৩-৪. জ্ঞান ফিরলো বনি আর বিনির

অনেক রাতে জ্ঞান ফিরলো বনি আর বিনির। ওরা তখন একটা চলন্ত মাল টানা রেলগাড়ির কামরায়। মালগাড়ির শক্ত মেঝের ওপর অনেকক্ষণ ধরে পড়ে থেকে আর চলন্ত রেলের ঝাঁকুনিতে ওদের হাত পা ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো। বিনির জ্ঞান ফেরার পর প্রথমে বোঝার চেষ্টা করলো ও কোথায়। বনিকে এক কোণে পড়ে থাকতে দেখে ওর কাছে ছুটে যেতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলো।

গুন্ডা দুটো এক পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভেতর কী যেন বলাবলি করছিলো। একটা টেকো আরেকটা বেদম কালো। বিনিকে পড়ে যেতে দেখে ওরা খ্যাক খ্যাক করে হাসলো। বিনি ভয় পেয়ে বনির কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো।

বনি চোখ মেলে যেই দেখলো অচেনা এক অদ্ভুত জায়গায় ও পড়ে আছে–হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। টেকো গুন্ডাটা বাজখাই গলায় বললো, অই চিল্লাবি না কইলাম।

বিনির ভয় হলো, বনি কান্নাকাটি করলে সত্যি সত্যি হয়তো ওকে মেরে ফেলবে। বনিকে বুকে টেনে আদর করে বললো, কাঁদে না বনি ভাইয়া। চুপ কর।

বনি কান্না জড়ানো গলায় বললো, আমি আম্বু আম্মুর কাছে যাবো।

খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে টেকো গুন্ডা বললো, নিজের বাপ মায়রে ভুইলা যাও। তোমগোরে নতুন বাপ মার কাছে লয়া যাইতাছি।

কালো গুন্ডা ওর সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলো, চাটগাঁ গিয়া মাল ডেলিবারির সময় কুননা ঝামেলা ওইব না তো!

ইস্টিশনে অগো মানুষ থাকবো। কুনো ঝামেলার কারবারে আমি নাই। এই বলে ও বনি বিনির দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। বিনিকে বললো, অই ছেমরি হোন। ইস্টিশনে নাইমা যদি চিল্লাচিল্লি করছস তর ভাইরে কাইট্যা দুই টুকরা কইরা ফালামু।

বিনি এবার কান্না সামলাতে পারলো না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো, আমি কিছু করবো না। আমার ভাইকে তোমরা মেরো না।

রাত বারোটা পর্যন্ত বনি বিনির বাবা মা আর অমল কাকু, রিনা কাকীরা সারা মেলা চষে ফেলেছিলেন। মেলার সব কটা গেট-এ পুলিস মোতায়েন করা হয়েছিলো। ততক্ষণে আবদুল মালেক বনি বিনিদের মেলা থেকে বের করে নিয়ে গেছে অনেক দূর।

রাত দশটার পর থেকেই দোকানগুলো এক এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। এগারোটা নাগাদ সব দোকান বন্ধ হয়ে গেলো। তারপরও বনির মা বাবা বসেছিলেন যাত্রা শেষ হওয়ার জন্য। যদি ওরা যাত্রায় ঢুকে পড়ে কারো সঙ্গে! পুলিশ অবশ্য যাত্রা শুরু হওয়ার পর পরই তাঁবুর ভেতর থেকে ঘুরে এসেছে, তবু মা বাবার মন মানছিলো না। যাত্রা শেষ হওয়ার পর রাত সাড়ে বারোটায় ওঁরা ঘরে ফিরলেন। বাড়িতে ঢোকার পর বুড়ো বাবুর্চি গণি মিয়া আর বুয়া যখন শুনলো বনি বিনি মেলা থেকে হারিয়ে গেছে তখন আরেক দফা কান্নার রোল উঠলো।

পুলিসের এক ডিআইজি ছিলেন বনির বাবার বন্ধু। আনন্দ মেলার পুলিস ক্যাম্প থেকে তাকে ফোন করে পাননি। নাকি শহরের বাইরে আছেন, ফিরতে অনেক রাত হবে। ঘরে ঢুকে মা থমথমে গলায় বললেন, সেলিম ভাইকে একবার ফোন করো।

কোনো কথা না বলে ডিআইজি সেলিম তরফদারকে ফোন করলেন বনির বাবা। ডিআইজিকে বাড়িতেই পেলেন। সম্ভবত কাজের লোক ফোন ধরেছিলো। বড় অফিসারদের বাড়িতে যারা কাজ করে তাদেরও মেজাজ একটু চড়া থাকে। বললো, এত রাতে স্যারকে ফোন দেয়া যাবে না।

বাবা ওকে ধমক দিয়ে বললেন, তোমাকে যা বলছি তাই করো। এক্ষুণি সেলিমকে ফোন দাও। বলল মাহমুদ হোসেন কথা বলবে।

ধমক খেয়ে লোকটা দোতালায় ডিআইজির রুমে কানেকশন লাগিয়ে বললো, স্যার, মাহমুদ হোসেন সাহেব আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।

সেলিম তরফদারও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। স্কুলে বনির বাবার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তেন, সেই থেকে তাদের বন্ধুত্ব। এত রাতে পুরোনো বন্ধুর ফোন পেয়ে তিনি চিন্তিত হলেন। আর্দালিকে বললেন লাইন দেয়ার জন্য।

বনির বাবার কথা শুনে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। বললেন, যা করার আমি করছি। তোরা এভাবে ভেঙে পড়িস না। এখন ঘুমোতে যা, কাল সকালে আমি তোদের। বাসায় আসছি।

ডিআইজি সেলিম তরফদার পুলিসের এসপি আর ডেপুটি কমিশনার–দুজনকে টেলিফোন করে ঘটনাটা জানিয়ে বললেন, তাঁর খুবই আপন জন এরা। যেভাবে হোক বাচ্চা দুটোকে উদ্ধার করতেই হবে। তিনি নিশ্চিত যে এটা অপহরণের ঘটনা এবং দু এক দিনের মধ্যেই মোটা অঙ্কের টাকা চেয়ে পাঠাবে অপহরণকারীরা।

সকাল নটায় তিনি অফিস হয়ে তাঁর বন্ধুর বাসায় গেলেন। বনির বাবা মা দুজনই উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওদের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?

গম্ভীর হয়ে পুলিসের ডিআইজি বললেন, না, এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

হতাশ হয়ে বাবা বললেন, আয়, বোস একটু। তোর কি মনে হয় ওরা কোনো ছেলেধরা গ্যাঙের পাল্লায় পড়েছে?

সন্দেহজনক সব জায়গাইতেই খোঁজা হচ্ছে।

মা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ছেলে ধরাদের হাতে পড়লে কম বয়সী ছেলেমেয়েদের ওরা হাত পা ভেঙে ভিক্ষে করতে বসায়।

সেলিম তরফদার বললেন, বড়লোকের ছেলেমেয়েদের দিয়ে ওরা ভিক্ষে করায় না। মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের জন্য ওরা কিডন্যাপ করে।

বনির বাবা দু হাতে তার বন্ধুর হাত চেপে ধরে বললেন, যত টাকা লাগে আমি দেবো সেলিম, তুই শুধু আমার বিনি বনিকে ফিরিয়ে এনে দে।

আমার ধারণা আজ যে কোনো সময়ে ওরা ফোন করে টাকা চাইতে পারে।

অমল কাকু চুপচাপ বসে বনির বাবার সঙ্গে ডিআইজির কথা শুনছিলেন। বললেন, কিডন্যাপাররা যদি টাকা চায় তো ভালো। এমনও তো হতে পারে ওদের দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছে?

হতে পারে। ডিআইজি বললেন, বর্ডারের সব চেক পোস্টে আর থানায় কাল রাতেই খবর পাঠানো হয়েছে। হাইওয়েতে গাড়ি চেক করা হচ্ছে।

অমল কাকু চিন্তিত গলায় বললেন, এটা তো রুটিন কাজ। কিডন্যাপাররাও জানে পুলিস এরকম স্টেপ নেবে। ওরা স্বাভাবিকভাবেই অন্য কোনও পথ খুঁজতে চাইবে।

ওরা যদি চেক পোস্টের বাইরে দিয়ে বর্ডার পার হতে চায় সেক্ষেত্রে আটকানো কঠিন কাজ হবে।

রিনা কাকী বললেন, আমার মনে হয় অবিলম্বে টেলিভিশন আর সংবাদপত্রে হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দেশের জনসাধারণ এতে সতর্ক হতে পারে। অপহরণকারীদের প্রকাশ্যে চলাফেরা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

বাবা তার ডিআইজি বন্ধুর কাছে জানতে চাইলেন হারানো বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে যদি আমি পুরষ্কার ঘোষণা করি তাহলে কেমন হয়?

মা ব্যগ্র হয়ে বললেন, দশ লাখ টাকা ঘোষণা করে দাও। এতেও যদি আমার চোখের মনিদের ফেরত পাই।

ডিআইজি সেলিম একটু বিব্রত হয়ে বললেন, হারানো বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা যেতে পারে। তবে টাকার অঙ্কটা কম হওয়া উচিৎ।

কেন, কম কেন? তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করলেন মা।

ওরা যদি সত্যি সত্যি কোনও খারাপ দলের হাতে পড়ে, বেশি অঙ্কের টাকা দেখলে ওদের নিজেদের ভেতর ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে মারপিট হতে পারে। কিংবা ওদের শত্রু পক্ষ গুন্ডাদের খপ্পর থেকে কেড়ে নিতে চাইতে পারে। যাই হোক এতে বনি বিনির জীবন বিপন্ন হতে পারে।

তাহলে? ভাঙা গলায় মা জানতে চাইলেন, আপনি কত টাকা ঘোষণা করতে বলেন?

আপাতত পঞ্চাশ হাজারের কথা বলুন। পরে না হয় টাকার অঙ্ক বাড়ানো যাবে। ঠিক আছে তাই করুন। হতাশ হয়ে বললেন মা।

ডিআইজি তার পকেট থেকে টেলিফোন বের করে ডেপুটি কমিশনারকে হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচারের কথা বলে দিলেন।

মিনিট পনেরোর ভেতর ডেপুটি কমিশনারের অফিসের লোক এসে বনি বিনির ছবি নিয়ে গেলো। আধ ঘন্টা পর ডেপুটি কমিশনার জানালেন, রেডিওতে দুপুর থেকে যাবে আর টেলিভিশনে সন্ধ্যা থেকে। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে আটটা দৈনিক পত্রিকায় আগামী কাল ছবি সহ হারানো বিজ্ঞপ্তি যাবে।

ডিআইজি সেলিম বললেন, আমি এখন উঠি। ঠিক তখনই টেলিফোন বাজলো। দুবার রিং হতেই বাবা টেলিফোন ধরে হ্যালো বললেন। একটু পরেই তিনি রিসিভারে

হ্যাঁ, বলে সেলিম তরফদারকে ইশারা করলেন প্যারালাল লাইনে কথা শোনার জন্য।

ওপাশ থেকে একটা ফ্যাশফ্যাশে গলা শুনলেন বাবা কী ওইলো কতা কন না ক্যা? আপনের পোলা মাইয়া হারানি গ্যাছে না?

হ্যাঁ।

হ্যাগো নাম বনি আর বিনি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওরা কোথায়?

আমাগো হেপাজতে আছে, ভালাই আছে। হ্যাঁগরে পাইতে ওইলে কিছু মাল পানি ছাড়ন লাগবো?

কত টাকা চান আপনারা?

বেসি না, দশ লাখ।

আমি দেবো। আমাকে বনি বিনির সঙ্গে কথা বলতে দিন।

এত জলদী কিসের? জলদীর কাম সয়তানে করে। ট্যাকা রেডি রাইখেন। আমি রাইতে কতা কমু। এই বলে ওপাশ থেকে লাইন কেটে দিলো।

ডিআইজি সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে কথা বললেন, কাল রাতেই তিনি বলে রেখেছিলেন মাহমুদ হোসেনের বাড়ির সব টেলিফোন যেন ট্যাপ করা হয়। টেলিফোন অফিস থেকে তাকে একটু পরে জানানো হলো–কলটা এসেছিলো চট্টগ্রাম থেকে। রেল স্টেশনের কার্ড ফোন বুথ থেকে ওটা করা হয়েছে।

বাবা শুনে আঁতকে উঠলেন–তার মানে, বনি বিনিকে চট্টগ্রাম নিয়ে গেছে শয়তানরা?

ডিআইজি সেলিম বললেন, উত্তেজিত হয়ো না। এটা যদি কোন গ্যাঙ হয়, আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য ঢাকা থেকে কল না করে চট্টগ্রাম থেকে করার জন্য ওদের কাউকে বলে দিয়েছে।

মা বিড় বিড় করে বললেন, আল্লাহ, যেন তাই করে। আমার বনি বিনি যেন ঢাকায় থাকে।

ওপাশে টেলিফোন রিসিভার রেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো টেকো গুণ্ডা। কালো গুণ্ডাকে বললো, কেমুন বুদ্দি বাইর করছি ক? হুজুর গো থনে ট্যাকা লয়া অগরে এক দফা বেচছি। অখন বাপের থনে বাইর করুম দস লাখ। আমগোরে আর পায় কে!

কালো গুণ্ডা স্বীকার করলো হ উস্তাদ, তোমার জবর বুদ্দি! এ্যার লাইগা পোলা মাইয়া গো কতা তুমি ক্যাসেটে তুইলা রাখছ!

জলদি যা! ইয়ার কণ্ডিসন কুচে ঢাকার টিকিট কাট। ফাইনাল খেলা খেলুম ঢাকায় গিয়া।

টেকো আর কালো দুজনই ভাড়াটে গুণ্ডা। ওদের তিরিশ হাজারে ভাড়া করেছিলো আবদুল মালেক। কথা ছিলো বনি বিনিকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার। মালেক জানতো মাহমুদ হোসেনের ছেলেমেয়েরা নিখোঁজ হলে সারা শহর তোলপাড় হবে। তাই ঢাকা স্টেশন থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেন না ধরে জয়দেবপুর থেকে মালগাড়ি ধরেছে। জয়দেবপুরের সিগন্যালে বলা ছিলো মালগাড়িটা স্টেশনে ঢোকার আগে দুমিনিটের জন্য যেন থামানো হয়। এর জন্য পাঁচশ টাকা লেগেছে। টেকো কালো বনিদের নিয়ে চট্টগ্রাম গেছে আর মালেক মাইক্রোবাসে ঢাকা ফিরে এসেছে।

চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে বিনির সঙ্গে কথা বলে টেকো যখন বুঝতে পারলো ওরা বড়লোকের ছেলেমেয়ে তখনই ও মতলব এঁটেছে বনি বিনিকে আরেক দফা বেচবে।

রাত আটটার দিকে টেকো আবার ফোন করলো বনিদের বাড়িতে। প্রচণ্ড উদ্বেগ নিয়ে বাবা মা অপেক্ষা করছিলেন ওর টেলিফোনের জন্য। প্যারালাল লাইনে কথা শুনছিলেন ডিআইজি সেলিম তরফদার।

টেকো বললো, ট্যাকা ম্যানেজ করছেন?

করেছি। কোথায় দিতে হবে বলুন।

ট্যাকা লয়া রাইত দসটার সুম বুড়িগঙ্গার বিরিজের উপরে আইবেন। পুলিসরে যদি খবর দেন, আর যদি কুন ফন্দি ফিকির করেন পোলা মাইয়া দোনজনরে কাইটা গাঙ্গে ফালাইয়া দিমু।

না না, পুলিসকে বলবো না। প্লীজ বনি বিনিকে আমার সঙ্গে কথা বলতে দিন।

হোনেন কতা। বলে টেকো ক্যাসেট অন করলো। বাবা বনির কান্নাভেজা গলা শুনলেন–আব্ব আমাদের নিয়ে যাও। বিনিও ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, ওরা টাকা যা চায় দিয়ে দাও! নইলে আমাদের মেরে ফেলবে।

টেকো ক্যাসেট বন্ধ করে বললো, কী মুক্তিযুদ্ধা সাব, বিশ্বাস ওইছে?

হয়েছে। আমি টাকা নিয়ে আসছি।

মনে থাকে যেন। রাইত ঠিক দসটা। কী গাড়ি লয়া আইবেন?

সাদা পাজেরো। আপনার গাড়ি কোনটা?

যখন দেখবেন তখন জানবেন আমার গাড়ি কোনটা। আমারে আপনের চিননের কাম নাই। টেকো রিসিভার নামিয়ে রেখে পাশে দাঁড়ানো কালো গুণ্ডাকে বললো, আবে কাউলা, একখান গাড়ি জোগাড় করন লাগে যে?

ক্যা, গাড়ি দিয়া কী করবা?

বাপে কয় আপনের গাড়ি কোনটা! হ্যায় আইবো সাদা পাজেরো লয়া।

জাগা মত ট্যাকা রাইখ্যা হ্যারা চইলা যাইবো। আমরা গিয়া খাতির জমা ট্যাকা লইয়া ভাম । আমাগো হুণ্ডায় গ্যালেই ত অয়!

আরে ব্যাক্কল! দস লাখ টাকা লয়া তুই হুণ্ডায় যাবি! এর উপরে কেউ বাটপারি করলে?

একটু চিন্তা করে কালো গুণ্ডা বললো, ন্যাটা মজনুর গ্যারেজ থেইকা একটা গাড়ি লইবার পারো! তুমি কইলে দিবো!

চল যাই, গ্যারেজ না আবার বন্ধ কইরা দ্যায়।

ওরা টেলিফোন করেছিলো হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের টেলিফোন বুথ থেকে। হোণ্ডা নিয়ে টেকো আর কালো গুণ্ডা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো পুলিসের জিপ এসে ভেতরে ঢুকলো। একজন অফিসার জিপ থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড়ে গেলেন টেলিফোন বুথের দিকে। বুথের ভেতর তখন এক মোটাসোটা বিহারী মহিলা চেঁচিয়ে কারও সঙ্গে ঝগড়া করছিলেন।

সন্দেহজনক কাউকে না পেয়ে অফিসার তার পকেট থেকে সেলুলার ফোন বের করে ডিআইজি সেলিম তরফদারকে বললেন, স্যার, সাসপিশাস কাউকে বুথের কাছে পেলাম না।

গেটের বাইরে রিকশার আড়াল থেকে টেকো আর কালো গুণ্ডা সব দেখলো। ওদের বুঝতে বাকি রইলো না পুলিস কাকে খুঁজছে। টেকোর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। পিজি হাসপাতালের বুথ থেকে বনির বাবাকে টেলিফোন করে জানালো, পুলিসরে খবর দিয়া আপনে ঠিক কাম করেন নাই। আইজকা আর পোলা মাইয়ার মুখ দ্যাখন আপনের কপালে নাই।

ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় বাবা বললেন, আপনারা বিশ্বাস করুন আমি পুলিসকে কিছুই বলিনি। আপনাদের টাকা রেডি আছে। দয়া করে বলুন, বনি বিনিকে আনার জন্য কোথায় যাবো?

কাইল কমু নে।বলে টেলিফোন রেখে ওরা হোণ্ডা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।

.

০৪.

সকালে পাহাড়তলীর আগে ট্রেন থামিয়ে টেকো আর কালো গুণ্ডা বনি বিনিকে নিয়ে নেমে পড়েছিলো। পাহাড়তলীর এক বাড়িতে বনি বিনিকে পৌঁছে দেয়ার কাজ ঠিক মতো সেরে ওরা ঢাকায় ফোন করেছে।

এক রাতের ধকলে বনি বিনির মুখ শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে। বাড়ির ভেতর খুব কালো আর মোটাসোটা এক মহিলা রান্না করছিলো। বসার ঘরে তিনজন লোক বসে তাস খেলছিলো। বনি বিনি দুজনই লক্ষ্য করেছে সিনেমার ভিলেনদের মতোই নিষ্ঠুর চেহারা লোক তিনটার। দেখেই মনে হয় প্রাণে দয়ামায়ার লেশমাত্র নেই। বনি বিনিকে নিয়ে টেকো যখন ঘরে ঢুকলো, শুকনো বয়স্ক লোকটা চেঁচিয়ে বললো, আঞ্জুমনের মা, কোনআনে গেলা? জলদী আইও, তোমার মেহমান আইসছে।

মহিলা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বসার ঘরে এসে বললো, আইছে ভালা কতা। তোমরা পাহারা দিবা। কিছু ওইলে আমি জানি না।

অল্প দাড়িওয়ালা লোকটা বনি বিনিকে ভেতরের একটা কামরায় ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিলো।

বেলা তখন দশটা বাজে। বনি বিনির খুব খিদে পেয়েছিলো। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে নাশতা খাওয়া হয়ে যেতো! নাশতা খাওয়ার সময় বনির কত বায়না! এই সিরিয়াল খাবে না। পাউরুটিতে মাখন খাবে না, দুধ খাবে না, ডিম খাবে ওষুধের মতো নাক সিঁটকে–এসব দেখে বড় চাচী ওর পছন্দ মতো ব্রেকফাস্ট মেন্যু বানিয়ে দিয়েছেন। বনি ভাবলো বাড়ি ফিরে গেলে আর কোনো দিন সকালের নাশতা নিয়ে খুঁত খুঁত করবে না।

সাড়ে দশটার দিকে একটা থালায় চারটা আটার রুটি আর দু গ্লাস পানি এনে মোটাসোটা আমনের মা জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ওদের খেতে দিলো। বাজখাই গলায় বললো, ভালো চাও তো ঠিক মত খাই লও। আমারে পেরেশানি কইরলে কপালে খারাপি আছে কইলাম।

যে রকম রংচটা ময়লা টিনের থালায় ওদের খেতে দিয়েছে বিনি ভেবেছিলো খাবে । বনি সঙ্গে সঙ্গে শুকনো রুটি মুখে দিয়ে চিবোতে গিয়ে বিষম খেলো। বিনি নিচু গলায় বললো, বনি ভাইয়া, এভাবে না, পানি দিয়ে ভিজিয়ে খা। তাহলে গলায় আটকাবে না।

বনির খাওয়া দেখে বিনিও এক খানা রুটি ছোট ছোট করে ছিঁড়ে মুখে দিলো। যতটা খারাপ লাগবে ভেবেছিলো ও, ততটা খারাপ লাগলো না। রুটি দুটো খেয়ে ওদের খিদের জ্বালা দূর হলো।

বিনি তাকিয়ে দেখলো ঢক ঢক করে পুরো এক গ্লাস পানি খেয়েছে বনি। বাড়িতে এই পানি খাওয়া নিয়েও বনির কত বায়নাক্কা। এমনি পানি খাবে না, সি ভিটা নয় কোক খাবে। পানি খাওয়ার জন্য মা কত বকেন ওকে! আজ ওর পানি খাওয়া দেখে বিনির মায়া লাগলো। আহা বেচারা ছোট ভাইটা! ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি ছেলেধরার পাল্লায় পড়ে ওদের এভাবে কষ্ট পেতে হবে।

বিনির কাছে এসে বনি ফিশফিশ করে বললো, আমরা এদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে পারি না?

কী ভাবে পালাবো?

রাস্তা দিয়ে কোথাও নেয়ার সময় যদি চিৎকার করি–বাঁচাও, আমাদের ছেলেধরা নিয়ে যাচ্ছে, তাহলে নিশ্চয় লোকজন আমাদের বাঁচাতে আসবে?

কাল ওরা কী বললো শুনিস নি? চ্যাঁচামেচি করলে ছুরি দিয়ে কেটে দু টুকরো করে ফেলবে।

আমাদের দু টুকরো করলে ওরা বুঝি বাঁচতে পারবে?

ওরা নিজেদের জানের পরোয়া করে না। তাছাড়া গুণ্ডাদের কাছে সব সময়। রিভলভার, পিস্তল, বন্দুক এসব থাকে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে কী যেন ভাবলো বনি। তারপর আগের মতো নিচু গলায় বললো, ওরা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

রাস্তা দিয়ে আসার সময় দেখেছি এটা চট্টগ্রামের পাহাড়তলী।

আমাদের কতদিন এভাবে আটকে রাখবে?

টেকো গুণ্ডা আমাদের ভয়েস রেকর্ড করেছে। আমার মনে হয় ওরা আমাদের আটকে রেখে বাবার কাছে টাকা চাইবে।

তোর কি মনে হয় বাবা ওদের কথা মতো টাকা দেবে?

কেন দেবেন না? বাবা মা আমাদের কি কম ভালোবাসেন?

টাকা নিয়ে ওরা যদি আমাদের মেরে ফেলে?

আমাদের ফেরত না দিলে বাবা টাকা দেবেন কেন?

বনি বিনিকে ফেরত না দিয়ে কীভাবে বাবার কাছ থেকে টাকা আদায় করা যায় এ নিয়ে টেকো আর কালো গুণ্ডা অনেক ভেবেছে। রাতে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে ফোন করে বেরোবার সময় পুলিস দেখে ওদের মনে হয়েছিলো বনিদের বাবা বুঝি পুলিসকে জানিয়েছে। পরে টেলিফোনে যখন তিনি মানা করলেন, কথাটা টেকো উড়িয়ে দিতে পারলো না। তাঁর মতো বড়লোক দশ লাখ টাকার শোকে নিশ্চয় কাতর হবেন না। ছেলেমেয়ের জানের কথা বিবেচনা করলে দশ লাখ তাঁর কাছে কোনো টাকাই না।

রাতে ওদের কলতা বাজারের ডেরায় বসে দেশী মদ খেতে খেতে টেকো আর কালো এসব কথাই বলাবলি করছিলো। কালো বললো, উস্তাদ, পোলা মাইয়ারে না দেইখা অরা ট্যাকা দিব ক্যান?

না দিলে অগো জানে মাইরা ফালামু।

কেমনে মারবা উস্তাদ? অগোরে তো তুমি হুজুরগো মাইনষের জিম্মায় রাইখা আইছ।

তয় কী? হ্যাঁগোরে কই রাখছি এক জানস তুই আর জানে হুজুররা। হ্যাঁগো বাপে জানবো ক্যামনে? বাপেরে পোলা মাইয়ার কতা হুনায়া দিছি। হ্যারা জানে পোলা মাইয়া আমগো কাছে।

তয় দেরি করতাছ ক্যান উস্তাদ? আইজ রাইতেই তো ট্যাকাটা লইবার পারতা।

চিন্তিত গলায় টেকো বললো, হ, পারতাম! মগর ওই যে ধান্দা লাগলো, বাপে আবার পুলিসরে খবর দিছে কিনা বুইঝা লইলাম।

কাইল লইবা?

কাইল না! আরও একদিন যাউক। বাপের পেরেসানি বাড়ুক। তয় দেখুম।

হুজুর হালারা ট্যার পাইলে ঝামেলা করবার পারে।

এত ডরাস ক্যা তুই!

সারা রাত মদ খেয়ে বেলা বারোটা পর্যন্ত বেহুশের মতো ঘুমিয়েছিলো টেকো আর কালো। ঘুম থেকে উঠে ওসমানিয়া হোটেলে নেহারি আর তন্দুরি খেয়ে ওরা প্রথমে গেলো ন্যাটা মজনুর গ্যারেজে। কাল রাতের জন্য একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করলো পাঁচ হাজার টাকায়। এমনিতে বারো ঘন্টার ভাড়া বারোশ টাকা। ন্যাটা মজনু পরিষ্কার বললো, তোমরা আকাম কুকাম করনের লাইগা গাড়ি নিতাছ। বহুত রিস্কের কারবার। পাঁচ হাজারের কমে ওইবো না।

ন্যাটা মজকে মনে মনে কয়েকটা খারাপ গালি দিয়ে টেকে! বললো, ঠিক আছে, পাঁচ হাজারই দিমু মগর কামের বাদে।

আলপিন দিয়ে দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করতে করতে ন্যাটা বললো, উঁহু! আদ্দেক এ্যাডভান্স দেঅন লাগবো।

ওকে আবার আগের মতো কতগুলো গালি দিয়ে টেকো পকেট থেকে আড়াই হাজার টাকা বের করে দিয়েছে। গত কাল ওরা আবদুল মালেকের কাছ থেকে তিরিশ হাজার পেয়েছে। আগামী কাল রাতে পাবে দশ লাখ। এত হিসেব করলে চলবে কেন! পথে আসতে আসতে এসব কথা কালো গুণ্ডাকে বোঝাতে হয়েছে। কালোর মাথায় আবার বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম। টেকো অবশ্য মনে করে ওর জন্য কম বুদ্ধিওয়ালা চ্যালাই ভালো। বুদ্ধি কম থাকলে বেশি বাধ্য হয়।

পরদিন রাত আটটায় টেকো ফোন করলো বনি বিনির বাবাকে। বললো, রাত ঠিক সাড়ে দশটায় টাকাটা একটা কালো ব্যাগে করে রমনা পার্কের পানির ট্যাঙ্কের তলায় রাখতে। টাকা গুণে দেখার পর সাড়ে এগারোটায় বনি বিনিকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হবে।

বাবা আর্ত গলায় বললেন, টাকা নিয়ে যদি ওদের ফেরত না দাও, তোমার কথায় বিশ্বাস কী?

বিশ্বাস করন ছাড়া আপনের কুন উপায় আছে? আমি যেমুন কমু তেমুনই করন লাগবো।

আমি ওদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

কতা একবার হুনছেন না? আবার কী?

ওদের কথা না শুনলে আমি এক পয়সাও দেবো না।

বাবার গলা শুনে দমে গেলো টেকো। ঠিক আছে, খাড়ান অগো ডাকতাছি। এই বলে কালোকে তাড়াতাড়ি ক্যাসেট রিউইন্ড করতে বললো। ভাগ্যিস গান শোনার জন্য ক্যাসেটটা সঙ্গে রেখেছিলো কালো।

রিউইন্ড করার পর টেকো বললো, চুপচাপ হুনেন অগো কথা। মইদ্যে কুন কতা কইবার পারবেন না।

বাবা আগের মতো বনির কান্নাভেজা কথা শুনলেন–আব্বু আমাদের নিয়ে যাও। তারপর বিনির ঠিক আগের মতো ফোঁপানো গলা। বাবা চিৎকার করে বললেন, বিনি, একবার আব্বু বলো! মা, একবার আব্বু বলো! কোনো উত্তর পেলেন না।

টেকো বললো, কতা হুনছেন, ট্যাকা লয়া ঠিক সময় ঠিক জাগায় রাইখ্যা আইসেন। নাইলে এ জনমে আর পোলা মাইয়াগো চোখে দেখবেন না।

টেকো টেলিফোন রাখতেই বাবা তাঁর বন্ধু ডিআইজি সেলিমকে বললেন, সেলিম, আমি হলপ করে বলতে পারি এটা বনি বিনির রেকর্ড করা গলা। ওদের আগের কথা আমার মনের ভেতর গেঁথে আছে। প্রত্যেকটা শব্দ, প্রত্যেকটা উচ্চারণ, কান্না সব আমার মেমরিতে রয়েছে।

ডিআইজি সেলিম গম্ভীর হয়ে বললেন, আগের বারও ওদের ক্যাসেটে রেকর্ড করা গলা শুনেছি।

তাহলে কি বনি বিনি এদের হাতে নেই?

হাতে না থাকলে গলা রেকর্ড করবে কী ভাবে? আমার মনে হয় ওদের কোনো ঘাঁটিতে বনি বিনিকে আটকে রেখেছে।

টাকা দিলেও যদি ফেরত না দেয়।

যদি বলছিস কেন? আমি নিশ্চিত যে দেবে না।

তাহলে?

টাকা নিতে যখন আসবে তখনই ধরে ফেলবো।

কিন্তু আমার বনি বিনি?

ধরে একটা রাম ধোলাই দিলে সুড় সুড় করে বলে দেবে বনি বিনি কোথায়।

ডিআইজি সেলিম হিসেবে একটু ভুল করেছিলেন এখানে। টেকো কালোর তখন জানার কথা নয় বনি বিনি কোথায়। সেদিন সকালেই ওদের পাহাড়তলীর বাড়ি থেকে অজ্ঞান করে নিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পোর্ট কলোনির এক বাংলোয়। মালেকদের দলের এক নেতার বিরাট ওষুধ কোম্পানি আছে । প্রতি মাসে বড় চালানের ওষুধ রফতানি হয় আরব দেশগুলোতে। ওখান থেকে আসে ওষুধের কাঁচা মাল। অন্তত বন্দরের সাধারণ লোকজন তাই জানে।

মাত্র অল্প কয়েকজন বন্দর কর্মী জানে ইবনে আবু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির বড় বড় ওষুধের বাক্স যেগুলোর গায়ে ইংরেজি আর আরবিতে লেখা থাকে সাবধান, ভঙ্গুর জিনিস, সেগুলোর ভেতরে থাকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। ক্রেনে খুব সাবধানে ওসব বাক্স জাহাজে তুলতে হয়। আল জেদ্দাহ শিপিং লাইন্স-এর মালিক আবদুল মালেকদের দলের শুভাকাঙ্খী। জাহাজের ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে ক্রুরাও তাই। ইবনে আবু ফার্মাসিউটিক্যালস-এর এসব ভঙ্গুর মাল খুব সাবধানে পৌঁছে যায় বিভিন্ন আরব বন্দরে।

আল জেদ্দাহ শিপিং লাইন্সের যে জাহাজটা সেদিন চট্টগ্রাম থেকে বোম্বে, করাচি হয়ে মাশকাত যাওয়ার কথা সেটার সামনে দুপুরে জনা পাঁচেক লোক কথা বলছিলো। এরা সবাই আবদুল মালেকদের দলের লোক। একজন ছিলো আরব, বাকিরা এ দেশী।

এদের চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই এরা যে আবদুল মালেকদের পার্টির লোক। খুবই স্মার্ট চেহারা, প্যান্ট শার্ট পরা, মুখে দাড়ির চিহ্নমাত্র নেই, দুজনের আবার ঝোলা গোঁফ, দেখে মনে হয় সরকারী দলের মাস্তান। এরা সবাই গড় গড় করে আরবি বলতে পারে।

আরবটা বললো, গতবার তোমরা ভালো মাল দাওনি। তোমাদের বার বার বলেছি ফকির মিসকিনদের বাচ্চা দিও না। ওরা না খেয়ে অপুষ্টিতে ভোগে। উটের দৌড় শুরু হওয়ার একটু পরেই মরে যায়। আমাদের দরকার শক্ত, স্বাস্থ্যবান বাচ্চা। বড়লোকদের বাচ্চা।

ঝোলা গোঁফ বললো, আপনাদের জানা উচিৎ বড় লোকদের বাচ্চা চুরি করা কী কঠিন কাজ। ওদের চাকর, দারোয়ান, ড্রাইভার, আর্দালিরা সারাক্ষণ ওদের ঘিরে রাখে। তবু এবার দুটো বড়লোকের বাচ্চা আপনাদের দিতে পারবো। চেহারা সুরত খুবই সুন্দর, আদব তমিষ জানে। মেয়েটার বয়স বারো তেরো হবে, ছেলেটার বয়স ছয় সাত, এখনও দুধের দাঁত পড়েনি।

আরবটা আহ্লাদে আটখানা হয়ে দাঁত বের কর হাসলো–শুকুর আলহামদুল্লিাহ! এরকমই দরকার আমাদের।

আপনি জেনে আরও খুশি হবেন এই বাচ্চা দুটি আমাদের এক খাস দুশমনের ছেলে মেয়ে।

আরবটা এবার বললো, মারহাবা, মারহাবা! এর জন্য তোমাদের অনেক ইনাম মিলবে।

ইনামের কথায় ঝোলা গোঁফের মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। বললো, গতবার আপনারা রিভলবার আর রাইফেলের গুলির যে চালান পাঠিয়েছিলেন, ওটা পুরোনো স্টকের। গ্রেনেড তো অর্ধেকই ফাটেনি।

আমি দুঃখিত! ইসরাইলি ইহুদিটা এবারও আমাদের ঠকিয়েছে। ওর কাছ থেকে আর মাল কেনা যাবে না।

আপনারা সরাসরি ইসরাইলের সরকারের কাছ থেকে কেনেন না কেন? তাহলে দামও কম পড়বে, জিনিসও ভালো হবে।

জানাজানি হলে কেয়ামত হয়ে যাবে।

জানাজানি কেন হবে? অন্য কোনও দেশ থেকে কিনবেন। ইউরোপের বহু দেশে ওদের ডিলার আছে।

ঠিক আছে, তোমার কথা মনে থাকবে। ওই বাচ্চা দুটো আলাদা বাক্সে রেখেছো তো?

জ্বি জনাব, ওই বাক্সটার গায়ে দুটো সবুজ দাগ আছে। ওটা ওপরে রাখতে বলেছি।

দুপুরের দিকে জাহাজ যখন চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়লো বনি বিনি কিছুই টের পেলো না। ইবনে আবু ফার্মাসিউটিক্যালস-এর একটা বিশেষ ধরনের বাক্সের ভেতর ওরা তখন বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলো।