পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের বিশাল স্ক্রিনের সামনে বৃদ্ধ মানুষটি দুই হাত বুকের কাছাকাছি ধরে রেখে নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। স্ক্রিনের উপর বড় ঘড়িটিতে এইমাত্র সে দেখতে পেয়েছে দশ সেকেন্ড সময় পার হয়ে গেছে। বৃহস্পতি গ্রহের কাছাকাছি যে মহাকাশযানটি একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করে বের হয়ে গেছে সেটি যদি তার দায়িত্ব শেষ করতে পারে তা হলে সেটি দশ সেকেন্ডের মাঝে ফিরে আসবে। মহাকাশযানটি ফিরে আসে নি, অভিযানটি ব্যর্থ হয়েছে। বৃদ্ধ মানুষটি বুকের মাঝে আটকে রাখা নিশ্বাসটি বের করে দিয়ে একটি কুৎসিত গালি দিল।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়স্ক মানুষটি মাথা ঘুরিয়ে বৃদ্ধ মানুষটির দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে এ রকম খিস্তি করবে জানলে তোমাকে কখনোই এখানে আসতে দিতাম না।
বৃদ্ধ মানুষটি দ্বিতীয়বার একটি গালি দিয়ে বলল, এত কষ্ট করে ওয়ার্মহোল তৈরি করা হল–এক বছর শুধু ইরন নামের মানুষটির পিছনেই খরচ করা হয়েছে। অ্যাকসিডেন্ট করে পুরো পরিবারকে খুন করা হল কীশা মেয়েটাকে রোবট বানানোর জন্য। আর জিনেটিক কোডে নিখুঁত মেয়েটার জন্য কত দিন ধরে কাজ করছি সেটার কথা তো ছেড়েই দাও।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি দাঁত খিঁচিয়ে বলল, তুমি চুপ করবে? চুপ করবে তুমি?
বৃদ্ধ মানুষটি রেগে গিয়ে বলল, কেন চুপ করব? কেন চুপ করব আমি? পুরো বিজ্ঞান একাডেমির চোখে ধুলা দিয়ে এই প্রজেক্ট দাঁড় করিয়েছ, বলেছ চতুর্মাত্রিক জগতের প্রযুক্তি নিয়ে আসবে, আর এখন?
মধ্যবয়স্ক মানুষটির ফরসা গালে হঠাৎ ছোপ ছোপ লাল রং ফুটে ওঠে, ভয়ঙ্কর ক্রোধে ফেটে পড়তে গিয়ে হঠাৎ করে সে থেমে যায়। বিশাল স্ক্রিনে একটা ছোট বিন্দু ফুটে উঠেছে, ওয়ার্মহোলের ভিতর দিয়ে মহাকাশযানটি বের হয়ে আসছে অস্বাভাবিক গতিতে, তার পিছনে ওয়ার্মহোলটি বন্ধ হয়ে আসছে, প্রচণ্ড আলোর বিকিরণে চোখ ধাধিয়ে যায় ওদের।
বৃদ্ধ মানুষটি স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে তারপর দুই হাত তুলে চিৎকার করে বলল, আমরা করেছি! অসাধ্য সাধন করেছি! চতুর্মাত্রিক জগতের প্রযুক্তি নিয়ে এসেছি!
হ্যাঁ, এনেছি। বিশ্বাস হল এখন?
হয়েছে। বিশ্বাস হয়েছে। বৃদ্ধ মানুষটি দাঁত বের করে হেসে বলল, এখন আমরা পৃথিবীর ইতিহাস নতুন করে লিখব।
হ্যাঁ। নতুন করে লিখব।
কেউ আমাদের থামাতে পারবে না।
না পারবে না। কেউ আমাদের প্রযুক্তি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না।
আধা রোবট মেয়েটাকে সেভাবেই প্রোগ্রাম করা হয়েছে?
হ্যাঁ। এই মুহূর্তে যারা যারা বেঁচে আছে সে তাদের খুন করে ফেলছে! তারপর নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে। মূল মহাকাশযানটি যখন নামবে তখন সেখানে কোনো জীবিত প্রাণী থাকবে না।
কোনো ত্রিমাত্রিক জীবিত প্রাণী থাকবে না। বৃদ্ধ মানুষটি আনন্দে হা হা করে হাসতে থাকে।
মধ্যবয়স্ক মানুষটিও হাসিতে যোগ দেয়। হ্যা কোনো ত্রিমাত্রিক জীবিত প্রাণী থাকবে না।
দুজন আনন্দে হাসতে হাসতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেখানে মহাকাশযানটি ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করেছে। আর আটচল্লিশ ঘণ্টার মাঝেই ওটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতর প্রবেশ করবে!
বৃদ্ধ মানুষটি তার পাকা চুলের ভিতর আঙুল প্রবেশ করিয়ে খিকখিক করে হাসতে হাসতে হঠাৎ একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে মাথা ঘুরিয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে। বলল, সেটি যদি ঠিক করে নামতে না পারে? নামতে গিয়ে যদি ধ্বংস হয়ে যায়?
তাতে কিছু আসে–যায় না, এক হিসাবে বরং সেটি আরো ভালো, পুরো মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে কোনো কিছুর কোনো প্রমাণ থাকবেনা! আর্কাইভ ঘরে যে ভল্টটি আছে সেটি কিছুতেই ধ্বংস হবে না। ওর ওপর নিউক্লিয়ার বোমা ফাটালেও ওটার কিছু হবে না। আমরা যেটা চাইছি সেটা ঠিক ঠিক পৃথিবীতে নেমে আসবে। আর্কাইত ঘরের জন্য পুরোপুরি আলাদা নিয়ন্ত্রণ, ইঞ্জিন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবকিছু আছে! আমাদের এই প্রজেক্টে কোনো খুঁত নেই!
বৃদ্ধ মানুষটি তার কুতকুতে চোখ ছোট করে আবার আনন্দে হাসতে থাকে!