উথলে উঠল এবং ভাবা যায় না, একটা সুন্দর সিল্কের শাড়িতে ঢেকে দিল,তা না করে শকুনগুলোর মুখের সামনে ছুঁড়ে ফেলা উচিত ছিল না?
আর ওই মেয়েটাকেও! আগে যদি জানতেন, ওকে রিকশোওলা ছোকরা ভাগিয়ে এনেছে, তাহলে তারও বডি তুলতে বাধা দিতেন। দারোগাবাবুর কাছে সব কবুল করল ছোকরা, ধমকের চোটেই করল– অথচ দারোগাবাবুটি তাকে কিছু বললেন না আর! নিশ্চয় টাকা খেয়েছেন। বংকুবিহারী যে ঘুসখোর; ব্ৰজহরি তা জানেনই। নতুন কথা আর কী?
পেছনে একটা শব্দ হল। দারুণ আঁতকে উঠে ব্ৰজহরি তড়াক করে দাঁড়িয়ে ঘুরলেন। বংকুবিহরীকে দেখে হাসলেন …ও আপনি? আসুন, আসুন। এক্ষুনি আপনার কথা ভাবছিলাম। অকেদিন বাঁচবেন।
আর বাঁচা! বংকুবিহারী শ্বাস ছেড়ে বললেন। সে-আশা ছেড়ে দিয়েছি। আপনিও দিন।
ভয় পাওয়া মুখে ব্রজহরি বললেন, সে কী! নতুন কিছু কি ঘটেছে?
বংকুবিহারী প্রায় গর্জন করলেন। ওই শকুনগুলো! ওরা কেন এসেছে বুঝতে পারছেন না? আমাদের জ্যান্ত ছিঁড়ে-ছিড়ে খাবে।
ব্ৰজহরি ব্যস্তভাবে বললেন, সেটাও তো ভাবছিলাম এতক্ষণ। চলুন, ইটপাটকেল। ছুঁড়ে ওদের তাড়িয়ে দিই!
বংকুবিহারী রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন মুখের। তারপর শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, দূরে একটা নৌকো দেখতে পেয়েছিলেন ওই ভদ্রলোক এম এল এর ভাগ্নে। ছাদ থেকে বাইনোকুলারে দেখেছিলেন।
তারপর, তারপর?
তারপর আর কী? চলে গেল।
রুমাল নাড়তে বললেন না কেন। আগুন জ্বেলে ধোঁয়ার সাহায্যেও অবশ্য দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেত।
ধূর মশাই! বাইনোকুলারে দেখা নৌকো। খালি চোখে দেখাই গেল না। বংকুবিহারী কান পাতলেন ডানদিকে। অসহ্য! শকুনগুলোর একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
ব্ৰজহরি একটা ইট কুড়িয়ে নিলেন পায়ের কাছ থেকে। পা বাড়িয়ে বললেন, চলুন! সবাইকে ডাক দিন। প্রচুর ইট আছে সাবধানে। আগে ইটগুলো এক জায়গায় জড়ো করে তারপর একসঙ্গে ছুঁড়তে শুরু করব।
বংকুবিহারী গুম হয়ে ভাবছিলেন। বললেন, পরে, পরে। ভাবছি, একটা গুলি ছুঁড়ে দেখব। একটা মারা পড়লে রিঅ্যাকশান বোঝা যাবে ওদের। ব্রজহরি লাফিয়ে উঠলেন।…তাই তো! আপনার কাছে পিস্তল আছে!
এটা পিস্তল নয়, রিভলবার।
একই কথা। ব্ৰজহরি খুশিতে হাসলেন।
একই কথা নয় মশাই! বংকুবিহারী বললেন। পিস্তল আর রিভলবার আলাদা জিনিস। ছটা গুলি ছিল। সাপ মারতে দুটো গেছে। আর চারটে আছে। পিস্তল হলে আঠারোটা পর্যন্ত গুলি থাকত। ভাবতে হত না! কিন্তু রিভলবার বলেই ভাবতে হচ্ছে। এখনও আমরা নিরাপদ নই।
ফের চমকে উঠলেন ব্ৰজহরি। চাপাস্বরে বললেন, তেমন কিছু কি–
বংকুবিহারী চারদিক দেখে নিয়ে বললেন, কর্নেলসায়েবের তালডোঙার গপ্পো আমি বিশ্বাস করি না।
হু। লোকটি সন্দেহজনক। গতিবিধিও সন্দেহজনক।
আমার দৃঢ় ধারণা খুনী আমাদের মধ্যেই আছে, চেনা যাচ্ছে না।
বলেন কী! ব্রজহরি ভড়কে গেলেন। তাহলে তো একা-একা বসে রিলিফের নৌকোর খোঁজ করা বড় বিপজ্জনক। রীতিমতো রিস্কি।
রিস্কি হলেও উপায় নই। বংকুবিহারী নির্বিকার মুখে বলেন। সাবধানে থাকলেই হল। একটু ফাঁকা জায়গা দেখে বসলেই হল। আপনি যেখানে বসেছিলেন, পেছনে গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে খুনী আপনার ওপর ঝাঁপ দিলেই হল! শেষে–
কাঁচুমাচু মুখে ব্রজহরি বাধা দিলেন, কী যে বলেন! আমাকে কেন খুন করবে কেউ?
কিছু বলা যায় না। সাবধানে থাকুন। বলে বংকুবিহারী বুটের শব্দ তুলে চলে গেলেন।
ব্ৰজহরি ইটটি ফেললেন না। একটু এগিয়ে ফাঁকা জায়গায় একটা লাইম কংক্রিটের চাঙড়ে বসলেন। খুব দুঃখিত দেখাচ্ছিল তাঁকে। দারোগাবাবুটি তাঁকে এভাবে ভয় না দেখালে পারতেন। তিনি এলাকায় আসা অব্দি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। রাতদুপুরে ঝড় বৃষ্টিতে রোগীর বাড়ি থেকে ডাক এলে তিনি তক্ষুনি বেরিয়ে পড়েন। একটি পয়সা বেশি ভিজিট নেন না। এমন মানুষকে কে খুন করবে কেনই বা করবে?
হঠাৎ একটু চমক খেলেন মনে-মনে। ওই লোকটা স্কুল-শিক্ষক বলে পরিচয় দিয়েছেন যে, হুঁ–হর্ষনাথ! হর্ষনাথ কাল বিকেলে বেশ্যাটার ওপর জবরদস্তি করছিল। বেশ্যাটাকে ব্ৰজহরি ভীষণ ঘৃণা করেছেন, সে জানে। বেশ্যাটা শেষ পর্যন্ত খুন হয়েছে। এখন কথা হল, হর্ষনাথ যদি তাকে খুন করে, থাকে তাহলে ব্ৰজহরিকেও খুন করার ইচ্ছে জেগে ওঠা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। প্রতিহিংসাবশত–হুঁ, প্রতিহিংসা! কারণ তার পয়লানম্বর পাপ অর্থাৎ ধর্ষণের চেষ্টার বাধা ছিলেন ব্রজহরি!
ব্ৰজহরি মরিয়া হয়ে গেলেন এবং ইটটি শক্ত করে ধরলেন। মনে মনে বললেন, আয়! কাম অন! মুণ্ডু থেঁতো করে দেব ব্যাটাচ্ছেলের!…
তখন ঘনশ্যাম একটা ইটের চাঙড়ে বসে ঢুলছিলেন। ভাবনার ক্লান্তিজনিত ঢুলুনি। খালি পেটে বিপ্লব হয় না। প্রকৃতি বাধা দিলে বিপ্লব হয় না। রোগা, ক্ষুকাতর ক্ষেতমজুর দিয়ে বিপ্লব হয় না। সংগঠন গড়ে ছোটখাটো লড়াই করতে করতে বড় লড়াইয়ের দিকে এগোনো যায় বটে, কিন্তু বিপ্লব আলাদা জিনিস। বিপ্লব সামরিক ঘটনা। কারণ রাষ্ট্র সামরিকভাবে শক্তিশালী। তাই পাল্টা সামরিক সংগঠন চাই। ধুস! কী করলেন এতটা কাল– জীবনভর?
নিজের ওপর রেগে গিয়ে ঘনশ্যামের ঢুলুনিটা কেটে গেল। দেখলেন, বন্যার জল ইঞ্চি ছয়েক নেমে গেছে। সামনে তাকালেন। রিলিফের নৌকো না ঘোড়ার ডিম! ঘণ্টায় তিন ইঞ্চি করে যদি জলটা নামে, তাহলে মাটি জাগতে কতক্ষণ লাগবে হিসেব করতে গিয়ে পেছনে শব্দ। দারুণ চমকে ঘুরে বসলেন ঘনশ্যাম।
দারোগাবাবু বংকুবিহারী। বললেন, কী? চোখে পড়ল কিছু?
ঘনশ্যাম মাথা দোলালেন। তারপর গম্ভীর মুখে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, জল নামছে। এই দেখুন!
বংকুবিহারীর নজর গেল আঙুলের দিকে। আঙুলটা তর্জনী এবং ডগায় পট্টিবাঁধা। বললেন, আঙুল কাটলেন কিসে?
ঘনশ্যাম হকচকিয়ে বললেন, খিচুড়ি বের করার সময় ইট সরাতে গিয়ে
বংকুবিহারী বাধা দিলেন। কিন্তু তখন আমরা কেউ দেখিনি। আপনি বলেননি!
আহা, তেমন বলার মতো কিছু নয় বলেই বলিনি। জাস্ট একটুখানি আঁচড় মাত্র।
আমাদের সঙ্গে একজন ডাক্তার আছেন। আপনি তাকে বললেই ব্যান্ডেজ পেতেন। বংকুবিহারী সন্দিগ্ধভাবে বললেন। তাছাড়া এ টি এস ইঞ্জেকশানও পেতেন। কারণ এ থেকে টিটেনাস হওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু সে-সব কিছুই করেননি। ওটা কী জড়িয়েছেন?
ঘনশ্যাম ভেতর-ভেতর খাপ্পা। কিন্তু মুখে কাঁচুমাচু ভাব ফুটিয়ে বললেন ছেঁড়া লুঙ্গির একটা ফালি।
কোথায় পেলেন?
ঘনশ্যাম ফোঁস করে বললেন, আশ্চর্য!
আশ্চর্য তো বটেই। বংকুবিহারী ঝুঁকে গেলেন তার দিকে। কৈ, খুলুন– দেখি কী অবস্থা।
যদি না দেখাই? ঘনশ্যামের মুখ লাল। চোখ বড়ো। নাকের ফুটো ফুলে উঠল।
বংকুবিহারী গলা চড়িয়ে বলেলেন, তাহলে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হবে।
বেশ। করুন। ঘনশ্যামের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। এ ঘনা রুদ্রকে অসংখ্যবার অ্যারেস্ট করা হয়েছে।
বংকুবিহারী চমকে উঠে বললেন, ঘনা রুদ্র? মাই গুডনেস! তার মানে ঘনশ্যাম রুদ্র? পলিটিকাল অ্যানডার? রিভলবার বেরিয়ে এল ঝটপট।.ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। উঠুন! আর আপনার ব্যাগটা দিন।
বাঁকা হেসে ঘনশ্যাম তার কাপড়ের ব্যাগটা ছুঁড়ে দিলেন সামনে। বংকুবিহারী সেটা কুড়িয়ে নিয়ে রীতিমতো তল্লাস করে ফেরত দিলেন। বললেন, আপনি আসুন আমার সঙ্গে।
নিয়ে যাবেনটা কোথায়? ঘনশ্যাম খ্যাখ্যা করে হেসে উঠলেন। মরিয়া হাসি। চলুন, নিয়ে চলুন! যাচ্ছি!
বংকুবিহারী ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবছিলেন। পুলিশ রেকর্ডে লোকটিকে বিপজ্জনক ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা আছে। বলা যায় না, রিভলবার বা পিস্তল থাকতেও পারে জামার পকেটে কিংবা কোমরে ধুতির ভঁজে লুকোনো। তার চেয়ে বড় কথা, গ্রেফতার করে বড়জোর আস্তানা ঘরে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তারপর? বন্যার জল কখন নামবে, কিংবা কখন দৈবাৎ একটা রিলিফের নৌকো এসে পড়বে– সেই অনিশ্চিত সময়ের জন্য তাকে পাহারা দিয়ে বসে থাকতে হবে। কী করা উচিত ঠিক করতে পারছিলেন না অইনরক্ষক।
ঘনশ্যাম বাঁকা মুখে বললন, কী হল? আসুন!
বংকুবিহারী, রিভলবার তুলে শাসালেন।…গুলি করে ঠ্যাং ভেঙে দেব। দুই ঠ্যাঙে দুটো গুলি। পড়ে থাকবেন। কাতরাবেন। পালাতে পারবেন না।
সোজা দাঁড়িয়ে একটা পা বাড়িয়ে দিলেন ঘনশ্যাম।…ভাল কথা! করুন গুলি! ঠ্যাঙ ভেঙে না হয়ে পড়েই রইলুম। ঘনা রুদ্রের শরীর অনেক গুলির দাগ আছে। যদি দেখতে চান, দেখাতে পারি। কিন্তু তারপর কী হবে, সেটাও বলে দিই। আপনার বউ বিধবা হবে। কারণ আমার কমরেডরা আপনাকে জবাই করবে। ঠিক যেভাবে ওই মেয়ে দুটোকে জবাই করা হয়েছে, তার চেয়ে বীভৎসভাবে। কেন? না– আপনি তাদের নেতার ঠ্যাং ভেঙেছেন। একটা নয়, দুটো ঠ্যাং! মাইন্ড দ্যাট।
হঠাৎ বংকুবিহারী হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসতে লাগলেন। …ধুর মশাই! বিপদের সময় কীসব রসিকতা হচ্ছে! চেপে যান। কাউকে বলবেন না আপনি ঘনাবাবু। আমিও বলব না। বুঝলেন না? বিপদের সময় সাপে-নেউলে বাঘে-গরুতে এক হয়ে যায়। তখন শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ থাকে না। আপনাকে জাস্ট একটু ভড়কি দিয়ে দেখে নিলাম। বসুন। নজর রাখুন। রিলিফের নৌকো দেখলেই চেঁচাবেন। যত জোরে পারেন চেঁচাবেন। আমরা সবাই এসে জড়ো হব একসঙ্গে চেঁচাব।
এটা বংকুবিহারীর ধূর্তামি। মনে মনে বললেন, রোশো ব্যাটাচ্ছেলে বিপ্লবী না টিপ্লবী! সময় এলে ব্যবস্থা হবে। ভুলিয়ে-ভালিয়ে যতক্ষণ রাখা যায়।
আর ঘনশ্যাম মনে মনে বললেন, খুব দিয়েছি! ভয় পেয়ে গেছে ব্যাটাচ্ছেলে!
বংকুবিহারী রিভলবারটি খাপে ভরলেন এবং পা বাড়িয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি চলে গেলে ঘনস্যাম চাঙড়টাতে বসে পড়লেন। আবার ঢুলতে শুরু করলেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই।…
চাক্কু রাঙা চোখে তাকিয়ে ছিল জলের দিকে। একটা দোনামনা ভাব। তাকে পেয়ে বসছিল। একবার ভাবছিল, এক্ষুনি ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে পালিয়ে যাবে, এই ভয়ঙ্কর দরগায় তার আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না– আবার ভাবছিল, তাহলে দারোগাবাবু তাকে সন্দেহ করবেন, সময়মতো হাজতে ঢুকিয়ে বেদম ঠ্যাঙানি দেবেন, আর খুনের দায়টা তো পড়বেই তার ঘাড়ে।
কিন্তু এ ভারি অদ্ভুত ব্যাপার, একখানা রিলিফের নৌকোও নজর হচ্ছে না কেন? এও ঠিক এ দরগাটা চারদিকে ফাঁকা মাঠের মধ্যিখানে। তবে একটু তফাত দিয়ে পাকা রাস্তা আছে। সেখান দিয়েও কোনো নৌকো চলাচল করছে না। কেন? করলে হরিপদর মুখে খবর হত। সে ওদিকেই বসে আছে। কোথাও।
এর একটাই মানে হয়– চুল্ল! চুল্লুর কথা সে শুনেছে ছেলেবেলা থেকে। চুল্লু এক চ্যালা– অশরীরী আত্মা। সে নাকি খোঁড়াপিরের দরগা পাহারা দেয়। চাক্কুর মনে হল, কানা দরবেশই চুল্লুকে লেলিয়ে দিয়েছেন তাদের ওপর। দিয়েছেন, তার একটাই কারণ, ওই বেশ্যা হারামজাদি! খোঁড়াপিরের পবিত্র দরগায় বেশ্যা এসে বেশ্যাগিরি করে বেড়াচ্ছিল– কে জানে, দরবেশবাবার সঙ্গে ও ঢলাঢলি করতে গিয়েছিল কি না! হয়তো গিয়েছিল; চাক্কু নড়ে বসল। আলবাৎ গিয়েছিল। সে জন্যই চুল্লুকে দিয়ে ওকে জবাই করিয়েছেন দরবেশবাবা। কিন্তু পুঁতি?
চাক্কু ভেবে পেল না, পুঁতি কী দোষ করল দরবেশবাবার কাছে? নাকি পুঁতি ক্ষিদের জ্বালায় দরবেশবাবার সঙ্গে ঢলাঢলি করতে গিয়েছিল? পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। দরবেশবাবার ঘরে খাবার-দাবার আছে। পুঁতি কি পোড়া পেটের জন্য দরবেশবাবাকে–
চাক্কু চমকে উঠে ঘুরল। পেছনে পায়ের শব্দ।
মেমসায়েব। মুখে পাগলাটে হাসি। বললেন, আপনি এখানে আছেন?
আপনাকে খুঁজছিলাম।
চাক্কু বলল, আজ্ঞে?
ক্লারা একটা লম্বাটে পাথরের স্ল্যাবে বসল। আপনার কাছে গল্প শুনতে এলাম। ক্লারা একটা ঘাস ছিঁড়ে নিল হাত বাড়িয়ে। বলল, আমি জানি, আপনি ভীষণ দুঃখিত। শোকগ্রস্ত। আপনার স্ত্রী নিহত হয়েছেন। কিন্তু আমার ধারণা, কথাবার্তা শোক দূর করে। আপনি কিছু কথা বলুন, এই দেশ সম্পর্কে অথবা আপনার যা ইচ্ছা।
চাক্কু রোদ্দুরে দেশলাই শুকিয়ে নিয়েছে। সিগারেটের প্যাকেটে এখনও তিনটে সিগারেট আছে। সে একটা ধরিয়ে জোরে টান দিল। ধোঁয়ার ভেতর বলল, কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মেমসায়েব! আর নতুন কথা কী বলব?
ক্লারা বলল, আমার মতো আপনার অবস্থা। আপনি কি আমাকে একটা সিগারেট দিতে পারেন?
চাক্কু জানে, দেখেছে, মেমসায়েবরাও সিগারেট টানে। তার কাছে মেমসায়েব সিগারেট চাওয়ায় সে খুশি হল। সিগারেট ও দেশলাই দিল।
ক্লারা হাল্কা একটা টান দিয়ে হাসল। ..ভারতে আসার আগে আমি ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই বিপদের অবস্থায় ধূমপান একটা শান্তি। আপনাদের দেশে নারীরা ধূমপান করেন না শুনেছি।
চাক্কু অগত্যা হাসল। …করে। করে বৈকি।
ধূমপান, অর্থাৎ সিগারেটের কথা বলছি!
বুঝেছি। চাক্কু বলল জোরগলায়। বাবু ভদ্রলোকের বাড়ির মেয়েরা না খেতে পারে। গাঁগেরামে আমাদের মতো ঘরে, আজ্ঞে, সিগারেট কোথা পাবে? তবে বিড়ি-তামাকটা খায়। তাপরে আজ্ঞে, মদ-তাড়িও খায়।
ক্লারা উৎসাহে বলল, বলুন, বলুন! আমাকে ভুল বলা হয়েছিল বুঝতে পারছি।…
প্রদোষ আস্তানাঘরের ছাদের কার্নিশে বসে বাইনোকুলারে সুদূর জল দেখতে দেখতে বাঁ-দিকে ঘুরেই অবাক হল। বাইনোকুলারে দেখল ক্লারার ঠোঁটে সিগারেট, তার পাশে রিকশোওলা ছোকরাটি। অসহ্য লাগায় প্রদোষ বাইনোকুলার নামিয়ে ফেলল। রাগে ও ঘৃণায় সে অস্থির কিন্তু এ মুহূর্তে কী করবে ঠিক করতে পারল না। আদিম ভারতের ভেতরে ঢুকে পড়তে চেয়েছিল ক্লারা। ঘটনাচক্রে অনেকখানি ঢুকে পড়েছে। প্রদোষ তার উপলক্ষ মাত্র। প্রদোষ তার নিতান্ত চাবিকাঠি। প্রদোষের স্ত্রী সেজে ক্লারা ভারতে ঢুকেছে এবং যথাসময়ে তাকে ফেলে চলে যাবে। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে বইটই লিখে ফেলবে। সব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে প্রদোষের কাছে। প্রদোষ ঠোঁট কামড়ে ধরল।…
ঢুলুনি কেটে গেল ঘনশ্যামের। পাশের ঝোপটা নড়ছে। খস খস শব্দ। বললেন, কে, কে?
কর্নেল সাড়া দিলেন, আমি।
ঘনশ্যাম গম্ভীর হয়ে বললেন, ঝোপের ভেতর সাপখোপ থাকতে পারে। ওখানে ঢুকে কী করছেন?
কর্নেল বেরিয়ে এলেন। …জলের অবস্থা দেখছিলাম। ইঞ্চি সাত-আট নেমেছে মনে হল। বলে কর্নেল একটু হাসলেন। দারোগাবাবুর সঙ্গে তর্কাতর্কি করছিলেন। কী ব্যাপার?
ঘনশ্যাম ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনাকে বলার কোনো দরকার আছে কি? সব সময় লক্ষ্য করছি, সবতাতে আপনি নাক গলিয়ে বেড়াচ্ছেন। কে আপনি? আপনার সঠিক পরিচয় কী?
ঘনশ্যামবাবু, আমার পরিচয় গোপনের প্রয়োজন হয় না।
ঘনশ্যাম চমকানো গলায় বললেন,–হুঁ–যা সন্দেহ করেছিলাম। আপনি সি বি আই অফিসার?
মোটেও না ঘনশ্যামবাবু! কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে দূরে কিছু দেখতে দেখতে বললেন। আমার নাম সত্যিই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। তবে নাকগলানোর কথা বললেন, ওটা আমার স্বভাব। কাল বিকেলে আপনি শাওনিকে থাপ্পড় মেরেছিলেন। তার ফলে ওর কানের গয়নায় আপনার আঙুল কেটে যায়। কথাটা দারোগাবাবুর কাছে গোপন না করলে আপনি স্কুলটিচার হর্ষনাথই থেকে যেতেন। আসলে, সহজ সত্য গোপন করতে গেলে ঝামেলা বাড়ে।
ঘনশ্যাম মুখ বাঁকা করে বললেন, বাঃ! বলেছেন ভালো! ওই বাঁকামুখো দারোগাবাবুটিকে আপনি চেনেন না! আসল কথাটা বললে ঠিকই ধরে নিত আমিই শাওনিকে খুন করেছি।
উনি কিন্তু তাই ধরে নিয়েছেন!
আমি শাওনিকে খুন করিনি। ঘনশ্যাম রোখের মুখে উঠে দাঁড়ালেন। আমি বিপ্লবী। বিপ্লবীরা অকারণ নরহত্যা করে না। তাছাড়া ওই হতভাগিনীর প্রতি বিপ্লবী মানুষের সিম্প্যাথিই স্বাভাবিক।
কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে একটু হেসে বললেন, ঠিক তাই।
তাহলে প্রত্যেকের পেছনে ওত পেতে বেড়াবেন না। আমাকে একলা থাকতে দিন।
থাকুন। কিন্তু সাবধান!
তার মানে?
কর্নেল পা বাড়িয়ে ছিলেন। ঘুরে আস্তে বললেন, আপনি কি এর আগে কখনও এই দরগায় এসেছেন?
নাঃ। কেন এ কথা জিগ্যেস করছেন জানতে পারি?
এমনি। বলে কর্নেল উঠে গেলেন ঢালের ওপর। ঘনশ্যাম তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কর্নেল অদৃশ্য হয়ে গেলে ফোঁস করে শ্বাস ফেললেন।…
কর্নেল দরগার প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখলেন, অন্ধ দরবেশ চিমটে বুকে ঠুকতে ঠকতে দরগার দিকে চলেছেন। আস্তানাঘরের দরজায় তালা। নির্ভুল অভ্যস্ত পদক্ষেপে দরবেশ উঁচু দরগা বা পিরের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাঁক দিলেন, চুল্ল। তারপর দরগার কিনারায় প্রকাণ্ড চিমটেটি রেখে নমাজ পড়া শুরু করলেন। কর্নেল ঘড়ি দেখলেন সাড়ে বারোটা বাজে। দক্ষিণের বটতলার ওখানে শকুনের চেঁচামেচি থেমেছে। শকুনগুলো চলে যায়নি। বংকুবিহারীকে খুঁজছিলেন। দেখতে পেলেন না। আছেন কোথায়, রিলিফের নৌকোর প্রতীক্ষা করছেন।…
ব্ৰজহরি ভাবছিলেন, আর পারা যায় না। আস্তানাঘরের বারান্দায় গিয়ে শুয়ে পড়বেন। রিলিফের নৌকোর আশা বৃথা। উঠতে গিয়ে চমকে বললেন, কে, কে?
দেখলেন, কর্নেলসায়েব। তখন হাসলেন।..ও! আপনি! কিন্তু সাড়া না দিয়ে আসতে আছে এমন করে? যা অবস্থা!
কর্নেল বললেন, কিছু দেখতে পেলেন ডাক্তারবাবু?
ব্ৰজহরি দঃখের মধ্যে হাসলেন।…মরীচিকা! বুড়ো আঙুলও নেড়ে দিলেন অভ্যাসমতো।…খালি মরীচিকা দেখছি কর্নেলসায়েব!
নৌকোর মরীচিকা?
শুধু নৌকোর কেন– কতরকম!
যেমন?
চুল্লুর। ইচ্ছার বিরুদ্ধে খ্যাখ্যা করে আরও হাসতে লাগলেন ডাক্তার ব্রজহরি কুণ্ডু।
চুল্লুকে দেখলেন বুঝি?
শব্দ শুনলাম, বুঝলেন? শব্দ খসখস, মচমচ, ধুপধাপ! বলে ব্ৰজহরি গাছপালার দিকে আঙুল তুললেন। যদি বলেন বাতাস, তত বাতাস। চুল্ল তো চুল্লু! তবে গলা নামিয়ে ফের বললেন, কাল একটা কালোমতো জিনিস দেখেছিলাম কয়েক সেকেণ্ডর জন্য। কিছুক্ষণ আগেও মনে হল, ওই ভাঙা ঘরগুলোর ভেতর কী একটা দেখলাম। আপনি যদি সঙ্গে যান, খুঁজে দেখতে আপত্তি নেই। কারণ আমার ধারণা, আমাদের অজানা কেউ এই দরগার ঢিবিতে লুকয়ে আছে। আসুন না, দেখি–
আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আপনি কি এই দরগায় আগে কখনও এসেছেন?
নাঃ। কেন বলুন তো?
এমনি। বলে কর্নেল চলে গেলেন বাঁদিকের ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে। ব্ৰজহরি তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ভাবলেন, লোকটা কে? সত্যিই কি কোনো রিটায়ার্ড কর্নেল? বড় রহস্যময় গতিবিধি এই বুড়ো ভদ্রলোকের। শাদা দাড়িগুলো আসল, না নকল? দারোগাবাবুর কাছে কথাটা তুলতে হবে এক্ষুনি। ব্ৰজহরি হন্তদন্ত পা বাড়ালেন বংকুবিহারীর খোঁজে।….
চাক্কু মেমসায়েবকে এই দরগার খোঁড়া পিরের কাহিনী শোনাচ্ছিল। এক বর্ষার দিনে একজন লোক মানত করতে এসে বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল। পিরসায়েব তাকে বলেন, থাক বাবা–এই বৃষ্টিতে বেরুসনি। দুমুঠো রান্না করি। খা। খেয়ে ঘুমো। কিন্তু খবর্দার, আমি যতক্ষণ রান্না করব, চোখ বুজে থাকবি। চোখ খুললে তোর বিপদ, আমারও বিপদ। কিন্তু লোকটা চোখ বুজে কতক্ষণ থাকবে? তাছাড়া তার প্রচণ্ড ইচ্ছে, ব্যাপারটা দেখবে। সে চোখ খুলে দেখে কী, পিরসায়েব উনুনে একটা ঠ্যাং ভরে রেখেছেন আর সেই ঠ্যাংটাই জ্বলছে। কাঠের বদলে ঠ্যাং! ব্যস! লোকটাও পাগল হয়ে গেল তাই দেখে। এদিকে মানুষের চোখ পড়ায় পিরসায়েবের ঠ্যাংটাও গেল পুড়ে। খোঁড়া হয়ে গেলেন। সেই থেকে খোঁড়া পির নাম। চাক্কুর ঠাকুর্দার কাছে শোনা কথা।
গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ পেছনে শব্দ। দুজনে চমকে উঠেছিল। ঘুরে দেখল, কর্নেল। বললেন, এই যে ক্লারা! তুমি এখানে আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম!
ক্লারা উদ্বিগ্নমুখে বলল, কেন বলুন? কিছু কি বিপদ হয়েছে?
না। কর্নেল একটা চাঙড়ে বসলেন। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে খুঁজিনি।
তবে—
বলুন পিতা!
তুমি আমাকে পিতা বললে!
বলতে ইচ্ছা হল। ক্লারা একটু হাসল।…আপনাকে মাঝে মাঝে খ্রিস্টীয় ফাদার দেখায়। আমি কী বলতে চাইছি, আশা করি বুঝেছেন। অবশ্য আপনি একজন কলোনেল- দুঃখিত, আমেরিকাবাসীরা কর্নেল বলে না– মুখের ভুল!
ক্লারা! কর্নেল জার্মান ভাষায় বললেন, প্রদোষ সম্পর্কে তোমার ধারণা হয়তো ভুল। ওর সঙ্গে তুমি মিটমাট করে নাও। আমি সাহায্য করতে রাজি। কারণ তুমি আমাকে যে অর্থে হোক, পিতা বলে ডেকেছ!
ক্লারা অবাক হয়ে জার্মান ভাষায় বলল, আপনি জার্মান জানেন?
জানি। যাই হোক, তুমি ওর কাছে যাও। তার সঙ্গে কথা বলো। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
ক্লারা একটু চুপ করে থাকার পর বলল, ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করতে রাজি। কিন্তু প্রদোষ আমার সঙ্গে কথা বলছে না।
তুমি এখনই যাও। ওকে নেমে আসতে বলো ছাদ থেকে। বলো, জরুরি দরকার আছে।
ক্লারা কর্নেলের মুখের দিকে তাকাল। তারপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে চলে গেল। তার চলার ভঙ্গি দেখে কর্নেল বুঝলেন, হয়তো প্রদোষের কাছে সে যাচ্ছে না। মনে মনে বিরক্ত হয়ে নিছক স্থানত্যাগ করছে। মেয়েটি অদ্ভুত প্রকৃতির যেন। কর্নেল ডাকলেন, চাক্কু!
চাক্কু হাঁ করে তাকিয়ে দুজনকে লক্ষ্য করছিল এতক্ষণ। বলল, আজ্ঞে সার?
তুমি আগে কখনও এ দরগায় এসেছ?
আজ্ঞে না, স্যার। তবে পেসেঞ্জার পৌঁছে দিয়েছি নিচের রাস্তায়।
পুঁতি কখনও এসেছিল কি না জানো?
পুঁতি– চাক্কু স্মরণ করার চেষ্টা করে বলল, তা এসে থাকতেও পারে। কেন সার?
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটি লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে বললেন, আচ্ছা চাক্কু, পুঁতিকে কে খুন করেছে বলে তোমার মনে হয়?
চাক্কু মুখ নামিয়ে এক টুকরো ইট পায়ের কাছে পাথরের স্ল্যাবে ঠুকতে ঠুকতে বলল, আমার ডেগারখানা পুঁতি কখন হাতিয়েছিল– তা পরে মনে হয়, শাওনিকে তাই দিয়ে খুন করেছিল…
পুঁতি? কর্নেল ঝুঁকে গেলেন তার দিকে।
চাক্কু গলার ভেতর বলল, পুঁতি খুব তেজী মেয়ে ছিল। নদীর ধারের ডুবো দেশের মেয়ে। ওর ওইরকমই। কখন আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে শাওনিকে আচমকা ধরে গলায় প্যাঁচ দিয়ে থাকবে।
কিন্তু পুঁতিকে কে খুন করল তাহলে?
চাক্কু এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, হরিপদকে সন্দ হয় আমার।
কেন বলো তো? সে তো বাউল!
চাক্কু তেতোমুখে বলল, হতে পারে বাউল-বোষ্টম। বাইরে থেকে কাউকে কি চেনা যায় সার? এই যে আমাকে দেখছেন, আম্মো কি কম? কম নইকো। এই বিপদের মধ্যে আটকে আছি, তাই। নৈলে
কর্নেল হাসলেন না। গম্ভীর হয়ে বললেন, নৈলে তুমি হরিপদকে জবাই করতে বুঝি?
হ্যাঁ–হ্যাঁ। চাক্কু শক্তমুখে বলল। সার! আমি এখন মরিয়া। আমার মাথায় খুন চড়ে আছে।
বুঝলাম। কিন্তু হরিপদ কেন খুন করবে পুঁতিকে?
চাক্কু একটু দোনামনা করার পর চাপাস্বরে বলল, তাহলে আসল কথাটা খুলে বলি, সার?
বলো, বলো!
শাওনির আসল নাম ছিল হরিমতী। চাক্কু আরও ফিসফিসিয়ে উঠল। শাওনির সব কথা আমার জানা। আমি, সার, এই তল্লাটের ছেলে। হরিমতী ছিল এলোকেশী বোষ্ট্রমীর মেয়ে। হরিপদ তাকে কিনেছিল এলোকেশীর কাছে। বাউলবোষ্টমরা কড়ি দিয়ে বোষ্টুমী কেনে, জানেন তে? কণ্ঠিবদল হয়– সেটাই ওদের বিয়ে বলতে পারেন। তো আগের বছর নবাবগঞ্জেতে ঝুলনের মেলার সময় হরিমতী হরিপদকে ছেড়ে এক বাবুর রাখনি হয়েছিল। রাখনি বোঝেন তো সার?
রক্ষিতা?
আজ্ঞে! চাক্কু মাথা দোলাল। রক্ষিতে। হরিপদ আমার চেনা লোক। আমি সব জানি। এবার আপনি ইশারায় বাকিটা বুঝে নেন। বাবুর সঙ্গে বনিবনা হল না, তখন হরিমতী কী করবে? শাওনি হয়ে বাগানপাড়ায় ঢুকল। আমি, সার, রিকশা চালিয়ে খাই। অনেক লোকের অনেক খবর আমার জানা। বাগানপাড়ার গলির খবরও জানা।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, শাওনিকে এখানে দেখে হরিপদ কি কিছু বলেছিল তাকে কিংবা তোমাকে?
চাক্কু জোরে মাথা দোলাল। না–বলেনি। বললে শাওনি হরিপদকে একশো খিস্তি না করে ছাড়ত ভাবছেন? তবে
তবে কী?
চাক্কু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, কাল রেতের বেলা হরিপদর গানখানা মনে করে দেখুন। সেই গানখানা, সার! মরা মানুষ পড়ল ধরা ছিমতী (শ্রীমতী) ভাগীরথীতে/চিত হয়ে ভাসচে জলে ঠুকরে খায় ডাল-কোয়োতে (দাঁড়কাকে)। গানখানা শুনে আমার কেমন যেন সন্দ বলুন সন্দ, ধন্দ বলুন ধন্দ, লাগছিল। তাপরে যখন গলাকাটা শাওনিকে জলে সেইরকম অবস্থায় দেখলাম, পেথমে হরিপদ শালাকে ধরিয়ে দেবার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু পুঁতি হঠাৎ বলল, চান। করব। আর হরিপদ অমন করে কাঁদছিল– আপনি দেখেননি?
লক্ষ্য করিনি। তখন শাওনিকে ওই অবস্থায় দেখে আমি তো বটেই, আমরা সবাই কেমন হয়ে পড়েছিলাম। কর্নেল স্বীকার করার সুরে বললেন। হ্যাঁ– তখন সবার চোখ ছিল শাওনির দিকে।
চাক্কু বলল, আমার ছিল না। আমি পেথমে পুঁতিকে, তাপরে হরিপদকে দেখছিলাম। শাওনি কাল বিকেলে পুঁতির সামনে আমার সঙ্গে মস্করা করতে গেল। পুঁতি ক্ষেপে গেল আমার ওপর। শাওনির ওপরও বটে! শাওনি আমাকে বলছিল, মেয়েটাকে ভাগিয়ে এনেছি আমি। বেচে দিলে পাঁচশো টাকা পাইয়ে দেবে। কাজেই বুঝলেন সার? শাওনিকে পুঁতিই আমর ডেগার দিয়ে মেরেছে।
কর্নেল সায় দেবার ভঙ্গিতে বললেন, হু। পুঁতির রাগের আরও একটা কারণ থাকতে পারে। রাত্রে দারোগাবাবুর কথায় শাওনি ওকে সার্চ করতে গিয়েছিল।
ঠিক ধরেছেন, সার! চাক্কু নড়ে বসল। হ্যাঁ– এক্কেবারে ঠিক। সকালে পুঁতি চান করতে গিয়েছিল মনে হয়, কাপড়ে রক্ত-উক্ত ছিল!
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়াতে গিয়ে ঘুরে বললেন, তুমি দারোগাবাবুকে এসব কথা বলেছ নাকি?
না। চাক্কু মুখ নামিয়ে বলল। বলিনি। তখন বলব বলব ভাবছিলাম, হঠাৎ মনে হল
চাক্কু থেমে গেলে কর্নেল বললেন, কী?
ইসমাইল ডাকুর কথা বলছিলেন দারোগাবুবু। তাছাড়া তালডোঙাটা! কাজেই সার, দোনামনায় পড়ে গেলাম। চাক্কু শ্বাস ছাড়ল জোরে। পুঁতি ইসমাইলকে চিনত। ওদের তল্লাটের লোক ইসমাইল। পুঁতি তাকে দেখে দারোগাবাবুকে ডাকবে এই ভয়ে শালা ডাকু হয়তো পুঁতিকে মেরে পালিয়েছে। কিন্তু এখানে বসে ভাবতে-ভাবতে মনে হচ্ছে, ইসমাইল তালডোঙা নিয়ে দরগায় লুকুতে এসেছিল। রাত্তিরটা কোনো গাছতলায় লুকিয়ে থেকে ডোঙাটা খুঁজে বের করে পালিয়ে গেছে। কেননা, দরগায় দারোগাবাবু হাজির। সার! এইসব কথা ভাবতে ভাবতে মনে হল, এটা হরিপদরই কাজ। হরিমতী বলুন বা শাওনি বলুন, মেয়েটা তার কণ্ঠিবদলকরা বউ তো বটে। পুঁতি তাকে মেরেছে। তাই হরিপদ পুঁতিকে মেরেছে। আমি এর শোধ না নিয়ে ছাড়ব না, তাতে শূলি-সি যা হবার হবে।
কর্নেল একটু হাসলেন। না চাক্কু! তুমি ওকে মারতে গেলে ও চাঁচাবে। তখন দারোগাবাবু ডাক্তারবাবু– সবাই দৌড়ে যাবে।
চ্যাঁচাতে দেব ভাবছেন নাকি? গলা টিপে ধরব পেছন থেকে।
সম্ভবত পারবে না। হরিপদ তোমার চেয়ে তাগড়াই লোক। তার গায়ে জোরও আছে। কর্নেল মিটি মিটি হাসছিলেন।…তাছাড়া হরিপদর কাছে তোমার ছোরাটা আছে। তাই না?
চাক্কু আগুনজ্বলা চোখে তাকিয়ে বলল, আজ্ঞে, সেই ভেবেই তো এতক্ষণ দোনামনা করছি। নৈলে কখন শালাকে গলা কেটে জলে ভাসিয়ে দিতাম।
সে ইটের টুকরোটা ঠুকতে ঠুকতে গুঁড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করতে থাকল। মুখটা নিচু। কর্নেল প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখলেন, দরবেশ দরগার কাছে নমাজ পড়ে আস্তানার বারান্দায় গেছেন এবং সেই জীর্ণ গালিচাটি পেতে হাঁটু মুড়ে বসে বুকে চিমটে ঠুকছেন। বিড়বিড় করে জপ করছেন এবং মাঝে মাঝে হাঁক দিচ্ছেন, চুল্ল!
কর্নেল পাশের ঘরে কাপড়ঢাকা বডি দুটো উঁকি মেরে দেখে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসলেন। আকাশের যে অংশটা দেখা যাচ্ছে, সেখানে কয়েকটা বৃষ্টিমেঘ খুব ধীরে ভেসে যাচ্ছে। বিকেলে আবার বৃষ্টি নামবে হয়তো। বাতাস বন্ধ। ভ্যাপসা গরম। নিঝুম দরগার বনভূমিতে পাখ-পাখালির ডাক মাঝে মাঝে। বাইনোকুলারে পাখি দেখার ইচ্ছে করছে না আর। চারদিক থেকে আবছা জলের শব্দ। যদি ফের বৃষ্টি নামে, জল ফের বাড়বে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের গতিবিধির ওপর কিছুক্ষণ নজর রাখলেন কর্নেল। তারপর উঠে পড়লেন। বংকুবিহারীর খোঁজে এগিয়ে গেলেন।…
হরিপদর একতারা চুপ। আর পিড়িং পিড়িং করে সুর দিতে বিরক্তি আসছে। একটা ছাতিম গাছের গোড়ায় ইটের মস্তো চাঙড়। তার ওপর বসে জলে পা ডুবিয়ে রেখেছিল সে। জলটা কমছে। সে বিড় বিড় করল, জয় গুরু! জয় গুরু! তারপর একটু চমকে উঠল। পাশে ও পেছনে ছাতিম গাছের ওপাশে ঘন ঝোপ। ধ্বংসপ জুড়ে জঙ্গল গজিয়ে আছে। যেন পায়ের শব্দ শুনেছিল। বলল, কে গো বাবা?
কেউ সাড়া দিল না। একটু হাসল হরিপদ।…মনের ভুল! আপনমনে বলল সে। তারপর গুনগুনিয়ে উঠল। ‘ওরে মোনকানা/তুমি মানুষ চিনেও চিনলে / লোকে ডেকে চিনিয়ে দিলে তুমি বললে চিনলাম না/ওরে আমার মোনকানা ॥‘
সেই সময় সামনের আকাশে ঘর-ঘর গুরু-গুরু শব্দ। গান থামিয়ে দিল হরিপদ। উত্তরপূর্ব কোণ থেকে প্রকাণ্ড কালো ভোমরার মতো কী একটা উড়ে আসছে। শব্দটা বাড়ছে। হরিপদ তাকিয়ে রইল। আস্তানার দিকে চ্যাঁচামেচি শুরু হয়েছে।…
.
হেলিকপ্টার এবং পঞ্চম হত্যাকাণ্ড
আস্তানাঘরের ছাদ থেকে হেলিকপ্টারটা বাইনোকুলারে এখন দেখেছিল প্রদোষ। তারপর সে চেঁচিয়ে উঠেছিল, হেলিকপ্টার! হেলিকপ্টার! ক্লারা ঘনশ্যামের সঙ্গে কথা বলছিল। দুজনেই দৌড়ে এসেছিল প্রাঙ্গণে। হেলিকপ্টারটা শব্দ শুনে ব্ৰজহরি এসে পড়ে বিকট চেঁচিয়ে বললেন, প্রদোষবাবু! প্রদোষবাবু! রুমাল নাড়ুন! রুমাল নাড়ুন! দৌড়ে এলেন কর্নেল, বংকুবিহারী, তারপর চাক্কু। সবাই চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিলেন। প্রদোষ উঁচুতে আছে। সে রুমাল নাড়তে লাগল। হেলিকপ্টারটা উত্তরপূর্ব কোণ থেকে এসে আস্তানাঘরের ওপর পৌঁছুলে প্রদোষ আরও জোরে রুমাল নাড়তে থাকল। ব্ৰজহরি ছাদে চড়ার চেষ্টা করছিলেন। ভাঙা দেয়ালে উঠে টাল সামলাতে না পেরে আছাড় খেলেন। বংকুবিহারী উঠে পড়লেন। তাঁর সঙ্গে কর্নেলও। শেষে ঘনশ্যাম এবং চাক্কু। কেউ হাত নাড়ছেন, কেউ রুমাল। হেলিকপ্টারের লোকেদের নিশ্চয় চোখে পড়েছে। কারণ হেলিকপ্টারটা চক্কর খাচ্ছে দরগার ওপর। অনেকটা নিচুতে নেমেও এল। তারপর একবার চক্কর দিয়ে দক্ষিণে চলে গেল। বংকুবিহারী ক্ষোভে দুঃখে এবং রাগে গর্জন করলেন, শুওরের বাচ্চা! নিচে থেকে ব্রজহরি চেঁচিয়ে উঠলেন, গুলি করে নামান! গুলি করে নামান ব্যাটাচ্ছেলেকে! অমনি বংকুবিহারী পিস্তল বের করে সত্যিই দু-দুটো গুলি ছুড়লেন– তখন হেলিকপ্টার দূরে, কর্নেল বললেন, কী হচ্ছে দারোগাবাবু? হেলিকপ্টারে কোনো মিনিস্টার থাকতে পারেন! শুনেই বংকুবিহারী দারুণ চমকে বললেন, সরি! আমি পাগল হয়ে গেছি বিলিভ মি! রিভলবার সঙ্গে সঙ্গে কোষবদ্ধ করে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফের বললেন, আই ডোন্ট কোয়ার মিনিস্টার অর ফিনিস্টার! কর্নেল বললেন, অবশ্য আপনার গুলি ছোঁড়া মিনিস্টার দেখতে পাননি– ভাববেন না। বংকুবিহারী ধপাস করে বসে বললেন, বয়ে গেল। আমি চাকরি ছেড়ে দেব। আমি একটা থানার অফিসার-ইন-চার্জ। দুদিন ধরে আমি নিখোঁজ। কারুর মাথায় এল না আমি কোথায় আছি– কী অবস্থায় আছি? জাস্ট পাঁচমাইল দূরে থানা। ব্ৰজহরি দ্বিতীয় চেষ্টায় উঠে এলেন ছাদে। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, নিশ্চয় থানার অফিসাররা বোট নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছেন ও তল্লাটে– মানে যে তল্লাটে গিয়েছিলেন। ওঁরা কেমন করে বুঝবেন, আপনি দরগায় আছেন? বংকুবিহারী ভেবে বললেন, — তা ঠিক। ঘনশ্যাম বললেন, দেখে গেল– নিশ্চয় বোট পাঠাবে। ওয়েট করুন। তারপর নিচের প্রাঙ্গণে ক্লারাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ম্যাডাম! এখানে চলে আসুন। উঁচুতে থাকলে ওদের নজরে পড়ত। ভেরি ইজি, ম্যাডাম! কাম হেয়ার! জয়েন আস্। ঘনশ্যাম আনন্দে হেসে ফেললেন। কিন্তু বংকুবিহরী আচমকা গর্জে উঠলেন, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। ডোন্ট ফরগেট ঘনশ্যামবাবু! ঘনশ্যামবাবুর মুখের হাসি মুছে গেল। গলার ভেতর বললেন, ঠিক আছে। হাজতখাটা আমার বহুকালের অভ্যেস! বলে বসে পড়লেন কার্নিসে। ক্লারা উঠে এল খুব সহজেই। সে চাক্কর পাশে বসে আস্তে বলল, আপনার কাছে আর সিগারেট আছে? চাক্কু বলল, আজ্ঞে না মেমসায়েব! প্রদোষ ভুরু কুঁচকে কথাটা শুনল। তারপর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিল তার দিকে। ক্লারা কিন্তু হাসল। বলল, ধন্যবাদ। তারপর চাক্কুকে বলল, আপনি দেশলাই জ্বালুন। প্রদোষ রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, উই আর অল ম্যাড- এভরিবডি! ব্ৰজহরি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন ঘনশ্যামের দিকে। এতক্ষণে বললেন, ও মশাই! আপনার নাম তো হর্ষনাথবাবু। আপনি ঘনশ্যামবাবু হলেন কখন? ঘনশ্যাম গর্বিত হেসে ললেন, আমি বিপ্লবী কৃষক-মজদুর পার্টির নেতা ঘনশ্যাম রুদ্র! আন্ডারগ্রাউন্ড ছিলাম! আমার নাম আপনার জানা উচিত ছিল। বংকুবিহারী বললেন, শাট আপ! আর একটি কথা নয়। এইসময় কর্নেল বললেন, কিন্তু হরিপদ- সে কোথায়? ব্ৰজহরি বললেন, আছে কোথাও। সংসারত্যাগী মানুষ। আউল-বাউল লোক। গুরুর নাম জপছে নিরিবিলিতে। বলে ডাকতে থাকলেন, হরিপদ! ও হরিপদ! হরিপদো—ও–ও! কর্নেল ছাদ থেকে ব্যস্তভাবে নেমে গেলেন। বংকুবিহারী মন্তব্য করলেন, পাগল!
তারপর কতক্ষণ কর্নেলের পাত্তা নেই। ক্লারা সিগারেট টেনে নিচে জল লক্ষ্য করে ছুঁড়ে ফেলল। জলে পৌঁছুল না। নিচে একটা পাথরের ফলকের খাঁজে আটকে গেল। ক্লারা যেন সেটা জলে না ফেলে ছাড়বে না এমভাবে কার্নিশ থেকে ভাঙা দেয়াল বেয়ে নেমে গেল। প্রদোষ ফের বলল, উই আর অল ম্যাড! ঘনশ্যাম ঘুরে মেমসায়েবকে নামতে দেখলেন। ব্ৰজহরিও দেখলেন, মুখে। ভয়ের ছাপ। পড়ে হাড়গোড় ভাঙবে, সে ভয় নেই- মেমসায়েবরা সত্যিই আজব দেশের আজব প্রাণী!
ক্লারা কিন্তু আস্তানাঘরের প্রাঙ্গণে চলে গেছে। তারপর হন হন করে হেঁটে চলেছে। সে গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলে প্রদোষ কার্নিশের ধারে চাক্কুর পাশে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা আনতে গেল। ব্ৰজহরি বললেন, আমাদের নজর রাখা দরকার। বোট আসবে। হেলিকপ্টারে মিনিস্টার যখন দেখে গেছেন, তখন বোট আসতে বাধ্য। প্রদোষ একটা সিগারেট ধরালে চাক্কু সবিনয়ে বলল, সার! একটা দিন না আমাকে। প্রদোষ তার দিকে তাকাল। তারপর একটা সিগারেট ছুঁড়ে দিল। চাক্কু দুহাতে সেটা লুফে নিল। বংকুবিহারী বললেন, আমি স্মোক করি না। তবে ইচ্ছে করছে। দিন তো মশাই একটা টেনে দেখি!
বংকুবিহারী সবে সিগারেট ধরিয়েছেন, ক্লারার চিৎকার ভেসে এল, আবার হত্যা! আবার একটি হত্যা! আপনারা আসুন! সকলে আসুন!
উত্তরপূর্ব কোণে ধ্বংসস্থূপের ফাঁকে ক্লারাকে দেখা যাচ্ছিল। প্রচণ্ড হাত নেড়ে চিৎকার করছে, হত্যা! ভীষণ হত্যা!
বংকুবিহারী উঠে দাঁড়ালেন। ঘনশ্যামের কথা ভুলে ধুড়মুড় করে ভাঙা দেয়াল দিয়ে নামলেন, দৌডুলেন। রিভলবার বের করেই ছুটে চললেন। ব্ৰজহরি কাঁপতে কাঁপতে বললেন, সর্বনাশ! সর্বনাশ! সর্বনাশ! আবার কে গেল? প্রদোষ নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে থাকল। চাক্কু শ্বাস ছেড়ে বলল, হরিপদ গেল!
ব্ৰজহরি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তারপর হাতপায়ে ভর করে হাঁচড়-পাঁচড় করে নামতে শুরু করলেন। ঘনশ্যামও নেমে গেলেন। তারপর গেল চাক্কু। প্রদোষ একা দাঁড়িয়ে রইল ছাদে।…
উত্তরপূর্ব কোণে বন্যার জলের ধারে হরিপদ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। চাপ চাপ রক্ত গলা থেকে বেরিয়ে জলকে লাল করছে। তার পা দুটো ওপরদিকে, মাথাটা জলে। একতারাটা ছিটকে পড়ে আছে। ব্ৰজহরি, ঘনশ্যাম, চাক্কু ও ক্লারা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ওঁদের দৃষ্টি বন্যার অবাধ জলের দিকে। বংকুবিহারী ও কর্নেলের দৃষ্টি হরিপদর দিকে। কর্নেল আস্তে বললেন, আমি আসার আগেই হরিপদ মারা পড়েছে। বংকুবিহারী এবার ভয় পাওয়া গলায় বললেন, চুল্লু! চুল্লু আছে।
কর্নেল হঠাৎ ব্যস্তভাবে বললেন, বডিটা তুলে আস্তানাঘরে নিয়ে যাওয়া দরকার। শকুনগুলো ওত পেতে আছে। আসুন ঘনশ্যামবাবু! ডাক্তারবাবু! চাক্কু! দেরি করা ঠিক নয়। শিগগির!…
.
ভিজে আগন্তুক এবং তালডোঙা রহস্য
আবার আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে এবং তারপর প্রচণ্ড বৃষ্টি। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন। বজ্রপাত। আস্তানাঘরের বারান্দায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। লোকগুলি। পাশের ঘরে তিনটি কাপড়টাকা লাশ এবং তাদের গলা ফাঁক। এবার ঘনিয়ে এসেছে সত্যিকার সন্ত্রাস। ব্ৰজহরির মতে একজন বেশ্যার মৃত্যু, যত বীভৎস হোক, ততকিছু আতঙ্ক ছড়াতে পারেনি। তার আগে একটি কুকুরের মৃত্যু তো গ্রাহ্য করার মতো ঘটনাই হয়ে ওঠেনি। আর একজন ঘর-পালানো, গ্রাম্য নিম্নবর্গীয় সমাজের মেয়ের মৃত্যু, বারবধূটির মৃত্যুই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। কিন্তু বাউল হরিপদর মৃত্যু জোর ধাক্কা দিয়েছে সবাইকে। ব্ৰজহরি কাঁপা কাঁপা গলায় শেষে বললেন, এবার কে? কার পালা?
বংকুবিহারীর হাতে এখনও রিভলবার। একটু নড়ে বসে বললেন, আপনি চুপ করুন। আমাকে ভাবতে দিন!
ঘনশ্যাম ম্রিয়মান কণ্ঠস্বরে বললেন, আমি নাস্তিক। ভূত-ভগবান মানি না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কী একটা আছে- একটা ব্লাইন্ড ফোর্স! নেচারের কতটুকুই বা সায়েন্স ভেবেছে? নেচারের মধ্যে ডায়ালেকটিক্স- মানে দ্বন্দ্ব আছে। বিরোধী শক্তি আছে।
বংকুবিহারী ফের বললেন, আঃ! চুপ করুন তো মশাই!
ক্লারা বলল, চুপচাপ থাকলে আমরা আরও ভয় পাব। দারোগামহাশয়, আমাদের কথাবার্তায় অনুগ্রহপূর্বক আপত্তি করবেন না।
প্রদোষও আর চুপ করে থাকতে পারছিল না। বলল, আমার একটা স্টোরি মনে পড়ছে অ্যারাবিয়ান নাইটসের।
ব্ৰজহরি বললেন, বলুন, বলুন!
প্রদোষ বলল, সিন্দবাদ এপিসোড। সেই যে এক রাক্ষসের হাতে সিদ্বাদ আর তার সঙ্গীরা বন্দী হল, রাক্ষস রোজ সেলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একজনকে বের করে নেয়, খেয়ে ফেলে, তারপর এইভাবে প্রতিদিন একজন। করে বন্দী–
ঘনশ্যাম দ্রুত বললেন, একজ্যাক্টলি! ঠিক তাই হচ্ছে। ব্লাইন্ড ন্যাচারাল ফোর্সের হাতে আমরা বন্দী।
ব্ৰজহরি কাঁপা-কাঁপা গলায় বলেন, এবং একজন করে তার হাতে ধরা পড়ছি। আমরা! ওঃ,ভয়াবহ! এবার কার পালা কে জানে?
বংকুবিহারী গলার ভেতর বললেন, আরে মশাই, সেটাই তো ভাবছিলাম! চুল্লু তার সিম্বল। চুল্লু আছে। চুল্লু ছাড়া এসবের কোনো অর্থ হয় না। তিরিশ বছর আমার পুলিশ লাইফ! অনেক মিসস্ট্রিয়াস ব্যাপার দেখেছি। এমন কখনও দেখিনি।
দরবেশে একইভাবে তার ঘরের দরজার সামনে জীর্ণ গালিচায় বসে দুলতে দুলতে জপ করছিলেন এবং বুকে চিমটে ঠুকছিলেন। ঝুম ঝুম চাপা শব্দ তালে-তালে। বলে উঠলেন, চুল্লু! সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ শব্দে কোথাও বাজ পড়ল। আস্তানা কেঁপে উঠল।
চাক্কু ফিসফিসিয়ে ব্ৰজহরিকে বলল, দরবেশবাবাকে ধরুন সবাই মিলে। বাঁচলে উনিই বাঁচাতে পারেন।
ব্ৰজহরি আর্তকণ্ঠস্বরে বললেন, দরবেশবাবা! দরবেশবাবা!
অন্ধ দরবেশ দুলতে দুলতে বুকে চিমটে ঠুকতে ঠুকতে ফের বললেন, চুল্লু! প্রাঙ্গণে, চারদিকের ঘন জঙ্গলে, চাপ চাপ ধ্বংসপে বৃষ্টির শব্দ, মেঘের গর্জন– ধারাবাহিক। মাঝে মাঝে ঝোড়ো, দমকা বাতাসে গাছপালা নড়ে উঠছে। ছাট আসছে বারান্দায়। কর্নেল বর্ষাতিটি ফের গায়ে চড়িয়েছেন এবং দেয়ালে হেলান দিয়ে শেষপ্রান্তে বসে আছেন। দাঁতে কামড়ানো জ্বলন্ত পাইপ। বারান্দার ভেতর আবছায়ায় সন্ত্রস্ত লোকগুলির দিকে মুখ ফেরালেন। আস্তে বললেন, বন্যাটা আবার বেড়ে যাবে হয়তো।
এই কথায় আবার আতঙ্ক ছড়াল। ব্ৰজহরি প্রাঙ্গণের দিকে ঘুরে চমকানো গলায় বললেন, ওই তো বেড়েছে! কবরগুলো ডুবেছে!
কর্নেল বললেন, না। ওগুলো বৃষ্টির জল।
প্রদোষ ক্ষোভে বলল, হেলিকপ্টারটা আমাদের দেখে গেল। অথচ এখনও বোট পাঠাল না। দু ঘণ্টা– টু আওয়ার্স পাড় অ্যাওয়ে! দিস ইজ ইন্ডিয়া।
দিস ইজ ইন্ডিয়া! সায় দিলেন ঘনস্যাম। ধনতন্ত্রের পোশাকপরা সামন্ততন্ত্রের এটাই নিয়ম।
ব্ৰজহরিও সায় দিলেন। রেডটেপিজম! মিনিস্টার নবাবগঞ্জের হেলিপ্যাডে নেমে এখন সার্কিটহাউসে বসে গরম-গরম কফি খাচ্ছেন। অফিসারদের হয়তো বলেছেন, জলবন্দী একজন লোকের কথা। এখন ফাইল চালাচালি হচ্ছে। রিলিফ অফিসারের কাছে সেই ফাইল পৌঁছুতে বছর ঘুরে যাবে এবং অবশেষে যখন বোট আসবে, দেখবে আটখানা গলাকাটা ডেডবড়ি ছিঁড়ে খাচ্ছে একদঙ্গল শকুন!
ব্ৰজহরির মুখে বীভৎসতা ফুটে উঠেছিল। ঘনশ্যাম চাপা গর্জন করলেন, রেভোলিউশন! বিপ্লব! বিপ্লব না হলে–
বংকুবিহারী পাল্টা গর্জন করলেন, শাট আপ! ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। ডোন্ট ফরগেট দ্যাট!
এই সময় চাক্কু হঠাৎ চমকানো গলায় বলল, পাশের ঘরে কে যেন ঢুকল!
সবাই নড়ে উঠলেন। পাশে ঘরের দরজার ভেতর দৃষ্টি চলে গেল। তিনটি কাপড়টাকা লাশের ওপর জল পড়ছে। ছাদ চুঁইয়ে টুপ টাপ…টুপ টাপ। কাপড়ে রক্তের ছোপ ফুটে উঠেছে। ক্লারা বলল, আমি দেখতে চাই। সে উঠতে গেলে প্রদোষ তাকে টেনে বসিয়ে দিল। বংকুবিহারী বললেন, কে ওঘরে? সাড়া না দিলে গুলি ছুড়ব!
কোনো সাড়া এল না। চাক্কু দম আটকানো স্বরে বলল, পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ওই তো দাঁড়িয়ে আছে।
চাক্কু পাশের ঘরের দরজার পাশে বসে ছিল। সে কথাটা বলেই সরে গেল ব্ৰজহরির কাছে। ব্ৰজহরি সরে গেলেন ঘনশ্যামের কাছে। দরবেশ বলে উঠলেন, চুল্লু! চুল্লু! চুল্লু! আবার বাজ পড়ল কোথায়।
বংকুবিহারী উল্টোদিকের দেয়ালে কর্নেলের পাশে বসে ছিলেন। রিভলবার তুলে বললেন, কে আছ। সাড়া না দিলে সত্যি গুলি ছুড়ব!
ক্লারা ক্ষোভে ফুঁসে উঠল।…আমাদের মতো কেউ কি এই উচ্চভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে না? কেন তাকে গুলিবিদ্ধ করবেন আপনি? আপনি আইনরক্ষক অথবা ঘাতক?
বংকুবিহারী খাপ্পা হয়ে বললেন, দিস ইজ ইন্ডিয়া, নট ইউ এস এ, ম্যাডাম! ডোন্ট ইন্টারভেন।
ক্লারা বলল, আপনি মাতৃভাষায় কথা বলুন। অথবা জার্মান ভাষায় বলুন। আমি জার্মান।
ঘনশ্যাম লাফিয়ে উঠলেন।…তাহলে বুঝুন কে এই মেমসায়েব! কাল বিকেলেই আমি ডাক্তারবাবুকে বলছিলাম- বলছিলাম না ডাক্তারবাবু?
ব্ৰজহরি রুদ্ধশ্বাসে বললেন, তক্কাতর্কি নয়, তক্কাতর্কি নয়। বড় দুঃসময়। সবাই কাছাকাছি বসে থাকুন। যে যার ইষ্টনাম জপ করুন। চাক্কু যাকে দেখেছে, সেই চুল্ল! অশরীরী আত্মা। এই দরগার গার্ড। বুঝলেন না আপনারা?
কর্নেল উঠে গেলেন পাশের ঘরের দরজায়। ব্ৰজহরি হাত বাড়িয়ে তাঁর বর্ষাতি খামচে বাধা দিতে গেলেন। কিন্তু কর্নেল ও-ঘরে ঢুকে পড়েছেন ততক্ষণে।
তারপর কেউ ফুঁপিয়ে উঠল ও-ঘরে…সার! সার! আমাকে মারবেন না! আমি ঝাঁপুইহাটির লোক। আমার নাম হরমুজ আলি, সার। বড় ঠেকায় পড়ে। ঘরে ঢুকেছি!
কর্নেল শান্তভাবে বললেন, বারান্দায় এস। এঘরটা ধসে পড়তে পারে।
কর্নেলের পিছু-পিছু নীল গেঞ্জি আর চেককাটা লুঙ্গিপরা এক যুবক কুঁকড়ে ঢুকল। ভিজে একাকার। ভয়ে কিংবা বৃষ্টিজনিত ঠাণ্ডায় কাঁপছে। বংকুবিহারী গোল চোখে তাকিয়ে দেখছিলেন। বললেন, তোমাকে চেনা-চেনা ঠেকছে যেন! কোনপথে ওঘরে ঢুকলে? ছাদ ফুঁড়ে, নাকি সিঁদ কেটে? ও-ঘরে তো আর দরজা-জানালা নেই!
জবাব দিলেন কর্নেল। ওপরের বড় ঘুলঘুলিটা লক্ষ্য করেননি কেউ। ওখান দিয়ে দেয়াল ধরে নামা যায়।
ঘুলঘুলি দিয়ে? বংকুবিহারী অবাক হয়ে বললেন। বুঝেছি! আভ্যেস আছে। তাহলে। অ্যাই ছোকরা, কী নাম বলছিলে যেন?
সার, আমার নাম হরমুজ আলি। বড়ি ঝাঁপুইহাটি।
ক্লারা বলে উঠল, ওর পোশাক বদলানো দরকার। আমি দিচ্ছি।
প্রদোষ বাধা দিল।…ডোন্ট ডু দ্যাট, বেবি! ইউ আর আ ম্যাড গার্ল!
ক্লারা গ্রাহ্য করল না। নিজের কিটব্যাগ খুলে একটা তোয়ালে ছুঁড়ে দিল হরমুজ আলির দিকে। তারপর বলল, আপনি চিন্তা করবেন না। আমার শেষ শাড়িটি দিচ্ছি। আপনি লুঙ্গির মতো পরুন।
কর্নেল ওঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। একটু পরে বললেন, যাও, পরে এস।
হরমুজ লাশ তিনটিকে এড়িয়ে কোণে চলে গেল। একটু পরে ক্লারার জংলিছাপ সূতী শাড়িটি লুঙ্গির মতো পরে তোয়ালে জড়িয়ে বারান্দায় এল। নিজের ভিজে লুঙ্গি এবং গেঞ্জিটি বারান্দার ধারে গিয়ে নিংড়ে জল বের করল। তারপর শুকনো জায়গায় রেখে ধুপ করে বসে পড়ল কর্নেলের পায়ের কাছে। বংকুবিহারী বললেন, তোমাকে বড্ড চেনা-চেনা ঠেকছে কেন হে?
হরমুজ ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে বলল, সার! আমি পাটের দালালি করি। আগাম দাদন দিয়েছি অনেক গাঁয়ে। ফেলাডে পাটের অবস্থা দেখতে বেরিয়েছিলাম। কাজেই দেখে থাকবেন বৈকি আমাকে! কত জায়গায় ঘুরি।
কর্নেল তার পাশে বসলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, তালডোঙাটা কি তোমার?
হঠাৎ একথায় হরমুজ হকচকিয়ে গেল। বলল, সার, আমি–
তালডোঙাটা তোমারই। কর্নেল আস্তে কিন্তু শক্ত মুখে বললেন। কাল বিকেলে তুমি এখানে এসেছ। তাই না?
হরমুজ আগের মতো ফুঁপিয়ে উঠল।..সার, আমি– বলেই সে থেমে গেল। কাঁদতে শুরু করল।
কর্নেল বললেন, কান্নাকাটির কারণ নেই। তুমি কাল তালডোঙা চেপে দূরগায় এসেছিলে!
হরমুজ কান্না থামিয়ে বলল, আজ্ঞে সার! সব পাট ডুবে গেছে। বছরকার দাদনের টাকা আটকে গেল। তাই খোঁড়াপিরের দরগায় মানত দিতে এসেছিলাম।
এসে শাওনির পাল্লায় পড়েছিলে! তুমি ওকে চিনতে।
আজ্ঞে সার!
শাওনি তোমকে কী বলেছিল!
চাক্কু লাফিয়ে উঠল হঠাৎ।…দারোগাবাবু! দারোগাবাবু! মিথ্যে বলছে। ওকে চিনতে পেরেছি। ওর নাম কালু! ইসমাইলের সাগরেদ! ওকে সবাই বলে গলাকাটা কালু!
বংকুবিহারী রিভলবার তাক করে বললেন, নড়ো না। নড়লেই মুণ্ড ছ্যাঁদা করে দেব। হুঁ–তাই চেনা-চেনা ঠেকছিল। কালুই বটে!
কর্নেল বললেন, তুমি তাহলে হরমুজ নও, কালু?
কালু. কর্নেলের পা চেপে ধরল।…আমাকে বাঁচান সার! কাল থেকে ভোঙা হারিয়ে গাছে লুকিয়ে ছিলাম। শেষে নিজেই ধরা দিতে এলাম দারোগাবাবুর কাছে। বংকুবিহারী ভেংচি কেটে বললেন, ধরা দিতে এলাম? গাছের ডালে লুকিয়ে থেকে শুওরের বাচ্চা তিন-তিনটে লোকের গলা কেটেছ। তারপর এসেছ ধরা দিতে! নড়ো না। চুপ করে বসে থাকো।
কালু হাউমাউ করে বলল, না সার! আমি কাউকে খুন করিনি। পিরের নামে কিরে করে বলছি, আমি খুন করিনি।
কর্নেল বললেন, একটু চুপ করুন দারোগাবাবু! কালু, কান্না থামাও। আমার কথার জবাব দাও। শাওনি তোমাকে কী বলেছিল?
কালু চোখ মুছে বলল, শাওনি বলল এখানে দারোগাবাবু আছে। তারপর বলল, পালিয়ে যাও। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও। তাই শুনে আমি বললাম, ঠিক আছে। আয়! এমন সময় হঠাৎ আপনি এসে পড়লেন। আপনার পরনে ওই ডেরেস। ভাবলাম দারোগাবাবু আসছেন। অমনি শাওনিকে বললাম, আঁধার হোক। আমি ছাতিম গাছে লুকিয়ে থাকছি। তাপরে সার, আঁধার হল। কিন্তু নেমে গিয়ে তালডোঙাটা খুঁজেই পেলাম না। সারারাত্তির বিষ্টির মধ্যে খুঁজে বেড়িয়েছি। পাইনি।
রাত্রে শাওনির সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি আর?
আজ্ঞে না। কালু দুহাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে বলল। ভোরবেলা ঠিক করলাম সাঁতার কেটে পালাব। কিন্তু অথৈ দরিয়া, সার! ভরসা হল না। তারপর আপনাদের আনাগোনা দেখে ফের একটা ঝাকড়া গাছে চড়ে লুকিয়ে ছিলাম।
কুকুরটাকে খুন করল কে?
পিরের কিরে সার, আমি দেখিনি।
শাওনিকে?
সার এ কালু খামোকা একটা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না!
শাওনি তোমার কথা দারোগাবাবুকে বলে দিতে পারে– এই ভয়ে তুমি ওকে খুন করেছ!
কালু ফের হাউমাউ করে উঠল, আমি ওকে খুন করিনি। খোদার কসম, পিরের কসম! শাওনি আমার কথা বলতে যাবে ক্যানে সার? সেও তো দরগা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। বলুন, তাই কিনা?
কেন?
কালু চোখ মুছে বলল, চুল্লুর ভয়ে। চুলুর কথা কে না জানে তল্লাটে?
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, এখন তুমি ধরা দিতে এলে কেন?
বৃষ্টি। কাল কাতর স্বরে বলল। বৃষ্টি আর সহ্য হল না। তার ওপর কাছেই বাজ পড়ল। এদিকে গায়ে ব্যথা। জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে। তার ওপর না-খাওয়া না-দাওয়া! কতক্ষণ পারে মানুষ, আপনি বলুন সার?
তুমি শাওনি, পুঁতি আর হরিপদর খুনি হওয়া টের পেয়েছিলে!
আজ্ঞে। গাছ থেকে দেখেছি আপনারা লাশ নিয়ে আসছেন।
তাহলে ওদের কে খুন করল তাও নিশ্চয় দেখেছ?
বংকুবিহারী গর্জন করলেন, দেখার কী আছে মশাই! আপনি যেন কোন মহাপুরুষের মতো বুলি আওড়াচ্ছেন। ওর নাম গলাকাটা কালু শুনেও কিছু বুঝতে পারছেন না?
কালু কান্নাজড়ানো গলায় বলল, খুন করা আমি দেখিনি। আপনারা একটা করে লাশ বয়ে এনে ও-ঘরে ঢোকাচ্ছেন, ওই টুকুন খালি দেখেছি।
বংকুবিহারীর ধৈর্য চলে গেল। উঠে এলেন রিভলবার উঁচিয়ে। ডাকলেন, চাক্কু, উঠে আয়! আসামিকে পিঠমোড়া করে বাঁধ। হুঁ–ওর লুঙ্গি ছিঁড়ে ফেল। ছেঁড় বলছি হতভাগা!
চাক্কু ভিজে লুঙ্গির সেলাই-বরাবর ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলল। লুঙ্গিটা লম্বা করে পাক দিয়ে মোটা রশিতে পরিণত করল। প্রচণ্ড উদ্যমে কালুকে পিঠমোড়া করে বাঁধল। তারপর ভিজে গেঞ্জিটা দিয়ে দুটো পাও বেঁধে ফেলল। কালু বাধা দিল না। বংকুবিহারী ক্লারার তোয়ালেটা তুলে ছুঁড়ে দিলেন।…নিন ম্যাডাম। কেচে নেবেন কিন্তু।
ব্ৰজহরি কাঠ হয়ে দেখছিলেন ব্যাপারটা। ঘনশ্যাম, প্রদোষ এবং ক্লারাও। তারপর শুধু ক্লারা আস্তে বলল, পাশবিক এবং অমানবিক। আমি বিশ্বাস করি না ওই যুবকটি হত্যাকারী।
কর্নেল বললেন, ডাক্তারবাবু, একটা অনুরোধ। দেখুন তো কালুর সত্যি জ্বর কি না?
ব্ৰজহরি কুণ্ঠিতভাবে বললেন, গলাকাটা কালুর নাম আমি শুনেছি। ওকে ছুঁতে ঘেন্না হয়। তবু বলছেন যখন, দেখছি। এথিকস্। ফিজিসিয়ানদের এথিকস্! বলে ব্ৰজহরি উঠে এসে কালুর গলার কাছে হাত রেখে বিকৃত মুখে বললেন, হুঁ, জ্বর। তারপর নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন। ঘনশ্যাম ফোঁস করে শ্বাস। ছাড়লেন। বৃষ্টিটা এবার কমে এসেছে। শুধু মেঘের ডাক থামছে না।…