বুলবুলকে পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে। শুধু হাত বেঁধেই কেউ নিশ্চিত হতে পারেনি, তাই পা দুটিকেও শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। লঞ্চের ছাদে রেলিংয়ের সাথে তার শরীরটা বেঁধে রাখা হয়েছে। তার সারা দেহ রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত। সে জানত তাকে যদি ধরে ফেলতে পারে সেটাই হবে তার শেষ, তাই সে প্রাণপণে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছিল, এতগুলো মানুষের সাথে সে একা কিছুতেই পেরে ওঠেনি। শেষ মুহূর্তে একজন লোহার বউ দিয়ে মাথায় মেরে বসেছে, তখন সে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তা না হলে সে হয়তো কোনোভাবে নিজেকে মুক্ত করে উড়ে যেতে পারত। খুব ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে, মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। তার চারপাশে কী ঘটছে সে ভালো করে বুঝতে পারছে না। তার সামনে অনেক মানুষ, তাকে অবাক হয়ে দেখছে, এটুকুই সে বুঝতে পারে। শুনতে পেল কেউ একজন বলল, জ্ঞান ফিরেছে! স্যারকে ডাকো। স্যারকে ডাকো।
কিছুক্ষণের মাঝেই ডক্টর আশরাফ লঞ্চের ছাদে চলে এল। বুলবুলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে সে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। তাকে ডাকল, এই।
বুলবুল চোখ খুলে তাকাল, কোনো কথা বলল না। ডক্টর আশরাফ জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথা থেকে এসেছ?
বুলবুল কোনো কথা বলল না। তার কথা বলার ইচ্ছে নেই, তা ছাড়া সে কোথা থেকে এসেছে সেটা সে কাউকে কেমন করে বোঝাবে? ডক্টর আশরাফ আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথা থেকে এসেছ?
বুলবুল কোনো উত্তর দিল না। ডক্টর আশরাফ আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কী?
বুলবুল কষ্ট করে চোখ তুলে ডক্টর আশরাফের দিকে তাকালো, তারপর ফিসফিস করে বলল, আমি জানি না। আপনি বলবেন আমি কী?
ডক্টর আশরাফ কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর উঠে দাঁড়ায়। যারা তার আশপাশে ছিল তাদের লক্ষ করে বলল, এই ক্রিয়েচারটাকে একটু পরীক্ষা করা দরকার। মেডিকেল পরীক্ষা।
একজন একটু এগিয়ে এসে বলল, করেছি স্যার।
কী দেখেছ?
অনেক ব্লাড লস হয়েছে। মানুষ হলে বলতাম রক্ত দিতে হবে। কিন্তু এটা তো মানুষ না, কী বলব বুঝতে পারছি না। কী ট্রিটমেন্ট করব বুঝতে পারছি না।
বেঁচে থাকবে?
জানি না স্যার। মাথার পেছনে রড দিয়ে মারা হয়েছে, ব্রেন ইনজুরি হয়েছে কি না বুঝতে পারছি না। মানুষ হলে এতক্ষণে মরে যেত।
ডক্টর আশরাফ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই প্রাণীটা মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রাণী। চেষ্টা করো এটাকে বাঁচিয়ে রাখতে।
চেষ্টা করব স্যার।
তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য বেঁচে না থাকলে ভালো।
কেন স্যার?
প্রাণীটার মানুষ অংশটা খুব প্রবল। আমার মেয়েকে মুগ্ধ করে ফেলেছে, বুঝতে পারছ না? যদি তার কথাবার্তা চিন্তাভাবনা মিডিয়াতে চলে আসে সায়েন্টিফিক কমিউনিটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সবাই তখন এটার ইমোশনাল অংশটা নিয়ে কথা বলবে। সায়েন্টিফিক অংশটা চাপা পড়ে যাবে।
তাহলে কি স্যার এটাকে মেরে ফেলব?
এই মুহূর্তে না। আমাদের ঢাকা ফিরতে ফিরতে এখনো তিন দিন। এর আগে আমরা কাউকে কিছু জানতে দিচ্ছি না। এই তিন দিন নিজেরা এটাকে স্টাডি করি। ঢাকায় ফেরার পর দেখা যাক। কাজেই তোমরা কেউ বিশ্রাম নেবে না, সবাই কাজ কর।
উৎসাহী বিজ্ঞানীরা মাথা নাড়ল, বলল, জি স্যার। আমরা বিশ্রাম। নিচ্ছি না।
ছবি ভিডিও তোলার আগে রক্ত মুছে নিও। ইনজুরিগুলো যেন দেখা যায়-প্রাণীটার মাঝে মানুষ মানুষ ভাব থাকায় মুশকিল। কেউ দেখলে অন্য রকম ভাবতে পারে!
জি স্যার। এখন মানুষের সমস্যা নিয়ে মানুষেরা যত ভাবে পশুপাখির সমস্যা নিয়ে তার থেকে বেশি ভাবে।
ঠিকই বলেছ।
ঠিক এ রকম সময় মিথিলাকে তার কেবিনে আটকে রাখা হয়েছিল। যে মানুষটি তার জন্যে খাবার এনেছে সে খানিকটা নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে আছে, কারণ মিথিলা পুরো ভাত তরকারি তার মুখের ওপর ছুড়ে মেরেছে। খবর পেয়ে ডক্টর আশরাফ এসেছে। তাকে দেখে মিথিলা অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বলল, আব্বু।
বলো মিথিলা।
এটা কি সত্যি তুমি ওদের বলেছ আমাকে কেবিনের মাঝে তালা মেরে রাখতে?
ডক্টর আশরাফ বলল, এটাকে অন্যভাবে নিও না। তোমার ভালোর জন্য আমরা তোমাকে এখানে আটকে রাখছি।
আমার ভালোর জন্যে? মিথিলা চিৎকার করে বলল, আমার ভালোর জন্যে?
হ্যাঁ। তুমি অত্যন্ত নির্বোধের মতো কিছু কাজ করেছ।
কী কাজ করেছি?
পাখাওয়ালা ঐ প্রাণীটার সাথে ওড়ার চেষ্টা করেছ। তুমি কি জান তুমি কত বড় ঝুঁকি নিয়েছিলে?
কীসের ঝুঁকি?
প্রাণীটা যদি তোমাকে ওপর থেকে ফেলে দিত?
ফেলে দিত? আমাকে? কেন আমাকে ফেলে দিবে?
ডক্টর আশরাফ বলল, এ রকম ভয়ঙ্কর একটা বন্য প্রাণী যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। তুমি কেমন করে তার পিঠে উঠে আকাশে উড়তে গেলে? তোমার কি বিন্দুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান নাই?
আব্বু! ও মোটেও বন্য প্রাণী না—
আমার সাথে তর্ক করবে না। আমি এই বিষয়গুলো তোমার থেকে অনেক বেশি জানি। তুমি কি জানো সে কত হিংস্রভাবে আমার স্টুডেন্টদের আক্রমণ করেছে? আরেকটু হলে এটা তাদের মেরেই ফেলত।
আব্বু! তোমরা ওকে ধরার চেষ্টা করেছ আর সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে না?
ডক্টর আশরাফ মাথা নেড়ে বলল, খুব একটা লাভ হয় নাই। তাকে আমরা ঠিকই ধরেছি।
শুধু ধরো নাই তাকে তোমরা মেরেছ। হঠাৎ করে মিথিলার গলা ভেঙে গেল, বলল, কেমন আছে এখন?
আছে একরকম।
বেঁচে আছে, নাকি তোমরা মেরে ফেলেছ?
মেরে ফেলব কেন?
লোহার রড দিয়ে তোমরা তার মাথায় মেরেছ—
আমাদের সেফটির জন্যে। একটা বন্য প্রাণী আমাদের আক্রমণ করবে আর আমরা চুপচাপ বসে থাকব?
মিথিলা একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ঠিক আছে। এখন আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আমাকে কেবিন থেকে বের হতে দিবে?
না।
ওকে একবার দেখতে দিবে?
কোনো প্রশ্নই আসে না।
আমাকে বাথরুমেও যেতে দিবে না?
সেটা দেব, তবে খুব সাবধানে। দেখতে হবে তুই যেন কোনো পাগলামি না করিস। একটু থেমে যোগ করল, আমরা ঢাকা রওনা দিয়ে দিয়েছি, দুই দিনে ঢাকা পৌঁছে যাব, তখন তোর যা ইচ্ছে হয় করিস।
ডক্টর আশরাফ চলে যাওয়ার পর মিথিলা কেবিনটা খুব ভালো করে পরীক্ষা করল। লোহার দেয়াল, লোহার দরজা ভেঙে বের হওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। দরজার মাঝে কাচ লাগানো আছে, সেই কাচ ভেঙে ফেলা যাবে কিন্তু বড় জোর সে তার হাতটা বের করতে পারবে। যদি কোনোভাবে তালার চাবিটা পেতে পারত তাহলে হাত বের করে তালাটা খুলতে পারত। কিন্তু চাবি পাবে কোথায়?
ঠিক তখন তার একটা জিনিস মনে পড়ল, বাথরুমেও তালা দেয়া আছে। ভাড়া করা লঞ্চ, কেবিনের প্যাসেঞ্জারের জন্যে আলাদা বাথরুমে রয়েছে। সাধারণ মানুষেরা যেন যেতে না পারে সে জন্যে তালা মারা থাকে, কেবিনের মানুষেরা যাওয়ার সময় চাবি নিয়ে স্কুলে বাথরুমে যায়। বাথরুমের চাবিটা প্রথমে নিজের কাছে রাখতে হবে, তারপর খুব সাবধানে তার কেবিনের তালাটাকে বাথরুমের তালা দিয়ে পাল্টে দিতে হবে। তারপর যখন কেউ লক্ষ করবে না তখন দরজার কাচ ভেঙে হাত বের করে চাবি দিয়ে তালাটা খুলে ফেলতে হবে, কাজটা সহজ নয় কিন্তু চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
কাজেই মিথিলা খুব ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করল। সে এর আগে কখনোই এ রকম কিছু করেনি, আজকে করবে। খুব ঠান্ডা মাথায় সে পুরোটা করবে, একটা শেষ চেষ্টা করবে।
রাতের খাবারটা সে আগের বারের মতো মানুষটার মুখে ছুড়ে দিল না। সে খানিকটা খেলো এবং খানিকটা লুকিয়ে রাখল। গভীর রাতে সবাই যখন মোটামুটি ঘুমিয়ে গেছে, তখন সে ঘরের ভেতর লুকিয়ে রাখা ভাততরকারি পানির সাথে মিশিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে বমি করার মতো শব্দ করতে থাকে। সাথে সাথে দরজায় ধাক্কা দিয়ে শব্দ করতে থাকে।
কিছুক্ষণের মাঝেই খবর চলে গেল এবং ডক্টর আশরাফ উদ্বিগ্ন মুখে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল, জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মিথিলা?
শরীর খারাপ লাগছে আব্বু। বমি হচ্ছে।
বমি হচ্ছে? কেন?
জানি না। বলে আবার সে বমি করার ভঙ্গি করল, মনে হলো আবার বমি করে দেবে। ডক্টর আশরাফ তাকে ধরল, মিথিলা দরজার কপাট ধরে বমি করার ভঙ্গি করে দরজায় লাগানো তালাটা সাবধানে খুলে নেয়।
মিথিলা টলতে টলতে হেঁটে বাইরে ঝোলানো বাথরুমের চাবিটা নিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায়। ডক্টর আশরাফ বলল, আমি খুলে দিই।
মিথিলা বিড়বিড় করে বলল, আমি পারব।
সে বাথরুমের তালাটা খুলে হাতে নিয়ে সেখানে তার ঘরের তালাটা ঝুলিয়ে দেয়। বাথরুমের ভেতর ঢুকে সে দরজা বন্ধ করে একটা বড় নিঃশ্বাস নেয়। এখন পর্যন্ত সবকিছু পরিকল্পনামতো হয়েছে। মিথিলার ইচ্ছে করল সে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দেয়। বাথরুমের ভেতর সে কয়েকবার বমি করার শব্দ করল, তারপর পানি ছিটিয়ে হাত-মুখ ধুতে শুরু করল। সে তার সুটকেসের চাবিটা নিয়ে এসেছে, সুতলি দিয়ে বাঁধা বাথরুমের চাবিটার জায়গায় স্যুটকেসের চাবিটা লাগিয়ে নেয়। বাথরুমের চাবিটা কোমরে খুঁজে নিয়ে সে বাথরুম থেকে বের হলো, বাইরে ডক্টর আসরাফ ঘুমঘুম চোখে দাঁড়িয়ে ছিল, মিথিলাকে জিজ্ঞেস করল, ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
তাহলে ঘুমিয়ে যা।
ঘুম আসছে না। তোমার কাছে ঘুমের ট্যাবলেট আছে?
হ্যাঁ, আছে।
বেশি করে কয়েকটা দেবে? খেয়ে ঘুমাব।
বেশি করে নয়। একটা দিচ্ছি, খেয়ে ঘুমিয়ে যা।
মিথিলা তখন সুতলিতে বাঁধা স্যুটকেসের চাবিটা বাথরুমের চাবি হিসেবে আগের জায়গায় ঝুলিয়ে দেয়, তারপর নিজের ঘরে ঢোকে, ঢোকার সময় দরজার কড়ায় সে বাথরুমের তালাটা ঝুলিয়ে দিল। তারপর ঘরে ঢুকে নিজের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
ডক্টর আশরাফ একজন লোককে ডাকিয়ে মিথিলার ঘরটা একটু পরিষ্কার করিয়ে দেয়। তারপর মিথিলার হাতে একটা ট্যাবলেট দিয়ে বলল, এটা খেয়ে ঘুমিয়ে যা।
দুইটা দাও।
দুইটা লাগবে না। একটাই যথেষ্ট।
না আব্বু। আমাকে দুইটা দাও। আমি মড়ার মতো ঘুমাতে চাই।
একটু ইতস্তত করে ডক্টর আশরাফ তাকে দুইটা ট্যাবলেট দিল। মিথিলা দুইটা ট্যাবলেট নিয়ে মুখে দিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেয়ে বলল, এখন আমি ঘুমাব।
ডক্টর আশরাফ বলল, হ্যাঁ, এখন ঘুমিয়ে যা।
গুড নাইট আব্বু। বলে সে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে জিভের নিচে লুকিয়ে রাখা ট্যাবলেট দুটো বের করে ফেলল, কী কুৎসিত গন্ধ, মনে হলো এবারে বুঝি সে সত্যি সত্যি বমি করে দেবে।
মিথিলা আরো ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করল তারপর সে উঠে বসল। কেউ এখন তাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না, সবাই জানে সে দুইটা ঘুমের ট্যাবলেই খেয়ে মরার মতো ঘুমাচ্ছে। মিথিলা সুটকেস থেকে তার একটা টি-শার্ট বের করে হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে সাবধানে দরজার কাচে আঘাত করে। দরজার কাচকে সে যতটুকু শক্ত ভেবেছিল সেটা তার থেকে অনেক বেশি শক্ত। কোনো কিছু দিয়ে জোরে আঘাত করে ইচ্ছে করলেই সে কাচটা ভেঙে ফেলতে পারে কিন্তু সে কোনো শব্দ করতে চাচ্ছিল না।
শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টার পর কাচে একটা ফাটল তৈরি হলো, তখন সে সাবধানে চাপ দিয়ে একটা বড় টুকরো আলাদা করে নেয়। চাপ দিয়ে সাবধানে আরো একটু ভেঙে সে আরো কয়েক টুকরো কাচ সরিয়ে নেয়। এখন মোটামুটিভাবে হাত বের করার মতো জায়গা হয়েছে। চাবিটা নিয়ে সে হাতটা বাইরে বের করে দরজার কড়াতে লাগানো তালাটা খোলার চেষ্টা করে। দুই হাতে যে কাজটি পানির মতো সহজ, এক হাতে সেই কাজটিই প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। তার ভয় করছিল হঠাৎ করে তার হাত থেকে চাবিটা না নিচে পড়ে যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
শেষ পর্যন্ত মিথিলা তালার ভেতর চাবি ঢোকাতে পারল এবং একটু চাপ দিতেই তালাটা খুট করে খুলে যায়। মিথিলা দরজার কড়া থেকে তালাটা খুলে নিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি সে শেষ পর্যন্ত মুক্ত হতে যাচ্ছে।
মিথিলা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর খুব সাবধানে দরজা খুলে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। বাইরে আবছা অন্ধকার, কেউ কোথাও নেই। লঞ্চের ইঞ্জিনের ধ্বক ধ্বক শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। মিথিলা রেলিংয়ের পাশে এসে দাঁড়ায়, পানি কেটে লঞ্চটা এগিয়ে যাচ্ছে। বাইরে আবছা অন্ধকার। মিথিলা আবার নিজের কেবিনে ঢুকে একটা পার্টির বোতল আর তার নিজের একটা তোয়ালে নিয়ে খুব সাবধানে বের হয়ে এল। এদিক সেদিক তাকিয়ে সে এবারে সাবধানে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। তার ভয় হচ্ছিল ছাদে ওঠার দরজায় কেউ থাকবে, কিন্তু সেখানে কেউ নেই। তার আরো বেশি ভয় হচ্ছিল উপরে কেউ পাহারায় থাকবে কিন্তু ভাগ্য ভালো সেখানেও কেউ নেই।
ছাদের রেলিংয়ে বুলবুলকে বেঁধে রেখেছে। সে মাথা নিচু করে অবসন্নের মতো বসে ছিল, মিথিলা ছুটে গিয়ে তাকে স্পর্শ করতেই সে চোখ খুলে তাকালো, মিথিলাকে দেখে মুহূর্তের মাঝে তার মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে। সে নরম গলায় বলল, তুমি?
হ্যাঁ। আমি। আমাকে আটকে রেখেছিল, কোনোমতে পালিয়ে এসেছি।
আমি ভাবি নাই তোমার সাথে আর দেখা হবে।
আমিও ভাবি নাই। মিথিলা তার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে বলল, কেমন আছ তুমি?
ভালো ছিলাম না। তুমি এসেছ এখন আমি খুব ভালো আছি।
মিথিলা বলল, কেউ এসে পড়বে। আগে তোমাকে খুলে দিই।
বুলবুল কোনো কথা বলল না। মিথিলা তার বাঁধন খুলে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। খুব শক্ত করে বেঁধেছিল, মিথিলার খুব কষ্ট হলো বাঁধন খুলতে। শেষ পর্যন্ত যখন খুলতে পারল তখন বুলবুল তার দুই হাত আর পায়ে হাত বুলিয়ে হাসার চেষ্টা করল।
মিথিলা টাওয়েলটা ভিজিয়ে তার মুখ থেকে শুকনো রক্ত মুছিয়ে দিয়ে বলল, তুমি এখন যাও। কেউ এসে পড়ার আগে তুমি যাও। এক্ষুণি যাও।
বুলবুল অনেক কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করল, বলল, আমার যাওয়ার ইচ্ছে করছে না।
মিথিলা তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, লক্ষ্মী ছেলে আমার! ইচ্ছা না করলেও তোমাকে যেতে হবে।
বুলবুল নিজের পায়ের ওপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল কোনোমতে মিথিলাকে ধরে সামলে নেয়। নিজের পাখা দুটো এবার বিস্তৃত করে দেখে নেয় তারপর সে মিথিলার দিকে তাকালো, বলল, ঠিক আছে মিথিলা।।
মিথিলা তার দুই হাত এগিয়ে দিয়ে বুলবুলকে গভীর মমতায় আলিঙ্গন করে ছেড়ে দিয়ে বলল, যাও! তুমি উড়ে যাও।
বুলবুল কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে মিথিলার দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব ধীরে ধীরে তার দুই চোখ পানিতে ভরে ওঠে। সে ফিসফিস করে বলল, মিথিলা।
বল।
তুমি আমাকে মনে রেখো।
মনে রাখব। আমি তোমাকে মনে রখব।
আমি তাহলে যাই?
যাই বলতে হয় না। বলতে হয় আসি।
আমি তাহলে আসি?
আস বুলবুল।
বুলবুল তখন এগিয়ে যেতে থাকে। খুব ধীরে ধীরে তার দুই পাখা বিস্তৃত করে ডানা ঝাঁপটিয়ে সে উপরে উঠে যায়। মিথিলা দেখতে পায় বিশাল শক্তিশালী দুটি পাখা দুর্বল ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে উপরে তুলে নেয়ার চেষ্টা করছে, অনেক কষ্টে সে উড়ে যাচ্ছে, উড়ে যেতে যেতে সে একবার পেছনে ফিরে তাকালো।
মিথিলা তার মুখে অনেক কষ্টে একটা হাসি ধরে রাখে। হাসি হাসি মুখে সে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে তার হাত নাড়ে। বুলবুল আবার মাথা ঘুরিয়ে নিল, তারপর ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে যেতে লাগল। খুব ধীরে ধীরে সে দূরে সরে যেতে থাকে, মিলিয়ে যেতে থাকে।
পুবের আকাশে তখন সূর্য উঠছে, দেখে মনে হয় বুলবুল বুঝি ডানা। ঝাঁপটিয়ে ঠিক সূর্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইকারাসের মতো।
মিথিলা তখন তার দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে আকুল হয়ে কাঁদল।
শেষ কথা
মিথিলা তার শিশু সন্তানটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ঘুমাও বাবা আর কত দুষ্টুমি করবে?
আগে তুমি গল্প বল, তাহলে ঘুমাব।
মিথিলা তখন তাকে ডেডিলাসের পুত্র ইকারাসের গল্প বলল। ইকারাস তার ডানা ঝাঁপটিয়ে কীভাবে সূর্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সেই গল্পটুকু বলার সময় মিথিলা কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। তার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছে।
আম্মু কেন এটা করে মিথিলার শিশুপুত্র বুলবুল সেটা কখনো বুঝতে পারে না। বুলবুল শুধু একটা জিনিস জানে–তার আম্মু তাকে খুব ভালোবাসে, কারণে-অকারণে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, বুলবুল। আমার সোনা বুলবুল!
———-