৩-৪. সড়কপথে সরাসরি বাসন্তী

০৩.

সড়কপথে সরাসরি বাসন্তী পৌঁছোনো যায় না। গাড়ি যায় সোনাখালি পর্যন্ত। বাসন্তীর চারপাশে জল। সোনাখালি আর বাসন্তীর মাঝে খাল আছে একখানা। নাম পুরন্দর। ভোর থেকে রাত, পুরন্দরে ফেরি পারাপার চলে অবিরাম।

সোনাখালি অবধি যেতে প্রায় দুটো বেজে গেল। পথে একবারই মাত্র থেমেছিল গাড়ি, ঘটকপুকুর বাজারে। ডাব খাওয়ার জন্য। বাদবাকি সময় শাঁই শাঁই ছুটেছে টাটা সুমো। প্রায় গোটা পথই দুধারে শুধু মাছের ভেড়ি। মাইলের পর মাইল জলাশয়, চলছে তো চলছেই। এদিকটায় যে এত ভেড়ি আছে টুপুরের জানা ছিল না। মাছের আঁশটে গন্ধে মাঝেমাঝে গা যেন গুলিয়ে ওঠে।

গাড়িতে অনেক জ্ঞান লাভ হয়েছে টুপুরের। পার্থমেসোর কল্যাণে। সুন্দরবন নিয়ে যা দীর্ঘ একটা বক্তৃতা দিল মেসো! সুন্দরবন নাকি পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ, সুন্দরবনের বেশিরভাগটাই নাকি পড়েছে বাংলাদেশে, সুন্দরবনের মতো ভয়ংকর অরণ্য নাকি দুনিয়ায় আর দুটো নেই। জঙ্গলের নদীগুলোতে তো কুমির আর কামট থিকথিক করে। জলে নেমেছ কী ওমনি ঘ্যাচাংফু, পা একেবারে ছিঁড়ে নেবে। আর ডাঙায় তো ঘুরছেই পৃথিবীর হিংস্রতম প্রাণী। দ্য রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বিষধর সাপও কিলবিল করছে জঙ্গলে। কেউটে, গোখরো, চন্দ্রবোড়া, শঙ্খচূড় … এদের কেউ কেউ নাকি গাছ থেকেও ঝোলে। এ ছাড়া জোঁক আর বিষাক্ত পোকামাকড় তো আছেই।

তা সোনাখালি সুন্দরবনের অংশ হলেও সোনাখালিতে কিন্তু জঙ্গলের চিহ্নমাত্র নেই। বড়সড় এক গঞ্জই বলা যায়। অজস্র দোকানপাট। লোকজনের ভিড়ও নেহাত কম নয়।

ড্রাইভার গাড়ি থামিয়েছিল বাসস্ট্যান্ডের পাশেই। গাড়িতে বসেই অনিশ্চয় হুকুম ছুড়লেন, মানিক, নেমে ঝটপট একটা ভাল খাওয়ার জায়গা খুঁজে বার করো তো।

মিতিন বলল, এখানে কেন? একেবারে বাসন্তী গিয়েই তো লাঞ্চ সারলে হত।

ওরে বাবা, না না। ছুঁচোরা পেটে খঞ্জনি বাজাচ্ছে। বেশি খিদে পেলে আমার আবার দৃষ্টিশক্তিটাও কেমন ক্ষীণ হয়ে আসে।

আমারও। পার্থও তালে তাল দিল, শুধু চোখ কেন, আমার হাত-পা কান-মাথা, সবই কেমন ঢলঢলে হয়ে যায়।

খিদে টুপুরেরও পেয়েছিল। সকালের দুখানা মশলা ধোসা কখন হজম। রাস্তাতেও যা ঝাঁকুনি ছিল, বাপস!

মিনিট দু-তিনের মধ্যেই একটা ভদ্রগোছের হোটেলের সন্ধান মিলল। তেমন আহমরি কিছু নয়, তবে পরিবেশ মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। এই ভরদুপুরে দোকানটায় তেমন ভিড়ও নেই, শুধু জনা দু-চার হাটুরে লোক বেঞ্চিতে বসে ভাত খাচ্ছে।

দোকানের মালিকটি মাঝবয়সি। খালি গা, পরনে চেক লুঙ্গি। কাউন্টারে বসে পাখার বাঁট দিয়ে পিঠ চুলকোচ্ছিল লোকটা। টুপুরদের দলটাকে দেখে সে রীতিমতো শশব্যস্ত। সাদা পোশাকে থাকলেও অনিশ্চয় যে একজন জাঁদরেল কেউ, সেটা বুঝি তাঁর হাবভাব, হাঁটাচলা দেখেই পলকে মালুম করে নিয়েছে।

উঠে দাঁড়িয়ে নিয়ে গদগদ স্বরে বলল, আসুন স্যার, বসুন স্যার। অ্যাই ভুতো, তিন নম্বর টেবিলটায় ভাল করে ন্যাতা লাগা তো।

সঙ্গেসঙ্গে ভুতো নামের কালো-সিড়িঙ্গে ছোকরাটি নেমে পড়েছে কাজে। রাস্তাতেই একগাদা জলের বোতল কিনেছিলেন অনিশ্চয়। তার মধ্যে থেকে ঢাউস বোতল দুখানা বগলদা করে বসলেন বেঞ্চিতে। ভরাট গলায় হাঁক ছাড়লেন, চারটে গ্লাস দিয়ে যাও তো। গরম জলে ধুয়ে।

 পাৰ্থ ফুট কাটল, গরম জল লাগবে না। এদের ড্রামের জল এমনিতেই তেতে আছে।

মালিক নিজেই গ্লাস এনে রাখল টেবিলে। জিজ্ঞেস করল, বলুন স্যার, কী খাবেন?

প্লেন পাঁঠার ঝোল আর ভাত, ব্যস।

আজ্ঞে, আজ বেস্পতিবার স্যার। পাঁঠা তো হবে না।

তা হলে মুরগি চলুক।

মুরগি স্যার ফুরিয়ে গিয়েছে। বাটাম পাখির মাংস পেয়ে যাবেন।

টুপুর জিজ্ঞেস করল, বাটাম পাখিটা কী?

মিতিন বলল, ছোট ছোট পাখি। কাদাখোঁচারই একটা ভ্যারাইটি। ট্রাই নিয়ে দেখতে পারিস, … বেশ সুস্বাদু।

পার্থ তো মাংস হলেই খুশি। গন্ডার কিংবা গেরিলা হলেও তার চলত। অনিশ্চয়েরও আপত্তি নেই। তিনি নাকি সর্বভুক। গোরু-শুয়োর-মোষ-হরিণ সবই তাঁর চলে। নাগাল্যান্ডে তিনি নাকি সাপের মাংস খেয়েছেন। অতএব অর্ডার দিতেও আর দ্বিধা রইল না।

আহার আসার আগে প্রায় হাফ বোতল জল খেয়ে ফেললেন অনিশ্চয়। পার্থ তাঁকে জিজ্ঞেস করল, বাসন্তী পৌঁছে আপনি কি সোজা ডক্টর সান্যালের বাড়ি যাবেন? নাকি আগে বাসন্তী থানা?

নানা, থানায় এখন কিছুটি জানাবনা। সটান সুমন্ত্ৰ সান্যালের বাড়ি, জেরাটেরা সারব, তারপর থানার খবর নিচ্ছি। আস্ত এক বিজ্ঞানী বেমালুম লোপাট হয়ে যাবে, এ কি মামদোবাজি পায়া হ্যায়?

হুম। আশা করি ডক্টর সান্যাল নিজের অজান্তে কিছু ক্লু ছেড়ে গিয়েছেন।

সেগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতেই তো এই শর্মার আগমন।

কথার ফাঁকেই গরমগরম ভাত হাজির। লাল লাল মোটা মোটা চাল। সম্ভবত ঢেঁকিছাঁটা। সঙ্গে স্টিলের বাটিতে আলু-ঝোলসহ মাংস। অনিশ্চয়ের আর তর সইছিল না, আস্ত বাটিটাই উলটে দিলেন শালপাতার থালায়। খাচ্ছেন হাপুসহুলুস। বড় বড় গ্রাসের ঝোলভাত নিমেষে মিলিয়ে যাচ্ছে তাঁর মুখগহ্বরে। পার্থও পিছিয়ে নেই, তারও হাত-মুখ বেজায় ব্যস্ত। মিতিন টুপুরও ভাত ভাঙল।

ভাতের স্বাদটা বেশ। কেমন যেন মিষ্টিমিষ্টি। মাংসটাও অন্য রকম। অনেকটা দিশি মুরগির মতো, তবে হাড়গুলো ভারী নরম। তৃপ্তি করে খাচ্ছিল টুপুর। নিঃশব্দে। একটা প্রশ্ন বহুক্ষণ ধরে পাক খাচ্ছে মাথায়। শেষমেশ জিজ্ঞেসই করে ফেলল, আচ্ছা মিতিনমাসি, সুমন্ত্ৰ সান্যাল একজন বিজ্ঞানী মানুষ..নিশ্চয়ই প্রখর বুদ্ধিমান… তিনি যদি স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করে থাকেন, তা হলে তাঁকে খুঁজে বের করা কি সহজ হবে?

অনিশ্চয় আগ বাড়িয়ে বললেন, স্বেচ্ছায়, না অনিচ্ছায় জানছ কী করে? সুমন্ত্ৰবাবুকে তো কেউ গুমও করতে পারে।

কেন গুম করবে?

মোটা মুক্তিপণের আশায়।

পণের টাকাটা দেবে কে? উনি তো শুনলাম এখানে একাই থাকেন।

এ যুক্তি অবশ্য জজে মানে। হয়তো অন্য কোনও মোটিভ আছে তা হলে, পার্থ এক টুকরো মাংস মুখে পুরে বলল, অনেক সময় উগ্ৰপন্থীরাও বিজ্ঞানীদের তুলে নিয়ে যায়। ফর্মুলাটর্মুলা হাতানোর জন্য।

কিন্তু ক্যান্সার নিয়ে রিসার্চ করা বিজ্ঞানীকে কি তারা আমল দেবে? সুমন্ত্ৰ সান্যাল অ্যাটম বোমাটোমা নিয়ে কাজ করলেও নয় কথা ছিল। ঠিক কিনা?

দোকানের মালিকটি পেঁয়াজ-লঙ্কা রাখতে এসেছিল টেবিলে। টুপুরদের কথোপকথন শুনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আমতা আমতা করে বলল, কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনারা কি ঝুঁকোবাবুর কথা বলছেন?

অনিশ্চয়ের চোখ তেরচা, কে ঝুঁকোবাবু?

ওই যে, বাসন্তীতে থাকেন। যিনি সাপের বিষ থেকে কী সব ওষুধপত্র বের করছেন। লম্বা মানুষ তো, অনেকটা ঝুঁকে হাঁটেন, তাই সকলে ঝুঁকোবাবু বলে।

অ আপনার সঙ্গে পরিচয় আছে?

বিলক্ষণ। যখন থেকে উনি নস্করদের বাগানবাড়িটা কিনে বাসন্তীতে বসবাস শুরু করলেন, তখন থেকেই চিনি। সেও না হোক চার-পাঁচ বছর হবে। ভারী সজ্জন ব্যক্তি। অত পণ্ডিত, অথচ এতটুকু দেমাক নেই। বাসন্তী থেকে এপারে এলে আমার দোকানের সামনে দিয়েই তো ওঁকে যেতে হয়। কখনওসখনও আমার এখানে চাবিস্কুটও খান।

তাই নাকি?

হ্যাঁ স্যার। ঝুঁকোবাবুর কাজের লোকটির সঙ্গেও ভাল পরিচয় আছে। নীলাম্বর বসিরহাটের দিকে বাড়ি। ন্যাজাটে। নীলাম্বরও বলে, বাবুর মতো নাকি মানুষ হয় না।

অনিশ্চয় সোজা হয়ে বসেছেন। পুলিশি মেজাজে বললেন, তা এতই যদি জানেন, আপনাদের ঝুঁকোবাবুর হারিয়ে যাওয়ার সংবাদটিও নিশ্চয়ই আপনার অবিদিত নেই?

লোকটা সেকেন্ডের জন্য থমকাল। পরক্ষণেই মুখে একগাল হাসি, ও হরি, আপনারা এখনও লাস্ট নিউজটা পাননি? ঝুঁকোবাবু তো ফিরে এসেছেন।

অ্যাঁ? অনিশ্চয়ের গলা দিয়ে শব্দটা বিটকেলভাবে ঠিকরে এল। মুখ হাঁ হয়েই রয়েছে, আর বন্ধ হচ্ছে না।

টুপুরও হতভম্ব। একবার পার্থমেসোকে দেখছে, একবার মিতিনমাসিকে। দুজনেরই খাওয়া থেমে গিয়েছে, দুজনেরই চোখে বিস্ময়।

পাৰ্থ বিড়বিড় করে বলল, যাঃ বাবা! সুমন্ত্ৰ সান্যাল ইজ ব্যাক? কবে?

এই তো, গত কালই, রাতে। তখন বোধহয় সাড়ে আটটা মতো হবে। দোকানে গরম বলে বাইরে টুল নিয়ে বসে ছিলাম। হঠাৎ দেখি ঝুঁকোবাবু ঘাড় নামিয়ে লম্বালম্বা পায়ে ফেরিঘাটের দিকে যাচ্ছেন। সোনাখালি বাজারের কেউই আগে খেয়াল করেনি, আমিই প্রথম। আমার মুখ থেকে শুনেই তো দু-চারজন ঘাটের দিকে দৌড়োল। দেখে এল স্বচক্ষে, লোকটার হাসি আরও চওড়া হল, তারপর তো হাওয়ায় হাওয়ায় রটে গেল খবরটা। এই তো, এগারোটা নাগাদ টিভির লোকরাও ক্যামেরা কাঁধে হুড়তে-পুড়তে হাজির।

টিভির লোক? অনিশ্চয়ের নাকের পাটা ফুলে উঠল, আমার আগে তারা খবর পায় কী করে?

মিতিন বলল, নিশ্চয়ই বাসন্তীতে ওদের সোর্স আছে এবং ক্যানিংয়ে কোনও করেসপন্ডেন্ট। সোর্স মারফত খবর পেয়েই চ্যানেল হয়তো নিউজটা ক্যাচ করতে এসে গিয়েছে। সর্বপ্রথম কভার করতে পারলে চ্যানেলের ইজ্জত বেড়ে যাবে না?

তবু খবরটা তো আমারই আগে পাওয়া উচিত, অনিশ্চয় গজগজ করছেন, আমার সোর্স এখানে কী করছে? ফ্রায়িং ভ্যারেন্ডা?

লোকটা চোখ নাচাল, আপনারা কোথা থেকে স্যার? কোন নিউজ পেপার?

আমরা কাগজের লোক নই। অনিশ্চয়ের গোমড়া জবাব। পর মুহুর্তেই ভুরু কুঁচকে পালটা প্রশ্ন, তা সেই টিভি চ্যানেলের লোকগুলো কি এখনও বাসন্তীতে?

গুলো নয় স্যার। মাত্র দুজন। খানিক আগে তারা ফিরেও গিয়েছে।

কেন?

ঝুঁকোবাবু নাকি দেখাই করেননি। গেট থেকেই হাঁকিয়ে দিয়েছেন।

মিতিন চাপা স্বরে অনিশ্চয়কে বলল, যাক, নিশ্চিন্ত হলেন তো? আপনাকে আর টিভি ক্যামেরা পাকড়াও করতে পারল না!

যা বলেছেন। ব্যাটারা যা উলটোপালটা প্রশ্ন জোড়ে। অনিশ্চয়ের স্বরও খাদে, মনে হয় যেন আমরাই আসল অপরাধী!

আর কী, এবার তা হলে ঠান্ডা মাথায় সত্যিকারের অপরাধটা সম্পূর্ণ করুন।

মানে?

আশা করি জানেন, বাটাম-কাদাখোঁচা… আই মিন, স্নাইপস জাতীয় পাখি হত্যা আইনত দণ্ডনীয়? মিতিন ঠোঁট টিপে হাসছে, আর আপনি আইনের রক্ষক হয়ে এতক্ষণ সেই পাখিরই মাংস…?

মুখটাকে গম্ভীর রাখতে গিয়েও অনিশ্চয় হেসে ফেললেন, ঝঞ্ঝাট পাকালেন তো! এখন আর কি শান্তিতে এ পাখি গলা দিয়ে নামবে?

আহা, আপনি তো কচি মুরগি ভেবে খাচ্ছেন। পাৰ্থ চোখ টিপল, দোকানদার যদি আপনাকে ঠকিয়ে অন্য কিছু খাওয়ায়, তাতে আপনার কী দোষ?

অনিশ্চয় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হালকা মেজাজে সাঙ্গ হল আহারপর্ব। বিল মিটিয়ে পার্থর সঙ্গে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন অনিশ্চয়। টুপুরও মৌরি মুখে দিয়ে মিতিনের সঙ্গে বেরিয়ে আসছিল, হঠাৎই মিতিন কী ভেবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হোটেল মালিকটিকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, ডক্টর সুমন্ত্ৰ সান্যালকে দেখে আপনারা তো কাল খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, তাই না?

হব না? মানুষটাকে নিয়ে এত তোলপাড় হল। টিভিতে, খবরের কাগজে…!

তা আপনারা কেউ গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এ কদিন তিনি ছিলেন কোথায়?

সুযোগ পেলাম কই? যা হনহনিয়ে চলে গেলেন। ভুটভুটিটাও ছেড়ে দিল সঙ্গেসঙ্গে।

আর-একটা কথা। ডক্টর সান্যালের কুকুরটাকেও কি পাওয়া গিয়েছে?

কই আর! সেটাও তো একটা খবর। গত হপ্তায় সোনাখালির হাটে এসেছিল নীলাম্বর। তখনই বলছিল, কুকুরটার জন্য ঝুঁকোবাবু নাকি বড় বিমর্ষ থাকেন।

কীভাবে হারাল কিছু শুনেছেন?

কী বলি বলুন তো দিদি? সে কুকুর তো ইদানীং নাকি রাতে ছাড়াই থাকত। কোনও শেয়ালটেয়াল ঢুকেছিল হয়তো বাগানে। তার সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে… অবশ্য তা হলে তো কুকুরটার বডিই পাওয়া যেত।

হুম।

আনমনা মুখে বেরিয়ে এল মিতিন। পার্থ কানখাড়া করে মিতিনের প্রশ্নগুলো শুনছিল। ঠাট্টার সুরে বলল, বিজ্ঞানী অন্তর্ধান রহস্য গুবলেট হয়ে গেল বলে তুমি কি এখন ডোবারম্যানটাকে নিয়ে পড়লে?

না। জাস্ট কৌতূহল।

পার্থ দুহাত তুলে অনিশ্চয়কে বলল, তা হলে আর আমাদের বাসন্তী যাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না তো? গাড়ি এখানে রেখে আমরা তা হলে একটু নদীবক্ষে ভ্রমণ করে আসি?

আপনারা বেড়াতে চাইলে বেড়ান, অনিশ্চয়ের মুখে গাম্ভীৰ্য ফিরে এসেছে, আমি বাসন্তী যাচ্ছি। টু মিট দ্যাট ট্রাবলশুটার। কখনও ফোন করে কুকুর হারিয়েছে বলে জ্বালাতন করবেন, কখনও নিজেই হারিয়ে গিয়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত করবেন, এ তো চলতে পারে না। তা ছাড়া সোনাখালির কোন লোক কী গপ্পো শুনিয়ে দিল, তার উপর বেস করে আমি নাচতে নাচতে ফিরে গেলাম…উহুঁ, আমি সে বান্দা নই। ইনফর্মেশনটা ভেরিফাই করতে হবে না?

মিতিন বলল, বটেই তো। আমাদের তো একবার চর্মচক্ষে দেখে আসা দরকার।

পার্থ বলল, কিন্তু শুনলে তো, উনি কাউকে মিট করছেন না।

আলত করবেন। অনিশ্চয় শূন্যে মুঠো পাকালেন, আমি গিয়ে দাঁড়ালে… বলতে বলতে অনিশ্চয় আরও উত্তেজিত, যদি সত্যি সত্যি সুমন্ত্ৰ সান্যাল ফিরে এসে থাকেন, তবে বাসন্তী থানার কপালে খুব দুঃখ আছে। ফর নাথিং আমাকে এত দূর ছুটিয়ে আনা।

আহা, এত চটছেন কেন? মিতিন ঠান্ডা করতে চাইল অনিশ্চয়কে, ধরে নিন না, এক বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলাপ করার জন্যই একটা দিন খরচ করলেন।

 হুঁঃ। যত্তো সব…।

 মানিককে গাড়িতেই থাকতে বলে ঘাটের দিকে এগোলেন অনিশ্চয়, গটমট পায়ে। কাছেই ঘাট। ভাটার টান চলছে এখন পুরন্দরে, জল খানিকটা সরে গিয়েছে, পাড়ে থকথকে এঁটেল মাটি। ভুটভুটিতে ওঠার জন্য সরু কাঠের পাটাতন পেতে দেওয়া হয়েছে একটা। অত সরু কাঠের উপর দিয়েও দিব্যি যাতায়াত করছে স্থানীয় লোকজন। কেউ কেউ আবার কাঁধে সাইকেল নিয়ে। কিংবা মালের বোঝা।

টুপুরের তো দেখেই বুক টিপঢিপ করছিল। পাটাতন থেকে পা পিছলোলেই চিত্তির! ওই তলতলে কাদায় কোমর পর্যন্ত গেঁথে যাবে! নিশ্বাস বন্ধ করে কাঠটা পার হল টুপুর। শেষ কয়েকটা পা তো প্রায় দৌড়ে। ভুটভুটিতে উঠে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

লোক ভরতি হতেই মেশিন বসানো নৌকো সশব্দে রওনা দিয়েছে। সোনাখালি থেকে বাসন্তী খুবই সামান্য দূরত্ব। তিন-চার মিনিটের বেশি লাগবার কথা নয়। ভাটার জন্য সময় যেন একটু বেশিই লাগছে। সওয়া তিনটে বাজে। সূর্য অনেকটাই পশ্চিমে হেলে গিয়েছে, তবু রোদ্দুরের কী তেজ! হাওয়া দিচ্ছে অল্প অল্প। নোনা বাতাস। কেমন যেন একটা গন্ধও আছে বাতাসে। আঁশটেআঁশটে, সোঁদাসোঁদা।

এটাই কি সুন্দরবনের গন্ধ? টুপুর বুঝতে পারছিল না।

.

০৪.

বাসন্তীতে ডক্টর সুমন্ত্ৰ সান্যালের ডেরা খুঁজে বের করা মোটেই কঠিন নয়। প্রতিটি ভ্যান-রিকশাওয়ালাই বাড়িটি চেনে। তবে ভ্যানরিকশায় চড়ার ব্যাপারে অনিশ্চয়ের ঘোর আপত্তি। খোলা পাটাতনে অমন বেআব্রুভাবে পা ঝুলিয়ে বসলে আই জি সাহেবের নাকি মানসম্মান খোয়া যাবে!

অগত্যা হন্টন। লোকমুখে শুনে যা বোঝা গেল, মাত্ৰ মিনিট দশবারোর পথ। পিচরাস্তা ধরে ফেরিঘাটের লাগোয়া বাজারমতো। এলাকাটা পেরোলে একটা গির্জা পড়ে বাঁয়ে। তারপর আরও খানিক এগোলে, ডান হাতে বিজ্ঞানীর বাসভবন। একতলা বাড়ি। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বলে দূর থেকে নজরে আসে না। তবে লম্বালম্বা লোহার শিকওয়ালা গেটখানার সামনে এলে গোটা বাড়িটাই চোখে পড়ে যায়। অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি। সামনে জমিও নেহাত কম নেই। বাড়ির ছাদে শোভা পাচ্ছে ডিশ অ্যান্টেনা এবং সোলার প্যানেল।

ভিতর থেকে তালা ঝুলছে গেটে। অনিশ্চয় হাঁক পাড়লেন, আই, কে আছ? গেট খোলো।

সাড়াশব্দ নেই।

এক-দুবার ডাকাডাকি করেই অনিশ্চয়ের মেজাজ টংয়ে। বাজখাঁই হুংকার ছুড়লেন, হচ্ছেটা কী, অ্যাঁ? কতক্ষণ গরমে দাঁড়িয়ে থাকব? তালা ভেঙে টুকতে হবে নাকি?

এতক্ষণে কাজ হল। কোত্থেকে এক বছরতিরিশের লোক হাঁপাতে হাঁপাতে উপস্থিত। ফটকের ওপার থেকে প্রশ্ন করল, আপনারা..?

ডক্টর সান্যালের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

কিন্তু স্যার তো কারও সঙ্গে দেখা করছেন না। ওঁর শরীর ভাল নেই।

পার্থ অনিশ্চয়কে দেখিয়ে বলল, এঁকে চেনেন? পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের আই জি। অনেক উঁচুতলার অফিসার। কলকাতা থেকে এসেছেন। না ঢুকতে দিলে উনি কিন্তু থানা থেকে পুলিশ এনে দরজা ভাঙবেন।

ও, আপনারা পুলিশ? আগে বলবেন তো! লোকটা চটপট গেট খুলে দিল, সকাল থেকে এত উটকো লোক এসে উৎপাত করছে! এই তো, কারা যেন ক্যামেরাট্যামেরা নিয়ে এসেছিল। যত বলি স্যার ক্লান্ত, আজ বিশ্রাম নেবেন…কিছুতেই শোনে না।

কম্পাউন্ডে ঢুকতে ঢুকতে মিতিন জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম তো নীলাম্বর, তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ। নীলাম্বর বিশ্বাস।

ডক্টর সান্যালের আসিস্ট্যান্ট?

ওই আর কী। নীলাম্বর গলে গেল, স্যারের দেখাশুনো করি। যতটুকু পারি সাহায্যও করি কাজে।

টুপুর লোকটাকে ভাল করে দেখে নিচ্ছিল। বেশ ঝকঝকে চেহারা, সুন্দর স্বাস্থ্য, কায়দা করে ছাঁটা চুল,হাতে সোনালি ডায়ালের ঘড়ি, পরনে আধুনিক কেতার থ্রি-কোয়ার্টার শর্টস, স্যান্ডো গেঞ্জি, পায়ে কেডস। দেখে কাজের লোক বলে আদৌ মনে হয় না। অনুমান করতে অসুবিধে নেই, সুমন্ত্ৰ সান্যালের বাড়িতে বেশ জাঁকিয়েই বাস করে নীলাম্বর।

গেট থেকে বাড়ি পর্যন্ত মোরাম বিছানো সরু পথ। সারসার ইট দিয়ে ঘেরা। দুপাশে ফুলগাছ আছে কিছু। গোলাপ, জবা, বেল, কামিনী। তবে গাছগুলোর চেহারা ভাল নয়, কেমন মরামরা টাইপ গোলাপ আর জবা ফুটে আছে, কিন্তু বেশ শুকনো শুকনো। একটা ঝাঁকড়া আমগাছও আছে, তবে তাতে ফল আসেনি। আমগাছের তলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে খান চার-পাঁচ বাঁশ।

বারান্দায় উঠে সামনের বড় ঘরটা খুলে দিল নীলাম্বর। বলল, ড্রয়িংরুমে একটু বসুন। আমি স্যারকে খবর দিচ্ছি।

মিতিন সম্ভ্রমের সুরে জিজ্ঞেস করল, ডক্টর সান্যালের কি সত্যিই শরীর খারাপ? মানে শুয়েটুয়ে আছেন?

দেখছি। স্যার বোধহয় এখন ল্যাবরেটরিতে। উনিই বলে রেখেছেন, আজেবাজে লোক এলে যেন ভাগিয়ে দেওয়া হয়। তা বলে সব্বাইকে তো আর সে কথা…। এই তো, সকালবেলা থানা থেকে দারোগাবাবু এসেছিলেন। তিনি তো ভিতরে গিয়ে কথা বলে এলেন।

অনিশ্চয়ের চোখ সরু, থানা কখন এসেছিল?

এই ধরুন, সাড়ে নটা-দশটা। আমি নিজেই স্যারের নিউজটা থানায় জানিয়ে আসব বলে সাইকেল বের করছি, তখনই!

আপনার কিন্তু আরও আগেই থানায় বলে আসা উচিত ছিল।

আমি তো কাল রাতেই যেতে চেয়েছিলাম। স্যার বললেন, তাড়া কীসের! আর তো তোমার টেনশন করার কিছু নেই, সকালে ধীরেসুস্থে যেয়ো।

নীলাম্বর অন্দরে যেতেই অনিশ্চয় প্রায় গর্জন করে উঠলেন, দেখেছেন লোকাল পি এসের বেআক্কেলপনাটা? আগে খবরটা পেয়ে গেলে থোড়াই আমায় কাজ ফেলে ছুটে আসতে হয়!।

উত্তেজিত হবেন না, ক্রোনোলজিক্যালি ভাবুন। মিনি শান্ত করতে চাইল অনিশ্চয়কে, আপনার দারোগাবাবুটি খোঁজখবর করে হেলতে দুলতে থানায় ফিরেছেন না হোক সাড়ে দশটায়। তিনি তো মন্ত্রীর হুড়োর খবর জানেন না, আপনি তাঁকে তাড়াও দেননি। অতএব তিনিও মিসিং পার্স স্কোয়াডে সংবাদটি দিয়েছেন ঢিমেতালে। মিসিং পার্সনড স্কোয়াড যখন আপনাকে খবরটি দিতে চাইছে, তখন আপনি অন দ্য ওয়ে টু বাসন্তী। সম্ভবত মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কের বাইরে। যদি তাঁরা এস এম এসও করে থাকেন, নেটওয়ার্কের আওতায় না এলে তো আপনি সেটিও পাবেন না।

হুঁ। অনিশ্চয় কিঞ্চিৎ শীতল হলেন। গলা নামিয়ে বললেন, বিজ্ঞানীমশাইটিও যথেষ্ট তিড়কম আছেন। কুকুর হারালে এখান থেকে আলিপুরে ফোন মারছেন, অথচ নিজে হারিয়ে ফেরত আসার পর বলেন কিনা টেনশান কোরো না।

পার্থ চাপা স্বরে বলল, দেখবেন, চটে গিয়ে ডক্টর সান্যালকে কথা শোনাবেন না যেন। টের পেয়েছেন তো, উনিও যথেষ্ট হেভিওয়েট মানুষ!

কথাবার্তার মাঝেই ঘরের চারদিকে দৃষ্টি বোলাচ্ছিল টুপুর। বড় সাইজের ঘরখানার সাজসজ্জা বেশ ছিমছাম। আসবাব সবই রট আয়রনের। সোফা, সেন্টার টেবিল, স্ট্যান্ড ল্যাম্প… দেওয়ালে গাঁথা কাচের আলমারিতে প্রচুর ইংরেজি বই। টুপুর উঠে বইগুলো একবার দেখে এল। গল্প-উপন্যাস নয়, ভারী ভারী বিজ্ঞানের কিতাব। বাঁধানো বিদেশি জানালও আছে কিছু। ঘরের এক কোণে চাকালাগানো ক্যাবিনেটে টিভি, ডিভিডি প্লেয়ার। গোছা করে ভিসিডিও রাখা আছে পাশে।

একদম উপরের ডিস্কে চোখ পড়তেই টুপুর হাঁ। হাতে তুলে দেখাল সবাইকে।

পার্থ বলল, আইব্বাস! মুঘল-এ-আজম! ডক্টর সান্যাল এসব ফিল্ম দেখেন নাকি?

মিতিন হেসে বলল, বিজ্ঞানীর কি অন্য কিছুতে আগ্রহ থাকতে পারে না? মনে রেখো, আইনস্টাইন বেহালা বাজাতেন, সত্যেন বোস এসরাজ, ফেইনম্যান ড্রাম। সুমন্ত্ৰবাবুকেই বা রসকষহীন ধরে নিচ্ছ কেন? আমার তো বরং ভদ্রলোকের রুচি সম্পর্কে শ্ৰদ্ধাই জাগছে। সুন্দর সুন্দর ফার্নিচার, কী মিষ্টি অ্যাপেলহোয়াইট দেওয়ালের রং…

হুঁ। পাৰ্থ নাক টানল, ঘরটা সদ্য রং করা হয়েছে। মেঝেতে এখনও রঙের ছিটে।

নীলাম্বর ফিরে এসেছে। ট্রেতে চার গ্লাস শরবত সাজিয়ে। কাচুমাচু মুখে বলল, স্যার কম্পিউটারে ব্যস্ত এখন। আপনাদের বসতে হবে। ততক্ষণ একটু আমপোড়ার শরবত খান।

অনিশ্চয়ের মুখে আবার বিরক্তির ছায়া! পাৰ্থ তাঁকে সামাল দিতে বলে উঠল, আহা, এই আমপোড়ার শরবতেরই দরকার ছিল এখন। খেয়ে নিন মজুমদারসাহেব, শরীর মাথা দুই-ই ঠান্ডা হবে।

নীলাম্বর নম্র স্বরে জিজ্ঞেস করল, একটু মিষ্টিটিষ্টি খাবেন তো স্যার? দূর থেকে আসছেন…

এখন কিচ্ছু লাগবে না। মিতিন মাথা নাড়ল, সোনাখালিতে ভাত খেয়েছি। পেট এখন টইটম্বুর। বরং আপনি একটু বসুন তো। আপনার সঙ্গে খানিক গল্প করি।

নীলাম্বর বসল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গা মোচড়াচ্ছে, আমাকে আবার আপনি কেন। তুমিই বলুন দিদি।

মিতিন নরম গলায় প্রশ্ন করল, তুমি স্যারের কাছে কত দিন আছ?

তা প্রায় চার বছর।

 এখানে তোমার কাজটা কী?

সবই করি। রান্নাবান্না, ঘরদোর ঝাড়পোঁছ, ওয়াশিং মেশিনে স্যারের কাপড়চোপড় কাচা, স্যারের সাপঘরের দেখভাল…। ল্যাবরেটরিতেই হাতেহাতে স্যারকে সাহায্য করি।

বাহ, অল ইন ওয়ান! তা তোমার স্যার এ কদিন ছিলেন কোথায়?

কী জানি! কলকাতাতেই হবে।

জিজ্ঞেস করোনি?

করেছিলাম। বললেন, তোর জেনে কী হবে? আমি বললাম, তা যেখানে খুশি থাকুন, খবর দ্যাননি কেন? জবাবই দিলেন না কোনও। এমন গোমড়া মুখে আছেন, বেশি ঘটাতে সাহস হচ্ছে না।

উনি কি এমনিতে বেশ হাসিখুশি? দিলখোলা?

তেমন আমুদে তিনি কোনওদিনই নন। সবসময় চিন্তায় ড়ুবে থাকেন তো। তবে রজার হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে যেন বড় বেশি মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন। খালি বলতেন, রজারটাকে বোধহয় মেরেই ফেলেছে রে।

কে মারবে?

কী জানি!

উনি কি কাউকে সন্দেহ করতেন?

 তাও তো জানি না দিদি। কখনও তে কারও নাম করেননি।

হুম। মিতিন শরবত শেষ করে ট্রেতে গ্লাস রাখল। রুমালে ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল, আচ্ছা নীলাম্বর, তুমি যখন দেখলে শুক্রবার রাতে তোমার স্যার ফিরলেন না, শনিবারই তুমি থানায় গেলে না কেন?

স্যার একবার বলেছিলেন, রাতে না ফিরলে পরদিন সকালে আসবেন। তাই ভাবলাম শনিবারটা দেখি। রোববারও সারাদিন ভাবছি, এই বুঝি স্যার এলেন, এই বুঝি এলেন…। সোমবার সকালে আর দেরি করিনি, দারোগাবাবুর কাছে রিপোর্ট লিখিয়ে এসেছি। কিন্তু উনি যে কাজেই আটকে গেছেন, কী করে বুঝব বলুন? বিপদআপদের ভয়টাই তো সবার আগে মাথায় আসে।

বটেই তো।… তা তোমার স্যারের আত্মীয়স্বজন সব কোথায়?

ম্যাডাম…মানে স্যারের ওয়াইফ আর মেয়ে তো থাকেন আমেরিকায়। আমি তাঁদের একবারই মাত্র দেখেছি। গত শীতের আগের শীতে। বাসন্তীতে এসে তাঁরা তেরাত্তিরের বেশি টিকতে পারেননি, কলকাতা চলে গিয়েছিলেন।

ও। তার মানে কলকাতায় ডক্টর সান্যালের আত্মীয়রা আছেন?

আমি নিশ্চয় করে বলতে পারব না দিদি। স্যার নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কখনও তো কিছু বলেননি।… তবে হ্যাঁ, স্যারের এক ভাই আছেন। মাঝেমাঝে তিনি ফোনও করেন।

কোথায় থাকেন তিনি?

সেটাও বলতে পারব না। সম্ভবত কলকাতাতেই। কিন্তু বাসন্তীতে তিনি কখনও আসেননি।

এমনি লোকজন নিশ্চয়ই ডক্টর সান্যালের কাছে আসেন? মানে গবেষণাটবেসনার ব্যাপারে?

আসেন। কালেভদ্রে। তাঁদের সঙ্গে কাজকর্ম নিয়ে আলোচনাও হয়। বোধহয় তাঁরা গভর্নমেন্টের লোক। এসে দিনভর থাকেন, খাওয়াদাওয়া হয়, মিটিং চলে… ও হ্যাঁ, মাসদুই আগে তিনজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। বেশিক্ষণ থাকেননি। কী নিয়ে যেন স্যারের সঙ্গে কথাবার্তা হল, তারপর তাঁরা চলে গেলেন। তবে স্যার তাঁদের খুব পছন্দ করেননি, বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন।

পার্থ বলল, হয়ত ইন্টারভিউ টিন্টারভিউ নিতে এসেছিল। ডক্টর সান্যাল হয়তো ওসব পছন্দ করেন না।

হতেও পারে। পার্থকে ঝলক দেখে নিয়ে মিতিন ফের নীলাম্বরের সঙ্গে গল্পে মেতেছে, এই বাড়ি তো দেখছি সম্প্রতি রং করা হয়েছে…

ওই তো, লোকগুলো যাওয়ার পরপরই স্যারের হঠাৎ ঘরদোরের দিকে নজর পড়ল। সারাইটারাইও করলেন কিছু। ল্যাবরেটরিতে আর একটা এগজস্ট লাগালেন। রংটং শেষ হওয়ার পর স্যারের মেজাজ যখন একটু ফুরফুরে, তখনই হঠাৎ রজারের ওই কাণ্ড।

মানে, তোমাদের ডোবারম্যানটার হারিয়ে যাওয়া?

হারিয়ে নয়, বলুন উবে গেল। ওইরকম একটা বাঘা কুকুর…! রজারের আতঙ্কে এ বাড়ির ত্রিসীমানায় কেউ ঘেঁসত না। আমি যখন প্রথম কাজে এলাম, রজার তখন এতটুকু। বয়স সবে তিন মাস। সেই কুকুর কেমন ধাঁইধাঁই করে প্রকাণ্ড হয়ে গেল। চেনে বেঁধে নিয়ে বেরোলে ও আমায় টানছে, না আমি ওকে, বুঝতে পারতাম না।

রজার তোমারও খুব প্রিয় ছিল নিশ্চয়ই?

 মায়া তো পড়বেই দিদি। আমরা তিনজনই তো বাস করতাম বাড়িতে। যদি না অবশ্য স্যারের সাপ আর ইঁদুরগুলোকে গুনতিতে ধরেন, নীলাম্বরের গলা যেন একটু দুলে গেল, আহা, কী প্রভুভক্তই না ছিল রজার। স্যার হয়তো অনেক রাত অবধি কাজ করছেন… আমি শুয়ে পড়লাম… রজার কিন্তু ঠায় বসে আছে স্যারের পায়ের কাছে। স্যার খেতে বসতে হয়তো দেরি করছেন, গিয়ে স্যারের অ্যাপ্রন ধরে টানাটানি করবে! পুরোপুরি মানুষের মতো বুদ্ধি। সব বুঝত। বুঝিয়েও দিত। শুধু কথাটাই যা বলতে পারত না। একবার মঙ্গলমেসো নাতিকে নিয়ে এসেছিল…

মঙ্গলমেসোটা আবার কে?

তাও তো বটে। আপনারা তাকে চিনবেন কী করে? নীলাম্বর দাঁত বের করে হাসল, আমার মায়ের খুড়তুতো বোনের বর। সুধন্যখালিতে থাকে। মেসোই তো আমাকে এ বাড়িতে কাজে দিয়েছে। মেসো খুব ভাল সাপ ধরতে পারে। স্যারকে সাপ তো মঙ্গলমেসোই সাপ্লাই দেয়। মাসে একবার এসে বিষও বের করে দিয়ে যায় সাপের। মঙ্গলমেসো এমন সুন্দর সাপ বশ করতে জানে…

মঙ্গলমেসোর কথা পরে শুনব। তার নাতির কথা কী বলছিলে?

ও হ্যাঁ, গোপাল। তাকে তো রজার আগে কখনও দেখেনি… গেট দিয়ে সে ঢোকামাত্র ঘাঁউ করে তার কবজি কামড়ে ধরেছে…। গোপাল তারস্বরে কাঁদছে, মঙ্গলমেসো চেঁচাচ্ছে, আমি রজারকে ধমকাচ্ছি, টানাটানি করছি… রজার ছাড়বেই না। স্যার তখন শুধু দরজায় এসে একবার বললেন, রজার, লিভ হিম! ব্যস, ওমনই রজার সুড়সুড় করে সরে গেল। এমন বাধ্য কুকুর উধাও হয়ে গেলে স্যারের মনখারাপ হবে না, বলুন? স্যার ছাড়া রজারের চলত না, রজার ছাড়া স্যারের। ছোট থেকে তো স্যারের কাছেই শুত। এই তো, বাড়ি সারাইয়ের সময় থেকে রাতে ঘরের বাইরে থাকা শুরু করল। কম্পাউন্ডে চরকি দিত রাতে। স্যারই হুকুম করেছিলেন, যা ব্যাটা, তুই লায়েক হয়ে গিয়েছিস। এবার থেকে নাইট ডিউটি দে। তা কে জানত, সেই রাতপাহারা দিতে গিয়েই রজার…। সেদিনটা আবার ছিল অমাবস্যা। ঘোর অন্ধকার…

মিতিনের সঙ্গে বেশ জমে গিয়েছে নীলাম্বর। টুপুর লক্ষ করছিল, পার্থমেসোও শুনছে মন দিয়ে। কিন্তু অনিশ্চয় আঙ্কল অধৈর্য ক্ৰমশ। বারবার ঘড়িতে চোখ, ঘনঘন ফিরে তাকাচ্ছেন দরজার দিকে। কপালে বিরক্তির ভাঁজ মোটা হচ্ছে।

হঠাৎই নীলাম্বরকে দাবড়ে উঠলেন অনিশ্চয়, এই যে, তোমাদের রজারের ঝাঁপিটা এবার বন্ধ করো তো। আমরা কাজের মানুষ, বিস্তর দূর ফিরতে হবে। দয়া করে দেখে এসো, তোমার স্যারের দর্শন দেওয়ার অবকাশ হল কিনা!

হকচকিয়ে দৌড় লাগিয়েছে নীলাম্বর। সঙ্গেসঙ্গে অনিশ্চয়ের কণ্ঠেও বিদ্রূপ ধ্বনি, হুঃ, যত্ত সব। সাধুবাবাদের দরজাতেও এতক্ষণ হত্যে দিতে হয় না।

মিতিন হেসে ফেলল, রজার হারানোটা কি আপনার ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে না মজুমদারসাহেব?

টুপুর জিজ্ঞেস করল, কী হতে পারে রজারের? কেউ কিডন্যাপ করেছে?

আর হাসিও না টুপুর। কে করবে কিডন্যাপ? এক সুন্দরবনের কোনও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার যদি পয়সার লোভে কনট্রাক্ট নেয়, তো অন্য কথা, অনিশ্চয় ফেটে পড়লেন, কোনও মানুষের পক্ষে ওই বাছুরের সাইজের ওয়াচডগকে কবজা করা ইমপসিবল।

মিতিন বলল, যদি কেউ ঘুমের ইঞ্জেকশন ঠুসে দেয়? বাঘটাঘকে যেভাবে ঘুম পাড়ানো হয় আর কী।

কিন্তু অপহরণ করার তো একটা কারণ থাকবে। পার্থ বলে উঠল, কুকুরের জন্য র‍্যানসম দাবি! এখনও তো শুনিনি!

টুপুর বলল, তা হলে ডক্টর সান্যালের আশঙ্কাটাই ঠিক। রজারকে কেউ মেরেই ফেলেছে। বিষ ইঞ্জেকশন দূর থেকে শুট করে …

রিভলভারে সাইলেন্সার লাগিয়েও ট্রিগার টেপা যায়।

কিন্তু মারলটা কে? বডিটাই বা গেল কোথায়?

অনেকেই সন্দেহের তালিকায় আসতে পারে। পাৰ্থ চোখ নাচাল, ফার্স্ট সাসপেক্ট, মঙ্গল। মোটিভ, নাতিকে কামড়ানোর বদলা। সাসপেক্ট টু, কোনও চোর বা ডাকাত। পাঁচিল টপকে রজারের মুখোমুখি হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে ব্যাটাকে নিকেশ করে দিয়েছে। তিন নম্বর সাসপেক্ট, এতক্ষণ ধরে কাঁদুনি গাওয়া নীলাম্বর বিশ্বাস স্বয়ং রজার হয়তো তার কোনও কুকর্মে বাধা সৃষ্টি করছিল। আর বডি পাচার করা এখানে তো কোনও সমস্যাই নয়। বস্তায় পুরে টানতে টানতে নিয়ে পুরন্দরের খালে ফেলে দিলেই কাম ফতে। বিদ্যাধরী বা মাতলা নদীতে বিসর্জন দিলেই বা ঠেকায় কে! কুমির-কামটদেরই পোয়াবারো হবে, ফোকটে নেমন্তন্ন জুটে যাবে একটা।

তোমার থিয়েরিতে প্রচুর গলদ আছে। বিশেষ করে মোটিভগুলো নিয়ে, মিতিন ঠোঁট টিপে হাসল, মঙ্গল তো একেবারেই অ্যাবসার্ড। দ্বিতীয়ত, চোর-ডাকাত রজারকে মারলে চুরি-ডাকাতির একটা চেষ্টা হতই। হয়েছে কি? তা ছাড়া রজারের মৃতদেহ তারা সরিয়েই বা ফেলবে কেন?

ওফ, আপনারা গবেষণা থামাবেন? অনিশ্চয়ের গলা গমগম বেজে উঠল, দেখুন ম্যাডাম, রজার চুরি হোক, কী খুন, আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড। যাঁর সন্ধানে আসা, তার সঙ্গে মোলাকাত করে এখন মানেমানে কেটে পড়তে পারলে বাঁচি। অনিশ্চয়ের শেষ বাক্য তখনও সম্পূর্ণ হয়নি। দরজায় এক দীর্ঘদেহী পুরুষ। ডক্টর সুমন্ত্ৰ সান্যাল।