৩.৪ শুমান্তি আর ত্রালুস

শুমান্তি আর ত্রালুস কোনো কথা বলল না, শূন্য দৃষ্টিতে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন ঘুরে ত্রালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। চতুর্মাত্রিক প্রাণী এক্ষুনি নিশ্চয়ই আবার নিশিকে নিতে আসবে।

ত্ৰালুস জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কী করব ইরন?

প্রথমে খুব সাবধানে নিশির শরীরের সাথে বাধা ঐ সিগন্যাল বিকনটি৩৬ ধ্বংস করে দাও। তারপর নিশিকে মুক্ত করে স্কাউটশিপে ফিরে চল।

শুমান্তি বলল, আমাদের নিজেদের স্কাউটশিপে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কীশার স্কাউটশিপটাই ব্যবহার করতে পারব।

হঁ। ঠিকই বলেছ। ইরন চিন্তিত মুখে বলল, শেষ পর্যন্ত কী হবে আমরা জানি না। চতুর্মাত্রিক প্রাণীর সাথে ত্রিমাত্রিক প্রাণী যুদ্ধ করতে পারে না। আমরা বেশিরভাগ সময় তাদের দেখতে পর্যন্ত পাই না।

কিন্তু তুমি বলেছ, তারাও পায় না। অসীমসংখ্যক ত্রিমাত্রিক জগৎ আছে তার কোনটার মাঝে আমরা আছি তারা জানে না।

কিন্তু এখন জানে–নিশির শরীরের সাথে সিগন্যাল বিকন বেঁধে রেখেছে, সেখান থেকে সঙ্কেত বের হচ্ছে। তারা সেই সঙ্কেত দিয়ে আমাদের খুঁজে বের করেছে।

ত্রালুস বলল, তা হলে প্রথমে এই বিকটাই উড়িয়ে দিই।

ত্রালুস স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে নিশির দিকে এগিয়ে যায়। নিশিকে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে সে বিকনটির দিকে অস্ত্র তাক করে ট্রিগার টেনে ধরে। একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল, কালো ধোঁয়া সরে যেতেই দেখা গেল বিকনটি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। নিশি তার শরীরের সাথে বাধা শেকলটি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ত্রালুসের দিকে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ তোমাকে।

আমার নাম ত্রালুস।

ধন্যবাদ ত্রালুস।

শুমান্তি এগিয়ে এসে বলল, আমি শুমান্তি।

নিশি শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে বাঁচানোর জন্য এসেছ বলে তোমাদের অনেক ধন্যবাদ।

ইরন আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, ধন্যবাদ দেওয়ার কিংবা নেওয়ার সময় মনে হয় নেই। চতুর্মাত্রিক প্রাণী আবার আসছে। আমার মনে হয় আমাদের ফিরে যাবার চেষ্টা করা উচিত।

সবাই আকাশের দিকে তাকাল। ধূসর আকাশে আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে। থলথলে কুৎসিত মাংসপিণ্ড দেখা দিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ইরন কঠোর গলায় বলল, সবাই অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাক।।

শুমান্তি অস্ত্র হাতে তুলে চারদিকে তাকাল, বলল, ওরা কি আমাদের দেখছে?

ইরন মাথা তুলে তাকাল, চারদিক থেকে ঘিরে আসা আলোর বিচ্ছুরণগুলো আরো কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে, থলথলে মাংসপিণ্ডগুলোকে আরো জীবন্ত বলে মনে হচ্ছে। ইরন গলার স্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,  ওরা আমাদের দেখছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা নিজেরা নিজেদেরকে যেভাবে দেখি ওরা তার চাইতে অনেক ভালোভাবে। দেখছে।

শুমান্তি ভয় পাওয়া গলায় বলল, সর্বনাশ!।

ইরন হাতের অস্ত্রটি শক্ত করে ধরে রেখে বলল, আমাদের যেহেতু দেখে ফেলেছে, আমার মনে হয় তা হলে ভালো করেই দেখুক। জানুক যে আমরা কিছুতেই নিশিকে নিতে দেব না। তোমরা অস্ত্র তাক করে নিশিকে ঘিরে দাঁড়াও।

ত্রালুস আর শুমান্তি নিশির দুই পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ত্রালুস কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, যদি হঠাৎ করে হাজির হয় তা হলে কী করব।

গুলি করবে। আমরা যে নিশিকে নিতে দেব না সেটা বোঝানোর আর কোনো পথ আমার জানা নেই।

যদি সত্যিই ওরা বুদ্ধিমান প্রাণী হয়ে থাকে তা হলে ওরা কি আমাদের মনের কথা বুঝতে পারছে না?

আমি জানি না। যদি জেনে থাকে তা হলে ভালো।

কিন্তু দেখা গেল চতুর্মাত্রিক প্রাণীরা ওদের মনের কথা জানে না। নিশিকে ঘিরে রেখে তিন জন স্কাউটশিপের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই হঠাৎ করে তাদের সামনে প্রথমে একটা তীব্র আলোর বিচ্ছুরণ এবং প্রায় সাথে সাথে থলথলে একটা মাংসপিও হঠাৎ করে তাদের সামনে এসে হাজির হল। মাংসপিণ্ডটি সামনে একবার দুলে উঠে তারপর ধাক্কা দিয়ে তাদের নিচে ফেলে দেয়। কিছু বোঝার আগেই থলথলে মাংসপিণ্ড থেকে অনেকগুলো শুড় বের হয়ে আসে, শুড়গুলো সাপের মতো কিলবিল করে ওঠে। তারপর হঠাৎ সেগুলো বিদ্যুদ্বেগে নিশির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, নিশি ভয়াবহ আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, তার। মাঝেই খুঁড়গুলো নিশিকে জড়িয়ে নিজের দিকে টেনে নেয়। মাংসপিণ্ডের এক অংশ হঠাৎ করে অন্ধকার গহ্বরের মতো খুলে যায় এবং ঔড়গুলো যাচকা টানে নিশিকে সেই অন্ধকার গহ্বরের মাঝে টেনে নিয়ে যায়। নিশির আর্তচিৎকার হঠাৎ করে থেমে গিয়ে এক ভয়াবহ। নীরবতা নেমে আসে।

ইরন অস্ত্র হাতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, থলথলে এই মাংসপিণ্ডের মাঝে নিশি আটকা পড়ে আছে, তাকে কি সে এখন গুলি করতে পারবে? গুলির বিস্ফোরণে নিশিও কি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে না? ত্ৰালুস এবং শুমান্তিও উঠে দাঁড়াল। অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে, কী করবে বুঝতে পারছে না।

ইরন দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করে। একটি চতুর্মাত্রিক প্রাণী ত্রিমাত্রিক জগৎ থেকে একটি ত্রিমাত্রিক প্রাণীকে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে কি কোনোভাবে থামানো যায় না? চতুর্মাত্রিক প্রাণীকে কি ত্রিমাত্রিক জগতে আটকানো যায় না? ত্রিমাত্রিক প্রাণী যদি দ্বিমাত্রিক জগতের ভিতর দিয়ে যেত তা হলে কী হত? একটি দ্বিমাত্রিক প্রাণী যদি ত্রিমাত্রিক প্রাণীকে আটকানোর চেষ্টা করত তা হলে কী করত? চিন্তা করার খুব বেশি সময় নেই, কিছু একটা করতে হবে, সামনে ঝুলে থাকা এই থলথলে মাংসপিণ্ডটি একবার অদৃশ্য হয়ে গেলে আর কখনো তারা এই চতুর্মাত্রিক প্রাণীটিকে খুঁজে পাবে না। নিশিকে নিয়ে সে চিরদিনের জন্যে মহাবিশ্বের বিশাল চতুর্মাত্রিক জগতে হারিয়ে যাবে। ইরন থলথলে কুৎসিৎ মাংসপিণ্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে, এখানে নিশ্চয়ই প্রাণীটির চোখ, নাক, মুখ বা অন্য স্পর্শ ইন্দ্রিয় লুকিয়ে আছে, প্রাণীটি হয়তো তাদের। দেখছে, তাদের নির্বুদ্ধিতা দেখে পরিহাস করছে। হয়তো প্রচণ্ড ক্রোধে তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, হয়তো তাদের নিয়ে কৌতুক করছে। কিন্তু এই থলথলে মাংসপিণ্ডটি একবার অদৃশ্য হয়ে গেলে আর তারা এর নাগাল পাবে না। কিন্তু প্রাণীটি অদৃশ্য চতুর্মাত্রিক জগৎ থেকে তাদের দেখতে পারবে। তাদের নিয়ে পরিহাস করতে পারবে, তাদের ওপর ক্রোধান্বিত হতে পারবে। কৌতুক করতে পারবে। এই প্রাণীটিকে কিছুতেই চলে যেতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না।

ইরন দেখতে পায় সরূসর শব্দ করে এই মাংসপিণ্ডটি তার আকৃতি পরিবর্তন করছে, কখনো বড় হচ্ছে কখনো ছোট হচ্ছে, কখনো তার ভিতর থেকে বিচিত্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বের হয়ে আসছে। ইরন জানে প্রাণীটি আসলে তাদের এই জগতের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, তাই তাদের। কাছে মনে হচ্ছে এটি আকৃতি পরিবর্তন করছে। প্রাণীটির যে অংশ এই জগতের মাঝে রয়েছে সেইটুকুকে এখানে আটকাতে হবে। যেভাবে সম্ভব।

ইরন দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করে, সময় চলে যাচ্ছে, যে কোনো মুহূর্তে প্রাণীটি অদৃশ্য। হয়ে যেতে পারে, যেটাই করতে হয় সেটা খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। তার মাথায় হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা উঁকি মারে, ব্যাপারটা আদৌ সম্ভব কি না সে নিশ্চিত নয় কিন্তু এখন আর ভেবে দেখার সময় নেই। সে চিৎকার করে ত্রাস আর শুমান্তিকে ডাকল। তারা গুঁড়ি মেরে কাছে এগিয়ে আসে। ইরন চাপা গলায় বলল, প্রাণীটিকে আটকাতে হবে, যেভাবে, যেভাবে সম্ভব।

কীভাবে আটকাবে?

আমাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রকে শক্তিশালী লেজার৩৭ রশ্মি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

হ্যাঁ, ত্রালুস মাথা নাড়ল, মেগাওয়াট শক্তি বের হয়।

মনে হয় কাজ চালানোর জন্য যথেষ্ট। আমরা প্রাণীটার তিন দিকে দাঁড়াব, আমি সামনে, ত্রালুস বামে এবং মান্তি নিচে। আমি সামনে থেকে লেজার রশ্মি দিয়ে প্রাণীটাকে গেঁথে ফেলব। খুব সূক্ষ্ম রশ্মি, সম্ভবত প্রাণীটার বড় কোনো ক্ষতি হবে না। ঠিক একই সময় ত্রালুস বাম থেকে ডান দিকে লেজার রশ্মি দিয়ে গেঁথে ফেলবে, শুমান্তি নিচে থেকে উপরে। একই সাথে তিনটি ভিন্ন মাত্রা থেকে আটকে ফেললে প্রাণীটা এই ত্রিমাত্রিক জগতে আটকা পড়ে যাবে, এখান থেকে আর বের হতে পারবে না। লেজার রশ্মিটুকু বন্ধ করবে না, এটাকে জ্বালিয়ে রাখবে।

কিন্তু বেশিক্ষণ তো রাখা যাবে না। একটানা খুব বেশি হলে পনের মিনিট।

যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণই রাখ। কিছু করার নেই। দেরি করা যাবে না, তোমরা নিজেদের জায়গায় যাও, এই আমাদের শেষ আশা।

নিশিকে এতক্ষণে চতুর্মাত্রিক জগতে নিয়ে গেছে, আমি নিশ্চিত সে এখানে নেই। যাও–দেরি কোরো না।

ত্রালুস অস্ত্রটি লেজার রশ্মির জন্য প্রস্তুত করতে করতে বাম দিকে সরে গেল। শুমান্তি প্রাণীটির নিচে গিয়ে দাঁড়াল। ইরন অস্ত্রটিকে পূর্ণ শক্তির জন্য প্রোগ্রাম করে ট্রিগারে হাত দেয়। তারপর প্রাণীটির দিকে তাক করে চিৎকার করে বলল, টানো ট্রিগার।

তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে শক্তিশালী লেজার রশ্মির আলো ঝলকে উঠল, প্রাণীটি মুহূর্তের জন্য ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল, হঠাৎ করে মনে হল পায়ের নিচে মাটি বুঝি থরথর করে কেঁপে উঠেছে।

প্রাণীটির শরীর থেকে হঠাৎ সহস্র ওঁড়ের মতো জিনিস বের হয়ে কিলবিল করতে লাগল, দেখে মনে হল তাদেরকে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদেরকে নাগালে না পেয়ে ক্রুদ্ধ আক্রোশে ছটফট করতে থাকে। ইরন, ত্রাস আর শুমান্তি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তীব্র লেজার রশ্মির বেগুনি আলো দিয়ে কদাকার প্রাণীটিকে শূন্যে আটকে রাখল।

ইরন বিস্ফারিত চোখে প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে এই প্রথমবারের মতো প্রাণীটির আকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে না, সত্যি সত্যি এটি এই জগতে আটকা পড়ে গেছে। ইরন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না, ত্রিমাত্রিক জগতের প্রাণী হয়ে সত্যি তারা চতুর্মাত্রিক জগতের একটি প্রাণীকে আটকে ফেলতে পেরেছে। প্রাণীটা নিজের শরীরকে দ্বিখণ্ডিত না করে এখন আর চতুর্মাত্রিক জগতে যেতে পারছে না। যতক্ষণ লেজার রশ্মি প্রাণীটির ভিতর দিয়ে যাবে প্রাণীটি এখান থেকে নড়তে পারবে না। তাদের লেজার রশ্মি। আর মিনিট পনের পর্যন্ত থাকবে তার ভিতরে কিছু একটা করতে থাকবে। শুধু তাই নয় ক্রুদ্ধ প্রাণীটি নিশ্চয়ই নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে। চতুর্মাত্রিক জগৎ থেকে তার অন্য অংশ নিশ্চয়ই তাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করবে। সেই আক্রমণ থেকেও তাদের নিজেদের রক্ষা করতে হবে। এই মুহূর্তে তিন জন তিনটি অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে, নিজের জায়গা থেকে কেউই নড়তে পারছে না। ইরন গলা উঁচিয়ে ত্ৰালুস আর শুমান্তিকে ডেকে বলল, তোমরা কোনো অবস্থাতেই লেজার রশ্মি বন্ধ কোরো না, যতক্ষণ এই রশি বের হতে থাকবে ততক্ষণ প্রাণীটা আটকে থাকবে।

ঠিক আছে।

আমি আমার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা এই পাথরের উপর রাখছি। এখান থেকেই লেজার রশি তাক করে রাখব।

কেন?

প্রাণীটা যদি চতুর্মাত্রিক জগৎ থেকে আক্রমণ করে তা হলে পাল্টা আক্রমণ করা দরকার।

কী দিয়ে আক্রমণ করবে?

দেখি কী আছে।

ইরন লেজার রশ্মিটুকু চালু রেখে খুব সাবধানে অস্ত্রটি একটি পাথরের উপর নামিয়ে রেখে আকাশের দিকে তাকাল। বহুদূরে আলোর বিন্দু ফুটে উঠছে, তা হলে কি চতুর্মাত্রিক প্রাণী তাদের দিকে আসছে? ইরন কাছাকাছি ভেসে থাকা জেট প্যাকটির দিকে ছুটে গেল, উপরে কিছু দ্বিতীয় মাত্রার বিস্ফোরক, মাঝারি পাল্লার অস্ত্র, ব্যবহারী যন্ত্রপাতি এবং একটি চতুষ্কোণ বাক্স। ইরন চতুষ্কোণ বাক্সটির কাছে গিয়ে সেটি চিনতে পারে, এটি এন্টি ম্যাটারের বাক্স। এখানে যে পরিমাণ এন্টি ম্যাটার রয়েছে সেটি দিয়ে এই গ্রহের অর্ধেকটুকু উড়িয়ে দেওয়া যাবে। ইরন একটি নিশ্বাস ফেলে, চতুর্মাত্রিক প্রাণীকে জানাতে হবে তারা প্রয়োজন হলে এই গ্রহটির অর্ধেকটুকু উড়িয়ে দেবে, লেজার রশ্মি দিয়ে বেঁধে রাখা প্রাণীটার অংশটুকুসহ।

ইরন মাঝারি পাল্লার একটি অস্ত্র হাতে তুলে নিল। কিছু বিস্ফোরক তুলে নিতে গিয়ে থেমে গিয়ে সে পুরো জেট প্যাকটি টেনে নিয়ে আসে। ত্ৰালুস তার লেজার রশিটুকু স্থিরভাবে। ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতে চোখের কোনা দিয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, জেট প্যাক দিয়ে কী করবে?

এখানে এন্টি ম্যাটারের বাক্সটা রয়েছে।

কী করবে এন্টি ম্যাটার দিয়ে?

এই গ্রহটার অর্ধেকটুকু উড়িয়ে দেব।

শুমান্তি কঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, উড়িয়ে দেবে?

হ্যাঁ।

উড়িয়ে দেবার ভয় দেখাবে, না সত্যি সত্যি উড়িয়ে দেবে?

সত্যি সত্যি উড়িয়ে দেব। এই চতুর্মাত্রিক প্রাণীটা যদি চায় শুধুমাত্র তা হলেই সে। আমাদের থামাতে পারবে।

অর্থাৎ নিশিকে যদি ফিরিয়ে দেয়?

হ্যাঁ। নিশিকে যদি ফিরিয়ে দেয়।

ইরন জেট প্যাকটি চতুর্মাত্রিক প্রাণীর একেবারে কাছাকাছি নিয়ে যায়। এন্টি ম্যাটারের বাক্সটি জেট প্যাকের মাঝামাঝি রেখে সেটিকে বিস্ফোরক দিয়ে ঢেকে দেয়। বড় একটি টাইমার দেওয়া বিস্ফোরককে আলাদা করে নিয়ে ইরন সেখানে সময় নির্ধারিত করে দেয়। লেজার রশ্মিটুকু সম্ভবত আরো দশ মিনিট পর্যন্ত থাকবে, সেগুলো শেষ হবার আগেই এই বিস্ফোরণটি ঘটতে হবে, কাজেই সাড়ে সাত মিনিট সম্ভবত পর্যাপ্ত সময়। এর মাঝে যদি কিছু না করা হয় তা হলে ঠিক সাড়ে সাত মিনিট পরে বিস্ফোরণ ঘটবে। এই বিস্ফোরণে এন্টি ম্যাটারের নিরাপদ শীল্ডিং চূর্ণ হয়ে যাবার কথা, সেটি তার ভারী ধাতব বাক্স স্পর্শ করামাত্রই পদার্থ–প্রতিপদার্থের সংঘাতে পুরো পদার্থ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে, এ ধরনের বিস্ফোরণ সচরাচর দেখা যায় না, ইরন একটি নিশ্বাস ফেলল, বিস্ফোরণে তারা সাথে সাথে ভস্মীভূত হয়ে যাবে–কিছু বোঝার আগেই। দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, বেদনা, যন্ত্রণা কোনোকিছুর অনুভূতিই তারা পাবে না–যদি দেহটিই না থাকে তা হলে ব্যথা বা দুঃখ–কষ্টটি হবে কোথায়?

এতক্ষণ নিজের ভিতরে যে উত্তেজনা ছিল হঠাৎ করে সেই উত্তেজনাটি কেন জানি কমে গিয়ে ইরন নিজের ভিতরে একটি বিচিত্র ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে, তার পক্ষে যেটুকু করার ছিল সে তার পুরোটুকু করেছে, এখন কিছুতেই আর কিছু আসে–যায় না। চতুর্মাত্রিক প্রাণী যদি নিশিকে ফেরত না দেয় এই গ্রহের অর্ধেকটুকুসহ তারা তিন জন কিছু বোঝার আগেই ভস্মীভূত হয়ে যাবে। মৃত্যুর ব্যাপারটিও এখন আর সেরকম ভয়ানক মনে হচ্ছে না।

ইরন হেঁটে হেঁটে শুমান্তির কাছে গিয়ে তাকে ডাকল, শুমান্তি।

বল।

লেজারটা এভাবে শক্ত করে ধরে রাখতে তোমার নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে।

না সেরকম কষ্ট হচ্ছে না।

আমরা খুব বেশি হলে আর মিনিট সাতেক বেঁচে থাকব। জীবনের এই শেষ সময়টা এ রকম কষ্ট না করলেই হয়। লেজারটা সাবধানে নিচে রেখে চলে এস। দূরে দাঁড়িয়ে দেখি কী হয়।

শুমান্তি কিছু বলার আগেই ত্রানুস বলল, ঠিকই বলেছ। শুমান্তি আগে তুমি রাখ, তারপর আমি রাখব।

শুমান্তি বেগুনি রঙের মেগাওয়াট রশিটুকু, যার ভিতর দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে মেগাজুল শক্তি বের হয়ে যাচ্ছে, অপরিবর্তিত রেখে খুব সাবধানে লেজারটি নিচে নামিয়ে রাখে। অস্ত্রটি থেকে তিনটি ধাতব খণ্ড বের হয়ে আসে, তার উপর ভর করে সেটি স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।

শুমান্তির লেজারটি স্থির করে দুজন লালুসের কাছে এগিয়ে গেল, তাকেও লেজারটি নিচে বসিয়ে রাখতে সাহায্য করে তারপর তিন জন ধীরপায়ে হেঁটে হেঁটে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন লেজার থেকে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী তিনটি লেজার রশ্মি মাটি থেকে কয়েক মিটার উপরে চতুর্মাত্রিক প্রাণীটির একটি অংশকে আটকে রেখেছে, প্রাণীটি এতটুকু নড়তে পারছে না, একটু নড়লেই লেজারের ভয়ঙ্কর রশ্মি সেটিকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে, নিজেকে ধ্বংস না করে এই প্রাণীটির চতুর্মাত্রিক জগতে ফিরে যাবার আর কোনো উপায় নেই।

ইরন একটি নিশ্বাস ফেলে প্রাণীটার নিচে রাখা জেট প্যাকটির দিকে তাকাল। সেখানে টাইমার লাগানো বিস্ফোরকটি অস্পষ্ট এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ করছে। এখান থেকেও টাইমারের সময়টুকু স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে, আর মাত্র ছয় মিনিট বাকি।

ত্রালুস হালকা স্বরে বলল, এটি একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা বলা যায়। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি সবকিছু নিয়ে ধ্বংস হওয়ার জন্য।

শুমান্তি কোনো কথা বলল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ইরন হাসার চেষ্টা করে বলল, এত নৈরাশ্যবাদী হচ্ছ কেন? নিশিকে ফিরিয়ে তো দিতেও পারে।

ত্রালুস, ফিরিয়ে দেওয়ার খুব বেশি সময় নেই। আর মাত্র ছয় মিনিট।

ত্রালুস টাইমারের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাদের জীবন থেকে মূল্যবান সময় নিতে চাই না, কিন্তু একটা জিনিস নিশ্চয়ই জান?

কী?

নিশিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু ছয় মিনিট সময় নেই। যদি সত্যিই তাকে ফিরিয়ে দেয় তা হলে আমাদের এই বিস্ফোরকের সাথে লাগানো টাইমারটি বিকল করতে হবে। সেটা করতে কমপক্ষে দুই মিনিট সময় লাগবে। কাজেই নিশিকে ফিরে পাবার জন্য আমাদের হাতে আসলে চার মিনিট থেকেও কম সময়।

ঠিক বলেছ। ইরন মাথা নাড়ল, আর চার মিনিটের মাঝে যদি চতুর্মাত্রিক প্রাণী নিশিকে ফেরত না দেয় তা হলে ধরে নেওয়া যায় আমাদের বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে।

ত্রালুস অন্যমনস্কর মতো একবার আকাশের দিকে তাকাল, ঘোলা আধো আলোকিত আকাশ, চারদিকে বড় বড় পাথর, সবুজাভ কুণ্ডলী পাকানো মেঘ, চারপাশে এক ধরনের বিষাক্ত ধোঁয়া। সে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, কে জানে কাজটা ঠিক করলাম কি না?

কী কাজ?

এই যে সবাইকে নিয়ে এত বড় একটা জুয়া খেলা।

ইরন হেসে বলল, ছোটখাটো জুয়া খেলার কোনো অর্থই হয় না। সত্যি যদি খেলতেই হয় তা হলে বড় জুয়াই খেলা উচিত।

ঠিকই বলেছ।

তিন জন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। শুমান্তি ত্ৰালুসের পাশে কাছে গিয়ে দাঁড়াল, বায়ু নিরোধক স্পেসস্যুটের মাঝে সবাই আটকা পড়ে আছে, তা না হলে সে নিশ্চয়ই এখন ত্রালুসের হাত ধরে রাখত। ত্ৰালুস শুমান্তিকে নিজের কাছে টেনে নরম গলায় বলল, ভয় করছে শুমান্তি?

শুমান্তি মাথা নাড়ল, বলল, জানি না এটাকে ভয় বলে কি না। কেমন জানি ফাঁকা ফঁকা লাগছে। কোনোকিছু নিয়ে আর চিন্তা করতে পারছি না।

ত্রালুস তরল গলায় বলল, চিন্তা করে কী হবে? এস দেখি কী হয়।

চার মিনিটের ভিতর নিশিকে ফেরত দেওয়া হল না। ইরন বুকের ভিতরে এক বিচিত্র ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ত্রালুস, জুয়ায় আমরা হেরে গেলাম।

ত্রালুস ইরনের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, আমি দুঃখিত ইরন।

শুমান্তি হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাদের কারণে তোমাকে এভাবে মারা যেতে হচ্ছে ইরন, আমরা সত্যিই দুঃখিত

আমি ঠিক জানি না, তোমরা ব্যাপারটিকে নিজেদের দোষ বলে কেন ধরে নিচ্ছ।

ত্ৰালুস মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, এই শেষ মুহূর্তে কার দোষে কী হয়েছে সেটি নিয়ে হিসাব করে কী হবে? তার চাইতে যেটা করে একটু শান্তি পাব সেটাই করি?

কী করে তুমি শান্তি পাবে?

এই চতুর্মাত্রিক প্রাণীকে কষে কিছু গালিগালাজ করলে।

শুমান্তি শব্দ করে হাসল এবং ত্রালুস সত্যি সত্যি তিনটি লেজার দিয়ে আটকে রাখা কুৎসিত মাংসপিণ্ডের মতো চতুর্মাত্রিক প্রাণীটির দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত তুলে চিৎকার করে বলল, এই যে চতুর্মাত্রিক প্রাণী তোমরা নাকি নিনীষ স্কেলে পঞ্চম মাত্রার বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণী? কাজকর্ম দেখে তো মনে হয় না– আহাম্মক কোথাকার! মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিলে বেঁচে যেতে, এখন পুরো গ্রহ নিয়ে তোমরা ধ্বংস হও। ত্রানুস হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ধ্বংস হও– ধ্বংস হও ধ্বংস হয়ে নরকে যাও!

শুমান্তি লালুসের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলল, আহ! কী পাগলামো করছ?

ত্ৰালুস হেসে বলল, সময়টা তো কাটাতে হবে। বিস্ফোরণ ঘটাতে এখনো এক মিনিট সময় বাকি। এক মিনিট সময় দীর্ঘ সময় তুমি জান?

ত্রালুসের কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে একটা আলোর বিচ্ছুরণ দেখা গেল, সাথে সাথে তাদের সামনে কুৎসিত মাংসপিণ্ডের মতো চতুর্মাত্রিক প্রাণীর একটা অংশ এসে হাজির হল। প্রাণীটি একবার দুলে ওঠে এবং হঠাৎ করে তার ভিতরে একটা কালো গহ্বরের মতো অংশ বের হয়ে আসে। সেখান থেকে প্রথমে আঠালো এক ধরনের তরল গড়িয়ে পড়ে এবং কিছু বোঝার আগেই তার ভিতর থেকে নিশি গড়িয়ে বের হয়ে আসে, তার সারা স্পেসস্যুট চটচটে আঠালো এক ধরনের তরলে মাখামাখি হয়ে আছে। যেরকম হঠাৎ করে প্রাণীটি এসেছিল সেরকম হঠাৎ করে সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল। নিশি কোনোমতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। কাছাকাছি একটা পাথর ধরে আবার সে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে মাথা তুলে তাকাল।

শুমান্তি হঠাৎ অপ্রকৃতিম্ভের মতো হেসে বলল, ত্রালুস, তোমার বকুনিতে কাজ হয়েছে!

উত্তরে কেউ কিছু বলল না, কারো কিছু বলার নেই। ইরন মাথা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তা করার চেষ্টা করে, চতুর্মাত্রিক প্রাণী নিশিকে সত্যিই ফিরিয়ে দিয়েছে। বিস্ফোরকের সাথে লাগানো টাইমারটিকে এখন বিকল করা গেলে সবাই বেঁচে যেত। তার আর সময় নেই। পুরো ব্যাপারটি আসলে একটি নিদারুণ রসিকতার মতো হয়ে গেল। অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটি রসিকতা।

ত্রালুস ফ্যাকাসে মুখে বলল, এখন আমরা কী করব ইরন?

ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, করার বিশেষ কিছু নেই। তবু চেষ্টা করে দেখা যাক। আমি আর শুমান্তি লেজারগুলো বন্ধ করে প্রাণীটিকে মুক্ত করে দিই। তুমি চেষ্টা করে দেখ বিস্ফোরকের টাইমারকে বিকল করতে পার কি না।

ঠিক আছে।

ত্ৰালুস ছুটে যেতে যেতে শুনল, ইরন বলছে, আমাদের হাতে সময় মাত্র আটচল্লিশ সেকেন্ড।

লেজার তিনটি বন্ধ করামাত্রই প্রাণীটি তার আকৃতি পরিবর্তন করে প্রথমে ছোট হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল। এই পুরো গ্রহটিতে এখন শুধুমাত্র চার জন মানুষ–চারজন অসহায় ত্রিমাত্রিক মানুষ।

ইরন জেট প্যাকের কাছে ছুটে গেল, সেখানে ত্রালুস খুব সাবধানে বিস্ফোরকটি আলাদা করে টাইমারের দিকে একটি বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইরনকে দেখে মাথা নেড়ে বলল, অসম্ভব, দুই থেকে তিন মিনিটের আগে এই টাইমার বন্ধ করার কোনো উপায় নেই।

ইরন হঠাৎ কেমন জানি দুর্বল অনুভব করে, সবকিছু কেমন যেন অর্থহীন মনে হতে থাকে। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার শুমান্তির দিকে আরেকবার ত্ৰালুসের দিকে তাকাল। নিশি টলতে টলতে এগিয়ে আসছে, সে কিছু জানে না, একদিক দিয়ে সেটি চমৎকার একটি ব্যাপার। ইরন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ত্ৰালুস একটি বিচিত্র দৃষ্টিতে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন শুধুমাত্র একটি জিনিসই আমরা করতে পারি।

ইরন চমকে উঠল, বলল, কী জিনিস?

সেটা বলতে গেলে সময় নষ্ট হবে। কাজেই আমি বলছি না, আমি করছি, তোমরা দেখ।

ত্রালুস এগিয়ে গিয়ে টাইমার লাগানো ভারী বিস্ফোরকটি কষ্ট করে হাতে তুলে নেয়, তারপর সে ছুটতে শুরু করে। ইরন অবাক হয়ে চিৎকার করে বলল, কী করছ তুমি? ত্রালুস, তুমি কী করছ?

ত্ৰালুস একমুহূর্তের জন্য থেমে বলল, আমি এই বিস্ফোরকটি সরিয়ে নিচ্ছি, ত্রিশ সেকেন্ড সময়ের ভিতরে ওই বড় পাথরটির আড়ালে যদি বিস্ফোরকটি নিতে পারি বিস্ফোরণের পুরো ধাক্কাটি পাথরটা নিয়ে নেবে। তোমরা বেঁচে যাবে।

আর তুমি?

ত্ৰালুস ইরনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিস্ফোরকটি নিয়ে আবার ছুটতে শুরু করে। ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে বলে, বিদায়। শুমান্তি হতচকিতের মতো একবার ত্ৰালুসের দিকে তাকাল, আরেকবার ইরনের দিকে তাকাল, তারপর দ্রুত গলায় বলল,  ত্ৰালুস ঠিকই বলেছে, এটিই একমাত্র সমাধান। বিদায়।

ইরন কিছু বোঝার আগেই অবাক হয়ে দেখল শুমান্তিও ত্রাসের দিকে ছুটে যাচ্ছে, ছুটে যেতে যেতে বলল,  ত্রালুস একা এত বড় বিস্ফোরক এত দূরে নিতে পারবে না। আমিও সাহায্য করি।

ইরন চিৎকার করে বলল, কী করছ তোমরা? কী করছ?

শুমান্তি ছুটে গিয়ে ত্রালুসকে জড়িয়ে ধরে। তারপর দুজন জড়াজড়ি করে বিস্ফোরকটি টেনে নিতে থাকে। এত দূর থেকেও টাইমারের প্যানেলটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটি বিস্ফোরিত হতে আর মাত্র পনের সেকেন্ড বাকি।

ইরন চিন্তা করতে পারছিল না, কী করবে বুঝতে পারছিল না, ঠিক তখন নিশি এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে ধর, দোহাই তোমার আমাকে একটু ধর।

কেন নিশি? কী হয়েছে তোমার?

আমার ভয় করছে। খুব ভয় করছে। আমাকে শক্ত করে ধরে রেখো–আমাকে ছেড়ে দিও না। দোহাই তোমার। আমাকে ছেড়ে দিও না।

ইরন নিশিকে শক্ত করে ধরে রেখে দূরে তাকাল। এই অপরিচিত গ্রহের একটি বিশাল পাহাড়ের আড়ালে ত্রালুস আর শুমান্তি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, দুজনে মিলে একটি বিস্ফোরককে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তার থেকেও শক্ত করে ওরা একজন আরেকজনকে ধরে রেখেছে। আর কয়েক সেকেন্ড পর যে বিস্ফোরণটি ঘটবে সেই বিস্ফোরণ কি তাদের ছিন্নভিন্ন করে আলাদা করে দেবে না?

ইরন নিশির অচেতন দেহকে ধরে রেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিচিত্র এই গ্রহটিতে একটি ঝড়ো বাতাস শুরু হয়েছে। বাতাসের ঝাঁপটায় বেগুনি রঙের ধুলো উড়ছে, মানুষের কান্নার মতো করুণ এক ধরনের শব্দ শোনা যাচ্ছে, বাতাসের প্রবাহে পাথরের গা থেকে এই শব্দ আসছে। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে কেউ যেন ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদছে।

ইরন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পায়। আর কয়টি হৃৎকম্পন শেষ হবার পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে এই গ্রহটি কেঁপে উঠবে? ইরন নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে।